মা হয়ে ওঠার গল্প
মা হয়ে ওঠার গল্প
পর্ব ১
নন্দিনীর পতিদেবতার বদলির চাকরি। সরকারি কলেজের অধ্যাপকের চাকরি। বহরমপুরে। বিয়ের পরেই কিছুদিনের মধ্যেই তাই বরের সাথে তার কর্মস্থলে বহরমপুরে যেতে হয়েছিলো নন্দিনীকে। সরকারি কোয়ার্টারে নিজেদের "আনি-টুনির সংসার" সাজাতে গুছোতেই দিন কাবার হতো। দুজনের সংসারে একজন গৃহসহায়িকা মাসী। ভারী কাজ বলতে সারাদিনে তেমনকিছুই নেই নন্দিনীর। অঢেল সময়ে গল্পের বই পড়ে, ম্যাগাজিন থেকে দেখে নতুন নতুন রেসিপির এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই বাসনপত্র পুড়িয়ে কালো ঝামা করে ফেলে, লম্বা লম্বা মোটা মোটা কাঁটায় বরের জন্য সোয়েটার বুনে বুনে দিন কাটছিলো ওর। আর দু-তিনমাস বাদেবাদে কলকাতার কোলে সোদপুরে শ্বশুরবাড়ীতে ও বাপেরবাড়ীতে আসা... এই রুটিনে চলতে চলতে বেশ হাঁফিয়ে উঠেছিলো নন্দিনী। আলাদা নিজের সংসারের মাসছয়েকের মাথায় ও নিজের উদ্যোগেই শুরু করলো চাকরির জন্য তৈরি হওয়া। বর তো সকালে দশটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে কলেজে চলে যায়। তারপর নন্দিনী বসে লেখাপড়া নিয়ে। দুপুরে খেয়ে উঠে ঘুমোতে ঘুমোতে বেশ গোলগাল হয়ে উঠলো কিছুদিনেই। বিকেলে বর ফিরলে দুজনে বসে একসাথে চা-জলখাবার খেয়ে একটু ঘুরতে বেরোনো। কোনোদিন রবীন্দ্রভবনে কোনো অনুষ্ঠান, কোনোদিন সিনেমা, কোনোদিন কোনো কলিগের বাড়ীতে আড্ডা দিতে যাওয়া, আবার কখনো দুজনে মিলে রাস্তায় বা গঙ্গার ধারে হেঁটে বেড়ানো। চলছিলো বেশ... ধীরেসুস্থে, শ্লথগতিতে। এভাবেই বছরখানেক পার হতে একদিন বর হাসিমুখে এসে জানালো তার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। বদলি হয়েছে কলকাতার কাছাকাছি কলেজে। খুশিতে নেচে উঠলো মন। বাব্বা, আবার বাড়ীতে সবার সাথে একসাথে থাকতে পারবে!
পর্ব - ২
তল্পিতল্পা বেঁধে গোছগাছ শুরু হলো। খুব বেশিকিছু নয়, সামান্যই দুজনের একবছরের সংসারের যাবতীয়। একদিনেই সারা হলো গোছানো। বহরমপুরকে বিদায় জানিয়ে চললো ওরা ম্যাটাডোরে গেরস্থালি চাপিয়ে নিয়ে। গন্তব্য এবারে চুঁচুড়া। ফিসফিস করে বরকে জিজ্ঞাসা করলো নন্দিনী, "এই বরুণ, চুঁচুড়ায় কেন? সোদপুরে তো?" বরও তেমনি ফিসফিস করেই বললো, "চুঁচুড়ায় সরকারি কোয়ার্টার অ্যালট হয়ে গেছে। জয়েন করতে গিয়েই ব্যবস্থাপনা করে এসেছি। সারপ্রাইজ এটা। আমার আর ঐ জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকার ইচ্ছে নেই মোটেই। এই আনি-টুনিই ভালো। নিজেদের মতো নিজেরা থাকা। কম সুবিধা?" একটু দমে গেলো নন্দিনী, "একলা একলা আবার সারাদিন থাকা?" বর এবার আরো চাপা গলায় বললো, "একলা থাকতে হবে না। এবার আরেকজনকে আনার কথা ভাবছি। কী হলো? চুপচাপ যে?" নন্দিনীর কাঁধে চাপ দিলো সে। মুখে নন্দিনী বললো বটে, "এমনিই। না কিছু না!" কিন্তু ওর চোখের সামনে দিয়ে একটা স্লাইডশো চললো। নন্দিনীর ছোটপিসিমা, ছোটকাকিমা, তিন মাসী আর দুই বৌদির বাচ্চা হবার আগেকার চেহারাটা মনে পড়লো ঝটিতি। উফ্, কী ভয়ানক অবস্থা! ইয়াব্বড়ো বিশাল মোটা একটা পেট নিয়ে নড়াচড়া করতে ওদের বেশ কষ্ট হচ্ছে মনে হতো নন্দিনীর। আর এখন আবার ওর নিজের? দোনোমনায় পড়লো। ও কী আদৌ পারবে সব ম্যানেজ করতে?
চুঁচুড়ায় এসে আবার সংসার গোছগাছ করতে ক'দিন গেলো ওদের। তারপর আবার সেই একই রুটিন। দেখতে দেখতে একবছর পার হয়ে গেলো ওদের চুঁচুড়ার সংসারেও। তারমধ্যেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চাকরির লিখিত পরীক্ষা পাশ করে গেলো নন্দিনী। বাকি প্যানেল তৈরি এবং ইন্টারভিউ ইত্যাদিতে আরো কয়েকটা মাস লেগে যেতে পারে। পরীক্ষার পরেই নন্দিনীর আবার সেই একাকীত্ব। বরুণ, মানে নন্দিনীর বর তো তখন উঠেপড়ে লাগলো বাবা হবার প্রচেষ্টায়। আর নন্দিনীর ভয় বাড়তে লাগলো ক্রমশঃ। কী হবে? ও কী পারবো সামলাতে? দুর্ভাবনায় অস্থির নন্দিনী। তারপর সেই বছর এপ্রিলের শেষের দিকে ওরা পেলো সেই সুখবরটা... প্রেগ-কালার পজিটিভ অর্থাৎ নন্দিনী মা হতে চলেছে। নন্দিনী হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ভয়ে, আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে বুক শুকিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা ওর। বর যতই সাহস দেয় ততই নন্দিনী বলে, "তোমার কী কখনো বাচ্চা হয়েছে নাকি? তুমি কী করে জানবে?" তারমধ্যে আরেকটি ভয়াবহ উপসর্গ... যা খায় তাই বমি করে ফেলে। ডাক্তারবাবু ওজন দেখে ওকে বললেন, "কমপক্ষে দশ কেজি বাড়াতে হবে ওজন। তবেই তুমি হেলদি বেবি পাবে। এভাবে ওজন কমে গেলে চলবেই না। আর তোমার ব্লাডপ্রেসার বাড়ছে কেন এতো? ভয় পাচ্ছো?" ডাক্তারবাবু হাসছেন, আর নন্দিনী কাঁদছে। যত সান্ত্বনা দেন উনি এবং অ্যাসিসট্যান্ট দিদি, ততই কাঁদে ও। শেষে ডাক্তারবাবু বললেন, "এমনিতেই হাইরিস্ক প্রেগনেন্সি, তারমধ্যে তুমি শুধু আম-ডাল আর পটল ভাজা ছাড়া আর কিছু খাও না। তোমার বর তো তাই বলছে। এভাবে কি করে চলবে? হুঁ? জিয়ল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবে, সবরকম সবজি আর ডাল দই ছানা খাবে। পরের চেক-আপে আমি দেখতে চাই ওজন বাড়িয়েছো! কেমন?"
কোয়ার্টারে ফেরার পথে বরুণ বললো, "ঠিক হয়েছে। খালি এটা খাবো না, ওটা খাবো না।" রিক্সা দাঁড় করিয়ে বাজার থেকে জিয়ল মাছ কিনে নিয়ে এলো বরুণ। ঐ মাছগুলো কিলবিল করছে দেখেই নন্দিনীর গায়ের ভেতরে গোলাতে শুরু করলো। চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইলো কাঠের পুতুলের মতো। ওদের হোলটাইমার পুষ্পদির সাহায্যে সেই জিয়ল মাছের ঝোল বরুণ রান্না করে নন্দিনীকে খাওয়াতে গেলো। রান্নার গন্ধেই নন্দিনী নাকে চাপা দিয়ে বিছানার এককোণে বসেছিলো। এবার কেঁদে ফেললো। নাকে গন্ধ লাগছে বলায় নাক চেপে ধরে হাঁ করিয়ে নন্দিনীর মুখে ঐ জিয়ল মাছের ঝোলটা ঢেলে দিলো বরুণ। তখন পুষ্পদি গাইড করছে, "দাদা, ঝোলটা খাইয়ে দ্যান। ঝোলের মধ্যেই তো সব স্বত্ব।" সুতরাং বরুণ মানে নন্দিনীর পতিদেবতা তখন চতুর্গুণ উৎসাহে নন্দিনীর গলায় জিয়ল মাছের ঝোল ঢালছে। আর বলে চলেছে, "একবার পেটে তলিয়ে গেলে আর কিছু হবে না। এইতো নাও গিলে ফেলো, গিলে ফেলো।" পুষ্পদিও মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যাচ্ছে, "বৌদি, দমটা চেপে ধইরে ঢঅক করে গিলে ন্যাও... কিচ্ছু হবেনে।" আর পারছিলো না নন্দিনী ঐ দুর্গন্ধময় জিয়ল মাছের ঝোল মুখে রাখতে। হাল ছেড়ে দিয়ে ঢক করে গিলেই নিলো কাঁদতে কাঁদতে। ওর নিজেরও যেইমাত্র মনে হলো, "আর কিছু হবে না মনে হয়!" ঠিক তখনই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বমি শুরু হলো। সামনেই পতিদেবতা বরুণ জিয়ল মাছের ঝোলের বাটি হাতে চামচ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বমির প্রথম দমকে তাই সে বেশ সুন্দর করে জিয়লের ঝোলে ভিজলো বিশেষকিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই। উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো নন্দিনী। তারপরের দমকে ভিজলো বিছানার একটা কোণ। তারপর ওয়াশ বেসিন পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ডাইনিং হল ভাসলো। তারপর পেটে যাকিছু ছিলো সব বেরিয়ে আসতে লাগলো... সকালের চা-বিস্কুট, একগাল মুড়ি। বিনা বাধায় উঠে আসছে পাকস্থলী থেকে। পেট খালি হয়ে গেলো পুরো। ওয়াক ওঠা বন্ধ হলো না। ঘাড় কাত করে নেতিয়ে পড়লো নন্দিনী। নন্দিনীর মাথায়-টাথায় বিস্তর জল-টল ঢেলে পুষ্পদির সাহায্যে জামাকাপড় পাল্টে, বিছানা পাল্টে নন্দিনীকে পুষ্পদির জিম্মায় শুইয়ে রেখে বরুণ ছুটলো আবার ডাক্তারবাবুর কাছে। সেদিন তার আর কলেজে যাওয়া হলো না।
ঘন্টাদুই বাদে ফেরত এলো ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে বেদম ধাতানি খেয়ে, "আপনাকে জোর করে খাওয়াতে বলেছি? জানেন এইসময় এইভাবে বমি হওয়াতে কীকী কমপ্লিকেশন হতে পারে? জোর করবেন না। নিজের থেকে যা খাচ্ছে সেটাই একটু বেশি পরিমাণে পেট ভরে খাক। বারে বারে খাক। জোরাজুরি করার দরকার নেই। মোটিভেট করতে হবে।" একেবারে ওষুধপত্র কিনে নিয়ে বরুণ ফেরত এলো। তার পরের সপ্তাহটাও বরুণ ছুটি নিলো নন্দিনীকে মোটিভেট করার উদ্দেশ্যে। সেও এক অত্যাচারের আকার নিলো। সারাক্ষণই বলে চলেছে কানের পাশে, "তুমি দুর্বল হয়ে গেলে বাচ্চা দুর্বল হয়ে যাবে। একটু বেশিবেশি করে খাও। বলো কী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।" শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা, মাথা পাগল-পাগল অবস্থা নন্দিনীর। ততদিনে নন্দিনীর এই খাওয়াদাওয়ার অবনতির খবর বেশ রসেবশে পরিবেশিত হয়েছে ও বাপেরবাড়ীতে এবং শ্বশুরবাড়ীতে। দলেদলে দেখতে আসার হিড়িক পড়ে গেছে। আর বরুণও মহা উৎসাহে সগৌরবে ঘোষণা করছে যে সে নন্দিনীর খাওয়াদাওয়ার জন্যই ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছে। সারাদিন দেখভাল তদারকি করছে।
নন্দিনীর বাবা-মা তখন অন্ধ্রপ্রদেশে। এসটিডিতে সব খবর শুনে মা ওর ছোটমাসীকে দায়িত্ব দিলো নন্দিনীর কিছুদিনের পরিচর্যার জন্য। ছোটমাসীও ছেলে-মেয়ে নিয়ে হাজির হয়ে গেলো বেশ ক'দিনের জন্য। তারপর নানারকম স্বাদবর্ধক রান্নাবান্না করে খাইয়ে খানিকটা সুস্থ করে রেখে সপ্তাহতিনেক বাদে ফেরার সময় বরুণকে আঙুল উঁচিয়ে বলে গেলো, "খবরদার জোর করে খাওয়াবে না কিছু। ছেলে-মেয়ের স্কুল কামাই করিয়ে আমি আর আসতে পারবো না কিন্তু। ওকে ওর মতো থাকতে দেবে একদম।" ততদিনে একমাত্র আমিষ খাবার ছাড়া অন্যান্য সব সহ্য হয়ে গেছিলো, ছ'মাস পরে মাছ খেতে পারলো শুধু, ডিম মাংস একেবারেই না। ডাক্তারবাবু বললেন, "থাক, ওজন বেড়েছে। এতেই হবে।" তারপর নন্দিনীর আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হলো। বাচ্চা ভালো আছে, তবে ওর ব্লাডপ্রেসার বেশি থাকায় যতটা গ্রোথ হওয়া উচিৎ ততটা হয়নি। আবার নন্দিনীর ভয় শুরু হলো। সবসময় বুক ঢিপঢিপ। কী হবে, কী হবে? এক্সপেক্টেড ডেট ২৩/২৪ জানুয়ারি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বরুণ ছুটি নিয়ে নন্দিনীকে নিয়ে ওদের সোদপুরের বাড়ীতে চলে যাবে। ওখানেই নার্সিংহোম বুক করা হয়েছে। চুঁচুড়ায় নন্দিনীর ডাক্তারবাবুর ট্রিটমেন্ট এবং প্রেসক্রিপশনই ওখানে ফলো-আপ হবে। এখান থেকে ডাক্তারবাবুই সব ব্যবস্থা ঠিক করে দিয়েছেন। এবং ডেলিভারির সময়েও ডাক্তারবাবু নিজেই থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।
মোটামুটিভাবে নিশ্চিন্তে আছে ওরা তখন। একরাতে হঠাৎ নন্দিনীর খুব পেটব্যাথা, আবার বমি, ভোর হতে না হতেই ছুটলো ডাক্তারবাবুর কাছে। ততক্ষণে নন্দিনীর ব্লিডিংও শুরু হয়েছে।
পর্ব - ৩
তারিখটা ১৫ই নভেম্বর। ডাক্তারবাবু সাথেসাথেই অ্যাডমিট করালেন। ১৬ই নভেম্বরও ওভাবেই কাটলো। অ্যানেস্থেসিয়া করা গেলো না অতবেশি ব্লাডপ্রেসারের কারণে। এদিকে পেটের মধ্যে বাচ্চার অক্সিজেন সাপ্লাই কমছে... নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে বাচ্চা। ১৭ই নভেম্বরে ডাক্তারবাবু আর ঝুঁকি নিলেন না। সিজারিয়ান সেকশন করা হলো নন্দিনীর... যা থাকে কপালে করে। এক্সপেক্টেড ডেটের ঠিক দু'মাস সাত দিন আগেই নন্দিনীর কন্যারত্ন মাতৃজঠর থেকে বেরোলেন মাত্র এক কেজি চারশো গ্রাম ওজন সহকারে। জ্ঞান আসার পরে তো কন্যাকে দেখেই নন্দিনীর দু'চোখে ধারাস্রোত, বরুণের হাত আঁকড়ে ধরে নন্দিনী কঁকিয়ে ওঠে, "একে বড়ো করবো কি করে?" বরুণ একমুখ হেসে বলে, "একে না... বলো আমাদের বনিকে... আমরা দু'জনে মিলে আমাদের বনিকে বড়ো করবো।" সেই সেদিন থেকে শুরু হলো নন্দিনীর জীবনে পৃথিবীর সুন্দরতম কঠিন যাত্রাপথ... মাতৃত্বের যাত্রাপথ। বরুণের শক্ত হাতের ছোঁয়ায় আর দায়িত্বশীলতার ছায়ায় নন্দিনী আষ্টেপৃষ্ঠে মা হয়ে উঠছে, তার বনির মা!
-----------------------------