এমন তো কথা ছিলো না
এমন তো কথা ছিলো না
- তুই কি জীবনে একটুও পল্টাবি না ....
ময়লা হয়ে আসা শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে কথা টা বললো টগরী ।
বলাই তখনও মদের নেশায় টলছে । কথা টা কিছুতেই কানে ঢুকছে না তার । ঠিক যেনো টাল সামলে দাড়ানোর ক্ষমতা নেই ওর ।
অস্ফুট ভাঙা ভাঙা নেশা ধরা কণ্ঠে বলল,
- যা তো শালী ফো ট আমার সামনে থেকে ।
.........
সেই কোন ছোট্ট বেলা থেকে ওদের প্রেম । ওরা একসাথে পুতুল খেলতো, ইস্কুলে যেতো , একসাথে আম কুড়িয়ে মাখা করে খেতো, আর পুজোর সময় নতুন জামা পরে দুইজনে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতো। আর যখন টগরির বাবা মদের নেশায় এসে ওর মাকে মার ধর করতো । ভয়ে ঘরের দেয়ালে সেদিয়ে যেতো টগরি। তখন বলাই ওর হাত ধরে নিয়ে বস্তির থেকে দূরে রেললাইনে নিয়ে ওকে ট্রেন দেখাতো । ছোট থেকে বড় হয়ে যাওয়ার কতো স্মৃতি ওদের জড়ানো। ছেলে বেলার বন্ধুত্ব যৌবনে প্রেমের রূপ নিলো । দুই ছেলে মেয়ের মা বাবা পারা পড়শী সবাই জানতো সে কথা । কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে ওদের ছোট বেলার স্বপ্ন গুলো বদলে যেতে থাকলো। মাতাল স্বামীর মার খেতে খেতে একদিন টগরি আর তার ছোট ভাইকে রেখে ওর মা পরলোক গমন করলো । মাতাল বাবার কাছ থেকে সংসার খরচের কোনো টাকা সারাজীবনে ওরা চোখে দেখে নি টগরীর মা কাজ করে এতো দিন ছেলে মেয়েদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলো । তাই অগত্যা পিছুটান ওই ছোটো ভাই টার দায়িত্ব নিতে বছর ২২ এর টগরি লোকের বাড়ি ঝি গিরি এর কাজ শুরু করলো। স্কুলে ওই প্রথম শ্রেণী অবধি তার পড়াশুনা তারপর আর স্কুল না বই খাতার মুখ সে দেখে নিন। কিন্তু ভাইকে সে মানুষ করবে । তাই তো দিন রাত এক করে মুখে রক্ত তুলে খেটে চলেছে সে ভাইয়ের জন্য।
নিজের ভাগে দুবেলা বাসি ভাত আর পোড়া রুটি ছাড়া কিছুই রাখে নি । শুধু মাঝে মাঝে নিজের ভালোবাসার মানুষ টাকে নিয়ে একটা ছোটো ঘর বাঁধার স্বপ্ন সে দেখে । বলাই ।
কিন্তু সময়ের পরিহাসে সেটাও কেমন যেনো ভেঙে পড়ছে ।
যৌবনে পা দেওয়ার সাথে সাথে বলাই কেমন যেনো বদলে যেতে শুরু করলো। খারাপ ছেলেদের সঙ্গ ধরে । মদ গাঁজা, চরস সব কিছুই যেনো তাকে গিলেছে । না আছে নিজের মা বাবার চিন্তা না টগরির । কতো বার কতো করে বোঝালো কিন্তু না সে বান্দা পাল্টানোর না । টগরি বলাইয়ের হাতে পায়ে অবধি ধরেছে কিন্তু না মদের নেশায় থাকলে বলাই কাউকে চেনে না । কিন্তু নেশা কেটে গেলে সে অন্য মানুষ এই বস্তিতে ওই ছেলের মতো একটা হীরের টুকরো ছেলে নেই । সারাদিন রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ সেটা না থাকলে দোকানের মাল টানার কাছ । সব কিছু সে করে । মা বাবা, টগরি , পাড়াপড়শি সকলের কথা মাথা নিচু করে বাধ্য ছেলের মতো শোনে সে। কিন্তু সন্ধ্যে হলে সারাদিনের উপার্জন মদের দোকানে ঢেলে দেবে ।
এমন নয় যে সে টগরী কে ভালোবাসে না , হয়তো নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে। তাকে নিয়েই সে সংসার বাঁধতে চায় । কিন্তু কি করবে সে যে নেশা ছাড়তে পারে না। চেষ্টা করে নি তা নয় । কিন্তু কিছুতেই পারছে না।
................
- আমাকে ওই পাঁচু দাস ৫০০০০ টাকা দেবে বলেছে । এতো টাকা কোনোদিন একসাথে চোখে দেখেছি ?
মদের নেশায় টলতে টলতে কথা গুলো টগরি কে বললো ওর বাবা ।
মুখ ঝামটা দিয়ে টগরি উত্তর দিলো ,
- দেখিনি আর দেখতেও চাই না ।
- হ্যাঁ রে শালী তা দেখতে চাইবি কেনো । তোর নাগর তোকে এনে দেবে কারি কারি টাকা ।
তুই কি ভাবছিস ওই বলাই তোকে বিয়ে করবে? কোনো দিন করবে না ।
টগরি এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো,
- করবে কি করবে না সেটা দেখেই নিও । কিন্তু আমি মরে গেলেও ওই মাতাল পাঁচু দাস কে বিয়ে করবো না ।
- হু মাতাল! তোর বলাই যে কতো ধোঁয়া তুলসী পাতা সে সকলের জানা আছে ।
- হ্যাঁ ও ধোঁয়া তুলসী পাতা নয় জানি । তবে একদিন ও সব নেশা ছেড়ে দেবে । আর যাই হোক ও বেঈমান নয় আমাকে ভালোবাসে ।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ঠোঁটের কোনে একটা শয়তানি হাসি খেলে গেলো টগরির বাবা হরেন মণ্ডলের ঠোঁটের কোণে।
সে বললো,
- ভালোবাসে? কচু ভালোবাসে ।
জিজ্ঞেস করিস তোর বলাই কে গত পরশুদিন সারা রাত সে কোথায় ছিলো ।
কথা টা শুনে রান্না থামিয়ে টগরি ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
- কোথায় ছিলো?
- মাগী পাড়ায় !
কথা টা শুনে বুকের ভেতর টা ধড়াস করে উঠলো । ওই নোংরা পাড়ায় বলাই যেতে পারে সেটা কোনো দিন ভাবতেই পারি না টগরি । ওটা তো দেহ ব্যাবসার আখড়া । কতো বার ওই পারার পাশ থেকে টগরি কে কাজের বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে বলাই নিজেই নাক সিটকে বলেছে । " এই জায়গা টা দেখলে আমার বড় ভয় করে, ঘেন্না করে " উফফ । আর আজ সে কিনা......
না না এ হতে পারে না । ওর বাপ মিথ্যে বলছে । বলাইয়ের নামে ওর কানে বিষ ঢালছে যাতে টাকা নিয়ে ওকে পাঁচু দাসের সাথে বিয়ে দিতে পারে ।
কথা গুলো ভাবতে ভাবতে চোখের কোনে কখন যে এক ফোঁটা জল জমেছে টের পায় নি সে । বাবার দিকে তাকিয়ে রক্ত চক্ষু নিয়ে টগরি বললো,
- আমি বিশ্বাস করি না তোমার এই মিথ্যে কথা ।
- যা যা বিশ্বাস করিস না তো । গিয়ে জিজ্ঞেস কর তোর নাগর কে । এক বাপের বেটা হলে সত্যি কথা বলবে ।
এখই বলাইয়ের সাথে তাকে দেখা করতে হবে । একটুও সময় নষ্ট না করে টগরি ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো ।
.......
আসে পাশে খোঁজা খুঁজি করে সে বলাইকে কোথাও খুঁজে পেলো না। শেষে পড়ার মুদি দোকানে লাল্টু কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আজ সে রেল গেটের ওই পারে রাজমিস্ত্রি র জোগাড়ের কাজে গেছে । তপ্ত দুপুরে খালি পায়ে গরম পিচের রাস্তার উপর থেকে ছুটে চলেছে একটি মেয়ে । তার বুকের মাঝে এক ঝড় উঠেছে । সেই ঝড়ের শেষে তার স্বপ্নের ঘর থাকবে না ভেঙে পড়বে সে নিজেই জানে না ।
........
- কি রে এই ভর দুপুরে তুই এইখানে? আর জানলি কি করে আমি এইখানে কাজে এসেছি ।
বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে কথা টা জিজ্ঞেস করলো বলাই।
- লাল্টু বলেছে।
উত্তর টা দিয়েই, নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে কেঁদেই ফেললো টগরি ।
বলাই ওকে শান্ত করে একটা গাছের ছায়াতে এনে বললো,
- কি হয়েছে বলতো? এই ভাবে কাদছিস কেনো । বাড়িতে কারো কোনো বিপদ হয়েছে বুঝি?
- পরশু রাতে তুই কোথায় ছিলি?
হঠাৎ করেই এমন প্রশ্নে বলাই একটু থতমত খেয়ে গেছিলো । তারপর নিজেকে সামলে বললো,
- কোথায় আবার থাকবো , নিজের বাড়িতেই ছিলাম ।
বলাইয়ের হাত টা নিজের মাথায় রেখে টগরী বললো,
- আমার দিব্যি খেয়ে বল ।
নিজের হাত টা এক ঝটকায় সরিয়ে বলাই বললো,
- কেনো তোর আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
- না হচ্ছে না। আমার দিব্যি খেয়েই তোকে বলতে হবে ।
- তুই এমন করছিস যেনো কিছু জানিস না ? রোজ রাতে মদ খেয়ে আমি অনেক রাতে বাড়ি ফিরি । আর মদ পেটে বেশি পড়লে আমার হুশ থাকে না হয়তো মাঠে ঘাটে পরে থাকি । পরশু রাত কেনো এমন অনেক রাত কেটেছে ।
- আমি অন্য কোনো রাতের কথা জানতে চাই না তুই পরশু রাতের কথা বল ।
এবার বলাই একটু রেগে গিয়ে বললো,
- সব কথার উত্তর তোকে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই । আমি তোর কাছে আমার মাথা বন্দক দিয়ে রাখি নি ।
আবেগে, রাগে দুঃখে টগরির মাথার শিরা ফুলে উঠেছে । চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । ওর এমন রূপ আগে কোনদিন দেখে নি বলাই । আগে কতই না ঝগড়া হয়েছে । তবে কি টগরি জেনে গেলো , পরশু রাতের কথা .....
কিন্তু ....
ভাবতে ভাবতেই একটা সপাটে চর এসে পড়ল বলাইয়ের গালে ।
সজোরে চর টা মেরে টগরি বললো,
- তুই মাতাল ছিলি, গাঁজা খোর ছিলি, আমি তাও তোকে মেনে নিয়েছিলাম। সেই ছোটো বেলা থেকে আমি তোকে ভালোবেসে এসেছি । আজ অবধি শুধু ভেবেছি কি করে তোকে নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার পাতবো ।
নিজের বাপ কে দেখেছি মদ খেয়ে সারা জীবন আমার মায়ের উপর অত্যাচার করে গেলো । আর মার খেতে খেতে মা টা একদিন মরেই গেলো । আমি আর আমার ছোট ভাই টা অনাথ হলাম । এখন লোকের বাড়ি ঝি গিরি করে বেচেঁ আছি । তুই তো সব টা নিজের চোখে দেখেছিস ...
আমি চাইতাম না মায়ের সাথে যা ঘটেছে এই একই ব্যাপার আমার সাথে ঘটুক । তাই বার বার তোকে বলতাম মদ ছাড় , নেশা করিস না । কিন্তু তুই আমার কোনো কথা শুনিস নি । তবুও আমি তোর পাশে থেকে গেছি । আজ পর্যন্ত তুই ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের কথা মনে আসে নি । আর সেই তুই কিনা মাগী পাড়ায় গেলি । একবার বলতেই পারতিস তোর শরীরে এতো ক্ষিদে , নিজের সারাজীবন যখন তোর নামে করে দিয়েছি এই শরীর টাও দিতাম ।
শেষ এর কথা টা বলাই কে খুব আঘাত করলো ।
সে বললো,
- ছি টগর!!
- তোর মুখে আর কোনো দিন আমার নাম নিবি না । আমি তোকে ঘেন্না করি।
- টগর বিশ্বাস কর , আমি....
- আমি শুধু একবার শুনতে চাই তুই ওই পাড়ায় গিয়েছিলি কথা টা সত্যি নাকি মিথ্যে?
- আমাকে একবার বুঝিয়ে বলার সুযোগ দে..
রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে উঠলো টগরি ।
- হ্যাঁ কি না?
মাথা নিচু করে বলাই বললো,
- হ্যাঁ... কিন্তু
- থাক এর থেকে বেশি আর কিছু শোনার বা বলার নেই । আমার এতো দিনের বিশ্বাস ভালবাসা সব শেষ । আজকের পর থেকে আমি তোর জন্য মরে গেলাম ।
- টগর শোন একবার কথা টা...
আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে ছুটে চলে গেলো টগরি ।
এইবার হঠাৎ যেনো বলাই এর মাথা টা গরম হয়ে গেলো । কোনো অপরাধ ছাড়া এই ভাবে তার প্রেমিকা তাকে সন্দেহ করছে । একবার বলে বোঝানোর সুযোগ টা অবধি দিলো না । সে যেটা করে নি সেটার অপবাদ নিতে হলো ।
তাই রাগে অভিমানে সেও চিৎকার করে বলল,
- যা চলে যা আমার কাউকে দরকার নেই । বেশ করেছি আমি গেছি। আরো যাবো বার বার যাবো ।
কথা টা কানে যেতেই একবার থমকে দাঁড়ালো টগরি । একবার ভেজা চোখে ফিরে তাকিয়ে ছিলো সে বলাইয়ের দিকে । সেই চোখে যে কি ছিলো বলাই সেই মুহূর্তে বুঝতে পারে নি কিন্তু । ওর বুকের ভেতর টা কেমন যেনো ফাঁকা হয়ে উঠেছিলো ।
...
সেইদিন রাতে বলাই আকন্ঠ মদ খেলো । চেষ্টা করলো সব ভুলে যাওয়া র ।পরদিন সকাল থেকে পারার মুদীর দোকানে অনেক কখন বসে ছিলো একবার টগর কে দেখবে বলে। প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে সে কাজে যায় । কিন্তু আজ বেলা গড়িয়ে গেল একবারও তার দেখা পেলো না । এইদিকে বলাইয়ের সাহসে কুলোচ্ছিলো না সে টগর দের বাড়ি যায় ।
এর মধ্যে হঠাৎ লাল্টু এসে দাঁড়ালো ওর পাশে, সকাল সকাল মুখ চোখের অমন অবস্থা দেখে সে বলাই কে জিজ্ঞেস করলো ।
- হ্যাঁ রে সকাল সকাল কি গিলে বসে আছিস নাকি?
লাল্টু বলাইয়ের ছোট বেলার বন্ধু , একদম ভাইয়ের মতো । একটা দোকানে কাজ করে বড় ভালো ছেলে । বলাইয়ের মত একটা নেশা খোর ছেলের বন্ধু হলেও আজ পর্যন্ত কোনদিন একটা বিড়ি খেয়ে দেখেনি ।
বলাই পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে সেটা জ্বালিয়ে কালকের সব ঘটনা বললো লাল্টু কে ।
লাল্টু সব শুনে একটা কাচা খিস্তি দিয়ে বললো,
- হারামজাদা তোকে নেশা খোর জানতাম এতো দিন । কিন্তু তোর চরিত্র যে এত নোংরা হয়েছে সেটা আমার ধারণা ছিলো না । বেশ করেছে । টগরির মতো ভালো মেয়ের যোগ্য তুই না । শালা তোকে তো পোদে লাথি মারে চলে যাওয়া উচিৎ । ঠিক করেছে ও তোর সাথে কথা বলে নি।
এমনিতেই বলাইয়ের মুড টা ঘেঁটে ছিলো সে রীতি মতো লাল্টু এর উপর রেগে পাল্টা খিস্তি মেরে বললো,
- ধুর বা# তুই ও তো দেখছি টগরের মতো পুরো কথা টাই শুনিস না । কেনো গেছিলাম ওই পাড়ায় সেটা শোন আগে । হ্যাঁ যাওয়া আমার ভুল হয়েছে । নেশার ঘোরে না থাকলে ওর তেই সীমানায় আমি পা রাখতাম না । সেটা তুইও। জানিস আর টগর ও ।
লাল্টু এবার একটু শান্ত হয়ে ওর পাশে বসে বললো,
- তবে গেলি কেনো?
- আর বলিস না । কাল বিশু মাল খেয়ে আমাকে বললো চল এক জায়গায় যাবো সেখানে আরো ভালো নেশার জিনিস আছে । আমিও ভাবলাম নিশ্চই গাঁজা টাজা হবে । সেই ভেবে ওর বাইকের পেছনে বসে গেলাম । গিয়ে দেখি , সেই নিষিদ্ধ পল্লী । আমি তো না না করছি বিশু আমাকে টেনে নিয়ে গেলো । ওর যাতায়াত ছিলো ঐখানে জানতাম । তারপর বাইক টা দার করিয়ে ও একটা ঘরে ঢুকে গেলো আমাকে বললো তুইও যা কোথাও একটা ঢুকে । নেশার ঘোরে সে বাইক লক করতে ভুলে গেছে আমি সেটা ঐখানে রেখে যেতেও পারছি না আর ওকে ডাকলেও কোনো সারা নেই । আমি এইদিকে বাইক চালাতে পারি না । আর নেশা টাও এমন হয়েছিলো যে হেঁটে বাড়ি ফেরার অবস্থা ছিলো না । তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ বাইরে বাইকের কাছে দাড়াই । রাত তখন অনেক , ঐখানেই একটা বন্ধ দোকানের বাইরে বসে থাকলাম কিন্তু কখন যে আমার চোখ বুঝে এলো আমি ঘুমিয়ে পরলাম টের পাই নি । সকালে নেশা কেটে ঘুম ভাঙতেই উঠে পালালাম । বাইক থাকলো সেখানে । ওই পারা থেকে বেরোনোর সময় সমানে পরলো টগরের বাপ টা । শালা বুঝতে পড়ি নি এই ভাবে লাগবে কথাটা ।
সব শুনে লাল্টু বললো,
- দেখলি তো মদ মানুষের কতো ক্ষতি করে । সেদিন যদি নেশায় না থাকতিস তবে সেই নোংরা জায়গায় পা রাখতে হতো না ।
মাথা নিচু করে অনুশোচনার সুরে বলাই বললো,
- হ্যাঁ রে , এই নেশা আমাকে কোথায় যে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই জানি না ।
- ছেড়ে দে ভাই এই সব ছেড়ে দে ।
- বিশ্বাস কর ভাই , অনেক চেষ্টা করি কিন্তু পারি না ।
- সবই বুঝলাম , তবে অন্য কারো মুখে শোনার আগে তোর উচিৎ ছিলো এই ঘটনা টগর কে বলার ।
- হ্যাঁ একবার ভেবেছিলাম বলবো কিন্তু সাহস হয় নি । যদি আমাকে ভুল বোঝে । সেই ভয়ে বলি নি । যদি বিশ্বাস না করে ....
- এটাই তো তোদের মত ছেলেদের ভুল । মেয়েদের মন বুঝিস না । মেয়েরা সব সহ্য করে নিতে পারে কিন্তু প্রতারণা বা মিথ্যে নয় । তুই যদি সেদিন নেশার ঘোরে কারো সাথে শুয়েও আসতি স আর নিজের ভুল বুঝে যদি টগরের কাছে সত্যি টা স্বীকার করতিস ও তোকে ক্ষমা করে দিতো। হয়তো সাময়িক রাগ অভিমান দেখাতো তবে ক্ষমা করে দিতো ।
এতো দিনে কম ঝগড়া তো হলো না তোদের আর প্রতিবার ভুল তোর ই ছিলো কিন্তু টগর তোকে ক্ষমা করে দিয়েছে বার বার ।
শোন ভাই মেয়েদের মত অমন নিরস্বর্থ ভালোবাসতে গেলে অনেক বড় হৃদয় লাগে সেই হৃদয় আমাদের ছেলেদের থাকে না ।
বন্ধু কে সান্তনা দিয়ে বাড়ির পথে ফেরার সময় লাল্টু বললো,
- পারলে মেয়েটাকে সত্যি টা জানিয়ে দিস । আর চিন্তা করিস না রাগ ভাঙলে টগরি আবার আসবে তোর কাছে । তুই খুব ভাগ্যবান অমন একটা মেয়ে কে পেয়েছিস । আগলে রাখতে শেখ ।
..........
আজ প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো টগরি কে দেখেনি বলাই সে আজ কাল আর ঘর থেকে বের হয় না । স্কুল যাওয়ার পথে ওর ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করে বলাই জেনেছে টগর সব কাজ ছেড়ে দিয়েছে এখন নাকি ঘরেই থাকে আর সারাদিন কাদে ।
বলাই বুঝতে পারলো সে এইবার অনেক বড় আঘাত দিয়েছে টগর কে । তার ভাইকে বলে পাঠিয়েছিলো একবার দেখা করার জন্য কিন্তু না টগর দেখা করে নি ।
এই ভাবে কেটে গেলো প্রায় দুই সপ্তাহ । বলাই এবার কেমন যেনো পাগল হয়ে উঠেছে । এবার যেনো টগরের উপর রাগ টা ওর বেড়েই চলেছে । আজ সে খুব বাজে রকম নেশা করে পরে আছে শ্মশান ঘাটে । লাল্টু এসে খুঁজে পেলো তাকে ।
- বলাই ! এই বলাই !
দুই তিনবার ডাকার পর হুশ এলো বলাইয়ের ।
লাল্টু বললো,
- ওঠ ভাই !! বাড়ি চল।
নেশার ঘোরে বলাই কোনো রকমে উঠে বসে লাল্টু কে জড়িয়ে ধরে বললো,
- টগর কে একবার বুঝিয়ে বল না ভাই আমি খারাপ ছেলে না । আমি যে আর ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না । একবার আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল । ওকে একবার আমি সব বলতে চাই ।
- আচ্ছা ঠিক আছে বাড়ি চল আগে ।
- আজ আমি ওর বাড়ি তে যাবোই। আজ কতদিন হলো দেখা করে না ফোন টা সুইচ অফ একবার কথা বলে না । আজ আমি যাবো ওর বাড়ি ।
নেশার ঘোরে কেমন যেনো পাগলের মতো করতে শুরু করলো বলাই । ওকে যেনো আটকে রাখা দায় । লাল্টু কোনো ভাবেই ওকে শান্ত করতে পারছে না । বলাই আজ পণ করেছে সে যাবে টগরি দের বাড়ি ।
অনেক চেষ্টা করেও যখন বলাই কে শান্ত করা গেলো না তখন লাল্টু বাধ্য হয়ে সত্যি কথা টা বলে দিলো ।
- ভাই আজ ওদের বাড়ি যাওয়া যাবে না।
- কেনো যাওয়া যাবে না? আজ যাই হয়ে যাক আমি আজ টগর কে দেখবোই।
লাল্টু এবার বলাইয়ের গেলে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বললো,
- আজ টগরির বিয়ে !! তুই যেতে পারবি না সেখান ।
কথা টা শুনে বলাইয়ের পায়ের তলার মাটি সরে গেলো । কিছুক্ষণ বোকার মতো দাড়িয়ে থেকে ।
- এটা হতে পারে না বলে, ছুট লাগলো বলাই ।
কিন্তু মদের নেশা তখন তাকে এমন ভাবে গিলেছে যে তার নিজের শরীরের উপর আর কোনো কন্ট্রোল নেই। একটু দূরে যেতেই সে উল্টে পরে গেলো রাস্তায় ।
......
সকালে যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে । তার টগর বিয়ে করে চলে গেছে সারাজীবনের জন্য ।
বিছানায় বসে মাথায় দুই হাত দিয়ে চাপড়াতে লাগলো।
ছেলের এই অবস্থা দেখে বলাইয়ের মা ঘরে এসে বললো,
- অমন করিস না বলাই। কি হবে এখন কেঁদে ।
নিজের দোষে আজ তুই সব হারালি ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মা বললো,
- যাওয়ার সময় একবার এসেছিলো মেয়েটা আমাদের বাড়ি । তুই তখন ঘুমাচ্ছিস । বললাম ডাকবো বারণ করলো, দরজার পর্দা সরিয়ে তোকে একবার দেখলো । তারপর কাদতে কাদতে বাইরে এসে আমার হাত ধরে বললো,
" মাসী আমাকে ক্ষমা করো তুমি"
আমি বললাম, তুই কেনো ক্ষমা চাচ্ছি স রে মা ! কপাল তো আমাদের খারাপ তোর মত মেয়েকে ঘরের বউ করতে পরলাম না ।"
তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
- বলাই, মেয়েটা অনেক যন্ত্রণা নিয়ে গেছে রে । যাওয়ার সময় আমাকে বার বার বলেছে মাসী বলাইকে বলো যেনো আর নেশা না করে ।
পারলে ওর এই কথা টা রাখিস ।
সেদিন সারাদিন একটা দানা পানি মুখে দেয় নি বলাই। কি করেই বা দেবে তার পৃথিবী টা যে শূন্য হয়ে গেলো ।
গতবার পুজোর সময় সপ্তমীতে ঠাকুর দেখতে গিয়ে ফটো স্টুডিও তে বলাই আর টগরি পাশাপাশি দাড়িয়ে একটা ছবি তুলেছিলো । বলাইয়ের দেওয়া গোলাপী রঙের শাড়ি টা পড়েছিলো টগর । একটা কপি ছবিই আছে ওর কাছে সেটাই হাতে নিয়ে বসে থাকলো বলাই সারাদিন । সেদিন থেকে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো আর কোনো দিন মদ কিংবা কোনো নেশার জিনিস ছোঁবে না । তাতে তার কষ্টও হয় আর সেই কষ্ট থেকে মৃত্যুও হয় তাই সই ।
....
দেখতে দেখতে কেটে গেছে মাস তিনেক । আজকাল বলাই কে পাড়াতে দেখা যায় না বিশেষ একটা । রাতে বাড়ি ফেরে মাঝে মাঝে বেশীর ভাগ সময় তার কাটে রেল লাইনের পাশের শ্মশান ঘাটে । না না সে নেশা করে পরে থাকে না। সেখানে মরা পড়ানো মানে ডোমের কাজ করে সে । এই কাজ টা করতে তাকে সবাই বারণ করেছে কিন্তু সে নিজের ইচ্ছেতে এই কাজ করে । তার মতে এই শ্বশানে ই সব থেকে বেশি শান্তি । কোনো মিথ্যের কারসাজি নেই এইখানে নেই কোনো দুঃখ। সব শেষ এই চিতার আগুনে । সবাই কে তো একদিন আসতে হবে এই ঠিকানায় । তাই এটাই শান্তির জায়গা । এইখানে এখন অবধি কতো মানুষ কে পুড়তে দেখেছে সে । অনেক কিছুই সে শিখছে প্রতিদিন । না আজ পাক্কা তিন মাস সে কোনো নেশার দ্রব্য ছুঁয়ে দেখে নি তবে এই শান্তির মাঝে একটা নেশা আছে আর এই নেশা নিয়েই সে সারাজীবনের ডুবে থাকতে চায় এই একাকীত্বের নেশায় ।
রাত আজকাল আর তেমন ঘুম আসে না । শ্বশান ঘাটের পাশেই একটা ছোটো অফিস রুম আছে সেখানেই ছোট খাটিয়া পেতে শুয়ে থাসে বলাই । সারাদিন শান্ত পরিবেশ ঘুমিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে । তাই রাতে আর ঘুম আসে না ।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত কাটে তার । ওর ভাবনা চিন্তায় দাড়ি টেনে শম্ভু দা ডাক দিলো ।
- এই বলাই ঘুমাচ্ছিস নাকি?
এতো রাতে কি আবার কোনো মানুষের শরীর এলো শান্তির খোঁজে ভাবতে ভাবতে । উঠে দরজা খুলে বলাই বললো,
- না দাদা ঘুমোই নি । বলুন ...
- আরে দেখ না একটা বডি এসেছে একটু তাড়াতাড়ি সালটে দে তো ।
- সাথে কতো জন আছে? পুরোহিতের কাজ আছে তো?
- ধুর শালা কেউ নেই রে , খালি দুটো লোক এসেছে ... সুইসাইড কেস তো।
- সেকি পুলিশ কেস হয়েছে নিশ্চই ?
- ওতো জানি না রে বাপু । শুধু এই টুকু জানি বাড়ির লোক বা আত্মীয় স্বজন বলে কেউ আসে নি প্রতিবেশী দুইজন লোক এসেছে দায়িত্ব পালন করে পালাবে।
- আচ্ছা চলো দেখি, আমি আসছি ।
এগিয়ে না গিয়ে ঐখানে দাড়িয়ে ই শম্ভু দা বললো,
- একদম কচি মেয়ে রে । মুখ টা দেখলাম বড্ড মায়াবী । কি যে হয়েছিলো কে জানে ।
বার্নিং প্লেসের কাছে বডি টা নামানো , সাদা কাপড়ে ঢাকা একটু দূরেই তিনজন লোক দাঁড়িয়ে । বলাই এগিয়ে গিয়ে বললো,
- বাড়ির লোক কেউ আছেন কি?
- না দাদা আমার প্রতিবেশী , দেখছেন না দুইজন এসেছি । আর সাথে ওই ড্রাইভার বডি টা তো নামানো যেতো না এই আপনাদের লোকটি যদি সাহায্য না করতো । শম্ভু দাকে দেখিয়ে একজন বললো।
বলাই লোকটিকে বললো,
- আচ্ছা আসুন কিছু সই এর ব্যাপার আছে ।
লোকটি প্রায় বলাইয়ের হাত ধরে বললো,
- ওই লেখা লেখির মধ্যে জড়াবে না । মানবিকতার জন্য এসে কোনো কেসে ফাঁস তে চাই না ।
- মানে?
- জানেন তো এটা সুইসাইড কেস ?
- হ্যাঁ শুনলাম ।
- কিন্তু পুলিশ কেস হয় নি । কোনো রকমে এইখানে এনেছি । বড্ড ভালো মেয়ে ছিলো । যদি কেস হতো কতদিন যে ওই বডি পচে গলে পড়ে থাকতো। বেচে থাকতে তো শান্তি পেলো না । মরেও...
বলাই এবার বললো,
- এটা তো বেআইনি । আমরা যদি ফেঁসে যাই? না না এ হবে না । আমি পারবো না ।
লোকটি এবার কাচুমাচু মুখে শম্ভু দার দিকে তাকালো ।
শম্ভু এবার আস্তে করে বলাই কে বললো,
- করে দে ভাই । আমি টাকা নিয়ে নিয়েছি । আর বডি টা র হাতে গলায় সোনার জিনিস পেয়েছি । তাতেই আমাদের হয়ে যাবে ।
- কথা টা শুনে বলাই এর সারা শরীর টা জ্বলে গেলো ।
পাশের লোক টি বললো,
- করে দিন দাদা , অভাগী মেয়েটার শেষ কাজ টা করে নি ।
শম্ভু দার কথা বাদ দিলেও । এই লোক টি কে মোটেই খারাপ মনে হলো না বলাইয়ের ।
সে এবার চুল্লির দিকে এগোতে এগোতে বললো,
- কি করে হলো এই সব ।
- কি আর বলি দাদা । বড়ই ভালো মেয়ে । এই তো মাস তিনেক আগে বিয়ে হয়ে এলো আমাদের পাড়ায় । ভারী মিষ্টি স্বভাব । সকলে কতো আপন করে নিলো। শুনেছিলাম মা মরা মেয়ে নিজের সন্তানের মতো স্নহ করতাম ।
দেখতে দেখতে আপন হলো ।
কিন্তু অমন ভালো মেয়ের স্বামী টা ছিলো পাষণ্ড । মেয়ে টাকে মারধর করত , সে ছিলো দালাল আমরা কেউ জানতাম না পরে জানলাম এমনি সেমনি নয় দেহ ব্যাবসার দালাল । একদিন তাকে জোর করে সে তার নিজের স্ত্রীকে এই ব্যবসায় নামাতে চায় । কিন্তু এই মেয়ে তো অন্য ধাতুর গড়া মার খেয়ে মরে যাবে কিন্তু নোংরা পথে যাবে না ।
রোজ রোজ অত্যাচার চলতে থাকে । এমন চাপা মেয়ে ছিলো কাউকে কিছু বলতোও না । আর মনে হয় সহ্য করতে পারছিলো না তাই গলায় দড়ি দিয়ে শান্তি পেলো ।
মেয়ের বাপ কে খবর দিলাম সেও দেখি আরো এক পাষণ্ড বলে। আমার কোনো মেয়ে নেই । আর এইদিকে ওর বর সেও তো বেপাত্তা ।
আর পুলিশ কে কি বলবো । বলুন ওই দালাল টা র পকেটে থাকে পুলিশ । আগের একটা বউ ছিলো ওই হারামিটার। সেও ঠিক এই ভাবেই চলে যায় । তখন বুঝতে পারি নি । তখন পুলিশ এসেও কোনো লাভ হয় নি উল্টে মেয়ের বাড়ির লোকজন হেনস্তা হয়েছে । আর কাটা ছেরার পর বেচারীর বডি টা মর্গে পচে যায় ।
কিন্তু এই মেয়েটার প্রতি এতো মায়া পড়েছিলো যে এর সাথে এমন হোক সেটা আমরা পারার কেউ চাই নি । তাই পাড়াপড়শি রা মিলে কোনো রকমে টাকা যোগাড় করে এনেছি অভাগী টাকে শেষ বিদায় দিতে।
কথা গুলো শুনে বলাইয়ের খুব কষ্ট হলো। আগেও কতো মরা সে পুড়িয়েছে । সব মৃত্যুর পেছনেই একটা দুঃখের গল্প থাকে না সেগুলো সে কোনো দিন শোনেনি। কিন্তু আজ এই গল্প টা শোনার পর কেমন যেনো কান্না পাচ্ছে তার ।
কথা বলতে বলতে চুল্লি রেডি করে ফেললো বলাই । এবার বডি টা তুলে এনে রাখতে হবে চুল্লিতে । ড্রাইভার টা মনে হয় কাছে ধারে কোথাও গেছে । বডি টা তুলতে চারজন লাগবে । বডির সঙ্গে আসা দুইজন আর শম্ভু দা, অপেক্ষা না করে বলাই এগিয়ে গিয়ে কাঁধে তুললো । শরীর টা কেমন যেনো শিহরিত হলো ওর, আগে অনেক মরা পোড়ালেও কাঁধে তোলে নি একটাও । হয়তো এই জন্যই ।
এই তো আর কয়েক টা মুহূর্ত এরপরই এই অভাগী মেয়েটা চির তরে শান্তি পাবে ।
চুল্লি ঢোকানোর আগে শম্ভু দা বললো , গায়ের শাড়ি টা মনে হলো দামী খুলে নিলে হতো না । সাদা কাফেনে ঢাকা শরীর টা তখন যেনো বলেছে এই মানুষ তোমরা এতো নিষ্ঠুর কেনো?
বলাই বললো ,
- শম্ভু দা আর কতো নিচে নামবে? নিজেই তো বললে মেয়েটা কে দেখলে মায়া হয়ে।
মদের নেশায় থাকা শম্ভু দা বললো,
- হ্যাঁ রে সত্যি হয় । দেখ তোর ও হবে বলে মুখের উপর থেকে সাদা কাপড় টা সরিয়ে দিলো । মৃত মেয়েটির মুখের দিকে নজর পড়তেই বলাই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। এ কি দেখছে সে । টগরি। তার টগর ... চির নিদ্রায় ঘুমোচ্ছে । বলাইয়ের মুখ থেকে আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এলো ।
- টগর ........!!!!
শম্ভু দা চমকে তাকালো বলাইয়ের দিকে ।
পেছনের লোকটি বললো,
- হ্যাঁ ওর নাম টগরি । কিন্তু আপনি জানলেন কি করে ?
বলাইয়ের কোনো কথাই কানে গেলো না । সে আঁছরে পড়লো মৃত টগরের উপর ... । কান্নায় আকুলি বিকুলি গেলো সে ।
- এ কি করলি টগর। একবার তো আমাকে বলতে পারতিস তোর যন্ত্রণা । আমি! আমি তোকে নিয়ে আসতাম । ওরে টগর তুই একবার কথা বল ... একবার ফিরে আয় দেখ তোর বলাই কতো পাল্টে গেছে । হ্যাঁরে তোর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী । আমি পারিনি নিজেকে বদলাতে আর তাই তুই এই ভাবে চলে গেলি... ।
এমন তো কথা ছিলো না । এমন তো কথা ছিলো না । আমরা এক সাথে বাঁচবো এটাই তো ঠিক ছিলো । কেনো রে তুই এই ভাবে চলে গেলি ।
না বডি টা এখনো পরে আছে চুল্লিতে দেওয়ার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই হয় নি শম্ভু দার । শম্ভু দার হাত থেকে পড়ে গেলো বডির গায়ের থেকে খুলে নেওয়া সোনার গয়না। লাশ দাহ করার টাকা টা ভদ্র লোকটিকে ফেরৎ দিয়ে শম্ভু বললো,
- দাদা টাকা টা রাখুন এটা দিয়ে গরীব বাচ্চা দের কিছু খাইয়ে দেবেন । বা এই মেয়েটির একটা ছোট ভাই আছে তাকে দেবেন পারলে । এই অভাগীর দাদা আজ তার শেষ কাজ করবে । বলেই চোখ মুছে শম্ভু চলে গেলো ।
হ্যাঁ টগর কে চোখে না দেখলেও তার কথা জানে সে । বলাই সব বলেছিলো তাকে । এরপর পুরোহিত ডাকা হলো, সমস্ত নিয়ম পালন করে বলাইয়ের হাতে মুখ আগ্নি করে তবেই টগরের শেষ কাজ সম্পন্ন হলো ।
"- শোন বলাই, আমি যখন মরে যাবো তুই আমার মুখ আগ্নী করবি ,
- চুপ কর তো , তোর শুধু ভুল ভাল কথা ।
- না রে সত্যি বললাম।, মরে গেলে ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের মুখে আগুন দেয়। কিন্তু আমি চাই তুই আমার মুখে আগুন দিবি । তবেই আমি মুক্তি পাবো ।
- তোর আগে আমি মরে যাবো দেখিস । বর রা আগে মরে বউ বাঁচে ।
- ধুর এই দেখ আমার বাপ বেচে আছে আর আমার মা কেমন চলে গেলো । আমিও চলে যাবো তোর আগে ।
- না আমি যাবো আগে...
- বলাই তুই অনেক বছর বাচবি আমার সব আয়ু তোর লাগুক ।
- তুই চুপ করবি না মার খাবি ।
.........
ভোরের আকাশে সূর্য্য ওঠার লাল আভা ভেসে উঠলো । মাটির ভাঁড়ে নিজের স্বপ্নের এক মুঠো ছাই নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বলাই । মনের গভীরে থেকে ভীষন অভিমানে একটা কথাই বার বার তার বলতে ইচ্ছে করছে ।
"এমনতো কথা ছিলো না... কেনো চলে গেলো টগর?"