Goutam Nayak

Romance Tragedy Thriller

3  

Goutam Nayak

Romance Tragedy Thriller

প্রিয়ংবদা

প্রিয়ংবদা

12 mins
261


শতাব্দীর’ শত ধারায় পরিবর্তন শীলতা না আসিলে তাহা অতীব ক্রুর রূপ ধরিয়া, বর্তমানে ভ্রুকুটি নৃত্য নেত্রপাত করিয়া আতঙ্ক অতীব বাড়িয়া দেয় । আপন আত্মসম্মান বোধের সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিতে হউক তাহাতে কোনোই প্রতিবন্ধকতা নেই । ইহার পশ্চাদপৃষ্ঠে আগুন জ্বলাইয়া দিলেও, স্বীয় সৃজনকারিণী কেউ পণ্যবীথীতে বেচিয়া সদর্পে গৃহ প্রবেশ করিবে। এরূপ প্রাচীনপন্থীর সম্মুখে শ্রী দুর্গার অভ্যুত্থান, নিশ্চিত রূপে কলঙ্কিত করিয়া তুলে । দায়বদ্ধতার সুযোগ লইয়া, সীমালঙ্ঘন করিলে , হৃদয়ের ঘৃণিত রূপ সর্ব সম্মুখে আসিয়া পড়ে । তথাপি মন ও হৃদয় তাহার নির্লজ্জ ও কলুষিত । কি করিয়া তিনি বুঝিবেন, সমাজ তাহাকে দূরে ঠেলিতেছে । অভ্যন্তরীণ এরূপ চেহারা লইয়া জনৈক চন্ড মন্ডলী প্রকট হইয়াছিল বাংলার নিতান্ত গ্রামে । ইহাদের সংযোগ এতটাই সুদৃঢ় ছিল যে তাহা কেহ বিন্দুমাত্র ধারণা করিতে পারে নাই । তাহাদেরই রসালো জালে পা আটকাইয়া ফেলিয়াছে প্রনামি ।


 


ভালোবাসার মেলবন্ধন যে কি তাহা জানিতে আর বেশি দেরি ছিল না, ছোট থেকে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা প্রনামীর। রূপ তাহার যেমনই হউক গুনে সে যে সকলকে হার মানায় তা তাহার ভাষায় প্রকাশ পায় । পূর্বপুরুষ প্রাপ্ত এই গুন শুধুই তাহার সম্পদ ছিল না, তাহার রূপও সকলের লোলুপ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতো । 


 


ভাষার চাঁদ যেন ধরাতলে নামিয়া আসিয়াছে । কখনো কখনো, তুলনায় চাঁদ লজ্জায় তাহার বদন ফিরিয়া নেয় । কথায় তো রহিয়াছে ,, যাহাকে আমি রূপ ও গুন দিয়াছি, তাহার কলঙ্ক তো রাখিবোই, না হইলে ইন্দ্র যে আমায় বিশ্বাসঘাতক বলিবে । সবই সহ্য করিব কিন্তু বিশ্বাসঘাতক বলিলে, কাহাকেও শান্তিতে থাকিতে দেবো না। সবকিছু কে মিলিয়ে গন্ডগোল বাঁধিয়ে দেবো। ইহাই করিল দেবাদিদেব। প্রনামীর জীবন লন্ডভন্ড করিয়া দিলো।


 


সে কি করিয়া বুঝিবে ভালোবাসার যন্ত্রনা হইতে পারে। সমস্ত কিছুই নিপুনতার সহিত করিলেও কিছু না কিছু ঘাটতি সবশেষে রয়েই যায়। তা বর্তমানে মুহুর্মুহু তার হৃদয়ে আঘাত হানিতেছে। প্রনামি তাহার সমস্ত গোপন কথা গোপনই রাখিয়া এগিয়ে যাইবার বহু চেষ্টা করিয়াছিল। 

কিন্তু অদৃষ্ট যা লিখিয়াছেন তাহা কি করিয়া পরিবর্তন করিবে। কিছুটা সাহস একদা সে একবার জুগিয়েছিলো কিন্তু সে হেরে গিয়েছিল যখন তাহার পিতা শিবপ্রসাদ কে খর্পর বলিয়া সর্বসম্মুখে কলঙ্কিত করিয়াছিল। সেদিনই শেষ করিয়াছিলো,অদৃষ্টের কাছে করজোড়ে নিবেদন করিয়া মৃত্যু ভিক্ষা চাওয়ার। প্রনামি এতটাই ক্ষিপ্ত হইয়াছিল যে মুহূর্তের মধ্যেই সে তাহার সমস্ত সম্পর্কের ইতি টানিয়া ও সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া প্রিয়ভুমি ছাড়িয়া আসিয়াছিলো।


জীবন তরঙ্গের কালিমালিপ্ত অধ্যায় বর্তমান সময়ে  মানুষটিকে জরাজীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে ঠিকিই কিন্তু অতীত যেন তাহার পিছু ছাড়ছে না। 


পূর্বা তাহাই বলিয়া মাথা হেঁট করিল। খাদ্যপদে একমুষ্টি মুড়ির মধ্যে অঙ্গুলিসর্ব বিকৃতপুর্ব বিচরণ করিতে লাগিল। মনের মধ্যে তাহার যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হইয়াছিল তাহারই ফলস্বরূপ কয়েক ফোঁটা লবনামবু খাদ্য পদে পড়িয়া মিশিয়া গেল। মুহূর্তের নিস্তবতা অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর জানিতে চাহিল আমার নিকট। উত্তর ছিল না, গন্ডদেশে মুষ্টি স্পর্শ করে নির্বাক চিত্তে তাহারই মুখমন্ডল পানে চাহিয়া ছিলাম।


 


 


মনুষ্য নামক উন্নত প্রজাতি কি বিভীষিকা ময় জীবন যাপন করিয়া থাকে তা আদতেও জানতাম না। অদ্য যখন জানিলাম তখন সমস্ত মনুষ্য সমাজ কেন, নিজেকেও বড্ড স্বার্থপর বলিয়া মনে হইলো। জগতের সকল প্রাণীকূলকেই বোধহয় অদৃষ্ট সবকিছুই দিয়াছে কিন্তু তাহার সহিত এই মনুষ্য কুলকে একটি সাজাও দিয়াছে। তাহাদেরকে ধন দৌলত বাড়ি গাড়ি সমস্তই দিয়াছে কিন্তু কাহাকেও সুখ দেয় নাই। তা থেকে সকলকেই বঞ্চিত রাখিয়াছে।


পূর্বার মুখ হইতে এই সব শুনিয়া নিজের মুখে কুলুপ আটলাম। কেননা তাহার কষ্টের কাছে আমার যন্ত্রনা একদম ফিকে হইয়া যায়।


তাহার বাড়ির প্রতি আমার অতীব আনাগোনা ও তাহার প্রতি সহানুভূতি বড্ড বাড়িয়া গিয়েছে। পূর্বাও সুখে নেই একদা একথা শ্রবণ করিবার পশ্চাৎ বড্ড দুঃখ পাইয়াছি। নিত্য দিন তাহার সহিত বাক্যালাপ করিবার চেষ্টা করি কিন্তু তাহা হইয়া উঠে নাই। সকাল হইতে সন্ধ্যা অবধি অতীব ব্যস্ত হইয়া ,সমস্ত রকম ক্রিয়াকর্ম অত্যন্ত নিপুনতার সাথে করিতে থাকে। ব্যস্ততা অদ্য তাহার জীবনের অর্ধাঙ্গ হইয়াছে। 


পূর্বা , শিবপ্রসাদের দ্বিতীয় কন্যা। তাহারও বিবাহ একপ্রকার অনিচ্ছা স্বত্বেও হইয়াছে। তাহাকে ও তাহার জীবন সঙ্গীকে দেখিলে যে কেউ বলিবে যে ইহারা ভালোবাসার বেড়াজালে আবদ্ভিত হইয়াছিল ও আজও তাহাদের ভালোবাসা সুদৃঢ় ভাবেই বর্তমান। কিন্তু তাহা অলীক।নিছক দ্বিবাস্বপ্ন বলিলেই ফুরাইয়া যায়।


আমার সহিত তাহার গল্প বেশ জমিয়া ওঠে। তাহার দিকে লক্ষ্য করিলেই বুঝিতে পারা যায় তাহার অত্যন্ত খুশি হওয়া মুখমন্ডল।তাহার মুখ থেকে যখন তাহার সমস্ত দুঃখ ও যন্ত্রণার কথা শুনতাম তখন মনে মনে প্রশ্ন করতাম, ইহাই কি তাহার কর্মফল নাকি তাহার পিতামাতার পাপের ফল।গীতাতে উল্লিখিত রহিয়াছে, “যে পাপ করিয়া থাকে তাহাকে পাপের ফল ভোগ করিতে হইবে । তাহা এক জন্মে না হইলে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ জন দের ভোগ করিতে হইবে। এড়িয়ে দেবার উপায় নেই। ভোগ করিতে হইবে”।


এ বাক্য শুনিলে হয়তো পূর্বা মনে মনে অতীব কষ্ট পাইবে কিন্তু তা চিরসত্য। এরূপ কথায় দুঃখ করিবার কিছুই নেই, মানিয়া লইতে হইবে।


বারান্দায় বসিয়া পূর্বার নানা কথা ও নানান দুঃখে মনের অবস্থার অবনতির কথা ভাবছি এমন সময়, পাশে রাখা অত্যাধুনিক গ্যাজেটে একটি বার্তা আসিল। সেদিকে সেরকম মন ছিল না,ভাবনায় বিভোর হইয়া চিবুকদ্বয় মুষ্ঠি ব্ধধ করিয়াছিলাম।দু তিনবার বোধহয় ঘন্টি বাজিয়াছিলো। আর খেয়াল নেই। তারপরই উছস্বরে রিং বাজিয়ে উঠিল। ভাবনায় বিভোর আমি বেশ খানিকটা অন্যমনস্ক হয়েই পড়লাম। ফোনের দিকে লক্ষ্য করিয়া বুঝিলাম অদ্য আর নিজেকে বাঁচানো যাইবে না। ফোন আসিয়াছে।ফোন উঠাইতে দেরি হইয়াছে, যুক্তিপূর্ণ দুচার কথা ঝাড়িয়া দেবে।দুবার পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর বাজিলো।রাগ নেই, তবে তার কথাবার্তার সরলতা নেই, বড্ড জটিল করিয়া বলে, বুঝিয়া উঠিতে বেশ দেরি হয়।তবুও তার সহিত বাক্যালাপ করিতে আমার বড্ড ভালো লাগে। তাহার দৃষ্টি ও ভাষা জটিল হউক কিন্তু মন অতীব মোলায়েম। তাহার ভাষায় বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সে তাহার মনকে অতীব ভালোবাসে। শিবপ্রসাদের এই তৃতীয় কন্যা ‘প্রস্তুতি’ আমার মনের অভ্যন্তরে যে প্রথম দেখাতেই বেশ খানিকটা জায়গা করে নিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


আবার তৃতীয়বার ফোনের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। ফোন না উঠাইবার উপায় নেই। অতঃপর উঠাইলাম,


-  মন কি খুবিই খারাপ হইয়াছে যে আমার সহিত ব্যক্যালাপ করিতে দ্বিধাবোধ হয়?


আমি জানতাম, সে এইভাবেই কথা বলিবে, আমি বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ছিলাম। সে বোধহয় আমার অভিপ্রায় বুঝিয়েছিলো।তাই সেও কোনো ব্যক্যালাপ করেনি।অধীর আগ্রহে আমার উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। নম্র ভাষাতে উত্তর দিলাম,


-  পূর্বার ক্ষোভ আর প্রনামীর পরিণতির সমাধান খুজছিলাম।তাই তোমার ফোন উঠাইতে বেশ দেরি হইলো।


-  তুমি ওদের পরিণতির সমাধান খুঁজছো ? মিথ্যা বলিবার আর জায়গা পাওনি তো। তাই আমাকে যায় হোক বুঝিয়ে দিচ্ছ।


কিছুটা ঝাঁজালো হইলেও, আমার নীরবতা তাহার উগ্রতার যে বারোটা বাজিয়ে দেয় তাহা তার কথার চাটুকারিতাতেই বোঝা যায়। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত ধ্বনির পরিবর্তন তাহা স্পষ্ট করিয়া তোলে।  


তাহার ও আমার মধ্যে অতীব সমস্যা হইয়া ছিল , তাহা ছিল নীরবতা। ইহা যে সমস্যা বলিব নাকি মনের দৃঢ়তা বলিব তাহাই বুঝিতে পারি নাই। কোথায় আছে, “নীরবতা কথা বলে যখন শব্দ নিজের থেকে চুপ হয়ে যায়”। তাহাই ঘটিয়াছে।বহুক্ষণ ধরে আমার উত্তরের অপেক্ষা করিবার পরও কোনো উত্তর না পাইয়া সে ফোন রাখিল।


স্নাতকের পড়া শেষ করিয়া বাড়ির বিভিন্ন রকম কাজের দায়িত্বে বেশ মনোযোগ করিয়া ফেলিয়াছিলাম। একদিন সকালে বারান্দায় বসিয়া খামারবাড়ির নানারকম হিসাবপত্র দেখিতেছি এমন সময় একটি বার্তা আসিলো। বার্তাটি এইরকম ছিল,


 


    স্যার আমি পুর্বা বলতেছি। আমি কিছুদিন পূর্বে আপনার বিষয়ে বেশ ভালো মন্তব্য শুনিয়াছি। তাহার কারন অতীব খুশি হইয়া, আমার একটি উপকার করিবেন সেই আশায়, আপনার সাথে যোগাযোগ করিলাম। আমি শুনিয়াছি আপনি শিক্ষা প্রদান করেন ও একজন শিক্ষক। আপনি যদি, আমার পুত্রকে কিছুটা শিক্ষা দিয়া তাহার মূঢ়তা কিয়ৎ দূর করিয়া দেন তাহলে বেশ উপকৃত হই। ছেলেটি বড্ড বাউন্ডুলে হইয়াছে। পড়াশোনায় মন নেই। যদিও বা পড়াশোনা করে সব কিছু ঠিকঠাক বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। তাহাই আপনার সাহায্য চাই।


আসা করি আপনি কথা রাখিবেন। 


বার্তার উত্তর দিতে বেশ কিছুদিন লাগিয়াছিল। পূর্বা আমায় গৃহ শিক্ষক হিবাসে চাইছিলেন। পূর্বার বাড়ি আমার বাড়ি হইতে বেশ অনেকটাই দূরে হওয়ায় আমি তাহার বার্তার উত্তর দিতে চাইছিলাম না। কিন্তু তাহার অতীব প্রিয় এক আত্মীয়, বারংবার আমায় বলিতেছিলো । আমি তাহার কথা এড়াইতে পারি নাই। অতঃপর তাহার কথা আমাকে রাখিতে হইয়াছিল। 


সম্ভ্রান্ত পরিবার, বহু লোকজনের সমাগম হইতে থাকে প্রতিনিয়ত। এত লোকজনের মধ্যে যে শিক্ষার প্রভাব যথেষ্ট ছিল, সকলের মনে; তা বড্ড ভালো লাগিয়াছিলো। একবিংশ শতকে এরকম বহু পরিবার রইয়াছে যাহারা পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া পছন্দ করেন না।ইহাদের পরিবারের প্রাচীন পন্থী মনভাবের বেশ খানিকটাই পরিবর্তন লক্ষ্য করিয়াছিলাম। তাহাই পাঠ্যদানে আমার মনঃসংযোগ অতীব বাড়িয়া তুলিয়াছিলো।


আলাপ আলোচনার মধ্যে কয়েক দিন অতিক্রান্ত হইয়া যাইবার পর জানিতে পারি; পূর্বার অতীত মোটেই ভালো নয়। তাহার নিকট হইতে তাহার অতীত যখন জানিতে চাহিয়াছিলাম, সে প্রথমবার আমাকে দূরে রাখিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু পরে পরে সে স্ব ইচ্ছায় তাহার অতীত তুলিয়া ধরিয়াছিলো।


 


মায়াজালে আবদ্ধ তাহার দিদির গ্রামীণ জীবন তিল তিল করিয়া কিরূপে শেষ হইয়া যাইতেছে ও নিজের জীবন; কিভাবে অন্ধকারে ডুবিয়া যাইতেছে,তাহা শুনিয়া আমার মনের অস্থিরতা অতীব বাড়িয়া গিয়েছিলো।

আমার জন্মলগ্ন হইতে জ্ঞান অর্জন পর্যন্ত বেশ কয়েকটা বছর বদ্ধ ভাবেই কাটিয়াছে। এই বৈচিত্র্যময় জীবন ও রঙিন পৃথিবীতে এত কষ্ট বিরাজমান তাহা আমার অজানাই ছিল। 

আমি যেমন বুঝিতে পরিয়াছি সেরকমই পূর্বাও বুঝিতে পারিতেছে, আমাদের এই বৈচিত্র্যময় জীবন যতটা বৈচিত্র্যময় ভাবিয়া থাকি বাস্তবে তাহা কিন্তু মোটেও নহে। বহিরাকৃতি দেখিয়া যেমন সৌন্দর্য বোঝা যায় তেমনি অন্তরকে অনুভব করিলে সৌন্দর্যের আড়ালে কতটা কষ্ট ও কতটা দুঃখ বিরাজমান তাহাও বোঝা যায়। সেইরকমিই ঘটিয়াছিল পূর্বার ও প্রণামীর জীবনে।


গৃহশিক্ষক হিসাবে তাহাদের বাড়িতে আমি যে ভালোবাসা পাইয়াছিলাম, তাহা আমার নিমিত্ত চির স্মরণীয়।শিক্ষাদান কতটা করিয়াছি বা তাহা আমার ছাত্রটি কতটা লইতে পারিয়াছে তাহা সঠিক বলিতে না পারিলেও পূর্বার মুখ হইতে তাহার ও তাহার প্রিয়তমা দিদির যে অতিত শুনিয়াছি, তাহাতেই আমার ধীরমস্তিস্ক বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিলো। পড়াশুনার ফাঁকে আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হইয়া উঠিয়াছিলো পূর্বার অশ্রু। তাহার অশ্রু চোখে দেখিতে পাইতাম না। সামান্য টুকু অনুভব করিলেই বুঝিতে পারিতাম, শুধুই লবনামবু নয় রক্তও বেরিয়ে আসিতেছে। যে রক্ত তাহার মনকে অতীব ধৈর্ষ শীল ও কঠিনে পরিনত করিয়াছে।

তাহার জরাজীর্ণ মন বুঝিবার ব্যক্তি অনেকেই রহিয়াছে কিন্তু কাহাকেও সে তাহার জীবনের সমস্যা সমাধান করিতে দেয়নি। আমি মাঝে মধ্যে কথার জালে তাহাকে আটকাইয়া ফেলিতাম।প্রশ্ন করিতাম, কিন্তু উত্তর দু এক কথায় আসিত। বড্ড ব্যাথা পাইতাম তাহা শুনিয়া । 


 


পাঠ্যদান করিতে করিতে কখন যে সময় কাটিয়া যায় তাহা বুঝিতেই পারিনা। প্রতিদিনের ন্যায় পাঠ্যদান শেষে পূর্বা কিছুক্ষণ আমার সহিত তাহার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত গুলো তুলিয়া ধরে। আজ তা হইতে সে দূরে রইলো না। আজও তাহার কথায় অভ্যন্তরীণ লহুক্রন্দন অনুভব করিলাম। নিজের জন্য তো বটেই, সঙ্গে তাহার বড়দিদির দুঃখ মিশ্রিত দিনগুলোর জন্য সে যে ব্যথিত তা বুঝিতে বাকি রহিলো না। আমার দুটো একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যখন প্রনামির প্রসঙ্গ তুলিয়াছিলাম, কেন জানিনা অবলীলায় সে তাহার জন্মলগ্ন হইতে জীবন কাহিনী শুরু করিয়াছিলো।


- ভূমিষ্ট হইতেই একঝাঁক ভালোবাসা আসিয়াছিলো দিদির জীবনে। তাহা যদিও আমার চোখে দেখার সৌভাগ্য হয় নাই তবুও তাহার, তখনের জীবন ও দিনগুলি বড়দের মুখ হইতে শুনিয়া বলিতেছি। 


 


কথা গুলি এক নিমেষে সমাপ্ত করিয়া আমার মুখের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া পুনরায় বলিল,


-  সবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়াছে। শিক্ষার প্রতি তাহার অগাধ সম্ভ্রম বাড়িয়া গিয়েছিল। পড়াশোনার সাথে সাথে সে গৃহস্থালির কাজও মায়ের নিকট শিখিতে থাকে। দেখিতে দেখিতে তাহার শারীরিক শ্রীবৃদ্ধি একেবারে তাক লাগানোর মত হইয়াছিল। আশেপাশের গ্রামের বয়জৈষ্ঠ মহিলারা স্কুলের পথে তাহাকে দেখিলেই আত্মলোভ সামলাইতে পারিত না। সকলেই তাহার নিজের বাড়ির বউ বানানোর কথা ভাবিত। আর ইস্টও তাহাই করিল। তাহাদের মধ্যেই স্বার্থনেশ্বি ও সুযোগসন্ধানী এক ললাসাগ্রস্ত মহিলা, ‘প্রিয়ংবদা’র নেত্রপাত ঘটিয়াছিলো। সেই নেত্রপাত যে ভবিষ্যতে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরী করিবে তাহা পিতাশ্রীও ভাবিতে পারে নাই।


 কথা গুলি শেষ করিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস লইয়া আমার নিমিত্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। আমি তাহার কথার উত্তর সরূপ বলিলাম,


- তাহার মিষ্টি ভাষা আপনাদের মন মোহিত করিয়াছিলো।আজকাল কেহ ভবিষ্যত ভাবিয়া চলে নাই। তাছাড়া প্রনামি অতীব সুন্দর ছিল। তাহার রূপ তো সকলের চোখে লাগিত। সেরূপে প্রিয়ংবদার চোখে লাগিয়েছে। ইহাতে কেহ কি করিয়া ভবিষ্যতের দুরাবস্থার কথা ভাবিতে পারে। 


আমার উত্তর শুনিয়া কিছুখন নির্বাক ও চিন্তাগ্রস্ত থাকিয়া বলিল,


-  আপনি আপনার মত বলিতেছেন ঠিকই কিন্তু শেষ পরিণতি শুনিলে আপনার মানসিক অবস্থা যে কি হইবে তাহা সম্পূর্ণ না হইলেও কীয়তঃ পরিমান অনুভূতি হইতেছে।


-  কেন? একথা বলছেন কেন? কি হইয়াছিল শেষ পরিণতি তাহার?


পূর্বা মস্তক নত করিয়া বসিয়াছিল, মুহূর্তটা একদম নিস্তব্ধ হইয়া গিয়েছিল। নিস্তব্ধতা এতটাই শান্ত হইয়াছিল যে প্রতিটি সেকেন্ডের শব্দ পরিষ্কার শুনিতে পাচ্ছিলাম। দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক চিত্তে বসিয়া ছিলাম। সময় একটু একটু করিয়া অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎই হাতঘড়ির দিকে নজর পড়িতেই বেশ খানিকটা অস্থির হইয়া উঠিলাম। পূর্বার দিকে তাকাইয়া বলিলাম,


-  আজ অনেক দেরি হইলো। আমাকে উঠিতে হইবে। নতুবা খুব সমস্যায় পড়িব। 


পূর্বা মুখ তুলিয়া দেখিল। চক্ষু তাহার ছলছল করিতেছে। সে ‘আসুন’ বলিয়া গৃহের প্রধান দরজা অবধি আসিলো ও আমাকে বিদায় জানিয়ে ক্ষীণ শব্দে দ্বার বন্ধ করিলো। 


সেদিন বাড়ি আসিয়া মোটেই ভালো লাগছিলো না কিছুই। পাঠ্য টেবিলের সম্মুখে বসিয়া পূর্বার কথা ভাবতেছিলাম। মনকে কিছুটা শান্ত করিয়া ডাইরি লইয়া তাহাতেই তাহার সমস্ত কথা লিখিতে লাগিলাম।


 


জটিল পরিসরে কি উপায় বের করিতে হইবে তাহা বাস্তবিক পরিস্থিতি নুতন করিয়া বুঝিয়া দিয়া থাকে। পূর্বা তাহা হইতে বেশ খানিকটা দূরেই ছিল। তাহার সহিত বাক্যালাপ করিয়া এটুকু অনুভব করিয়াছিলাম শুধুমাত্র তাহার পৈতৃক অতীত তাহার মনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারন নহে। ইহা শুধু দুঃখের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অভ্যন্তরীণ বিষয় অন্য কিছু রহিয়াছে। কিছু সংশয় ও প্রশ্নের উত্তর না পাইয়া ডাইরিটা অসম্পূর্ণ রাখিয়াই বন্ধ করিলাম।


সময়ের মায়াজালে আবদ্ধ হইয়া বেশ কয়েকদিন অতীব ব্যস্ততার কারণে পূর্বার বাড়ি আসিতে পারি নাই। আজ বেশ খানিকটা সময় হস্তান্তর করিয়া তাহার বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। পূর্বা আমাকে দেখিয়া আজ বড্ড আপ্লুত হইয়াছে। তাহা তাহার বহিরাকৃতি দেখিয়া সহজেই বুঝিলাম। পাঠ্যদান সবে শুরু করিয়াছি এমন সময় পূর্বা আমার নিকট আসিয়া বলিল,


-  আজ এপনাকে সমস্ত বিষয়টি শুনিয়া ফিরিতে হইবে। মনের মধ্যে কথাগুলি রাখিয়া অতীব কষ্ট পাইতেছি।


-  আমি শুনিব। কিন্তু তাহা আমার পাঠ্যদান পর্ব সমাপ্ত হইলে।


 


পূর্বা কথাগুলো শুনিয়া, আমার মুখের দিকে একবার তাকাইয়া, ঈষৎ হাসিয়া খুশিমনে নীচে নামিয়া যাইলো।


 


প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর আমার পাঠ্যদান শেষে বারান্দার প্রান্তিক কক্ষে বসিয়া চায়ের কাপ হাতে তুলিয়াছি পূর্বা আসিয়া হাজির হইলো।তাহার হাতে একটি মাঝারি ধরনের ফটো আলব্যাম। আমার সম্মুখে বসিয়া তাহার দুই পৃষ্ঠা উল্টাইয়া একটি মাঝবয়স্কা ভদ্র মহিলার ছবি বাহির করিয়া বলিলেন,


-  আপনি এ'নাকে বুঝিতে পরিতেছেন? কে উনি?


