অনুভবে তুমি
অনুভবে তুমি
আমার খুব টেনশন হচ্ছে ! জানি না আজ কি হবে ? আমি পারবো তো বাবলী?
অখিলেশ ভ্রু কুঁচকে কাচুমাচু মুখ করে বললো মিশিকা কে ।
গোলাপ চারার টবের পাশে রাখা। সদ্য ফোটা চন্দ্রমল্লিকা গুলোর উপর হাত বুলিয়ে মিশিকা খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলো ।
- নিশ্চই পারবি । এতো গুলো বছরের পরিশ্রম কি বৃথা যাবে নাকি? আমার বিশ্বাস তুই পারবি।
- তোর কথা গুলো শুনে মনে একটা জোর পাই । তুই আমার শক্তি বাবলী।
- আচ্ছা হয়েছে ! নে এবার তৈরী হয়ে নে , সময় মতো পৌঁছাতে হবে তো ইন্টারভিউ সেন্টারে । আজ ফাইনাল ইন্টারভিউ আজ কোনো ভাবেই দেরি করা যাবে না।
......
আকাশী রঙের শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজারটা পরে ট্যাক্সির ব্যাক সিটে র গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে মিশীকা বললো,
- দারুন লাগছে তোকে ।
- তোর পছন্দের রং টা পরলাম ।
- হ্যাঁ এই রং টাতে তোকে দারুন মানায়।
গাড়ি গতি নিয়েছে , হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে ।
ট্যাক্সির ব্যাক সিটে বসে মিশিকার হাত ধরে অখিলেশ বললো।
- আজ তোকে আমার পাশে বড্ড দরকার ছিলো বাবলী।
- হুঁ সেই জন্যই তো আজ তোর সাথে যাচ্ছি, হুতুম প্যাঁচা ।
- তুই না থাকলে আমার যে কি হতো ।
খিল খিল করে হেসে মিশিকা বললো,
- কিচ্ছু হতো না, কিচ্ছু না!
- একদম ঠিক বলেছিস।
কথা বলতে বলতে অখিলেশ খেয়াল করলো, ট্যাক্সি ড্রাইভার লুকিং গ্লাস থেকে বিস্ময়ের চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে । বিষয় টা অখিলেশ কে বেশ অস্বস্থি তে ফেললো ।
মিশিকা ব্যাপার টা বুঝে দুই হাতে অখিলেশ র মুখ টা ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
- ওতো ভাবিস না শুধু ভাব আজকের পর তুই একজন সরকারি কর্মচারী হবি ।
চোখের কোনে একফোঁটা জল ছলকে গেলো অখিলেশের , কাপ কাপ গলায় বললো,
- হ্যাঁ রে বাবলী আমাকে আর শুনতে হবে না , বেকার ,অপদার্থ , কুলাঙ্গার এই জ্বালাময় শব্দ গুলো ।
বাবা মা কেও আর আত্মীয় স্বজনের সামনে মাথা নিচু করে থাকতে হবে না ।
অখিলেশের মাথায় হাত বুলিয়ে মিশিকা বললো,
- আমি বলেছিলাম না তুই পারবি । তোকে পারতে ই হবে । অখিলেশ ব্যানার্জী হেরে যেতে পারে না ।
শক্ত করে মিশিকার হাত টা চেপে ধরে অখিলেশ বললো,
- পৃথিবীর সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো , এমন কি একদিন রাতে মা আমার ঘরে এসে চোখের জল ফেলে বলে গেলো ,
"আর পারছি না বাবু তুই এবার একটা কিছু ব্যবস্থা কর, কিছু না পেলে ভ্যান চালা, মুচি গিরি কর, কিছু একটা কর । একান্নবর্তী সংসারে থেকে দিন রাত তোর জেঠিমার খোটা শুনতে হচ্ছে আমাকে । তোর বাবা রিটিয়ার করে গেছে দুই বছর হলো , তুই বেকার সেই নিয়ে দিন রাত আমি নিমের পাচনের মতো তোর জেঠি র কথা গুলো গিলছি ।"
সেদিন সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি ভেবেছিলাম গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পরি । ৩২ বছর বয়েস হয়ে গেলো এখনও মা বাবার উপর বোঝা হয়ে বসে আছি ।
কিন্তু সেই রাতে তুই আমাকে নিজের বুকে আগলে ধরে বেচে ওঠার নতুন সাহস জুগিয়েছিলি । তুই না থাকলে আমি আজ শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম বাবলী ।
.............
ইন্টারভিউ থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো অখিলেশ খুঁজে চলেছে মিশিকা কে । এই তো এই অফিসের গেটের কাছেই দাড়ানোর কথা ছিলো ওর ।
আজ অখিলেশের দুই চোখে শুধু খুশি আর সাফল্যের দীপ্তি । দূরে দাঁড়িয়ে সব টা দেখছে মিশিকা ।
- চল আজ বিকেল থেকে পুরো সন্ধ্যে টা আমরা কলকাতার রাস্তায় হাঁটবো ।
কথাটা বলে থেকে অখিলেশের পিঠে হাত রাখলো মিশিকা ।
- আমার ইন্টারভিউ খুব ভালো হয়েছে বাবলী। চাকরি টা কনফার্ম।
মিশিকা কে দু হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো অখিলেশ ।
- আমি
জানি !
অখিলেশ বললো,
- গঙ্গার ধারে যাবি?
- সেটা আর বলতে । যাবো ই তো।
........................
৪.১.২০২১
সকাল ১০.৪০ টা ,
কাল সারা রাত মিশিকার কোলে মাথা রেখে গল্প করেছে অখিলেশ তাই সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে । সকাল সকাল মা বক বক করতে করতে এক কাপ চা রেখে গেছে ওর ঘরে ।
" নবাব পূত্তুর এখনও ওনার ঘুম থেকে ওঠার সময় হলো না । চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেলো যে "
দক্ষিণের জানলা থেকে মিঠে রোদ এসে পরেছে বিছানায় ।
আলসেমি ভেঙে হাতে ফোন টা নিয়ে অখিলেশ চমকে উঠলো । আজ ৪ঠা জানুয়ারি মিশিকার জন্মদিন । ইসস কাল রাতে ওকে উইশ করা হয় নি । আজ সকালেও এতো বেলা হলো ।
- নিশ্চই খুব রেগে আছে, সেটাই স্বাভাবিক ।
নিজের মনেই বলে উঠলো অখিলেশ।
বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে এদিক সেদিক দেখলো অখিলেশ । ব্যালকনি, ছাদ না কোথাও নেই বাবলী।
কোনো রকমে ঠান্ডা চা গলায় ঢেলে , বাথ রুমে ঢুকলো সে। মিনিট পনেরো মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলো সাইকেল টা নিয়ে।
বাজার থেকে এক গোছা লাল গোলাপ আর একটা সাদা চন্দ্রমল্লিকা কিনে নিয়ে আসলো ।
এই লাল গোলাপ পেলেই রাগ ভাঙবে ম্যাডামের ।
বাড়ি ফেরার পথেই ঠিক গেটের কাছে আসতেই একটা ডাকে থমকে দাঁড়ালো অখিলেশ ।
বরুণ দা, মানে পোস্টমাস্টার দাদা ।
বিগত চার বছরে এই পাড়াতে বলতে গেলে শুধু মাত্র অখলেশের চিঠিই দিয়েছে বরুণ দা । সব ইন্টারভিউ কল লেটার । খুব ভালো একটা দাদা ভাইয়ের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে ওর অখিলেশের সাথে ।
হাসি মুখে এগিয়ে এসে অখিলেশের হাতে একটা লেটার দিয়ে বললো,
- মিষ্টি টা কবে পাচ্ছি ভাই?
অখিলেশের বুকের ভেতরে তখন তোলপাড় ।
জল ভরা চোখে সে বরুণ পোস্টমাস্টারের দিকে তাকালো ।
বরুণ দা ওর কাঁধে স্নেহের হাত রেখে বলল,
- হ্যাঁ ভাই হয়েছে তোমার । ঠিক এই রকম আবেগে আমারও বুক টা কেঁপে উঠেছিলো যখন আমি প্রথম লেটার টা পেয়েছিলাম ।
.......
বাড়িতে ঢুকেই দৌড়ে উপরে নিজের ঘরে গেলো অখিলেশ দরজা বন্ধ করে টেবিলে র উপর রাখলো লাল গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকা । তার পাশেই রাখলো এতো দিনের উপেক্ষা, অপামান
অপেক্ষা, আর পরিশ্রমের একটা জীবন্ত উত্তর, খাম বন্ধী চাকরির জয়েনিং লেটার। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মিশিকার সামনে। দুইচোখে তখন জলের ধারা।
কাপা কাপা গলায় বললো,
- আমি পেরেছি! বাবলী আমি পেরেছি ! তোর এই অপদার্থ প্রেমিক টা পেরেছে নিজেকে প্রমাণ করতে ।
দেওয়াল ঝোলানো ৮ বাই ১২ এর ফটো ফ্রেম থেকে মুখ ভরা হাসি আর চোখ ভরা অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প নিয়ে তাকিয়ে আছে মিশিকা চ্যাটার্জী ।
চোখের জল মুছে মাথা তুলে তার বাবলীর ছবির দিকে তাঁকিয়ে অখিলেশ বললো,
- হ্যাপি বার্থ ডে বাবলী । হ্যাপি বার্থ ডে ।
হঠাৎ পেছন থেকে মিশিকা বলে উঠলো,
- শুধু লাল গোলাপ দিয়ে উইশ করলে হবে না । আজ কিন্তু সারাদিন বাইরে কাটাবো । পুরো কলকাতা চষে ফেলবো । সকাল সকাল এতো ভালো একটা খবর পেলাম ।
ব্যালকনিতে গোলাপ চারার গায়ে হাত বোলাতে বলতে বললো মিশিকা ।
অখিলেশ দৌড়ে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- কোথায় ছিলি তুই ? সকাল থেকে তোকে না দেখতে পেয়ে আমার কেমন লাগছিলো জানিস । কোথায় ছিলি , বল? এই ভাবে আমাকে ছেড়ে যাস না তুই । আমি পাগল হয়ে যাবো।
অখিলেশের কলাপে আলতো চুমু খেয়ে ওকে শান্ত করে , ওর জলে ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে মিশিকা বললো,
- আমি সব সময়, সব জায়গায় , প্রতি মুহূর্তে তোর সাথে আছি । আমি আছি তোর মনে, আমি আছি তোর চিন্তায় , আমি আছি তোর অনুভবে ।