Abhijit Das

Drama Fantasy

3  

Abhijit Das

Drama Fantasy

মুশকিল আসান

মুশকিল আসান

7 mins
11.6K


রাতে খাবার টেবিলে বসে বার বারই আড়চোখে বাবার মুখের দিকে দেখছিলো সন্তু I আসলে বাবার মুড টা কেমন আছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিলো I কি একটা বলবে বলে অনেকক্ষণ ধরে সুযোগ খুঁজছিলো I আর ঠিক তখনই একটা ফোন আসায় বাবা উঠে গেলো ফোন টা ধরতে I "যা: সব ভেস্তে গেলো" ভেবে মুখটা একটু ব্যাজাড় করে আবার খাবার দিকে মন দিলো I কিন্তু কানটা পড়ে আছে বাবার ফোনের দিকে I মিনিট খানেক বাদে ফোন সেরে বাবা ফিরে এলেন I সন্তু আবার তাকালো বাবার মুখের দিকে I বাবার মুখে এখনো একটা হালকা হাসি লেগে আছেI "একদিকে ভালোই হয়েছে" মনে মনে ভাবলো সন্তু I

- বাবা, আমাকে নতুন ভিডিও গেমটা কবে কিনে দেবে ? বললো সন্তু I কিন্তু সুযোগ বুঝে কথা টা বললেও বিশেষ সুবিধা হলো না I

- এই তো গত সপ্তাহে তোমার বার্থ ডে তে বাই সাইকেল কিনে দিলাম I এখন আবার ভিডিও গেম কেন ?

- "রোহনও তো কিনেছে" কাঁদো কাঁদো গলায় বললো সন্তু I

এবার রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সন্তুর মা I

- গত ইউনিট টেস্টে রোহন ফার্স্ট হয়েছে সেটা মনে আছে তো ? তোমার জন্য রোহনের মায়ের কাছে আমাকে কত লেকচার শুনতে হয়েছে তুমি জানো ?

- আমিও তো সেকেন্ড হয়েছি, তাও শুধু তিন নম্বরের জন্য I বলতে যাচ্ছিলো সন্তু I

- ব্যাস ব্যাস আর তর্ক কোরো না I তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বাকি চ্যাপ্টার গুলো রিভিশন করতে বোসো I মনে রেখো রোহনের মায়ের মুখ টা কিন্তু এবার তোমাকেই বন্ধ করতে হবেI এই বলে সন্তু কে মাঝ পথেই থামিয়ে দিলেন মা I

"আচ্ছা ঠিক আছে দাদু ভাই, আমি কিনে দেব তোমাকে" পাশের ঘর থেকে বললেন সন্তুর ঠাম্মা I শুনে একটু হাসতে যাচ্ছিলো সন্তু কিন্তু মায়ের কথা শুনে সে হাসি আবার মিলিয়ে গেলো I

- না না মা, একদম প্রশ্রয় দেবেন না I স্কুলে যার কাছে যা দেখবে তাই চাই I আর মা বাবারাই বা কি ? সব কিছু বাচ্চাদের ব্যাগে ভরে স্কুলে পাঠানোর কি আছে বুঝি না I কিভাবে নিজেদের স্টেটাস দেখাবে তাই ভাবছে সারাদিনI

স্টেটাস-এর কি বুঝলো সন্তু কে জানে? কিন্তু অগত্যা গিয়ে ঢুকতে হলো পড়ার ঘরে I ইংরেজি বইটা খুলে রবার্ট ব্রূসের গল্পটাই আবার পড়তে শুরু করলো I অনেক বার পড়া কিন্তু অন্য গল্প গুলোর থেকে এটা পড়তেই ওর বেশি ভালো লাগে I কি আর করবে টিনটিন পড়ার তো জো নেই তাই রবার্ট ব্রূসই সইI

ঢং ঢং করে বারোটার ঘন্টা পড়লো ঘড়িতে I পিছন ফিরে তাকিয়ে সন্তু দেখলো মা বাবার ঘরের আলো নিভে গেছে I চার দিকে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে ভীষণ রাগ হলো ওর I "ধুর ভাললাগে না বলে" বইটা দিলো বন্ধ করে I ঠিক তখনি ঠাম্মা ঢুকলেন সন্তুর ঘরেI

- কি দাদু ভাই, এখনো ঘুমোওনি তুমি ?

- দেখো না ঠাম্মা, সবই আমার পড়া I তবুও মা খালি বলবে আবার রিভিশন করো I কি মুশকিল বলো তো I

- "তাই তো" বলে সায় দিলেন ঠাম্মা I "কিন্তু মুশকিল আসান এখন কোথায় পাই বলো তো দাদু ভাই ?”

- মুশকিল আসান কি ঠাম্মা ? কৌতূহল ভরে জিজ্ঞেস করলো সন্তু I

- সে অনেক কথা I বলবো ক্ষণ কালকে I

- কাল না আজই বলতে হবে I জেদ ধরলো সন্তু I

- এত রাতে ? মা শুনতে পেলে কিন্তু আমাদের দুজনকেই খুব বকবে I

- মা শুনতে পাবে না I মা তো কখন ঘুমিয়ে পড়েছে I গলাটা একটু নামিয়ে বললো সন্তু পাছে ওর গলার আওয়াজে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়I

- আচ্ছা ঠিক আছে I তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি গল্প বলছি I বলে গল্প শুরু করলেন ঠাম্মা I

-তখন আমি অনেক ছোট…

-আমার থেকেও ছোট ? জিজ্ঞেস করলো সন্তু

- না অত ছোটও না I তোমার থেকে একটু বড় I তখন আমরা থাকতাম মুর্শিদাবাদে I আমাদের বাড়িতে অনেক আম গাছ ছিল I আর গরম কালে সব আম পেকে গাছ গুলো হলুদ হয়ে থাকতো I তো একদিন কি হয়েছে বিকেল বেলা আমি, পলটু, মনা, বুড়ি , নিতাই সব জড়ো হয়েছি আম বাগানে খেলবো বলে I কি খেলবো ভাবছি সবাই I কে যেন একটা বুদ্ধি দিলো, ওই যে বাগানের এক কোণে সব চেয়ে ছোট যে আম গাছ টা আছে, ওটাতে উঠে আম পেড়ে আনতে হবে I যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সবার থেকে বেশি আম পেড়ে আনতে পারবে সে-ই জিতবে I আমরা তো সবাই হৈ হৈ করে রাজি হয়ে গেলাম I

- তুমি গাছে উঠতে পারো ঠাম্মা ?

- এখন কি আর পারি ? তখন তো বয়স কম ছিল আর আমরা খুব দুষ্টু ছিলাম I কথায় কথায় গাছে উঠতাম নামতাম I তো তারপর তো শুরু হলো একে একে আম পাড়া I ওরা তো সব এক এক করে যাচ্ছে আর টপাটপ আম পেড়ে নিয়ে আসছে I আমার পালা পড়েছিলো সবার শেষে I গাছে ওঠার আগে দেখে নিলুম এখনো পর্যন্ত পলটু সব থেকে বেশি আম পেড়েছে - ন'টা I তার মানে দশ টা পাড়তে পারলেই আমি জিতে যাবো আর সব আমও আমার হয়ে যাবে I তাই জয় মা বলে উঠে পড়লাম গাছে I কিন্তু উঠে তো হাতের কাছে আর আম পাই না I সব আম ওরা পেড়ে নিয়েছে I এদিকে সময়ও চলে যাচ্ছে I এই ডাল ওই ডাল হাত বাড়িয়ে ন'টা আম পেয়েছি আর এক খানা খুঁজছি I হঠাৎ দেখি পাতার ফাঁকে লুকিয়ে আছে একটা আম I যেই না দেখেছি ওমনি পেড়ে ডাল থেকে দিলুম এক লাফ I কিন্তু মাটি তে পড়তেই পা টা এমন মচকে গেলো যে আমি আর কিছুতেই উঠতে পারলাম না I একে তো পায়ের ব্যাথা তার উপর বাড়ি গেলে মায়ের বকুনি, এই ভেবে আমি তো ভয়েই কাঁটা I আমি তো বেশ বুঝতে পারছি এক সপ্তাহের আগে কিছুতেই এই ব্যাথা সারবে না I এদিকে দুদিন বাদে মামার বিয়ে তাই পর দিনই আমাদের মামার বাড়ি যাওয়ার কথা I মা বোধ হয় আমাকে এক রেখেই চলে যাবে, এসব ভেবে আমার ততক্ষনে কাঁদো কাঁদো অবস্থা I এমন সময়ে পাশের রাস্তা দিয়ে একজন ফকিরবাবা যাচ্ছিলেন I আমাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছে খোকি, কাঁদছো কেন ?" এই ফকিরবাবা কে আমি আগেও দেখেছি গ্রামে I তাই ভয় না পেয়ে বললাম যে গাছ থেকে নামতে গিয়ে পা মচকে গেছে, মা জানলে খুব বকবে I তারপর উনি হাঁটু গেড়ে বসলেন আমার পাশে আর জিজ্ঞেস করলেন "কৌন সা প্যাড় ?" আমি ডান পা টা এগিয়ে দিলাম I উনি পা টা ধরে বললেন, "মামুলি চোট আছে, অভি ঠিক হয়ে যাবে" শুনে তো আমি অবাক I এক সপ্তাহ, আচ্ছা পাঁচ দিন, আচ্ছা কিছু না হলেও অন্তত তিন দিন তো ব্যাথা থাকারই কথা I আর ইনি বলছেন এখনই ব্যাথা সেরে যাবে I আমি মনে মনে এসব ভাবছি এমন সময়ে হঠাৎ ফকির বাবা পা টা ধরে দিলেন এক টান I এমন ব্যথা লাগলো যে আমি ও মাগো বলে চিৎকার করে উঠলাম I কিন্তু তার পরেই বুঝলাম ব্যাথা কম I আস্তে আস্তে পা টা নাড়ালাম সাহস করে, দেখি না ব্যাথা নেই I তারপর সাহস করে উঠে দাঁড়ালাম I মনেই হলো না একটু আগেও পায়ে ব্যাথা ছিল I আমি তো অবাক আর তার সাথে পলটু, বুড়ি ওরাও সব হাঁ I ফকির বাবা আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন "যা অব দৌড়কে ঘর চলে যা" বলে চলে গেলেন I সেদিন আর মাকে কিছু বললাম না I বেশ কিছুদিন পরে বলেছিলাম I শুনে মা বলেছিলো উনি মুশকিল আসান I কোথায় থাকে কেউ জানে না, মাঝে মাঝে আসেন আবার কোথায় উধাও হয়ে যান"

হঠাৎ ফ্ল্যাট-এর দরজায় টোকা I আওয়াজ শুনে সন্তু গিয়ে দরজা খুললো I কালো আলখাল্লা পড়া একজন লোক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, বেশ লম্বা চওড়া চেহারা I এমন লোককে সন্তু আগে কখনো দেখেনি I একগাল হেসে সে জিজ্ঞেস করল, "কি খোকাবাবু কাল তুম্হার পরিকসা আছে না ? "

- হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি করে জানলে ?

- পরিকসার কোয়েশ্চেন পেপার চাই তুম্হার ? বলে ঝোলা থেকে একটা কাগজ বের করে সন্তুর দিকে এগিয়ে দিলো লোকটা I

সন্তু কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখলো, এ তো তার কালকের ইংলিশ টেস্টের কোয়েশ্চেন পেপার I যদিও সব গুলো প্রশ্নই সে পারবে, কিন্তু এই লোকটা এটা পেল কোথা থেকে ?

- এই সব তো আমার পড়া I লোকটাকে বলল সন্তু

- সে তো হামি জানি খোকাবাবু I তুমি তো আচ্ছা বাচ্চা আছো I এবার তাহলে হামি আসি I বলল লোকটা I

- কিন্তু তুমি কে আর এটা তুমি পেলেই বা কোথা থেকে ?

লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিলো I পিছন ফিরে মুচকি হেসে কি যেন একটা বলল সন্তুকে I কিন্তু সে কথা সন্তুর কানে এলো না I তার বদলে কানে এলো মায়ের গলার আওয়াজ, " সন্তু, সন্তু এবার উঠে পড় I স্কুলের জন্য রেডি হতে হবে I আজ না তোর টেস্ট আছে I "সন্তুর ঘুমটা ভেঙে গেলো I এতক্ষন কি তাহলে সে..হ্যাঁ স্বপ্ন দেখছিলো, বুঝতে পারলো সন্তু I ঠাম্মার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল I


ঘড়িতে ন'টার ঘন্টা পড়লো I বাবা তৈরি হয়ে নিচে নেমে গেছে I সন্তু জুতো পড়ছে I বাবার গাড়ির হর্ন শুনে মায়ের হাত থেকে ওয়াটার বটল টা নিয়ে এক ছুট্টে বেড়িয়ে গেলো I ঠিক তখনি আবার দরজা দিয়ে মাথাটা ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে সামনে বসে থাকা ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করল "ঠাম্মা মুশকিল আসান এখন আর আসে না কেন ?" বলেই আবার এক ছুটে বেড়িয়ে গেল।


সেই স্বপ্নে দেখা লোকটার দেওয়া প্রশ্ন সন্তুর পরীক্ষায় এসেছিলো কিনা আমরা জানি না I কিন্তু সন্তুর ওই যে প্রশ্ন, মুশকিল আসান আজ আর আসে না কেন ? এটা শুনে ঠাম্মা কি ভাবলেন সেটা হয়তো অনুমান করা যায় I পুরোনো দিনের মানুষের জীবনে আড়ম্বর কম ছিল কিন্তু সারল্য ছিল অনেক বেশি I মানুষের অর্থ সম্পত্তির অভাব ছিল কিন্তু জীবনে শান্তির অভাব ছিল না I তখন মানুষের সমস্যা গুলোও ছিল আজকের থেকে অনেক বেশি সহজ I আর আজ আমরা যত বেশি সভ্য হয়েছি, যত উন্নত হয়েছি, সমস্যা গুলোও তত বেশি কঠিন হয়ে আমাদের ঘিরে ধরেছে I সমস্যা গুলো আজ এতই জটিল যে সেগুলো সমাধান করার সাধ্য হয়তো মুশকিল আসানদেরও নেই I তাই তারা আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো I ঠাম্মা একটু ভাবলেন তারপর একটু হেসে দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন "দুগ্গা দুগ্গা" I


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama