Goutam Nayak

Drama Romance Others

3  

Goutam Nayak

Drama Romance Others

প্রমীলা (পঞ্চম পর্ব)

প্রমীলা (পঞ্চম পর্ব)

13 mins
235


প্রমিলা কে নিয়ে আসার পর বিভূতিবাবুর একটি ফোন এসেছিল। কাজের চাপটা এই কদিনে খুবই বেড়ে গেছে। অফিসে অডিট হবে বলে সমস্ত ডেটা পত্র আমার কাছ থেকে ম্যানেজার বাবু নিতে চাইছিলেন। আমি সেসব নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।প্রমিলা,রুক্মিণী দেবীর সঙ্গে কথা বলে; কখন যে আমার ঘরের দরজার পাশে এসে হাজির হয়েছে, আমি তা লক্ষ্য করিনি। নিজের কাজগুলো করতে করতেই একবার দরজার দিকে তাকিয়েছি― দেখি প্রমিলা দাঁড়িয়ে আছে।হালকা হেসে প্রমিলাকে বললাম,

―প্রমিলা কখন এলেন এখানে? রুক্মিণী দেবীর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে???

―অনেকক্ষণ এসেছি। আপনার তো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই দেখছি।

―আরে আসুন আসুন―

আপনি, আজ খুবই ব্যস্ত আছেন মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ; একরকম তাই বলতে পারেন, অফিসের থেকে বেশ খানিকটা চাপ আছে।

―ঠিক আছে। আপনি চাপটা সেরে নিন, তারপরেই না হয় কথা হবে।

প্রমীলা সেই মুহূর্তে আমার নিমিত্তে এই কয়েকটি কথা বলেই বোধহয় স্নানের ঘরে গেল।

প্রমিলা বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে।তার কথার চাটুকারিতা বেশ সুন্দর আছে। কয়েকটা কথাতেই যেকেউ তার প্রিয় হয়ে উঠবে।তবে সে কথা বললে, সহজে তার কথার উত্তর কেউ দিতে পারে না। কিন্তু জানিনা আমি কি বলেছি যার জন্য সে আমার প্রতি এতো আসক্ত হয়ে পড়েছে।

কাগজপত্র খুঁজতে খুঁজতে আমার প্রায় ২০ মিনিট লেগে গেলো। প্রমিলা তখনো আসেনি। মেয়েদের স্নান করতে এতখন সময় লাগে!!!! 

আরো প্রায় 15 মিনিট বাদে স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে আমি এতটাই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, যে তা হয়তো ঠিকভাবে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

সদ্য প্রস্ফুটিত কুড়ির মত লাগছিল তাকে। ভেজা চুলে তার রূপের বর্ণচ্ছটা চারিদিকে আলো করে তুলেছিল। বোধ হয় চোখে কাজল লাগিয়ে ছিল। তার ওই কাজল কালি লিপ্ত দুটি চোখ আমাকে বারবার আকর্ষিত করছিল। সরল সাধারণ মেয়ে, নয়ন চাতুরী জানেনা, জানলে আমাকে নিশ্চয় পাগল করে তুলতো। দিশেহারা হয়ে যেতাম তখনই।এমনিতেই অবশ্য কোন অংশে দিশেহারা না হবার কম কিছু ছিল না আমার মধ্যে।আমি তখন স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে প্রমীলার চোখ আর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার চোখের ভাষা প্রমীলার মনে যে’ ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল তা পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। স্থির হয়ে গিয়েছিলো কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রমীলা। অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। দুজনের প্রেম বোধহয় সীমালংঘন করে কোন এক দূর দেশের নির্জন পরিবেশে খেলা করছিল। কোন বাক্যালাপ হয়নি; তবে হৃদয় অভ্যন্তরে যেটা চলছিল তা যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারত ওই মুহূর্তটা কিভাবে কাটছিল। কয়েক মিনিট এইভাবেই নিশ্চুপ ছিলাম কিন্তু ছোট্ট একটা দেয়াল ঘড়ি আমাদের অনন্য মুহূর্তটা নষ্ট করে দিল। নিজেকে বেশ লজ্জিত লাগছিলো তখন। তবে তা প্রমীলা নিজে নিজেই অনেকটা সামনে নিয়েছিল।

প্রমীলা পাশ কাটিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেই মুহূর্তে আমি স্নান ও খাওয়ার কথা প্রায় ভুলেই গেছি।মনের এমন অবস্থা হয়েছিল তখন বারবার ধরে শুধু একটা কথাই অন্তর থেকে আসছিল; যদি প্রমীলাকে আরেকটু ক্ষণ দেখতে পায়― আরেকটু ক্ষণ —

আরেকটু ক্ষণ ―

মুখ ঘুরিয়ে,প্রমিলার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে; প্রমিলা বলল―

কি অনন্ত বাবু শুধু কি দেখবেন, না’কি আমায় একটু সাহায্যও করবেন??

হ্যাঁ; বলেই আমি তার কাছে গেলাম। আমার মুখ থেকে তখন কোন কথাই বেরাচ্ছিল না। নিশ্চুপ ভাবেই প্রমীলার ব্যাগপত্র থেকে তার পোশাক-আশাক ও বইপত্র বের করতে সাহায্য করেছিলাম মাত্র। আমার নিশ্চুপ নির্বাক অবস্থা দেখে প্রমিলা বলল—

আপনি এত কম কথা বলেন কেন??

না― না― কই,

ওই তো, কতক্ষন ছাড়া ছাড়া উত্তর দিচ্ছেন।

ওহ! আরে আমি কম কথা বলি না তো, আসলে আজ ওই মনটা একটু হারিয়ে ফেলেছি তো তাই মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না।

―বা!!! অনন্ত বাবু কোথায় মন হারিয়ে ফেললেন??

―সে থাক না তা জেনে কি হবে—

এবার প্রমিলা আমার দিকে ঘুরে দাড়ালো, কেমন যেন একটা অদ্ভূৎ চাউনি দিয়ে বলল—

―না আপনাকে বলতেই হবে;

প্রমিলা সবই জানে তবুও আমার মুখ থেকে শুনতে চাই। চিঠির উত্তরে অনেকবার আমি এ রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। সে সবই বুঝতে পারছে তবুও আমাকে লজ্জায় ফেলতে চাই । হয়তো খুব মজা পাই তাতে। আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই লজ্জার অনুভব কতটা যে লজ্জাজনক তা বোধহয় চাক্ষুষ দেখতে পাবো। আমি থাক না থাক না করি আর প্রমিলা আমাকে চাপ দিতে থাকে বলতেই হবে। আমি যখন বলছিলাম না তখন শেষমেষ প্রমিলা হাতের পোশাকটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে বললো

আপনি যদি না বলেন  তো—

পরের কথাটা বলতে যাবে আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম

–আপনার মধ্যে;

প্রমিলা বোধহয় আমার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে চরম সুখ অনুভব করল।কিন্তু আজ সামান্য হলেও খুব বেশ অবাক হলাম।প্রমীলার সাথে যখন পত্রালাপ হয়েছে বা ফোনেও কথা হয়েছে তখন কিন্তু তাকে এত অগ্রেসিভ বলে মনে হতো না ।প্রমিলা কে এরকম অবস্থায় দেখে আমি সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম আবার ভয় পেয়েছিলাম। চমকে গিয়েছিলাম এই জন্য যে তাকে কোনদিনও ঐরকম দেখিনি আবার ভয় পেয়েছিলাম জীবনের এতোগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এত সুন্দর একটা ভালোবাসা পেয়েছি সেটা নষ্ট করে দেওয়া টা ঠিক হবে না। কিন্তু আমি যদি না বলি তাতে যদি সে কিছু করে বসে,সেইসব কথা ভেবেই তৎক্ষণাৎ উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারলাম না।

প্রমীলার ব্যাগের জিনিসপত্রগুলো স্থানান্তরিত করতে তাকে কিছুটা সাহায্য করতে হলো। তখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে এসেছে ।প্রমীলাকে আসছি বলে, আমি লাঞ্চের জন্য তৈরি হতে গেলাম।

প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের এক অনন্য ক্ষমতা থাকে তা প্রমিলার চোখে মুখে প্রস্ফুটিত।এটা আমি আমার অনেকগুলি অফিস কলিগের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তবে তার সত্যতার আজ প্রমান পেলাম। প্রমীলার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিনা একদম। কাউকে ভালবাসলে কি এরকমটা হয়। হৃদয় টা কেমন যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠে। আর তখনই মনে হয় প্রমিলার মুখোমুখি হয়ে কথা বলাটা সত্যিই একটা কঠিন কাজ। ভালোবাসার দু'চারটে কথা বলার জন্যই চিঠিপত্র অনেক ভালো,সেখানে তো আর মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয়না। তবে এক-একবার মনে হয় প্রমিলাকে না দেখে নিজেকে অসম্পূর্ণ রাখছি।আনমনা মন আমার ছটফট করে উঠে তাকে দেখার জন্য।প্রমিলা, আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে কিনা জানিনা তবে নিজেকে ঠিক রাখার জন্য তার সামনে খুব একটা বেশি কথা বলি না। স্নান করতে করতে এই কথাগুলো ভাবছিলাম। এমন সময় রুক্মিণী দেবীর আওয়াজে আমার ভাবনা ভঙ্গ হল।

—লাঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে কখন খাবেন অনন্ত বাবু? বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসুন—

নিজের প্রতি লজ্জিত অনুভব করে স্নানের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। প্রমিলা তখনও আমার রুম থেকে বেরিয়ে লাঞ্চের জায়গায় আসেনি। দরজার পাশ থেকে লক্ষ্য করলাম আমার পুরনো সব ডাইরি গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। পোশাক পরিবর্তন করব বলে দরজায় নক করলাম। নক করার শব্দ শুনে প্রমিলা দরজার দিকে তাকিয়ে একদম স্থির হয়ে গেল—

কোমরে একটা তোয়ালে জড়ানো ছিল মাত্র। বাকি শরীরটা বেশ নগ্নই ছিল। প্রমীলার দৃষ্টি যেন আমার শরীরটা কে তীক্ষ্ণ ভাবে ছিন্নভিন্ন করছিল। বারবার ধরে দরজায় নক করছিলাম। প্রমিলা যে আমার দিকে তাকিয়ে রইল,একদম অবাক হয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়েই রইল। এদিকে রুক্মিণী দেবীর ডাক আর বন্ধ হয় না,,,, আমাকে বেশ অবাক লাগছিল, আরে বাবা! এ কেমন মেয়ে রে― ছেলের শরীর কি জীবনে দেখেনি,,,

আমি প্রমিলা কে বললাম

―প্রমীলা আপনি একটু বাইরে যান, আমি পোশাকটা পরে নিই।

অবাক ব্যাপার, তার মুখ থেকে কোন উত্তর তো এলোনা, ও সেখান থেকে সরিয়ে যাওয়ার কোন পরিকল্পনাও দেখলাম না। আমি এবার কিছুটা বিরক্ত বোধ করলাম এবং অধৈর্য হয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে পোশাকগুলো নিয়ে প্রমিলার সামনেই চেঞ্জ করবো বলে সম্পূর্ণ তৈরি হয়েছি; এমন সময় রুক্মিণী দেবি দরজার সামনে এসে হাজির। আমাকে অর্ধ নগ্ন অবস্থায় দেখে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু প্রমীলাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হেসে বলল―

দিদিমণি আপনি কি প্রথম দেখছেন নাকি??? চলে আসুন লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

প্রমিলা যেন সম্বিত ফিরে পেল। রুক্মিণী দেবীর কথা শুনে, কিছুটা লজ্জা পেল বোধহয়। এবার একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রুক্মিণী দেবী না আসলে হয়তো আমাকে ওখানে অর্ধনগ্ন দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।যতই ভাবি সামনেই পোশাক পরিবর্তন এর কথা কিন্তু তা আমার মত মানুষের সম্ভব হয়ে উঠত না।

রুক্মিণী দেবী বাইরের বারান্দায় লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছিলেন। দেখলাম প্রমিলা আমার মুখোমুখি বসেছে। লাঞ্চ করতে বসলাম ঠিকই কিন্তু ভালো হলো না । বারবারই প্রমিলার মুখের দিকে তাকানো হয়ে যায়। রুক্মিনী দেবী আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী।আমি রুক্মিণী দেবীর দিকে তাকাতেই, সে পরিস্থিতি বুঝে গল্প শুরু করে দিলো। খাবার খাওয়ার সময় কেউ যদি গল্প করে তাতে আমি বেশ বিরক্তি অনুভব করি। রুক্মিণী দেবীকে এ ব্যাপারে অনেক আগেই বলেছিলাম কিন্তু মন ভোলা মানুষ তো,ভুলে গেছে ভেবে আমি আর কথা বাড়ালাম না।

কয়েক মিনিট বাদেই প্রমিলা বলে উঠলো―

–অনন্তবাবু আপনার বেড়াতে যাবার কি হলো, জায়গা ঠিক করলেন কি ― না?

–একদম ভুলেই গিয়েছিলাম, আজই সকলে মিলে ঠিক করে নেব।

রুক্মিনী দেবী এক অদ্ভুত ধরনের মুখভঙ্গি করে বললেন―

–বাব্বা, সামনে পেয়েছে আর কিছু মনে থাকে ভুলে তো যাবেই।

ইসারাটা আমার দিকেই ছিল। কেননা প্রমিলাকে সামনে দেখতে পাচ্ছি তো তাই। আমি কথাটা শুনে লজ্জিত বোধ করতেই প্রমিলা বলল,

–রুক্মিণী দেবী আপনিও তো মনে করিয়ে দিতে পারতেন।আর তাছাড়া আমি ভাবছিলাম আপনার পছন্দমত জায়গাতেই আমরা বেড়াতে যাবো।

রুক্মিণী দেবী সামান্য উছস্বরে বললেন,

–ওটা বলবেন না প্রমিলা , আমার পছন্দমত জায়গা হলে আবার অনন্তবাবুর পছন্দ হবে না।

–কেন রুক্মিণী দেবী??? প্রমিলা বেশ কৌতূহলেই কথাটা বলল।

–সেটা অনন্তবাবুকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না।

কথাগুলো সীমালঙ্ঘন করছে তা বোধহয় কাওকে বোঝাতে হবেনা। রুক্মিণী দেবী, প্রমিলার কাছে আমাকে লজ্জায় ফেলার যে তুমুল চেষ্টা করছে তা প্রমিলার চোখের ভাষাতেই বোঝা যায়। আমি খাবারটা মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে প্রমিলার চোখের দিকে তাকালাম। প্রমিলার; ইশারাটা বুঝতে দেরি হল না।আমি মুখের খাবার শেষ করে বললাম,

–রুক্মিণী দেবী– কেন আপনি,আপনার মনের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্গুলির এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছেন। একদিন আপনার সঙ্গে দামোদরে ঘুরে আসবো তো।

আমার উত্তরে রুক্মিণী দেবির মুখখানা দেখার মত হয়েছিল। প্রমিলা হা হা করে হেসে উঠলো ও বলল-

–রুক্মিণী দেবী, আপনি যদি অনন্তবাবুকে দামোদরে ঘুরতে যাবার কথা বলেছিলেন এবং তাতে সে যদি না যায় তাহলে তার ভুল।সবথেকে বড়ভুল এটাও যে আপনার মত একজন সুন্দরীর সাথে সে ঘুরতে যাইনি। আমি হলে তো সে সুযোগ ছাড়তাম না।

কথাগুলো শুনে রুক্মিণী দেবীর মুখ বেশ খুসিতে ভরে গেল।আমি অবাক হয়ে নির্বাক চিত্তে তাকিয়ে রইলাম।প্রমিলার কথা বলার মধ্যে এক রকম মলিনতা আছে। যা কিন্তু সচরাচর সকলের মধ্যে দেখা যায় না। আর হয়ত এই কারনেই ভগবান আমার সঙ্গে প্রমিলার আলাপ করিয়ে দিয়েছে।

লাঞ্ছ শেষ করে প্রমিলা রুক্মিণী দেবির সঙ্গে আবার গল্প জুড়ে দিল। টুকি বাবুকে গাড়িটা লক করতে বলে দিয়ে আমার ঘরে আসতে বললাম।দুপুরে আজ বেড়াতে যাবার জায়গা ঠিক করতে হবে। টুকি বাবু কিছুক্ষণের মধ্যে এসে হাজির হল।আমি বললাম-

–টুকি বাবু আজ জায়গাটা ঠিক করেই নিই বলুন-

–হাঁ,বাবু। আর একটা কথা বলার ছিল।

বলুন টুকি বাবু বলুন;

–রুক্মিণী আপনাকে বেশ লজ্জায় ফেলেছিল।আমি বুঝেছি বাবু। আপনি তার কথায় রাগ করবেন না যেন–

–দূর, এতে আবার রাগের কি আছে। আমি রুক্মিণী দেবীকে নিজের লোকের মত ভাবি।তার কথায় কি রাগ করা যায়।আমি তার কথায় রাগ করিনি।

টুকি বাবু বেশ খুশি হয়ে বললেন– বাবু আপনার মত মানুষ হয় না।

আমিও সামান্য হেসে বললাম– সে যাই হোক এখন ও কথা থাকুক।এখন বলুন আপনাদের মতে কোনখানে বেড়াতে গেলে ভালো হবে…।

আপনাকে তো বলেছিলাম বাবু-

ওহ! বলেছিলেন,বলেছিলেন- অনেকদিন হয়ে গেল ভুলেই গেছি।তাহলে এক কাজ করুন, প্রমিলাকে ডেকে একটু ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিন।

টুকি বাবু রুক্মিণী দেবীর উদ্দেশ্যে হাঁক দিয়ে বললো,,,

দিদিমনিকে নিয়ে তুমি অনন্ত বাবুর ঘরে এসো।

রুক্মিণী দেবী আসছি বলে উত্তর দিলো। টুকি বাবু আমার রুমে চেয়ারটা নিয়ে বসলো।মিনিট দুয়েক বাদেই রুক্মিণী দেবী ও প্রমিলা এলো। প্রমিলাকে একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললাম।

রুক্মিনী দেবী আমার হাতে পানমসলাটা দিয়ে সম্মুখের চেয়ার টা টেনে বসল ও বলল,

অনন্ত বাবু কোন জায়গা ঠিক করলেন???

না, এখনো ঠিক করিনি। টুকি বাবুর সাথে সেই নিয়ে আলোচনা করছিলাম এইমাত্র।

তাহলে আজ চলুন না সকলে মিলে দামোদর থেকে একটু ঘুরে আসি।

রুক্মিণী দেবীর কথা তে আমি প্রমিলা র দিকে তাকালাম। প্রমিলা মুচকি হেসে বলল–

–রুক্মিণী দেবী আজ আমি বড় ক্লান্ত, আজ থাকুক না; এখন তো কিছুদিন এখানে থাকবো বলেই ভেবেছি। তখন না হয় কোন একদিন ঘুরে আসবো। এখন আপনি বলুন, কোন জায়গাতে বেড়াতে গেলে আমরা সব থেকে বেশি আনন্দ অনুভব করব।

প্রমীলার কথা শুনে রুক্মিণী দেবীর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। আমি রুক্মিণী দেবী র হাত দুটো ধরে বললাম–

আপনি রাগ করলেন রুক্মিণী দেবী???

– রুক্মিণী দেবী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে বললেন, না না রাগ করিনি কিন্তু মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।

প্রমীলা হাসতে হাসতে বলল,

–মন মন খারাপ করলে চলবে না রুক্মিণী দেবী এখন তো অনেক সময় আছে আজকের দিনটা গল্প করেই কাটায় না।

রুক্মিণী দেবীর রাগ ভাঙ্গানো শেষ হতে না হতেই টুকি বাবু বলে উঠলেন—

—অনন্ত বাবু এখানে অনেক জায়গা আছে দেখার মত, আপনাকে এর আগেও বলেছিলাম আমি একবার। তবুও আবার আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, আপনারা ঠিক করে নিন কোনখানে বেড়াতে যাবেন—

প্রমিলা বলল, অনন্ত বাবু এমন একটা জায়গার সন্ধান করুন যেখানে চারিদিকে শুধু সবুজ ঘাসে ভরা পাহাড়। পাহাড়ের পাশে নদী ও নদীর পাশে এক বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে রয়েছে সমভূমি। যেখানে আমরা খুব মজা করতে পারবো। আরেকটা কথা এমন একটা জায়গা খুঁজুন যেখানে রুক্মিণী দেবী একদম চাঙ্গা হয়ে ওঠে—

প্রমীলার কথা শুনে আমরা সকলেই হো হো করে হেসে উঠলাম।

টুকটুকি বাবু এবার বলতে শুরু করলেন,

অনন্ত বাবু আপনি তো জিরো ভ্যালি আগেই দেখে নিয়েছেন, এবার প্রমীলা দেবীর কথামতো দেখার জায়গা হিসাবে রইং খুব ভালো জায়গা। প্রমিলা দেবী যেমনটি চাইছেন সেরকমই। কিন্তু এছাড়াও সবুজে সবুজে ভরা আরো অনন্য সুন্দর জায়গা আছে, যেমন তেজু, সিলাবাস, বোমডিলা ইত্যাদি আরো অনেক।

