Goutam Nayak

Drama Romance Others

3  

Goutam Nayak

Drama Romance Others

প্রিয়তমা (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রিয়তমা (দ্বিতীয় পর্ব)

12 mins
202


নৃপেনের চিত্ত বিলুপ্তি হইয়াছিলো।ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া কি করিবে তাহা বুঝিতে পারিল না। মাথা হেঁট করিয়া টেবিল প্রান্তে দাঁড়াইয়া রহিলো। 


ছোটমা আজ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। তাহার রূঢ় প্রত্যাখ্যান যেন দংশন করিতেছে। কি হইয়াছে তাহা কেহ না বুঝিলেও অদৃষ্টের আড়ালে কেহ যে আছে এবং তিনি যে বুঝিতে পারিতেছেন, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই।


চেয়ার টানিয়া লইয়া, টেবিল সম্মুখে এক টুকরো কাগজ ও কলম লইয়া, বসিয়া ইংরেজিতে কি সব লিখিতে লাগিল। লিখিতে লিখিতে একবার ঠাকুর ঘর হইতে ঘুরিয়া আসিয়া পুনরায় শুরু করিলো। নিস্তব্ধ বারান্দা যেন মৌনরূপ ধারণ করিয়াছে। সময় ধীরে ধীরে বহিয়া যাইতেছে। নৃপেন আর থাকিতে পারিলো না, ছোটমার ভর্ৎসনা প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিল,

- ছোটমা,,,

কোনো উত্তর আসিল না, নৃপেনের মুখদিকে একবারও সে তাকাইলো না পর্যন্ত। নৃপেন আবার বলিল,

- ছোটমা, খেয়ে নাও, চা ঠান্ডা হইলো যে।

নৃপেনের কথার আর উত্তর না দিয়া ঠিক থাকিতে পারিলো না ছোটমা। তিনি বলিলেন,

- নৃপেন আমি খাইবো না। আমার ক্ষুধা নেই। তুমি রান্না সালে গিয়ে বড়ঠাকুর আর তোমার ছোট বাবুর খাবারের ব্যবস্থা করো। আমি এক্ষুনি, নিচে বড়ঠাকুরের খবর লইয়া ফিরিয়া যাইবো।

অতঃপর নৃপেন আর কোনো কথা না বলিয়া নিচে নামিয়া যাইলো। আর কথা বাড়াইলে তিনি হয়তো আরো রাগিয়া যাইবেন। তাহার তুলনায় না প্রসঙ্গ উত্থাপন করাটাই যে শ্রেয় হইবে, তাহা বুঝিয়ায় নৃপেন নীচে নামিয়া গেল।


নৃপেন নামিয়া যাইতেই, ছোটমা কিছুক্ষনের মধ্যেই তাহার লেখা সমাপ্ত করিল। তিনি অত্যন্ত রাগিয়া আছেন। কতক্ষন হলো নিজের বাড়িতে আসিয়াছে , নৃপেন ছাড়াও বাড়িতে আরো দুটি জলজ্যান্ত মানুষ রহিয়াছে। কেহ তাহার খবর পর্যন্ত নেই নাই। 

একজন না হয় বুঝিলাম , তাহার আমার নিমিত্ত খবর নেওয়া ঠিক হবে না। আমারই না হয় নেওয়া দরকার। কিন্তু আর একজন, তিনি তো আর অন্যজনের মত নহে, তিনিও একবার খবর পর্যন্ত নিলেন না। আরতির সময় লক্ষ্য করিয়া চলিয়া গেলেন। মুখ হইতে তাহার একটি বাক্য পর্যন্ত বের হইলো না। কিছুটা ক্রোধ ও মনের গোপন আক্ষেপে, হাতে ধরে রাখা কলমটা ছুড়ে ফেলিয়া দিলো। চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া, বাতিটি নিভাইয়া বারান্দার গ্রিলের সামনে আসিয়া দাঁড়াইলো। সমস্ত বাড়িটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হইলো। 


বারান্দা হইতে বিপুলবিহারীর বৈঠকখানার আলো দেখা যাইতেছে। হতাসচিত্তে কুমুদিনী গ্রিল ধরিয়া কিছুক্ষণ তাহারই কক্ষে দৃষ্টি নির্বন্ধ করিয়া রহিলো। তাহার মনের মধ্যে যে একরকম আন্দোলন শুরু হইয়াছে তাহা বোধহয় ইস্ট ছাড়া কেহই বুঝিতে পারে নাই। সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাগনের মিটমিট আলো আর চাঁদের শোভা, হতাশ চিত্তে লক্ষ্য করিতে লাগিল। নির্মল জোৎস্না ও তারার মিটমিট আলো হয়তো সন্ধ্যার একাকীত্ব ,কিছুটা কাটিয়ে তুলবে।


এ বাড়ি তাহার নিজের বাড়ি। এ বাড়ির সকলের উপর তার অধিকার সবথেকে বেশি। আজ এ বাড়ি ছাড়িয়া তাহার যাইতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হইয়াছে যে তাহাকে এ বাড়ি ছাড়িতে হইবে। মনে মনে কুমুদিনী তাহার পিতাশ্রীর উপর যেমন চটিয়া উঠিল তেমনিই নিজের বাড়ির লোকজনের উপরও আস্থা হারিয়ে ফেললো। বিশেষ করিয়া বিপুল বিহারীর উপর রাগটা বাড়িয়া গেলো। এতদিন কেহ কি করিয়া তাহার প্রিয়তমার সহিত সম্পর্ক না রাখিয়া থাকিতে পারে। একবার করিয়া সে কি দেখা করিতে পারিত না। কি হইতো সে যদি দিনের মাথায় একবার দেখা করিয়া জানিত, কেমন আছি? সে নিজে না জানিলেও কাহারো কাছ হইতে একবার যদি খবর নিতো - যে আমি কেমন আছি? তাহলেই বা কি ক্ষতি হইতো তাহার। আজ অবধি সে আমার খবর পর্যন্ত নেই না। আজও নিলো না। তাহলে ? প্রশ্নটা অদৃষ্ট কে করেই ফেললো।

যতই এটা নিজের বাড়ি হোক, আজ আমি একফোঁটাও জলস্পর্স করবো না। মনে মনে ভাবিতেছে এমন সময় লক্ষ্য করিল , বিপুলবিহারি তাহার কক্ষের বাহিরে আসিয়া অন্যমনস্ক চিত্তে দেওয়ালে হেলান দিয়া ধূম্রপান করিতেছে।

এমনিতেই তো রাগিয়া ছিলেন। বিপুলের ধূম্রপান তাহাকে ক্ষেপিয়ে তুলিল। নিজ নিজ বিড়বিড় করিয়া বলিতে লাগিল: এই রূপ ধরিয়াছে, ঘরময় শুন্য পাইয়া এই চরিত্র আপন করিয়াছে। আজ এর একটা বিহিত করিয়া ছাড়িবো। 

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে ও তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করিয়া নীচে নামিতে লাগিলেন।

বারান্দার সিঁড়ির নিম্নে যে গলির মত বইঘরটি রহিয়াছে তাহারই পাশের কক্ষে চাটুজ্জে মশায় থাকেন। বারান্দা থেকে নামিবার সময় তাহার কক্ষ খোলা দেখিয়া কুমুদিনী তাহার সহিত না দেখা করিয়া পা আগাইতে পারিলো না।

চাটুজ্জে মশায়, তাহার কৃষিবাড়ির সমস্ত হিসাবপত্র দেখছিলেন। কুমুদিনী তাহার সম্মুখে আসিয়া সষ্টাঙ্গে প্রণাম সমাপ্ত করিয়া,ঘোমটা টানিয়া দেরাজ সম্মুখে দাঁড়াইলো। চাটুজ্জে মশায় তাহাকে দেখিয়া একেবারে হতবাক। সন্ধ্যা হইতে সে আজ অন্যরকম গন্ধ পাইতেছিলো, আরতিটাও অন্যরকম শোনাচ্ছিলো, কিন্তু এ যে কুমুদিনীর আগমনে, তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। তিনি বেশি কথা বললেন না, আজ কুমুদিনী কে দেখিয়া তাহার হৃদয় অভ্যন্তরে যেমন শান্তি মিললো তেমনিই আবার ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া হতাসাটা বাড়িয়া গেল।তিনি বলিনেন,

- কখন আসিয়াছো মা ?

- সন্ধ্যায়। আপনি শরীরের একি হাল বানিয়েছেন?

- কল্যানিনি অনুপস্থিত থাকিলে নিজের শরীরের এর থেকে বেশি আসা করা যায় না।ইহাই আমার উপযুক্ত পরিণাম।

কুমুদিনী কোনো উত্তর করিলো না।তাহা দেখিয়া চাটুজ্জে বলিল,


- সেখানের সকলে কেমন আছে?

- ভালো আছে। রোজ তাহারা আপনাকে গালাগালি দেয়। বলে নাকি আপনি, তাহাদেরকে শান্তিতে থাকিতে দিচ্ছেন না। সকলকে নাকি পিছনে লাগাইয়া দিয়াছেন। 

মৃদু হেসে চাটুজ্জে মশায় বললেন,

- চৌধুরী বাবু বোধ হয় ক্রোধে জ্বরাগ্রস্ত হইয়াছেন।তাহাকে দিনের কিছুক্ষন ধ্যান ও জ্ঞানে বসিতে বলিবে।


কুমুদিনী, মনে মনে ভাবিতে লাগিল - আজ তার জীবনের একটা হেস্ত নেস্ত করিয়ায় যাইবে এখান হইতে। তাই সে বলিল,,

- আমাকে শুনাইয়া শুনাইয়া বেশিরভাগ কথাগুলো বলিয়া থাকে। একদা সহ্য করিতে না পারিয়া আমিও বেশ উত্তম মধ্যম বলিয়া দিয়েছিলাম।

- ভুল করিয়াছো। মা তুমি ভুল করিয়াছো। তিনি তোমার জন্মদাতা পিতা। তাহার বিরুদ্ধে বলা খুব ভুল হয়েছে। চাটুজ্জে পরিবারের কোন ব্যক্তি এ চরিত্র দেখাইতে পারে নাই।আমাদের সংস্কার যেন না ভুলিয়া যাও। পিতাশ্রীর সম্মুখীন হইয়া ক্ষমা চাহিয়া নিয়ো। তিনি গালাগালি দিলে আমার কিছু আসিয়া যায় না। এই ভুল যেন না হয়।

 কুমুদিনী যে ভুল করিয়াছে তাহা সে নিশ্চুপ থাকিয়া বুঝাইয়া দিলো।সে বলিল,

- আমার সময় হইয়াছে। এবার আমায় যাইতে হইবে। 


চাটুজ্জে মহাশয় তাহার মুখপানে একবার চাহিলেন।ভালো করিয়া তাহার মুখখানি লক্ষ্য করিয়া আর কোনো বাক্যালাপ না করিয়া হিসাবে মনঃসংযোগ করিলেন।


কুমুদিনী পুনরায় প্রণাম সারিয়া; আসছি বলিয়া শশুর মশায়ের কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।


চাটুজ্জে মহাশয়ের কক্ষ হইতে বাহির হইয়া তাহার দর্প বাড়িয়া গেল। তিনি বিপুলবিহারীর কক্ষ সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

বিস্মিতপ্রবন বিপুল তাহার ধুম্রোপানে এতটাই মগ্ন যে কুমুদিনী তাহার সন্মুখে হাজির হইয়াছে তাহা টের পাইলেন না। 

কুমুদিনী নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে তাহার প্রিয়তম কে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন।

যথা সময়ে সিগারেটের শেষ রক্তবিন্দু টানিয়া দূরে ছুঁড়ে ফেলে, একটা হতাশার নিশ্বাস ফেলিয়া; দেওয়ালে হেলান দিলো। কুমুদিনী তাহার হতাশা দেখিয়া আর নিশ্চুপ থাকিতে পারিল না। সে বলিল,

- এখন বুঝি ধুম্রোপান মনস্থির করিতে খুব সাহায্য করে?

 

বিপুল,কুমুদিনীর গলা শুনিয়া চমকে উঠিল।সে হেলান ছাড়িয়া কুমুদিনীর দিকে তাকাইলো।

তাহার চাউনি তে আর ভালোবাসা নেই। কেমন যেন হতাশাগ্রস্ত ক্লান্তি ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে। দৃঢ় সংকল্প ধারী মানুষটি পরিস্থিতির কাছে যেন শোষিত হইয়াছে। কুমুদিনীর হৃদয়ে তা গভীর ভাবে ধাক্কা দিলো। ব্যাক্তিটির চরিত্রে বেশ বদল আসিয়াছে। ভগবানের সুক্ষ কারুকার্যে বানানো তাহার এই রক্তমাংসের শরীরে আমূল পরিবর্তন হইয়াছে, দেখিলেই বোঝা যায় কেউ যেন তাহার শরীর থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পৃথক করিয়াছে। মনের অভ্যন্তরে তাহাকে কেউ যেন বধির করিয়া তুলিয়াছে। কুমুদিনী বলিল,

- এ কি করিয়াছো নিজের শরীরের? 

কুমুদিনীর করা প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বিপুল খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না। হতভম্বের মত বলিল,

-আর ভালো লাগছে না। 

-কেন? (কুমুদিনীর মুখ হইতে যেন তীরের মত কথাটা বাহির হইলো। ) শরীর ভাঙিয়াছে কিন্তু মনতো নরম হয় নাই।

কথাগুলো বেশ ঝাঁঝালো লাগলো বিপুলের।বিপুল কোনো উত্তর না দিয়া, কক্ষে প্রবেশ করিয়া টেবিল সম্মুখে চেয়ার অধিগ্রহন করিলো ও বলিল,

- ভালোবাসার মানুষটিকে কেউ যদি দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় তাহলে তার মন নরম হইবে ? যা করিয়াছি তাহা যথেষ্ট নহে। আরো নিষ্ঠুর হইলে হয়তো বা ঠিক হইতো।


কুমুদিনী কিছুটা উত্তেজিত হইলো ঠিকিই কিন্তু ভালোবাসার মানুষ বলিতে যে বিপুল তাহার কথায় বলিয়াছে; তাতে কিছুটা সন্তুষ্ট হইয়া বলিল,

- আমি এখানে ওই কথা শুনিতে আসিনি। 

কথাটি শেষ করিয়া কক্ষের প্রবেশদ্বার সম্মুখে মুখ করিয়া দাঁড়াইলো।

বিপুল কি উত্তর দেবে সেই ভাবিয়া মুখ তুলিয়া কুমুদিনীর দিকে তাকিয়ে রহিল।


কুমুদিনী অনেকখানি বদলাইয়া গিয়াছে। জরাজীর্ণ হইলে একটি মহিলার রূপ যাহা দেখাইয়া থাকে, আবছা অন্ধকারে তাহাকে সেইরকমই দেখাইল। তাহাকে ঐরূপ দেখিয়া বিপুল অতীব দুঃখ পাইয়া বলিল,

- আজকাল বুঝি খাওয়াদাওয়া ঠিক হয় নাই?

কুমুদিনী কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকিয়া বলিল,

- সে খবর তোমার লইয়া কি হইবে? আমি খাওয়া দাওয়া করি বা না করি। 

বিপুল, দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলিল,

- এভাবে কথা বলছো কেন তুমি? তোমার শরীর তো ভালো দেখছি না।


বিপুল যে কুমুদিনীর প্রতি অতীব দুর্বল তাহা কুমুদিনী প্রথম থেকেই জানিত। সে যতই উগ্র হউক না কেন, প্রিয় মানুষটির মুখের উপর যে, সে একটি কোথাও জোর করিয়া বলিতে পারিবে না, তাহা কুমুদিনীর অগোচরে ছিল না। কুমুদিনী বিপুলের দুর্বলতার বেশ সুযোগ নিয়ে তার একবছর ধরে জমিয়ে রাখা সুপ্ত ক্ষোভ উগরে দিলো। সে বলিল,

- বলিব না মানে? আজ একবছর আমাকে ছাড়িয়া রহিয়াছো। একবারও খবর পর্যন্ত নাওনি, সারাদিন কিভাবে আছি, কি করছি, আমার মনের অবস্থা কেমন? তাহার বিন্দুমাত্র তো খবর নেবার প্রয়োজন বোধ করোনি। 

কথাগুলো শেষ করিয়া, কাপড়ের গোছাটা নিয়ে, কোমর বাঁধিলেন। যেন এবার যুদ্ধে নামিয়া পড়িবেন। বিপুল তাহার মুখের দিকে তাকিয়ে, বলিল

- তুমি কেমন বদলাইয়া গিয়েছো। আমার কুমুদিনী এরকম ছিল না।

কথাটি শেষ করতে না করতেই, কুমুদিনী কাঁদিয়া উঠিল।আমি এটা বুঝিতে পারিলাম না।বিপুলের কথাতে কি এমন ছিল কুমুদিনী কে কাঁদাইবার মত।


 কুমুদিনী কাঁদিতেই বিপুলের মনেতে যে শিহরণ শুরু হইলো তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই। দ্রুত চেয়ার ছাড়িয়া কক্ষ হইতে বাহির হইলো ও সম্মুখে আসিয়া বলিল,

- কাঁদছো কেন? চুপ দাও। শান্ত হও,,

কথাগুলি বলিতে বলিতে বিপুল অস্থির হইয়া উঠিল।


কুমুদিনীর এ কান্না যে কিছুতেই থামিবে না তাহা বিপুলের অধরা। তাহার ও যে মন রহিয়াছে ইহাতেই কুমুদিনী ক্ষান্ত। ইহা অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে নাই সে। বিপুলের মুখে 'আমার কুমুদিনী' কথাটি শুনিয়াই তাহার নয়ন হইতে অজস্র লবনাম্বু বাহির হইলো। এবং তাহা সে কোনোমতেই বিপুলের চোখের আড়াল করিতে পারিল না। এই কান্না যে বড্ড আদুরে। থামানোর চেষ্টা করিলেও যেন থামে না। বিপুলের অস্থিরতা কুমুদিনীর মনেতে যে এক অদৃশ্য খুশির হাওয়া বাহিত করিল। ক্ষনিকের জন্য দুজনেই একে অপরের অভিমুখে তাকিয়ে রহিল। কুমুদিনী কাঁদিতে কাঁদিতে বসিয়া পড়িয়াছিল। বিপুল তাহার হাত দুটি ধরিয়া তাহাকে তুলিবার চেষ্টা করিলো ও বলিল,

- কক্ষে আসিয়া বসো। এইভাবে বিলাপ করো না। আমারও মনের অবস্থা ভালো নয়।

বিপুলের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই, কুমুদিনীর অদূরে বিলাপ আর একটু বাড়িয়া গেল। ইহাতে বিপুল উত্তেজিত না হইয়া,কুমুদিনী কে কোলে তুলিয়া কক্ষে প্রবেশ করিল। তাহাকে টেবিল সম্মুখে বসাইয়া বলিল,

- তুমি কি ভাবিয়াছ আমার কষ্ট হয় নাই। তোমার অনুপস্থিতি আমার সমস্ত মানসিকতার সীমারেখা লঙ্ঘন করিয়াছে। আজ আমাকে দেখিয়া তুমি কি কিছুই বুঝিতে পারিতেছ না।

কুমুদিনী কিছুটা শান্ত হইয়া, বলিল

- আমার খবর নাওনি কেন তাহলে?

- খবর নিয়নি! এটা তুমি ভাবিলে কি করিয়া। চরণ তোমায় কিছুই কি বলেনা?

- চরণ, কিছু বলতে যাবে কেন? সে তো আমাকে খুব ভয় পায়। 

- বাগান বাড়ি থেকে সমস্ত হিসাব পত্র দেখিয়া , আমি তোমার সাথে দেখা করার উদ্যেশ্যে; শেষ বিকালে প্রত্যহ চৌধুরীর মশায়ের বাগান বাড়িতে যায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি, তোমার মুখদর্শন কৰিব বলেই। কিন্তু তুমি আসোনা।

- চরন তো কোনদিনই আমাকে এসব কথা বলেনি। সে তো সব সময় আমার থেকে দূরে দূরে থাকে।

- প্রায়শই আমাকে সে এড়িয়ে যেতো। অপেক্ষারত অবস্থায় দেখিলে কোনো কোনো দিন লুকিয়ে যাইতো, আবার কোনো কোনো দিন সম্মুখে আসিয়া উপহাস ছলে হাসিতে হাসিতে বলিত,

- দাদাবাবু, কুঞ্জ দিদিকে কি ডাকিয়া দেবো?

- প্রতিনিয়ত আমি উপহাস তাহার বুঝিতে পারিতাম।তাই বলিতাম ডাকিতে হইবে না। তুই শুধু বলিয়া দিস, আমি আসিয়াছিলাম।কথা শেষ করিয়াও কিছুখন অপেক্ষা করতাম। তুমি আসছোনা দেখে প্রতিদিনের ন্যায় হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরতাম।


শব্দগুলো যে কুমুদিনীর হৃদয়ে কিভাবে আঘাত করছে তা যদি দেখাইবার মত হইতো তাহলে সে দেখাইয়া দিত।কান্না তাহার থামিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তার প্রিয়তম যে প্রতিদিন, তাহাকে এক মুহূর্তের জন্য দেখিবার; ও তাহার ব্যাকুলতার কথা শুনিয়া হতাশ হইয়া উঠিল।ভাবিতে লাগিল, যাকে তার পরম পূজনীয় পিতাশ্রী চারপায়ের শ্ব' বলিয়াও গণ্য করে না, যাহার প্রতিচ্ছবির ধারে কাছে এই প্রিয় মানুষটি যেতে পছন্দ করে না, সে নির্লজ্জ হইয়া; তাহার সমস্ত লজ্জা, ও ক্রোধের বিসর্জন দিয়া আমারই মুখখানি দেখিবার জন্য আসত আর আমি শুধু শুধু তাহার উপর অযথা রাগ করেছিলাম।


কুমুদিনী চেয়ার ছাড়িয়া , বিপুলকে জড়িয়ে ধরলো। ভালোবাসা নাকি আবেগ কিছুই বুঝে ওঠার আগেই, কুমুদিনী বলিল,


তুমি কেন আমার কাছে যাওনি? তুমি চরনের কাছে খবর নিতে পেরেছো আর আমার কাছে যেতে পারোনি?কেন যাওনি,,,


বিপুলের বুকে মাথা রেখে অনুরাগের সুরে প্রশ্নগুলো করেই ফেললো কুমুদিনী। বিপুলের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর অধরা। সে যে অতদূর পর্যন্তই যাইতে পারিত, আর সে যে এগুতে পারতো না। তাহা কুমুদিনী কে কিভাবে বোঝাইবে। তবুও তাহার মন শান্ত করিবার জন্য,,বলিল


- তুমি কি চাইতে তোমার পিতা তোমার চোখের সামনে আমাকে অপমানিত করুক?

নির্বোধ বালিকার মত ডান হস্ত মুষ্টি করিয়া বিপুলের হৃদয়ে আঘাত করিতে করিতে বলিল, 

- আমি জানিনা, দেখা করোনি কেন? আমার মনের কথা তুমি কেন ভাবোণি? তুমি জানো না আমি কি কষ্ট পাইতেছি। নিজের ঘর ছাড়িয়া কোনো মেয়েকে তার পিতার বাড়িতে থাকিতে হইলে কি পরিমান কষ্ট সহ্য করতে হয়।

বিপুল নিজেকে আর সংবরন করিতে পারিল না।কুমুদিনী কে দুই বহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। 

দুই হৃদয় ভালোবাসার বন্ধনে চরম তৃপ্তি লাভ করিল।কুমুদিনীর সমস্ত ক্রোধ, বিপুল এক লহমায় চূর্ণ করিয়া দিলো। বিপুল যেন সমস্ত বর্ষের যন্ত্রনার সমাপ্তি করিল। আবেগঘন মুহূর্তে কুমুদিনী ,বিপুলের হৃদয়ে বিলীন হয়ে গেল।দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া,

কুমুদিনী বলিল,

- রাত হইয়াছে আমাকে যাইতে হইবে।

বিপুল কোন উত্তর দিলো না।কুমুদিনী পুনরায় বলিল,

- আমাকে যাইতে হবে।

বিপুল সামান্য কৌতূহলে বলিল,

- যাইতে হইবে মানে?

- আমাকে সেই বাড়িতে যাইতে হইবে। আমি গোপনে আসিয়াছি।

- আজ রহিয়া যাও। কতদিন তোমাকে ভালো করিয়া দেখি নাই। আজ দেখিব।

- না তা সম্ভব হইবে না।তোমার দেখিবার ইচ্ছা হইলে তুমি সেখানে আসিতে পারো।

বিপুল এবার হতাশ হইয়া কুমুদিনী কে ছাড়িয়া টেবিল সম্মুখের চেয়ারটিতে বসিয়া পড়িল।ও বলিল,

- আমি তো প্রতিদিনই যেতাম কিন্তু তোমার দেখা তো আমি পাই নাই। নিজের সমস্ত লজ্জা বর্জন করে সেখানে আমি যেতাম, কিন্তু তোমার সাথে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হতো না। তাহলে সেখানে কি করে যাই বল।

- তুমি কেন বুঝতে পারছো না। বাড়িতে কাউকে না বলিয়া আসি আছি। গতকাল নৃপেন আসিয়াছিল কান্নাকাটি করছিল আমার কাছে। তাই আজ আরতি করতে আসিলাম ও ঘরের খবর নিতে এসেছিলাম।


একথা হইতে হইতে দরজার সম্মুখে কেউ একজন আসিয়া দাঁড়াইল। ইনি, রোহিনী দেবী কুমুদিনীর পিতার বাড়ির পাশেই বাড়ি। কুমুদিনী হইতে দুই এক বছরের বড় হইবে। সে কুমুদিনী কে খুব ভালোবাসে। প্রায়ই সে কুমুদিনী কে বলে; সে যেন তার বাড়িতে ফিরে যায়। কিন্তু কুমুদিনীর, বিপুল এর প্রতি রাগ ও চাটুজ্জে মশাযের স্নেহের প্রতি অনুরাগ, তাহাকে এ বাড়ীতে ফিরে আসতে বাধা দেয়। তাই আজ সে রোহিণীকে বলিয়া নিজের বাড়িতে ফিরে আসিয়াছিল। রোহিনী কে, কুমুদিনী বলিয়াছিল সময় হইলে সে যেন তাহাকে ডাকিয়া নিয়ে যায়। তাহাই রোহিনী আসিয়া তাহার কক্ষ সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে রোহিনী বলিল,

