STORYMIRROR

আশালতা Ashalata

Classics Inspirational

4  

আশালতা Ashalata

Classics Inspirational

ডিয়ার আমি

ডিয়ার আমি

7 mins
309

আশ্বীনের দুপুর। ওয়েদারটা বেশ পুজো পুজো । আজ তৃতীয়া । স্কুলের থেকে বাড়িতে ফিরছিলো অপর্ণা , পুজোর আগে আজ শেষ স্কুল হল। কাল থেকে পুজোর ছুটি পড়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ কফিশপের সামনে সুস্মিতাকে দেখে বেশ অবাক হল অপর্ণা। আজ কতবছর পরে দেখলো সুস্মিতাকে। 

সুস্মিতাও অপর্ণাকে দেখেছে।

দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ও অপর্ণার দিকে।

ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,"কেমন আছিস অপু? কত বছর পরে দেখা।"


অপর্ণা হেসে বলে,"ভালো আছি। কিন্তু তোর কি ব্যাপার বলতো সুমি? তোর নাকি কলকাতার ইট কাঠের দৈত্যের মাঝখানে দম আটকে আসে? তাহলে এখানে কি করছিস?"


"এখনও মন টেকে না রে এখানে । তবে কাজের জন্য আসতেই হয়।" সুস্মিতা বলল।


"তাহলে কোথায় থাকিস এখন?" কথাটা বলতে বলতে অপর্ণার চোখদুটো আটকে যায় সুস্মিতার নিটোল মুখটার দিকে। 

এখনও ঠিক একই রকমের আছে মুখটা।

বয়েসের বলিরেখা মুখে ভাসলেও , জীবনের দৈনন্দিনতার ক্লান্তি যেন ওকে ছুঁতে পারেনি।


"সত্যি কথা বলতে সেইরকম ভাবে কোথাও থাকি না। নর্থ বেঙ্গলে বাবার বাড়িটা পড়ে আছে। 

মা বাবা কেউই এখন আর বেঁচে নেই । আমার তো বছরের অধিকাংশ সময়ই ট্যুর থাকে। আর না থাকলে তখন যাই বাড়িতে , একটু ঝাড়পোছ করে আসি ।" 

বলতে বলতে হেসে উঠলো সুস্মিতা।


মুগ্ধ হয়ে ওর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে অপর্ণা।

থাকতে না পেরে বলেই ফেলে,"তুই বদলালি না রে একটুও। বিয়ে করিস নি ?"


"ধুর! বিয়ে তো করে পাগলে। বিয়ে করলে কি আর এই মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়িতে পারিতাম সখী?" রসিকতা করে বলল সুস্মিতা।


তারপরে বলে ,"এখানেই কি সব কথা বলবি? আয় কফিশপটায়ে বসি । তুই ফ্রী আছিস তো?"


ব্যাগের থেকে মোবাইলটা বের করে টাইমটা দেখে নিয়ে অপর্ণা। তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"নাহ্ , চারটে বাজে, ওর বাড়িতে ফিরতে এখনও ঘন্টা দেড়েক দেরী আছে , চল বসি ।"


কফিশপে ঢুকতে ঢুকতে সুস্মিতা বলল,"বাবা অপু , বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্যেও তোকে বরের কাছে জবাবদিহি করতে হয়?"


"নারে জবাবদিহি না, তবে সন্ধ্যের চা টা আমার হাতে না পেলে ওর মুড অফ হয়ে যায়।" ঈষৎ গর্ব মিশ্রিত কণ্ঠে বলল অপর্ণা।


সুস্মিতা বাঁকা হাসলো।


দুই কাপ কফি অর্ডার করার পর অপর্ণা জিজ্ঞেস করল ,"কি চাকরি করিস রে তুই যে সারা বছর তোকে ট্যুরে থাকতে হয় ?"


"আমার ট্যুর আর ট্র্যাভেল এর নিজস্ব কোম্পানি আছে, "Enjoy yourself tour and travel"। আমিই ওনার আমিই গাইড, লোকেদের ঘোরাতে আমার ভালো লাগে সেই সাথে নিজের ঘোরাটাও হয়ে যায়।" বলে মিষ্টি করে হাসলো সুস্মিতা। 


"ও , তা এবার কি পুজোয় কলকাতা ঘোরাবার প্ল্যান?" 


"না না, আসলে যেকোনো ট্যুরের জন্যই আমি কলকাতায় আসি, এয়ারপোর্ট থেকে সবাইকে কালেক্ট করে তারপর আসল জায়গায় যাই। আসলে আমি মেইনলি বেঙ্গলের লোকদের নিয়েই ট্যুর করি, তাই কলকাতা থেকে জার্নি করাটাই সুবিধার হয়।"


"কোথায় যাচ্ছিস রে তোরা এবার পুজোয়?" কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করে অপর্ণা । ঘুরতে যেতে যে ও নিজেও খুব ভালোবাসত।


"মেঘালয়টা পুরোটা কভার করার প্ল্যান আছে।"


"মেঘালয়?" মুখটা ঝলমল করে ওঠে অপর্ণার।


মনে পড়ে যায় পুরোনো কিছু আলগোছে তুলে রাখা স্মৃতি।


অপর্ণার খুব ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পর হানিমুনে মেঘালয় যাবে। নর্থ - ইস্ট - ইণ্ডিয়া ঘোরার শখ ওর বরাবরের।

কিন্তু সেই ইচ্ছে ওর বর সৌম্যর কাছে প্রকাশ করা মাত্র সে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল,"কি যে বলো না? বিয়ের পরে বউকে নিয়ে ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি শুনলে বন্ধুরা যা খিল্লি উড়াবে। স্ট্যাটাস বলেও তো কিছু আছে নাকি? যত্তসব মিডিল ক্লাস চিন্তা ভাবনা।"


সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলো ওরা । হ্যাঁ সেই ঘোরায় আতিশয্য ছিলো প্রচুর পরিমাণে, ওতে স্ট্যাটাস বাড়ে ঠিকই কিন্তু যেটা হয়না সেটা হল মনের খোরাক। 


ওর ইচ্ছেটাকে এভাবে কেউ দাবড়ে দিলো, এটা পুরো হানিমুনের সময়টা জুড়ে খচখচ করছিল অপর্ণার মনে।

তারপর অবশ্য এইগুলো মানিয়ে নিতে শিখে গেছে ও।


পুরোনো কথাটা মনে করতে গিয়ে ভাবনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিল অপর্ণা। সম্বিত ফিরল সুস্মিতার ডাকে।


"ওই মেয়ে, আমার কথা তো শুনলি প্রচুর। পুরো বায়োডেটা দিয়ে দিলাম নিজের । এবার তোরটা বল।" সুস্মিতা বলল।


"আমার আর কি?" একটু মলিন হেসে বলল অপর্ণা," ওইতো ভদ্রমার্কা শিক্ষিকার চাকরি, বরের অফিস, ছেলের পড়া, ওই একঘেয়ে সংসারের সাতকাহন আর শুনে কি করবি? ছেলে অবশ্য এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে পড়ার জন্য। 

তোর মতন প্রত্যেকদিন একেকটা অ্যাডভেনচার করা আমার স্বপ্ন হলেও বাস্তব বারবার তার মাটিতে পা রেখে চলার কথা জানান দেয়।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপর্ণা।


সুস্মিতার অপর্ণার চোখের নিচে কালি আর বয়সের ভারে থলথলে চেহারাটা দেখে মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফে ডাকসাইটে সুন্দরী বলে বেশ নাম ছিল অপর্ণার। প্রত্যেকদিন কত ছেলে প্রেমপত্র দিত। 


সুস্মিতা আবার বরাবরই একটু ডাকাবুকো রকমের , জীবনে রিস্ক নিতে খুব পছন্দ করে। 


ওকে সবাই টমবয় বলত।


সুস্মিতা অপর্ণাকে বলে,"নিজেকে এভাবে অবহেলা কেন করছিস অপু? চেহারাটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?"


অপর্ণা কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল,"ধ্যাত! সংসারে একবার ঢুকে গেলে নিজের দিকে তখন আর তাকানোর সময় হয় না। ওসব ছেলেমানুষদের কাজ। তুই তো আর সংসার করিসনি, তাই ওইসব বুঝবি না।"


সুস্মিতা একটু প্রতিবাদ করে বলে,"সংসার করলেও সেই সংসারের যাতাকলে নিজেকে পিষে মারতাম না যেটা তুই করছিস। নিজেকে ভালো রাখতে শেখ অপু, নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না এভাবে।"


একটু হেসে কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে অপর্ণা বলে,"আজ উঠি রে সুমি, অনেকটা দেরী হয়ে গেল, পরের বার কলকাতায় এলে, অবশ্যই আসিস আমার বাড়িতে।"


উত্তরে হাসে সুস্মিতা। 


ট্যাক্সিতে উঠে শরীরটা সিটে এলিয়ে দেয় অপর্ণা।


ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে । ভাবতে থাকে কলেজ লাইফের দুরন্ত স্মৃতি গুলোর কথা।


ও আর সুস্মিতা খুব কাছের বন্ধু ছিলো।


সুস্মিতা এমনিতে ভালো হলেও ভীষন দুরন্ত ছিল, যেই কাজগুলো লোকে করার আগে দশবার ভাবতো, সেই কাজ গুলো ওর কাছে জলভাত ছিল।

ছেলেদের সাথে পাঞ্জা লড়া, গাছে চড়া এইসব ওর একরকম হবি ছিল।

মাঝেমধ্যে আবার ও উধাও হয়েও যেত।

হঠাৎ শোনা গেল মহারানী নাকি কোন নাম না জানা পাহাড়ে ট্র্যাকিং করতে গিয়েছেন।

ঘুরতে ভীষন ভালোবাসতো মেয়েটা। বিশেষ করে পাহাড়ে।


আর অপর্ণা ছিল শান্তশিষ্ট স্বভাবের । একই স্রোতে চলতেই ও পছন্দ করত।


অপর্ণা মাঝেমধ্যেই সুস্মিতাকে বলত,"সুমি, এমন রেকলেস লাইফ লিড করিস না, পরে পস্তাতে হবে।"


কথাটা মনে পড়তেই হাসি পেলো অপর্ণার। এই রেকলেস লাইফ লিড করেই সেই সুমি একটা স্বাধীন, মুক্ত জীবন কাটাচ্ছে, নিজের মত করে উপভোগ করছে। আর ও , সেই তথাকথিত ছন্দে মিলে গিয়ে খিটখিটে জীবন কাটাচ্ছে। 


মাঝেমধ্যে মনে হয় অপর্ণার , এই যে বলা হয় মেয়েরা আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হলেই নাকি তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, সত্যিই কি তাই? শুধুই কি আর্থিক দিক দিয়ে স্বাধীন হলে হয়? নাহ্! মনের দিক দিয়েও স্বাধীন হতে হয়। নিজেকে বুঝতে হয়, নিজেকে ভালো রাখতে হয়। যেমনটা সুস্মিতা করেছে, তাই তো এই মধ্যবয়সে এসেও সেই কুড়ি বছরের একটা মেয়ের মতই প্রাণবন্ত, বয়স তার মনে প্রবেশ করতে পারেনি।

আর অপর্ণা ? বয়সের গ্লানি সারা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠেছে ‌।


"আচ্ছা, যদি আমি জোর দিয়ে সৌম্যকে বলতে পারতাম, স্ট্যাটাস ট্যাটাস অত বুঝিনা, আমার মেঘালয় যেতে ইচ্ছে হয়েছে, চলো না। তাহলে কেমন হতো?" মনে মনে ভাবে অপর্ণা।


"এই যে আমরা মেয়েরা ' মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফোটেনা ' কথা শুনে বেশ গর্ব বোধ করি, এটা গর্বের না লজ্জার।

মুখ ফোটেনা বলেই সবার ইচ্ছেটা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। "


কথাটা মনে আসতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় ওর মুখ দিয়ে।


"নাহ্ , এবার থেকে আমিও ভালো থাকবো।"


ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেছে খেয়াল করেনি অপর্ণা। ড্রাইভারের কথা শুনে হুস ফেরে ওর।


বাড়িতে ঢুকে দেখে সৌম্য অলরেডি বাড়িতে চলে এসেছে।


অপর্ণাকে দেখেই বলে উঠলো,"কোথায় ছিলে এতক্ষণ? এখন কি অফিস থেকে ফিরে চা টাও নিজেকে বানিয়ে নিতে হবে?" 


অপর্ণা হেসে বলল,"কেন গো? আমিও তো স্কুল থেকে ফিরে নিজের চা নিজেই বানিয়ে নিই, একদিন নাহয় তুমি তোমারটা বানালে।"


"তোমার চাকরি আর আমার চাকরি এক নয় , তোমাদের সারাদিন বসে বসে ছাত্র পড়ানো আর খাতা দেখার কাজ , যাকে বলে আরামের চাকরি, কিন্তু আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত বসকে তেলিয়ে চলতে হয়। হার্ড আর্নড মানি, ওসব তোমরা বুঝবে না।"


"বুঝি, যখন মাইনের অর্ধেকটা হাউস বিল্ডিং লোনের পিছনে চলে যায় তখন হাড়ে হাড়ে টের পাই হার্ড আর্নড মানি কি জিনিস, যখন তোমার গাড়ির ই.এম.আই আমাকে মাসের পর মাস গুনতে হয় তখন বুঝি হার্ড আর্নড মানি কি জিনিস।" কথাগুলো কড়া গলায় বলে অপর্ণা।

সৌম্য কিছুক্ষণ কদাকার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে চলে যায় ।


বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা ভালো ভাবে দেখে অপর্ণা , মনে মনে ভাবে ,"একটু ঘষে মেজে নিতে পারলে খুব খারাপ লাগবে না।"


ফ্রেস হয়ে বাইরে এসে ফোনটা হাতে নেয় অপর্ণা, ভাগ্যিস আজকে মনে করে সুমির ফোন নাম্বারটা নিয়ে নিয়েছিল।


নাম্বারটায় ডায়েল করে অপর্ণা।


ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হতেই ও বলে,"শোননা সুমি, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।"


ওপাশ থেকে সুমি বলে,"বল"


"তোর মেঘালয়ের ট্রিপটা যেন কবে?"


"কালকে, কেন বলতো?"


"কদিনের ট্রিপ রে ?" সুমির প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলল অপর্ণা।


"ষষ্ঠীর দিন ট্রেনে উঠবো, সপ্তমীর সকালে পৌঁছোবো। কেন এইসব জিজ্ঞেস করছিস রে?" সুমি জিজ্ঞেস করল।


"না মানে আরেকজনের বুকিং করা যাবে রে?"


"এইভাবে শেষ মুহূর্তে তো আরেকজনেরটা অ্যারেঞ্জ করা মুশকিল। কে যাবে বলতো?"


"আমি।"


"তুই!"


"হ্যাঁ রে, আসলে নিজের সাথে হানিমুন করাটা বাকি রয়ে গিয়েছিল, এবার পুজোয় ভাবছি সেটা করে নেবো।"


সুমি বলে,"কোনো চিন্তা করিসনা, আমি যেভাবে পারি ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি, তুই শুধু ব্যাগ গুছিয়ে চলে আয়‌। বাই।"


"বাই।"


ফোনটা রেখে দেয় অপর্ণা।


তাড়াতাড়ি ব্যাগ নামিয়ে ড্রেস গুলো গুছাতে লাগল অপর্ণা।

সৌম্য ঘরে এসে এসব দেখে বলে,"ব্যাগ গুছাচ্ছো যে? কোথায় যাচ্ছো? বাপের বাড়ি?"


হেসে উত্তর দেয় অপর্ণা,"নাহ্ , হানিমুনে যাচ্ছি, নিজের সাথে।"


"মানে?"


"মানে নিজেকে নতুন করে চিনতে যাচ্ছি, নিজের সাথে প্রেমালাপ করার বড্ড প্রয়োজন পড়ে গেছে। ঝুমাকে বলে যাবো, তোমার খাওয়াদাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না। সপ্তমীর দিন সকালে চলে আসবো, চিন্তা কোরোনা। পুজোয় তোমাকে একা রেখে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াবো না, যেমনটা তুমি করেছিলে আমাদের বিয়ের পর প্রথম পুজোয়।"


বলে আবার ব্যাগ গুছানোয় মন দেয় অপর্ণা। 

হানিমুনে যাচ্ছে বলে কথা!


কলমে-আশালতা



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics