Swagata Pathak

Romance Fantasy Inspirational

4.1  

Swagata Pathak

Romance Fantasy Inspirational

তার চোখের তারায়

তার চোখের তারায়

6 mins
986


- হয়তো জীবনে আর সে ভাবে কিছুই বাকি নেই । আমি এই বেশ ভালো আছি কাকী মনি । খামোখা নিজের জীবনের সাথে অন্য একজন কে জড়িয়ে আর তার জীবন নষ্ট করতে চাই না। আর তাছাড়া তোমরা সবাই আমাকে এতো ভালোবাসো , এতো আদর যত্নে রেখেছো যে আমি আর কিছুই চাই না।

প্রতাপ কথা টা বলে উঠে পরল । 

এই নিয়ে তার কাকী মনি তার জন্য তিনটে বিয়ের সমন্ধ এনেছে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হয়নি । তার অগাধ সম্পত্তি বসে খেলে শেষ হবার নয় । আর সে জানে যে সব মেয়েরা তাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে শুধু মাত্র তার সম্পত্তির লোভে।

বছর চারেক আগে একটা দুর্ঘটনায় সে নিজের দৃষ্টি শক্তি হারায় শুধু তাই নয় সঙ্গে হারায় তার একজন প্রিয় মানুষ নীলাঞ্জনা কে । 

নিজের অমতে নীলাঞ্জনার সাথে ওর বিয়েটা হয়েছিলো এটা ঠিক কথা কিন্তু মেয়েটা সময়ের সাথে সাথে তাকে বাধ্য করেছিলো আরও একবার অবাধ্য প্রেমিক হয়ে উঠতে । 

প্রতাপ ভালোবেসে ফেলছিলো নীলাঞ্জনা কে । আজও মনে পরে সেই সন্ধ্যের কথা। বার বার বারন করা সত্যেও জোড় করে সে রান্না ঘরে যায় প্রতাপের পছন্দের "মশলা পনির" বানানোর জন্য । বড় লোক বাবার এক মাত্র মেয়ে কোনোদিন রান্না ঘর তো দুর এক গ্লাস জল গড়িয়ে খায়নি সে রান্না ঘরে যেতে চাওয়াতে বাড়ির সকলেই বাঁধা দেয় । হাজার গন্ডা কাজের লোক আছে তবুও কেনো সে জেদ করছে । তবে তার সখ যখন হয়েছে বর কে নিজে হাতে রেধে খাওয়াবে তখন কে আর বাঁধা দেয়। 

নীলাঞ্জনা কাউকে রান্না করে আসতে দেয় নি । মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর প্রতাপ নিজের বউকে সাহায্য করতে জোড় করে রান্না ঘরে যায় আর ঠিক তখনই বিরাট একটা শব্দ করে গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে । ওভেনের কাছে থাকায় সব থেকে বেশি ক্ষতি হয় নীলাঞ্জনার। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায় নি । আর দরজার কাছে ছিলো বলে প্রতাপের প্রাণ টা বেঁচে গেলেও চোখ দুটো শেষ হয়ে যায় । আজও মনে পরলে নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখ দুটো ভিজে আসে প্রতাপের ।

অনেক চেষ্টা করা হয়েছে । ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে কর্নিয়া বদলাতে হবে । অনেক জায়গায় কথা বার্তা চালানো হচ্ছে কিন্তু প্রতাপের সাথে ম্যাচিং কর্নিয়া পাওয়া খুব মুশকিল হচ্ছে । তবুও বাড়ির লোক আশা ছাড়ে নি, ভাত ছড়ালে কি কাকের অভাব হয় । সোজা পথে বাঁকা পথে সব ভাবেই চেষ্টা করা হচ্ছে ।

এর মধ্যে প্রতাপের মা বাবা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছে একান্ত যদি প্রতাপ আর ঠিক না হয় ওর সারাজীবনের একটা সম্বল তো লাগবে । কিন্তু প্রতাপ এতো দিনে এই জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে সত্যি বলতে আর কাউকেই তার দরকার নেই । আর তাছাড়া ওর পক্ষেও নতুন করে আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয় ।

দিন কেটে যাচ্ছিলো এই ভাবেই। হঠাৎ করেই মরুভূমির মাঝে জলের খোঁজ পওয়ার মতো দুটো কর্নিয়ার খোঁজ পাওয়া গেলো যেটা টেস্ট করে প্রতাতের শরীরের সাথে একেবারে ম্যাচ করে গেছে । কিন্তু একটা সমস্যা আছে। কর্নিয়া দুটো এক জীবিত মানুষের ।

সে বেশ মোটা টাকার বিনিময়ে তার কর্নিয়া বিক্রি করছে । প্রতাপের পরিবার জানে এই কথা প্রতাপের কানে গেলে সে কিছুতেই রাজি হবে না উল্টে ওই মানুষ টিকে তার সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করবে । তাই সত্যি চেপেই ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ।

প্রতাপ এক প্রকার নিজের দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার আসা ই ছেড়ে দিয়েছিলো। তবে সংবাদটা পেয়ে সে খুশি হলো।  

নির্ধারিত দিনে প্রতাপের অপারেশন হলো বিদেশের সব থেকে বড় হাসপাতালে। মাস তিনেক পর সে সম্পুর্ণ সুস্থ্য হয়ে ফিরে এলো নিজের বাড়িতে ।

স্বাভাবিক ভাবে সে আবারও নিজের কাজে মন দিলো । তবে আজও নীলাঞ্জনার স্মৃতি তাকে আটকে ফেলে অতীতের পাতায় ।

নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অনেক বছর সে খোলে না । কাজের ফাঁকে সময় পেয়ে নিজের জীবনের আলো চলে যাওয়া আর ফিরে আসার গল্পটা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে হলো ।

ফেসবুক খুলতেই তার চক্ষু চরক গাছ কতো নোটিফিকেশন । পুরোনো বন্ধুরের সুখ দুঃখের পোস্ট । হঠাৎ করেই কলেজের এক বান্ধবীর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে কেক কাটার একটা ছবিতে তার চোখ আটকে গেলো । চেনা বান্ধবী , তার স্বামী, মেয়ে আরও কিছু লোকজনের মাঝে একটা মুখ উঁকি দিচ্ছে একদম কোনে, ঈশিতা। তার প্রাক্তন প্রেমিকা । 

তাকে দেখে থমকে গেলেও হতো কিন্তু তার ছবি দেখে একটু অবাক হলো প্রতাপ এমন পার্টির মধ্যে সে চোখে সান গ্লাস পরে আছে। একটু ভালো করে দেখার পর সে বুঝলো যে না এটা তো সান গ্লাস নয়। সে উঠে গেলো তার পুরোনো আলমারির দিকে । অন্ধত্ব কালে সে তার ব্যবহার করা, লাঠি আর চশমা টা মা কে বলে রেখে দিয়েছিলো । চশমা টা হাতে নিয়ে দেখলো আর তারপর সে ভালো করে ঈশিতার চোখের চশমা টা দেখলো । হ্যাঁ সে যা ধারণা করেছে সেটাই । কিন্তু ঈশিতার তো চোখ খারাপ ছিলো না । 

সাথে সাথে প্রতাপ তার পুরোনো বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করলো আর ঈশিতার ব্যাপারে সমস্ত কিছু জানালো । মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ঈশিতা, বাবা সামান্য এক প্রাইভেট অফিসে কাজ করতো হঠাৎ বাবার মৃত্যু হয় । মাঝ পথে কলেজ ছেড়ে তাকে কাজে ঢুকতে হয়। মা আর ছোটো ভাইয়ের দায়িত্ব তখন তার মাথার উপর । ইতিহাস নিয়ে এম এ তে ভর্তি হয়েছিলো সেটা আর শেষ হলো না তার । 

কিন্তু জীবনের পরীক্ষা যে কঠিন কোনো রকমে সংসার টানছিলো হঠাৎ তার ভাইয়ের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরে। কিছুতেই সে সংসার চালিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা চালাতে পারছিলো না । শেষ সম্বল ভিটে টুকুও তাকে বিক্রি করতে হয়। একটা ভাড়া বাড়ীতে থেকে চলছিলো । বাজারে প্রচুর দেনায় ডুবে যায় সে । বাড়ি বয়ে লোক আসতো বিভিন্ন কথা শোনাতো । তবুও মুখ বুঝে সবটা শয়ে লড় যাচ্ছিলো ঈশিতা। কিন্তু ওর মা আর পারলো না । চোখের সামনে ছেলেরা মরে যাচ্ছে, মেয়েটা খেটে খেটে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা ছাড়া দুটো কাজ করছিলো ঈশিতা । কোন মা আর সন্তানের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারে , ঈশিতার মা আত্মহত্যা করেন । এবার যেনো ঈশিতার ভর ডুবি অবস্থা । মানসিক ভাবে সে ভেঙে পরে, আর্থিক ভাবে তো শেষ হয়েই গিয়েছিলো । এখন শুধু মাত্র ভয়ের জন্য তার বেঁচে থাকা । বলতে কষ্ট হলেও এটা সত্যি ঈশিতা নিজের ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য শেষ মেশ বন্ধুদের কাছে সাহায্যের হাত পাতে । স্যোশাল মিডিয়াতে সাহায্য চেয়ে পোস্ট দেয় । কিছুটা উপকার হয়েছিলো। কিন্তু ব্লাড ক্যান্সার শুধু আক্রান্ত মানুষটাকে শেষ করে না । শেষ করে দেয় তার সাথে থাকা পুরো পরিবারটাকে । 


অনেক কিছু চেষ্টা করেও কোনো উপায় হয়নি । তারপর কোথায় একটা খবর পায় । কোনো এক কোটিপতির ছেলে না মেয়ে চোখের জন্য হাহুতাশ করছে । তাকে কর্নিয়া দান করলে প্রচুর টাকা দেবে । তাতে তার ভাইকে সে বাঁচাতে পারবে । আমাকে সব কিছু বলতো এটা তো বেআইনী তাই কাউকে বলার সাহস করেনি । তুই বলেই বলছি । ঈশিতা নিজের চোখের দুটো কর্নিয়া বিক্রি করে দেয় । আর ওদের সাথে চুক্তি হয় এক কালীন কিছু টাকা ওরা দেবে ওকে সে ওর ভাইয়ের চিকিৎসা চালাবে ।

সব কিছু শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে প্রতাপ । তার মনে পরে যায় পুরোনো কথা। কলেজ জীবনে সকলের প্রিয় কাপল ছিলো । ঈশিতা স্কলার শিপে পড়াশুনা করতে এসেছিলো ওদের কলেজে । ঈশিতার জীবনের সমস্ত কিছু জেনেই প্রতাপ ওকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু প্রতাপের পরিবার মেনে নেয় নি । একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে । কলেজ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় জোড় করে ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করে প্রতাপ কে নীলাঞ্জনার সাথে বিয়ে দেয় । ঈশিতা কোনোদিন নিজের অধিকার চায় নি প্রশ্ন করেনি প্রতাপ কে কেনো সে তাকে ছেড়ে গেলো । আর ঈশিতার এই চুপ করে যাওয়াটাই প্রতাপ কে কতো রাত ঘুমোতে দেয় নি । সময়ের সাথে সে সবটাই ভুলে গেছিলো । আজ তার মনে হচ্ছে কি বড় অপরাধ সে করেছে। একটা মেয়ে জীবনের এমন কঠিন যুদ্ধ একা লড়ে গেছে আর সে পাশে থাকতে পারেনি । যে সময় ঈশিতার খুব বেশি দরকার ছিলো প্রতাপ কে সে ওর কাছে ছিলো না ।

আর হয়তো ভগবান প্রতাপকে তার পাপের সাজা দিয়ে দিয়েছে এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করার সময় ।

প্রতাপ তার বান্ধবী কে বললো,

- আজ থেকে ঈশিতার সব দায়িত্ব আমার । তুই আমাকে একবার ওর কাছে নিয়ে চল ।

- কিন্তু তোর বাড়ির লোক কি মানবে?

- একবার ভুল করেছি আর নয় । আজ যার জন্য আমি আলো দেখছি তাকে কি করে অন্ধকারের রাখি বল?

প্রতাপের বান্ধবী অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

- ওর জন্য আলো দেখছিস মানে?

প্রতাপ ছলছল চোখে বলে,

- যে কোটি পতি ছেলের জন্য নিজের কর্নিয়া দিয়ে ঈশিতা সে আর কেউ নয় আমি । 

অপারেশনের সময় না জানালেও পরে আমি আমার মায়ের কাছে জেনেছিলাম একটা অসহায় মেয়ে নিজের ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য তার কর্নিয়া বিক্রি করে দেয় । 

ওর বান্ধবী একটা ঠিকানা লিখে প্রতাপের হাতে দেয় ।

আর প্রতাপের হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে । 

- বড্ড অসহায় ওই মেয়েটা, অনেক সহ্য করেছে পারলে সুখে রাখিস ।

প্রতাপ বান্ধবীর হাত টা চেপে ধরে বলে। 

- শুধু সুখে নয় তাকে রাখবো " তারই চোখের তারায় " !


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance