Abhijit Das

Drama

0.8  

Abhijit Das

Drama

শাস্তি

শাস্তি

4 mins
18.2K


বাবুঘাট ছাড়িয়ে ট্যাক্সি ছুটেছে প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে এমন সময়ে রাই-এর আবদার "চলো না আজ ওপারের কোনো ঘাটে গিয়ে বসি, কোনো দিনও যাইনি ওই দিকটায় I" গত দশ মিনিট ধরে লক্ষ্য করেছি ও চুপ করে কি যেন ভাবছে I এই ব্যাপারটা আমার খুব পরিচিত I

- কিন্তু ওপারে বসলে যে সূর্যাস্ত দেখা যাবে না, সূর্য তো পিছনে থাকবে I বললাম আমি I

- সে হোক I ওপার থেকে কলকাতাকে দেখবো I বলল রাই I

তাই ট্যাক্সি ঘুরিয়ে ব্র্যাবোর্ন রোড I দুদিন আগে যখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবার জন্মদিনে কি চাই বলেছিলো বিকেল বেলায় দুজনে গঙ্গার ঘাটে বসে জলে পা ডুবিয়ে সূর্যাস্ত দেখবো I

- কিন্তু পরশু তো আমার অফিস আছে, শনিবার চলো I

- সে আমি জানি না I আমি ওই দিনই যাবো I

রাইকে না বলার সাধ্য আমার নেই I তার উপরে জন্মদিনের আবদার বলে কথা I

হাওড়া স্টেশন ছাড়িয়ে ফোরশোর রোড ধরে আধ মাইল মতো গেলে একটা ছোট ঘাট আছে , বেশ পুরনো I মাস খানেক আগে যখন এই দিকটায় একা এসেছিলাম তখন এই ঘাটটা আমার চোখে পড়ে, তাই আজ এই ঘাটটার কথাই প্রথম মাথায় এলো I

ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে পিছন ফিরে দেখি রাই ঘাটের সিঁড়ি ধরে বেশ কিছুটা নেমে গেছে I বুঝলাম এই ঘাটটা ওর বেশ পছন্দ হয়েছে I পুরনো ইঁট, বৃদ্ধ অশ্বত্থ এসব আমার মতোই ওকেও টানে I তখন ভাঁটা চলছে তাই জল অনেক নিচে, কাজেই জলে পা ডুবিয়ে বসার সুযোগ নেই I তাই যতটা সম্ভব জলের কাছে নেমে ঘাটের সিঁড়িতে বসলাম I মিনিট কুড়ি হয়ে গেলো ও কোনো কথা বলেনি , শুধু একটু আগে আমার আরো কাছে সরে এসে আমার ডান হাতটাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসেছে I আমিও চুপ, এই সময় গুলোতে আমি ওকে বিরক্ত করি না I আরো আধ ঘন্টা কাটলো এভাবে I দুজনেই চুপ করে জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছি I মুখে কথা নেই কিন্তু তবু কথা হচ্ছে I সান্নিধ্য তখন ভাষাকে ব্রাত্য করেছে I একেই বোধ হয় বলে বাঙ্ময় নীরবতা I

এ ঘাটে লোক বেশি আসে না, পাশেই নতুন ঘাট হয়েছে সেখানেই বেশি ভিড় I এতক্ষনে মাত্র দুটো প্রাণীকে আসতে দেখেছি এই ঘাটে I একটা কুকুর এসেছিলো জল খেতে আর একটু আগে একজন সাধু এসেছিলেন স্নান করতে I ঘাটের পাশেই একটা মন্দির আছে I আসার সময়ে ওখানেই ওনাকে দেখেছি, প্রদীপের সলতে বানাচ্ছিলেন I

দিনের আলো কমছে I একটা নৌকা এসে ভিড়লো ঘাটে I আমি হাত নেড়ে মাঝিকে বলতে যাচ্ছিলাম যদি আমাদের একটু ঘুরিয়ে আনে I রাই আঙ্গুল দিয়ে আমার হাতে একটা চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দিলো দরকার নেই I অন্য কোনো ছুটির দিন হলে হয়তো দুজনে সিনেমা দেখতে যেতাম বা কোনো শপিং মলে কেনা কাটা করতে যেতাম I কিন্তু আজ তো অন্য কোনো দিন নয়, আজ তোমার দিন I

এতক্ষণ চারপাশটা বেশ নিস্তব্ধ ছিল, সেটা ভাঙলো হেমন্ত মুখার্জির গলার আওয়াজে I ঘাটের পাশের চা- এর দোকানে কে যেন একটা রেডিও চালালো, "...তারপরে পৃথিবীতে আঁধারের ধুপ ছায়া নামবেই, মৌমাছি ফিরে গেলে জানি তার গুঞ্জন থামবেই.." দেখলাম গানটা শুনে রাইও গুন্গুন্ করছে "সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো, গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নের দেশ তো, বেশ তো.." I

এপার থেকে দেখে বোঝা যায় কলকাতা কত পাল্টে গেছে I প্রাসাদ নগরীর স্কাই লাইন পাল্টে দিয়েছে হাই রাইজ I আগে এপার থেকে জিপিও-র গম্বুজ, সেইন্ট জোন্স চার্চের চূড়া পরিষ্কার দেখা যেত I তারা আস্তে আস্তে আড়ালে চলে যাচ্ছে, নতুন কে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে I ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় ছ'টা বাজে I পাশের লঞ্চ ঘাটে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে I দিনের শেষে সবাইকে ঘরে ফিরতেই হয় I অন্য কোনো দিন হলে এতক্ষনে আমিও হাতের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে, ল্যাপটপের ব্যাগটা পিঠে ফেলে অফিস বাস ধরার জন্য ছুটতাম I তোমার কাছে ফিরবো বলে I কিন্তু আজ তো অন্য কোনো দিন নয়, আজ তোমার দিন I আজ তুমি আমার কাছেই আছো I তাই তো আজ আর আমার কোথাও ফেরার তাড়া নেই I কাছের কোনো বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে এসে জানান দিলো সন্ধ্যা হয়েছে I ঘাটের পাশের মন্দির থেকেও ঘন্টার আওয়াজ আসছে I কিছু পরেই পাশের বড় ঘাটে গঙ্গারতি শুরু হল I এঘাট থেকেই দেখা যায় I পাশের ঘাট থেকে কেউ একটা গঙ্গাপ্রদীপ ভাসিয়েছে, সেটা ভাসতে ভাসতে এই ঘাটে এসেছে I আমরা দুজনেই ওটার দিকে তাকিয়ে আছি I আমার হঠাৎ কেমন যেন মনে হল, এ তো এই প্রথম নয় I আমি, রাই আর গঙ্গা এই 'ত্রহস্পর্শ' আগেও বহুবার ঘটেছে I হাজার বছর ধরে বয়ে চলা এই জলধারা আগেও আমাদের এভাবেই বসে থাকতে দেখেছে কখনো গঙ্গোত্রী, কখনো এলাহাবাদ, আবার কখনো হয়তো বারাণসীর কোনো ঘাটে I শুধু নাম, স্থান আর জীবন পাল্টে গেছে I কিন্তু এই জন্মে তো এমনটা হওয়ার কথা ছিল না I সেই যে তুমি বলেছিলে, "আজ আমাকে অবহেলা করছ, কিন্তু একদিন ঠিক আমার মূল্য বুঝবে I" এই স্মৃতি তো মৃত্যুর সঙ্গে মুছে যায়নি, এই জীবনেও স্পষ্ট মনে আছে I এই জন্মেই তো আমার সেই দাম দেওয়ার কথা তোমাকে কাছে না পেয়ে I বরাবর তো এই ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছি I তবে কি আজ আমার শাস্তি শেষ হল ? তাই তুমি আজ আমার কাছে ফিরে এসেছো ?

গঙ্গাপ্রদীপটা ভাসতে ভাসতে ঘাটের সিঁড়িতে আটকে গেছে I আমি গিয়ে জলে ঠেলা দিয়ে সেটাকে স্রোতে ফিরিয়ে দিলাম, আবার সেটা চলতে শুরু করলো I ফিরে এসে দেখি রাই নেই I এদিক, ওদিক, মন্দির চা-এর দোকান, বড় ঘাট কোত্থাও নেই I পাগলের মতো খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না I

একটা প্রচণ্ড মেঘের গর্জনে ঘুম ভাঙলো I বুঝলাম চোখের জলে বালিশটা ভিজে গেছে আর বাইরে বসন্তের রাত তখন ভিজছে অকাল শ্রাবণ ধারায় I


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama