SUKANYA SAHA

Classics

2  

SUKANYA SAHA

Classics

বোধন

বোধন

3 mins
820


স্কুলের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে এক মনে তাকিয়ে ছিল হৃদয়। ভূগোলের স্যারের পড়া তার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না । সামনে খোলা বইয়ের পাতা হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছিল।বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখছিল বর্ষার মেঘ কেটে ঝলমলে নীল আকাশটা বেরিয়ে পড়ল কিনা !-- তার মানে পুজোর আর কদিন বাকি আছে ? মনে মনে হিসাব কষে হৃদয়। 


 শেষ পিরিয়েডের এই ভূগোল ক্লাসটায় কিছুতেই আর পড়ার বইয়ে মন থাকে না তার।উন্মুখ হয়ে বসে থাকে কখন ছুটির ঘন্টা পড়বে । ঘন্টা পড়লেই একছুটে স্কুল থেকে বেড়িয়ে পড়বে ---- বাড়ীতে ঢূকে কোনরকমে খাটের উপর স্কুলব্যাগটাকে ফেলে দিয়ে লাফাতে লাফাতে পৌঁছে যাবে রাখাল দাদুর আস্তানায় । সেখানে বুড়ো রাখাল মিস্ত্রী একমনে বসে ঠাকুর গড়ছেন। কখনও মা দুগগার মুখ তৈরী করছেন তো কখনও সরস্বতীর হাঁস বা গণেশের ইঁদুর -- সেই ছোট্টবেলা থেকেই ঠাকুর গড়ার ওপর এক অদ্ভুত নেশা হৃদয়ের । অথচ বাপের জন্মেও তাদের পরিবারে কেউ কোনদিন কুমোর ছিল না যে তার রক্তে নেশা থাকবে ।


দিন রাত এখন তার একটাই স্বপ্ন রাখাল দাদুর মত সেও বড় বড় ঠাকুর গড়বে । তার গড়া মা দুগগা , লক্ষ্মী সরস্বতী বসবেন জমিদার বাড়ীর ঠাকুর দালানে।স্কুলের পড়াশুনা , বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানো কোনদিকেই তার মন নেই আজকাল।এই পুজো যত এগিয়ে আসবে নাওয়া খাওয়া ভুলে সেও রাখাল দাদুর পায়ে পায়ে তত ঘুর ঘুর করে বেড়াবে। ফাই-ফরমাশ খাটবে, তামাক ভরে দেবে রাখাল দাদুর হুঁকায় আর পরিবর্তে দুচোখ ভরে দেখবে রাখাল দাদু কি করে ঠাকুর বানান। মায়ের মুখের আদল যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে রাখাল দাদুর হাতের ছোঁয়ায়-

তারপর প্রতিমা রঙ শুরু হয়--অদ্ভুত সূক্ষ্ম তুলির টান-- বিস্ময়ের পর বিস্ময়। 

 


            বষীয়াণ রাখাল মিস্ত্রী যেন খানিকটা স্নেহ মিশ্রিত প্রশ্রয়ই দেন হৃদয়কে । তার নিজের বলতে তো তিনকুলে কেউ নেই--- কাকেই বা পিতৃপ্রদত্ত ক্ষ্মমতার উত্তরাধিকার দিয়ে যাবেন? যাক ছেলেটা তো তাকে জান দিয়ে ভালওবাসে। এ সংসারে ভালোবাসার লোকের বড়ই অভাব। 


         এবারে রাখাল দাদুর শরীরটা বেশীরকমই খারাপ হয়েছে । ঘন ঘন জ্বর - আর সেই সঙ্গে কাশির দমক। এদিকে পুজোরও আর বেশী দিন দেরী নেই। সাবেকী জমিদার বাড়ীর তিনিই তো বাঁধা কুমোর। অবশ্য রাখাল দাদুর যে  এ নিয়ে আদৌ কোন চিন্তা আছে --- মনে হয় না । "বুঝলি হৃদে "--- সবই মায়ের কৃপা। তার কৃপা হলে এবারও ঠিক সময়ে ঠাকুর তৈরী হয়েই যাবে।এবার এক একদিন এমন হয় যে কাশির দমকে রাখাল দাদু মাটি নিয়ে বসতেই পারেন না । লক্ষী ,কার্ত্তিক, গণেশ সব কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে আছে । এখনও মাটি পড়ে নি।


 

আকাশও এবার বাধ  সেধেছে। আশ্বিন মাস পড়ে গেল এখনও বর্ষা যাচ্ছে না --- পুজোয় আবার না ভাসায়।" রাখাল দাদু "? "বল ভাই"--


"কাল থেকে আমি একটু হাত লাগাবো নাকি মূর্ত্তির কাজে ?তোমার শরীরের এবার যা অবস্থা---" "পারবি তুই ? পারবি হৃদে?" " কোনদিন তো করিস নি--" "তা নাই বা করলাম অনেকদিন ধরে তো দেখছি বসে বসে ---" " দেখিস মা দুর্গাকে স্বর্গ থেকে আবাহন করে আনা কিন্তু অত সোজা নয়-- শ্রীরাম চন্দ্র স্বয়ং নিজের চোখ আহূতি দিয়ে তবে অকালবোধন করেছিলেন।"" তুমি প্রাণভরে আশীর্বাদ করো দাদু আমিও যেন মাকে নিয়ে আসতে পারি।" 

 

         

 পরদিন আর স্কুলের  দিকে পা বাড়ায় না হৃদয়। নাওয়া খাওয়া ভুলে একমনে পড়ে থাকে রাখাল দাদুর বাড়ীতে । রাখাল দাদুর হাতে অবশ্য জাদু আছে । তার জাদুর ছোঁয়ায় মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী রূপ ধরেন। কোনও ছাঁচ ব্যবহার করেন না রাখালদাদু মায়ের মুখ তৈরী করতে । সেকি পারবে রাখাল দাদুর মত? ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে ওঠে সে । শুধু রাতটুকুর জন্য সে বাড়ী ফেরে । মা গজ গজ করেন, বাবা বকাবকি করেন । সে ভ্রূক্ষেপও করে না । সকাল হলেই রাখাল দাদুর বাড়ী চলে যায়।


 একটু একটু করে পুজো  এগিয়ে আসতে থাকে । আজ মহালয়ার ভোর । বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। পিতৃপক্ষের অবসানে আজ দেবীপক্ষের শুরু। আজ মায়ের চক্ষুদান করতে হয়। অথচ কাল রাত্রি থেকে রাখালদাদু খুব জ্বর । জ্বর গায়েই রং তুলি নিয়ে কোনরকমে রাখাল দাদু মইয়ের উপর উঠে মায়ের চক্ষুদান করছিলেন আর হৃদে সাজ সরঞ্জাম নিয়ে নীচে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ কি হল জ্বরের ঘোরে টাল খেয়ে পড়ে গেলেন বৃদ্ধ রাখাল মিস্ত্রী ।চীৎকার করে ওঠে হৃদয় ।রাখাল দাদু গো ... চীতকার শুনে ছুটে আসে প্রতিবেশীরা। ধরাধরি করে ডাক্তার খানায় নিয়ে যায় রাখাল দাদুকে ।হঠাৎ কী যেন হয় হৃদয়ের। ঘোরের মাথায় সে নিজেই বসে যায় চক্ষুদান করতে । একবার - দুবার - কিছুতেই মনসংযোগ করতে পারে না সে । তবে কি অধরাই থেকে যাবে তার স্বপ্ন ?চোখ বন্ধ করে একমনে দুর্গা স্তোত্র পাঠ করে তুলি ধরে সে। 

        

            আজ মহাপঞ্চমী । জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে আজ মায়ের মূর্ত্তি  প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা । রাখাল দাদু এখন অনেকটা সুস্থ । তার হাতের কাজ দেখে আশীর্বাদ করেছেন তাকে--- তোর হবে রে বেটা চালিয়ে যা -- সবসময় মনে রাখবি মা জগজ্জননী তোর সংগে আছেন । প্রতিমার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা । গায়ের রং কাঁচা হলুদ বর্ণ । নীচে পায়ের কাছে সবুজ  রংয়ের মহিষাসুর ।


       যথা সময়ে দেবীর বোধন শুরু হয় ।শুরু হয় অকাল বোধনে দেবীর আবাহন--- মূর্হু মুর্হু শংখ আর উলুধ্বনির মধ্যে সে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে -- পুরোহিত মশাই মন্ত্র পাঠ করছেন ---"যা দেবী সবর্ব ভুতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা--" আর হৃদয়ের বুকের মধ্যে একটা স্বপ্ন তির তির করে কাঁপতে থাকে -যাক সে পেরেছে। আজ বোধন - দেবীর অধিবাস।                                            


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics