ইতিহাসের আঁধারে
ইতিহাসের আঁধারে


(১)
প্রকাণ্ড ইট কাঠে মোড়া বিশাল দূর্গ। তার স্তরে স্তরে পাহারা দিচ্ছে সুলতানের খাস লেঠেলরা।
দূর্গের ভিতরে সূর্যের এতটুকু আলোও পৌঁছায় না।
অবশ্য পৌঁছালেই বা কি? সেই সূর্যের আলোয় মুক্ত নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায় তো আর নেই কমলার।
কি বা আছে আর তার জীবনে? সবই তো শেষ ।
অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
গুজরাট প্রদেশের মহারাণী ছিল সে।
কত মান ছিল তার।
সবাই একবাক্যে বলত , রানি কমলাবতি
তো সতীসাধ্যি মা, অমন পতিব্রতা স্ত্রী হিন্দুস্তানে আর নেই।
মহারাজ রায় কর্ণ বাঘেলার মতন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । কি সম্মানটাই না করতেন তিনি তাঁর রানিকে।
তবে কেন সবটা এক লহমায় শেষ হয়ে গেল?
ওনারা তো কখনো কারোর ক্ষতি করেননি। তবে কার নজরে ওদের সাধের সংসার ভেঙে গেল?
জহর ব্রত টুকু করতে পারেনি রানি কমলাবতি, তার আগেই দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী এসে তাকে অপহরণ করল। আর পালন করতই বা কেমন করে সে ? মহারাজ যে জীবিত ছিলেন।
সুলতান এমনই পাষান যে রানিকে তার ছয়মাসের শিশুকন্যাটি কে পর্যন্ত আনতে দিলো না।
আজ প্রায় একমাস হতে চলল, এই দূর্গতে বন্দী আছেন মহারাণী কমলাবতি।
সুলতান প্রতি রাতে আসেন, ঝাঁপিয়ে পড়ে কমলার কোমল শরীরটার উপর, ইচ্ছে মতন খুবলে খায় ওর শরীরটাকে, আর যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে,"আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না মাগী, ভালো কথা বলছি আমাকে নিকা কর, তোকে আমার খাস বেগম করে রাখবো, কিন্তু কথা না শুনলে কিন্তু কোঠি বাড়িতে কাটাতে হবে তোকে সারাটা জীবন।"
নিজের মেয়েটার জন্য খুব মন কাঁদে কমলার, নিজের সতীত্ব তো ও খুইয়েছেই, মহারাজের কাছে ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই তার, অন্তত যদি নিজের মেয়েটাকে নিজের কাছে পেতো?
তবে এই কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠছে কমলার কাছে, আজ ও ঠিক করেই নিয়েছে , সুলতান যদি ওকে স্ত্রী রূপে বরণ করতে চান তবে সে করবে ওনাকে নিকা, কিন্তু তার বদলে সে ও কিছু চেয়ে নেবে।
(২)
রাত্রীর দ্বিতীয় প্রহর চলছে, গোটা দিল্লি শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
এমন সময় দূর্গের প্রকাণ্ড লৌহকপাট টা খুলে গেল, ভিতরে প্রবেশ করলেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী, যার নামে সারা হিন্দুস্তান কাঁপে।
কমলার নিস্তেজ শরীরটার দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল সুলতান।
কমলার গালটা একহাতে চেপে ধরে নিজের লাল টকটকে, হিংস্র চোখে তাকিয়ে বলল,"কি সিদ্ধান্ত নিলি?করবি আমায় নিকা নাকি ......" বলেই কুৎসিত হাসিতে ফেটে পরলেন সুলতান।
কমলা কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বলল,"করব নিকা।"
সুলতান প্রথমে একটু অবাক হয়ে তাকালেন, তারপরে ক্রুর হাসি হেসে বললেন,"এই তো, চিড়িয়া এবার ঠিক ফাঁদে পা দিয়েছে।"
কমলা কঠিন স্বরে বলল,"কিন্তু তার বদলে আমার একটা শর্ত আছে।"
সুলতান ভ্রু কুঁচকে বললেন," মেয়েমানুষ দের সবেতেই শর্ত। বল, কি চাই তোর?"
