Goutam Nayak

Romance Tragedy Others

3  

Goutam Nayak

Romance Tragedy Others

প্রিয়তমা

প্রিয়তমা

12 mins
393


বিপুলবিহারী উঠানে দাঁড়াইয়া ধুতির কাছাটি মুঠোর মধ্যে ধরিয়া উচ্চস্বরে অত্যন্ত দ্রুত বলিলেন—

—আমি যদি আপনাকে, এই গ্রাম হইতে ভিটেছাড়া না করিতে পারি তো আমার নাম বিপুলবিহারি চাটার্জী নয়।


কথাটি শুনিয়া চৌধুরী মশায়, চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া ও দীর্ঘকায় পা সহযোগে কয়েকবার লাফাইয়া ঝাঁপাইয়া বলিলেন,— 

—তুই যদি বাপের ব্যাটা হোস; তাহলে আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে দেখাস।

বিপুল বিহারী পুনরায় উচ্চস্বরে বলিল,

—আমি আবারও বলছি, যদি তাড়াতে না পারি তাহলে আমি এই গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইব।

কথাটি শেষ হইবামাত্ৰই, হন হন করিয়া,চৌধুরী বাড়ির সম্মুখ হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

?

দুই চক্রবর্তীর যে দ্বন্দ্ব লাগিয়েছে; তাহার মজা নেওয়ার জন্য গ্রামের প্রায় সকলেই এসে হাজির হইয়াছিল। চৌধুরী মশায়ের লম্ফঝম্প ও বিপুলবিহারীর উগ্র অঙ্গীকার স্বীকারোক্তি, গ্রামের লোকজনদের বোধগম্য না হইলেও তাহারা যে অতীব মজা পাইতেছিলো,!.   তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই। কিছুক্ষণ সকলে অপেক্ষা করিল ঠিকই কিন্তু বিপুলবিহারীর চলিয়া যাওয়াতে সকলেই হতাশ হইয়া যে যাহার বাড়ি ফিরিয়া গেল।কারন বিপুলবিহারি থাকিলে, দ্বন্দ্ব আরো কিছুক্ষণ চলিত ও সকলেই তাহা খুব আনন্দের সহিত উপভোগ করিত।

অদূরে; বৃক্ষরূপী আমগাছটার তলায় যে, একজন নিশ্চুপ হইয়া সমস্ত কথাবার্তা শুনিল ও কিছুক্ষন নির্বিকারে সমস্ত কিছুই লক্ষ্য করিয়া চোখের জল মুছিতে মুছিতে চৌধুরী মশায়ের বাড়ির পিছনের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল তাহা ওই চক্রবর্তী দ্বয় কেউই লক্ষ্য করিলেন না। কিন্তু তিনিই যে এই সমস্ত দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ তাহা দুই চক্রবর্তী না বুঝিবার অভিনয় করিলেও গ্রামের লোকের বুঝিতে বাকি রহিল না। সামনে আসিলে বোধহয় সমস্যা আরো বাড়িয়ে যাইত। তাই দূরে ওই আমতলা থেকেই সমস্ত কিছু লক্ষ্য করিলেন।


বিপুরবিহারী প্রচণ্ড রাগিযা ছিলেন। ক্রোধ সংবরন করতে পারছিলেন না তাই দ্রুত বাড়ি অভিমুখে আসছিলেন। বাড়ির নিতান্ত সাদাসিধা ও মনভোলা কর্মচারী নৃপেন বারান্দা থেকে তাহা লক্ষ্য করিয়া দ্রুত নীচে নামিয়া    গেলেন,ও দরজা খুলিয়া অপেক্ষা করছিলেন। বিপুরবিহারী বাড়িতে ঢুকেই সোজা নিজের পড়াশোনার ঘরে চলে গেলেন। কয়েক মিনিট বাদে নৃপেন এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে বিপুলবিহারীর নিকট আসিয়া বলিলেন,

―ছোটবাবু এই নিন জলপান করুন।

―নৃপেন তুমি এক কাজ করো, আমায় এক খন্ড বরফ আনিয়া দাও।আজ মাথাটা প্রচন্ড গরম হইয়াছে।

―কেন বাবু? কি হইয়াছিল?

―কি আবার হইয়াছিল, ওই চৌধুরী! ওটাকে গ্রাম থেকে তাড়াইবা!?র প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসিয়াছি।

ক্রোধে বিপুরবিহারীর চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়াছিল।নৃপেনের সঙ্গে কথা বলিবার সময় কথাগুলি পরিষ্কার হচ্ছিল না।নৃপেন সব কিছু জানিত; যে কি হইয়াছে এবং এ সমস্যা যে প্রতিদিনের সহজে সমাধান হইবে না।

গ্রাম থেকে চৌধুরীকে তাড়ানো চাটুজ্জেদের যে এক মুহূর্তের ব্যাপার তাও সে জানিত। কিন্তু বিপুরবিহারীর ক্রোধ যে বিপদ ডাকিয়া আনিবে সেই কথা ভাবিয়া একদম নিশ্চুপ হইয়া রহিলেন। বিপুরবিহারীর জন্য একটি পাত্রে বরফ আনিয়া নৃপেন বলিল,

―ছোটবাবু; তাহলে আমি বড়ঠাকুরকে কি বলিব?

―না না, নৃপেন বলিও না। বড়ঠাকুরকে শুনাইলে ঝামেলা বাঁধিয়া যাইবে।

নৃপেন একটি হাতপাখা নিয়া ছোটবাবু কে বাতাস করেছিলেন।বিপুরবিহারী বরফের থলেটা মাথায় নিতে নিতে বলিল, 

―বড়ঠাকুর কোথায়?

―আপনি আসিবার আগে কোথায় বেরোলেন ।আমাকে বলে গেলেন না। জানতে চাওয়াতে, তিনি বললেন; আমি একটু ঘুরে আসি।

―সঙ্গে কেউ আছে না নেই?

―আছে বাবু। ফড়িং(বাগানবাড়ির রক্ষক) সঙ্গে আছে। 

―ঠিক আছে নৃপেন। তুমি এখন যাও।

নৃপেন, এই নিয়ে চাটুজ্জে বাড়িতে গত 25 বছর ধরে কাজ করে আসছে। সে এই বাড়ির শুধুই সেবক নয়, একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বটে। তবে মধুমতি(বিপুরবিহারীর মা) মারা যাবার পর তাহার উপর চাপটা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে গিয়েছে। মধুমতিকে দেওয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি সে পদে পদে পালন করে চলেছে।তবে কুমুদিনী কে সে কোনোমতে আটকে রাখতে পারল না। রান্না বাটার সময় তার কথা যে মুহূর্তে মুহূর্তে মনে পড়ে তা থেকে আজও বিরত হয় নাই।তাহার; রান্নাসালে কাজ করিতে করিতে কয়েকফোঁটা লবনামবু পড়িয়া গেল।


রান্নাসাল থেকে মনিলাল চাটুজ্জের ডাক শুনিয়া ধড়ফড় করিয়া নৃপেন বারান্দায় বেরিয়ে আসিল ও বলিল,

―বলুন বাবু,

―বিপুল, আসিয়াছে?

―আসিয়াছে বাবু। পড়ার ঘরে আছে। কিছু বলিতে হইবে?

―না কিছু বলিতে হইবে না। তুই আমার ঘরে একটু জল নিয়ে আই।

নৃপেন তৎক্ষণাৎ জল নিয়ে চাটুজ্জে মশায়ের কক্ষে এসে বলল,

―এই নিন বাবু।

চাটুজ্জে মশায় আরাম কেদারে হেলান দিতে দিতে বলল,

―আজ কি কিছু হইয়াছে?

―কিছুই তো হয়নি বাবু।

মনিলাল ,নৃপেনের দিকে একবার তাকিয়ে বোধহয় সত্যতা যাচাই করিয়া বলিলেন,

―বাগান বাড়ির দিকের থেকে আসার সময় আমাকে লক্ষ্য করিয়া' বড়ো কান্না কাটি করিতেছিল দেখলাম-

―কে বাবু?

মনিলাল, নৃপেন কে আর কোনো কথা না বলে শুধু মুখের দিকে একবার তাকাইলো ও ইশারায় বাড়ির বাইরে চলিয়া যাইবার আদেশ করিল।

নৃপেন বড় দুঃখের সহিত মনিলালের কক্ষ থেকে বাহির হইল।সে যে ভালো করিয়াই বুঝিতে পারিয়াছে; কে কাঁদিতেছিলো এবং কেনই বা কাঁদিতেছিলো। 

কিন্তু চাটুজ্জে মশায়ের সম্মুখে আর কিছু উত্তর করিবার সাহস তাহার নাই। ছোটবাবু হইলেও বা দু চারটে কথা বলা যাইত। অতঃপর তাহাকে ওখানেই প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব সমাপ্ত করিয়া রান্না সালে ফিরিতে হইলো।

নৃপেনকে এখন কয়েকদিন মুখে কুলুপ আঁটিয়া থাকিতে হইবে।কেননা ছোটবাবু যদি ঐ কান্নার কথা শুনিয়া ফেলে তাহলে লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়া যাইবে। তাহাকে এইবার আর কেহ আটকাইতে পারিবে না।ক্রোধ তার মাথায় একবার উঠিয়া গেলে রক্ষে নেই। ভয় এটাই বড়োঠাকুর যদি বলিয়া ফেলে তাহলেই গ্রামের লোক বুঝিতে পারিবে যে চাটুজ্জে আজ ক্ষেপিয়া গিয়াছে।এই সব ভাবিতে ভাবিতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেছে তাহা টের পাইনি নৃপেন। 

দুপুরের অন্ন গ্রহণের সময় হইয়াছে।বাড়িতে লোক বলতে ওই তিনজন পুরুষ মানুষ।নৃপেন; বড়ঠাকুর ও ছোটবাবুকে খায়িয়ে নিজে খাবার গ্রহণ করে। আজও সেইরকমই হইলো। অন্ন গ্রহনের সময় বড়ঠাকুর কথা বলে না সচরাচর। তবে আজ কি হইয়াছিল তা কে জানে। খাবার গ্রহণ করিতে করিতেই বলিলেন, 

- ঘরটা বেশ শূন্য শুন্য লাগছে। এত বড় ঘর শূন্য মানায় না।

বিপুরবিহারী, কোনো দিন বাবার উপর জোর করে কথা বলেননা, তাই তিনি অন্নগ্রহনেই বেশ ব্যস্ত ছিলেন।কথাটা শুনিয়াও যেন শুনিলেন না।বড়ঠাকুর এবার একটু জোর গলায় বলিলেন,

―বিপুল আজ তুমি খুবিই ব্যস্ত মনে হচ্ছে?

বিপুরবিহারী খাবার মুখে তুলতে যাইতেছিল , বড়ঠাকুরের আওয়াজে তা নামিয়ে রাখিয়া পরের প্রশ্নটির জন্য নিঃশ্চুপ ভাবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

―আজ কি হইয়াছিল? 

বিপুল নিঃশ্চুপ রহিলেন। খাবারের পাত্রে তাহার অঙ্গুলি বিচরণ যেন মনিলাল চাটুজ্জের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বলিয়া দিয়াছিল। তিনি বিপুলের এই ব্যবহার দেখিয়া আর কোনো প্রশ্ন করিলেন না।অন্ন গ্রহণের নির্দেশ দিয়া নিজেও সেদিকে মন সংযোগ করিলেন।

দুজনের অন্ন গ্রহণ শেষ হলে নৃপেন নিজের ভোজন শেষ করলো।বড়ঠাকুর দুপুরে বিশ্রাম নেন না। দুপুরে বিশ্রাম নিলে নাকি তার রাত্রিটা মাটি হইয়া T তিনি দুপুরে খামার বাড়ির সমস্ত হিসাবপত্র দেখেন। আজও যথারীতি তিনি তাই করলেন। নৃপেন বিশ্রাম উদ্দেশ্যে যখন নিজের কক্ষে যাইতেছিল, তখন লক্ষ্য করিলেন ছোট বাবু তাহার স্ব বিশ্রাম কক্ষে নেই।সচরাচর ছোটবাবু মধ্যাহ্নভোজনের পর বিশ্রাম নেন। অদ্য তাহাকে দেখিতে না পইয়া নৃপেন বেশ অস্থির হইয়া উঠিল।মনে মনে তাহার, কুমুদিনীর নিঃশব্দ লবনামবু বিয়োজনের খবর পাইয়া যাইবার শঙ্কা মুহুর্মুহু প্রতাড়িত করিতে লাগিল। তিনি হাতের জিনিস গুলি সেখানেই নামাইয়া রাখিয়া বাড়িময় খুঁজিতে লাগিলেন। বিপুরবিহারীকে খুঁজিয়া পাইলেন না।নৃপেন হতাশ হইয়া মেঝেতে বসিয়া পড়িলেন।কিছুক্ষন হতাশ হইয়া বসিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাতই বাগান বাড়ির কথা স্মরণ হইতেই সেদিকে ছুটিলেন।বাগান বাড়িতে আসিয়া: মালি, ফড়িং কে জিজ্ঞাসা করিলেন―

― ছোটবাবু আসিয়াছে?

―আসিয়াছে। তবে অদ্য ভীষণ উগ্র হইয়া আছেন। চক্ষু রক্তবর্ণ সম, ঘন ঘন নিঃস্বাস ফেলিতেছেন আর নিজেই বিড়বিড় করে কি যেন কইতেছেন। তাহা স্পষ্ট বোধগম্য হইনাই।

― তুই, বাবুকে জিজ্ঞাসতে পারলি নি।

―না , নৃপেন দা, চোখমুখ খান দেখে ভয় পাচ্ছিল। পাস থেকে শুনার চেষ্টা করছিলুম কিন্তু বুঝতে পারিনি। 

নৃপেন,নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলো,

-কি ঝামেলায় পড়লাম বলতো।এর যে কি বিহিত করি; বড় মা তুমিই একটা পথ দেখাও। এ বাড়িতে তুমি ছাড়া কেউ আমার কথা শোনে না। বড় বাবু একরকম আর ছোট বাবু আর একরকম।

নৃপেনের বিরবিড়ানি শুনে ফড়িং বললো,


―ওহ নৃপেন দা কি বিড়বিড় করছো? বলি ছোটকর্তাকে তোমার আসার খবর দেব?

― না, বলতে হবে না। জানতে চাইলে বলিস। আর ছোটবাবু যতক্ষন এখানে থাকবে ততক্ষন চোখে চোখে রাখিস তাকে।

― আচ্ছা ঠিক আছে।

কথাটি শেষ করিয়া নৃপেন নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে বাড়িতে ফিরিয়া আসিল। প্রদোস কাল হইতে আর সেরকম কিছু বিলম্ব নাই। ঠাকুরের আরতি করিবার কোনো বিলাসিনী বাড়িতে নেই। তাই নৃপেনকেই সব কিছুই করিতে হয়। আজও তাহাকে সেই একই পথনুসারান করে চলিতে হইবে। তাই সে চাটুজ্জে মশায়ের ঘরটা একবার ঘুরিয়া, ঈষৎ ভাবে চারিদিকটা লক্ষ্য করিয়া, সন্ধ্যা আরতির ব্যবস্থায় মত্ত হইয়া উঠিলেন। দশকর্মা কক্ষ হইতে বরনডালা লইয়া আরতি উদ্দেশ্যে যখন দ্বার কক্ষে পদার্পন করিল তখনই অকস্মাৎ চমকাইয়া উঠিলেন এবং প্রদীপ সহ তাহার আরতির থালাটি মাটিতে পড়িয়া গেল। নৃপেনের এমনিই ভাবমূর্তি হইয়াছিল যেন সে অকস্মাৎ কোন প্রেতাত্মা দেখিয়াছে। চক্ষু তাহার চড়কগাছ হইয়াছে যেন। হতভম্ব হইয়া কিছুক্ষন নির্বাক চিত্তে, হৃদয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ ও ভয় কাটাইয়া ক্ষীণ কণ্ঠে বলিল, 

- ‘ছোট মা’!

কথার উত্তর আসিল না। পুনরায় নৃপেন হতবাক চক্ষু ও নির্বাক চিত্তে হ্যাঁ করিয়া সব কিছু দেখিতে লাগিল।


ছোট মা ! ইনি অন্য কেউ নন, চাটুজ্জে বাড়ির একমাত্র গৃহবধূ।চাটুজ্জে আর চৌধুরী পরিবারের একমাত্র গৃহ কল্যানিনী। এত সুন্দর রূপ যেন সাক্ষাৎ কোনো দেবীকেও হার মানায়। দুই পরিবারের কোন্দল শুরু হয় তাহাকে নিয়েই। বিয়ের পর কিছুদিন শশুর বাড়িতেই ছিলেন। তারপর চৌধুরী মশায়, ভারত সরকারের পাস করা তাৎক্ষনিক বিবাহ সম্পর্কিত আইনের ফায়দা নিয়া বিপুলকে দূরে ঠেলিয়া দিলো।দেখিতে দেখিতে কয়েক দিনের মধ্যেই, সেই যে বড়মার শরীর ভাঙিয়া গেল ,তখন হইতে তিনি আর সুস্থ হইলেন না। বড্ড ভালবাসিয়া ফেলিয়া ছিলেন ‘ছোটমা’ কে।সব সময় চোখে চোখে রাখিতেন। কোনো কাজ করিতে দিতেন না। পাশে বসিয়ে গল্প শোনাতেন ও শুনতেন, আর বড় আদরের সহিত বলিতেন-

-মা’ এবার তুই সব কিছু দায়িত্ব নিয়ে নে। আমার আর ভালো লাগছে না। তোর হাতে সব তুলে দিয়ে আমি একটু আরামে থাকতে চাই।

আর তখনই ছোটমা, কিঞ্চিৎ বড়মার গলা জড়িয়ে ধরে বলত-

- মা, আমি তো এখন দায়িত্ব নিতে চাইনা। কেন আমায় জোর করিতেছ। আমি দায়িত্ব নেব না।


কথাগুলি শেষ করিয়া পা দাপাইয়া দাপাইয়া, গুরু গম্ভীর ভাব দেখাইয়া চলিয়া যাইত।বড্ড আদুরে ছিল; এই ছোট মা বড় মার কাছে।তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করিতাম কাজের কোনই ভুল হইলেই, তাহাকে সামলানো দূর্দায় ব্যাপার হইয়া যাইতো। জানিনা ছোট মার এটা কিরুপ চরিত্র ছিল। ভুল কোনমতে সে সহ্য করিতে পারিত না। চেচামেচি শুরু করিয়া দিত। বড়মা যেমন তাহাকে ভালোবাসিতো; ঠিক সেই রকমই তাহাকে ভয়ও করিতো। ছোটমা চেঁচামেচি শুরু করিলেই বড়মা একেবারে নিশ্চুপ হইয়া থাকিতো। আবার ছোট বাবু বাড়িতে আসিবার পূর্বেই ছোটমাকে যেমন করিয়া হোক শান্ত করিতে হইত। নতুবা সে আবার লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দেবে। তাই বড়মা ছোটমাকে নানারকম প্রলোভন দেখাতো। যখন প্রলোভনে কাজ হতো না তখনই বড়মা ঈষৎ ভৎসনা পূর্ব বলিতো আমি আর সংসারের দায়িত্ব নিতে পারিবো না । যে যার সংসার সে তার বুঝিয়া লইবে। আর তখনই ছোটমা একদম শান্ত হইয়া পড়িতো। কেন জানিনা ,ছোটমা সংসারের দায়িত্ব হইতে সবসময় দূরেই থাকিত। 

আর আজকাল , সেই ছোটমাকে নিয়েই দুই পরিবারে কোন্দল শুরু হইয়াছে। ভালোবাসার অর্থ কি কিভাবে যে বোঝাইব এদের তাহার কোনো কিনারায় পাচ্ছি না।


- নৃপেন, কি এত ভাবিতেছ? আমাকে দেখিয়া একেবারে হ্যাঁ হইয়া গেলে যে? 

নৃপেন ধড়ফড়িয়ে উঠিবার চেষ্টা করিল। ছোটমা আরতি করিবার পোশাক বদলাইয়া ছিল। তাই নৃপেন কে উঠিতে সাহায্য করিতে পারিল না। নৃপেন এমন ভাবে পড়িয়া গিয়েছিল, যে তার লাগিযাচ্ছে; তাহা স্পষ্ট বোঝা যাইতেছিল। কষ্ট হইলেও সে উঠিয়া বলিল, 

- আরতির থালা পড়িয়া গেল। আমি আবার সজিয়া নিয়ে আসি। 

-না নৃপেন অনিতে হইবে না। আমি সাজিয়ে নিয়েছি। তুমি এখানেই বসো। 

ছোট মা,আজ অনেকদিন বাদে আরতির ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। নম্র হস্তে প্রদীপ জ্বালিয়ে, গৃহদেবতার আরতি শুরু করিলেন। আজ গৃহদেবতা গন বড্ড খুশি হইয়াছে বোধহয়। ঘরময় আলোয় জ্বলজ্বল করিতেছে। সবকিছু যেন নুতন নুতন লাগিতেছে , বাড়িতে যেন একটা খুশির সুভাষ পাওয়া যাইতেচ্ছে। আজ বাড়ির গৃহিণী ফিরিয়া আসিয়াছে।

ছোটবাবু , বাড়ি ফিরিয়াছে। তাহার রাগ এখনো অবধি কমেনাই। বাড়িতে প্রবেশ করিয়া, নৃপেনকে হাঁক দিতে যাইবে এমন সময় তাহার সমগ্র চিত্ত অন্য ধারা বহিয়া যাইল। সে মনে মনে বলিতে লাগিল,আজ বাড়িময় কেমন অন্য রকম লাগিতেছে। অন্যদিনের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। সুগন্ধির গন্ধে মন ভরে উঠছে তাহার। এই সুগন্ধি তো নৃপেন ব্যবহার করেনা। তাছাড়া অন্যদিন নৃপেন আরতির সময় তো এত মোহময় মুহূর্তের স্মৃষ্টি হয় না। 

ছোটবাবু কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। আজ কি তাহলে কেউ আসিয়াছেন? যে সুগন্ধির গন্ধ সে পাচ্ছে এই সুগন্ধি তো শুধুমাত্র একজনই ব্যবহার করিত। সে ছাড়া বাড়িতে অন্য কেউ এটা ব্যবহার করিতে পারিতো না। ব্যবহার করলে একদম হুলস্থুল পড়িয়া যাইতো। তাই বিপুল নিজের কক্ষে না গিয়ে গৃহদেবতার কক্ষের সামনের বারান্দায় আসিয়া হাজির হইলো। বিপুল অবাক হইয়া গেল, অদ্ভুত ব্যাপার আজ নৃপেন আরতি করিতেছে না। গৃহদেবতার কক্ষদারের সম্মুখে জোড়হাত করিয়া ধ্যানে মগ্ন হইয়াছে। কৌতূহল বাড়িয়া গেল। তাহলে আরতি কে করিতেছে ? নিঃশব্দে নৃপেনের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল বিপুল। 

দেবতা উদ্যেশ্যে লক্ষ্য করিয়া একদম চক্ষুস্থির হইয়া গেল, এ যে কুমুদিনী! 

বিপুল বিহারীর মাথায় একদম বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, বিভিন্ন রকম প্রশ্ন ও কৌতূহলে তিনি জর্জরিত হইয়া গেলেন। নিজেকে বারবার বলিতে লাগিলেন, এইবার ঐ ভীমরতিধারী চৌধুরীকে গ্রামছাড়া করিব। কার বাবার সাধ্যি আছে আমাকে আটকাইয়া দেয়। ভাবিতে ভাবিতে সে গৃহদেবতার কক্ষ সম্মুখ হইতে নিজ পঠন কক্ষে আসিয়া বসিলেন।


মিনিট পনেরো পরে ছোট মার আরতি সমাপ্ত হইলো। সে ঠাকুর প্রণাম শেষ করিয়া নৃপেন কে প্রণামের সম্মতি জানিয়ে ধুনোচি নিয়ে প্রস্তুত হলো। আজ থেকে প্রায় এক বছর সে এই গৃহ অভিমুখ করে নাই। তাই, সারা বাড়িতে ধুনোর ধোঁয়া দেবার প্রয়োজনে, ডান হস্তে ধুনোচি ও বামহস্তে ঘন্টা নিয়ে বের হলেন। নৃপেন প্রণাম শেষ করে ছোট মায়ের পিছু পিছু চলতে লাগিলেন ।

নৃপেন আজ ছোট মাকে কাছে পাইয়া সবকিছু ভুলিয়া গিয়াছে। তাহার খেয়ালই নেই ছোট বাবু ফিরেছে কিনা, বড়বাবু কি করিতেছে। তাহার টিফিনের জন্য কি করিতে হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সম্পূর্ণ বাড়িটা ধুনোচি ঘুরিয়া শেষ করিতে আধা ঘণ্টা লাগিয়া গেল। গৃহদেবতার কক্ষে সমস্ত কিছু গোছগাছ করিয়া ও আরো কয়েকদিনের জন্য একই রকম ভাবে ধুনোচি ঘোরানোর ব্যবস্থা করিয়া দিয়া কক্ষদার বন্ধ করিয়া বারান্দায় আসিয়া ছোট মা দাঁড়াইলেন। নৃপেন আবার গদগদ স্বরে বলিল,

 ছোট মা, আপনি আপনার কক্ষে গিয়ে শয়ন করুন আমি আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি।

বড় আদরের সহিত কুমুদিনী, নৃপেনের দিকে তাকিয়ে বলিল,

- না , আমি খাবোনা । আমার জন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি দেখিবে "ইহাদের" জন্য আমি যেন না চিন্তায় পড়ি। তুমি যাও , তোমার ছোটবাবু বাড়িতে আসিয়াছে।

- ছোটবাবু! আসিয়াছে? কই আমাকে তো আজ ডাকিলো না। খাবারের কোথাও বলিল না। 

-হ্যাঁ, সে অনেক্ষন আসিয়াছে। তার পড়ার কক্ষে আছে। বাতি জ্বলিয়েছে । তুমি যাও তাহার খাবারের ব্যবস্থা করো।

নৃপেন, বেশ চিন্তিত ভাবেই বলিলো,

- আজ ছোট বাবু প্রচন্ড রাগিয়া আছে। তাহার রাগ বোধহয় এখনো পড়ে নাই। তাই মনে হয় আমাকে ডাকেনি।

- তুমি যাও , তিনি আর রাগিয়া নেই। শান্ত হইয়াছেন। 

-ছোট মা, আপনি কি করে বুঝিলেন ছোট বাবু আসিয়াছে ও শান্ত হইয়াছে?

- আরতির সময় ,তুমি যখন ধ্যানে খুব মগ্ন তখন তিনি আসিয়াছিলেন। তোমাকে ধ্যানে মগ্ন দেখিয়া তিনি নিচে নামিয়া গেছেন।

- ছোট বাবু এখানে আসিয়াছিলেন? 

- হ্যাঁ , আসিয়াছিলেন।

-আপনাকে দেখেছে? ছোট মা!

-তা জানিনা,তিনি আসিয়াছিলেন এটা আমি লক্ষ্য করিয়াছিলাম।

নৃপেন , আবার বড্ড খুশি হইয়া নীচে নামিতে নামিতে ছোট মা কে বলিল,

- ছোট মা আপনি হয় রান্না সালে আসুন নয়তো আপনার কক্ষে যান । আমি আসছি। অনেক কথা জমিয়ে রেখেছি আপনার জন্য।

বিদ্যুৎ বাতির ঈষৎ আলোতে ছোট মায়ের মৃদু হাসি দেখে নৃপেনের চিত্ত নৃত্য বেশ খানিকটা বাড়িয়া গেল ও দ্রুত নীচে নামিয়া গেল।


নৃপেন, নামিয়া যাইতেই, কুমুদিনী তাহার সুসজ্জিত পোশাকে ,শয়ন কক্ষের দিকে আসিল। কক্ষে তালা লাগানো রহিয়াছে।এমনিতেও এই ঘরের দিকে কেউ আসতো না। বড়ো মা মাঝে মধ্যে আসতো যখন ছোট মা রাগ করতো।এখন তো তালা ঝুলছে, ছোট বাবুও আসেনা। সামনে আসিয়া কুমুদিনীর চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। তালা বন্ধ থাকিলে চাবি কোথায় থাকিত তাহা সে জানিত। সেখান হইতে চাবি উঠাইয়া চাবি খুলিল,দরজা খুলিতেই কেমন একটা গন্ধ বেরিয়ে এলো। আজ প্রায়, এক বছর কুমুদিনী এই বাড়িতে আসে নাই। কোনো কক্ষ বহুদিন ব্যবহার না হইলে যা হয় তাহাই হইয়াছে।ভিতরে প্রবেশ করিয়া বাতি জ্বালাতেই তাহার চক্ষু চড়কগাছ হইলো। যেমন অবস্থায় বাড়ি ছাড়িয়া গিয়েছিল সেইরকমই রহিয়াছে। কেউ গোছ পর্যন্ত করিতে আসেনায়। বাড়ির লোকের অগোছালো ভঙ্গিভাঙ্গায় কিছুটা বিরক্ত হইয়া নিজেই গোছগাছ ও পরিষ্কার করিতে লাগিল। সমস্ত কিছু গোছ করিতে তাহার প্রায় এক ঘন্টা লাগিয়া গেল।


নৃপেন নীচে নামিয়া আসিয়া, ছোট বাবুর পড়ার ঘরে উপস্থিত হইলো।ছোট বাবু বই নিয়া বসিয়া ছিলেন ও কিছু ভাবিতেছিলেন। নৃপেন তাহার সম্মুখে আসিয়া গদ গদ কণ্ঠে বড় উৎফুলতার সহিত বলিল,

- ছোটবাবু, আজ ছোটমা আসিয়াছে।

ছোটবাবু নৃপেনের দিকে একবার তাকিয়ে টেবিলে বইটি নামিয়ে বলিল,

- দেখিয়াছি,, তুমি তখন পূজাপাঠে মগ্ন ছিলে।

- হা বাবু,। আর বলি ছোটমাকে ডেকে দেব ?

- সে এখন কি করছে?

- তাকে শয়ন কক্ষে বসতে বলে আমি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে এসেছি।

ঠিক আছে তুমি এখন যাও। তাহার খাবার ব্যবস্থা করিও।

আর আপনার জন্য কি নিয়ে আসবো?

-কিছু আনিতে হইবে না। আমার আজ সেরকম কোনো ক্ষিধা নেই।

নৃপেন আজ বড্ড অবাক হইয়া গেল,,,ছোট বাবু তো কোনোদিন এরকম করে বলে নাই,,হইলো টা কি তাহলে তাহার।কিছুক্ষণ ঐখানেই অপেক্ষা করিয়া নৃপেন রান্নাসালে ফিরিয়া আসিলো। এক গ্লাস শরবত, চা ও কিছু পাঁপড় নিয়ে ছোট মায়ের উদ্যেশ্যে উপরে উঠিয়া গেল।

তখনকে ছোট মা সম্পুর্ন ঘর একদম গোছগাছ করিয়া সমস্ত কিছু সু সজ্জিত করিয়াছে।নৃপেন ছোটমার ঘরের সামনে আসিয়া সজ্জিত গৃহ দেখিয়া অবাক হইয়া গেল।ছোট মার কক্ষের সামনে রাখা টেবিলে খাবার রাখিয়া ,তাহার উদ্যেশ্যে ডাকিলেন,

-ছোট মা,,

- এসো, টিফিন অনিয়াছি। 


কুমুদিনী, কক্ষ হইতে বাহির হইয়া চিৎকার করে বলিল, 

-নৃপেন, আমি এখানের জলস্পর্সও করিব না।বলেছি তো তোমাকে এর আগেও।


টেবিলের সামনে দাঁড়াইয়া নৃপেন হা করিয়া রহিয়া গেল। সে একথা বুঝিতেই পারিলো না কেন সে সামান্য টিফিন টুকু না খাইবার জন্য চিৎকার করিয়া বলিল।নৃপেন তো বধির নহে। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance