মনে প্রাণে - খাতায় কলমে
মনে প্রাণে - খাতায় কলমে
নিজেকে আরেকবার আয়নার সামনে দেখে নিলো লাবণ্য।
নাহ্, তুতে রঙের লিলেন শাড়িটার সাথে কালো ব্লাউসটা মানিয়েছে ভালো। চুলটা খানিকটা ছেড়ে পিছনে একটা ক্লাচার দিয়ে নিল। সব শেষে হালকা গোলাপি রঙের ম্যাট ফিনিশ লিপস্টিক একটু ঘষে নিল।
ব্যাস্ একদম পারফেক্ট লাগছে প্রোফেসর লাবণ্য মুখার্জীকে।
লাবণ্য মুখার্জী, নামটা শুনলে সাউথ ক্যালকাটার ভবানীপুরের লোকেরা থরথর করে কাঁপে। অমন ডাকসাইটে সুন্দরী প্লাস রাগী স্বভাবের ভদ্রমহিলা থুড়ি ভদ্র মেয়ে বড়ই বিরল।
বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ, মায়ের কথায় বিয়ের জন্য একদম সঠিক বয়স।
লাবণ্যর বিয়ে করতে না চাওয়ার পিছনে অবশ্য একটা কারন আছে।
বাংলায় পি.এইচ.ডি করা লাবণ্যর দাবি, যে ওর জীবনসঙ্গী হবে তাকে নাকি খাঁটি বাঙালি হতে হবে।
বাংলার সাহিত্যে থাকতে হবে অগাধ জ্ঞান। উচ্চারণ হতে হবে স্পষ্ট। ব্যাস আর কিছু চাইনা।
এরপর পাত্র রোগা হোক , মোটা হোক, লম্বা হোক, বেটে হোক, কালো হোক ফর্সা হোক, আমাদের লাবণ্য দেবীর তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
খুব বেশি চাওয়া হল কি? না মনে হয় তাই না?
কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন পাত্র এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউই বাংলা সাহিত্যে এমন পারদর্শী নয় তাই লাবণ্য আপাতত আইবুড়োই আছে।
তবে কতদিন থাকবেন সেটা একটা বড় প্রশ্ন, কারণ লাবণ্যর মা চিত্রা দেবী ম্যাট্রিমোনিয়াল অ্যাপ ঘেঁটে ঘেঁটে একটি সুপাত্রের খোঁজ পেয়েছেন।
ছেলে নাকি সরকারি অফিসে ভালো মাইনের চাকরি করে, তাছাড়া বয়সও এখনও তিরিশ ছোঁয়নি। চিত্রা দেবীর ভাষায় বলতে গেলে সেই অমূল্য রত্নটি কলকাতাতেই থাকে।
আর তার সাথে দেখা করতে যেতেই লাবণ্যর আজ এত সাজের বাহার।
লাবণ্যর এতটুকুও ইচ্ছে নেই ওই ছেলের সাথে দেখা করার, তবু মা ঠেলেঠুলে পাঠাচ্ছেন।
নিজের চোদ্দ গুষ্টিকে গালি দিতে দিতে গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করল লাবণ্য, তারপর সেটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পাত্র দেখতে।
প্রায় পাঁচ মিনিট হল তূর্য এসে বসেছে কফিশপটায়। ফোন করবে কি করবেনা ভাবছে এমন সময় শ্রীমতি শ্মশান কালি মানে আমাদের লাবণ্য দেবীর আগমন ঘটল।
কিছুক্ষণ ইতিউতি চাইলো লাবণ্য, তারপর ফোনটা বের করে তূর্যকে কল করল ।
"হ্যালো , আমি পৌঁছে গিয়েছি, আপনি কোথায়?"
তূর্য ফোনটা কানে রেখে লাবণ্যকে লোকেট করে ওর দিকে হাত নাড়ে।
লাবণ্যও দেখতে পেয়ে ওর টেবিলের দিকে যায়।
"রোদের মধ্যে এসেছেন, জল দিতে বলি?" তূর্য কথা শুরু করল।
বরাবরের ঠোঁটকাটা লাবণ্য বলে দিলো, "আপনি না বললেও ওরা কমপ্লিমেন্টারি সার্ভিস হিসেবে দেবেই।"
তূর্য একটু ভড়কে গেল।
আমতা আমতা করে বলল,"না আসলে আমি তো..."
"জানি ফর্মালিটি করছিলেন।" লাবণ্য হেসে বলে।
তারপর একটু থেমে বলে,"আপনার নাম তূর্য সেনগুপ্ত তাই না?"
"হ্যাঁ" তূর্য একটু হেসে বলে।
এরপরে দুই পক্ষই আর কোনো কথা খুঁজে পায় না।
অনেক্ষন নিরবতা পালন করার পর তূর্য জিজ্ঞেস করে,"আপনি কলেজের প্রোফেসর তাই না?"
মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায় লাবণ্য।
"কোন সাবজেক্ট?" কনভার্সেশনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তূর্য।
"বাংলা।" লাবণ্য উত্তর দেয়।
"ও, ওয়াও! সাহিত্য? আমারও সাহিত্য পড়তে খুব ভালো লাগে। কিন্তু মুম্বাইয়ে বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ, তাই খুব বেশি বাংলা পড়া হয়নি।"
"কি! আপনি প্রবাসী বাঙালী?" রীতিমতো আঁতকে ওঠে লাবণ্য।
"ইয়া, হোয়াই ?" অবাক হয় তূর্য।
"তার মানে আপনি বাঙালি না বাঙ্গালী, আপনি ফুচকা না পানিপুরি খান, রসগোল্লাকে রসগুল্লা বলেন?" লাবণ্য জিজ্ঞেস করে।
"না, তা কেন? আর তাছাড়া আমি তো এখন কলকাতাতেই সেটেল্ড।" তূর্যর অবাক ভাব এখনও কাটেনি।
"আমার যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। দেখুন আপনার যদি সময় নষ্ট করে থাকি তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। কিন্তু আমার পণ আছে, বাংলা সাহিত্য জানে না এমন কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ে তো দুরের কথা, we can't even be friends . আসি কেমন? ভালো থাকবেন।"
বলে পিছন ফিরেছে লাবণ্য, এমন সময় পিছন থেকে তূর্য বলে উঠলো,
"তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি,
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার ,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।।"
লাবণ্য হতবাক হয়ে শুনছে, এত সুন্দর উচ্চারণ , এত সুন্দর বাচনভঙ্গি , কি সুন্দর রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করল ছেলেটা।
লাবণ্য মুগ্ধ হয়ে শুনছে।
তূর্য একটু হেসে বলল,"সব না পড়লেও কিছুটা সাহিত্য আমিও পড়েছি। মুম্বাইয়ে বড় হলেও রসগোল্লা আর ফুচকা আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে বাস করে। আর বাকি যেটুকু রসগোল্লার রস আর ফুচকার তেঁতুল জল বাকি আছে সেইটুকু তুমি নাহয় এই হৃদয় ভরে নিও। প্রেমটা টক ঝাল মিষ্টি থেকে ক্ষীর দইয়ের ন্যায় জমে যাবে সখী।" বলে হেসে ওঠে তূর্য।
হেসে ফেলে লাবণ্যও।
তূর্য আবার জিজ্ঞেস করে,"শেখাবে তো? আমি কিন্তু মনে প্রাণে খাতায় কলমে শুদ্ধ বাঙালি।"
লাবণ্য সলজ্জ হাসি হেসে বলে,"জানি না , যাও তো।"
কলমে-আশালতা