"আমার মেয়েকে যদি আমার কাছে এনে দিতে পারেন, তবেই আমি আপনাকে আমার পতি হিসেবে বরন করব।" দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা বলল কমলা।
"আরে জানেমন , ব্যাস এইটুকুই? তুমি চাইলেই আমি তোমাকে চাঁদ , সূর্য অব্দি পেরে এনে দিতে পারি, আর এইটুকু তো হিন্দুস্তানের সুলতানের কাছে কিছুই না।"
বলে ওঠেন খিলজী।
(৩)
প্রাসাদের অন্দরমহলে দাসীদের কোলে খেলছিলো ছয়মাসের দেবল। ভারি মিষ্টি দেখতে হয়েছে মেয়েটা, আর হবে নাই বা কেন, ওর মা কি কম সুন্দর দেখতে নাকি?"
রাজা রায় কর্ণ বাঘেলা দরবারে বসে ছিলেন, এমন সময় খিলজীর খাস দূত এসে জানালো , সে মহারাজের উদ্দেশ্যে পত্র এনেছে, খিলজীর তরফ থেকে।
মহারাজ বললেন,"আমার যা সর্বনাশ করার তো করেইছেন তোমাদের সুলতান , আর কি চান উনি?"
দূত বলল,"আজ্ঞে, আমাদের ভাবী বেগম কমলা আম্মা শর্ত দিয়েছেন, যদি উনি ওনার মেয়েকে কাছে পান, তবেই উনি সুলতানকে নিকা করবেন।"
মহারাজ বললেন,"আমি আমার কন্যাকে কোনো মতেই দেবোনা।"
দূত বলল,"নাহলে সুলতান যুদ্ধ ঘোষণা করবেন।"
তখন সভাসদেরা রাজাকে উপদেশ দিলো, যদি দেবলের বিনিময়ে শান্তি পাওয়া যায় তবে তাই হোক না, আর দেবল তো সেখানে খারাপ থাকবে না।
রাজা তখন এক সহস্র স্বর্নমুদ্রার বিনিময়ে রাজকন্যা দেবল কে সুলতানের হাতে তুলে দিলো।
মাস ছয়েকের মেয়েটা বুঝলো না, যে তাকে তার বাবা বেচে দিলো।
কমলা তার মেয়েকে পেয়ে খুশি মনে সুলতানকে নিকা করল।
(৪)
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। কমলাকে এখন আপাতদৃষ্টিতে বেশ সুখীই মনে হয়। সুলতানের বেগমদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা সেই পায়। বড় দুই বেগমরা তো এখন আর সুলতানের কাছে পাত্তাও পায়না।
এর মাঝে আবার সুলতানের নজর যায় চিতোর নগরীর রানি পদ্মিনীর উপর।
দিল্লিতে বসে কমলা ভাবতো, কে জানে কোন হিন্দু নারীর আবার কপাল পুড়তে চলেছে তার মতন। দীর্ঘ বছরের লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে খিলজী জয় করেন চিতোর, কিন্তু পাননি রানি পদ্মিনীকে, উনি জহর ব্রত পালন করার সৌভাগ্য টুকু পেয়েছিলেন।
দেবল এখন বেশ ডাগরটি হয়েছে ।
সুলতান এসে আজ কমলাকে প্রস্তাব দিয়েছে যদি তাঁর বড় পুত্র খীজর খানের সাথে দেবলের নিকা করানো যায়।
প্রস্তাবটা শুনে প্রথমে কমলার গা গুলিয়ে উঠেছিলো। নিজের সতীনের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে, ছিঃ!
কিন্তু এ কবছরে এদের এমন নোংরামি কমলার গা সওয়া হয়ে গেছে।
সুলতানের উপরে কথা বলার সাহস কমলার নেই, যদি রেগে গিয়ে মেয়েটার কিছু করে দেন।
আর তাছাড়া খীজরের সাথে নিকা হলে মেয়েটা অন্তত তার চোখের সামনে থাকবে।
তাই কমলা সবদিক বিবেচনা করে বিয়েতে মত দিয়ে দিলো।
দেবল যেদিন থেকে জেনেছিল সে আসলে হিন্দু বংশের রাজকন্যা, তবে থেকে মায়ের প্রতি তার মনে একটা চাপা অভিমান তৈরি হয়েছিল, মা তো ওকে এই নোংরা পরিবেশে না আনলেও পারত ।
খীজরের সাথে নিকার কথা শুনে ও মায়ের উপর প্রচন্ড রেগে গেল। নিজের সৎ দাদাকে কিনা বিয়ে করতে হবে!
কিন্তু কে শুনবে ওর কথা?
