ঝি ঠাকুরাণী
ঝি ঠাকুরাণী


"আরু মা বলি এই আরু মা , কোথায় গেলি রে , দেখ দেখ তোর বাপ তোর জন্যি কি এনেচে।" নরেন হাঁক পারতে পারতে দাওয়ায় এসে বসে । একটু দম ফেলে গলার গামছাটা দিয়ে ঘাম মোছে।
বাবার গলার আওয়াজ শুনে ছোট্ট আরু একটা ঘটিতে করে জল ভরে নিয়ে আসে।
"নাও দেকি বাবা, হাতমুখ ধুয়ে নাও, সারাদিন রোদে পুড়ে খাটাখাটুনি, এত ধকল কি শরীরের উপর সহ্যি হয়?" বড়দের মতন কোমরে হাত দিয়ে বলে ওঠে আরু।
হেসে ফেলে নরেন। মেয়ে তো নয় যেন মা।
মেয়েটার দিকে তাকালে বড় কষ্ট হয় নরেনের। ওই ডাগর ডাগর দুটি চোখ, পানপাতার মতন মুখ এমন মেয়ের যে রাজরানী হওয়ার কথা । তা না হয়ে সে এই চাষাভুষোর ঘরে জন্ম নিলো।
কি বা দিতে পারে মেয়েটাকে? ওই তো বর্ষায় খরের চাল ফুটো হয়ে জল পড়া আর দুবেলা একমুঠো করে ভাত , তাও ঠিক করে জোটেনা ।
নামটাই যা রানির মতন দিয়েছিলো, আর কোনোটাই নয়।
কিন্তু সাত বছরের অরুন্ধতীর এইসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ও ওর মা বাবাকে নিয়ে দিব্যি আছে। খালি মাঝে মধ্যে মনে হয় ওর বাড়ির সামনে দিয়ে ছেলেরা যেভাবে স্লেট আর খড়ি নিয়ে পাঠশালায় যায়, ও যদি যেতে পারতো তা হলে খুব মজা হত।
ও ওর মায়ের মুখে শুনেছে , আসছে মাসে ও আট বছরের হলে ওকে মা সাথে করে নিয়ে যাবে ওই জমিদার বাড়িতে, কাজ করার জন্য।
জমিদারবাড়িতে এর আগে বেশ কয়েকবার গেছে আরু। ওর মা তো জমিদারবাড়িতে ঝি গিরি করে তাই পুজো পার্বনের দিনে আরুকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
সেই বাড়িতেই এবার থেকে কাজ করতে হবে আরুকে। তাহলে ঘরে দু পয়সা বেশি আসবে।
নরেনের হাতমুখ ধোঁয়া হলে সে আরুকে বলে,"এই দেখ দেখ, কত কাঁচামিঠে আম এনেচি তোর জন্যি। ওই রাখালদের বাড়ির পিছনের গাছটার তলায় কত আম পড়েচিল , আমি কুড়িয়ে এনেচি।"
আরু খুশি হয়ে বলল,"দাঁড়াও , আজ দুপুরে এই আমগুলোকে ভালো করে মাখবো।"
তারপর বলে,"এই যাঃ , বাড়িতে তো কাঁচালঙ্কা ফুরিয়ে গেছে। ওইটা ছাড়া আম মাখা ভালো লাগে নাকি? দাঁড়াও, কমলাদের উঠোন থেকে দুটো ছিঁড়ে আনি।"
"আরে আস্তে যা, পড়ে যাবি তো।" নরেন চেঁচায়।
আরু ছুটতে ছুটতে কমলাদের বাড়িতে আসে।
"জেঠিমা গো, তোমার গাছের থেকে কটা লঙ্কা নিলুম।" চিৎকার করে বলে আরু।
"নিয়ে যা।" কমলার মা রান্নাঘর থেকে বলেন।
আরু লঙ্কা তুলছে এমন সময় কমলা ঘরের থেকে বেড়িয়ে আসে।
"লঙ্কা নিয়ে কি করবি রে আরু?" কমলা জিজ্ঞেস করল।
"বাবা কাঁচা আম এনেছে। মাখবো ভালো করে। ওবেলা আসিস , খেয়ে যাস।" আরু লঙ্কাগুলো তুলে নিয়ে বলে।
কমলা মুখটা একটু কালো করে বলে,"দেখ দেকি, আমাদের গাছটায় এবার মোটে গুটিকয়েক আম ফললে, আর বাকি যে আমের মুকুল ছিল তার সবটাই ঝরে পড়ে শেষ হয়েছে আর নাহলে পাখিতে এসে খেয়ে গেছে।"
"মন খারাপ করিস নে কমলা" আরু বলল, "পরের বছর দেকবি আবার ফলবে ক্ষণ। যাকগে যাক, আমি এখন যাই কেমন? মেলা কাজ পড়ে আছে আমার।"
এই বলে যেমন ছুটতে ছুটতে এসেছিলো তেমনই ছুটতে ছুটতে চলে গেল আরু।
বাড়িতে এসে রান্নাঘরে ঢুকে লঙ্কাগুলো রেখে আবার বেড়োতে যাচ্ছিল আরু এমন সময় পিছন থেকে মা সুভাগা ডাক দিলো,"এই ভরদুপুরে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?"
আরু একটু ভয় ভয় বলল,"পুকুর পাড়ে, মাছ ধরা দেখবো।"
সুভাগা চোখ গরম করে বলল,"তোরে না আমি কতবার কয়েছি , এমন হুটহাট করে বাইরে বেড়িয়ে যাওয়া মেয়েমানুষরে শোভা পায়নে?"
"কিন্তু ওবাড়ির দাদারা যে গেলো?" আরু বলল।
"ওরা পুরুষমানুষ, যেখানে খুশি যেতে পারে, কিন্তু আমরা মেয়েরা একা কোতাও গেলে যে অন্যের কুনজর পরে। মেয়েমানুষরে অনেক বাঁধানিষেধ মেনে চলতি হয়।" সুভাগা মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
আরু একটু অবাক হয়ে বলল,"মেয়ে বলে কি মানুষ নয়?"
সুভাগা এ কথার উত্তর খুঁজে পায়না।
তাই মুখে বলে,"যা বলছি তাই শোন, এত প্রশ্ন করবি নে।"
আরু এত কিছু বুঝলো না। সে বাইরে না যেতে পারার দুঃখে উঠোনেই বসে পড়ে।
তারপর মায়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে,"আমায় বাইরে যেতে দিলে নে তো? দেখো, ওবেলা আম মাখবো, তোমায় কম দেবো।"
মেয়ের এমন কথা শুনে হেসে ফেলে সুভাগা। মেয়েটা একেবারেই পাগলী।
"ঠিকাছে দিস নে, মাকে আর দিবি কেন? মা তো খারাপ।" কপট দুঃখ দেখিয়ে বলল সুভাগা।
জিভ কাটে আরু। একটু বেশিই বলে ফেলেছে বোধহয়।
ভিতরে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে বলল,"থাক আর মন খারাপ করতে হবে নে, তোমাকেও দেবো।"
সুভাগা হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
আজ জমিদারবাড়িতে সবাই ভীষন ব্যস্ত। তাদের ছোটো ছেলে অনন্ত আজ বাড়িতে ফিরছে। এই ছোটো ছেলের বিষয়খানা ভারি অদ্ভুত।
কোন এক পণ্ডিত তার হাত দেখে বিচার করেছিলেন যে এই ছেলের নাকি দশবছর বয়সে বিরাট বিপদ আসতে পারে তাই এই স্থানে থাকা তারপক্ষে নিরাপদ নয়।
তাই তাকে পাঁচবছর বয়সে তাকে জমিদারমশাই মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
এতগুলো বছর বাড়িতে ফেরেনি সে।
কিন্তু জমিদারমশাইয়ের এখন ছোটো ছেলেকে বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
বড় ছেলে দিগন্ত একেবারেই কুলাঙ্গার। দিনরাত মদ আর মেয়েমানুষের নেশায় মত্ত থাকে সে, তাই ব্যাবসার কাজকর্ম তাকে দিয়ে হয়না। জমিদারমশাই এখন আর একা দেখা শোনা করতে পারেন না। বয়েস তো হয়েছে। তাই ছোটো ছেলেকে এবার বাড়িতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সেই ছোটো ছেলে আসবে বলে বাড়িতে আয়োজনের শেষ নেই।
হেঁসেলে কত কি ভালোমন্দ রান্না হচ্ছে। সারাটা বাড়ি পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। অনন্তের ঘরটা দামী আসবাব দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
জমিদার গিন্নি আজ সারাদিন উপোস করে আছেন, ছেলে বাড়িতে এসে কিছু মুখে না দেওয়া পর্যন্ত উনি কিচ্ছুটি মুখে তুলবেন না।
আরু আজ মায়ের সাথে জমিদারবাড়িতে এসেছে। বিশাল বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে সে।
কি সুন্দর সাজানো হয়েছে বাড়িটা।
আরু আজ ভিতরে ভিতরে ভীষন উত্তেজিত। সে শুনেছে ছোটো বাবু আসছেন বলে নাকি বাড়িতে বাঈজী নাচের আসর বসবে।
কোঠিবাড়ির থেকে বিখ্যাত মল্লিকাজান আসবে । তার আসর নাকি মেলা জমজমাটি হয়।
সাহেবরাও নাকি নিজেদের উৎসবে এনাকে বায়না করেন।
আরু আজ পর্দার আড়াল থেকে সেই নাচ দেখবে। কি যে ভালো লাগছে ওর।
এগুলো ভাবতে ভাবতেই বাড়ির সদরে নেমে এসেছিল আরু হঠাৎ কারোর সাথে ধাক্কা লাগায় চোখ তুলে চায়।
একটা অল্পবয়সী ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।
"আশ্চয্যি কাণ্ডি তো? একে তো আমায় ধাক্কা মারলেন আবার অমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকা হচ্ছে?" আরু কোমরে হাত দিয়ে বলে উঠলো।
এই শুনে ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল,"আমি কই ধাক্কা দিলাম, তুমিই তো নিজের খেয়ালে চলছিলে।"
আরু বলল,"সে যাই হোক, কিন্তু আপনি কে?"
ছেলেটা এবার একটু হেসে বলল,"আমি অনন্ত, এ বাড়ির ছোটো ছেলে।"
আরু কিছুক্ষণ অবাক করে চেয়ে রইল, তারপরে বলল,"হাঁ ভগবান, দেকেছো আমার বুদ্ধি, শেষে কিনে বড় বাড়ির ব্যাটারেই দশকতা শুনিয়ে দিলুম। আপনি যেন কিচ্ছুটি মনে করবেন নে দাদাবাবু। আমি চললুম।"
এই বলে এক ছুটে সেখান থেকে পালালো আরু।
অনন্ত দুই বিনুনি করা, কোমরে আঁচল গোঁজা মিষ্টি মেয়েটার কথার তোড় শুনে আপন মনেই হেসে উঠলো।
"পাগলি একটা!" বলে ফেললো।
ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই যতন আত্তির বন্যা বয়ে গেল অনন্তের উপর দিয়ে।
জমিদার গিন্নির আর ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে অাঁশ মিটছে না।
অবশেষে অনন্ত নিজের ঘরে একটু বিশ্রাম করার সুযোগ পেলো।
জমিদারমশাই ওকে আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন সন্ধ্যেবেলার আসরের কথা।
এই বাঈজী আসরের প্রথা অনন্তের কোনোকালে পছন্দ হয়নি। কেমন যেন লাগে বিষয়টা। মনে হয় ওই আবেদনময়ী মেয়েগুলো কাজটা মন থেকে করে না, এই কামার্ত সমাজ ওদের দিয়ে জোর করে করিয়ে নেয়।
কিন্তু বাবা মশাইয়ের মুখের উপর না তো বলা যায়না , বিশেষ করে তার জন্যই যখন এত আয়োজন।
তাই আর না ভেবে বিছানায় গা টা এলিয়ে দেয় অনন্ত। শুতে না শুতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়।
বিকেলবেলা থেকে যাই ঘটছে তা দেখেই অবাক হচ্ছে আরু।
বাঈজী নাচের আসর খানা কি সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে।
চারিদিকে ফুলের তোড়া রাখা আছে। মান্যিগন্যি মানুষেরা আসবেন তাদের জন্য লাল রঙের ফুলকাটা কাপড় দিয়ে আসন পাতা হয়েছে।
একপাশে দুরে চিক টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে মেয়ে বউরাও নাচ দেখতে পারে। মেয়েদের নাচ দেখার নিয়ম নেই কিন্তু জমিদারমশাই মেয়েদের সেই সুযোগখানা দেন।
আরু বড় বড় চোখে দেখছে , একটা বড় রূপোর থালায় বেল ফুলের ছোটো ছোটো মালা রাখা আছে।
মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিল, যে বাবুরা নাচ দেখতে আসবেন তাদের হাতে সেই মালা বেঁধে অভ্যর্থনা জানানো হবে।
আরুর আর তর সইছে না, কতক্ষণে নাচ শুরু হবে।
সেও আজ মায়ের থেকে চেয়ে একটা সুন্দর লাল টুকটুকে শাড়ি পড়েছে, সাথে কপালে একটা ছোট্টো টিপ। চুলগুলো বেঁধে দুপাশে দুটো ছোট খোঁপা করা। আরুও সেজেছে আজকে।
অনন্ত উত্তরীয়টা ঠিক করে নেয়। তারপর ঘরের দোড় খুলে আসরের দিকে পা বাড়ায়।
অন্যান্য অতিথিরাও আসা শুরু করেছেন, যে যার জায়গায় গিয়ে বসেছেন।
অনন্তের দাদা দিগন্ত আসর বসবার আগেই তিন চার পেয়ালা মদ পেটে ঢেলে ফেলেছে। সবার মাঝখানে বসে বসে সে ঢুলছে।
দাদাকে এমন অবস্থায় দেখে গা টা ঘিনঘিন করে ওঠে অনন্তের।
আরু চিকের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলো, সব অতিথিদের গায়ে কেমন আতর আর গোলাপ জল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
একসময় সবাই নিজেদের আসন গ্ৰহণ করার পরে একজন নর্তকী ভিতরে এসে সবাইকে সালাম ঠুকে বলল,"মল্লিকাজান আসছেন।"
সবাই বেশ একটু নড়ে চড়ে বসলেন।
বেয়ারারা এসে একটা লাল পর্দা টাঙিয়ে দিলো। ঘুঙুরের ছমছম আওয়াজে সবাই বুঝতে পারলো পর্দার আড়ালে কারোর প্রবেশ ঘটল।
এরপর আস্তে আস্তে পর্দা সরে যায় আর সামনে ফুটে ওঠে মল্লিকাজানের মনমোহিনী রূপ।
সবাইকে সালাম জানিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন তিনি।
সেই হাসিতে পবিত্রতা নেই আছে শুধুই আবেদন।
আরুর ওই হাসি দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হল। সবাই কি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই নাচনেওয়ালীর দিকে।
মল্লিকাজান আর তার সহচরীরা নাচগান শুরু করলো। মেতে উঠেছে আসর।সবাই তবা তবা করে উপভোগ করছে, পয়সা ছুড়ে দিচ্ছে ওদের দিকে, সেই সাথে মদের ফোয়ারা ছুটছে চারদিকে।
আরুর কেমন যেন গা পাকিয়ে উঠলো , এক ছুট্টে বেরিয়ে গেল সে চিকের পিছন থেকে সোজা অন্দরমহলে।
আসরের শেষের দিকে নেশা এমন চড়ে গেল যে দিগন্ত সমেত আরও অনেক বাবুরা সেই বাঈজীর সাথে নাচা শুরু করলো। দিগন্ত তো এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে যে পারলে মল্লিকাজানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দোড়ে খিল দেয়।
অনন্তর এইসব দেখে বিরক্ত লাগছিলো তাই সে আসর ছেড়ে বেরিয়ে পরে।
সোজা ছাদে চলে যায় অনন্ত।
সেখানে উঠে দেখে....
অনন্ত আরুর দিকে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
তারপর জিজ্ঞেস করল,"তুমি এখানে একা দাঁড়িয়ে কি করছো?"
আরু হঠাৎ কারোর গলার আওয়াজ পেয়ে প্রথমে একটু চমকে উঠলো তারপর পাশে অনন্তকে দেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,"আপনারা বড়লোকেরা ওইসব কি নাচগান দেখেন বলুন তো। ওই মেয়েটা কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিল আমার কেমন একটা জানি লাগছিল।"
আরুর মুখে এমন কথা শুনে অনন্ত হো হো করে হেসে উঠলো।
আরু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অনন্তের হাসির দিকে। কি সুন্দর হাসিটা!
অনন্তর হাসির দমক কমে আসলে ও জিজ্ঞেস করল,"তা কেমন কেমন লাগছিল শুনি।"
হঠাৎ এমন প্রশ্নে আরু একটু লজ্জা পেয়ে গেল। মাথাটাকে নিচু করে বলল,"জানি নে আমি।"
অনন্ত ফের প্রশ্ন করল,"তা থাকা কোথায় হয় ?"
আরু ছাদের থেকে সোজা আঙ্গুল দেখিয়ে দিল,"ওই তো ,ওই নদীর পারেই ঘর আমাদের।"
নীচে আরুর ডাক পড়েছে তাই আরু চলে গেল।
অনন্ত খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,"মেয়েটা খুব দুরন্ত, বেশ ছটফটে স্বভাবের। মুখখানাও মিষ্টি।"
ভাবতে ভাবতে নিজেই হেসে ফেললো।
অন্য দিকে ছোট্টো আরু বাড়িতে ফিরে মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবছে,"ছেলেটার হাসি ভারী সুন্দর, আমিও যদি ওইরকম ভাবে হাসতে পারতাম, ঈশ্।"
আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো আরু।
পড়ের দিন ভোরে উঠেই আরু সবার আগে চলে গেলো পুকুর পাড়ে। জল তুলে আনলো তাড়াতাড়ি করে।
এই কাজটা ওর মাই ওকে দিয়েছে। মেয়েদের নাকি ছোটো থেকেই সংসারের খুঁটিনাটি শিখে রাখা ভালো।
জল ভরে এনে একপাশে রেখে দিয়ে আরু জিজ্ঞেস করল,"মা, ওই বড় বাড়িতে আমাকে কবে থেকে কাজ করতে যেতে হবে?"
প্রশ্নটা শুনে সুভাগার বুক ফেটে গেল। এতটুকু মেয়েকে কি ওর কাজে পাঠাতে ইচ্ছা করে? তাও আবার ঝি গিরি করতে!
কিন্তু গরিব ঘরের মেয়েকে অত তুলো তুলো করে রাখলে চলে না। তাই সুভাগা বলল,"এই তো আর দু চার দিন পর থেকে।"
আরুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে জানে সে কাজে গেলে তাকেও পয়সা দেওয়া হবে আর পয়সা পেলে তার বাবা মায়ের কিছুটা সাহায্য হবে।
সাড়ে সাত বছরের মেয়েটাও সংসারের অভাব অনটনের কথা বুঝে গিয়েছে।
কিন্তু এটা তো ভবিতব্য নয়। ওর কপালে যে অন্য কিছু লেখা আছে।
একেকটা দিন একেকটা নতুনের শুরু। তার সাথে জড়িয়ে থাকে কত গুলো পুরাতন স্মৃতির হিসেব।
কিছু স্মৃতি অস্পষ্ট, আবছা, মলিন, কিছু স্মৃতি একেবারেই মুছে গিয়েছে আবার কিছু স্মৃতি সম্পূর্ণ নতুন। মনে হবে যেন কালকেরই তো ঘটনা।
একটা ছোট্ট চারাগাছ আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। সূর্যের আলো , জল , সার সবকিছু দিয়ে যেমন একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে সে আরুও ঠিক তেমন ভাবেই একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
ভাবতেই অবাক লাগে নরেন আর সুভাগার। এই তো সেইদিনই আরু হল।
আজও মনে আছে সেই দিনটি। আঁতুড়ঘরের সামনে পাড়ার কিছু বউ দাঁড়িয়ে ছিলো। ভিতরেও কয়েকজন ছিলো। মেয়ে হয়েছে শুনে সবাই মুখ কালো করে নরেনের মাকে বলেছিলো,"বংশের পিদিম এলো নে গো ঠানদিদি। কি আর করবে, মেয়ে হয়েছে। সুরাহা কিছু হল নে তোমাদের।"
পঁয়ষট্টি বছর বয়সী নরেনের মা সেইদিন তেড়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন,"মুখপুড়ীর দল সব, আমার নাতনীরে লইয়া একখান বাজে কথা যেন তোদের মুখে না শুনি। ওই মেয়েই একদিন আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেকে নিস তোরা।"
বউরা বাঁকা হেসে বলেছিলো,"মেয়ে মানুষ নাকি মুখ উজ্জ্বল করবে!"
মাঝে মধ্যে এখন সেই মৃত মায়ের টাঙানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবে নরেন,"তোমার নাতনী মুখ উজ্জ্বল করতে পারলো নি মা, আর তার জন্যি আমি দ্বায়ী। ওইটুকুন মেয়েরে জমিদার বাড়িতে পাঠাতি হইবে , কাজ করানোর জন্যি।"
কথাটা সত্যি। আরুর আট বছর হয়ে গিয়েছে। এবারে তো তারও জীবনের যাতাকলে পিষে মরার সময় এসেছে।
কিন্তু ওইযে, শুরুর থেকে একটা কথা বলে আসছি।
সব মেয়েরা পিষে মরার জন্য আসেনা। কেউ কেউ মাথা উঁচু করে বাঁচতে জানে।
আর যারা তাদের পায়ের তলায় পিষতে চায় তাদের পা ছেটে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতাও তাদের থাকে, যাতে সেই পা আর কখনও তাদের খোলা আকাশের উপর কালো ছায়া না ফেলতে পারে।
"আরু তাড়াতাড়ি কর, দেরী করিসনে এত।" সুভাগা ডাক দিলো মেয়েকে।
আরু কোমড়ে আঁচল গুজতে গুজতে বাইরে বেরিয়ে এলো।
"চলো মা।" বলে সুভাগার হাতটা ধরলো।
আজ থেকে আরু জমিদারবাড়িতে কাজে যাবে।
দুদিন হল আট বছরে পড়েছে আরু ।
ওইটুকু মেয়েকে কি কাজ দেবেন বুঝে পাননি জমিদার গিন্নি। কিন্তু সুভাগা হাতে পায়ে ধরায় তিনি, আরুকে বলেছেন ছোটোবাবু মানে অনন্তর কি লাগবে না লাগবে সেই বিষয় খেয়াল রাখতে।
মাস গেলে চার আনা করে পাবে আরু।
গরিবের ঘরে এই বা কম কি?
সুভাগা জমিদার বাড়িতে যেতেই জমিদার গিন্নি আরুকে ডেকে নিলেন।
"দেখ আরু, এইটুকু বয়েসে তুই আর কি করবি? আমার ছোটো ছেলেটার একটু খেয়াল রাখবি, ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে হাতে এগিয়ে দিবি, তাহলেই হবে। পারবি তো?" জিজ্ঞেস করেন জমিদার গিন্নি।
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় আরু।
"তাহলে যা দেখি, হেঁসেলের থেকে ওর জলখাবার টা নিয়ে ওর ঘরে দিয়ে দে। খাওয়ার দিয়ে কিন্তু চলে আসবি নে, ওর পাশে বসে ওকে হাওয়া করবি কেমন?দেখি তো, এই বাড়ির ছোটো ঝি ঠাকুরাণী কেমন কাজ পারে।" জমিদার গিন্নি হেসে বললেন।
একটু হেসে চলে যায় আরু ঘরের থেকে।
জমিদার গিন্নি মহামায়া দেবীর জমিদারী ঠাট বাট থাকলেও মনটা ভারি নরম। ওইটুকু মেয়েকে দিয়ে তাই বেশী কাজ করাতে চাননি উনি।
হেঁসেলে গিয়ে খাওয়ারের থালাটা নেয় আরু তারপরে সোজা চলে যায় অনন্তর ঘরে।
অনন্ত একটা দরকারি দলিল খুঁটিয়ে দেখছিলো।
এমন সময় আরু শ্বেত পাথরের টেবিলের উপর থালাটা রাখতেই অনন্ত ওর দিকে তাকায়।
আরুকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয় অনন্ত। সেই গত সপ্তাহে মল্লিকাজানের আসরের পরে আর সাক্ষাৎ হয়নি ওদের।
"অরুন্ধতী, তুমি এখানে?" অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
"আপনার খাওয়ারটা দিতে এয়েছিলুম।" আরু মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল।
"কিন্তু এইসব তো ঝিয়ের কাজ, তুমি কেন করছো?" অনন্ত অবাক হয়ে বলল।
"আমিও তো ঝি । এই বাড়ির ছোটো ঝি ঠাকুরাণী। আর আপনার দেখাশোনা করাই আমার কাজ। গিন্নিমাই দিয়েছেন আমাকে এই দ্বায়ীত্ব।" আরু ধীর কণ্ঠে বলল।
অনন্তর মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। ওর মনে পড়ে গেল আরুর বয়েসে ও পাঠশালায় পড়তে যেতো, বন্ধুদের সাথে খেলতো।
কিন্তু আরুকে এই বয়স থেকে লোকের বাড়ি কাজ করতে হচ্ছে।
এটা কি শুধুই দারিদ্রতার জন্য, নাকি আরু মেয়ে জন্য ও এইগুলো কাজ করতে বাধ্য?
আরু ততক্ষণে পাখাটা নিয়ে বাতাস করতে শুরু করেছে অনন্তকে।
অনন্ত আরুর হাত থেকে পাখাটা নামিয়ে বলল,"এইসব দয়া করে কোরোনা।"
"কিন্তু গিন্নিমা যে বললেন।" আরু বলল।
"আমি অক্ষম নই অরুন্ধতী, কাউকে আমার হয়ে সব কাজ করে দিতে হবেনা। নিজের কাজটুকু আমি নিজে করে নিতে পারি। তুমি বোসো দেখি আমার সামনে।" অনন্ত বলল।
"ছিঃ, ছিঃ, কি যে কইছেন আপনি। মালিকের বিছানায় আমি বসতে পারবো নে। ওতে যে আমার পাপ লাগবে।" আরু প্রতিবাদ করে ওঠে।
অনন্ত ভাবতে থাকে এত ছোট মেয়েটাকে এই বয়েসেই মালিক আর চাকরের ভেদাভেদ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আর কিছু না বলে খাওয়ারটা খেয়ে নেয় ও।
খাওয়া শেষ হতেই থালাটা নিয়ে চলে যায় আরু।
অনন্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথের দিকে।
কথায় আছে মেয়েরা নাকি ছেলেদের তুলনায় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। সাংসারিক বুদ্ধি তারা আগে বোঝে। কথাটা ভুল।
মেয়েদের ছোটো থেকেই শেখানো হয় তাদের জন্মই হয়েছে পরের সংসারে বিনা পয়সার চাকরানী হয়ে থাকার জন্য। আর এছাড়াও "ওখানে যেওনা , এটা কোরোনা , পুরুষের থেকে নিজেকে সামলে রাখো" এই সামলাতে সামলাতেই যে মেয়েরা কবে এত বড় হয়ে যায় বোঝাই যায়না।
পুতুল খেলার বয়েসে নিজেরাই অন্যের খেলার পুতুল হয়ে যায় , ওরা জানতেও পারে না।
কথাগুলো আজকাল খুব ভাবায় অনন্তকে। মেয়েদের জন্য ভাবত ও অনেক আগে থেকেই, কিন্তু আরুকে দেখার পর থেকে যেন বিষয়টা ওর মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে।
কেন মেয়েরা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে পারবে না, কেন সমাজের পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের মতামত থাকতে পারবে না, কেন হাজার হাজার অরুন্ধতীকে ছোটো থেকেই সংসারের যাতাকলে পিষে মরতে হবে, এই প্রশ্নগুলোই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ।
আরু এই বাড়িতে কাজে ঢুকেছে তার প্রায় দেড় সপ্তাহ হতে চলল।
কাজটা ও মোটামুটি ভালোই করছে। আসলে গুছিয়ে কাজ করাটা ওর স্বভাব। যেই কাজই করুক না কেন, সেটাকে নিখুঁত ভাবে করে।
অনন্ত একদিন আরুকে জিজ্ঞেস করেছিল,"আচ্ছা অরুন্ধতী, তোমার লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে না?"
আরু মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিল ,"জানেন তো , আমাদের ঘরের রাস্তা দিয়ে যখন যদু দাদা, রাঘব দাদারা সবাই কাঁধে ঝোলা , সেলেট এইসব নিয়ে পাঠশালায় যায় আমারও তখন খুব ইচ্ছে করে ওদের সাথে যদি নেকাপড়া করতে যেতে পারতুম। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়।"
অনন্ত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল , "কেন? কেন হওয়ার নয়?"
"আরে আপনি জানেন নে? মা বলে মেয়েমানুষেরা নাকি নেকাপড়া করলে তারা বেধবা হয়ে যায়।" আরু গম্ভীর গলায় বলেছিল।
"এই সব কুসংস্কার অরুন্ধতী। এইগুলো মেনে চললে আমাদের সমাজ কোনোদিনই এগোবে না।" অনন্ত ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
"অতসত আমি বুঝিনে ছোটো বাবু, আমি শুধু জানি গরিবের ঘরে অত পড়াশোনা শোভা পায়েনে। দুই বেলা দুমুঠো ভাত জুটছে, এই ঢের। " কথাগুলো বলে চলে গিয়েছিল আরু।
আবার এই আরুই দুইদিন আগে ভাড়ারের ঘরের থেকে এক লেঠেলকে চাল চুরি করতে দেখে হেস্তনেস্ত কাণ্ড বাঁধিয়েছিল।
সেইদিনই বুঝে গিয়েছিলো অনন্ত। মেয়েটার ভিতরে আগুন আছে, শুধু একটু উস্কে দিতে পারলেই হল। পারলে এই মেয়েই পারবে সমাজে একটা বড়সড় ছাপ ফেলতে।
অনন্ত আরুকে একটু কাজ আছে বলে ঘরে ডাকলো। ডেকে বলল,"চলো আমার সাথে একটা ঘরে।কাজ আছে।"
আরু অনন্তের পিছন পিছন ঘরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে যায়।
এটা কি দেখছে ও? যেইদিকে তাকাচ্ছে শুধু বই আর বই । বিশাল বিশাল তাকে জুড়ে লাখ লাখ বই সাজানো।
বিস্মিত আরুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,"এত বই, বইয়ের মেলা লেগেছে যে।"
অনন্ত হাসিমুখে বলল,"এটাকে গ্রন্থাগার বলে।"
আরু একটু অবাক হয়ে বলে,"কি খটমট উচ্চারণ রে বাবা।"
হেসে ফেলে অনন্ত। তারপর বলে,"তুমি পড়বে এই এত বই?"
আরু মুহুর্তের মধ্যে ভুলে যায় মায়ের বলা কথা। ও মিষ্টি হেসে বলে,"আমি তো জানিনা কি করে লিখতে পড়তে হয়। আপনি দেবেন আমাকে শিখিয়ে? আমিও লিখতে পড়তে পারবো?"
অনন্ত হেসে বলে,"পারবে, সব পারবে।"
এইভাবে শুরু হয় আরুর লেখাপড়ায় হাতে খড়ি।
কখনো নিজের উৎসাহে , কখনো অনন্তের ধমক খেয়ে অক্ষরপরিচয় হয় আরুর।
"অরুন্ধতী, নে না , না বলো না। এই খাবো নে, পড়বো নে এগুলো ভুল উচ্চারণ। বলো পড়বো না।" অনন্ত কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে আরুকে সঠিক উচ্চারণ শেখানোর।
"পড়বো না।" বলে উঠে পড়লো আরু।
অনন্ত জিজ্ঞেস করে,"একি? উঠে পড়লে কেন?"
"ওই যে আপনি কইতে কইলেন, পড়বো না। তাই আমিও ঠিক করছি পড়বো না...." আরু বলে ওঠে।
"অরুন্ধতী দুষ্টুমী করে না।" চোখদুটো একটু বড় করে বলল অনন্ত।
অনন্তকে রাগ করতে দেখে বসে পড়ে আরু।
তারপর খানিকক্ষণ কিছু একটা ভেবে বলে,"আচ্ছা আমাকে তো সবাই আরু বলে ডাকে, আপনি কেন আমাকে অরুন্ধতী বলে ডাকেন?"
অনন্ত গম্ভীর গলায় বলল,"নিজের নামটাকে চিনতে শেখো অরুন্ধতী। কতটা রানিত্ব মিশে আছে নামটায় একবারও খেয়াল করেছো। নিজের নামটাকে কেটে ছেঁটে ফেলো না। তোমার নাম তোমার পরিচয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওটাকে হেলাফেলা করা মানে নিজেকে হেলাফেলা করা। নিজের পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করো অরুন্ধতী।"
আরু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অনন্তের দিকে। ছেলেটা এত ভারি ভারি কথা বলে কিছুই ওর মাথায় ঢোকে না।
এখনও হয়তো এত বোঝার সময় আসেনি, এখন শুধুই শেখার সময়। এই শিখতে শিখতেই একদিন অনন্তের প্রত্যেকটা কথার মানে বুঝবে আরু। সেই কথাগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করতে শিখবে।
নব জাগরণের জোয়ারে সবে তো নৌকাটা নামিয়েছে । এরপরে ভাসতে ভাসতে অনেকটা দুরে যেতে হবে। যাত্রার পদে পদে যে ঘূর্ণিঝড় অপেক্ষা করছে। তার সম্মুখীন হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে যে।
পর্বত শৃঙ্গ জয় করতে হলে তার মুখোমুখি যে দাঁড়াতেই হয়।
একটা মেয়ের শৈশব সহজ সরল ভাবে কাটলেও কৈশরে পা রাখতে না রাখতেই চোদ্দটা অসুবিধা এসে স্রোতের গতি রোধ করে।
আট বছরের সেই দুই বেনি দোলানো আরু এখন তেরো বছরের কিশোরী। সে এখন আর আগের মতন অবুঝটি নেই।
বরং ওর বয়সী মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি জানে বোঝে।
পরিবর্তন এসেছে এখন ওর জীবনে। সে এখন পরিপূর্ণ রূপে জমিদার বাড়ির ঝি ঠাকুরানীতে পরিণত হয়েছে। এখন শুধু ছোটো বাবুর খেয়াল রাখাই তার কাজ নয়।
সুভাগা বা বাড়ির অন্যান্য ঝি দের মতন ওকেও ভারি কাজে হাত লাগাতে হয়।
উঠোন থেকে কলসীর পর কলসী জল তোলা, উঠোন ঝাঁট দেওয়া, মাছ কুটে দেওয়া সবই ওর রোজনামচার মধ্যে পড়ে।
অনন্তর সাথে এখনও রোজ দেখা হয় ওর কিন্তু পড়তে বসা আর হয়না।
আরুর খুব বেশিদিন লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। ওই অক্ষরপরিচয় আর কয়েকটা ছোটো খাটো হিসেব, ব্যস ওই পর্যন্তই।
এরপরে একদিন আরুর মা বিষয়টা জানতে পেরে ওকে মাথার দিব্যি দেয় , আরু যাতে আর লেখাপড়া না শেখে।
মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে নাকি তাদের বিয়ে হয়না।
আরু মায়ের কথা রেখেছে। সে আর অনন্তর কাছে পড়তে যায়নি।
অনন্ত মনে মনে আঘাত পেলেও এই নিয়ে কিচ্ছুটি বলেনি। সেই ষোলো বছরের ছেলেটা এখন একুশ বছরের যুবক।
আরুকে এখন আর কাছে পায়েনা অনন্ত। ওই ছটফটে মেয়েটাকে এখন আর শান্ত করে বসিয়ে পড়ানো যায়না।
সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে মেয়েটা। তবু অনন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ওকে।
কবে যে আরু ওর মনে এতটা জায়গা জুড়ে ঘর বেঁধেছে বুঝতেই পারেনি ও।
তবে এখন বোঝে, নিজের মনের গোপন ঠিকানাটা খুঁজে পেয়েছে ও।
কিন্তু আরুকে নিজের করে পাওয়া সহজ নয় এ কথা ও জানে। এই বাড়ি, এই সমাজ কেউই মেনে নেবে না ঝি কে স্ত্রীর পরিচয় বরণ করা।
এখন তবু চোখের দেখাটুকু দেখতে পায় আরুকে। কিন্তু আরু তো এখন বড় হয়েছে। ওর বিয়ে হয়ে যাবে নিশ্চই কদিন পরে। তখন কি করবে অনন্ত?
আরু বুদ্ধিমতী মেয়ে । সে জানে অনন্ত ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, এও বোঝে অনন্ত ওকে কি চোখে দেখে। ও নিজেও তো মনের অনেকখানি তার ছোটো বাবুকে দিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু যেই সম্পর্কটা কোনোদিন পরিণতি পাবে না সেই সম্পর্কে জড়াতে চায়না। ও জানে ওর একটা ভুল পদক্ষেপ ওর গোটা পরিবারকে পথে বসাতে পারে।
তাই আরুও দুরে দুরেই থাকে।
আজ সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ করছে আরুর। তলপেটটায় খুব ব্যাথা করছে।
কাপড় ছাড়তে যেতেই শাড়ির উপর কাঁচা রক্তের দাগ দেখে রীতিমতো ভিড়মি খাওয়ার যোগার আরুর।
ভয় ভয় মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
সুভাগা কাজ করছিল, আরুকে দেখে বলল,"কি রে? কিছু কইবি?"
ফোঁপাতে ফোঁপাতে আরু বলল,"আমি বোধহয় আর বাঁচবো নে গো মা।"
বলে রক্ত মাখা আঁচলটা মেলে ধরল।
মেয়ের এমন কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেও আঁচলটা দেখে হেসে ফেললো সুভাগা। মেয়ের কি হয়েছে তা বুঝতে আর ওর বাকি নেই।
মেয়ের শাড়ি ছাড়িয়ে দিয়ে একটা সাদা কাপড় ওখানে লাগিয়ে রাখতে বলে বলল,"এটা যে এখন থেকে প্রতি মাসে হবে তোর।"
"এই অসুখ কোনোদিন সারবে নে?" আরু চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল।
"এটা অসুখ নয় রে, এটা হয় বলেই মেয়েরা মা হতে পারে, এটা শুধু মেয়েদেরই হয়।" মেয়েকে বোঝালো সুভাগা।
আজ সুভাগা একাই জমিদারবাড়িতে এসেছে। প্রথমবার মেয়েটা রজঃশ্বলা হল , আজ আর ও কোনো কাজ করতে পারবে না।
পাশের বাড়ির ঠানদিদিকে একটু খেয়াল রাখতে বলে এসেছে।
এইদিকে আড়তের থেকে ফিরে অরুন্ধতীকে দেখতে না পেয়ে মনে অন্ধকার নামে অনন্তর।
"ও কি আজকে আসেনি?" এই প্রশ্নই সারাদিন ঘুরপাক খায় ওর মাথায়।
অথচ মুখফুটে কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারে না ।
অরুন্ধতী যেন ওর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
আজ প্রায় ছয়দিন পরে আরু আবার জমিদারবাড়িতে এসেছে। এই কয়দিন শরীরটা বিশেষ ভালো ছিলো না। এখনও শরীরটা বেশ দুর্বল।
তবে কাজ তো করতেই হবে নইলে টাকা আসবে কোথার থেকে?
জল ভর্তি বালতিটা টেনে নিয়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে আজ। এই কয়দিন যে ভাবে রক্তক্ষরণ হয়েছে তাতে শরীর আর দিচ্ছে না। অথচ কাউকে বলতেও পারছে না সাহায্য করতে। তাছাড়া বাকি ঝিরাও নিশ্চই এই অবস্থাতেও কাজ করে। ওকেও পারতে হবে।
অতি কষ্টে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল বালতিটাকে এমন সময় পা পিছলে গেলো।
ভয় চোখ বন্ধ করে ফেললো আরু। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকার পরেও যখন দেখলো ব্যাথা অনুভব করছে না তখন ভয় ভয় চোখদুটো মেলে তাকালো।
অবাক হয়ে দেখে আরু , অনন্ত শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছে।
আরুকে ঠিক করে দাঁড় করিয়ে অনন্ত জিজ্ঞেস করল,"তোমার কি শরীর খারাপ অরুন্ধতী?"
আরু মাথাটা নিচু করে ফেললো। মাথাটা এখনও ঘোরাচ্ছে।
অনন্ত আবার গম্ভীর গলায় বলল,"শরীর যখন খারাপ তখন এত কাজ করতে কে বলেছে তোমায়?"
অনন্তের গম্ভীর গলার স্বর শুনে কেঁপে উঠল আরু।
তারপর নত মুখে বলল,"কাজটুকু তো করতেই হবে নইলে শুধু শুধু আপনারা পয়সা দিয়ে রাখবেন কেন?".
"তুমি কি ভাবো বলো তো অরুন্ধতী? বড়লোকেদের মন বলে কিছু নেই? আমরা পাষাণ ?" অনন্তর মেজাজ চড়ে গেল।
আরু ঈষৎ কেঁপে বলল,"আমি তা কইনি ছোটো বাবু। আপনি আমায় ভুল বুঝবেন নে। "
অনন্ত গলাটাকে নরম করে বলল,"দাও ওই বালতি আমি নিয়ে যাচ্ছি ।" বলে আরুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বালতিটা তুলে নিলো অনন্ত।
আরু ওকে বাঁধা দিতে যাবে এমন সময় মহামায়া দেবী এসে বললেন,"একি ছোটো খোকা? তুই ওই বালতিটা নিয়ে কি করছিস?"
অনন্ত বলল,"মা অরুন্ধতীর শরীরটা ভালো নয়, তাই আমি ওকে সাহায্য করছিলাম।"
আরু সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা দিয়ে বলল,"গিন্নি মা, আমি না করেছিলুম কিন্তু ছোটো বাবু আমার কথা শুনলো নে।"
মহামায়া দেবী জলদগম্ভীর স্বরে বললেন,"অনন্ত , তুমি অন্য কোনো ঝি কে কইলেই তো পারতে। যাও এখন ঘরে যাও। আমি কাউকে বলে দিচ্ছি বালতিখানা নিয়ে যেতে।"
এই বলে উনি ডাক পারলেন,"জবা, এইদিকে আয় তো।"
জবা সামনেই ছিলো , এসে বলল,"আজ্ঞে গিন্নি মা আমি নিয়ে যাচ্ছি।"
বলেই যাওয়ার সময় আরুর দিকে তাকিয়ে বলল,"তোর কপাল ভালো রে ছুঁড়ি। ছোটো বাবুর কৃপা পেলি। আমাদের যদি কচি বয়স থাকতো তবে আমরাও পেতুম।"
এইবলে হাসতে হাসতে চলে যায় সে।
অনন্ত এই কুৎসিত ইঙ্গিত শুনে রেগে গেলেও কিছু বলতে পারে না। সোজা ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা আটকে দেয়।
আরু লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। সেও ওখান থেকে চলে যাবে এমন সময় মহামায়া দেবী ওকে ডেকে বললেন,"দেখো মেয়ে, তোমার এখন উঠতি বয়স। তাই পুরুষ মানুষের থেকে একটু দূরে দূরেই থাকবে। সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল। কথাটা যেন মনে থাকে।" এই বলে চলে যান উনি।
আরুর মনে মনে অনন্তের প্রতি একটু অভিমান জন্মায়। শুধু শুধু তার জন্য সে এতগুলো কথা শুনলো।
মাঝে কেটে গেছে প্রায় একমাস। জমিদার বাড়ি মেতে উঠেছে উৎসবে।
জমিদার বাড়ির বড় ছেলে দিগন্তর বিয়ে হবে রায়বাড়ির মেজো মেয়ে মাধবীবালার সাথে।
আরুদের এখন বেশীর ভাগ সময় তাই জমিদার বাড়িতেই কাটছে। কতরকমের কাজ। প্রতিদিনই একেকরকমের নিয়মের জন্য একেকরকমের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
আরুর ভালো লাগে না এখানে সারাদিন থাকতে। ওই দিগন্ত কেমন যেন একটা অদ্ভুত চোখে তাকায় ওর দিকে। চোখদুটো কামনায় ভর্তি।
বড় অস্বস্তি হয় আরুর। হাঙরের দাঁতগুলো কোনদিন না ওর শরীরে বিঁধে যায়।
অকুল ঢেউয়ের মাঝে সবে তো পা রেখেছে আরু। আসল বিপদের সম্মুখীন হওয়া যে এবার শুরু হবে।
মেয়েরা চিরকালই ভোগের বস্তু। এ কথা আমাদের সংস্কৃতিই বলে। কিন্তু এই ভোগবতি থেকে ভগবতী হয়ে ওঠার শিক্ষাও আমাদের সংস্কৃতিই দেয়।
সেই যাত্রাই শুরু হয়েছে অরুন্ধতীর।
জীবন কখন কাকে কোন স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বোঝা যায় না।
জীবন নিজের প্রত্যেকটা বাঁকে একটা করে বিস্ময় তৈরি করে রাখে।
কখনও সেটা ভালো কখনও সেটা খারাপ।
যেই মেয়েটা কালকেও নিজের বাবা মায়ের কুড়ে ঘর আলো করে ছিলো আজ তাকে রাজবাড়ির ঝমকালো আলোর মধ্যে নিজের ভিতরের আলোটা কে বুজিয়ে দিতে হতে পারে।
জমিদারবাড়ি আজ আভিজাত্যের আলোয় সেজে উঠেছে। দিগন্তর বিয়ে আজ।
আরু মায়ের দেওয়া লাল পাড় সাদা শাড়িটা আটপৌরে করে পরে মাথায় একটা বেল ফুলের মালা জরিয়ে এইপ্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ছুটে ছুটে কাজ করছিলো।
মেয়েটা তখনও জানতো না বিধাতা ওর অদৃষ্টে কি লিখে রেখেছে।
দিগন্ত আজও গলা অব্দি গিলে রেখেছে।
মদে ভেজা লাল টকটকে চোখদুটো নিয়ে টলতে টলতে যেইমাত্র ও বর সেজে নিচে উপস্থিত হল চারিদিকে চাপা গুঞ্জন শোনা গেল।
জমিদার মশাই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছে।
অনন্ত এতক্ষণ আরুকে খেয়াল করছিলো। খুব সুন্দর লাগছে আজকে মেয়েটাকে।
দিগন্ত ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় তার চোখ গেল আরুর দিকে।
যৌবনের চিহ্নগুলো বেশ ভালোই ফুটে উঠেছে ওর সারা শরীরে।
লালসায় উথলে ওঠে দিগন্তর চোখমুখ। স্থান , কাল, পাত্র সব ভুলে গেছে সে।
এখন তার শুধুই নিজের কামনার নারীটিকে চাই।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই আরুর দিকে ছুটে গেল দিগন্ত।
শক্ত করে আরুর কাঁধ দুটো ধরে ফেললো।
আরু ভয় চিৎকার করে উঠল।
সবাই তো রে রে করে উঠেছে।
অন্য দিকে অনন্তের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।
আরুর মা দিগন্তকে সরাতে চায় কিন্তু পেরে ওঠে না।
এমন সময় অনন্ত এসে দিগন্তকে ধরে সজোরে একটা ঘুষি মেরে দেয় নাকে। ছিটকে পড়ে দিগন্ত। নাক ফেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসে।
আরু ভয় জাপটে ধরে অনন্তকে।
লোকে ছিঃ ছিঃ করা শুরু করেছে।
বিশ্বাস বাড়ির কর্তা তো বলেই ফেললেন,"অন্য সময় হলে ধরে নিতাম মেয়েটি উত্তেজিত করার মতন কিছু করেছে। কিন্তু চোখের সামনেই তো দেখলাম চৌধুরী মশাই , আপনার ছেলে কেমন ঝাঁপিয়ে পড়লো।"
জমিদার মশাই আরুর বাবাকে ডেকে বললেন,"নরেন তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি চলে যাও। আর কোনোদিন এই বাড়িতে যাতে ও না আসে।"
অনন্ত প্রতিবাদ করে ওঠে,"কেন বাবামশাই, অরুন্ধতী তো কোনো দোষ করেনি , ও কেন চলে যাবে।"
"থেকেই বা কি করবে? ওই মেয়ের যা সব্বনেশ হওয়ার হয়েই গিয়েছে। ওই মেয়েকে কি আর কেউ বিয়ে করবে? নষ্ট মেয়েমানুষের কোথায় ঠাঁই হয়?" একজন মহিলা বলে উঠলেন।
সুভাগা আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেললো।
"আমার ছেলে করবে বিয়ে।"
পিছন থেকে একটা গমগমে স্বর শোনা যায়।
সবাই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে মহামায়া দেবী এসে দাঁড়িয়েছেন।
মহামায়া দেবী আবার বলে ওঠেন,"আমার এক ছেলের জন্য আজ একটা মেয়ের এতটা অসম্মান হয়েছে। তার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।
আমাদের বাড়িতে মেয়েরা মায়ের সম্মান পেয়ে থাকে। আর সেই মায়ের জাতকে কেউ অপমান করলে তার প্রতিকার করা আমাদের কর্তব্য।
তাই আমি চাইব অনন্ত, তুমি অরুন্ধতীকে বিয়ে করে ওকে নিজের স্ত্রীয়ের মর্যাদা দাও, ওকে ওর হারানো সম্মান ফিরিয়ে দাও।"
"এ সব কি বলছোটা কি তুমি, তোমার মাথার ঠিক আছে?" জমিদার মশাই প্রতিবাদ করে উঠলেন।
"আমার মাথা একেবারে ঠিক আছে। তাই আমি কইছি, অনন্ত তুমি অরুন্ধতীকে বিয়ে করো। করবে তো?"
আরু অনন্তের বুকে মাথাটা এলিয়ে রেখেছিলো। বিয়ের প্রস্তাব শুনে একটু চমকে উঠলো। কিন্তু ভয় মুখ দিয়ে কথা ফুটলো না।
অনন্ত দৃঢ় গলায় বলল,"আমি প্রস্তুত মা।"
জমিদার মশাই বললেন,"যা করছো ভেবে করছো তো? এর জন্য পরে আফশোস করতে না হয়।"
"আমার ভাবা হয়ে গেছে।" অনন্ত বলল।
"এই বাড়ির যোগ্য বউ কিন্তু তোমায় হয়ে উঠতে হবে।" মহামায়া দেবী আরুকে নিজের বেনারসি পড়িয়ে দিয়ে বললেন।
আরু আর অনন্তর বিয়ে । দিগন্তকে নিয়ে জমিদারমশাই গেছেন বরযাত্রী সমেত।
একই লগ্নে দুইভাইয়ের বিয়ে হবে কিন্তু আলাদা আসরে।
আরু কিছু বলল না। ওর মাথা ঝিমঝিম করছে।
আরুকে বিয়ের মন্ডপে নিয়ে যাওয়া হল।
একে একে সমস্ত নিয়ম পালন করার পরে অনন্ত সিঁদুর পড়িয়ে দিলো আরুর সিঁথিতে।
কিছুটা সিঁদুর নাকে পড়তেই আরু মনে মনে বলে উঠলো,"এই বিয়ের ভবিষ্যত কি ঠাকুর?"
নিজের শরীরের একটা অংশকে যখন সম্পূর্ণ রূপে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে হয় তখন একটা মায়ের কেমন লাগে? এতটুকু একটা পুতুলকে একটু একটু করে বড় করার পর তাকে যখন পরের বাড়ি পাঠাতে হয় তখন একটা বাবার কেমন লাগে?
"আমার মেয়েটাকে একটু দেখবেন কর্তা।" অনন্তের হাত ধরে কথাটা বলে চলে এসেছিল সুভাগা আর নরেন।
এইবাড়ির পাট তাদের চুকলো। মেয়ে এখন এই বাড়ির বউ। সেই বাড়িতে তো আর ঝি গিরি করা চলে না।
মহামায়া দেবী তাদের কয়েক বিঘা জমি দান করেছেন চাষাবাদ করার জন্য। ওতে দুটো মানুষের চলে যাবে।
আরুকে জরিয়ে ওর মা বাবা যখন কাঁদছিল আরু একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি।
শুধু নিঃশব্দে মাথাটা মা বাবার বুকে রেখেছিল। এই শেষ বারের মত মা বাবাকে জরিয়ে ধরতে পারছে। আর তো কোনোদিন সম্ভব হবে না তাই কেঁদে কেটে সময় নষ্ট করতে চায়েনি ও।
নরেন আর সুভাগা চলে যাওয়ার পরে মহামায়া দেবী অনন্ত আর অরুন্ধতীকে বাইরের চৌকাঠে দাঁড়াতে বলে। বউকে বরণ করা হবে।
বরণডালাটা সাজিয়ে নিয়ে আরুকে বরণ করেন মহামায়া দেবী। এরপরে দুধে আলতার পাত্রটা সামনে রাখা হয়।
আস্তে আস্তে পাত্রটায় পা রেখে রাঙা পা দুটো লাল সাদা কাপড়ের উপরের রেখে ছাপ ফেলতে ফেলতে ঘরে প্রবেশ করে অরুন্ধতী।
এরপরে শুরু হয় স্ত্রী আচার।
বারবেলা পড়ার আগে দিগন্ত তার বউকে নিয়ে চলে আসবে তাই তার আগেই আরুর স্ত্রী আচারটা সেরে ফেলতে চাইছেন মহামায়া দেবী।
সব নিয়ম শেষে মহামায়া দেবী আরুকে অনন্তের ঘরে নিয়ে এলেন।
"আজ থেকে এটা তোর ঘর।" মহামায়া দেবী বললেন।
আরু চারদিকটায় ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। যে ঘরে আগে সে তার কর্তাবাবুর কাছে বসে পড়াশোনা করতো সেটা এখন তার আর তার স্বামীর ঘর।
বেনারসীটা ছাড়িয়ে আরুকে তাঁতের নতুন পাটভাঙা শাড়ি পড়িয়ে দিলেন মহামায়া দেবী।
ঘোমটাটা মাথায় টেনে আরু আয়নায় তাকিয়ে দেখলো, একদম বউ বউ লাগছে ওকে দেখতে।
মহামায়া দেবী নিচে নেমে গেলেন। দিগন্তরা চলে এসেছে। উনি বরণ করবেন।
এমন সময় অনন্ত ঘরে এলো।
আরু ওর দিকে তাকিয়ে চোখদুটো নিচে নামিয়ে নিলো।
অনন্ত এগিয়ে এসে আরুর হাতদুটো ধরে বলল,"আমি তোমাকে দয়া করে বিয়ে করেছি এমনটা ভেবো না অরুন্ধতী। তোমার ভিতরে আগুন আছে। সেটা যাতে নিভে না যায় তার দ্বায়ীত্ব আমি নিয়েছি। প্রস্তুত হও। ঝরের সম্মুখীন হতে হবে যে।"
কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলো অনন্ত ।
আরু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কালরাত্রীটা কোনো ভাবে কেটে গেল।
মহামায়া দেবী শুয়েছিলেন আরুর সাথে।
আর মাধবীবালার সাথে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা শুয়েছিলেন।
বউভাতের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
আরুকে সাজিয়ে নিচে নিয়ে এলেন মহামায়া দেবী। অনন্তর আগে বিয়ে হয়েছে তাই ওর ভাতকাপড়ের অনুষ্ঠান আগে হবে।
সাজানো গোছানো থালাটা অনন্তর হাতে দিয়ে একজন বললেন,"বলো দেখি বাবা তোমার বউকে, আজ থেকে সাত জন্মের ভাতকাপড়ের দ্বায়ীত্ব আমি নিলাম।"
অনন্ত থালাটা আরুর হাতে দিয়ে বলল,"তোমার ভাতকাপড়ের দ্বায়ীত্ব যাতে তুমি নিজেই নিতে পারো তার দ্বায়ীত্ব আমি নিলাম।"
চারদিকে সবাই অবাক হয়ে নানান কথা বলা শুরু করল।
এইদিকে আরু চোখদুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে অনন্তর দিকে।
"ওরে বাবা , এত গয়নাগাটি কেউ পড়তে পারে নাকি? এত কিছু পড়িয়ো নে গো আমাকে ।" আরু বলে উঠলো।
একজন ঝি আরু আর মাধবীবালাকে ফুলের সাজ পড়াচ্ছিলো।
এই এত এত বোঝা গায়ে চাপানো দেখে আরু প্রতিবাদ করে ওঠে।
ঝিটা মুখ বাঁকিয়ে বললো,"না চাইতেই এত সব পেয়ে গেলি তো তাই কদর করতে পারছিস নে। ওরে, এ তোর হাভাতে বাপের সংসার নয় , এ হল জমিদার বাড়ি। এখানকার আদপ কায়েদা রপ্ত করে ফেল।"
কথাটা মানে লাগলো আরুর ।
"আমার বাবা যেমন তেমনিই খুব ভালো।" আরু বলল।
মাধবীবালার প্রথম থেকেই আরুকে পছন্দ ছিলো না। ওর স্বামী এই ঝিটার উপর আকৃষ্ট হয়েছিল জেনে ওকে সহ্য করতে পারছিলো না।
তাই আশেপাশে তেমন কেউ নেই দেখে বলল,"ঝিয়ের আবার মান অপমান বোধ। মরণ আর কি!"
আরু আর কিছু বলল না।
কথাটা ঠিকই। এত কিছু তার পাওয়ার কথা ছিল না।
কিন্তু সত্যিই পাওয়ার কথা ছিল না?
ফুলের তোড়ায় মুড়ে আরুকে অনন্তের ঘরে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বউটা বলল, "সোয়ামী যেমন যেমন ভাবে চাইবেন তেমন তেমন ভাবেই দিস।"
কথাটা বলে চলে গেল সে।
আরু এদিকে বসে বসে ভাবছে,"যেমন যেমন ভাবে কি চাইবেন উনি?"
কিছুক্ষণ পরে অনন্ত ঘরে ঢুকলো।
অনন্তকে দেখেই আরু তড়াক করে উঠে বলল,"আপনার কি চাই? কিভাবে দিতে হবে আপনাকে?"
অনন্ত একটু হকচকিয়ে গেল।
তারপর অবাক গলায় বলল,"কি চাওয়ার কথা বলছো তুমি?"
আরু বলল,"আপনি নিজেই জানেন নে আপনার কি চাই? তবে যে ওই কাকিমা বলে গেলেন আপনি যেমন ভাবে চাইবেন তেমন ভাবেই যেন দিই।"
ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় নিলো অনন্ত। তারপর হেসে ফেললো।
"আমার কিছু লাগবে না অরুন্ধতী।"
"তবে উনি যে বললেন।" আরু বলল।
অনন্ত হাসিমুখে বলল,"যেই জিনিসটার কথা তুমি শুনেছো সেটা আমি নেবো তোমার কাছ থেকে। তবে আজ নয়। যেইদিন তুমি কথাটার মানে বুঝতে পারবে সেইদিন তোমার অনুমতি নিয়ে তারপরে তোমার থেকে নেবো।"
আরু কিছুই বুঝতে পারলো না কথাটার। শুধু এইটুকু বুঝলো যে এটা বড়দের বিষয়।
অনন্ত প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল,"তোমাকে আমার কিছু বলার আছে অরুন্ধতী।"
"পড়াশোনার কথা বলবেন নে। দোহাই আপনার।" আরু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো।
অনন্ত অবাক হয়ে বলল,"তুমি কি করে বুঝলে আমি পড়াশোনার কথা বলব?"
আরু মুখ ভার করে বলল,"বুঝবো নে? আমাকে আপনি বোকা ঠাউরেছেন নাকি? আপনারে আমি হাঁড়ে হাঁড়ে চিনি। তার উপর আপনি কাল আমারে কি সব কইলেন নে তখনই আমি বুঝে গিয়েছি।"
"তা এতো কিছুই যখন বুঝেছো তাহলে এটাও মাথায় ঢুকিয়ে রাখো , লেখাপড়া তোমাকে করতেই হবে।" অনন্ত হাসিটা চেপে নিয়ে বললো।
"আপনি কেন বুঝতে চাননে বলুন তো? মেয়েমানুষের লেখাপড়া করতে নেই।" আরু অনন্তকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
"কেন করতে নেই? অরুন্ধতী মনের থেকে এইসব অন্ধকার সরানোর সময় এবার এসেছে। অন্ধকারকে দুর করতে একমাত্র পারে আলো আর মনের অন্ধকার তাড়াতে শিক্ষার আলোর বিকল্প নেই।" অনন্ত বলে।
"আমি পড়তে বসলে ঘরের কাজ কে করবে? বাড়ির বউয়ের কাজ না করলে চলে?"
"রাত্রিবেলা তো ফাঁকাই থাকো, ওইসময়টা পড়বে । কিন্তু পড়তে তো তোমাকে হবেই।"
আরু মুখটাকে ভার করে বসে পড়ে।
অনন্ত বুঝতে পারে সবটা।
আস্তে আস্তে আরুর দিকে এগিয়ে যায় অনন্ত। তারপর ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে,"আজ হয়তো তুমি আমার কথার গুরুত্ব বুঝতে পারছো না অরুন্ধতী। কিন্তু একদিন তুমি ঠিক বুঝতে পারবে। আমি তোমাকে শুধু মেয়েমানুষ হয়ে থাকতে দেবো না অরুন্ধতী। তোমাকে রানি হয়ে উঠতে হবে। শুধু রাজার স্ত্রী রানি না। আক্ষরিক অর্থে রানি হয়ে উঠতে হবে।"
আরু বড়বড় চোখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপরে বাচ্চাদের মতন চোখদুটো পিটপিট করে অনন্তর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
অনন্ত আপন মনেই হেসে ফেললো।
"মেয়েটা বড্ড বাচ্চা এখনও।"
তারপরে আরুর গায়ের থেকে আস্তে আস্তে ফুলগুলো খুলে ওকে শুইয়ে দিলো।
নিজেও পাশে শুয়ে পড়লো।
কাল থেকে মহাযুদ্ধে নামতে চলেছে যে।
"গল্পটা সেই ছোট্টো মেয়ের,
ঘুম ভাঙতো তার পাখির ডাকে।
হঠাৎ এলো রাজপুত্তুর ,
ছুটিয়ে নিয়ে গেল অন্য পথের বাঁকে।
হারিয়ে গেল রোদের আভাস,
মেঘ পড়লো লুকিয়ে,
বিশাল বড় প্রাসাদে
দিলো যেই ঢুকিয়ে।"
ছড়াটা আরুকে ওর মা বলেছিলো। তখন আরু খুব ছোটো। সবে পাঁচ কি ছয় বছর বয়স।
আরু জিজ্ঞেস করেছিলো,"প্রাসাদে বুঝি রোদ মেঘেদের আসতে মানা?"
সুভাগার কাছে সেইদিন আরুকে দেওয়ার মতন কোনো উত্তর ছিল না।
এখন আরু নিজেই বুঝতে পারবে। রোদ মেঘের ছোঁয়া যে শুধু মুক্ত হৃদয়েই পৌঁছতে পারে। শিকলে বাঁধা মনে তারা ঢুকবে কি করে?
মুখের উপর বন্ধ জানলার থেকে যেইটুকু সূর্যের আলো এসে পড়লো তাতেই আরুর ঘুম ভেঙে গেল। আজ থেকে ওর এক নতুন জীবনের শুরু হল।
আজ থেকে এক নতুন পরিচয় আরুর।
"ওমা আপনি কে?" পাশে অনন্তকে শুয়ে থাকতে দেখে ভয় চিৎকার করে উঠলো আরু।
আসলে পাশে চিরটাকাল মাকে দেখেছে। আর গতকালও উঠে প্রথম মহামায়া দেবীকে দেখে অতটা ভয় লাগেনি।
কিন্তু আজ পাশে একটা পুরুষমানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল আরু।
তারপর নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটলো।
কিন্তু ততক্ষণে ঘুমটা পুরোই চটকে গেছে অনন্তর ।
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বলল,"বিয়ে করা যে এতবড় শাস্তি তা তো জানতাম না। আমার বউ দেখছি শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না।"
"আপনি আমাকে নিয়ে রঙ্গ করছেন?" আরু কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
"আমার একমাত্র বউয়ের সাথে একটু রঙ্গ নাহয় করলাম।" বলে আরুকে একটু কাছে টেনে নেয় অনন্ত।
অনন্তর স্পর্শে একটু কেঁপে ওঠে আরু।
এই দেখে অনন্ত হাসতে হাসতে আরুকে ছেড়ে দেয় ।
আরু লজ্জা পেয়ে এক ছুটে পালিয়ে যায়।
স্নান সেরে নতুন শাড়ি পড়ে আয়নার দিকে তাকায় আরু। চুলটা ভেজা তাই খোঁপা না করে পিছনে ছেড়ে সিঁথিতে সিঁদুরটা পড়ে।
বিয়ে হয়েছে ইস্তক নিজের দিকে তাকাতে লজ্জা পায় আরু। নিজের এই বউ বউ চেহারাটা দেখে গালদুটো ওর লাল হয়ে যায়।
মেয়েরা খুব বোকা হয়। এক মুহূর্তের জন্য একটু ভালোবাসা পেলেই তারা ভুলে যায় যে সংসারটা শুধু তার মনের মানুষটিকে নিয়ে না। আরও অনেকে আছে সেখানে। তাদের সাথে উঠতে বসতে একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলতে থাকে।
তবে জিততে সে তখনই পারবে যখন নিজের সাথে যে যুদ্ধটা ক্রমাগত চলছে সেটাতে যদি জিততে পারে।
আরুর মনে হয়েছিল অনন্ত যখন ওকে ভালোবাসছে, গিন্নি মা যখন ওকে মেনে নিয়েছে তখন পুরো সংসারটাই ওকে আপন করে নেবে।
অত সোজা জীবন কখনো হয়না। তার একেকটা ঢেউ তোমায় অকুল পারাবারে আছড়ে ফেলতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
আরু নীচে নেমে আসতেই আত্মীয়দের মধ্যে একজন বলে উঠলো,"বাবা, নতুন বউয়ের বুঝি এতক্ষণ লাগে ঘুম থেকে উঠতে?"
আরেকজন বলল,"আরে বুঝতে পারছো নে? ছিলো তো ঝি। হঠাৎ এমন আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।"
অনন্ত সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে সবটাই শুনলো, কিন্তু কিছু বললো না। ও চায় আরু যাতে নিজের অপমানের জবাবটা নিজেই দিক।
আরুর আত্মসম্মান বোধ মারাত্মক। তাই চুপচাপ কথাটা হজম না করে ও বলল,"কাল থেকে হাজার একটা নিয়ম তো আপনারাই পালন করিয়েছেন। মানুষ তো আমি , ভগবান তো নই । তাই বিশ্রাম আমারও লাগে।"
"ও মাগো মা, নতুন বউ সে কিনা আবার মুখে মুখে তক্ব করে। দেখ অনন্ত দেখ। দেখে যা তোর বউয়ের কাণ্ডি।"
"ভুল তো কিছু বলেনি ও। আর তাছাড়া এমন কিছু সকালও হয়নি। এত ভোরে উঠে করবেটা কি?" অনন্ত নেমে এসে বলল।
সবাই চুপ করে যায়। এর উপর তো আর কথা বলা চলে না। বর যখন বউয়ের বিরুদ্ধে নেই তখন লোকে পাঁচটা কথা বলার আগে দশবার ভাববে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে সময়ও লাগেনা।
আরু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অনন্তের দিকে।
একটা কথা ও ভালো করে বুঝে গিয়েছে। অনন্ত কখনো ওর হাত ছাড়বে না। চিরটাকাল আগলে রাখবে।
বিয়ের বন্ধনটাই তো এই কারণে হয়। দুটো মানুষ একেঅপরকে আগলে রাখবে, একেঅপরকে জড়িয়ে বাঁচবে।
এর নামই তো ভালোবাসা।
জমিদারবাড়ির বউরানি হলে কি হবে, কোনো ঝি চাকরই আরুকে সেই মান দেয় না।
আরুর অবশ্য সেটা নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই।
সাধারণ জীবন যাপন করাই ওর অভ্যাস , আর সেটাকেই ও বজায় রাখতে চায়।
কিন্তু অনন্তর এই নিয়ে অসুবিধা আছে।
ওর ধারণা ও যাকে নিজের স্ত্রীয়ের মর্যাদা দিয়েছে তাকে তার প্রাপ্তিগুলোর থেকে সে বঞ্চিত হতে দিতে পারে না।
আজ সকালবেলায় মহামায়া দেবী অরুন্ধতী আর মাধবীকে হেঁসেলে ঢুকিয়ে বলেছিল একটা পদ রাঁধতে।
হেঁসেলের বামুন বউ বলল,"কালে কালে কত কি দেখতে হবে। ছিল ঝি ঠাকুরাণী হয়ে গেল বৌঠাকুরাণী।"
আরু সেইভাবে কথাটাকে গায়ে না মাখলেও অনন্তর কানে যেতেই সে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলো।
সোজা মহামায়া দেবীর কাছে এসে বলল,"মা, আমার স্ত্রীয়ের যদি এখানে এত অসম্মান হয় আমি কিন্তু ওকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। বৌঠান আর অরুন্ধতীকে এক চোখে দেখতে সবার কি অসুবিধা আছে? "
মহামায়া দেবী শান্ত গলায় জবাব দিয়েছিলেন,"দেখো অনন্ত, আমি যতটা সম্ভব অরুন্ধতীর সম্ভ্রম রক্ষা করেছি। বাকিটা ওকে নিজের যোগ্যতায় তৈরি করতে হবে। এই বাড়ির আদব কায়দা সব রপ্ত করে ফেলতে হবে। আমার আর কিছুই করার নেই।"
অনন্ত চুপচাপ কথাটা শুনে চলে এসেছিলো। কথাটা সত্যি।
আরুকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
"এককালে যেইটুকু শিখিয়েছিলাম সেটা কি মনে আছে নাকি ভুলে গেছো?" অনন্ত জিজ্ঞেস করল আরুকে।
রাত্রি বেলা, অনন্ত আরুকে নিয়ে পড়াতে বসেছে।
আরু একটা লম্বা হাই তুলে বলল ,"আছে মনে।"
"লেখো দেখি সবকটা স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনবর্ণ ।" অনন্ত বলল।
"জ্বালাতন কাকে বলে!" বলে খাতাটা টেনে নিলো আরু।
অনন্তর ভীষন হাসি পেলেও ও চুপ করে রইল।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে খাতাটা অনন্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,"দেখুন।"
কিছুক্ষণ মন দিয়ে খাতাটা দেখে অনন্ত বলল," ঠিকই লিখেছো তবে "ক্ষ" লেখাটাকে দেখে আমার কিরকম মৃত টিকটিকির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এটা আগেও ঠিক করে লিখতে পারতে না, আর এখনও পারোনা।"
আরু মাথাটাকে নিচু করে ফেললো।
অনন্ত আরুর গালটা একটু টিপে বলল,"এদিকে আসো। এই দেখো..."
বলে আরুকে লেখা দেখাতে লাগলো। আরুও খাতার দিকে মন দিলো।
এককালে লিখতে পড়তে তো ও ভালোবাসতো।
কিন্তু বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে নিজের ইচ্ছেগুলোকে কি করে গলা টিপে মেরে ফেলতে হয় সেটা সব মেয়েরাই খুব সুন্দর করে শিখে যায়।
আরুও নিজের ইচ্ছেগুলোকে মেরে ফেলতে সময় নেয়নি। বা বলা ভালো সমাজ ওকে এতটা সময় দিতে চায়নি।
আজ অনন্তর কাছে পড়তে পড়তে আবার মেয়েবেলার দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছে আরু।
সুন্দর ছিলো খুব দিনগুলো।
রাজার ঘরের রানি হওয়ার চেয়ে যে বাবার ঘরের রানি হওয়া অনেক ভালো।
আচ্ছা নিজের ঘরের রানি হলে কেমন লাগে? কথাটা মনে আসতেই হেসে ফেললো আরুর।
মেয়েদের আবার নিজের বাড়ি হয় নাকি?
"হাসলে কেন?" অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
আরুর হাসির কারন শুনে অনন্ত আরুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,"একদিন তুমি সত্যিই নিজের ঘরের রানি হবে অরুন্ধতী। আমি কথা দিলাম তোমায়। এরজন্যই তো তোমাকে জোর করে পড়তে বসাচ্ছি। এটাই নতুন আলোর পথে যাওয়ার সূচনা।"
আরু অনন্তের এইসব ভারি ভারি কথা না বুঝলেও এইটুকু বুঝেছে যে এই মানুষটা ওর জন্য যা করবে তা ভালোই হবে।
তাই কথা না বাড়িয়ে অনন্তকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
দুজনেই এক অজানা আবেশে চোখ বুজে ফেললো।
কিন্তু হঠাৎ পাশের ঘর থেকে জোরে একটা আওয়াজ হওয়ায় চমকে উঠলো দুজনে।
দিগন্ত চেঁচামেচি করছে।
অনন্ত দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো। আরুও এলো পিছন পিছন।
জমিদার মশাই আর গিন্নিমাও আওয়াজ পেয়ে চলে এসেছে।
দিগন্ত মদ খেয়ে এসে মাধবীর উপরে হম্বিতম্বি করছিলো।
আসলে আরুর জন্য অনন্ত ওর গায়ে হাত তুলেছিল এই অপমান এখনও ভুলতে পারেনি ও।
সেই রাগটাই মাধবীর উপরে গিয়ে পড়েছে।
আরুরা গিয়ে দেখে মাধবীর কপাল অনেকখানি কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। দিগন্ত রাগের বশে ফুলদানি ছুড়ে মেরেছে ওকে।
মহামায়া দেবী আজ আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না।
কষিয়ে একটা চড় মেরে দিলেন দিগন্তর গালে।
জমিদার মশাইও আজ বলে ফেললেন,"এমন কুশিক্ষা কোথায় পেলি তুই ? জানোয়ার তৈরি হয়েছিস একটা।"
আরু মাধবীকে ধরে খাটে বসিয়ে কপালটা পরিষ্কার করে দিলো , তারপর ওষুধ লাগিয়ে দিলো।
মাধবী কেঁদে যাচ্ছে তখনও।
দিগন্ত রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেল বাড়ির থেকে।
একটা বউকে মাধবীর খেয়াল রাখতে বলে যে যার ঘরে চলে গেল।
আরুর আর রাতে শুয়ে ঘুম আসছে না।
অনন্তর দিকে ফিরে বললো,"আচ্ছা আমি যদি কোনো ভুল করি, তাহলে কি আপনিও আমাকে মারবেন?"
অনন্ত আরুকে বুকে জড়িয়ে বলল,"তোর তাই মনে হয় পাগলি?"
"জানি না।" বলে অনন্তর বুকে মুখ গুঁজলো আরু।
একটুকরো চাঁদের আলো ওদের মুখে পড়ে মিষ্টি প্রেমের মুহূর্তটাকে আরো স্বর্গীয় করে তুললো।
"অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে,
পার করো বলিয়া ডাকিলো পাটনীরে।।"
একমনে বসে কবিতা মুখস্থ করছে আরু।
আস্তে আস্তে নতুন জীবনের সাথে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে মেয়েটা।
মাঝেমধ্যে বাড়ির কথা, বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে তবে মানিয়ে নিচ্ছে ও সবটাই।
ঘরের কাজ খুব বেশি থাকে না কখনোই। তাই সময় কাটতে চায় না খুব একটা।
বইপত্র নিয়ে বসতেও পারে না। কেউ যদি দেখে ফেলে?
রাতের বেলাই তাই ভরসা।
মাঝখানে অষ্টমঙ্গলা সেরে এসেছে আরু আর অনন্ত। মেয়ে ভালো আছে দেখে শান্তি পেয়েছে সুভাগা আর নরেন।
জমিদার মশাই অনেকটাই মেনে নিয়েছে আরুকে।
কবিতাটা মুখস্থ করে অনন্তর দিকে তাকালো আরু।
এখন আর আরুকে ধরে ধরে পড়া শেখাতে হয় না। নিজেই অনেকটা রপ্ত করে ফেলে একটু বুঝিয়ে দিলে।
অনন্ত পাশে বসে থাকে।
"হয়ে গেছে?" অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল আরু।
"তাহলে কয়েকটা পাটিগণিত করতে দিই , করো তো।" এই বলে অনন্ত খাতা বের করে।
মাঝখানে আরু হঠাৎ বলে,"শুনছেন, আজ না টগর দিদি কইছিলো বিয়ের পরে নাকি তাড়াতাড়ি বাচ্চা হলে স্বামী বারমুখী হয় না। আমরা তো অনেকদিন হল একঘরে আছি, তাহলে আমাদের কেন বাচ্চা হচ্ছে না?"
কথাটা শুনে বিষম খেয়ে গেল অনন্ত। মেয়েটা বলে কি? এক ঘরে থাকলেই বাচ্চা হয়ে যাবে? অবশ্য ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এগুলোর কিছুই জানে না ও।
"আরু তুমি এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করো আর মা যেমন যেমন বলছে সেইটুকু করো। মা হওয়ার জন্য আরেকটু বড় হতে হবে তো। তখন ভাববো এইসব নিয়ে।" অনন্ত একটু গম্ভীর গলায় বলল।
আরু মুখ ফুলিয়ে বলল,"আমি বুঝি বাচ্চা?"
"বাচ্চা নও কিন্তু মা হওয়ার জন্য আরেকটু বড় হতেই হবে। নাও এইকটা অঙ্ক করে ফেলো দেখি।" অনন্ত বলে।
বিরস বদনে অঙ্ক কষতে বসে আরু।
আজ সবাইকে বৈঠকখানায় ডেকেছেন জমিদার মশাই। ওনার কিছু প্রস্থাব দেওয়ার আছে।
দিগন্ত আর মাধবীও এসেছে। দিগন্ত কিছুটা সামলে রেখেছে নিজেকে। নইলে যদি সম্পত্তি হাত থেকে ফসকে যায়। মাধবীই দ্বায়ীত্ব নিয়ে সম্পত্তির ভুত মাথায় ঢুকিয়েছে দিগন্তর, যাতে স্বামীর কাছে কিছুটা প্রিয় হওয়া যায় আবার নিজের আখেরও গোছানো যায়।
জমিদারমশাই অনন্ত আর দিগন্তকে বললেন,"তোমাদের তো বিয়ের অনেকদিন হল। ভাবছিলাম কাজকর্মের ফাঁকে কোথাও যদি ভ্রমণে যাওয়া যেত সবাই মিলে।
আমাদের রংপুরের তালুকে অনেক বছর যাওয়া হয়নি। তাই ভাবছি চলো সবাই মিলে ঘুরে আসি একটু।"
ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে আরুর মনে আর আনন্দ ধরে না।
ঘরে ঢুকে অনন্তকে বলে,"জানেন , ঘুরতে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। সেই কোন ছোটোবেলায় একবার মা বাবার সাথে মামাবাড়িতে গিয়েছিলুম। এবারে আবার যাবো। ওরে বাবা! আমার না খুশিতে নাচতে মন চাইছে।"
তারপর কোমরে হাত দিয়ে বলল,"শুনুন, আপনি কিন্তু ওই বইপত্তর নিয়ে যাবেন নে। ঘুরতে গিয়ে আমি কিন্তু পড়তে বসবো নে । কিছুতেই না।
আচ্ছা পরশুদিনই তো যাওয়া, সব তো গোছাতে হবে।"
অনন্ত আরুর পাগলামি দেখছে আর হাসছে।
মেয়েটা পারেও বটে!
সারাদিন ধরে গোছগাছ করেছে আরু। তোরঙ্গে ঠেসে ঠেসে সব ঢুকিয়েছে।
আর নিয়েছে একটা খাতা।
খাতা নিচ্ছে দেখে অনন্ত জিজ্ঞেস করেছিলো ,"এই না বললে ওখানে পড়তে বসবে না? তাহলে আবার খাতা নিচ্ছো কেন?"
"বারে, ওখানে যা যা দেখবো সব লিখে রাখতে হবে নে? আর যদি কখনও ঘুরতে না যাওয়া হয়।" আরু বলেছিলো।
অনন্ত হেসে বলেছিলো,"তোমার যখন ঘোরার এত ইচ্ছে তখন আমি আবার তোমাকে নিয়ে যাবো।"
আরু বলেছিলো,"দ্বিতীয়বারের জন্য কখনও অপেক্ষা করতে নেই বুঝলেন। এর পরে যদি আমি আর না থাকি, যদি মরে যাই। তখন কি হবে?"
কথাটা শুনেই আরুকে বুকের মাঝে টেনে নিয়েছিলো অনন্ত।
"এইসব কথা আর কখনও বলবে না অরুন্ধতী। তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।"
আরু বোঝেনি ও কি এমন বলে ফেললো।
রাতে দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি আরু উত্তেজনার বশে।
কখন যে সকালটা হবে!
নিজের চেনা জায়গাটাকে পিছনে ফেলে পালকিতে চলেছে অরুন্ধতী।
বারবার মাথাটাকে বের করে দেখছে চারপাশটা।
পালকির পাশে পাশে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে অনন্ত।
সামনের পালকিটাতে আছেন মহামায়া দেবী আর মাধবী।
দিগন্ত যেভাবে মদ গিলে রেখেছে তাতে ঘোড়ায় চড়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সেও চলেছে পালকিতে করেই।
একবার অনন্ত ঘোড়া থামিয়ে পালকির ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে বলল,"কি? কেমন লাগছে?"
আরু একগাল হেসে বলল,"খুব ভালো লাগছে জানেন? চারপাশটা কেমন অন্যরকম। সবটাই অচেনা তাও ভীষন আনন্দ হচ্ছে।"
অনন্ত হেসে বলে,"প্রকৃতির এটাই তো গুন। অচেনাকেও আপন বানিয়ে দেয়।"
রংপুরের বাড়িতে পৌঁছে সকলে হাতমুখ ধুয়ে নেয়।
যে যার ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে। সারাদিন এতটা পথ এসে সকলেই ক্লান্ত।
"প্রথমবার এমন অনুভূতি হচ্ছে। চারপাশটা সবুজ, তার মাঝখানে কতরকমের , কত রঙের ফুল, পাখির কলকাকলি সবটাই বড় মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।
পালকিটা যখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছিলো পাশের গাছপালা আকাশ সবাই যেন আমার সাথে ছুটছিলো। সেই সাথে পালকির বেয়ারাদের 'হুম হুমা রে হুম হুমা' শব্দ।
আজ ওনাকেও যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।
আচ্ছা ওনার ওই ভাষা ভাষা চোখদুটো কি আমার মনের ভাষা পড়তে পারে? আমার না খুব ওনাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে,"এই মন শুধু আপনাকে চায়।"
কথাগুলো নিজের খাতাটায় বন্দি করে ফেললো আরু।
তারপর খাতাটা কে বন্ধ করে রেখে ঝুলবারান্দাটায় এসে দাঁড়ালো।
সামনের দীঘিতে কয়েকটা রাজহাঁস সাঁতার কাটছে।
কি স্বাধীন ওরা। বিয়ের আগে আরুও দীঘিতে সাঁতার কাটতো।
বিয়ের সবে একমাস হয়েছে তাও মাঝেমধ্যে মনে হয় এই বন্দিদশা যেন কত যুগের।
না না, অনন্তবাবু ভীষন ভালো মানুষ। ওর সব বিষয় খেয়াল রাখে, ওকে সম্মান করে, ও কি চায় সেটার গুরুত্ব দেয়।
বাড়ির বাকিরাও খুবই ভালো।
কিন্তু নিজের রানি সত্ত্বাটাকে আর কতদিন ছাই চাপা দিয়ে রাখবে আরু।
যার জন্মই হয়েছে খোলা আকাশে ওড়ার জন্য তাকে সংসারে বাঁধা যায় না।
অনন্ত জানে কথাটা , তাই তো সে তার রানিকে সবদিক দিয়ে প্রস্তুত করছে।
কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো জানেনা, অনন্তর ডাকে সম্বিত ফিরে পায় আরু।
"অরুন্ধতী শুনছো?" অনন্ত ডাকে।
মাথায় ঘোমটা টেনে আরু বলে,"কিছু কইবেন?"
"ঘুরতে যাবে?" অনন্ত জিজ্ঞেস করে।
"ঘুরতেই তো এয়েছি।" আরু বলে।
"আরে আমি চারপাশটা ঘুরে দেখার কথা বলছি। শুধু তুমি আর আমি। যাবে?" অনন্ত বলে।
আরুর মন এমনিতেই যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলো। অনন্তর কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠলো।
বাড়িতে জানাজানি হলে কি হবে একবারও ভাবলো না।
সারি সারি বিশাল গাছ, কিছুটা ঝোপঝাড় ফুলের গাছ আর কয়েকটা রঙিন প্রজাপতি। যারা উড়ে বেড়াতে ভালোবাসে অরুন্ধতীরই মতন।
তাদের মাঝখান দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা একটা নদী। এই নিয়ে প্রকৃতির আরেকটা সুন্দর ছবি ফুটে উঠেছে।
শাড়িটা সামলাতে একটু কষ্ট হচ্ছে আরুর।
সামনে পার দেখে আরু বলল,"বসবেন ওখানে?"
সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায় করছে।
নদীর পারে বসে আছে আরু আর অনন্ত।
আরু অবাক হয়ে দেখছিলো সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় কত রকমের রঙ ছড়িয়ে দেয় সারা আকাশটা জুরে। আর সেই রঙের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে নদীর জলে।
আরুর মনে হয় কিছুটা রঙ বোধহয় তার আর অনন্তর শরীরও ছুঁয়ে যায়।
এই রঙ ভালোবাসার রঙ।
"আপনি নিজেও জানেন না আপনি আজ কতটা ভালো লাগায় ভরিয়ে দিলেন আমাকে। এই দিনটা উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে শত ধন্যবাদ দিলেও কম পড়বে।" আরু অনন্তের দিকে তাকিয়ে বলল।
অনন্ত একটু হেসে বলল,"কিছু সম্পর্কের মধ্যে ধন্যবাদ শব্দটা না আনাই ভালো। এতে ভালোবাসা বাড়ে।
এই দিনটা যে আমিও ভীষন উপভোগ করলাম অরুন্ধতী।
নিজের অর্ধাঙ্গিনীর সাথে প্রথম ভ্রমণ, এ এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি যে।"
সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত পাখিগুলো এবারে বাড়ি ফিরছে।
প্রকৃতি কি যেন এক মায়ার সৃষ্টি করেছে। এই মুহূর্তগুলোতে কেন জানি না খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অকারণেই ভালোবাসার ইচ্ছে জাগে। কাকে? সেই উত্তরও জানা নেই তবু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
মন বড় খামখেয়ালী হয়ে ওঠে। অজানা আবেগ ভর করে যেন।
নিজেকে চেনা দায় হয়ে যায় অথচ এই অচেনা আমিটাই সেই মনে নিখাদ ভালো লাগার আলোড়ন তোলে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ জুড়ে আবেশ নামে আরুর। জীবনে যেন সবটাই পাওয়া হয়ে গেল। ওর যতটুকু সুখ পাওনা ততটা যেন আজ বিধাতা চুকিয়ে দিলেন। কিন্তু আরও এক ভালোলাগার ঢেউ যে ভবিষ্যতের মাঝপথে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চুপ করে অনন্তর কাঁধে মাথা রেখে সূর্যটাকে আস্তে আস্তে ডুবে যেতে দেখে অরুন্ধতী।
"কোথায় ছিলে এতক্ষণ তোমরা?" আরু আর অনন্ত ঘরে ঢোকা মাত্র প্রশ্ন ছুঁড়লেন মহামায়া দেবী।
অনন্ত একটু হকচকিয়ে গেল। এতক্ষণে ওর মনে পড়লো যে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে যাওয়ায় ঝামেলা হতে পারে।
"বেশি দুরে নয় মা, এই তো কাছেই ছিলাম।" অনন্ত মাটির দিকে তাকিয়ে বলে।
"কাছে ছিলে না দুরে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল তুমি বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে তোমার বউকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলে। এটা কতটা দৃষ্টিকটু তুমি জানো?"
অনন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
"ঘরে যাও। এরপর থেকে বুঝেসুঝে কাজ করবে।" কথাটা বলে মহামায়া দেবী ঘরে চলে গেলেন।
আরু আর অনন্ত দুজনেই হাঁফ ছাড়ল, তারপরে একেঅপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
মাঝেমধ্যে অবাধ্য হওয়ার মধ্যে একটা মজা আছে। কখনো কখনো মনকে বাঁধতে নেই, সে যা চাইছে তাকে সেটা করতে দিতে হয়। পড়ে অবশ্য কপালে বকুনি জুটতে পারে। সেটা হজম করার ক্ষমতাও রাখতে হয়।
"তোমার অনুরাগের ছোঁয়ায়
সিক্ত হোক আমার আমি,
তোমার প্রণয় ডোরে
বাঁধা পড়ুক আমার আমি।
তোমার মনে হোক
আমার অবাধ যাতায়াত,
আমার মনে হও তুমি
সদা বিরাজমান।
হাজার তারার মাঝে যেমন
ঝলমলিয়ে ওঠে চাঁদ,
তেমনিই শত লোকের ভিড়ে
তুমি করো ঝলমল।
আমার আমিটাই যে তোমাকে ঘিরে
তুমি থাকো আমার মনের নীড়ে।
সূর্যের অস্তরাগে যেমন
রঙ লাগে আকাশের নীল তটে,
তেমনিই তোমার ভালোবাসার রঙ
লাগুক আমার সারা শরীরে।"
কবিতাটা খাতায় লেখা মাত্র একটা শিহরণ খেলে যায় আরুর সারা শরীরে।
হঠাৎই মনে হচ্ছে এই মন যেন আজ তার প্রাণনা
থকে অন্য ভাবে চাইছে।
কেমন চঞ্চল হয়ে উঠছে।
বারবার অরুন্ধতীর চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনন্তর ওই সূর্যাস্তের আলো মাখা মুখখানা।
নিজের অবাধ্য মনকে শ্বাসন করতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে।
অনন্ত অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিলো আরুর ছটফটানিটা।
এবারে আর থাকতে না পেরে কাছে চলে গেলো।
"কি লিখলে দেখি।" বলে খাতাটা নেয় আরুর হাত থেকে।
এমন আচমকা খাতাটা নিয়ে নেওয়ায় আরু প্রথমে হকচকিয়ে যায়। তারপর পরক্ষণেই লজ্জায় নিজের দুই চোখ বুজে ফেলে।
ঈশ্! ওই লেখাটা অনন্ত পড়ে ফেললো!
অনন্ত এইদিকে একদৃষ্টিতে খাতাটার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটা ওকে বড় বেশী ভালোবাসে।
ভয় হয় অনন্তর, বেশি ভালোবাসলে যে কষ্ট পেতে হতে পারে।
কিন্তু সে সব চিন্তা দুরে সরিয়ে আরুর দিকে ফিরে ওর গালদুটো একটু টেনে বলল,"বাবা , এই বাড়ির ছোটো বউঠাকুরাণী দেখছি বড় হয়ে গেছে। বড়দের মতন করে ভাবতে শিখে গেছে।"
আরু লজ্জায় মুখটা নামিয়ে ফেলে।
অনন্ত আরুর মুখটা তুলে ধরে বলে,"লাগাবো নাকি ভালোবাসার রঙ?"
আরুর মুখটা ঈষৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে , জিজ্ঞেস করে,"কিভাবে?"
"দেখবে?" বলে নিজের ঠোঁটদুটো আরুর ঠোঁটের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিয়ে যায় অনন্ত।
অনন্ত যত কাছে আসছে আরু ততই কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ধীরে ধীরে আরুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখে অনন্ত।
শিউরে ওঠে আরু।
এই শিহরন প্রেমের।
কতক্ষন এইভাবে ছিলো খেয়াল নেই। হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ে আরু।
অনন্ত একটু ভয় পেয়ে যায়।
"তুমি ঠিক আছো তো অরুন্ধতী?" অনন্ত জিজ্ঞেস করে।
অরুন্ধতী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"নিজেকে না আজ সত্যিই অরুন্ধতী মনে হচ্ছে জানেন। আর যেন আমি বাবা মায়ের সেই আদরের ছোট্টো মেয়েটি নেই।"
অনন্ত হেসে আরুকে একটু কাছে টেনে নেয়।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা বিকট শব্দ শোনা যায়।
আরু ভয় পেয়ে অনন্তকে জিজ্ঞেস করলো ,"ও কিসের আওয়াজ?"
অনন্ত আশ্বস্ত করে বলে ,"বাজ পড়েছে , দেখছো না বাইরে বৃষ্টি নেমেছে।"
সত্যিই আজ বড় বেশি জোরে বৃষ্টি নেমেছে। বিকেলটা যতটা কোমল যতটা সুন্দর ছিলো রাতটা ঠিক ততটাই কঠিন।
এমন বজ্রপাতের সাথে মেঘ।
আজ প্রথম অনন্ত আর অরুন্ধতী এতটা কাছাকাছি এলো আর আজই এই দুর্যোগ ?
ভয় বুকটা কাঁপছে আরুর।
"সম্পর্কের সমীকরণগুলো ওলটপালট হয়ে যাবে না তো? আজকের দিনে এমন ঝড় উঠলো কেন?"
কথাটা অনন্তর মনে আসতেই আবার জোরে একটা বাজ পড়লো।
এবারে অনন্ত সত্যিই ভয় পেলো।
পুরোনো ভয়টা আবার ফিরে আসছে।
আরুর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো।
ঝাড়বাতির আলোটা হঠাৎ নিভে গেল দপ করে।
আরু উঠে বললো,"আপনি বসুন, আমি মোমবাতি নিয়ে আসছি।"
সঙ্গে সঙ্গে আরুর হাতটা টেনে ধরলো অনন্ত। বললো,"কোথাও যাবেনা তুমি, চুপটি করে এখানে বসে থাকো ।"
"আমি পারবো যেতে, অন্ধকারে চলাফেরা করার অভ্যেস আছে আমার।" আরু বললো।
"তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। বাজ বিদ্যুতে আমার ভয় করে।" লজ্জার মাথা খেয়ে কথাটা বলেই ফেললো অনন্ত।
জমিদারবাড়ির ছেলে বাজ বিদ্যুতে ভয় পায় একথা শুনলে যে কেউই হাসবে কিন্তু অনন্তর সত্যিই ভয় করে। কোনো কারণ নেই তাও করে।
আরু খাটে ধপ করে বসে বললো,"যাক, আপনিও কিছুতে ভয় পান। জেনে ভালো লাগলো।"
অনন্ত একটু রাগি দৃষ্টিতে তাকালো আরুর দিকে।
তৎক্ষণাৎ আরেকটা বাজ পড়লো আর অনন্ত ভয় আরুকে জরিয়ে ধরলো।
আরু হেসে অনন্তর মাথায় হাত রেখে বলল,"আজ রাতে আর ছোটো বাবুর কোনো হম্বিতম্বি চলবে নে। এমন ঝড় মাঝেমধ্যে হলে বেশ হয়।"
তারপর অনন্তর গালটা ধরে বললো,"আর ভয় পেয়ে কাজ নেই। অনেক রাত হয়েছে , শুয়ে পড়ুন দেখি।"
অনন্তকে শুয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আরু। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে অনন্ত।
অনন্ত ঘুমালে আস্তে আস্তে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আরু।
জানলার পাল্লাদুটো খুলে দেয় । সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট এসে মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যায় আরুর।
কেন জানি মনটা ভারি কু গাইছে আজ তার।
এই ঝড় কেমন যেন অশুভ লাগছে। জীবনটা ওদের যেভাবে সহজ সরল ভাবে কাটছে সেটা শুধুই মোহ।
শুধু দরজা বন্ধ করে পড়ে শিক্ষিত হলেই সমাজের সাথে লড়াই করা যায়না।
ওটা যুদ্ধের প্রস্তুতির একটা ধাপ মাত্র।
কথাটা অনন্ত শুরুর থেকেই জানে। আর এখন অরুন্ধতীও জানে।
বয়েসের তুলনায় অনেকটা বেশী বোঝে এখন মেয়েটা।
নিজের মনটাও আজকাল বিদ্রোহ করে উঠছে। চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে চাইছে।
যা করতে মানা সেটাই করতে ইচ্ছে করছে।
সমাজ কি বাঁধা দেবেনা? আরে সমাজ তো পরের কথা নিজের ঘরের বাকি লোকগুলোই সবার আগে বাঁধা দেবে।
তখন কি হবে ?
নিজেকে প্রশ্নটা করে আরু।
আবার পরক্ষণেই নিজে উত্তর দিয়ে দেয়,"করুক মানা। "লোকে কি ভাবলো"র ভাবনা ছেড়ে এবার নিজের ভাবনাকে প্রাধান্য দেবো। দেখিই না কতদূর কি হয়।"
বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো হঠাৎই। মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ তার সাথে বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো আলো সবটাই যেন সামনে অপেক্ষা করে থাকা অশনি সংকেত।
জানলাটা বন্ধ করে দেয় আরু।
ধীরে ধীরে অনন্তর দিকে এগিয়ে যায়।
ঘুমোলে পরে মানুষটার মুখটা আরও মায়াবী লাগে।
আস্তে আস্তে অনন্তর কপালে নিজের ওষ্ঠদয় স্পর্শ করে আরু।
ঘুমের মধ্যেও অনন্তর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। হয়তো নিজের প্রেয়শীর ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করতে পেরেছে।
আরুও গিয়ে অনন্তর পাশে শুয়ে পড়ে।
আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসে।
সারাদিনের ক্লান্তি আর এই বর্ষনমুখর দুর্যোগের রাত মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, করে সৃষ্টি করে এক অদ্ভুত পরিবেশের ।
আরুর দুইচোখেও আস্তে নেমে আসে ঘুম। বাইরে পড়তে থাকে ঝমঝম বৃষ্টি।
ঘুমটা ভেঙে গেল অনন্তর।
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আর আসলো না।
বাইরের ঝড় এখনো থামেনি। আস্তে আস্তে উঠে বসে অনন্ত। একটু ভয় ভয়ও
লাগছে । তবে আরুকে ডাকলো না।
মেয়েটা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
থেকে থেকে বিদ্যুৎ চোখ ঝলসে দিচ্ছে।
বৃষ্টির ছাঁট এসে গায় লাগতেই একটু কেঁপে উঠলো অনন্ত। ঠাণ্ডা লাগছে।
ধীরে ধীরে থামটার উপর হাত রেখে বাইরের পরিবেশটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছিলো অনন্ত।
খেয়াল করেনি পাশে রূপোর পাত বসানো আছে। ওটায় হাত রাখার সাথে সাথেই বাইরে জোরে বাজ পড়লো।
জোরে ঝটকা লাগলো অনন্ত , সারা শরীর দিয়ে কি যেন একটা বয়ে গেল।
চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।
চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল আরুর।
পাশে অনন্তকে না পেয়ে বারান্দায় গেল।
"কি বুঝছেন ডাক্তারবাবু?" জমিদার মশাই জিজ্ঞেস করলেন।
অনন্তকে ওইভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল ভীষন। ছুটে ওর কাছে চলে গেলো।
"কতটা সুস্থ হবে বলতে পারছিনা। অল্পই বিদ্যুতের সংস্পর্শে এসেছে, কিন্তু মানসিক ভাবেও ভয় পেয়েছে প্রচণ্ড। তাই জ্ঞান ফিরছেনা। তবে ফিরলেও কবে আবার স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারবে তা বলতে পারবো না। একমাস , দুইমাস তো লাগবেই।" ডাক্তার অনন্তকে পরীক্ষা করে বললো।
মহামায়া দেবী কাঁদছেন খুব । আর আরু? সে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে।
"আমি ওষুধ পাঠিয়ে দেবো ।" কথাটা বলে চলে গেলেন ডাক্তারবাবু।
"আমাদের আজই বাড়ি ফিরতে হবে। সব গোছগাছ করে নাও বৌমা।" কথাটা বলে জমিদার মশাই মহামায়া দেবীকে নিয়ে ঘরে গেলেন। মনটা ভালো নেই ওনার।
মাধবী এতক্ষণ সবটা শুনেছিলো। ওনারা চলে যেতেই অরুন্ধতীকে বলল,"ভাবলাম দুটো দিন একটু আনন্দ করবো তা নয় তোর বরকে নিয়ে সবাই মাতামাতি জুড়লো।"
কথাটা অরুন্ধতীর কানে গেলো না ঠিক করে। ও শুধু এখন একটা কথাই ভাবছে।
অনন্তকে সুস্থ কি করে করবে?
অনন্তর পরণের পোশাকটা খুলে ফেললো অরুন্ধতী।
অনন্ত চুপচাপ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
প্রায় ঘন্টাখানেক হল ওরা বাড়িতে ফিরেছে।
অনন্তর জ্ঞান ফেরার পরই রওনা দিয়েছিলেন ওনারা।
আরু অনন্তের মুখটার দিকে তাকালো। ভিতরটা কেঁদে উঠলো ওর। যেই চোখমুখ এত দিন সাহস আর তেজে ভরা ছিলো তা আজ বড়ই অসহায়।
অনন্তকে এইভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছে খুব। যেই ছেলেটা সারাদিন ছুটে বেড়াতো, একা হাতে পুরো কারবার সামলাতো সে আজ বিছানায়। নিজের কাজটুকু নিজে করার ক্ষমতা অব্দি তার নেই।
নাহ্ ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজের মনকে শ্বাসন করলো আরু। ও ভেঙে পড়লে অনন্তও যে ভেঙে পড়বে।
অরুন্ধতী অনন্তর উন্মুক্ত শরীরে হাত দিতেই কেঁপে উঠল অনন্ত। জড়তা কাজ করছে খুব।
অরুন্ধতী আর অনন্ত স্বামী স্ত্রী হলেও ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি এখনও। তাই অনন্ত হঠাৎই নিজেকে অরুন্ধতীর সামনে মেলে ধরতে পারছে না।
আরু সেসব নিয়ে ভেবেই দেখেনি । ও শুধু চায় ওর ছোটো বাবু যাতে তারাতারি সুস্থ হয়ে উঠে আবার আগের মতন হয়ে যান।
গরম জলটা হাতে ঢেলে নিয়ে দেখলো আরু, গরমটা সইবার মতন কিনা?
তারপর আস্তে আস্তে যত্ন করে স্নান করিয়ে দিলো অনন্তকে।
না অরুন্ধতীর স্পর্শে কেঁপে ওঠেনি অনন্ত। যেই ছোঁয়ায় কামনা থাকে না সেই ছোঁয়া পেলে শরীরে না মনে দোলা লাগে।
অনন্তর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কি জানি হঠাৎ চোখ দুটো জলে ভরে গেল অনন্তর। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
অরুন্ধতী আস্তে করে জলটা মুছিয়ে দিয়ে বললো," কাঁদবেন নে একদম। আপনার না কত কাজ। আপনাকে যে ঠিক হতেই হবে, নইলে আমি কি করে নিজের পরিচয় তৈরি করবো?"
অনন্ত আস্তে করে মাথাটা অরুন্ধতীর কোলে রাখে।
নাহ্, মেয়েটা সত্যিই অনেকটা বড় হয়ে গেছে।
জীবনে এমন একেকটা সময় আসে যখন নিজের সাথে নিজেকে লড়াই করতে হয়। যেই কান্নাগুলো ঠেলে বের হতে চায় সেগুলোকে মনের ভিতরেই জমতে দিতে হয়।
নাহলে পাশের মানুষটাকে ভালো রাখা যায় না।
অনন্তর বাঁচার ইচ্ছেটা এখন একেবারেই চলে গেছে।
নিজেকে বড় অপদার্থ মনে হয়।
বিশেষ করে নিজের ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্রতম কাজগুলো করে দেওয়ার জন্য যখন আরুর সাহায্য লাগে তখন মনে হয় এর চেয়ে মৃত্যু বোধহয় বেশি ভালো ছিল।
আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল অনন্ত বিছানায়।
আরুর দিনের পুরোটাই অনন্তর সাথে কেটে যায়।
"আমি আর খাবো না অরুন্ধতী।" অনন্ত বলল।
আরু বলল,"না খেলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন কি করে? খাওয়া নিয়ে এত জেদ করতে আছে?"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্ত বলল,"আমার আর সেরে ওঠা হবে না গো। এই ভাবেই পরনির্ভরশীল হয়ে কাটতে হবে বাকি জীবনটা। তারপর একদিন আস্তে আস্তে চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়বো, সেই ঘুম ভাঙ্গবে না কোনোদিন।"
আরু সঙ্গে সঙ্গে অনন্তর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল,"এসব অলুক্ষুণে কথা যেন আর কখনো কইতে না শুনি আপনারে। কি ভাবেনটা কি আপনি? যখন যা ইচ্ছে বলবেন আর আমি চুপ করে সহ্যি করবো?"
জল গড়িয়ে পড়ে অনন্তর চোখের থেকে।
মেয়েটাকে যত দুরে সরাতে চাইছে ততই যেন কাছে চলে আসছে।
অনন্ত চায় অরুন্ধতী যাতে ওর থেকে দুরে চলে যায়। নাহলে মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ওর মতন একটা অক্ষম ছেলের সাথে সারা জীবন থাকা যায়না।
অরুন্ধতী মিষ্টি হেসে অনন্ত গালের জলটা মুছে দেয়। তারপর কপালে ওষ্ঠদয় স্পর্শ করে বলে,"যত দুরে সরাতে চাইবেন, তত কাছে চলে আসবো। সে আপনি যে ছলই করুন নে কেন।" এই বলে অনন্তর মুখে ভাত ঢুকিয়ে দেয়।
"এই মেয়ে কি আমার মন পড়তে জানে নাকি?" অনন্ত মনে মনে ভাবলো।
থালাটা ধুতে দিয়ে আরু চলে আসছিলো।
এমন সময় মোক্ষদা ঝি পিছন থেকে বলে উঠলো,"ছিলি ঝি, হলি রানি । তারপরেও কি কপাল দেখ। সোয়ামী পড়লো বিছানায়। এখন তার জন্য খেটে মরো।"
তারপর আরুর কানের কাছে এসে আস্তে আস্তে বলল,"বলি এ যদি না সারে, তাহলে শরীরের জ্বালা মিটাবি কেমনে, ভেবে দেখেছিস?
কান মাথা গরম হয়ে যায় আরু।
ছেলেটা অসুস্থ, লোকে তার শরীরের কথা না ভেবে তাকে যৌনতা দিয়ে বিচার করতে নেমেছে। ছিঃ !
আরু মোক্ষদার দিকে ফিরে বলল,"বেশি জ্বালা পোড়া হলে বরফ লাগিয়ে নেবো। তোমার চিন্তে না করলেও চলবে।"
কথাটা বলে ঘরে চলে আসলো আরু।
মোক্ষদা মুখ হাঁড়ি করে বলল,"মরণ! আমি কইলুম ভালোর জন্যি। তা সে কথা ছুঁড়ি বুঝলে তো। "
আরু ঘরে ঢুকে দেখে অনন্ত চোখটা বন্ধ করে শুয়ে আছে।
অনন্তর পাশে বসে পড়ে আরু।
আস্তে আস্তে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
হঠাৎই অনন্ত শক্ত করে আরুর হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,"আমি সুস্থ হতে চাই অরুন্ধতী, আমি আবার নিজের দুটো পায়ে দাঁড়াতে চাই। তোমাকে নিয়ে আবার নদীর পারে বসে সূর্যাস্ত দেখতে চাই।
আরও একবার রামধনুর সাতটা রঙ মাখতে চাই তোমার সাথে। এই অচলায়তনের গণ্ডি ভাঙার পথে তোমার পাশে থাকতে চাই।
আর একবার নতুন করে বাঁচতে চাই আমি অরুন্ধতী, আমি বাঁচতে চাই।"
অতি কষ্টে নিজের চোখের জল সংবরণ করে আরু অনন্তর গালে হাত রেখে বলে,"এই জেদটা নিজের মধ্যে রাখুন, দেখবেন আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে।
আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আপনাকে নিজের পায়ে দাঁড় আমি করাবোই।"
ফ্যালফ্যাল চোখে তাকায় অনন্ত আরুর দিকে।
আরু হেসে ফেলে অনন্তর মাথাটা ওর কোলে রেখে ঘুম পাড়ায়।
অনন্তও আরুর কোলটাকে আঁকড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
অনন্ত ঘুমিয়ে গেলে আরু দরজা আটকে বইপত্র নামিয়ে পড়তে বসে।
পড়ার অভ্যেসটা ছাড়েনি আরু।
ওকে অনেক দুর যেতে হবে।
তাই পড়াশোনাটা যে চালিয়ে যেতেই হবে।
সংসারে দাম তোমার ততক্ষণই থাকবে যতক্ষন তুমি কিছু দিচ্ছো তাকে। যেই মুহুর্তে তুমি দিতে অক্ষম হয়ে গেলে সেই মুহূর্ত থেকেই তোমার দাম পড়তে পড়তে তলানিতে এসে ঠেকবে।
আগে যারা অনন্তকে সম্মান করতো তারা আজ ওকে করুণা করে।
"আরেকটু কষ্ট করুন , তাহলেই পারবেন।" আরু অনন্তের হাতটা ধরে বলল।
অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে আরু অনন্তকে হাঁটানোর কিন্তু অনন্ত একেবারেই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে।
শরীরটায় জোর দেওয়ার এতটুকু চেষ্টা করছে না।
আরু যত বুঝিয়ে যাচ্ছে একটু চেষ্টা করলেই হবে অনন্ত ততবার বলছে,"আমার দ্বারা হবে না অরুন্ধতী।"
শেষে কেমন যেন রাগ উঠে গেল আরুর।
বলল,"ঠিকই বলেছেন জানেন? আপনার দ্বারা সত্যিই কিচ্ছু হবে না। যার নিজেরই কোনো তাগিদ নেই ভালো হয়ে ওঠার তাকে আমি কি বোঝাবো? আপনার বাকি জীবনটা সত্যিই বিছানাতেই কাটবে।"
কথাটা বলে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে গেল আরু।
"তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলে অরুন্ধতী।" কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠলো অনন্ত।
আরুর বলা প্রতিটা কথা কাঁচের মতন বিঁধলো অনন্তর বুকে।
ওর অরুন্ধতী ওকে এতগুলো কথা শোনাতে পারলো?
না উঠতে তো ওকে হবেই। উঠে আরুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে কি করে এতগুলো কথা শোনালো ওকে আরু?
আস্তে আস্তে নিজের শরীরটাকে টেনে তোলে অনন্ত, কষ্ট হচ্ছে খুব । বড় বেশি জোর দিতে হচ্ছে তবু উঠে বসলো অনন্ত।
এরপর এক পা নিচে নামাতে যেতেই কোমড়ে টান লাগলো।
ব্যাথা লাগলো, তবু চিৎকার করলো না।
টেনে হেঁচড়ে শরীরটাকে দাঁড় করালো।
এই তো , এই তো পেরেছে ও দাঁড়াতে।
কিন্তু ওসব নিয়ে এখন ভাবলো না অনন্ত।
ওকে যে আরুর কাছে যেতে হবে।
ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এলো ও।
সামনে টগর ঝিকে দেখে বলল,"তোদের ছোটো বউঠাকুরাণী কোথায় রে?"
টগর অবাক হয়ে বলল,"ওমা কত্তা, আপনি চলতে ফিরতে পারছেন আবার? ঠাকুর রক্বে করেছেন।"
অনন্ত বলল,"ঠাকুরের নাম জপ পরে করবি, আগে বল বউঠাকুরাণী কোথায়?"
টগর বললো,"বৌরাণী তো ছাদে গেল।"
আরু ছাদে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো।
এমন সময় পিছন থেকে অনন্ত এসে ওর হাত ধরে টেনে সামনে ঘোরালো।
হকচকিয়ে গিয়েছে অরুন্ধতী।
তার উপর সামনে অনন্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরোও অবাক হয়ে গেছে।
অনন্ত আরুর হাতদুটো ধরে বললো,"তু...তুমি পারলে আমাকে ওই কথাগুলো বলতে? কি করে পারলে?
এখন আর ভালোবাসো না আমাকে তাই না? কি করেই বা বাসবে, আমি তো..."
আর বলতে পারে না অনন্ত। অরুন্ধতী ততক্ষণে ওকে বুকে জরিয়ে ধরেছে শক্ত করে।
কান্নাভেজা গলায় আরু বলে,"দেখলেন তো , দুটো কথা শোনানোর ফল। আপনি আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। "
অনন্ত ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় নেয়।
তারপর বলে ওঠে," অভিমানেই তাহলে মুশকিল আসান হলো বলো?"
মাঝখানে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস।
অনন্ত এখন পুরোপুরি সুস্থ। আরুও পড়াশোনায় অনেকটা এগিয়ে গেছে।
শুধু বাংলা না এখন ইংরেজিতেও লিখতে পড়তে পারে সে।
অনন্ত বলেছে ইংরেজদের সাথে কারবার করতে গেলে তাদের ভাষা রপ্ত করতে হবে।
তবে এখন অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
ইংরেজরা ব্যবসায় মেয়েদের দেখলে আপত্তি তুলবে না।
কিন্তু এ দেশের কারবারিরা কি মেনে নেবে?
"ও কি বৌমা, তুমি বইপত্তর নিয়ে বসে কি করছো?" মহামায়া দেবীর গলার স্বর শুনে চমকে মুখ তোলে আরু আর অনন্ত।
অনন্তর কাছে পড়তে বসেছিলো আরু।
রাত্রিবেলা, সবাই শুয়ে পড়েছিলো।
অনন্ত ভাবতে পারেনি মা এত রাতে ওদের ঘরে আসবে।তাই দরজায় খিল দিতে ভুলে গেছে।
ভয় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আরুর। কি জবাব দেবে এখন সে?
অনন্ত অবশ্য ভয় পেলো না । কোনো না কোনো দিন তো এই কথাটা সবাইকে জানাতে হতই।
তাই বেশ দৃঢ় গলাতেই সে বলল,"আমি অরুন্ধতীকে ব্যবসার কাজকর্ম শেখাচ্ছিলাম মা।"
মহামায়া দেবী অবাক হয়ে বললেন,"বৌমা ব্যবসার কাজ শিখে করবেটা কি?"
অনন্ত বলল,"আপাতত আমাকে সাহায্য করবে। আর তারপর সবটা ঠিকঠাক সামলানো শিখে গেলে নিজেও কারবারে যোগ দেবে।"
"অনন্ত, বাপ আমার, বলি তোর মাথাখানা কি ঠিক আছে নাকি এক্কেরে গেছে? বাড়ির বউ কিনে শেষে কারবারে নামবে? এমন ছিঁড়িছাঁদ হীন কথা তোর মাথায় আসে কোথার থেকে?" মহামায়া দেবী বললেন।
অনন্ত হেসে বলল,"মাথা আমার একদম ঠিক আছে মা। আর ঠিক আছে বলেই বলছি অরুন্ধতীর মধ্যে ক্ষমতা আছে একটা কারবারকে সুন্দর করে পরিচালনা করার, জমিদারী সামলানোর। আর আমি চাইনা সেটা নষ্ট হোক। আমি চাই ওর নিজের একটা পরিচয় তৈরি হোক। শুধু বাড়ির বউ হয়ে নিজের প্রতিভা ও নষ্ট করুক এমনটা আমি কিছুতেই হতে দেবো না । "
মহামায়া দেবী ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,"লোকে কি কইবে ভেবে দেখেছিস? বাড়ির বউ কিনা সংসার ফেলে ড্যাং ড্যাং করে বাইরে বেড়োবে? এতে সংসারের শ্রী থাকবে? আমাদের বাড়ির কোনো মান সম্মান নেই?"
"কেন থাকবে না মা? আমি, বাবা মশাই সারাদিন বাইরে কাজ করা সত্ত্বেও ঘরে নারায়ণ বজায় আছে তখন অরুন্ধতী বাইরে গেলেও শ্রী থাকবে ঠিকই।" অনন্ত বলল।
"তুই থাম দেখি। বৌমা আমি যেন না দেখি যে তুমি অনন্তর কথায় তাল মিলিয়েছো। রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।" কথাটা বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন মহামায়া দেবী।
আরু অনন্তের দিকে ফিরে বললো,"এবার কি হবে?"
অনন্ত আরুর ভয় পাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
তারপরে বলল,"ভয় পেলে কি হবে? এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো তাই না? এইগুলোর মুখোমুখি যে হতেই হবে।"
আরু বললো,"আপনি শুয়ে পড়ুন , আমি একটু কাজ সেরে শোবো।"
"বুঝেছি, এখন তোমার সেই গোপন সহচর, আমার সতীনকে বের করা হবে বুঝি?" অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
অনন্ত আরুর লেখার খাতাটাকে সতীন বলে ডাকে। অনন্তর পরে ওই খাতাটাই যে আরুর সবচেয়ে আপন।
আরু ফিক করে হেসে ফেলে।তারপর ঘাড় নাড়িয়ে বলে ," হ্যাঁ ।"
অনন্ত শুয়ে পড়ে। এই মেয়েটা কি করে যে ওর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল, এখনও ভাবলে অবাক লাগে।
মেয়েটা শুধু ওর স্ত্রী না, ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধুও বটে।
ওর সাথে মনের সবটা ভাগ করে নেওয়া যায়।
এখনও ভুলতে পারেনা অনন্ত, এই কয়েকমাস আগে মেয়েটা কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওকে সারিয়ে তুলেছিলো। মনে নিখাদ ভালোবাসা না থাকলে
এমনটা সম্ভব হয়না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অনন্ত।
আরু খাতাটা খুলে লেখে,
"পায়ের বেড়ী শক্ত হচ্ছে। এতদিন যেই জীবনটা কাটালাম সেটার আজ ইতি ঘটলো। কাল থেকে আসল লড়াই শুরু হবে।
এতদিন তো শুধু প্রস্তুতি নিয়েছি। এবার সেটার পরীক্ষা দিতে হবে।
পাস করা কঠিন , কিন্তু করতে যে হবেই।
আচ্ছা, আমি পারবো তো?
যদি হেরে যাই , তাহলে যে ওনার আমাকে ঘিরে সব স্বপ্ন ভেঙে যাবে।"
"কঠিন হচ্ছে পথ,
নদীর স্রোতের বাড়ছে গতি
পাল্টাচ্ছে গতিপথ।
মিশছে গিয়ে বিশাল সাগরে
আছড়ে পড়ছে ঢেউ।
মাঝ দরিয়ায় ভাসছি আমি
ডুবে না যাওয়ার লড়াই
মনের ভিতর চলছে কি যেন,
নিজেকে যদি হারাই?
তবু বারে বারে
কেউ যেন এসে বলে,
ধরে আছি আমি তোমায়।
আসুক হাজার প্রতিকুলতা
তবু জিতিয়ে ছাড়বো তোমায়।।"
"বাবামশাই, আপনাকে আমার একটা কথা বলার ছিলো।"
অনন্ত জমিদার মশাইকে বলল।
দুজনে ছোটো বৈঠকখানায় কাগজপত্র নিয়ে বসেছিলো।
জমিদার মশাই বললেন,"কি কথা?"
অনন্ত বলল,"আমাদের এত বড় কারবার, সবটা একা সামলে উঠতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। তাই সাহায্য করার জন্য কাউকে পেলে খুব ভালো হত।"
জমিদার মশাই বললেন,"তা বেশ তো, তুমি লোকের খোঁজ করো। তোমার দাদাকে তো আর বলতে পারবো না। সে তো উচ্ছন্নে গেছে।"
অনন্ত ভয় ভয় ঢোক টোক গিলে বলল,"না মানে লোকের সন্ধান একটা আছে। আমি ভাবছিলাম অরুন্ধতী যদি আমাকে সাহায্য করে তাহলে কেমন হতো?"
জমিদার মশাই ভ্রু কুঁচকে মুখ তুললেন,"ছোটো বৌমার কথা বলছো তুমি? মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? আমাদের সমাজে বাড়ির মেয়ে বউরা কখনও বাইরে কাজ করেনা। এ কথা তো তোমার অজানা নয়।"
"কিন্তু বাবামশাই নিয়ম তো পাল্টায়। যে নিয়ম আমাদের এগোনোর বদলে পিছিয়ে দিচ্ছে তা তো বদলাতে হবেই। মেয়েরা কতদিন শুধু চিকের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে বলুন তো? ওদের তো ক্ষমতা আছে পুরুষদের সাথে সমান তালে কাজ করার।" অনন্ত বলল।
"দেখো অনন্ত বিষয়টা ক্ষমতার নয়। বিষয়টা প্রকৃতির। মেয়েদের কোমল গড়নে ভারী কাজ করা সম্ভব নয়।
রান্নাঘর সামলানো আর কারবার সামলানো তো আর এক কথা নয়। মেয়েরা ভিতর সামলাবে আর পুরুষরা বাইরেটা। এতে আপত্তি করার কি আছে?" জমিদার মশাই জোড় দিয়ে বললেন।
অনন্ত হাসলো। তারপরে বলল,"কি বললেন বাবামশাই? কোমল গড়নে ভারী কাজ? যারা এত যন্ত্রনা সহ্য করে আপনাকে আমাকে পৃথিবীর আলো দেখালো তারা ভারী কাজ করতে অক্ষম এমনটা আমি বিশ্বাস করিনা।
যাদের শরীর থেকে মাসে মাসে ঘামের মতন রক্ত ঝরে , তারা শুধু রান্নাঘর সামলাবে এটা মানতে আমি পারবো না।"
জমিদার মশাই একটু থামলেন। এই অকাট্য যুক্তির সামনে কি বলবেন বুঝে পেলেন না।
তারপর বললেন,"সমাজ কি বলবে? ওদের মুখোমুখি কি করে হবে তোমরা?"
"বাবামশাই সমাজ নিয়ে আমি ভাবি না। ওরা দুদিন বলবেন, তারপর মেনে নেবেন।" অনন্ত বললো।
"সমাজকে নিয়েই আমাদের চলতে হয়। আর এই বিষয়টা হেলাফেলা করার মতন নয়।
তবে আমি আগে বৌমাকে একটু পরখ করে নিতে চাই। ডাকো দেখি ওকে। "
অনন্তর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
আরু তো ভয়ই অস্হির।
জমিদার মশাই বললেন,"বৌমা তোমাকে কটি প্রশ্ন করবো। যদি উত্তর দিতে পারো তাহলে তোমার বিষয়টা ভেবে দেখবো।"
আরু মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।
তারপর ভয় ভয় অনন্তর দিকে তাকালো।
অনন্ত ইশারায় আস্বাস দিলো।
জমিদার মশাই বললেন,"বলো বৌমা, কারবার করতে কোন জিনিসগুলো অপরিহার্য?"
আরু একটু ভেবে বললো," পরিশ্রম , একাগ্ৰতা, আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধি , মূলধন আর ভালোবাসা।"
জমিদার মশাই বললেন ,"সবই বুঝলাম কিন্তু ভালোবাসার সাথে কারবারের কি সম্পর্ক।"
আরু বলল," আমি যেই কাজটাই করবো তা নিষ্ঠা ভরে ভালোবাসা দিয়ে না করলে তাতে উন্নতি সম্ভব নয়। যদি কাজটার প্রতি টানই না থাকলো তাহলে তার ভালোমন্দ কোনোটাই আর মনকে নাড়া দেবে না।"
উত্তরটা জমিদার মশাইয়ের পছন্দ হয়েছে বলে মনে হল। ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা দেখা দিলো।
তারপর বললেন,"তুমি যদি দেখো তোমার কোনো বিশ্বস্ত কর্মচারী তোমাকে ঠকাচ্ছে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হবে? তাকে কি তুমি তাড়িয়ে দেবে?"
আরু বললো,"তাড়িয়ে যদি দিই তাহলে সে নিজের ভুলটা বুঝবে না। তাকে তো বোঝাতে হবে যে সে ভুল করেছে। নাহলে অন্য কাউকেও সে ঠকাবে।"
জমিদার মশাইয়ের মুখের হাসির রেখাটা আরও চওড়া হল।
হাসিমুখে বললেন,"অনন্ত, বউকে তো দেখছি পুরো তৈরি করে ফেলেছিস। না এরপরে আর কিছু বলতে পারছি না।
বৌমা তুমি যাও অনন্তকে কারবারে সাহায্য করতে করতে পুরোটা শিখে নাও।"
আরুর মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। জমিদার মশাইকে গিয়ে একটা প্রণাম করলো আরু।
জমিদার মশাই আশীর্বাদ করে বললেন,"মা রে, আমার চিরকালের দুঃখ ছিলো আমার এক ছেলে অমন অপদার্থ কি করে হল। আজ তুই তার অনেকটা পূরণ করে দিলি। তুই আমার বৌমা না, আমার মেয়ে। এই বাপের ঘর চিরকাল আলো করে থাকিস রে মা। "
আরুর চোখে জল চলে আসলো।
পর্দার আড়াল থেকে সবটা দেখছিলো মাধবী।
রাগে গা টা জ্বলে যাচ্ছে ওর।
না না, আরুকে কিছুতেই বাইরে যেতে দেওয়া যাবেনা।
সামান্য ঝি, সে কিনা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর সে সংসারের হাজার একটা কাজ করে মরবে।
কক্ষনো না। এর ব্যবস্থা মাধবী ঠিক করবে!
"ওকি বৌরাণী, কি করছো টা কি তুমি?" টগর ঝি মাধবীকে জিজ্ঞেস করলো।
"চুপচাপ থাক তো মুখপুড়ি। যা করতে কইছি তাই করবি। আর খবরদার। এ কথা যদি পাঁচকান হয়েছে তবে তোরে আমি ছাড়বো নে।" মাধবী নিজের গলার ছড়া খানা খুলে টগরের হাতে দিয়ে বললো ,
"যদি কাজখানা করতে পারিস তাহলে এই যে হাতের বালাখানা দেখছিস সেইটাও পাবি। যা দেরি করিসনে।"
টগর ঝি গয়নার লোভে রাজী হয়ে গেল।
মাধবী স্থির করে ফেলেছে, আরুকে কাল কিছুতেই সেরেস্তায় যেতে দেবেনা।
তাই সে টগর ঝিকে বলেছে ডাক্তারখানা থেকে ঘুমের বড়ি আনিয়ে রাতে আরুর দুধের মধ্যে মিশিয়ে দিতে।
অনন্ত দ্বায়ীত্বজ্ঞানের অভাব ভেবে ক্ষিপ্ত হবে।
ব্যাস ! ঘুচে যাবে ঝি ঠাকুরাণীর রানিমা হওয়ার শখ।
মেয়েটা বুঝলো না এমনটা করে নিজের মুক্তির পথও সে বন্ধ করে দিলো।
দুধটা খেয়ে আরু ঘুমিয়ে পড়লো। মনের মধ্যে একরাশ উত্তেজনা। কাল থেকে ওর জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।
নতুন পরিচয় তৈরি হবে ওর।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে উঠলো। বেশ কড়া মাত্রার ওষুধই পড়েছে পেটে।
"অরুন্ধতী, ওঠো আর কতক্ষন ঘুমোবে? এবার তো আমায় বেড়োতে হবে।"
সকাল থেকে আরুকে ডেকে ডেকে সারা হচ্ছে অনন্ত।
এই নিয়ে মোট পনেরো বিশবার ডাকা হয়ে গেছে।
আরও কিছুক্ষণ ডাকার পর আরু আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। তারপর ধরফর করে উঠে বসে।
সূর্যের কড়া তেজ দেখে জিজ্ঞেস করে,"আমার কি উঠতে খুব দেরি হয়ে গেল?"
"এটা তুমি আবার জিজ্ঞেস করছো?" অনন্ত বেশ কড়া গলায় বললো।
আরু মুখ নিচু করে বলল ,"আমি বুঝতে পারিনি। কি যে পোড়া ঘুম লেগেছিলো আজ চোখে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে।"
"অজুহাত দিওনা আরু।" ঝাঁঝিয়ে উঠলো অনন্ত।
"এইভাবে কাজ করতে পারবে ভেবেছো তুমি? আমি ভাবতে পারিনি প্রথম দিনেই তুমি এমন দ্বায়ীত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেবে। আর গিয়ে কাজ নেই তোমার।
আমারই ভুল হয়েছে। তোমার জায়গা ওই রান্নাঘরেই।"
কথাগুলো বলে সেরেস্তার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অনন্ত।
পর্দার আড়াল থেকে সবটা দেখে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলো মাধবীবালা।
নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে আরুর চোখের থেকে।
অনন্ত ওকে ভুল বুঝলো?
ও তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি। অনন্ত ওর কোনো কথাই শুনলো না।
উঠে পড়লো আরু। আর শুয়ে থাকা চলে না। ঘরের কাজটুকু তো অন্তত করুক।
সারাদিন ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত রাখলো নিজেকে।
মহামায়া দেবী জিজ্ঞেস করেছিলেন," কিরে, তোর না আজ সেরেস্তায় যাওয়ার কথা ছিলো? গেলি নে?"
আরু শুকনো মুখে বলেছিলো ,"সেই যোগ্যতা আমার নেই।"
মহামায়া দেবী আর কিছু বলেননি, ভেবেছেন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অমন ঝগড়া হয়েই থাকে।
নিস্তব্ধ দুপুর। সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে ভাতঘুম দিচ্ছে।
আরু নিজের খাতার থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিলো।
"প্রিয় আপনি,
আর কি বলে আপনাকে সম্বোধন করবো আমার জানা নেই। তাই আপনিই লিখলাম।
অনেক ভেবে দেখলাম জানেন? আজ বুঝলাম আমি সত্যিই আপনার যোগ্য নই।
বিয়েটা করুনার বশে করে ফেলেছেন। আমাকে উদ্ধার করেছেন।
আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো কেউ আপনার প্রাপ্য।
আমি আর কে?
এই জমিদারবাড়ির দুটাকার ছোটো ঝি ঠাকুরাণী।
ভাগ্যের পরিহাসে বৌঠাকুরাণী হয়ে গিয়েছিলাম।
আপনি প্রচুর চেষ্টা করেছেন আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর। আমাকে ভরসা করেছেন। আমিই সেই ভরসার মর্যাদা রাখতে পারলাম না।
তবে আপনার সাথে সাথে আমিও একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম জানেন? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন।
আর সেই স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজের আসল জায়গাটা ভুলে গিয়েছিলাম।
আজ আবার নিজের জায়গাটা মনে পড়ে গেল।
তাই সবটা ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি।
আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাববেন না। শুধু আমি চাই আপনি ভালো থাকুন। নতুন করে জীবনটাকে শুরু করুন।
আমি চললাম।
ভালো থাকবেন।
ইতি ,
আপনার আশ্রিতা।"
চিঠিটা ভাজ করে আরু রেখে দেয় খাটে।
গায়ের সমস্ত গয়না খুলে রেখে দেয়। এই বংশের আভিজাত্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
আস্তে আস্তে বেড়িয়ে আসে ঘর ছেড়ে।
বিশাল বড় জমিদারবাড়ির চোকাঠের বাইরে পা রাখে।
একবার পিছন ফিরে তাকায়। যেই চৌকাঠ ডিঙিয়ে একদিন দুধে আলতার ছাপ ফেলে নিজের সংসার মনে করে পা রেখেছিলো তা আজ সারাজীবনের মতন ছেড়ে যাচ্ছে।
সামনের দিকে তাকিয়ে এক অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ালো অরুন্ধতী।
আজ আর সে ছোট্টো আরু নেই। সে আজ পরিপূর্ণ অরুন্ধতী।
জীবনের স্রোত তাকে আজ অন্য পথে নিয়ে যাচ্ছে।
কি হবে এরপরে?
"ঠাস!" একটা চড় নেমে এলো অনন্তর গালে।
চোখ বেয়ে অনবরত জল নেমে আসছে অনন্তর।
কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে আছে আরুর রেখে যাওয়া চিঠিটা।
চড়টা অনন্তকে মারলেন মহামায়া দেবী।
জমিদার মশাই মাথা নিচু করে বসে আছেন।
মহামায়া দেবী চিৎকার করে বললেন,"তুই কোন সাহসে মেয়েটাকে অতগুলো কথা বললি? কি ভাবিসটা কি? যেভাবে ইচ্ছে নিজের বউকে চালাবি?"
অনন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আজ আর কোনো কথা বলার সাহস ওর নেই।
ও ভেবেছিল আরুকে শ্বাসন না করলে মেয়েটা এগোতে পারবে না, কিন্তু কথাগুলো যে আরুর আত্মসম্মান বোধকে আঘাত করবে ও বোঝেনি।
মহামায়া দেবী বললেন,"কোথায় গেল মেয়েটা? লেঠেলরা গিয়ে খোঁজ করে এলো, বাপের ঘরেও তো যায়নি। তাহলে গেলটা কোথায়?
এখন ঠাকুর না করুক ওর ভালোমন্দ কিছু হলে তার দ্বায় কে নেবে? তুই?"
"নাহ্! অরুন্ধতীর কিচ্ছু হবে না।" অনন্ত আঁতকে উঠে বললো।
মাধবী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলো, এবারে হাতমুখ নেড়ে বলে উঠলো,"আর কি এসব ভেবে লাভ হবে ঠাকুরপো? ওই কুলত্যাগিনী মেয়েকে তো আর ঘরে তোলা যায়ে নে।"
জমিদার মশাই বললেন,"আহ্! বড় বৌমা , এখন এসব কথা থাক না।"
মাধবী মুখ গোমড়া করে দায় রইলো।
অনন্তর ভালো লাগছে না এইসব কথা শুনতে। ওর মন ছুটে যেতে চাইছে আরুর কাছে।
"এত মান তোমার আমার উপর হল অরুন্ধতী? আমাকে নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত দিলে না? আমি কোথায় খুঁজব তোমায় অরুন্ধতী? কোথায় খুঁজব?" অনন্ত মনে মনে বলল।
এমন সময় একজন এসে খবর দিল কবিরাজ মশাই এসেছেন।
জমিদার মশাই তাকে ভিতরে আসতে বললেন।
কবিরাজ এসে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন,"আজ্ঞে আমার ওষুধের টাকাটা পেয়ে গেলে ভালো হত কর্তা । "
" কোন ওষুধ ? " জমিদার মশাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ।
"আজ্ঞে, ওই যে বড় বৌঠাকুরণ কাল টগর ঝিকে পাঠিয়েছিল না ঘুমের ওষুধ কেনার জন্য , ওই টাকাখানা। তিন টাকা দাম।" কবিরাজ বললো।
কথাটা শুনে মাধবীর তো ভয় গলা শুকিয়ে এসেছে।
মহামায়া দেবী মাধবীকে জিজ্ঞেস করলেন ,"বড় বৌমা, তোমার হঠাৎ ঘুমের ওষুধের কি প্রয়োজন পড়লো।"
মাধবী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,"আ....আম..মার ক.ক.কি প্রয়োজন পড়ব.বে মা।
ওই টগর কি উল্টোপাল্টা বলেছে। আমি ওষুধ কেনাইনি।"
মহামায়া দেবী বললেন,"না, টগর এত ভুল তো করবেনা।" বলে টগর ঝিকে ডাকলো ।
টগর ঝি এসে ভয় ঠকঠক কাঁপছে।
মহামায়া দেবীর পায়ে পড়ে সে কেঁদে উঠলো, "আমি কিচ্ছুটি করিনি গিন্নিমা, আপনি আমায় তাড়িয়ে দেবেন নি, ওই বড় বৌরাণী যা করতে কইছে আমি তাই করেছি।"
বলে সব কথা গড়গড় করে বলে দিলো।
"ছিঃ বৌমা ছিঃ! এত ছোটো মন তোমার। এত নীচ কাজ কি করে করলে তুমি?" মহামায়া দেবী বলে উঠলেন।
মাধবী মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল ।
অনন্ত আরও বেশি আঘাত পেলো। অরুন্ধতী বলেছিলো ওকে ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। অনন্ত সেটাকে অজুহাত বলে উড়িয়ে দিয়েছিলো।
নিজের ঘরে চলে যায় অনন্ত। দরজাটা আটকে দেয়।
আরুর খুলে যাওয়া গয়নাগুলোর উপর হাত বোলায়। অনুভব করার চেষ্টা করে আরুকে।
আজ সেরেস্তা থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে যখন সমস্ত গয়না আর চিঠিটা দেখেছিলো কেমন পাগল পাগল লাগছিলো।
সারা গ্ৰাম খুঁজেও পায়নি। অনন্ত নিজেও গিয়েছিল কিন্তু নাহ্! সে যে কোথাও নেই।
আজকের রাতটা বড় কষ্টের। প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট।
অনন্ত কেঁদে ফেলে।
"কেন আমাকে ছেড়ে গেলে অরুন্ধতী? কেন? আর কি কোনোদিনও ফিরে পাবোনা তোমাকে? আমাদের স্বপ্নের সাজানো সংসারটা কি অসমাপ্তই থেকে যাবে? কি করে বাঁচব বলোতো আমি তোমাকে ছাড়া ?" বারান্দায় গিয়ে কথাগুলো চিৎকার করে বলে অনন্ত।
গলার স্বরটা ভেঙে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই বসে পড়ে অনন্ত।
অমাবস্যা নিজের গাঢ় কালো রঙ ঢেলে দিচ্ছে সারা আকাশে। পুরো পৃথিবীটা তলিয়ে গেছে অন্ধকারের ভিতর।
ঠিক যেমন তলিয়ে গেছে অনন্তর জীবনটা এই বিষাদময় রজনীর আড়ালে।
চোখে মুখে জলের ছিটে পেতেই আরু চোখ খুললো।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা অচেনা ঘরে শুয়ে আছে। আগে কি হয়েছে মনে করার চেষ্টা করলো একটু।
মাথার একপাশটায় বেশ ব্যাথা করছে।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলো আরু। সারাদিনের ক্লান্তি আর মানসিক চাপের কারণে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে পড়ে যায়।
ধরফর করে উঠতে গেলো আরু।
হঠাৎ পাশের থেকে একটা মিষ্টি গলা বলে উঠলো,"কি করছো টা কি? উঠো নে উঠো নে। শরীর যে বড় দুর্বল তোমার।"
আরু তাকিয়ে দেখলো ওর চেয়ে বয়েসে কিছুটা বড় একটা মেয়ে বসে আছে।
মেয়েটার পরনে বিধবার থান।
আরু জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল,"তুমি কে? আর আমিই বা কোথায়?"
মেয়েটি বললো,"আমার নাম কুন্দমালা । তুমি যে জঙ্গলের ধারে পড়ে ছিলে গো । আমি দেখতে পেয়ে কোনো ভাবে টেনেটুনে আমার ঘরে নিয়ে আসি। ওর কাছেই আমার ভিটে কিনা।"
আরু বুঝলো মেয়েটা বকবক করতে ভালোবাসে।
কুন্দ আবার জিজ্ঞেস করলো,"তুমি এখানে এলে কি করে কও দেখি।"
আরু চুপ করে থাকলো। জল গড়িয়ে পড়লো ও চোখ থেকে।
কুন্দ বলে উঠলো ,"আচ্ছা, আচ্ছা। আগে তাহলে আমার কথা বলি শোনো।
আমার এই বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিলো। বাপ মা ছিল নে, কাকারা তাই এই হাভাতের ঘরে পাঠিয়ে দিলো।
তা আমার শ্বাউড়ি মা বিয়ের মাসখানেক পরেই মরে যায়। শ্বউররে তো চোখেই দেখিনি, সে আগেই পটল তুলেছে।
বরটা আমার বহুত মদ খেতো। কাজ তেমন করতোনি। আমিই চাষাবাদ করে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলুম।
ভালোই চলছিলো, ঘরে বেশ টাকাও আসছিলো। হঠাৎ একদিন মিনসেটা টপকে গেল। গিলতো তো সারাদিন তাই বাঁচাতে পারলুম নে।
আমার চাষবাস করে ভালোই পেট চলে যায়, বরং মাস শেষে কিছু টাকা বেঁচে যায়। তবে ওই যে, কথা কওবার লোক নেই। এই জঙ্গলে একা থাকি।
এবার তোর গল্প বল দেখি। তুই করেই বললাম। তুই আমার বোনের মতন।"
আরু একটু ধাতস্থ হয়ে কুন্দকে সবটা বললো।
শুনে কুন্দ বলে,"মরণ! এই কারণে কেউ অত কিছু ছেড়ে আসে?"
আরু বলে,"আমাকে কটা দিন এখানে আশ্রয় দেবে গো দিদি? একটা কিছু ব্যবস্থা করে আমি ঠিক চলে যাবো।"
"তা কটা দিন কেন? যতদিন ইচ্ছে থাক।
আরেকটা পেট আমি দিব্যি চালাতে পারবো। তবে এভাবেই কি বাকি জীবনটা কাটাবি?" কুন্দ বললো।
আরু হেসে বলল,"না গো দিদি। নিজের ব্যবসাটা এবার খুলেই ফেলবো।"
কুন্দ উৎসাহিত হয়ে বললো,"সত্যি? এই তোর কারবারে আমাকে কাজ দিবি? আমার না কাজ করতে খুব ভালো লাগে।"
আরু বললো,"তোমাকে ছাড়া যে আমার কাজই এগোবে নে।"
মাঝে দুইদিন কেটে গেছে। আরু এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে।
আজ ও আর কুন্দ এসেছে কোম্পানি বাহাদুরের অফিসে। আরু ঠিক করেছে নিজের কারবারের জন্য একেবারে আসল লোকের থেকেই ও সাহায্য নেবে।
বড় লাটসাহেব আরুকে বললেন,"সবই তো বুঝিলাম অরুন্ধতী দেবী, কিন্তু আপনাদের সোসাইটি এটা মানিয়া নিবে কি?"
আরু বললো,"আপনারা সাহায্য করলে সব হবে সাহেব।"
লাটসাহেব হেসে বললেন,"দেখুন আপনার কথাবার্তা আমার পছন্দ হইয়াছে। ইন ফ্যাক্ট অনেক জমিদারের চেয়েই আপনার বিহেভিয়ার বেশ polished। তবে আপনি কি দিয়ে কারবার শুরু করবেন একটু ব্রিফ করলে ভালো হইত।"
আরু বললো,"আমি শাড়ির কারবার দিয়ে শুরু করতে চাই। সেই শাড়ির উপর কাঁথার নক্সা করবো। এই দেখুন এইরকম।"
বলে নিজের খাতাটা খুলে দেখালো আরু। বাড়ি ছাড়ার সময় এই খাতাটা আনতে ভোলেনি সে।
লাট সাহেব বললেন,"Ummm, highly impressive! " তারপর কুন্দর দিকে তাকিয়ে বললেন,"Who is she? Is she your assistant?"
কুন্দ একবর্ণ না বুঝলেও এইটুকু বুঝলো ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে তাই ও একটা হাসি হেসে দিলো।
আরু বললো ,"Yes, she is my business partner."
সাহেব বললেন,"ঠিকাছে, আমি আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি মূলধন। আপনি শুরু করুন আপনার কারবার।"
আরু বললো,"অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তবে একটা অনুরোধ করছি এই বিষয় কেউ যেন কিছু না জানতে পারে এখনি। আসলে একটু ব্যক্তিগত কারণ আছে।"
সাহেব বললেন," Fine, কেউ কিছু জানবে না। Wish you all the best for your future."
আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসে আরুরা।
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আরু ভাবতে থাকে দুদিন আগেও অনন্তর ভালোবাসায় সিক্ত ছিল তার হৃদয়।
আর আজ!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরু।
কোন দুরে বাইরে দাঁড়িয়ে এই সময় অনন্তও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
দুজনেই হয়তো আঁধারের অন্তরালে একেঅপরকে খুঁজছে।
সম্পর্কটা কি সত্যিই অসমাপ্ত রয়ে গেল?
নাকি কালের নিয়মে আবার দেখা হবে তাদের।
সেইদিন কি আবার তারা পারবে, নিজেদের সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দিতে?
আবার বাঁধা পড়বে নিজেদের সীমাহীন বন্ধনে?
কবে আসবে সেইদিন? বেলা যে বয়ে যায়।
"বেলা যে যায় বয়ে
এলোনা তবু সে,
পোড়া মন আজও পাগল
তারে হেরিবার তরে।
ব্যস্ত ব্যাকুল মন যে শুধু
খোঁজেই কেবল তারে,
প্রাণের মানুষ দুরে গেলে
এ মন পুড়ে মরে।।"
সত্যিই বেলা বয়ে গিয়েছে।
সময়কে কি আর বেঁধে রাখা যায়?
সে চিরটাকাল ছুটে বেড়ায়। আমরা শুধু শুধুই তার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করি।
আজ যাকে ছেড়ে বাঁচতে পারবোনা মনে হচ্ছে তার বিরহে থাকতে থাকতে সময়ের নিয়মে সবটাই একদিন সয়ে যায়।
আবার সকালে উঠে রোজনামচার পুনরাবৃত্তি ঘটাই। সবই করি শুধু সেই মানুষটা আর থাকেনা। তাকে আমরা ঠাঁই দিই মনের মণিকোঠায়। সে হয়ে যায় আমাদের অতীত।
কিন্তু অতীত যখন বর্তমানের মুখোমুখি হয় ? বা বলা ভালো যখন বর্তমান অতীতের মুখোমুখি হয় ? তখন কি করা উচিত?
পাঁচটা বসন্ত কেটে গেছে, অরুন্ধতী আর অনন্তর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি।
একেঅপরের খোঁজ তারা আজও জানে না।
শুধু স্মৃতিটুকু আঁকড়েই বাঁচা।
এর নামই বোধহয় জীবন।
অনন্ত সেরেস্তা ঘরে বসে হিসেবের খাতা দেখছিল।
এখন আর আগের সেই হাসিখুশি বছর কুড়ির ছেলে সে নেই।
সে এখন পঁচিশ বছরের রাগি গম্ভীর ব্যস্ত কারবারি।
বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকেই না বলতে গেলে।
মা বাবা দুজনেই ওর উপর আজও রেগে আছে।
ওনাদের ধারণা অনন্ত সেইদিন আরুকে ভুল না বুঝলে এমনটা হত না। আরু যে কয়েকটা মাসে ওদেরও ভীষন কাছের হয়ে উঠেছিল।
ঝি এসে জল খাবারটা শুধু দিয়ে যায়।
বাকি সময়টা ব্যবসার কাজ করেই কেটে যায়।
তবে রাতটা কিছুতেই কাটতে চায়না। বড় একা একা লাগে নিজেকে।
মাধবী এখন দিগন্তকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকে। দিগন্ত শ্বশুরের কাজে কিছুটা সাহায্য করে আর বাকিটা সময় মদের ফোয়ারা। এভাবেই আছে তারা।
হিসেবের খাতা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল অনন্তর।
"নায়েব মশাই, আমাদের শাড়ির মাল এবার কার থেকে কিনেছেন? এই নাম তো আগে কখনও দেখিনি।" কথাটা বলে কারবারীর নামটার উপর হাত বোলালো অনন্ত।
"ইচ্ছেতরী" ।
কারবারীদের মাথাতেও বুঝি এমন সুন্দর নামের ভাবনা আসে?
নায়েব বললেন,"আজ্ঞে কর্তা, এ কারবার এক মেয়েমানুষের। আপনি তো বেশ কয়েকবছর বাইরের কোনো খবর রাখেন না, তাই জানেন না।
ক'বজর হল একজন মেয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। সত্যি বলছি কর্তা মেয়েমানুষের যে বৈষয়িক বুদ্ধি থাকে তা একে না দেখলে জানতেই পারতাম না।
যাকে বলে রমরমিয়ে চলছে কারবার। শুনেছি আগে শুধু শাড়ির কারবার ছিল। এখন তো অনেক কিছুরই আছে।
বেশ কয়েকজন ছোটোখাটো জমিদারের তালুকও কিনে নিয়েছে।
বিশাল জমিদারনী এখন সে। আর সত্যি কথা বলতে কি, কিছুদিন পরে আমাদের কারবারকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।"
অনন্ত অবাক হয়ে শুনছিলো সবটা।
একটা মেয়ে এত কিছু করে ফেললো।
বুকটা ফেটে যাচ্ছে অনন্তর।
ও তো চেয়েছিল ওর অরুন্ধতীও যাতে এইরকমভাবেই রানিমা হয়ে ওঠে।
কিন্তু মেয়েটা তো হারিয়েই গেল।
তবে অনন্তর খুব কৌতুহল জাগলো এই জমিদার রানিকে সামনাসামনি দেখার।
তাই সে বললো ,"ওনার থেকে শাড়ি কেনার আগে তো একবার সামনাসামনি কথা বলা দরকার। কাল সাক্ষাতের ব্যবস্থা করুন নায়েবমশাই।"
জোছনায় মোড়া আকাশ। হাজার তারার আলোর মাঝে রানির মতন দাঁড়িয়ে গোল সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ।
ছাদে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করতে ভীষন ভালো লাগে আরুর ।
বিশাল বড় প্রাসাদের মতন বাড়িটা । এই বাড়িটা আরুর নিজের ।
এটা ওর নিজের সাম্রাজ্য। নিজের পরিশ্রমে একটু একটু করে গড়ে তুলেছে এটাকে ও।
দেখেশুনে মনে হয় না সবটা খুব সহজেই হয়ে গেছে? কিন্তু সেটা তো সত্যি না ।
সব সাফল্যের পিছনেই অনেকটা পরিশ্রম , একাগ্ৰতা আর মনের জোর লাগে।
কত বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে।
সবটা সামলেছে একা হাতে। কেউ তো ওর পাশে ছিল না। শুধু ছিল কুন্দ।
যখন প্রথম কারবার শুরু করলো কেউ তো ওর সাথে কারবার করতে চাইতো না।
ওর সুনিপুণ হাতের কাজ দেখেও কেউ কিনতো না, ও মেয়েমানুষ বলে।
ব্রাহ্মণসমাজ কতবার এসে হুমকি দিয়ে গেছে এক ঘরে করে দাওয়ার , বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দাওয়ার।
কতজন এসে বলতো,"কারবারের কি প্রয়োজন? কয়েকরাত শুয়ে যাও আমার সাথে, দেখবে ভরিয়ে দেবো তোমাকে।"
এই সব নোংরামো, সব কুসংস্কারের সাথে একা লড়াই করেছে অরুন্ধতী ।
একদম একা।
আর আজ , সমাজের মাণ্যিগণ্যি মানুষদের সাথে তার নামও উচ্চারিত হয়।
যদিও তার আসল নাম কেউ জানে না। "ইচ্ছেতরী" নামটাই সবাই জানে।
হঠাৎ চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো আরুর।
কাল অনন্ত দেখা করতে চেয়েছে আরু, না না "ইচ্ছেতরী"র সাথে।
অনেকবার ভেবেছে আরু যাবে না। কিন্তু তারপরে ভেবে দেখলো এইভাবে লুকিয়ে বাঁচা অসম্ভব।
তাই এইবার নাহয় মুখোমুখি হলই।
"তিনিও এবার দেখুন, সেই অরুন্ধতী আজ কোথায় উঠেছে।" প্রচণ্ড অভিমানের থেকে কথাটা বললো আরু।
দুজনেই আজও দুজনকে বড্ড ভালোবাসে। আজও খুঁজে চলে নিজেদের হারানো হিয়াকে।
তবুও পায়না!
