পুরোনো মলাট
পুরোনো মলাট
- দিদি এই মাসের মাইনে টা কি একটু আগাম পাওয়া যাবে?
একটু ইতস্তত করে কাঞ্চন, মালকিন মাধবী দেবী কে বলল।
পান চিবোতে চিবোতে ব্যানার্জী গিন্নি উত্তর দিলো,
- সবে তো সাতাশ তারিখ এতো সাত তাড়াতাড়ি মাইনে চাইলে তো হবেনা বাপু ।
- না ইয়ে মনে বলছিলাম।
- না না এখন ওই ঘ্যান ঘ্যাণ কোরো না। কাজ সারা হয়ে গেলে এসো দিকি ।
....................
- মা মাইনে পেলে আজ?
ক্লাস নাইনের ছোট্ট মেয়ে পূরবী তার মাকে জিজ্ঞেস করলো ।
ঝাঁঝিয়ে উঠে কাঞ্চন বললো,
- অনেক পড়াশুনা করে আমাকে উদ্ধার করেছো। বিদ্যা আমার মাথায় থাকুক আমি আর পারছি না খরচ জোগাতে । ওই বই খাতা চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ফেলো। সংসার চালাবো না তোমার পড়ার মাইনে দেবো । তোমার বাপ নেশা করে সব টাকা উড়িয়ে আসে । দু বেলা যে দুমুঠো খেতে পারছো এটাই অনেক ভাগ্গী । লোকের বাড়ির মুখ ঝামটা শোনো তারপর বাড়িতে এসে এনাদের ফাই ফরমাস খাটো । জীবন টা আমার শেষ হয়ে গেল ।
বলতে বলতে কাঞ্চন কেঁদে ফেললো ।
পূরবী কিছু বুঝে উঠতে পরলো না । নেশাখোর বাবার গাল মন্দ সে প্রায় শোনে সেটা তার গা শওয়া হয়ে গেছে কিন্তু মা বকলে বুকের মধ্যে কেমন যেনো ব্যাথা করে ওঠে। ছোটো দর্মার বেড়ার ঘর থেকে ছুঁটে বেরিয়ে গেলো পূরবী ।
......................................
পরদিন কাজ সেরে বিকেল বেলা বাড়ি ফিরে কাঞ্চন দেখলো মেয়ে বারান্দায় বসে একটা জামা সুই সুতা দিয়ে সেলাই করছে ।
- কিরে আজ না সোমবার , তোর ইংরেজি স্যারের কাছে পড়া আছে । পড়তে যাস নি কেনো?
পূরবী কি বলবে বুঝতে পারছিলো না । তাই চুপ চাপ মাথা নিচু করে বসে রইল ।
কাঞ্চন আরও বার কয়েক জিজ্ঞেস করে উত্তর না পেয়ে চোটে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেয়ের চুলের মুঠি ধরে পিঠের উপর সজোরে কটা কিল চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
- আমি রক্ত জল করে খেটে তোমার পড়ার খরচ চালাচ্ছি আর তুমি পড়তে যাও না।
পূরবী মারের ব্যথায় কোকিয়ে উঠে বারান্দার কোণে সরে গেলো। আর হাত দিয়ে পিঠ ডলতে লাগলো ।
সারাদিন লোকের বাড়ির কাজ করে মনিবের খোটা শুনে শরীর মন দুটোই অবসাদে ভরে থাকে কাঞ্চনের। আর বাড়ি ফেরার পর রাগ টা এসে পড়ে মেয়ের উপর ।
কাঠের উনুনের ধারে থেকে একটা চ্যালা কাঠ তুলে কাঞ্চন বললো,
- বল কেনো যাসনি পড়তে। না হলে আজ তোর পিঠের ছাল তুলবো ।
পূরবী তখন ভয়ে সেদিয়ে গেছে কিন্তু মুখে কোনো জবাব নেই ।
তারপর চললো বেস প্রচন্ড লাঠির প্রহার। মেয়ের মুখ থেকে কোনো কথা সরছে না দেখে কাঞ্চন একটু বিস্মিত হলো। হঠাৎ করেই তার মনে পরল , স্যারের মাইনে দেওয়া হয় নি। এবার সে নিজের মনের দুঃখে অনুতাপ গুটিয়ে গেলো । মেয়ের কান্না ভেজা মুখ টা দেখে মায়ের বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনেই বললো,
" আহারে মেয়েটাকে শুধু শুধু মারলাম"
তারপর আদর করে মেয়েকে কাছে টেনে বলে,
- হ্যাঁ রে মাইনে না দিলে স্যার কি পড়তে যেতে মানা করেছে?
পূরবী ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,
- হ্যাঁ, আগের দিন সবার সামনে বলেছে । মাইনে না নিয়ে পড়তে আসলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
মেয়ের ভেজা চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে কাঞ্চনের চোখ টা ভিজে আসে । সে মেয়েকে আদর করে বলে,
- কাঁদিস না মা। কি করি বল কেউ তো আমাকে আগাম টাকা দিলো না । দেখি কাল পরশু জোগাড় করতে পারি কিনা ।
পূরবী মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
- মা তুমি একটু টাকা জোগাড় করে আমাকে একটা ইংরেজির মানে বই কিনে দাও আমি নিজে নিজেই পড়ব আমার স্যারের কাছে যাওয়া লাগবে না ।
- সেকি রে, তুই তো সব বই বাড়িতে পড়িস ওই ইংরেজি আর অংক স্যার টাই শুধু রাখা । আবার এখন ইংরেজি টাও নিজে পড়বি?
না না তা হয় না । যদি ফেল করিস ।
পূরবী চোখ মুছতে মুছতে বলে ,
- না মা ফেল করবো না দেখো আমি ঠিক পাশ করবো ।
শুধু একটা মানে বই কিনে দাও ।
...........................
- এই নে তোর ইংরেজি মানে বই। মলাট টা একটু পুরনো কিন্তু বই একদম নতুন আমি দেখেই এনেছি ।
এক গাল যুদ্ধ জয়ের হাসি হেসে পুরনো মলাটের বইটা পূরবী র দিকে এগিয়ে কাঞ্চন বললো।
- তুমি তো মাইনে পাও নি, তবে বই ...
- চৌ মাথায় পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম , এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে এই বই পেলাম , দরদাম করে ৫০ টাকা নিলো, আর একটুও কমালো না ।
- কিন্তু তুমি তো এখনও মাইনে পাও নি ।
- আরে আজ ওই ব্লাউজ হেম সেলাই করার ৫০ টাকা টা দিলো ঊষা দিদি। হাতে পেয়ে আর খরচ করি নি ।
- ৫০ টাকা!!
- হ্যাঁ রে ।
- তুমি ৫০ টাকার বই কিনে আনলে চৌ মাথা থেকে ওতো দুর গেলে কি করে ?
গামছা দিয়ে হাত পা মুছতে মুছতে কাঞ্চন বললো হেঁটে গেলাম আবার কি করে যাবো ।
না তারপর পূরবী আর একটা কথাও বলে নি । মাথা নিচু করে তাঁকিয়ে ছিলো পুরনো মলাট দেওয়া বই টার দিকে । হঠাৎ করেই দু ফোঁটা জল পরল বইয়ের উপর । পূরবী চোখে হাত দিয়ে অনুভব করল । চোখ টা ভিজে এসেছে ।