দুর্গা দুর্গতি নাশিনী
দুর্গা দুর্গতি নাশিনী


কি মশা রে বাবা ! তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরম ! খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে কার সাধ্যি ! এর মধ্যেই কুলকুল করে ঘামতে থাকে আর মনে মনে
পাড়ার পুজো কমিটির সেক্রেটারি পাঁচুদার বাপ বাপান্ত করতে থাকে মদন । কি কুক্ষনেই যে মহিষাসুর সাজতে রাজী হয়েছিল কে জানে ! ওই লোভ,
কথায় বলে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু । পার ডে পাঁচ হাজার টাকার লোভ ছাড়া বড় সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ।আর এই টাকার জন্য তাকে পিংকির কাছে
কম খোঁটা সহ্য করতে হয় নাকি ! সুতরাং ওই লোভ আর লাভ এর চক্করে পড়ে তার যা হবার তাই হয়েছে । পাড়ার পুজোর জ্যান্ত ঠাকুরের
মন্ডপে মা দুর্গার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে হবে আগামী চার দিন ধরে । সবে সপ্তমীর সন্ধ্যে ! এর মধ্যেই গরম আর মশার কামড়ে প্রাণ
ওষ্ঠাগত ! এদিকে পিল পিল করে রাস্তায় লোক বেরিয়ে পড়েছে । জ্যান্ত ঠাকুর হয়েছে শুনে ভীড় বাড়ছে পাল্লা দিয়ে ...
একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আর কানের কাছে মশাদের কনসার্ট শুনতে শুনতে মদন থুড়ি মহিষাসুর আবিষ্কার করে ভীড়ের মধ্যে পিঙ্কি আর তার
বন্ধু রিংকি তার দিকে অপলক চেয়ে চেয়ে ঝাড়ি মারছে আর নিজেদের মধ্যে গা টেপাটিপি করে হাসাহাসি করছে ... ধুত্তোর নিকুচি করেছে মহিষাসুরের !
পুরো পুজোটাই মাটি ! এরপর আর পিংকি পাত্তা দেবে তাকে ? খালি গায়ে গর্জন তেল মেখে মহিষাসুর সাজার ফলে নিশ্চয়ই বন্ধুদের কাছে তার প্রেস্টিজ
পাংচার হয়েছে ... "যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর !" আশ্চর্য ! পাড়ার ভবসিন্ধু ব্যায়ামাগারে কিশোর বয়েস থেকেই বারবেল ভাঁজে মদন । শরীর চর্চাটা
তার কাছে নেশার মতন ... ফলে উঠতি বয়েস থেকেই বাইসেপস ট্রাইসেপস এমনকি সিক্স প্যাকস অ্যাপস কোনো কিছুরই অভাব ছিল না মদনের । এখন সে
নিজেও দুটো জিমে ট্রেনার হিসেবে কাজ করে ...
পর্দা পড়ে গেছে , মাঝখানে আধ ঘন্টার বিরতি । গা হাত পা ছাড়িয়ে নেওয়ার , জল -টল খাওয়ার । স্টেজের পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি
মেরে মদন দ্যাখে পিংকি আর তার বন্ধু চলে গেছে । সরস্বতীটাকে হেব্বি দেখতে , এই পাড়ার মেয়ে নয় অবশ্য। কিন্তু কার্তিকের দিকে সারাক্ষণ এমন
জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে , যে লাইন মারতে সাহস হয় না ; দেখে মনে হয় কার্তিকে মজেছে মেয়েটা ... অথচ ওই তো ছিরি কার্তিকের !
সিড়িঙ্গেপনা ! তার মতো বাইসেপস ট্রাইসেপস দেখাতে পারবে? হুঁ! তবে কথায় বলে ," যার যেখানে মজে মন / কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম ;চেষ্টা
চরিত্তির যে একেবারে করেনি মদন তা নয় ... তবে হালে পানি পায় নি । বিড়িতে শেষ সুখটানটা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে ।
দূর থেকে দেখতে পেল পুজো কমিটির সেক্রেটারি পাঁচুদা ওরফে পাঁচুগোপাল রায় আসছে হন্তদন্ত হয়ে... মদনকে দেখেই বললেন আরে তোদের এখনও রেস্ট
নেওয়া শেষ হয়নি , ওদিকে তো বার্জার পেন্টস শারদ সম্মানের বিচারক মন্ডলী প্রায় এল বলে ! কি যে করিস তোরা ! এই নে ওঠ ওঠ ! গ্রীণ রুমে
গিয়ে সব্বাইকে তাড়া লাগান পাঁচুদা ... এই মদনা তুই কিন্তু ঠিক করে পড়ে থাকবি পায়ের তলায় ... এবারে অসুরই আমাদের মেন অ্যাট্রাকশন । কোনো ভাবেই
যেন বিচারক মন্ডলীর মেকি না মনে হয় ! গতকালের টাকাটা কিন্তু এখনও পাইনি পাঁচুদা ... একটু গাঁইগুঁই করে মদন ...
আরে পাবি পাবি ... আশ্বস্ত করেন পাঁচুদা , একবার এই শারদ সম্মানটা পেতে দে তারপর কেল্লা ফতে !
ওদিকে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট শুরু হয়ে গেছে ," আশ্বিনের এই শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর / ধরনীর বহির্কাশে ... আজ সপ্তমীর সন্ধ্যা । আমাদের এবারের
মূল আকর্ষণ জ্যান্ত দুর্গা । মৃন্ময়ী মাতৃমূর্ত্তিকে আমরা চিন্ময়ী রূপে ধরার চেষ্টা করেছি । আপনারা আসুন প্রতিমা দর্শন করুন , অন্যদেরও প্রতিমা দর্শন করার সুযোগ
করে দিন ... মা দুর্গার পায়ের তলায় পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মদন । পর্দা উঠল বলে ...
এখন মহাঅষ্টমীর সন্ধ্যে । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে সন্ধিপুজো। সন্ধি পুজোর পরেই তিথি অনুযায়ী নবমী পড়ে যায়। কথায় বলে নবমীর নিশি পোহাতে দিও না ... আজ রাস্তায় মানুষের ঢল ...
পুজোর শেষ আনন্দটুকুউপভোগ করে নেওয়ার জন্য ছেলে বুড়ো সব্বাই বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায় ... এই কদিনে জ্যান্ত ঠাকুর বেশ হিট । লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে জ্যান্ত ঠাকুরের কথা !
বার্জার পেণ্টস শারদ সম্মানের বিশেষ পুরস্কার ঝুলিতে ঢুকেছে ক্লাবের । শুধু মদনের মনটা ভালো নেই ... একটা ঘুরঘুরে পোকা থেকে থেকে ঘুর ঘুর করছে ... না টাকা পয়সা নিয়ে
নয় ... পাঁচুদা সে ব্যাপারে কার্পন্য করেন নি । কিন্তু সেদিনের পর থেকে পিংকির সঙ্গে একবারও যোগাযোগ করতে পারে নি ! মোবাইল বলছে সুইচড অফ ।বাড়িতেও গিয়েছিল
লজ্জার মাথা খেয়ে । বাড়ির লোকেরা বলছে এখানে নেই এখন ।ব্যাজার মুখে ফিরে এসেছে মদন ! বেশ বুঝতে পারছে একটা বড় গণ্ডগোল হয়েছে কোথাও ! এই জ্যান্ত ঠাকুরের
চক্করে তার প্রেমটা এখন টিঁকলে হয় !
স্টেজটার দুটো ভাগ , একদিকে মাটির প্রতিমা । এই তিনদিন ধরে পুজোর সব আচার নিয়ম সেখানেই হয়েছে । আজও চলছে সন্ধি পুজোর আয়োজন । আর অন্যদিকে
জ্যান্ত ঠাকুর । সন্ধি পুজোয় একশো আট প্রদীপ লাগে । জ্বালানো হয় দুটো বড় পেতলের পঞ্চ প্রদীপ । ঢাক বাজছে জোরে । একটা অল্প বয়েসী মেয়ে মোমবাতি দিয়ে প্রদীপ গুলো জ্বালছিল ।
পরনে শাড়ি; কখন যে তার শাড়ির আঁচলে আগুন ধরে গেছে খেয়াল করে নি একবারে ।শাড়ির আঁচল থেকে আগুন ধরে গেছে প্যান্ডেলের কাপড়ে । মদন একদৃষ্টে তাকিয়ে
ছিল সন্ধিপুজোর দিকে ।প্যাণ্ডেলের কাপড়ে আগুন লাগতেই এক লাফে স্টেজ থেকে নেমে আসে সে । মেয়েটির সারা শরীর তখন জ্বলছে দাউ দাউ করে । চারিদিকে হুড়োহুড়ি চিৎকার
চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে ... আগুন আগুন । এর মধ্যেই মদন গ্রীন রুমে রাখা একটা কম্বল চাপা দিয়েছে মেয়েটাকে। ঠাকুর দেখতে আসা অজস্র লোক তখন বালি ছুঁড়ছে বালতি বালতি জল
ঢালছে প্যাণ্ডেলে । বিদ্যুৎ গতিতে ভীড় সরিয়ে মেয়েটিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠে মদন । সে তখন অচৈতন্য। শেষ পর্যন্ত দমকল এসে আগুন আয়ত্তে আনে । সারা প্যাণ্ডেল জুড়ে পোড়া গন্ধ।
হাসপাতাল থেকে সব মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে সেদিন অনেক রাত হয়ে যায় মদনের । আশার কথা মেয়েটি প্রাণে বেঁচে গেছে । ভালো আছে এখন । পরদিন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে মদনের ।
ইসস ! কত্ত বেলা হয়ে গেছে ! মা ডাকছেন , মদন ওঠ ! একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে তোর সঙ্গে । গেঞ্জিটা গায়ে গলিয়ে দরজা খোলে মদন ! দ্যাখে দরজার বাইরে পিংকি দাঁড়িয়ে !
নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে না সে ... চোখ কচলে ভালো করে তাকাতেই দ্যাখে হ্যাঁ পিংকিই তো !
"দিশা আমার মামাতো বোন "... অস্ফুটে কেবল এই কয়েকটি কথা উচ্চারণ করতে পারে সে । মদন দ্যাখে তার দু চোখে টল টল করছে কৃতজ্ঞতার অশ্রু ...