লক্ষ্য
লক্ষ্য
বিভাগ-গল্প
শিরোনাম-লক্ষ্য
কলমে-সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
চারদিক গ্লাসে ঘেরা একটা কর্ম জগতে রাতদিন কম্পিউটারে চোখ রেখে বিশ্বব্যাপী খরিদ্দারদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চলছে। মিটিংয়ের পর মিটিংয়ে নির্মিত হচ্ছে উন্নতির সোপান। মঞ্জিমার কাঁচ গড়িয়ে বৃষ্টি নামে, টেবিলে এক ফালি রোদের খেলা চলে, কিন্তু সেদিকে ওর ভ্রূক্ষেপ কোথায়। হ্যাঁ একটা আমেরিকান
কোম্পানির স্থানীয় অফিসের নির্ভরযোগ্য সিনিয়ার
প্রোগ্রামিং ম্যানেজারের দিন-রাত টার্গেটের একঘেয়েমিতেই কেটে যায়। একটা টার্গেট পেরোতেই আর একটা এসে যায়। ফুরসৎ কোথায়, প্রকৃতিকে দেখার,ঘাসে পা রাখার। বাল্যবন্ধুদের মুখও ভাল করে মনে পড়ে না। গলাতে গানও আজকাল উঠে আসে না। মাথাটা ধরতে এক কাপ কফি আনায় মঞ্জিমা,কি মনে হতে পায়ে পায়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। উল্টোদিকের মাঠে বাচ্ছারা ক্রিকেট খেলছে,
ওদের মধ্যে বড়সড় একজন,মনে হয় ওদের কোচ হবে। ছোটবেলার বিকেলটাও মঞ্জিমার এরকমই কাটত, জানলা ধরে মাঠের বাচ্ছাদের বিভিন্ন রকম খেলা দেখে। সন্ধ্যেবেলায় বাবা-মা অফিস থেকে ফিরলে পড়তে বসা। বিন্তি মাসি ওকে দেখাশোনার জন্য ছিল,সুযোগ পেলেই মাসি টিভিতে সিনেমা, সিরিয়াল দেখত। মঞ্জিমা তখন পাজেল খেলত বা জানলায় চোখ রাখত। এভাবে স্কুল,ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গণ্ডি কাটিয়ে ও একজন সফল চাকুরে। ব্যস্ততার ঘেরাটোপটা এখন বইয়ের পাতা ছেড়ে ল্যাপটপে পৌঁছেছে। মাঠের বাচ্ছাগুলোর খেলার উত্তেজনা ওকেও স্পর্শ করছিল। হঠাৎ একটা ফোন কলে আহুত মেয়েবেলা ফর্সা হয়ে মঞ্জিমাকে বাস্তবে এনে ফেলল। আবার টার্গেট আর টার্গেট ছোঁয়ার গল্প শুরু হল। খুলে রাখা ল্যাপটপের মেসেজ, ডেটা,নোটিশগুলো আজ ওর চোখ টানছে না,মনেতে উল্টো সুর বাজছে। ধরাবাঁধা জীবনে ওর ভাবনা চিন্তার ছন্দপতন মঞ্জিমাকে বিস্মিত করছে। ওর চিন্তাকে ছিন্ন করে ক্রিকেটের একটা ডিউজ বল জানলা ভেঙে ওর পায়ের কাছে এসে থামল। ভাঙা জানলা দিয়ে মঞ্জিমা দেখল বাচ্ছাদের ক্রিকেট দলটা ঐ ধাড়ি ছেলেটা সহ ওদের অফিস বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। অফিসের পিওন শিউচরণ আওয়াজ শুনে ঘরে ঢুকে কাচগুলো দ্রুত হাতে সরিয়ে ফেলল।
মঞ্জিমা মেঝে থেকে কুড়িয়ে ক্রিকেট বলটাকে ওর হ্যান্ডব্যাগে ভরে ফেলল। অফিস শেষে নীচে পার্কিং স্পেস থেকে গাড়ি বার করে দেখল,পাশের মাঠ শুনশান। ব্যাগে হাত দিয়ে বলটা অনুভব করে মঞ্জিমার মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। পরদিন মঞ্জিমা অফিস গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে দেখল আগের দিনের শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকা সেই ছেলেটা আর একটা বাচ্ছা সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলছে। সম্ভবত ক্রিকেট বলের খোঁজ করতে এসেছে,
কিন্তু ওদের ছোঁড়া বলটা যে অফিসের জানলার কাচ ভেঙেছে তা তো ওরা জানে না। তাই গার্ডের থেকে ঝাড় খাচ্ছে। মঞ্জিমা অবস্থা সামাল দিয়ে গার্ডের আড়ালে ওদের বলটা ফেরত দিল। ছোট ছেলেটার নাম কুশ,ও তো বল হাতে নিয়ে খুব খুশী। পাশের বড় জন হঠাৎ মঞ্জিমাকে বলল-"আমি তো আপনাকে চিনি, আপনি যাদবপুরের পাস আউট না।" মঞ্জিমা সায় দিতে ওদিক থেকে-"আপনার যখন এমটেক ফাইনাল, আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফার্স্ট ইয়ারে।
একটা সেমিনারে দেখেছিলাম আপনাকে।"
মঞ্জিমা সোজা তাকিয়ে-"ও তাহলে তুমি আমার কলেজ জুনিয়র।এখন কোন্ ইয়ার তোমার?"
"থার্ড ইয়ার"
"ও তাহলে তো এবছরই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হওয়ার কথা।"
"হ্যাঁ, নেক্সট মান্থে শুরু হবে।"
"ক্রিকেট খেলতে ভাল লাগে?"
"হ্যাঁ সুযোগ পেলে ওদের শেখাই।"
কুশ চারদিকে তাকিয়ে-"কি বড় অফিস।"
মঞ্জিমা হেসে বলল-"হ্যাঁ রে সুন্দর করে সাজানো জেলখানা।"
কুশ অবিশ্বাসের সঙ্গে-"ধ্যাৎ"
ওরা যেতে গেলে মঞ্জিমা ওর কলেজ জুনিয়রকে প্রশ্ন করে-"তোমার নামটা তো জানা হল না।"
কুশ পাস থেকে-"ওমা,তুমি তাও জানো না,ও তো আমাদের সব ছোটদের বন্ধু ঋভুদা।"
ওর বলার ধরণে মঞ্জিমা হেসে ফেলে-
"না জানতাম না,তুমি জানালে বলে জানলাম।"
মঞ্জিমা ওদেরকে বলে অফিসে ঢুকে যায়। কুশ আর ঋভু গল্প করতে করতে বেরিয়ে যায়। বলটা ফেরত দিতে পেরে মঞ্জিমারও বেশ ভাল লেগেছে। কুশদের
দেখতে দেখতে মঞ্জিমার ছেলেবেলা যেন ওর সামনে ফিরে আসছে। বান্ধবীরা ডেকে যাচ্ছে-"মঞ্জি খেলতে যাবি না।" ও হেঁকে উত্তর দিচ্ছে-"বাবা-মা ফেরে নি,কাকে বলে যাব।" তারপর নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে সবার খেলা দেখা,ইস এখন যদি ওর ছেলেবেলাটা ফিরে আসত আর টুকি দিয়ে বলত,আমায় ধরতে পারে না। মঞ্জিমার ভাবনার মাঝে শিউচরণ একটা ফাইল দিয়ে গেল। দরজার কাছ থেকে বলল-
"বড়া সাহেব নে ভেজা।"
মঞ্জিমা শৈশব ভাবনা ছেড়ে মনোনিবেশ করল কম্পিউটারের স্ক্রিনে। ওর গ্রুপে যে কোন কাজে ও সবসময় এগিয়ে থাকে।কিন্তু গতকাল থেকে কিছু কাজ বাকী পড়ে থাকায় তা রুহানাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন বস।তাই ওর কীর্তির একটা তারা খসে তা রুহানার পাশে যোগ হয়েছে।অন্য সময়ে বিষয়টা নিয়ে ওর খারাপ লাগত,টেনশন করত।কিন্তু আজ ওসব কিছু হচ্ছে না দেখে ওর খুশী কয়েক গুন বেড়ে গেল।
হঠাৎ তার এই ছন্দপতন মঞ্জিমা নিজেই বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ কাজ করার পরই জানলায় এসে দাঁড়ালো শহরের বৃষ্টি স্নান দেখবে বলে। মোবাইলে বেজে উঠল, আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে। প্রফেসর মিত্র ফোন করেছেন, ফোনটা তুলতেই-"হ্যাঁ রে তোর কী খবর বল তো? চাকরি তো সকলেই করে,তোর মতো কেউ উবে যায়। তোর রেখে যাওয়া থিসিসটা জার্মান বিজ্ঞানী থিজুর খুব পছন্দ হয়েছে। করবি পিএইচডি টা? দেখ মানসিক প্রস্তুতি আছে তো বল? তোর এখনকার চাকরির থেকে অনেক ভাল প্রসপেক্ট আছে। তাড়াতাড়ি জানাস,রাখছি এখন।"
প্রফেসর মিত্রের এই এক দোষ, নিজের কথাটুকু বলা হয়ে গেলেই ফোন রেখে দেন।যদিও মঞ্জিমাকে খুব স্নেহ করেন,ওর ভাল চান। প্রফেসর মিত্রের প্রস্তাবটা মঞ্জিমার মনে ঘুরপাক করে। বাড়িতে জানিয়েও তো উপায় নেই,সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সেই ওর ওপরেই ছেড়ে দেবে। এত বড় চাকরিটা এক কথায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তো একটু সময় লাগবে। পরদিন অফিসের জানলা দিয়ে দেখল ঋভু বাচ্চাদের ক্রিকেট কোচিং করাচ্ছে,সময়টা টিফিনের মাঝে,তাই
মঞ্জিমা গেল খেলার মাঠে। ওকে দেখে ঋভু এগিয়ে আসতেই মঞ্জিমা বলল-"প্রফেসর মিত্র ফোন করেছিলেন,জার্মানিতে পিএইচডিতে জয়েন করতে বলছেন। ঋভু খুশী হয়ে-"খুব ভাল,ইনফ্যাক্ট আমারও
সামনের বছর যাওয়ার কথা আছে। এমটেক আর পিএইচডির জয়েন্ট কোর্সে ভর্তি হব। পাশ থেকে কুশ বলল-"তুমি চলে গেলে আমাদের কী হবে?কে ক্রিকেট কোচিং করাবে?"
"আরে সেসবের দেরী আছে,গেলে তোদের এই নতুন বন্ধু মঞ্জিমা যাবে,ও এখনই সুযোগ পেয়েছে।"
"না এখনো কিছু ঠিক করি নি,দেখি অফিসকে ইনফর্ম করতে হবে।"
যে মঞ্জিমা নিজের কথা বিশেষ একটা কারুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায় না সেও ঐ খেলা পাগল দলটাকে নিজের খুব কাছের বলে ভাবতে শুরু করেছে। আজকাল ফাঁক ফোঁকর পেলেই ছুটে যায় ওদের কাছে।এমনইতেই অফিসে ওর সেরকম কোন বন্ধু ছিল না।অষ্টপ্রহর উন্নতির প্রতিযোগিতায় কাকে বন্ধু ভাববে ও। বরঞ্চ ঐ কচিকাঁচাগুলো আর ঐ মিষ্টি ধেড়েটার সঙ্গ ওর ভালোই লাগছে। ঋভু একদিন জিজ্ঞেস করল-"তোমার জার্মানি যাওয়া কতদূর?"
"আরে জার্মান ভাষার একটা শর্ট কোর্স করে নিতে হবে।"
"আরে আমাকেও তো করতে হবে,গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে শেখানো হয়,শিখবে একসঙ্গে?"
"শেখাই যায়।"
"তাহলে অফিসের পর উল্টোদিকের বাস স্ট্যান্ডে আমাকে পাবে।"
"ঠিক আছে।"
পাশ থেকে কুশ আর ওর ভাই লবও এগিয়ে এসে-
"আমরাও শিখব,আমরাও তোমাদের সঙ্গে জার্মানি যাব।" মঞ্জিমা লবকে আদর করে বলল-
"আগে আমার আর ঋভুর মতো বড় হ,তারপর।"
"দূর,ঋভুদাদা বড় নাকি?আমাদের মতো ছোট।"
ঋভু একটা থাপ্পড়ের ভঙ্গী করতে দুজনেই ছুটে পালালো। অফিস ফেরত মঞ্জিমা এখন সত্যিই ঋভুর সঙ্গে জার্মান ভাষা শিখতে যায়। মঞ্জিমা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে,ঋভু ওকে শুধু নাম ধরেই ডাকে,দিদিটিদি যোগ করে বলে না। একদিন কৌতূহল চাপতে না পেরে বলেই ফেলল মঞ্জিমা-
"এই তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকো কেন?"
"সময় আসুক বলব"-মিটিমিটি হেসে উত্তর দেয় ঋভু।
ওদের এই ক্লাসে যাতায়াতের পথটা ভালোই কাটত।
দেখতে দেখতে ছ-টা মাস কেটেও গেল। মঞ্জিমা মোটামুটি মন স্থির করে ফেলেছে,চাকরি ছেড়ে পিএইচডি করার ব্যাপারে। বাড়িতেও কেউ আপত্তি করে নি কারণ বাবা-মা ওকে বরাবরই উচ্চপ্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছে। ওর সমস্ত ডকুমেন্টস্ তৈরী হয়ে যেতে ভিসার জন্য আবেদন করে। প্রফেসর মিত্রও
খুব খুশী ওনার প্রিয় ছাত্রী ওনারই একটা প্রিয় বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে যাচ্ছে বলে। আপাতত ঋভু ও ওর দলবল মঞ্জিমার সঙ্গ পাবে না বলে ওদের খুব মন খারাপ। কুশ একদিন বলল-"আমাদের বল তুমি চলে গেলে কে ব্যাগে করে লুকিয়ে এনে তা ফেরত দেবে?
আমাদের এবার গার্ড কাকুদের মার খেতে হবে..হু..হু।" মঞ্জিমা ওদের একদিন চিড়িয়াখানায় বেড়াতে নিয়ে যায়। খুব আনন্দ করল ছোটদের দলটা। যাওয়ার আগে মঞ্জিমাকে কথা দিতে হল যে
ওদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা বলবে। ঋভুও ওর নীরব চোখের ভাষায় অনেক রকম কথা আদায় করে নেয়। হামবুর্গের স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ফ্লুইড ডাইনামিক্সের ওপর গবেষণা করতে চলল মঞ্জিমা। সামনে ওর নতুন জীবন,তা নিয়ে চিন্তিত নয় মঞ্জিমা, কারণ এরমধ্যেই জীবনের অনেক হার্ডেল টপকে ও আজকের এই জায়গায় পৌঁছেছে। তবে নিজের দেশ ছেড়ে এই প্রথম ওর বাইরে আসা তাই একটা অনভ্যস্থ মনখারাপ ওকে ঘিরে আছে।
ওর গাইড হিউজম্যান একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী।অত বড় মাপের একজন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পারাটাকে মঞ্জিমা নিজের সৌভাগ্য বলেই মনে করে। ডঃ হিউজম্যানের তত্ত্বাবধানে মঞ্জিমা বারনৌলির ইকুয়েশনের ওপর কাজ করবে,তত্ত্বটার ওপর নতুন করে আলোকপাত করবে। মাঝে কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে মঞ্জিমার পড়ার ধৈর্য্য একটু কমে গেছে,সেটাকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। ডঃ হিউজম্যানের শৃঙ্খলা প্রশ্নাতীত, ওনার সঙ্গে চলতে পারলে মঞ্জিমা মনে করে ওর কাজ সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাবে। ডঃ হিউজম্যান মঞ্জিমার সঙ্গে চারটে শব্দ ইংরেজীতে না বলে জার্মান ভাষায় বলেন। যেমন সকালে দেখা হলে
গুড মর্নিংয়ের জায়গায় গুটেন মরগেন, দুপুরে দেখা হলে গুড আফটারনুনের জায়গায় গুটেন ট্যাগ,সন্ধ্যেবেলায় দেখা হলে গুড ইভিনিংয়ের জায়গায় গুটেন অ্যাবেন্ড আর রাতে হলে গুড নাইটের জায়গায় গুটেন ন্যাট বলে থাকেন। মঞ্জিমাও চায় ওর স্বল্প শেখা জার্মান ভাষাটাকে ঝালিয়ে নিতে।
এখানের নিয়মানুসারে ওকে ওর থিসিসের কিছু অংশ জার্মান ভাষায় লিখতে হবে। তা নিয়ে মঞ্জিমার কিছুটা চিন্তা আছে তাই ও ওর নতুন শেখা ভাষাটার চর্চা চালিয়ে যায়। এরমধ্যে ঋভু ফোনে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে,লব-কুশের সঙ্গেও কথা হয়েছে।
মঞ্জিমার ইউনিভার্সিটি আর গবেষণাগার দিনের শেষেও ক্লান্ত হয় না,রাতেও বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করার সুযোগ আছে।সেখানে হয়তো শ্রম দিয়ে স্বপ্ন বুনছে ভাবীকালের কোন নোবেল প্রাপক। ঋভুর বোধ হয় আর পড়াশোনার জন্য হামবুর্গ আসা হল না,কারণ এখানে ওর পুরো স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয় নি। ও তাই আমেরিকার আর কানাডার ইউনিভার্সিটিগুলোতে চেষ্টা চালাচ্ছে। জার্মানিতে পড়া ঋভুর স্বপ্ন ছিল এটা মঞ্জিমা ভালোমতোই জানে। তবু
ঋভু যাতে পুরোপুরি নিরুৎসাহিত না হয় তাই মঞ্জিমাও ঋভুর স্যাটের স্কোর মিলিয়ে সন্ধান চালায়।
শেষপর্যন্ত দেখা গেল আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটিটা সব কিছুর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, পুরো
স্কলারশিপও পাওয়া যাবে।অতএব লব-কুশদের ধেড়ে সঙ্গী আপাতত ওখানেই উচ্চশিক্ষার জন্য যাবে। ফিলাডেলফিয়া শহরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকার তৃতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। মঞ্জিমা নিজের গবেষণার কাজে বিশেষ ব্যস্ত তবু ঋভুকে কথা দিয়েছে যে ইয়েলে ঋভুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। এক সপ্তাহ হল ঋভু ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে,ওখানে নানা ঐতিহ্যের সঙ্গে ও এটাও আবিষ্কার করেছে যে অন্যান্য ইউনিভার্সিটির তুলনায় ওখানে লেসবিয়ানের সংখ্যা বেশী। স্যামি বলে একটা ছেলে প্রথম দিনই এসে ঋভুর সঙ্গে আলাপ করে বলেছিল যে ও সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ভক্ত তাই বাঙালি হিসেবে ঋভুর থেকে সেসব জানতে চায়। প্রথম প্রথম ঋভু বোঝে নি,ও যতটুকু সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জানে তা উজাড় করে দিল স্যামির কাছে। ও ভাবল বিদেশ বিভুঁইয়ে একজন সংস্কৃতিমনা প্রকৃত বন্ধু পাওয়া গেল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ঋভুর ভুল ভাঙল। স্যামিও একজন লেসবিয়ান আর ঋভুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে ওর উদ্দেশ্যও আলাদা। মঞ্জিমা ঋভুর খবর নিতে গিয়ে বুঝল যে উৎসাহ নিয়ে ঋভু ইয়েলে যোগ দিয়েছিল সেই উৎসাহের আর ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। মঞ্জিমাকে প্রায়ই বলে-"হয় আমি তোমার ইউনিভার্সিটিতে যাই,নাহলে দেশে ফিরে যাই।"
কুল,মান দুই-ই রেখে বুদ্ধির সঙ্গে চলার পরামর্শ দিয়েছে মঞ্জিমা ঋভুকে। তবে সব শুনে মঞ্জিমাও বেশ উৎকন্ঠায় আছে। স্যামি দেখল ভাল কথায় কাজ হচ্ছে না,তাই ঋভুকে নানাভাবে ভয় দেখানো শুরু করল। ঋভু এটা জানে যে আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেশ বা জাতিগত কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, বাজার সবজায়গায় হিংসার ঘটনা ঘটে।তাই কলেজ কর্তৃপক্ষকে স্যামির ব্যাপারে অভিযোগ জানাবে বলে ঠিক করল ঋভু। মঞ্জিমা আজ দুদিন হল ঋভুর কোন খবর পাচ্ছে না। বহুবার মেসেজ করেও উত্তর পায় নি,ফোন ধরে নি। লব ফোন করে জানিয়েছে ঋভুর বাড়ির লোকও ঋভুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে নি। চিন্তার পারা বেড়েই চলেছে মঞ্জিমার, দ্রুত ভিসার ব্যবস্থা করল ও। ঋভুর অসহায় বাবা-মায়ের ওর খোঁজ পাওয়া সহজ নয় ওকেই পৌঁছোতে হবে ঋভুর কাছে। সমস্ত উদ্বেগ নিয়ে পথটুকু পেরিয়ে ও সরাসরি ঋভুর ইউনিভার্সিটির এনকোয়ারি বিভাগে গিয়ে ঋভুর খোঁজ করল। ওখানে ওরা ঋভুর ব্যাপারে সদর্থক কিছু জানাতে পারল না। ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করতে করতে মঞ্জিমার দেখা হয়ে গেল ওর কলেজ জীবনের বান্ধবী এষার সঙ্গে, ও এখন নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক। এষা ঋভুকে খোঁজার ব্যাপারে মঞ্জিমাকে সঙ্গ দিল। শেষপর্যন্ত যখন কোন সুরাহা হল না তখন স্যামির ব্যাপারে খভুর পাঠানো মেসেজসহ গোটা ঘটনাটা নিউইয়র্ক টাইমসে এষা তুলে দিল। এতে শুধু ইয়েল ইউনিভার্সিটি নয় গোটা প্রশাসন নড়েচড়ে বসল। স্যামি ওর দলবলসহ গ্রেপ্তার হল। ওদের কাছ থেকেই জানা গেল,ওরা ঋভুকে পেসিফিকের একটা দ্বীপে আটকে রেখেছিল,সেখানে বিষধর সাপের দংশনে ঋভু মারা গেছে। পরোক্ষভাবে ঋভুর মৃত্যু ডেকে আনার জন্য স্যামির দশ বছরের কারাদণ্ড হল।
মঞ্জিমা নিজের গবেষণা সফলভাবে শেষ করে দেশে
ফিরে এসেছে। নিজের অধ্যাপনার পাশাপাশি ঋভুর প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের দেখাশোনা করে।লব-কুশ এখন অনেক বড় হয়ে গেছে,ওরাও ওদের প্রিয় ঋভুদাকে ভোলে নি,শিশু, কিশোরদের প্রশিক্ষণ দেয়। ক্লাবের ফটকে ঋভুর প্রস্তর মূর্তি, আর সাথে ঋভুকে ভালোবাসার মানুষেরাও তাদের লক্ষ্যে পাথরের মতো অবিচল।