- কুমুদিনী, সময় হইয়াছে।  ইহা হইতে এবার যদি না যাও তাহলে ধরা পড়িয়া যাইবে।

রোহিনীর কথার উত্তরে বিপুল বলিল,

- তুমি বাড়ি চলিয়া যাও। আমি পৌঁছাইয়া দিয়া আসবো।

বিপুল বিহারীকে যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাকে রোহিনীদেবী। তাই তার কথার কোন উত্তর না দিয়াই উঠান ধরিয়া সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।


নিজের প্রিয়তম মানুষটিকে চোখের সামনে দেখিয়াও যেন যেন তাহাকে অনুভব করিতে হইতেছে। কুমুদিনী কে সে আটকাতে পারবে না, তবুও যতক্ষন চোখের সম্মুখে তাহাকে রাখিতে পারে সেই ভাবিয়া, কুমুদিনী কে বলিল

- কেন তুমি এরকম করছো। আজ যদি এখানে থাকিয়া যাও তাহলে কি হইবে।

- কি হইবে তুমি বুঝি বুঝতে পারছো না। যেমন আমাকে নিয়ে গেছে, তেমন করেই যেদিন; সেই বাড়ি থেকে পুনরায় দিয়ে যাবে সেদিনই আমি আবার ফিরে আসিব। নচেৎ আমাকে এখানে থাকার কথা বলো না।


কুমুদিনী এতক্ষন বিপুলের বৈঠকখানা, ভালো করিয়া লক্ষ্য করে নাই। বিপুলের সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে যখন ঘরের দিকে লক্ষ্য পড়লো, তখন কিছুটা বিরক্তিভাব প্রকাশ করিয়া বলিল,

- নিজের বৈঠকখানাটা পর্যন্ত পরিষ্কার রাখতে পারো নাই। চারিদিক সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছো।

কুমুদিনী চারদিকে এলোমেলো ভাবে ফেলিয়া রাখা বইগুলো ও বিছানাপত্র গোছগাছ করিতে লাগিল। শেষমেষ ঘরটা পরিষ্কার ও সুসজ্জিত করিয়া বলিল ,      - নৃপেন কে বলিও সে যেন এগুলো সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। আমার চোখে আর এসব যেন না পড়ে। যদি পড়ে থাকে তাহলে আমার থেকে ভয়ংকর আর কেউ হবে না।

ছোটখাটো এক রকমের শাসানি দিয়া দরজা সম্মুখে আসিয়া বলিল,

 - আমি আসছি

বিপুল চেয়ার হইতে উঠিয়া বলিল,

- এখনি না, আজ এখানে খাইয়া নাও, তারপর আমি তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসবো।

- আমি এখানে জ্বলস্পর্স পর্যন্ত করবো না।

- কি জন্য তুমি জ্বলস্পর্স করবে না শুনি? এ বাড়ি তোমার নিজের বাড়ি। এখানে তুমি জ্বলস্পর্স করবে না!


বিপুল কথাগুলি বেশ উগ্রভাবেই বলিল।কুমুদিনী বিপুলের কথার কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কেননা সে তো বিপুলের মুখে, এই কথাটির অপেক্ষাতেই ছিল। বিপুল নৃপেন কে হাঁক দিয়ে বলল,

- নৃপেন , ছোট মায়ের খাবারের ব্যবস্থা কর। 

নৃপেন অত্যন্ত খুশি হইয়া দূর হইতে উছস্বরে উত্তর দিলো।

- আমি জানতাম, আপনি বলিলে ছোট মা না করিতে পারিবে না। তাই সন্ধ্যা থেকেই খাবারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে ছিলাম। আমি সমস্ত কিছু তৈরি করিয়াছি। আপনি, ছোট মাকে নিয়ে আসুন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama