লাল খাম
লাল খাম
লেখনীতেঃ হুমায়রা জান্নাত মীম
আমার বিয়ের এক বছর পেরুতেই একদিন রাতে আমার স্ত্রী আমাকে বললো, তোমার বাবাকে আমি আর জাস্ট নিতে পারছি না। সারাক্ষণ বৌমা, আমার চশমা দেখছো? বৌমা আমাকে একটু চা করে দেবে। বৌমা আমার লাঠিটা একটু খুজে দেবে? সারক্ষণ এটা দাও। ওটা দাও। আর নেওয়া যাচ্ছে না। এবার তুমি এর একটা বিহিত কর। হয় তোমার বাবাকে এ বাড়িতে রাখো, নাহলে আমায় রাখো।
আমি আমার স্ত্রীর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার কি করার আছে? নিজের বাবাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না। সারাজীবন এই বোঝা বইতে হবে কিছু করার নেই।
" নেই মানে! বললেই হলো? ওনাকে তুমি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এতে তোমার আমার দুজনেরই আপদ বিদায় হবে।"
" কি বলছো এসব? বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে লোকে কি বলবে?"
" লোকের কথা না ভেবে আমার কথা ভাবো। তুমি যদি বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠাও তাহলে আমি মারুফকে( আমার ছেলে) নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো। এই আমি বলে রাখলাম।" এই বলে আমার স্ত্রী রাইসা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ভাবতে লাগলাম, আমি কি করবো। রাইসাকে আমি খুব ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। কিন্তু বাবাকে ফেলে দেওয়াও যায় না।
অবশেষে অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবো। এতে যদি আমার সংসারটা বেঁচে যায়।
সকালে বাবাকে বললাম, বাবা তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।
আমার কথা শুনে বাবা চা খাওয়া রেখে বললেন, কেন খোকা কোথাও বেড়াতে যাবো?
" হ্যাঁ, তোমার এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাবো। ওখানে কিছুদিন থেকে আসবে। আমি অফিস থেকে এসে নিয়ে যাবো।"
আমার কথা শুনে বাবা আনন্দিত হয়ে বললেন, তাই! আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি সব গুছিয়ে রাখবো।"
" হুম।"
আমি ইশারায় রাইসাকে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝালাম। সেটা বুঝে রাইসা সেদিন খুব আনন্দিত হয়েছিল। সেদিন বাবার মুখে ফুটে উঠা সেই অমায়িক হাসিটাও আমার পাথর মনটাকে গলাতে পারে নি। এতটাই পাথর মনের হয়ে গিয়েছিলাম আমি!
অফিস থেকে এসে বাবাকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের দিকে রওয়ানা হলাম। বাবাকে এখনো জানাইনি যে ওনাকে কোন আত্মীয়ের বাড়ি নয় বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে যাচ্ছি। বৃদ্ধাশ্রমে গাড়িটা থামার পর বাবাকে নিয়ে ঢুকবো অমন সময় বাবা বললেন, খোকা আমরা না আত্মীয়র বাড়িতে যাবো! তাহলে এই বৃদ্ধাশ্রমে কি করছি?
আমি বললাম, ভেতরে চলো বুঝতে পারবে।
আমার কথা শুনে বাবা কিছু বললেন না। আমি ভেতরে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ওনার থাকার ব্যবস্থা করে এলাম। বাবা সবটা নির্বাক হয়ে দেখছিলেন। সব ব্যবস্থা করার পর বাবাকে বললাম, বাবা, আজ থেকে তুমি এখানে থাকবে। এটাই তোমার নতুন ঘর। তোমার বৌমা চায় না তুমি আমাদের সাথে থাকো। তাই এখন থেকে এটাই তোমার ঘর।এখানে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তাই ফোন দিয়ে আমাদের বিরক্ত করবে না।
আমার কথাগুলো শুনে বাবা তখনো নির্বাক। হয়তো নিজের ছেলের কাছ থেকে পাওয়া এত বড় আঘাত ওনি মেনে নিতে পারছেন না। ওনার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। কিন্তু আমি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে আসতেই বাবা পেছন থেকে কান্নামাখা কন্ঠে বলে উঠেন, তোর এত বড় বাড়ির একটা কোণেও আমার জায়গা হলো তাই না রে খোকা। এতটাই বোঝা হয়ে গিয়েছি তোর কাছে আমি!
বাবার কথা শুনে আমার খারাপ লাগলেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম। পেছনে তাকালে হয়তো বাবার আঘাতে ভেঙে পড়া মুখটা দেখতে পেতাম।
★★ বাবাকে ওখানে রেখে আসার বেশ কয়েকমাস হয়ে গেছে। যে শান্তির জন্য বাবাকে ওখানে রেখে এলাম সেটার দেখা এখনি অব্দি পাই নি। প্রথম কয়েকদিন ভালো গেলেও এখন রাইসা আর আমার মধ্যে ভীষণ ঝগড়া হয়। এখন ঝগড়ার বিষয় হলো মারুফ। রাইসা আর আমি দুজনেই চাকরিজীবী। তাই মারুফকে দেখা-শুনা কে করবে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। আগে বাবা থাকায় মারুফকে বাবার কাছে রেখে নিশ্চিন্তে থাকা যেত। আজ অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হবে। এমন সময় বৃদ্ধাশ্রম থেকে খবর এলো বাবা মারা গেছেন। আমাকে নাকি ওনার দাফন কাজের জন্য ওখানে যেতে হবে। এটা শুনে আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। আমি বললাম, আমি যেতে পারবো না। আমার অফিসে কাজ আছে। আপনারা তা সেরে নিন। যত টাকা লাগে আমি পাঠিয়ে দেবো।
আমার কথা শুনে বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঠিক আছে পাঠিয়ে দিন।
অফিসের কাজ শেষে বাড়িতে আসলাম ততক্ষণে বাবাকে দাফন করা হয়ে গেছে। রাইসা এখনো ফিরে নি। মারুফ স্কুলে। বাড়িতে ঢোকার সময় একটা ডাকপিয়ন এসে বললো, এটা আশরাফ আলমগীরের বাড়ি?
" হ্যাঁ, আমি আশরাফ আলমগীর। কেন কি হয়েছে?"
" আপনার নামে একটা চিঠি আছে।"
" দিন।"
ডাকপিয়ন একটা লাল খাম বের করে আমার হাতে দিল। ডাকপিয়ন বললো, আপনাকে এত এত চিঠি কেন পাঠায় বলুন তো? প্রতি সপ্তাহে একটা করে লাল খামে মোড়া চিঠি দিয়ে যাই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, প্রতি সপ্তাহে মানে? আজই তো আমি প্রথম চিঠি পেলাম।
" হ্যাঁ, প্রতি সপ্তাহে আপনার নামে এরকম চিঠি আসে। একজন মহিলা রিসিভ করেন। সম্ভবত আপনার মিসেস।"
" ওহ, আচ্ছা। আপনি আসতে পারেন।"
ডাকপিয়ন চলে গেলে আমি গিয়ে বাকি চিঠিগুলো খুজতে লাগলাম। রাইসা তো কখনো আমায় এই চিঠির বিষয়ে বলে নি। অনেক খোজা-খুজির পর একটা ড্রয়ারে অনেকগুলো লাল খাম দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম এগুলোতেই বাকি চিঠি আছে। সবগুলো খামের উপর বাবার নাম লেখা। আমি একে একে সব চিঠি পড়তে লাগলাম। চিঠিগুলো পড়ে আমার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। একেবারে প্রথম চিঠিতে লেখ-
" খোকা, একবার আসবি বাবা? অনেকদিন হলো তোকে দেখি না। তোকে বড্ড মনে পড়ে। বাড়িতে ফোন দিলে বৌমা কেটে দেয়। তাই তোকে চিঠি দিচ্ছি। একবার দাদুভাইকে নিয়ে আসবি?"
পরের চিঠিতে লেখা-
"খোকা, এলি না কেন বাবা? তোর অপেক্ষায় যে আমি বৃদ্ধাশ্রমের পথে চেয়ে থাকি। আসবি একবার? তোকে একবার দেখতাম।"
এভাবে একে একে সবগুলো চিঠি পড়তে লাগলাম। বাবার সর্বশেষ চিঠি যেটা আজ এসেছে সেটা খুলে পড়তে লাগলাম,
আদরের খোকা,
কেমন আছিস খোকা? তোকে অনেকগুলো চিঠি দিলাম। কিন্তু তুই একটা বারের জন্যও এলি না। জানিস খোকা, আজ তোর ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ছে। তুই আমার আর তোর মায়ের বড্ড আদরের ছিলি। যেদিন তোকে প্রথম ডাক্তার আমার কোলে দেয়। সেদিন তোর মুখ দেখে আমার যে স্বর্গীয় অনুভূতি হয়েছিল সেটা তোকে আমি কখনো বোঝাতে পারবো না। আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীতে প্রথম আমিই বাবা হচ্ছি। তোকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য আমি আর তোর মা আর কোন সন্তান নিই নি। জানিস যেদিন তুই প্রথম আধো আধো মুখে আমাকে বাবা বলে ডেকেছিলি, সেদিন আমার মনে হচ্ছিলো আমি পৃথিবীর সেরা সুখ পেয়ে গেছি। জানিস খোকা আমার ডান হাতের শাহাদাত আঙুল ধরে তুই প্রথম হাটতে শিখেছিলি। একবার হাটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলি তাতে তোর কি যে কান্না। তোকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছিলো না। তখন তোকে আমি একটা হলুদ রঙের গাড়ি কিনে দিয়েছিলাম।গাড়িটা পেয়ে তোর কি যে আনন্দ। মনে আছে সে কথা? হয়তো মনে নেই।কিন্তু আমি ভুলতে পারি নি। তারপর তোকে যেদিন স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এলাম, সেদিন তোর কি কান্না! তুই কিছুতেই আমাকে ছেড়ে থাকবি না। আস্তে আস্তে তুই এইটুকু বাবু থেকে এত বড় হলি। দেশে-বিদেশে তোর নাম হলো। তোর এই নাম দেখে গর্বে আমার বুক ভরে উঠতো। সবাইকে বলতাম, ওই দেখো ওটা আমার ছেলে।যে অনেক বড় স্কলার। তারপর তোর বিয়ে হলো। ঘরে বৌমা এলো। আমার কোন মেয়ে ছিল না। তাই বৌমাকে আমি আমার মেয়ে ভেবেই স্নেহ করতাম। হ্যাঁ, বৌমাকে আমার এটা ওটা আনতে করতে বলতাম। এতে বৌমা বিরক্ত হতো বুঝতে পারতাম। কিন্তু আমিও যে নিরুপায় ছিলাম রে। বয়স হচ্ছে লাঠি ছাড়া হাটতে পারতাম না। চশমা ছাড়া দেখতে পারতাম না। নিজের জামা-কাপড় ধুতে আমার ভীষণ কষ্ট হতো। তাই বৌমাকে বলতাম। কিন্তু এতে তোরা বিরক্ত হয়ে আমায় বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলি। এখানে আমার একদম ভালো লাগে না। বড্ড একা লাগে রে। তোদের কথা খুব মনে পড়ে। কতদিন মারুফ দাদুভাইয়ের সাথে খেলি না। আমাকে একদিনের জন্য হলেও নিয়ে যাবি বাড়িতে? আজকাল শরীরটাও বেশ ভালো যাচ্ছে না। বোধহয় আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। শেষবারের মতো একবার আসবি খোকা? আয় না। তোদের প্রতি আমার কোন রাগ নেই। কোন বাবাই পারে না তার সন্তানের প্রতি রেগে থাকতে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বাবা হিসেবে ব্যর্থ। ব্যর্থ বলেই আমাকে জীবনের শেষ সময়টুকু বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে হচ্ছে!
ইতি,
তোর ব্যর্থ বাবা
চিঠিটা পড়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।এতটা অমানুষ আমি হলাম কিভাবে? নিজের বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। যার ঔরসে আমার জন্ম হয়েছিল। তাকে শেষ দেখাটাও দেখতে যাই নি। আজকে বাবাকে হারিয়ে বুঝতে পারলাম আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ছায়াটাকে হারিয়ে ফেলেছি। যে মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে আমাকে সারাটা জীবন ভালোবেসে এসেছে। তাকে আমি দিনশেষে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিই নি। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। আমি আর সময় নষ্ট না করে বৃদ্ধাশ্রমে গেলাম। সেখান থেকে বাবার কবর কোথায় সেটা জেনে বাবার কবরের সামনে বসে পড়লাম। নতুন কবর দেওয়া হয়েছে। বাবার কবরে হাত বুলাতে বুলাতে কেঁদে কেঁদে বললাম, বাবা, ও বাবা। ফিরে আসো না বাবা। বাবা কথা দিচ্ছি আর তোমায় কষ্ট দেবো না। আমাকে একটা বার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দাও। আমাকে এভাবে অপরাধী করে চলে যেও না বাবা। সন্তান হিসেবে আমি ব্যর্থ, তুমি নও বাবা।প্লিজ ফিরে আসো। আমি পারবো না এ পাপের বোঝা বইতে।প্লিজ ফিরে আসো।
এতো আহাজারি করার পরেও বাবা এলেন না। সব কিছু নিস্তব্ধ। বাবার নিরব কবরটা যেন আমায় বলছে, তুই আসতে বড্ড দেরি করে ফেললি খোকা। বড্ড দেরি করে ফেললি!
সমাপ্ত