এই সমাজে মেয়েদের কথা কে কবে শুনেছে?
নিকার দিন তিনবার কবুল বলার সময় ওর গলাটা বারবার কেঁপে উঠছিলো।
আজ ও ওর বাবার কাছে থাকলে , ওর সিঁথিতে সিঁদুর উঠতো, ও পবিত্র থাকতো।
আজ সম্পূর্ণ ভাবে ও ধর্মভ্রষ্টা হল।
অবশ্য সে তো ও সেইদিনই হয়ে গিয়েছিল যেইদিন মুসলমানের অন্ন ও মুখে তুলেছিল।
তবে একটা কথা মানতেই হবে খীজর খান ওকে রেখেছিল ভালো। ওকে বেশ সম্মান করতো। যত্ন নিতো নিজের বেগমের। কখনও জোর করেনি।
স্বামীর সোহাগ পেয়ে মায়ের উপর কিছুটা রাগ পড়েছিল দেবলের।
মা মেয়ে কিছুটা কাছাকাছি এসেছিল।
তবে মানুষ ভাবে এক আর বিধাতা লেখেন আরেক।
সন ১৩১৬ তে কুতুব উদ্দিন মুবারক শাহ্ এর হাতে নিহত হন খীরজ ।
মেয়েটা নিজের স্বামীর মৃত্যুর শোক ঠিক করে উপলব্ধি করার আগেই মুবারক শাহ্ ওকে নিকা করে বলপূর্বক। খিলজী নিজের ক্ষমতা খোয়ানোর ভয় সবটা মুখ বুজে মেনে নেয়। কমলা চেয়েও কিছু করতে পারেনা।
প্রতি রাতে দেবলের শরীরটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে যখন মুবারক শাহ্ ওকে ধর্ষণ করত , দেবল চোখ বুজে সকল অত্যাচার সহ্য করতো আর ভাবতো, আজ খীরজ থাকলে এই দুর্দিন তাকে দেখতে হত না।
(৫)
খুঁজলে দেখা যায় ইতিহাস নোংরামি তে ভরা, ঠিক তেমনি ভারতের ইতিহাস।
মুবারক শাহ্ ছিলেন উভলিঙ্গ । তার জন্য তিনি একটি ছেলে পুষেছিলেন , নাম খুশরো খান।
কিন্তু খুশরো যখন দেখলো মুবারক শাহ্ এখন দেবল কে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে তখন সে প্রচণ্ড রেগে যায় ।
চক্রান্ত করে খুন করে মুবারক শাহ্ কে।
সত্যি কথা বলতে মুবারকের মৃত্যুতে শান্তি পেয়েছিলো দেবল , কিন্তু বিধাতা কবে সহ্য করেছেন মেয়েদের শান্তি!
দ্বিতীয় বার বিধবা হওয়া দেবলকে নিকা করে খুশরো শাহ্।
দেবলকে যখন কবুল বলতে বলা হয়েছিল , বলতে বলতে সে হেসেই ফেলেছিল, কষ্ট এমনই গভীর। মনে মনে ভেবেছিলো, কে জানে আর কতবার এই জীবনে ওকে কবুল বলতে হবে।
তৃতীয় বিয়ের পর কমলার কাছে একটা চিঠি পাঠায় দেবল, ওতে লেখা ছিল,
শ্রীচরণেষু মা,
মা বলব নাকি আম্মি? আজকাল নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেই ভাবি আমি , আমি কে? আমি কার? শুধু একজনের থালার এঁটো থেকে আরেকজনের থালার এঁটো, এই তো আমার জীবন। নিশ্চই শুনেছো আমার তৃতীয় বিয়ের কথা? খুব ভালো আছি আমি জানো মা? আজ এর বিরিয়ানীর আলু তো কাল আরেকজনের, কে জানে আবার কবে কার হয়ে যাই?
তুমিও ভালো থেকো মা।
ইতি তোমার,
কন্যা
চিঠিটা পড়ে কমলার না তো কিছু বলার ছিল না কিছু করার।
কেবল ওর নিঃশব্দ চিৎকার গুলো গুমড়ে মরেছিল সুলতানের বিশাল সুসজ্জিত কক্ষের ভিতরে, কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ প্রাসাদের মোটা ইট পাটকেল ভেদ করে বের হতে পারেনি , পারলে সারা পৃথিবী জানতো একটা মায়ের কান্না কিভাবে মনকে দোলা দিতে পারে।
কলমে-আশালতা