জমিদার বাড়ি আজ আবার গমগম করছে। অতিথি আসছে বলে কথা।
তার যথার্থ আদর যত্ন করতে হবে যে ।
অনন্ত মহামায়া দেবীকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে।
সেইমতন ঝি দের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন মহামায়া দেবী।
কিছুটা বিকেলের দিকে লেঠেল এসে খবর দিলো,"কত্তা, রানিমার পালকি এসে এসে গেছে।"
অন্দরে একটি সুসজ্জিত রূপোর পালকি এসে থামলো।
সত্যি কথা বলতে জমিদার মশাই নিজেই একটু অবাক হয়ে গেছেন।
এমন দামী রূপোল পালকি, তার উপর কি সুন্দর কারুকার্য করা।
মেয়েমানুষ একা কারবার করে এত ঐশ্বর্যের মালকিন হতে পারে?
পালকিই যখন এমন তখন তার নিজের গায়ে কত ভরি গয়না থাকবে!
কিন্তু ভিতর থেকে যিনি নামলেন তার শরীরে প্রাচুর্যের চিহ্ন নেই।
বরং সাজ পোশাকে একটা আলাদা মার্জিত রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে।
তবে তিনি পিছনে ফিরতেই সবার চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেছে।
সত্যিই কি এ সেই মেয়েটাই।
অনন্ত হাঁ করে তাকিয়ে আছে অরুন্ধতীর দিকে।
কত বছর , কত বছর পরে দেখা।
মেয়েটার মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তবুও মনে হচ্ছে এ যে শুধু তার অরুন্ধতী, শুধুই তার।
অরুন্ধতীর মনেও তোলপাড় চলছে। এতগুলো বছর পরে আবার নিজের ভালোলাগার মানুষ , নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে।
তবে বাইরে সেটা প্রকাশ করলো না। ঈষৎ গাম্ভীর্য বজায় রেখে একটু হেসে নমষ্কার করলো সবাইকে।
অনন্তর ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে আরুকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিতে।
কিন্তু এক ঘর লোকের সামনে সেটা পারছে কই ?
মহামায়া দেবী আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে বললেন,"ব...বৌমা, কেমন আছো মা তুমি?"
অরুন্ধতী হেসে বললো,"যেমন থাকার কথা। আপনি কেমন আছেন মা?"
বলে একটা প্রণাম করলো ।
অনন্ত অবাক হয়ে ভাবছে।
সেই আরু আজ এত নাম করা কারবারী।
অনন্ত আরুকে বললো,"তুমিই তাহলে ইচ্ছে তরী অরুন্ধতী?"
আরু এর উত্তর দিলো না।
উল্টে বললো,"কাজের কথায় আসা যাক চৌধুরী মশাই? আপনারা কত টাকার শাড়ি কিনবেন?"
আরুর মুখে চৌধুরী মশাই ডাকটা শুনে বুকটা ফেটে গেল অনন্তর ।
এতটা পর করে দিল আরু ওকে।
অনন্ত আরুকে বৈঠকখানায় নিয়ে গেল।
জমিদার মশাইও যাচ্ছিলেন কিন্তু মহামায়া দেবী আটকে নিলেন।
ছেলেমেয়ে দুটো একটু একান্তে সময় কাটাক।
অনন্ত আর আরু চুপ করে সব কাজ সারলো। কেউই বারতি কোনো কথা খুঁজে পেলো না।
অনন্ত কিই বা জিজ্ঞেস করতো?
"কেন আমায় ছেড়ে চলে গেলে?"
ও তো জানে এর কারণ কি।
আরু কি জিজ্ঞেস করতো?
"কেন আমাকে ফেরাতে এলেন না?"
ও তো নিজেই সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। আর এখন হয়তো অনন্ত নতুন করে সংসার পেতেছে। এত বছর কি আর ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে?
তবু অনন্ত একবার সাহস করে বললো,"অরুন্ধতী, তুমি কি ফিরে এসেছো?"
আরু হেসে বললো,"নতুন করে কারো জীবনে সমস্যার সৃষ্টি আমি করতে চাইনা।"
অনন্ত বললো,"তুমি আমার জীবনে কখনই সমস্যা ছিলে না অরুন্ধতী। বরং আমিই তোমার উপর অন্যায় করেছি।"
আরু উঠে দাঁড়ালো।
বললো,"আমায় এবার যেতে হবে। আপনার জিনিস আপনি ঠিক সময় মতন পেয়ে যাবেন।"
কথাটা বলে বেড়িয়ে গেল অরুন্ধতী।
অনন্ত চেয়েও আটকাতে পারলো না।
শুধু ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকলো ওর যাওয়ার পথের পানে।
পালঙ্কের উপর শুয়ে ছিল অনন্ত।
আরুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ দুটো লেগে এসেছিল।
মহামায়া দেবীর ডাকে উঠে বসলো।
"অনন্ত, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।" মহামায়া দেবী বললেন।
অনন্ত বললো,"অরুন্ধতীর ব্যপারে?"
মহামায়া দেবী বললেন,"দেখো , এতদিন তোমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির জন্য যোগাযোগ ছিল না।
কিন্তু এখন যখন মেয়েটার খোঁজ পেয়েছো তখন ওকে মানানোর দ্বায়ীত্ব কিন্তু তোমার।
তোমার জন্যই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
এবার ভেবে দেখো তুমি কি করবে।
হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে নাকি বউয়ের মান ভাঙাবে।"
কথাগুলো বলে চলে গেলেন মহামায়া দেবী।
অনন্ত বসে বসে ভাবতে থাকে।
কথাটা সত্যি।
অরুন্ধতীকে বাড়িতে তো ফিরিয়ে আনতেই হবে। কিন্তু কিভাবে?
মেয়ের যা রাগ ! রাগ সবসময় নাকের ডগায় চড়ে থাকে।
তার উপর এখন আবার তিনি রানিমা।
কথা বলতে গেলে যদি তলোয়ার দিয়ে গলাটা কুঁচুঙ করে নামিয়ে দেয়।
কথাটা ভেবেই হাসি পায় অনন্তর।
কি করলে যে বাঘিনীর রাগ পড়বে?
হঠাৎ মনে পড়ে যায় অনন্তর।
আরু কবিতা লিখতে ভালোবাসতো।
অনন্ত যদি আরুকে একটা কবিতা লিখে পড়ায়, ওর উদ্দেশ্যে? এতে নিশ্চই কাজ হবে।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে কবিতাটা অনন্তর একটুও আসে না।
তাই ভাবলো একটা প্রেমপত্রই নাহয় লিখলো নিজের স্ত্রীকে।
আগে তো কখনো লেখা হয়নি, এবার নাহয় লিখবে।
কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলো অনন্ত ।
অনেকক্ষণ ভেবে লিখলো ,
"জানি রাগ করে আছো , তবু সাহস করে লিখছি তোমায়।
বকা দিওনা দয়া করে। সত্যি বলছি , সেইদিন না বুঝেই তোমায় কথাগুলো বলেছিলাম।
তোমাকে কষ্ট দিতে আমি চাইনি। ক্ষমা করে দাও আমাকে।
কতগুলো বছর তোমাকে ছাড়া কাটালাম। এবার অন্তত ফিরে এসো।
আর কখন এমনটা হবে না।
একবার এসেই দেখো না। প্রথম কারোর জন্য প্রেমপত্র লিখছি।
আর রাগ করে থেকো না।
ইতি,
তোমার ভালোমানুষ স্বামী।"
চিঠিটা কেমন হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত রসকষহীন চিঠি যে কোনো প্রেমিকারই মন ভেজাতে পারবে না তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
কিন্তু আমাদের অনন্ত ভাবছে কি নাকি লিখে ফেলেছে ও।
"আরে এত ভালো হাত জানলে তো আমি লেখকই হতাম।" আত্মসন্তুষ্টির সাথে কথাটা বললো অনন্ত।
তারপর ভাবলো কাল গিয়ে অরুন্ধতীকে নিজে গিয়ে চিঠিটা পড়াবে। তারপরে দেখবে রানিমা কি করে মান করে থাকেন।
"রানিমা, চৌধুরী মশাই এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে। পাঠিয়ে দিই?" লেঠেল এসে বলল অরুন্ধতীকে।
অরুন্ধতী একটু অবাক হয়ে তাকালো। তিনি এসেছেন?
"পাঠিয়ে দাও।" অরুন্ধতী বললো।
"আসতে পারি রানিমা?" অনন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
অরুন্ধতী ভ্রু দুটো কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। তারপর বললো,"আসুন।"
অনন্ত ভিতরে এসে বললো,"রানিমাকে তুষ্ট করতে আজ্ঞা হোক।"
অরুন্ধতী একটু বিরক্ত হয়ে বলল,"আপনি কি আমার সাথে রঙ্গ করতে এসেছেন?"
অনন্ত বললো,"তা ঠিক নয়। তবে এমন একটা জিনিস এনেছি যেটা দেখলে তুমি আর আমার উপর রাগ করতেই পারবে না।"
আরু অবাক হয়ে তাকালো।
অনন্ত আরুর হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,"পড়ে দেখো। এত ভালো একটা জিনিস।"
আরু কৌতুহলী হয়ে চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলো।
পড়তে পড়তে আপন মনেই কখন যে হাসতে শুরু করেছে খেয়াল করেনি ও।
একেকটা বাক্য পড়ছে আর হো হো করে হাসছে ও।
এদিকে অনন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
হাসার মতন কি লিখলো ও?
আরু হাসতে হাসতে বললো,"বিশ্বাস করুন আজ অব্দি এত হাসি আমার কোনো কালে পায়নি। এত বাজেও কেউ লিখতে পারে?"
অনন্তর মুখটা কালো হয়ে এলো।
"পছন্দ হয়নি তোমার?"
আরু যেন এবার সম্বিত ফিরে পেলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,"আমার জন্য ছিল বুঝি?"
অনন্ত আর সামলাতে পারলো না। আরুর হাতদুটো নিজের মধ্যে নিয়ে বললো,"দেখো অরুন্ধতী, তুমি আমাকে মারো, কাটো, বকো যা ইচ্ছে করো। কিন্তু আর দুরে দুরে থেকোনা। দোহাই তোমার।"
আরু কেঁদে ফেললো এবার। অনন্তর বুকে ঘুষি মারতে মারতে বললো,"আপনি কেন খোঁজেননি আমায়। কেন নেননি ফিরিয়ে?"
অনন্ত আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,"খুঁজেছিলাম। পাইনি যে।"
আরু জড়িয়ে ধরে অনন্তকে।
অনেকদিন বাদে দুজনে আবার এক হল।
কিছুক্ষণ বাদে আরু মুখ তুলে বললো,"আমার মা বাবা কেমন আছে?ওনারা কষ্ট পেয়েছে না খুব?"
"ওনারা তোমার মামাবাড়ির দিকে কাজ পেয়ে চলে গিয়েছিলেন, তাই এত কিছু জানেন না। চিঠি লেখালেখি চললেও আমি জানাইনি ওনারা কষ্ট পাবেন বলে।" অনন্ত বলল।
আরু বললো,"ভালো করেছেন।"
অনন্ত আরুর গালটা ধরে বললো,"এবার বাড়ি ফিরবে তো?"
আরু বললো,"আপনি ফেরালেই ফিরবো।"
আরু বাড়ি ফিরে আসায় বাড়িটায় যেন আবার প্রাণ ফিরে এসেছে।
বিশাল বাড়িটাকে এখন আর শুধু ইট কাঠ পাথরের বাড়ি মনে হয়না।
কুন্দও এসেছে অরুন্ধতীর সাথে।
আরু আবার সংসারে ফেরায় সে খুব খুশি হয়েছে। কুন্দ যে আরুকে নিজের বোনের চোখেই দেখে।
এখন এখানে থেকেই নিজের জমিদারী সামলাচ্ছে আরু।
আজ আরু আর অনন্ত রওনা দিচ্ছে রাঢ়বঙ্গের দিকে। সেখানে কোন জলদস্যু নাকি তাদের জাহাজের মাল আটক করে রেখেছে । সেই জাহাজ মুক্ত করতেই যাওয়া।
আরু এর আগে একাই কারবারের কাজে এদিক সেদিক গেছে।
কিন্তু এবার অনন্ত আছে ওর সাথে।
কেমন যেন একটা আলাদা অনুভুতি হচ্ছে।
সেই পাঁচ বছর আগে অনন্তর সাথে রংপুরের তালুকে বেড়াতে গিয়েছিল আরু।
কিন্তু সেবার যে বিপত্তি ঘটলো !
ভাবতে ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে ওঠে আরুর।
তবে এবার আর খারাপ কিছু আরু হতে দেবে না।
"আমরা প্রায় পৌঁছেই গিয়েছি। এখানেই নোঙর করবো। তাঁবু খাটিয়ে দুটো রাত এখানেই থাকবো।" অনন্ত চোখের থেকে দুরবিনটা সরালো।
আরু ভিতরের থেকে বেড়িয়ে এলো।
আজ আর তার পরনে সেই আটপৌরে শাড়ি নেই।
বরং শক্ত করে কোমরে আঁচল গুঁজে শাড়ি পড়েছে।
অনন্ত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
"তা রানিমা বুঝি জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করবেন?"
"করবোই তো। বেশি বেগড়বাই করলে দেবো ব্যাটাদের ঘাড়ে এক কোপ।" আরু আবার সেই মেয়েবেলার মতন কোমরে হাত দিয়ে বলে উঠলো।
অনন্তর সাথে সাথে ওর সব ছেলেমানুষীগুলোও যেন ফিরে এসেছে।
অনন্ত হেসে ফেললো।
কিছুক্ষণ পরে একটা পার দেখে জাহাজ থামানো হল।
আরুরা জাহাজে বসে আছে। মাঝি আর লেঠেলরা মিলে তাঁবু খাটাচ্ছে।
এমন সময় দুর থেকে একটা জাহাজ আসতে দেখা গেল।
লেঠেল সর্দার ছুটে এসে জাহাজে উঠে বললো,"কত্তা, জলদস্যু আসি পড়িছে। দেখতি পাচ্ছেন নি?"
অনন্ত একটু ভয়ই পেলো। নিজের জন্য না, আরুর জন্য। ও জানে আরু ডাকাবুকো মেয়ে।
কিন্তু আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা আরুর নেই।
"ঈশ্! মেয়েটা রাগ করে চলে না গেলে লাঠি চালানোটা অন্তত শিখিয়ে দেওয়া যেত।" অনন্ত মনে মনে ভাবলো।
ওইদিকে আরু ততক্ষণে একটা মশাল জোগাড় করে আলো জ্বালিয়েছে।
অনন্ত বলে উঠলো,"আলো জ্বালালে কেন? ওরা দেখতে পেয়ে যাবে তো!"
"বুদ্ধির আপনার বলিহারি যাই বাপু। আরে ওরা তো দেখতে পেয়েছে বলেই এদিক পানে আসছে। আগুন খানা ওদের জাহাজে ছুড়ে মারবো। একটু কাছে আসতে দিন।" আরু বললো।
অনন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,"পুড়ে যাবে তো। একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে?"
"না, তা কেন? কোণার দিকে ছুঁড়বো। আগুন দেখে ওরা ভয় ঝাঁপ দেবে জলে। এটা তো আর মাঝ দরিয়া নয়। ডুবে মরবে না।" আরু বুঝিয়ে দিলো।
অনন্ত আর কিছু বললো না।
এই মেয়ের বুদ্ধি যে ওর চেয়ে চারগুণ বেশি সেটা ও বুঝে গেছে।
হিসেব মতনই কাজ এগোচ্ছিলো। কিন্তু
একটু অসাবধানতার ফলে বড় বিপদ ঘটে গেল।
জলে ঝাঁপানোর সময় জলদস্যুদের একজন অরুন্ধতীর কপালে হারপুন ছুড়ে মারে।
সৌভাগ্যবশত হারপুনের সামনের দিকটা না লেগে পিছনের দিকটা লাগে।
তবে তাতেও শেষরক্ষা হলো না।
"আহ্!" শব্দ করে বসে পড়লো অরুন্ধতী।
অনন্ত প্রথমে খেয়াল করেনি বিষয়টা ।
কিন্তু অরুন্ধতীর গলার আওয়াজ পেয়ে ছুটে গেল ওর দিকে।
কপাল থেকে তখন অবিরাম রুধির ধারা বয়ে চলেছে আরুর।
বিছানায় শুয়ে আছে অরুন্ধতী। ডাক্তার এসে দেখে গেছে। অল্পের জন্য এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। তবে রক্ত গেছে অনেকখানি। তাই শরীরটা দুর্বল।
গরম দুধের গেলাসটা পাশে রেখে মোক্ষদা ঝি বললো,"এর জন্য বলি বাপু, মেয়েমানুষের এত সাহস দেখানো ভালো নয়। নাও, এবার ঠেলা সামলাও।"
অনন্ত এর উত্তর দিলো না। ও তো জানে কতটা সাহস ছিল বলেই আরু নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে।
তবে পাঁচলোকে তো পাঁচ কথা বলবেই।
অত ধরলে কি চলে?
"এখন কেমন লাগছে?" অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
আরু ধিরে ধিরে বললো,"অনেকটা ভালো।"
অনন্ত একটু চুপ থেকে আরুর কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললো।
আরু আস্তে আস্তে উঠে বসে বললো,"ওকি? আপনি কাঁদছেন কেন?"
অনন্ত কাঁদতে কাঁদতে বললো,"আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেনা। কথা দাও , কথা দাও আমাকে।"
"আচ্ছা বাবা , যাবোনা। আপনি চোখদুটো মুছুন তো আগে।" বলে নিজেই অনন্তর চোখদুটো মুছিয়ে দিলো আরু।
আজ অনেকদিন বাদে সবটা কেমন যেন সুন্দর লাগছে। আবার যেন সব ঠিক হয়ে গেছে।
নতুন একটা যুগের যেন সূচনা ঘটলো।
এবার থেকে সব ভালো হবে।
একেকটা বসন্ত কেটে যায়, লিখে যায় জীবনের আরো কিছুদিন কমে এলো।
আর শেষ বসন্তের বেলা হিসেব কষতে বসে জীবনে কি কি দেওয়া হল, কি কি পাওয়া হল। আর যা দেওয়া পাওয়া হল না তা তুলে রাখতে হয় পরের জন্মের জন্য।
অনন্তর রজনীগন্ধার মালা পড়ানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল আরু।
কতগুলো এমন বসন্ত একসাথে কাটিয়েছে ওরা?
প্রায় তিরিশটা। জীবনের হিসেবে নেহাত কম নয়। তবুও আরুর মনে হয় দু'বছর আগে অনন্ত ওকে ছেড়ে চলে না গেলেও পারতো।
কিন্তু জন্ম মৃত্যু আমাদের হাতে নেই।
নিয়তিকে মেনে নিয়েছিল আরু।
ও বোঝে এখন ওর যাওয়ার পালাও এসেছে।
তবে নিজের ছেলেমেয়ে দুটোকে ছেড়ে যেতে খুব মন কাঁদে।
যদিও তারা এখন বড় হয়েছে।
আজ উকিল ডেকে নিজের ব্যবসা ছেলে মেঘরাজ আর মেয়ে পত্রলেখার মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিয়েছে।
দুজনেই আজ কেঁদে ফেলেছিলো । মায়ের ভাবগতিক ওদের ভালো লাগছে না।
কেন জানিনা মনে হচ্ছে মা আর বেশিদিন নেই।
অরুন্ধতী সাদা থানটা জড়িয়ে অনন্তর ছবির সামনে এসে দাঁড়ালো।
সামনে প্রদীপ জ্বেলে বললো,"জানেন ছেলে মেয়ে দুটো একদম আপনার মতন হয়েছে। নরম অথচ দৃঢ়।
আজ আপনার অভাব বড় বোধ করছি জানেন।
মনে হচ্ছে পাশের মানুষটা হাত আলগা করে চলে গেল।
আপনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে বড্ড আপন।
আমার দ্বায়ীত্ব আজ শেষ হল।
এবার আমিও আপনার কাছে পাড়ি দেবো।
অপেক্ষা করছেন তো আপনি?"
অরুন্ধতীর মৃত শরীরটায় আগুন ধরিয়ে আরেকবার চোখ মুছলো মেঘরাজ আর পত্রলেখা।
তারপর অরুন্ধতীর ছাই হয়ে যাওয়া শরীরটারদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,"তোমার আর বাবামশাইয়ের শিক্ষা বিফলে যাবেনা মা। তোমাদের এই শিক্ষা আমরা ঠিক সার্থক করে তুলবো।
রাণি অরুন্ধতী আর বাবু অনন্তরাজ চৌধুরীর সন্তান আমরা।
তোমাদের মতনই যেন হতে পারি।"
-সমাপ্ত-