শুকনো গোলাপ
শুকনো গোলাপ
দেখতে দেখতে কেটে গেলো প্রায় আঠেরো দিন পৌলমী বাড়ির বাইরে যায় নি । কি করেই বা যাবে চারিদিকে মহামারী যে ভাবে ছড়িয়ে পরেছে তার উপর সরকারের কড়া নির্দেশ । বাড়িতে বসে সারাদিন মোবাইল ফোন ঘেঁটে আর টিভি দেখে এক রকম বোরিং জীবন হয়ে গেছে তার । কবে যে সব ঠিক হবে আর আবার সে স্কুলে জয়েন করতে পারবে । ছোটো ছেলে মেয়ে গুলো ওর এক মাত্র বেঁচে থাকার রসদ । জীবনে যখন সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিলো যখন মনে হয়েছিলো এই জীবন টাই সে রাখবে না, ঠিক তখনই ওর জীবনে যেনো ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো নেমে আসে বকুল পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার চাকরি টা ।
ব্যালকনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবছিলো পৌলমী ঝমঝিময়ে বৃষ্টি এলো । হঠাৎ এমন বৃষ্টি দেখে সে বললো,
- বৃষ্টি!! অকাল শ্রাবণ ।
ব্যকনির দেওয়াল বেয়ে উঠে এসেছে বাগান বিলাস গাছের একটা ডাল । তার মধ্যেই টুপটাপ করে বৃষ্টির জল পরছে আর সেটা ঠিক যেনো লজ্জাবতী প্রেমিকার ঠোঁটের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে ।
এই তো আজও মনে হয় সেদিনের কথা সৈকত যখন প্রথম ওর ঠোঁট ছুঁয়ে গেছিলো । সেই প্রথম পুরুষের শরীরের স্পর্শ এতো নিবির ভাবে পেলো সে । সৈকতের শরীরের পুরুষালি গন্ধ মুহূর্তে মাতাল করে দিয়েছিলো পৌলমী কে ।
ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তেই গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো ওর।
সব স্বপ্ন গুলো কেমন যেনো তাসর ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছিলো ।
মনে পরে সৈকত ওর হাত ধরে বলেছিলো,
- আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না পৌলমী । কথা দাও কোনো দিন ছেড়ে যাবে না ।
হ্যাঁ পৌলমী কথা রেখেছে কিন্তু সৈকত রাখে নি। সে ছেড়ে গেছে। সে সুখে আছে অন্য কারো বুকে মাথা রেখে । আর পৌলমী আজও তার স্মৃতি আগলে পরে আছে বছরের পর বছর ধরে ।
আজও ওর ডাইরি জুড়ে শুধু সৈকতের স্মৃতিরা আনাগোনা করে ।
হঠাৎ পৌলমীর মনে পরল সত্যিই তো কদিন পুরনো বইয়ের তাক আর ডাইরি টা দেখা হয়নি । ধুলো জমেছে বইয়ের তাকে । তবে ভেতরের উপন্যাস আর গল্প গুলো ঠিক ওর ক্ষতের মতোই সতেজ।
সঞ্চয়িতার নীচ চাপা পরে থাকা কালো মলাটের ডাইরি টা বের করে ধুলো ঝেড়ে নিলো পৌলমী ।
প্রথম পাতা খুলতেই চোখে পরলো গোটা গোটা হরফে লেখা তেরো লাইনের একটা কবিতা ।
বাকিটা টা পরতে গিয়েই কখন যেনো ওর চোখের কোন টা ভিজে এসেছিলো নিজের অজান্তেই ।
পাতার পর পাতা উল্টে যেতেই একটা পাতাতে চোখ আটকে গেলো পৌলমীর । একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ডাইরির মাঝ খানে ঠিক পেজ মার্কর মতো রাজত্ব করছে । এই তো সেই গোলাপ যেটা দিয়ে প্রথম সৈকত বলেছিলো ভালোবাসি । আর আজ ও চলে যাওয়ার এতো বছর পরও সেটাকে যত্ন করে রেখেছে সে । এতদিনের ব্যস্ত জীবনে সে ভুলেই গেছিলো আজও একটা মুছে যাওয়া অধ্যায় ওর জীবনে পুরোপুরি মুছে যায় নি । শুকনো গোলাপ টা হতে নিয়ে সে দাড়িয়ে ছিলো জানলার কাছে । বাইরে তখন মুষল ধারায় বৃষ্টি । আজ প্রায় সাত বছর ধরে এটা একটা না হওয়া প্রেমের গল্প কে বয়ে নিয়ে চলেছে । চোখের সামনে অতীতের স্মৃতির গুলো ভেসে উঠছে পর পর। এমনকি জীবনের সেই সব থেকে কষ্টের দিনের ছবি গুলোও ফাঁকি দেয় নি তার স্মৃতির ঘর কে । আজও তার বোবা হৃদয় জুড়ে রক্ত ক্ষরণ হয় প্রতি নিয়ত।
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পৌলমীর ফোন টা বেজে উঠলো ।
পলাশ ফোন করেছে । হ্যাঁ পলাশ এই তো এই মানুষ টা র সাথেই তো সে খুব শীঘ্রই নতুন বাধনে বাঁধা পরতে চলেছে । বিয়ে টা বাড়ির থেকে দেখে শুনে হলেও পলাশ অনেকটাই পৌলমীর মনের মতো । তবুও আজ অবধি তাকে মনের পুরোটা দিতে পারে নি পৌলমী ।
ফোনটা রিসিভ পৌলমী বললো,
- হ্যাঁ বলো...
- তোমাদের ওই দিকে বৃষ্টি হচ্ছে?
- মুষল ধারায়!
- হ্যাঁ আমাদের এই দিকেও । অফিস থেকে বেরোতে গিয়ে আটকে গেছি ।
- বৃষ্টি থামলে বেরিও । এটা প্রথম বৃষ্টি কিনা ভিজলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে ।
- এই প্রথম তুমি আমাকে আমার যত্ন নিতে বললে । ভালো লাগলো ।
পলাশের গলায় আবেগ ।
সত্যিই তো কোনদিন সে ভাবে ছেলেটার কথা ভাবেই নি পৌলমী ।
সে বললো,
- হ্যাঁ হয়েছে । ওতো সেন্টু খেতে হবে না ।
পলাশ হেসে বললো,
- যাই হোক কি করছিলে?
- আর বলো না এমনিতে তো সময় হয় না । এই এতো দিনে লক ডাউনে একটু সময় হলো । তাই পুরনো বই গুলো একটু ঝেড়ে মুখে রাখছি । ঘর থেকে আবর্জনা সাফ করছি ।
কথা টা বলেই হাতের ওই শুকনো গোলাপ টা দোতলার জানলা থেকে ফেলে দিলো পৌলমী ।
আর মনে মনে বললো,
" আর মনের ঘরের আবর্জনা টাও "