আমি বললাম, টুকি বাবু আমি তো মাত্র কয়েক মাস এসেছি এখানে। আপনি তো এখানে বহুদিন ধরে আছেন আমার থেকে আপনার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি হবে। কোন জায়গাতে গেলে ঠিক হবে আপনিই ঠিক করুন না।

প্রমিলা বলল—, আচ্ছা টুকি বাবু আপনি যে রোইং জায়গাটির কথা বলছেন, সেখানে কোন মন্দির নেই।

—প্রমিলা দেবী, আমি এর আগে অবশ্য ওখানে যায়নি—,অনন্ত বাবুই একদিন আমাকে বেড়াতে যাওয়ার ক থা বলছিলেন।সেদিন রাত্রে, আমি খবর নিয়ে জানতে পারি, জায়গাটি খুব মনোরম এবং আপনি যেরকম চাইছিলেন সেরকমই। কিন্তু ওখানে মন্দির আছে কিনা আমার তো জানা নেই।

—ওহ, বুঝলাম।

রুক্মিণী দেবী চুপ দিয়ে কথাগুলি শুনছিলেন। এবার গলাটা একটু ঝাকুনি দিয়ে টুকি বাবুর উদ্দেশ্যে বললেন—

শিলাপাস জায়গাটা কেমন কি খোঁজ নিয়ে দেখেছো? আমি ওই জায়গাটার সমন্ধে শুনেছি তবে কতটা সত্য জানিনা। সেদিন রাজনের (পাশের বাড়ির ছেলে) মা বলছিল,তার বড় ভাই নাকি ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল। জায়গাটা নাকি খুবই সুন্দর―

আমি রুক্মিণী দেবীর উদ্দেশ্যে বললাম আপনার ওই জায়গাটিতে যাওয়ার শখ আছে বুঝি ?

―হ্যাঁ, কিছুটা আছে বলতে পারেন।

তাহলে এক কাজ করুন না প্রথম টুরটা আমরা ওখানেই যাই—

টুকি বাবু এবার গলাটা ঝেড়ে বললেন― বলেন কি! প্রমিলা দেবী যাবেন তো ওখানে?

প্রমিলা দেবী কথাটির কোন উত্তর দিলেন না। মুচকি হাসলেন ও তাকিয়ে রইলেন।

আমি বললাম―

এখন পর্যন্ত যেটুকু জেনেছি তাতে প্রমীলা দেবীর পছন্দ খারাপ হবে না। আমরা প্রথমে ওখানেই যাব এবং তারপর না হয় রোইং এ যাব।

প্রমিলা ,এবার টুকি বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

আচ্ছা টুকি বাবু, সিলাবাস এ কি কি দেখার আছে???

টুকি বাবু কিছু একটা বলতে যাবে, আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম

ওহ! প্রমিলা, যদি আগেই জেনে নেন তাহলে তো সেখানে গিয়ে দেখার মজাটাই সম্পূর্ণ বদলে যায়।

আমার কথা শুনে সকলেই প্রমিলার মুখের দিকে তাকালো। প্রমিলা কিছুটা অস্থিরতা বোধ করেই উত্তর দিল-

―ঠিক আছে; বলতে হবে না। আমরা প্রথম ওখানেই যবো।

বোলেঙ্গ থেকে সিলাবাস প্রায় 140 কিলোমিটার দূরে, এবং যা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় 1700 মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তথ্য অনুযায়ী জায়গাটির সৌন্দর্য এতটাই যে সম্মোহনের মতো করে দেয় সকলকে।তাছাড়া আমার আর বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে আশাকরি জায়গাটাকে গেলে জীবনের একটা দারুণ আনন্দ উপভোগ করা যাবে।

আরও দু চারটে সুন্দর জায়গার আলোচনা হওয়ার পর প্রমিলা বলল―

―অনন্ত বাবু আমার রিসার্চের জায়গাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিলেক্ট করতে হবে।আপনি যদি একটু ঠিক করে দেন তাহলে খুবই ভালো হয়।

প্রমীলার পড়াশোনার ব্যাপারে আরো দু-চারটে কথা শুনে রুক্মিণী দেবী ও টুকি বাবুর সেখানে থাকাটা অযৌক্তিক মনে করলেন এবং আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে; ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রুক্মিণী দেবী ও টুকি বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রমীলার মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম প্রমীলা মুচকি হাসছে। কারণটা স্পষ্ট ছিল না আমার কাছে আমি প্রমিলা কে জিজ্ঞাসা করলাম,

―প্রমিলা আপনার হাসার কারণ? আপনি হাসছেন কেন?

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে চেয়ার টা নিয়ে আমার মুখোমুখি এসে বসলো। কেন জানিনা তখন থেকে আমার হৃদস্পন্দন একটু একটু করে বাড়তে শুরু করলো। প্রমিলা আমার চোখের উপর চোখ রেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। আমার অনুভবটা তখন এতটাই অস্থির হয়ে উঠেছে যে হৃদস্পন্দন অত্যাধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। কোনদিন এরকম অবস্থাতে পড়িনি। তাছাড়া প্রমীলার উদ্দেশ্যটা কি ছিল সেটাও আমার কাছে পরিস্কার নয়। সে এই কিছুক্ষণ আগে ল্যাব সিলেক্ট করার কথা বলছিলো আবার টুকি বাবু রুক্মিণী দেবী কে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে আমাকে অস্থির করে দিল।

আমার অবস্থা বুঝে প্রমিলা হো হো করে হেসে উঠলো। এবং বলল—

—অনন্ত বাবু, অত অস্থির হবার কিছু নেই। আপনাকে কিছু করব না। আপনি এত ঘেমে যাচ্ছেন কেন???

এবার বুঝেছি প্রসঙ্গ তা ল্যাব সিলেক্ট করা কে নিয়ে নয়। আমার সাথে নয়ন চাতুরী করার জন্যই ওদের দুজনকে বাড়ি থেকে বাইরে বের করে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। তাই ওদের সামনে পড়াশুনার প্রসঙ্গ তুলে দিল যাতে ওরা বেরিয়ে যায়। কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা—শিক্ষিত মেয়ে তো! আমি নিজেকে কিছুটা কন্ট্রোল করে নিয়ে বললাম,

—না না তা নয়,আসলে কখনো কোন মেয়ে এইভাবে আমার দিকে তাকাই নি তো। তাছাড়া মেয়েদের প্রতি আমার প্রথম থেকেই দুর্বলতা রয়েছে।

—কি দুর্বলতা অনন্ত বাবু। মেয়েরা তো আর বাঘ ভাল্লুক নয় যে খেয়ে নেবে।

—হ্যাঁ তা বটে, যে মেয়েরা খেয়ে নেবে না, কিন্তু অনেক লেখকের লেখাতে পড়েছি মেয়েদের একরকম অনন্য সম্মোহনী ক্ষমতা থাকে। যার সাহায্যে তারা যে কোন পুরুষ মানুষকে যে কোন দিক থেকে অক্ষম করে দিতে পারে। যেমন ঠিক আপনি আমায় করলেন।

—তাই বুঝি???

আমি এবার চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বললাম,

—তাই নয় কি???? আপনার মধ্যেও তো সেই ক্ষমতা রয়েছে।যা তার থেকে কোন অংশে কম ক্ষমতা নয়।

আমি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার সম্মোহনী ক্ষমতার সত্যতা যাচাই করছিলাম না। আপনার মনে আছে কতদিন আগে আপনাকে দেখেছি! সেদিন দেখে আমার মনে তৃপ্তি হয়নি তাই আজ আপনার চোখে চোখ রেখে আমার মনকে তৃপ্ত করছিলাম।

—যাইহোক বেঁচে গেলাম। আমি তো ঠিক সেই রকমই ভেবেছিলাম।

প্রমিলা মুখে এক মুখ কৌতুহল নিয়ে বলল,

—কি রকম ভেবেছিলেন অনন্ত বাবু???

আমি ঠিক কি ভেবেছিলাম, নির্দিষ্টভাবে তাহা যে বলা আমার কাছে সহজসাধ্য নয় তা প্রমীলা ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল। আর সেই জন্যই বোধহয় আমাকে কতইনা কৌতুকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কথাটি বার বার ধরে ঘোরানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু প্রমীলার নাছোড়বান্দা ভাব আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। সেদিন রুক্মিণী দেবীর বিকালের টিফিন নিয়ে এসে কথাগুলির দিকভ্রান্তি করার চেষ্টা করলেও তার কাছে যথেষ্টভাবে ব্যর্থ হয়ে উঠেছিল এবং শেষমেষ আমাকে একটা কিছু উত্তর দিতেই হয়েছিল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama