STORYMIRROR

Zakir Hossain

Romance Tragedy

3  

Zakir Hossain

Romance Tragedy

অমর প্রেম

অমর প্রেম

7 mins
243

   জীবনের প্রথম চুম্বনের এঁটোভাবটা এখনো কাটেনি রিমির ঠোঁট থেকে । একটা লাজুক ভাব জমা হওয়ায় রাত্রে ডিনারের সময় বাবা মায়ের সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারছিল না কিছুতেই । অকারনে বেশী হাসি দিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছিল লজ্জাটা । ডিনারের পর্ব চুকে গেলে বেডরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সন্ধ্যার সুখ সুখ অনুভবটা গোটা গায়ে ছড়িয়ে দিতে দিতে ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে । জোভানের একটা খোঁজ নেওয়া দরকার । 

  'কি করছিস ?' টাইপ করে হোয়াটস্অ্যাপে ভাসিয়ে দেয় কথাটা । কিছু সময় বয়ে গেলেও প্রত্যুত্তর না পেয়ে দ্বিতীয়বার চেক করতেই শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে । সুখের বজরা ভড়ভড় করে ডুবে যায় অনিশ্চয়তার ঘোলা জলে । সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতোন গোঁত্তা খায় কঠিন পাষাণে । জোভান কি ওকে ব্লক করেছে ! যদিও রাত সাড়ে এগারোটার আগে ওদের কল করার কথা নয় তবু দ্রুত কল করে ওর নির্দিষ্ট নম্বরে । কিন্তু সম্ভব হয়না । বুঝতে পারে জোভানের নম্বরটি থেকে তাকে ব্লক করা হয়েছে । এরপর একে একে জোভানের সঙ্গে যোগাযোগের সব কটা মাধ্যমেই ট্রাই করে রিমি । কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয় । একটা কুলুকুলু ঘাম জমতে শুরু করে ঘাড়ের পেছনদিক থেকে । কি হলো ব্যাপারটা ?

  বাকি রাত দুশ্চিন্তায় ভালো ঘুম হয়না । সকাল হতেই আরেকপ্রস্থ যোগাযোগের চেষ্টা করে । কিন্তু ফল আগের মতোই । জোভান তাকে সবকিছু থেকে ব্লক করে দিয়েছে । 

  পৃথিবী থেকেই যেন হারিয়ে গিয়েছে ছেলেটি ! গোবিন্দদার চায়ের দোকান , গঙ্গার ঘাট , সাড়ে চারটের সময় গির্জার মোড়ের সিনহা বাস , এ রকম যে যে জায়গায় তারা এ যাবৎ দেখা করেছে তার সবটাতেই ঢুঁ মারে , কিন্তু কোথাও দেখা মেলে না জোভানের । প্রথম প্রথম একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল রিমির , কিন্তু এখন ধীরে ধীরে সেটি অপমানিত হবার রূপ নিচ্ছে । সাথে জেদও । ওকে জানতেই হবে তার অপরাধটা কি ? কি কারণে জোভান তাকে এভাবে অপমান করল ? সবটাই তো ঠিক ছিল । জোভানের ইচ্ছেতেই তো সাড়া দিয়ে জীবনের প্রথম চুম্বনটা ওভাবে গঙ্গার পাড়ে সেদিন খরচ করে এলো । তাহলে ? কি ভুল তার ?

  সাতদিন পেরিয়ে যেতে জোভানের খবর নিতে মরিয়া হয়ে একদিন মিলিকে ফোন করল রিমি । মিলি রিমির স্কুলজীবনের বন্ধু । স্কুল পেরিয়ে আলাদা কলেজে ভর্তি হওয়ায় ওদের সম্পর্কটা আলগা হয়ে গেলেও নিজের বিয়েতে রিমিকে নেমন্তন্ন করতে ভুল করেনি মিলি । আর সেই বিয়ে বাড়িতেই জোভানের সঙ্গে রিমির আলাপ হয়েছিল । মিলি জোভানের কেমন যেন আত্মীয় হয় ! রিমি আর জোভানের সেই বিয়ে বাড়ির আলাপ একটু একটু করে ঘন হয়ে জমতে শুরু করে । ' লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ' এই ক্লিশে প্রবাদটিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে তারা জ্বাল দেওয়া রসের আস্তে আস্তে ঘন হয়ে ওঠা আঠালো গুড়ের মতো পরস্পরের মনের খুব কাছাকাছি চলে আসে । 

  রিমি যখন ফোন করে মিলি তখন শ্বশুরবাড়িতে ছিল । মন দিয়ে রিমির সব কথা শুনে । কথা দেয় সে অবশ্যই খুব তাড়াতাড়ি ওর সঙ্গে জোভানের দেখা করিয়ে দেবে । কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় রিমি । রিমির খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে জোভান তাকে ঠকায়নি । নিশ্চয় কোনো কারনে বাধ্য হয়ে নিজেকে সাময়িক গুটিয়ে নিয়েছে সে ।

  জোভান সৎ , পরিশ্রমী । পড়াশুনোয় মেধাবী । অল্প বয়সে মোটা মাইনের একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে । চারিত্রিক দোষগুন বলতে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কথা বলে । ওর ভাবনাচিন্তাগুলো সাধারণের চাইতে অন্যরকম । 

  একবার এক ঘটনা ঘটেছিল । ময়দানের ধারে একটা পাগলীকে একটা লোক ধর্ষণ করেছিল বলে খবর রটে ছিল । এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিমির সঙ্গে জোভানের কথা কাটাকাটি হয়েছিল বেশ । জোভান অদ্ভুতভাবে লোকটাকেই সাপোর্ট করেছিল । তর্ক করে রিমিকে বলেছিল , ' তুই কি করে জানলি পাগলীটা সেক্স করার সময় আনন্দ নেয়নি ! বরং পাগলীটার ভাগ্য ভালো যে কেউ অন্তত ওকে সেই আনন্দটুকু দিয়েছে ! ' রিমি সেদিন আশ্চর্য হয়েছিল খুব জোভানকে দেখে ।

  

   

   

   মিলির জরুরী তলবে জোভান ওর নতুন ফ্ল্যাটে এসে শোবার ঘরে ঢুকেই হকচকিয়ে যায় । রিমি আগে থেকেই দেওয়ালের দিকে বিছানার এককোনে চুপটি করে বসে আছে । নীলরঙা শাড়িতে বেশ পরিপাটি দেখাচ্ছে ওকে । জোভানকে দেখতে দুটি মলিন চোখ মেলে তাকায় । ওর ফর্সা মুখে ব্যাকুলভাব কালো মেঘের ছায়া ফেলে রেখেছে । টলটলে চোখের নীচে কালো ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায় । 

   মিলির এই নতুন ফ্ল্যাটে নিতান্তই অপরিহার্য্য কয়েকটি জিনিস ছাড়া আসবাব বলতে তেমন কিছুই নেই । তাই ওদের শোবার ঘরের বিছানাতেই বসতে হয়েছে সবাইকে । মিলি ওদের দেখা করিয়ে দিয়ে 'পাঁচমিনিটের মধ্যে আসছি ' বলে টুক করে কেটে পড়েছে । রিমিই ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে পরে একসময় মিলির কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবে । আগে থেকেই সেই রকম কথা হয়ে আছে । এখন এই বারোশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটিতে রিমি ও জোভানের মাঝে তৃতীয় কেউ উপস্থিত নেই । 

  জোভান থমথমে মুখে প্রশ্ন করে , ' মিলিকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে এই দেখা করার আইডিয়াটা কি তোর ? '

  রিমি রহস্য করে উত্তর দেয় ,

  - হতেও পারে । 

  জোভান বিছানার একধারে পা ঝুলিয়ে বসে । ওর মুখে বেশ কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি । চুলগুলো উসকোখুশকো । ডানহাত দিয়ে গোটা মুখ টেনে টেনে মুছে নিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে । বলে ,

   - আচ্ছা বেশ । তোকে কিছু প্রশ্ন করতে হবেনা । আমিই তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি এক এক করে । ঠিক আছে ?

  একটু বিরাম নেয় । তারপর বলে , 

  - বিশ্বাস কর রিমি আমি কিন্তু তোকে অপমান করিনি কোনভাবেই ।

   রিমি শ্লেষের সঙ্গে বলে ,

   - তাই নাকি !

   - হুমম্ ..

   এতোক্ষন পর জোভান সরাসরি রিমির মুখের দিকে তাকায় । স্বরটাকে স্বাভাবিক রেখে বলে ,

   - আচ্ছা... নেতাজীকে সব রাজনৈতিক দলই পছন্দ করে কেন ভেবে দেখেছিস কখনও ?

   - কেন ?

   - কারণ উনি যে কারনেই হোক না কেন স্বাধীন ভারতে কোন পক্ষ সমর্থন করেননি বা সমর্থন করতে পারেননি । যদি সেরকমটা না হতো , যেই উনি কোন দল সাপোর্ট করতেন বা মন্ত্রীত্ব গ্রহন করতেন ওমনি বিরোধী দলগুলো উনার খারাপ দিকটা দেখতে পেতেন ।

   রিমি এই কথার প্রাসঙ্গিকতা কিছুই বুঝতে না পেরে ভ্রুতে সামান্য ভাঁজ তুলে চুপ করে শুনতে থাকে । জোভান বলে চলে ,

   - মহানায়িকা সুচিত্রা সেন কেন নিজেকে আত্মগোপন করেছিলেন জানিস কি ? উনি চেয়েছিলেন উনার বয়সজনিত ভগ্নরূপ কাউকে না দেখাতে । উনি চেয়েছিলেন উনার ঝলমলে হাসিমুখটা নিয়েই দর্শকদের মনে চিরকাল বেঁচে থাকতে । আসলে কি বলতো এই নেতাজীই বল আর সুচিত্রা সেনই বল উনারা সাফল্যের শিখরে পৌঁছেই হারিয়ে গিয়েছিলেন বলেই আমাদের মনে অমর হয়ে রয়েছেন ! তেমনি আমিও চেয়েছিলাম আমাদের প্রেমকে সারাজীবন অমর করে রাখতে । আমরা সম্পর্কটাই যতো বেশী জড়াবো , নিজেদের যতো বেশী করে জানব ততোই কিন্তু শূন্যের দিকে এগোব । একসময় তুইও হয়তো আমাকে বিয়ে করতে চাইবি । কিন্তু আমি কি মনে করি জানিস ? মুখে যে যাই বলুক না কেন বিয়ে করা মানেই কিন্তু প্রেমের মৃত্যু ! যারা 'সুখে আছি , সুখে আছি ' বলে হাসিমুখে বিজ্ঞাপন দেয় তারা আসলে সবাই অভিনয় করে । আমাদের প্রেমটাকে অমর করে রাখতে নিজেদের এবার সরে আসা উচিত । এটাই সঠিক সময় । মনে করিস না এই ব্রেকআপের কষ্ট শুধু তুই একাই পাচ্ছিস ! আমিও অনেক কষ্ট পাচ্ছি । তুই হয়তো জানিস না সেদিনের পর থেকে হাতে নতুন ব্লেড নিয়ে আমি রাতের পর রাত জেগে জেগে কাটিয়েছি । 

  একটু ম্লান হেসে নিয়ে বলে , 

  - শিরাতে সামান্য ছোট্ট একটা প্যাঁচ টানার কথা কতবার ভেবেছি , কিন্তু সাহসে কুলায়নি । 

   রিমি শিউরে ওঠে । মুখে ভাষা জোগায় না । এ কাকে ভালোবেসেছে সে ! কাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছে ! যদি জোভান অন্যকাউকে ভালোবেসে তাকে অবহেলা করতো তাহলেও হয়তো সে মেনে নিতে পারতো । কিন্তু তা তো নয় ! ও নিজেও কষ্ট পাবে , রিমিকেও কষ্ট দেবে এ কেমনধারা ভালোবাসা ! কেমনধারা প্রেম ! জোভান আরো কিছু বলার আগেই এক পাহাড়ি পাখির ডাকে ডোরবেল বেজে ওঠে । রিমি উঠে যায় দরজা খুলতে । কিছু খাবার হোম ডেলিভারীর অর্ডার দিয়েছিল সে । দাম মিটিয়ে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিচেনে ঢোকে । কিছুক্ষণ পরে প্লেটে করে খাবার সাজিয়ে নিয়ে ফিরে আসে ।

  - হাত ধুয়ে আয় । তোর ফেভারিট মশালা কুলচা আর চিলি চিকেন আনিয়েছি । 

  প্রসঙ্গান্তরে যেতে পেরে জোভানও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে । সুস্বাদু খাবারের গন্ধ নিতে নিতে লাফিয়ে নামে বিছানা থেকে । 


  অনেক রাতে জোভান টলতে টলতে নিজের ঘরে ফেরে । শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে ওর । বিছানায় শরীরটা ছুঁড়ে দিতেই কিছুক্ষনের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় । 

  সকালে মোবাইলে ডাটা অন করতেই রিমির পাঠানো অনেকগুলো মেসেজ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে । সেগুলো দেখেই জোভানের পায়ের তলার মাটি সরে যায় । একটা ভিডিও ক্লিপিংসে দেখা যাচ্ছে সে চেতন আর অচেতনের মাঝে নগ্নভাবে বিছানায় পড়ে আছে । আর একটা হিলহিলে নারীশরীর উল্টোদিকে মুখ করে একটু একটু করে তার পা বেয়ে উপর দিকে উঠে আসছে । অনেকগুলো মেসেজের একটাতে লেখা কিভাবে রিমি চিলি চিকেনে ওষুধ মিশিয়ে জোভানকে বেঁহুশ করে ফেলেছিল । সবার শেষে লেখা , ' আমিও তোরই মতোন , বরং তোর থেকেও আরো বেশী গভীর করে আমাদের প্রেমটাকে অমর করে নিলাম । আমাদের আর দেখা হবেনা কখনোই । আমাদের মাঝে আর কেউ আসবেওনা কোনোদিন । যদি ভুল করে তোর জীবনে কেউ এসে পড়ে , তো সেই ভুল ভাঙ্গানোর জন্যই ভিডিও রেকর্ডিং করা । ভুল বুঝিস না । ভালো থাকিস । '


   


   

   

   

   

   



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance