প্রাণহরা
প্রাণহরা
থালায় ভাত বেড়ে তরকারি আর মাছের বাটিগুলো সাজিয়ে কনিকা দেবী হাঁক পারেন, "বলি খাবারটা কি নিজে এসে গলধঃকরণ করা হবে নাকি সেটাও শাশুড়িকে দিয়েই করানো হবে?"
"কোনোকালে দেখিনি বাপু, শাশুড়ি বউকে পাত পেড়ে খাওয়ায়। আমরাও তো এককালে বউ ছিলাম। ঘরে বাইরে দাপিয়ে সামলেছি।
তোমাদের তো আরামের চাকরি বাপু, ওই ফোনে কি সব খুটখুট করলে আর গাড়ি এসে বাড়ির সামনে হাজির হল। আমিও তো চাকরি করেছি, ভরা নদী ডিঙিয়ে তবে গিয়ে পৌঁছতাম স্কুলে। বর্ষায় তো আরো কষ্ট। ওসবের এরা কি বুঝবে? এরা হল গিয়ে আজকালকার ছেলেমেয়ে, এরা সবদিক দিয়েই কেতাদুরস্ত....."
গজগজ করতে করতে খাবারের থালাটা ডাইনিং টেবিলে রাখেন কনিকা দেবী।
আহেলীর দিনের শুরুটা শাশুড়ির এই ঠোঁটস্থ কয়েকটা ডায়লগ দিয়েই হয়। এই দুই বছরে ওর কানেরাও এতটাই ইমিউন্ড হয়ে গেছে কথাগুলো শুনে যে ও আর গায়ে বা মনে কোথাওই মাখে না কথাগুলো।
চুপচাপ নিচে নেমে খাবারটা গিলতে শুরু করে। গেলাই বটে!
তাড়াহুড়ো করে না বেড়োতে পারলে আটটার ট্রেনটা মিস করবে।
সাড়ে আটটার আপ লোকাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে অফিসে যাওয়াটা যে কি পরিমাণ কষ্টের তা ওর চেয়ে ভালো কে জানে?
কনিকা দেবী তখনো বিড়বিড় করে চলেছেন।
কোনো ক্রমে মুখ ধুয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝোলায় আহেলী।
"মা আসি।" বলেই বেড়িয়ে যায় আহেলী।
কনিকা দেবী পিছন থেকে চিৎকার করে বলেন, "টিফিনটা খেয়ে আমার চোদ্দ পুরুষকে উদ্ধার কোরো।"
এই মুমুর্ষ সময়ও কথাটা শুনে আহেলীর হাসি পেয়ে যায়।
কনিকা দেবী তখন আহেলীর এঁটো থালা তুলতে তুলতে বলে চলেছেন, "খাবারও খাবে কাক ছড়ানোর মতো করে। বারবার বলেছিলাম, বাড়ির কাছে চাকরি পেয়েছো, ঠাকুরকে প্রণাম ঠুকে জয়েন করো। কিন্তু না, সেই মেয়ে কথা শুনলে তো। বেছে বেছে চাকরি নিলো সেই দুর শহরে। কি হত এখানে চাকরি করলে? পয়সা নাহয় দুটো কম পেতো।
তাতে কি এমন ক্ষতি হত। আরে বাবা
আমার ছেলে কামাচ্ছে, তুই কামাচ্ছিস, আমাদের বুড়োবুড়ি দুটোর পেনসন আছে। সংসার কি এমন খারাপটা চলতো? এখন মর খেটে খেটে। দু দণ্ড স্বস্তিও তো পাসনা।"
"আহ্ গিন্নি, তুমি আবার সকাল থেকে শুরু করেছো? আমার ওলি মায়ের ইচ্ছে হয়েছে ওই অফিসে কাজ করার ও করছে। তোমার এত সমস্যা কিসের বুঝিনা।" বলতে বলতে খবরের কাগজটা খুলে বসেন সমীরণ বাবু।
কনিকা দেবীর মাথাটা তেঁতেই ছিল, বরের কথা শুনে আরো জ্বলে উঠে উনি বললেন, "তোমার আস্কারাতেই আমার সংসারটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। বলি তো তোমার সাধের ওলির ভালোর জন্যই। মেয়ের যে শরীর দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে সে বিষয় কোনো খেয়াল আছে তোমার?"
"আরে বাবা, আজকালকার ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট কর্মঠ হয়। ও ঠিক সামলে নেবে। তুমি এখন আমায় কড়া করে এক কাপ চা খাওয়াও দেখি।"
খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখেন সমীরণ বাবু।
"ওই করেই মরি আমি। বউকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দাও, বুড়োকে পঞ্চাশবার চা করে খাওয়াও, আর আমার ছেলে? সে তো কোনো ট্যুরে গিয়ে বসে আছেন।"
বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান কনিকা দেবী।
******
ট্রেনের উইন্ডো সিটে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আহেলী। বাড়িতে দিনে দিনে যেন অশান্তি বেড়েই চলেছে।
খোলা জানলা দিয়ে ইঞ্জিনের গন্ধ মেশানো শীতল হাওয়া বারবার বিরক্ত করছে ওকে।
জানলার রডে মাথা রেখে চোখ বোজে আহেলী। অফিস এখনো এক ঘন্টা লাগবে পৌঁছতে।
কত পুরোনো কথা মনে পড়ছে আজ।
বাপ মা মরা আহেলীর সাথে কৌনিকের পরিচয় হয়েছিল ইন্টার্নশিপের সময়।
একটা সময়ের পর দুজনের মধ্যেই একটা ভালোবাসার রেশ তৈরি হয়। দুজনে চাকরি পাওয়ার পর কৌনিক বাড়িতে সবটা জানায়। কেউই আপত্তি করেনি। বরং সবাই খুশীই ছিল।
সমীরণ বাবু তো নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন আহেলীকে, ওলি মা বলতে অজ্ঞান।
কনিকা দেবীও ভালোবাসেন, আহেলী জানে সেটা। কিন্তু উনি চিন্তাটা বড় বেশি করেন। সবসময় আহেলীর প্রতি একটা অধিকারবোধ কাজ করে ওনার। কই? কৌনিকের বেলায় তো এতটা বাড়াবাড়ি করেন না।
প্রথম প্রথম ভালো লাগতো আহলীর। মায়ের অভাবটা ছোটো থেকেই ফিল করেছে, তাই কনিকা দেবীর এই অধিকার বোধটা ভালো লাগতো।
কিন্তু এখন যেন ধীরে ধীরে বিষয়টা লাগাম ছাড়া হয়ে উঠছে।
বিশেষ করে এক বছর আগে আহলী ট্রান্সফার নেওয়ার পর থেকেই যেন কনিকা দেবীর সাথে ওর ঝামেলাটা বেড়েছে।
কনিকা দেবী আহেলীর এত দুরে রোজ যাতায়াত করাটা মোটেও পছন্দ করেন না। কিন্তু আহেলীও যে নিজের পেশাটাকে ভালোবাসে, তাছাড়া আরো ভালো অপশন পেলে সেটা নেবে না কেন ?
কৌনিক যে মাঝে মাঝেই অফিসের কাজে বাইরে যায়, তখন তো উনি বাধা দেননা।
ভাবতে ভাবতে একবার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নেয় আহেলী, স্টেশন এসেছে কিনা।
হঠাৎ কনিকা দেবীর একটা কথা মনে পড়ে যায় আহেলীর।
"চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়াবি না।"
মুহুর্তের মধ্যে মনটা ভালো হয়ে যায় আহেলীর। এই ছোটো ছোটো কথাগুলোর মধ্যে অনেকটা ভালোবাসা জমে আছে।
হঠাৎ খেয়াল হয় আহেলীর, দুদিন পরে পহেলা বৈশাখ। না, বাড়ির সবার জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাবে।
কনিকা দেবী লাল পাড়ের জামদানি খুব ভালোবাসেন। একবার গড়িয়া হাঁটে ঢুকতে হবে।
******
বিকেলের দিকে সব কাজ সেরে এক কাপ দুধ চা দুই চামচ চিনি মিশিয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে বসেন কনিকা দেবী। সুগার বর্ডার লেভেলে আছে, কিন্তু আহেলীর হুকুম চায়ে আধ চামচের বেশি চিনি মেশানো যাবে না।
অন্যান্য সময় এসব না পারলেও বিকেলের এই সময়টা উনি নিজের রসনা তৃপ্ত করেই ছাড়েন।
মেয়েটা একটু অবাধ্য, তবে কনিকা দেবীর খুব খেয়াল রাখে।
যতটা সময় বাড়িতে থাকে পিছনে আঠার মতো লেগে থাকে।
ভালোও বাসে খুব। কখনো রাঁধতে গিয়ে কনিকা দেবীর সামান্য ব্যাথা লাগলেই সেই মেয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে।
একবার তো গরম চায়ের কাপ ধরতে গিয়ে অল্প ছ্যাকা খেয়েছিল বলেও আহেলী পাড়ার ডাক্তারকে ধরে এনেছিল।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজটা সামনে মেলে ধরেন কনিকা দেবী।
পড়তে পড়তে হঠাৎ একদম কোনার একটা খবরে চোখ যায় কনিকা দেবীর।
"নির্ভয়া কাণ্ড আবার!!!
কলেজ ফেরৎ অষ্টাদশী যুবতীকে গণধর্ষণ ও খুন, অভিযুক্ত পাঁচ জন।
যদিও প্রমাণের অভাবে গ্ৰেপ্তার হয়নি কেউই।"
পড়তে পড়তে ভয় কেঁপে ওঠেন কনিকা দেবী। এক প্রকার শিউরে ওঠেন।
আজকাল কি হচ্ছে এসব?
আচ্ছা, আহেলীটাও তো রাত করে বাড়ি ফেরে। ওর যদি ভালোমন্দ কিছু একটা...
না না, খারাপ কথা ভাবতে চাননা কনিকা দেবী।
কিন্তু মেয়েটা তো এখনও ফিরছে না।
প্রায় সাড়ে পাঁচটা তো বাজেই।
সমীরণ বাবুর কাছে ছুটে যান কনিকা দেবী।
"হ্যাঁ গো শুনছো, অনেক তো রাত হল। মেয়েটাকে একবার ফোন করে দেখো না কোথায় আছে?"
আহেলী দেবীর কথা শুনে সমীরণ বাবু বলেন, "আরে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ও ঠিক ফিরে আসবে।"
"না না না, আমার মন মানছে না। যা দিনকাল পড়েছে আজকাল। তুমি একটা ফোন করো প্লিজ।"
স্ত্রীয়ের অনুরোধে আহেলীকে ফোন করেন সমীরণ বাবু।
দুই তিন বার রিং হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ ফোন রিসিভ করে না।
ভয় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে কনিকা দেবীর। এত দেরী তো মেয়েটা কোনোদিন করেনা। আজ কি হল?
"এই, এবার কি হবে গো?" কাঠ হয়ে আসা গলায় বলেন কনিকা দেবী।
"ভিড় ট্রেনে হয়তো শুনতে পারছে না। এত চিন্তা কেন করছো?" স্ত্রীকে বোঝান সমীরণ বাবু।
******
ট্রেনে যখন উঠে বসলো আহেলী তখন প্রায় সোয়া ছয়টা বাজে। কনিকা দেবীর জন্য মন মতন শাড়ি কোথাওই পাচ্ছিল না।
খুঁজতে খুঁজতে শেষে বাস স্ট্যান্ডের মোড়ের একটা দোকানে সেই শাড়ির দেখা মিললো।
কিন্তু ওটা নিতে গিয়ে পাঁচটার ট্রেনটা মিস হয়ে যায় আহেলীর।
তারপর অপেক্ষা করতে করতে এই এতক্ষণে আরেকটা ট্রেন আসলো।
উঠে বসে প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে আহেলী।
কনিকা দেবী নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন আজ।
......
"শুনছো, পুলিশে একবার খবর দেবে। আমার মোটেও ভালো ঠেকছে না। সাতটা বাজতে গেল এখনও মেয়েটা আসছে না?"
এই নিয়ে প্রায় চল্লিশ বার এক কথা বলে ফেলেছেন কনিকা দেবী।
চোখটাও ছলছল করছে।
সমীরণ বাবু বারবার বুঝিয়ে চলেছেন যে এর আগেও আহেলীর এইরকম দেরি হয়েছে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? কাগজে ওই খবরটা পড়ার পর থেকেই ওনার বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠছে।
"এই শোনো না...
"মা, দেখো আজ কি এনেছি।" বলতে বলতে ঘরে ঢোকে আহেলী।
কনিকা দেবী আহেলীর গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকান।
প্যাকেটগুলো সোফায় রেখে আহেলী কিছু বলবে তার আগেই কনিকা দেবী বলে ওঠেন, "এত রাতে বাড়ি ফেরার কারণটা কী?"
"মা আসলে.."
"একদম চুপ! কি ভেবেছো কি তুমি? আমার বাড়িতে স্বেচ্ছাচারিতা চালাবে? কটা বাজে তোমার কোনো খেয়াল আছে? এত রাত করে কেউ বাড়ি ফেরে?"
"মা, তুমি আমার কথাটা শোনো একবার।"
"আমার আর কিচ্ছু শোনার নেই। তোমার বাজে ওজর তোমার কাছেই রাখো। এক কাজ করো না, একেবারে মেরেই ফেলো আমাকে। তুমিও বাঁচো আমিও বাঁচি। এমনিতেও আমাকে তো দেখতে পারো না...." চিৎকার করে কথাগুলো বলেন কনিকা দেবী।
শুনতে শুনতে আহেলীরও মাথাটা গরম হয়ে যায়।
"মা এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। সত্যি বলছি, প্রতিদিনের এই অশান্তি আমার আর ভালো লাগছে না।
কি চাওটা কি তুমি? আমি সবকিছু ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকি? কি মনে হয় তোমার আমি অফিসে যাই মজা করতে?
ওয়ার্ক লোড নিতে নিতে আমি ক্লান্ত মা।
আর আজ কেন দেরি হয়েছিল জানো? তোমার জন্য শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। দোকান টু দোকান ঘুরেও পছন্দ হচ্ছিল না, মাঝখান থেকে ট্রেনটা মিস হয়ে গেল।
কিন্তু না, তুমি তো কোনো কথাই শুনবে না।
আজ কৌনিকের পাঁচটার মধ্যে ফেরার কথা, কিন্তু ফ্লাইট ডিলে হয়েছে জন্য ওর আসতে লেট হবে। কই এইবেলা তো তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সব নিয়ম খালি বাড়ির বউয়ের জন্যই তাই না?
আসলে বৌমা বৌমাই হয়, মেয়ে হয়না।"
ভিতরে চলে যায় আহেলী।
কনিকা দেবী মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকেন।
সমীরণ বাবু এগিয়ে এসে বলেন, "এই জন্যই বলেছিলাম, বাড়াবাড়িটা কোরো না।"
কথাটা বলে ঘরে চলে যায় সমীরণ বাবু।
******
ছাদের ধার ধরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে আহেলী। ওর কথাগুলো কনিকা দেবীকে যত না বেশি আঘাত করেছে তার থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছে ও নিজে।
হ্যাঁ মানছে কনিকা দেবী একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেন ওর সাথে কিন্তু তাই বলে ও কি করে এতগুলো কথা শোনালো?
দুরের জঙ্গলটায় কয়েকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা এক দমে ডেকে চলেছে।
মনে আছে, এই রকম একটা রাতেই আহেলীর খুব জ্বর এসেছিল। কনিকা দেবী সারারাত না ঘুমিয়ে আহেলীর পাশে বসেছিলেন।
আহেলীর বকবক শুনতে শুনতে মাঝেমধ্যে কৌনিক ক্লান্ত হয়ে বলে ফেলতো, "একটু শ্বাস নিয়ে নে, আমাকেও নিতে দে তারপর আবার মহাভারত খুলে বসিস।"
গাল ফোলানো আহেলীর মুখটা তুলে কনিকা দেবী বলতেন, "ও আমাদের বকবকি রাধিকা, ও থামলে তো পুরো বাড়িই থেমে যাবে।"
না, খুব কষ্ট হচ্ছে আহেলীর, খুব কষ্ট হচ্ছে।
"আর কতক্ষন মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকবি? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।"
কাঁধে কারো উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকায় আহেলী।
কনিকা দেবী হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে।
কান্নাভেজা গলায় আহেলী বলে, "আমি ওভাবে কথাগুলো বলতে চাইনি, বিশ্বাস করো আমি বলতে চাইনি।"
আহেলীর হাতটা ধরে কনিকা দেবী বলেন, "জানি তো। ওইটুকু মান অভিমান মা মেয়ের মধ্যে চলে।
আসলে আমিই তোর জীবনে একটু বেশি নাক গলিয়ে ফেলেছি।"
"এভাবে বলো না মা। আমি..."
"বয়স তখন বোধহয় আমার পঁচিশ কি ছাব্বিশ। হসপিটালে লেবার রুমে শুয়ে আছি। শুয়ে আছি বলা ভুল, ছটফট করছি বললেই চলে। ভেবেছিলাম আমার বাচ্চাটাও আমার মতোই ছটফটে হবে। একটা ফুটফুটে মেয়ে হল জানিস? ঠিক ডল পুতুলের মতোন দেখতে, ছোট্টো ছোট্টো হাত পা, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল।
কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দিলেন ও মৃত।
বুঝতে কিছুটা সময় নিয়েছিলাম যে আমার জ্যান্ত পুতুলটা আর জ্যান্ত নেই।
তারপর কেটে গেছে কতগুলো বছর। মেনে নিয়েছিলাম সত্যিটা, এগিয়েও গিয়েছিলাম।
তারপর তুই এলি, সেই ছটফটে দুরন্ত একটা পাখি। মেয়ের খুব শখ ছিল আমার।
তোকে যেদিন আশীর্বাদ করতে গেলাম সেদিনই তোকে দেখে আমার ওই জ্যান্ত পুতুলটার কথা মনে পড়ে গেল।
তবে বেশি চিন্তা করতে গিয়ে তোকে আমি বড় বেশি বেঁধে ফেলেছি। সব সম্পর্কেই স্পেস লাগে, ভুলে গিয়েছিলাম আমি। তাই তো তুই আমার থেকে দুরে চলে যাচ্ছিস।"
"কে বলেছে আমি দুরে চলে গিয়েছি? এই তোমার ঘাড়ে চেপে বসলাম, আর নামছি না।" কনিকা দেবীকে জাপটে ধরে কথাটা বলে আহেলী।
"আর পাগলি মেয়ে, কাঁদছিস কেন? ওই দেখো।"
আহেলীর চোখদুটো সযত্নে মুছে দেন কনিকা দেবী।
কৌনিক বাড়িতে ফিরেই বাবার মুখে পরিবেশ গরমের খবর পেয়েছিল।
বেচারা ভেবেছিল ঘরে ঢুকে মা আর বউকে নতুন শাড়ি দিয়ে ভাব করাবে কিন্তু ছাদে এসে যে এমন একটা দৃশ্য দেখতে পাবে ও ভাবতেই পারেনি।
"চলে আয়, অত দেখে কোনো লাভ নেই। ওদের মা মেয়ের ব্যপার ওরাই মিটিয়ে নিয়েছে। তুই আমি তো নিমিত্ত মাত্র।" সমীরণ বাবু পিছন থেকে কথাটা বলেন।
কৌনিকও অল্প হেসে নিচে নেমে যায়।
কনিকা দেবী আহেলীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, "আমার শাড়িটা কই?"
আহেলী মিষ্টি হেসে বলে, "নিচে রাখা আছে।"
"আমি কিন্তু এবার নববর্ষে তোর কোনো কথা শুনবো না। চারটে মিষ্টি খাবো বলে দিলাম।"
"তারপর চারদিন করলার রস দুইবেলা খাওয়াবো কেমন?"
আহেলীর কথায় ওর পিঠে একটা মেরে দিয়ে কনিকা দেবী বলেন, "পাজি মেয়ে কোথাকার।"
"আচ্ছা ঠিক আছে, কি মিষ্টি খাবে বলো?"
একটু ভেবে কনিকা দেবী বলেন, "দুটো রসগোল্লা, দুটো কাঁচাগোল্লা, একটা ক্ষীরের সন্দেশ আর..."
"আর?" চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে আহেলী।
"আরে এই যে, আমার একটা পাগলি মেয়ে আছে। ওই তো আমার প্রাণহরা। ওর দুটো মিষ্টি বাক্য শুনে আমার মন জুড়াবো।"
আহেলী মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরে শাশুড়ি মা, না না মাকে।
-সমাপ্ত-
