উড়ান
উড়ান


আজ অনুষ্ঠান আছে তার। ঠিক সন্ধ্যে ছটায়। রবীন্দ্র সদনে ,আবৃত্তি পরিষদের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সে তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় চারটে ছুঁই ছুঁই । বেরোনোর আগে শয্যাশায়ী মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল , "মা আমি আসি ?
আজ আমার প্রোগ্রাম আছে । অনেক বড় প্রোগ্রাম।অনেক লোক আসবে--- প্রত্যুত্তরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক হল ,মনে হল কিছু বলতে চায়-
কিন্তু কোনো শব্দ বেরোলো না শুধু দুচোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিজের অজান্তেই একটা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। হঠাৎ মনে পড়ল
কোথায় যেন শুনেছিল শুয়ে থাকা মানুষের পায়ে হাত দিতে নেই--- থাক গে , মা কি আর কোনদিন উঠে বসতে পারবে ! বেরোনোর সময় দেখল দরজার
একপাশে একটা ছেঁড়া মাদুরের ওপর বসে অপু একমনে পড়া করছে । অপু তার ছোটো ভাই । অস্ফুটে তাকে বলল-" আসি রে -- আর দেরী করলে প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে ।"
ভাই আলগোছে ঘাড় নেড়ে নিঃশব্দে হাসল।রাস্তায় বেরিয়ে মনে পড়ল কালই মায়ের ওষুধটা শেষ হয়ে গেছে আজ যে করেই হোক ওষুধটা আনতে হবে। আজ অনুষ্ঠানে সেই প্রধান
শিল্পী বলে একটু সাজগোজ করেছে বৈকি ! যদিও সে ভালোই জানে এ সব পরিষদের অন্যান্য ছাত্রীদের কাছে নেহাতই চড়া মেকাপ - সকালেই তোরঙ্গ থেকে চকচকে জড়িপার সবুজ শাড়িটা
বার করেছিল(তবে এ শাড়িটাও বোধহয় আর বেশিদিন টিঁকবে না)। আজ তার চোখে আইলাইনার ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া কিন্তু ইদানীং চিন্তায় ভাবনায় তার চেহারাটাই এত রোগা আর কালিবর্ণ
হয়ে গেছে যে কোনকিছুতেই চেহারার সেই আগের জৌলুস আর ফিরে আসে না।
গলির মোড় ঘুরতেই দেখতে পেল সমরদা নতুন কেনা মোটরবাইকটা ফটফট করতে করতে এদিকেই আসছে-- "আরে শ্যামলী না?" তা চললে কোথায়? মনে মনে প্রমাদ গোনে শ্যামলী । আজ সত্যিই
দেরি হয়ে গেছে , এখন যদি আবার সমরদা খাজুরি শুরু করে ব্যস তাহলে প্রোগ্রামের দফারফা--কোনওরকমে পাশ কাটানোর ভঙ্গিতে বলল আজ রবীন্দ্রসদনে আমার প্রোগ্রাম আছে সমরদা, অলরেডি অনেক
দেরি হয়ে গেছে , সবাই অপেক্ষা করবে।'মূহূর্তের মধ্যে সমরদার মুখের আলো নিভে গেল। একটু যেন আহতই হয়েছে এরকম ধরা গলায় বলল-তাই নাকি? তা টিকিট তো দিলে না -- টিকিট দিলে না হলে যেতুম।"
পড়িমরি করে বাস ধরার জন্য দৌড়তে দৌড়তে শ্যামলী শুনতে পেল সমরদার শেষ কথা গুলো-- তা তুমি এই লাইনটা ধরে থেকে ভালোই করেছ--অভাবের সংসারে যেন
একঝলক টাটকা বাতাস।"বাসে উঠে শ্যামলী ভাবতে থাকে জীবনের একটা সময় ছিল যখন সমরদাকে দেখলেই বুকের মধ্যে উথাল পাথাল-- এমন কতদিন হয়েছে যে সমরদা তাদের গার্লস স্কুলের সামনে
সাইকেল নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত -- অবশ্য তখন সমরদার চেহারাও ছিল দেখবার মতই-- কালের স্রোতে সে ঝড়ের বেগ স্তিমিত হয়ে এসেছে -- সমরদাও বিয়ে থা করে আজ ঘোর সংসারি-অবশ্য এই
রোগা ভোগা শ্যামলা দোহারা চেহারার মেয়েটার প্রতি সমরদার যে আজও বিশেষ দুর্বলতা আছে সেটা শ্যামলী তার চোখের দিকে তাকালেই টের পায়।
রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে সে দেখল ইতিমধ্যেই পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা সবাই এসে পড়েছে। মেয়েদের সবার পরনে দামি শাড়ি--হয় সাউথ ইন্ডিয়ান ন্য় জামদানি, চুলে জুঁইয়ের মালা সঙ্গে মানানসই মুক্তোর গয়না - ছেলেদের পোশাক
পাজামা পাঞ্জাবী। এই অনুষ্ঠানে ঢুকতে টিকিট লাগে না কারণ পরিষদ অনুষ্ঠান করে অর্থসংগ্রহ করে না -- সবই প্রায় গেস্টকার্ড আর তারা সবাই বিনে পয়সার শিল্পী-- সে ছাড়া অন্যান্যদের প্রাচুর্্য্যের অভাব নেই তাই তারা আবৃত্তি করে শখে প্রয়োজনের তাগিদে
নয়। নেহাত পরিষদের সেক্রেটারী অমরদা তাকে মেয়ের মত স্নেহ করেন আর তার বাড়ীর অবস্থাটা জানেন তাই প্রত্যেকবারই অনুষ্ঠান শেষে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেন।
স্টেজে উঠে উইংসের পাশে দাঁড়াল সে -- পল্লব আর দীপুদি দাঁড়িয়ে আছে-- দীপুদি বলল নিজেরটা হলেই চলে যাসনি যেন শ্যামলী-- তুই তো সবই জানিস দীপুদি--মাইকে তার নাম অ্যানাউন্স হচ্ছে -- অডিটোরিয়ামে শুধু কালো কালো মাথা-- জনসমাগম ভালোই হয়েছে ।
আরেকবার মায়ের ওষুধ কেনার কথাটা তার মনে পড়ল-- অমরদাকে বললেই হয়ত পার্স থেকে বের করে দিয়ে দেবেন -- কিন্তু কারো কাছে কিছু চাইতেই কেমন বাধো বাধো ঠেকে, যত আড়ষ্টতা এসে ঘিরে ধরে । মুখ ফুটে আজ
অবধি কারও কাছে কিছু চাইতেই বা পারল কই ?
স্টেজে উঠলে সে একেবারে অন্য মানুষ -- নিজেকে একদম হারিয়ে ফেলে । স্টেজের লাল নীল আলোর মায়া -- কবিতার সঙ্গে কিবোর্ড অক্টোপ্যাডের সঙ্গত ,জোড়া জোড়া উৎসুক নিবিষ্ট চোখ তাকে যেন অন্য এক জগতে নিয়ে যায়--চোখ বন্ধ করে শুরু করে আবৃত্তির মাধ্যমে রবিবন্দনা --------
"সেই কথা ভালো, তুমি চলে এসো একা
বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে
স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা
সন্ধ্যা তারাটি শিরীষ ডালের ফাঁকে
তারপর যদি ফিরে যাও ধীরে ধীরে
ভুলে ফেলে যেয়ো তোমার যূথীর মালা ;
ইমন বাজিবে বক্ষের শিরে শিরে
তারপরে হবে কাব্য লেখার পালা।" হঠাৎ চোখের সামনে দুলে ওঠে অসুস্থ মায়ের মুখ, শীর্ন শরীর ,ছোট ভাইয়ের মলিন হাসি , বুকের ভিতর থেকে বোবা চীৎ
কার বেরিয়ে আসতে চায় , আমার মা অসুস্থ -- যে ভাবেই হোক আজকের মধ্যেই আমায় ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করতেই হবে । মুখে সে আবৃত্তি করে চলে --
রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে / জগতের নদী গিরি সকলের শেষে /
একসময় বলা থেমে যায় , হল ফেটে পড়ে হাততালিতে ; নিভে যায় স্টেজের আলো। উইংসের পিছনে দাঁড়ানো পল্লব হঠাত বলে ওঠে শ্যামলী একবার গ্রীনরুমে যাস। অমরদা তোকে ডেকেছেন । গ্রীনরুমের পর্দা ঠেলে সরিয়ে শ্যামলী দেখতে পায় একজন অত্যন্ত সুদর্শন ভদ্রলোকের সঙ্গে অমরদা বসে আছেন।
"আয় শ্যামলী ইনি হলেন গাথানী অডিও র মালিক । তোকে বলা হয়নি আজকের প্রোগ্রামের ইনি বিশেষ অতিথি ।তোর প্রোগ্রাম পুরোটা শুনেছেন দর্শকাসনে বসে , তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।" প্রথমটায় একটু অবাক হয়ে থতমত খেলেও শ্যামলী একটু পরেই বুঝতে পারল ভদ্রলোক চমতকার কথা ব লেন এবং আন্তরিক ভাবেই চান তার সঙ্গে একটা সিডি করতে।
আসলে আগামী কবিপক্ষে তারা রবীন্দ্রনাথের উপর একটা সম্পূর্ন নতুন ধরনের কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন । তারই একটি অংশ রবীন্দ্র নাথের কবিতা আবৃত্তি । তবে এত শিল্পীর মধ্যে ভদ্রলোক কেন শ্যামলীকেই বেছে নিলেন সেটা কিছুতেই তার বোধগম্য হল না। যাওয়ার সময় অমরদা শ্যামলীর হাতে কড় কড়ে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বল্লেন , " এটা রাখ। এ টা তোর অগ্রিম। ভদ্রলোক তোকে দিয়ে গেছেন। পরে এসে এগ্রিমেন্ট করে নেবেন। কবি পক্ষের আর বেশি দেরী নেই। ওরা খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করতে চান।"
কৃতঞ্জ তায় শ্যাম লীর চোখে জল চলে এল। নীচু হয়ে সে অমরদাকে প্রণাম করল ।
দুই
বাড়ির সামনে একটা অপ্রত্যাশিত জটলা দেখে হঠাত ছ্যাঁত করে ওঠে শ্যামলীর বুকটা ... তাহলে কী তার আশংকাই সত্যি হল ! ভীড় ঠেলে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে ছোটো ভাই চীতকার করতে করতে এগিয়ে আসছে ..."দিদি রে... মা আর নেই..." ।মূহুর্তের মধ্যে হাত পা অসাড় হয়ে আসে শ্যামলীর মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে ... সংগাহীন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।
আজ মায়ের কাজ । শ্যামলীর চোখ মুখ উসকো খুসকো , তার শরীরটাও ভালো নেই। মায়ের মৃত্যু তারপর অশৌচের ধকল সব মিলিয়ে চেহারায় একটা কালিবর্ন ছাপ পড়ে গেছে ।সর্বোপরি একমাত্র ছোটো ভাইকে হবিষ্যি করতে দেখে তার বুকটা পুড়ে যায়... কত বা বয়স হবে অপুর ? বাবা তো কবেই চলে গেছেন এই বয়েসে মাতৃহীনও হলো... কি কপাল!বিরাট করে কোনো আয়োজন করেনি শ্যামলী ... শ্রাদ্ধানুষ্ঠান টুকু আর কয়েকজন ব্রাক্ষণ ভোজন।অমরদা আর আবৃত্তি পরিষদের পল্লব, দীপুদি জান প্রাণ দিয়ে সাহায্য করেছেন নাহলে যে শ্যামলী একা কি করত!
আর একজনের কথা না বল্লেই নয়... তিনি গাথানী অডিও র মালিক উল্লাস মল্লিক। সৌম্য দর্শন এই মানুষটির ঋণ সে জীবনেও শোধ করতে পারবে না ।
মায়ের কাজ মিটে যাওয়ার পর সে নিজে থেকেই অমরদাকে বলে , এবার তো তাহলে গাথানী অডিও র সংগে কাজটা শুরু করতে হয়... অমরদা বলেন তোর শরীরের এই অবস্থা পারবি তুই এক্ষুনি এক্ষুনি এই ধকল নিতে ?রেকর্ডিং শুরু হলে কিন্তু রোজ একটানা কাজ চলবে। ঠিক পারবো অমরদা পারতে যে আমাকে হবেই...
তিন
শুরু হয় রেকর্ডিং এর কাজ...রবীন্দ্র নাথের কবিতা এবং রবীন্দ্র নাথের প্রভাব পরবর্তী আধুনিক কবিতার উপর এই বিষয় নিয়েই সি ডি ,শ্যামলীকে আবৃত্তি করতে হয় সাতটি কবিতা... চারটি রবীন্দ্র নাথের বাকিগুলি আধুনিক কবি রেহান কৌশিকের ... রেকর্ডিং এর কাজ অসম্ভব খাটুনির, কোথা দিয়ে যে দিনরাত কেটে যায় শ্যামলী বুঝতেও পারে না... কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সে থাকে আজকাল... সবসময় মাথায় ঘোরে আরও ভালো বলতে হবে... নিজেকে ছাপিয়ে যেতে হবে...
অমরদা একদিন এসেছিলেন এর মধ্যে স্টুডিওতে সব দেখে শুনে খুব খুশি বললেন খুব ভালো কাজ হচ্ছে ... তবুও যেন সন্তুষ্ট হতে পারে না শ্যামলী... তার মাথায় ঘুরতে থাকে কয়েকটি লাইন ,তার প্রিয় কবিতার লাইন...
"রঙ পারে ডেকে নিতে স্বপ্নোদ্যানের মর্মমূলে একা
রঙ পারে না বলেই এত সম্মোহন শরীরী বিস্তার
এই তো লেগেছে দোল স্তব্ধ ঝড় জেগে আছে বুকে
শাল আর পলাশেরা কোনো কথা বলেনি তোমার ।
রঙ নয় শব্দ নয় স্তব্ধতায় থাকো অবিচল
নিজের নিবিড়ে দেখো আত্মমগ্ন উজ্জ্বল উড়ান
তোমার ভিতর ঘরে খুলে দিচ্ছে যমুনার টান..."
দেখতে দেখতে পূজোর আগেই প্রকাশ পায় শ্যামলীর সিডি , "চয়ন", বাচিক শিল্পী হিসাবে শ্যামলীর বাচন ভঙ্গি , কবিতার সাথে একাত্ম বোধ বিদগ্ধ সমাজের প্রংশসা পায় খুব ।তবে শহরের প্রথম সারির একটি দৈনিকে তার সিডির রিভিউ বেরোনোর পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় সে। হাতেও তার মোটামুটি অনেক গুলো কাজ ।ইতিমধ্যে গাথানী অডিও র মালিক উল্লাস মল্লিক তার বিশেষ বন্ধু হয়ে গেছে ... ভদ্রলোক সত্যিই ভালো । সব চেয়ে বড় কথা তিনি শ্যামলীর অন্ধ ফ্যান ।তবে এখনই কোনো ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে নারাজ সে। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা... আরও ভালো কাজ করতে হবে আরো ভালো কাজ...
চার
পূজো এসে গেছে । পুজোতে এবার শ্যামলীর তুমুল ব্যস্ততা। সব কটা দিনই কোথাও না কোথাও প্রোগ্রাম রয়েছে । তার মধ্যে শ্যামলীর মন ভালো নেই । ছোটো ভাই অপুর ক্যানসার ধরা পড়েছে । আপাতত সে পিয়ারলেস হসপিটালে ভর্তি । চোখের সামনে ছোটো ভাইটিকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখে চোখের জল আর বাঁধ মানে না শ্যামলীর।সেদিন বিজয়া দশমী। সকাল থেকেই স্টুডিও তে সাংঘাতিক ব্যস্ত শ্যামলী । অপুর কাছে যাওয়ার সময়ও পায় নি ,আকাশের মুখও আজ ভার, থেকে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে,স্টুডিও থেকে বেরিয়ে পড়ি মড়ি করে পিয়ারলেস হসপিটালের দিকে ছোটে সে । রাস্তায় যানজট... এদিকে হসপিটাল থেকে ক্রমাগত ফোন আসছে...অপুর অবস্থা ভালো নয়।
শেষপর্যন্ত সে যখন পৌঁছায় হাসপাতালে পল্লব ছুটে এসে বলে শ্যামলী অপু আর নেই... আর কিছু কানে ঢোকে না শ্যামলীর ... সে ধীরে ধীরে অপুর বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়...। কে বলবে অপু মারা গেছে ? মুখে একটা স্মিত হাসি... দু চোখে অনেক না বলা কথা... শেষ মূহূর্তে কি বলতে চেয়েছিল শ্যামলীকে ?সবাইকে হারিয়ে সব কিছু হারিয়ে এই কি তবে তার আশ্চর্য উড়ান ? বাইরে তখন বিসর্জনের বাজনা বাজছে... ঠাকুর থাকবে কতক্ষন ঠাকুর যাবে বিসর্জন...