বেন্দার সাথে
বেন্দার সাথে
বিভাগ-ছোট গল্প
শিরোনাম-বেন্দার সাথে
কলমে-সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
সেবা সমিতির মাঠে একটা বেঞ্চিতে এক বৃদ্ধ বসে আছে। একটু পরে বছর দশেকের একটা ভিখিরি ছেলে দুটো কেক কিনে ঐ একই বেঞ্চির একপাশে এসে বসল। প্রথম কেকটা খেতে খেতে দেখল বৃদ্ধ ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। কি মনে হতে দ্বিতীয় কেকটা বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে ধরল ছেলেটা-"খাবে তুমি?" বৃদ্ধ একটু ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে কেকটা নিয়ে খেতে শুরু করল। কেক খেয়ে বোতল থেকে গলায় ঢকঢক করে জল ঢেলে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল-"দাদু তোমার বাড়ি কোথায়?তোমাকে এর আগে এখানে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না।"
বৃদ্ধ ওর চাহনিকে সুদূরে প্রসারিত করে বলল-
"জানি না,কিছুতেই মনে পড়ছে না।"
ছেলেটা তৎপর হয়ে জিজ্ঞেস করল-"আর তোমার নাম?" এতেও মাথা নাড়ায় ছেলেটা ঘাবড়ে গেল।
"দাদু তোমার তাহলে ভুলে যাওয়া রোগ হয়েছে। চল তোমায় থানায় নিয়ে যাই,ওরাই তোমার বাড়ি খুঁজে দেবে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ভালো ঘরেরই লোক।""কি জানি,কিছুই তো মনে পড়ছে না"বৃদ্ধ অসহায়ভাবে বলল। "আচ্ছা তাহলে আমাদের বাড়িতেই চল,যদিও মা দমে গালাগাল দেবে,গায়ে মেখো না,চল চল"তাড়া লাগায় ছেলেটা।"তোর নাম কি রে?"বৃদ্ধ আলতোভাবে জিজ্ঞেস করল। "আমার নাম বৃন্দাবন, সবাই বেন্দা বলে ডাকে,চার ক্লাস অব্দি পড়েছি,তারপর বাপটা মরতে ভিক্ষে করে সংসার চালাই"বেন্দা এক নিশ্বাসে বলে গেল।"তাহলে তো আমি গেলে তোদের খুব অসুবিধে হয়ে যাবে"বৃদ্ধের কাতর ভাব দেখে বেন্দার চটপট উত্তর-"তোমাকে বাড়ির কাছাকাছি কোথাও চট পেতে বসিয়ে দেব,বেশীদূর হাঁটতে হবে না,ওখানে বসেই ভিক্ষে করতে পারবে।তাহলে তো আর আমাদের ঘাড়ে বসে খাওয়া হল না।" বেন্দার সহজ সমাধানে বৃদ্ধ কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। বেন্দা যা অনুমান করেছিল তাই হল,ওর নতুন দাদুকে দেখামাত্র ওর মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল-"নিজেদের খাওয়ার জোগাড় হয় না আবার ঐ ঘাটের মড়াকে কী করতে নিয়ে এলি। ভাতারটা মরে এই এক বিচ্ছু ছেলে রেখে গেছে আমার হাড় জ্বালাতে। নিজের ঘরে নাই কো চাল,পরের তরে তুলল তাল।" এত বাক্যবাণে নতুন অতিথি পায়ে পায়ে পেছোবে কিনা ভাবছে অমনই বেন্দা খপ করে হাতখানা ধরে-"মায়ের কথা ছাড় তো,এখনই রাগ গলে জল হয়ে যাবে,তুমি থাকলে মায়ের একটা অভিভাবক হবে তো নাকি। নাহলে তো চারদিকে হায়না আর শকুনের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে ছিঁড়ে খাবে বলে।" এই ছোট ছেলেটার জন্য বৃদ্ধের মনে মায়া জেগে উঠল,এরকমই কাউকে কি আগে কোথাও দেখেছে,ভাবতে ভাবতে মাথাটা গুলিয়ে উঠল। মুখের ভাব দেখে বেন্দা-"আরে না গো দাদু,তোমাকে আর দুঃখ পেতে হবে না,স্থির হয়ে বোসো দেখি নি।মা স্টোভ জ্বালিয়েছে,এখনই চা পাবে।" কদিন থাকার পর বেন্দার নতুন দাদু উসখুস করতে করতে বলল-"বেন্দা রে,আমার দ্বারা ঐ ভিক্ষে হবে না,তার চেয়ে বরং কটা ছেলেমেয়ে পড়াই।"
দাদুর এই প্রস্তাব লুফে নিয়ে বেন্দা-"বাহ্!এ তো খুব ভাল কথা,তার মানে তুমি মাস্টারী করবে?চিন্তা কোর না,আমি ছাত্রছাত্রী জোগাড় করে দেব। তবে সকালে ভোলা,ন্যাপচা ওরা কাজেতে থাকে,তুমি ওদের রাতে পাবে।" অগত্যা দাদুর ক্লাস শুরু হয়ে গেল। বেন্দা মনে মনে ভাবল,ওর এই নতুন দাদু প্রাইমারীর ভূদেব মাস্টারের থেকে কত ভাল পড়ায়। দাদুও নিশ্চয়ই তাহলে মাস্টার ছিল। এভাবে চলতে চলতে বেন্দার বন্ধু ন্যাপচা চায়ের দোকানের খবরের কাগজে একটা ছবি দেখতে পেল।ভাল করে দেখে ন্যাপচা এই সিদ্ধান্তে এল যে এ ছবি তাদের মহল্লায় আসা নতুন দাদুরই ছবি। কাগজটা নিয়ে এসে বেন্দাকে দেখাতে
ও সহমত হল যে এটা নতুন দাদুরই ছবি। বাড়িতে এসে বলল-"দাদু তোমার বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে,এই দেখ।" বেন্দার মাও নিরুদ্দেশ পত্রের ছবি
একবার দেখেই প্রাপ্তির অঙ্কটা দেখে নিল কুড়ি হাজার টাকা। পরদিন ওরা পরিস্কার কাচা কাপড় পরিয়ে নতুন দাদুকে ওর বাড়িতে নিয়ে চলল। বাড়ি দেখে তো বেন্দা,ন্যাপচার চোখ কপালে উঠল,এত বড় বাড়ি। বেন্দার মা আড়ালে কুড়ি হাজার টাকাটার কথা মনে করিয়ে দিল। দরজা খুলতেই একজন নতুন দাদুকে"বাবা"বলে জড়িয়ে ধরল,প্রায় ওদের বয়সী একটা বাচ্ছা এসে দাদুর আঙ্গুল ধরল। বেন্দার তখন মনটা হু হু করে উঠল,ঐ বাচ্চাটার মতো বেন্দা তো আর দাদুর আঙ্গুল ধরতে পারবে না। দাদুর চোখমুখে বাড়ি ফেরার একটা তৃপ্তি লক্ষ্য করল বেন্দা।পরক্ষণেই মাকে টাকা নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বেন্দা ঐ বাড়ির থেকে বেরিয়ে এল।