এড়িয়ে
এড়িয়ে
" অতনু দেখ তো এই উত্তরটা লেখা ঠিক হয়েছে কিনা"-
বলেই খাতাটা মেলে ধরে প্রবাল। দুজনেই বোটানি অনার্স নিয়ে পড়ছে প্যারিমোহন কলেজে। এটা ওদের ফাইনাল ইয়ার, সাথে এসএসসিতে বসার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। অতনু বইয়ের পাতায় তার গোঁজা ঘাড়টাকে উঁচু করে বলে-"কেন রে আমি কি তোর মাষ্টার?"
"না তুই আমাদের ইয়ারের ফার্স্ট বয় আর একটা আস্ত বইয়ের পোকা তাই তোর কাছে আসা।"- প্রবালের কথার ধরণে আপাত গম্ভীর অতনুও হেসে ফেলে। অতনুর এই চেষ্টা যেমন লেখাপড়াকে ভালবেসে তেমন কতকটা অবস্থার চাপে। ওর বাবা ওর ছোটবয়সেই মারা গেছেন তারপর থেকে মামার বাড়িতে মানুষ। ছেলেকে মানুষ করবার জন্য অতনুর মা বিমলাকে দাদা-বউদিদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। তাই অতনু চায় একটা ভদ্রস্থ চাকরি, যা দিয়ে ওদের মা-ছেলের সংসার চলে যাবে। সেই তুলনায় প্রবালের চাপ কম, বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে, স্বাচ্ছল্যেই থাকে। প্রবাল গ্রুপ থিয়েটারে মেতে থাকে, আজকাল একটা সিনেমা হাউসে ওয়ার্কশপ করছে। তাই পড়ায় যা খামতি থাকে তার জন্য অতনুর কাছে চলে আসে। বাইরে হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে প্রবাল বন্ধুর ঋণ শোধ করে। যদিও অতনু বেশীরভাগ সময় যেতে চায় না, সময় নেই বলে। কলেজের পর টিউশন পড়িয়েই অতনু নিজের খরচ চালায়, মনে মনে স্বপ্ন, পাশ করে যদি স্কুলের চাকরিটা পাওয়া যায়। থিয়েটার, সিনেমা যে অতনুর ভালো লাগে না তা নয় কিন্তু ওসব দেখতে যাওয়া ওর কাছে বিলাসিতার নামান্তর।
অতএব অতনু আর প্রবাল দুজনে প্রাণের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও দুজনের জীবনখাতা ভিন্নভাবে লেখা হয়। অতনু ধারাবাহিক পরিশ্রমের ফল পায় চূড়ান্ত ফলাফলে, ভাল রেজাল্ট করে সরকারি কলেজে বিএড-এ ভর্তি হয়। প্রবাল চলে যায় মুম্বাইয়ে তার অভিনয় জীবনের জন্য বিভিন্ন রকম তালিম নিতে। প্রথম প্রথম দুই বন্ধুর ফোনে যোগাযোগ থাকলেও আস্তে আস্তে তা ক্ষীণ হয়ে যায়। বরঞ্চ ওদের ইয়ারের যারা পড়াশোনার দিকে এগোতে চায় তাদের সঙ্গে অতনুর যোগাযোগ থাকে।
এভাবে বছর পাঁচেক কেটে যায়, অতনু বিএড শেষ করে এসএসসি দেয়, টেট পাশ করে কিন্তু পরের ধাপে আর এগোতে পারে না, তালিকা ঝুলে থাকে। একদিন
ওদের ইয়ারের কুন্তল ফোন করে-" হ্যালো অতনু শুনতে পাচ্ছিস, শহর কার্ হোর্ডিং-এ ছেয়ে গেছে দেখ।" অতনু নির্লিপ্তভাবে বলে-"কার?" "কার আবার, আমাদের বন্ধু প্রবালের, "স্বপ্ন সুন্দর"-সিনেমার নতুন নায়ক, খবরের কাগজেও আছে, সব নিউজ পেপারেই দিয়েছে দেখলাম, কাল সিলভার বাংলায় ইন্টারভিউ আছে ওর, দেখিস, এখন রাখছি, আরও খবর পেলে তোকে জানাব।" ফোনটা ছেড়ে অতনুর বেশ অভিমান হয়, প্রবাল শহরে ফিরে এল, একবারও বলল না, ও যখন বলে নি নিজের থেকে আর অতনু যোগাযোগ করবে না। আর কি বলবে সে-" এই দেখ প্রবাল, ডিগ্রীর কাগজগুলো নিয়ে টেট প্রার্থীদের ধর্ণায় আমার জীবন কেমন কাটছে এই দেখ।" প্রবাল তার সুখ নিয়ে বাঁচুক, মাটির কাছাকাছি রোজকার সমস্যাগুলো না হয় তোলা থাক অতনুর জন্য।
বাবার কিনে দেওয়া নতুন গাড়িতেই স্টুডিওপাড়ায় যাওয়াআসা করে প্রবাল। আজ গাড়ি চলছে ধীর গতিতে। ড্রাইভার জানালো, সামনে একটা ধর্ণা মঞ্চ আছে, রাস্তায় জ্যাম ওই জন্যই। প্রবাল স্বগতোক্তি করল-" শহরটা ধর্ণায় ধর্ণায় শেষ হয়ে যাবে, কাজ নেই তো খই ভাজ।" গাড়িটা আস্তে আস্তে জায়গাটা পার হচ্ছে,-" আরে মঞ্চে ও কে? অতনু না, চাকরির দাবীতে অনশন মঞ্চ,"- উক্তিটা করেই তার নতুন বুটসহ পা-টা নিয়ে নামতে যেতে গিয়ে থমকাল। না নামা যাবে না, ওর সব কিছুর ওপর ওর নতুন ছবির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। যদি বিতর্কে জড়িয়ে যায় এই চিন্তায় গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে পেরিয়ে যায় প্রবাল।