-  আমার অনুভব অনুযায়ী ইনিই বোধহয় আপনার মনের জটিলতার মধ্যমনি? 


-  একদম ঠিক ধরিয়াছেন। ইনিই হলেন প্রিয়ংবদা। যিনিই দিদির জীবনের সর্বনাশের কারন।


একই প্রশ্ন বারবার করিতে ভালো লাগে না। তাই নিশ্চুপ হইয়া চায়ের কাপ হাতে লইয়া বসিয়া রইলাম। পূর্বা তাহার নীরবতা শেষ করিয়া বলিল,


-  ইনি এমন একজন মহিলা যিনি পিতাশ্রীর ভালো মানসিকতার সুযোগ নিয়েছিলেন ও তাহার সদ ব্যবহার করিতে পেছন নি। আমার চোখে মহিলাটি বড্ড স্বার্থপর বলিয়াই মনে হয়।


 


 


কল্পনায়, বাস্তবতা দেখিতে দেখিতে যে অটুট চিত্র পরিলক্ষিত হইয়াছে তাহা সত্যি হৃদয় অভ্যন্তরে দাবানলের সৃষ্টি করিবে। তাহা যদি কেহ বহিরাকৃতি তে প্রকাশ করিতে চাই; তাহার রূপ যে কি হইবে তাহা আমার লেখনী কল্পনাও করিতে পারিবে নাই। বারংবার প্রতিনিয়ত হৃদয় কে খণ্ডিত করিতে করিতে একদা এক সময় তাহা একেবারে শেষ করিয়া দেবে, তাহা বলাই বাহুল্য। সুতরাং মানুষটি বাঁচিয়া থাকিবে কিন্তু তাহার অভ্যন্তরীণ স্বত্ব মৃত্যু বরন করিবে। ইহাই তো ঘটিয়াছে শিবপ্রসাদের জীবনে। 


প্রিয়ংবদার লোলুপ দৃষ্টি যেদিন হইতে প্রনামির উপর পড়িয়াছে সেদিন হইতেই শিবপ্রসাদের উপর প্রশংসার প্রলেপ ও মিথ্যা সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সুযোগ নেওযার নাটকীয় ভাবনাগুলো ব্যক্ত হইতে শুরু হইয়াছে। 


প্রিয়ংবদার ভালোবাসার ছত্রছায়ায় শিবপ্রসাদ তাহার ধ্যান ও জ্ঞান সমর্পন করিয়া অতীব বিশ্বাসের সহিত একটি সম্পর্ক তৈরি করে। 


প্রিয়ংবদা এতটাই স্বার্থপর ছিল যে কোনোরকম ভুত ভবিষ্যতে না ভাবিয়া তাহার দাদা উপেন্দ্রনাথ দত্ত কে কথা দিয়াছিল। তাহার একমাত্র বংশধারী উল্লাসের বিবাহের জন্য কন্যার সন্ধান করিয়া দেবেন। বনেদি বংশের ছেলে উপেন্দ্র তাহার উচ্চপদস্থ কর্মজীবনে নিজের পরিবারের প্রতি বেশ ভালোই মনোযোগ রাখিত। তাহার কারন সে তাহার বোনকে অতীব বিশ্বাস করিত।তাহার সমস্তকিছুই উল্লেখযোগ্য ছিল কিন্তু তিনি যে উল্লাস কে একেবারে অমানুষ করিয়া তুলিয়াছেন তাহা তাহার অধরাই ছিল। ভালো শিক্ষার আড়ালে উল্লাসের নিম্নমুখী চরিত্র তাহার ভবিষ্যৎ সমাপ্তের জন্যই যে যথেষ্ট ছিল তাহা উপেন্দ্রবাবুর গোচরে ছিল না। আসলে তাহাকে উল্লাসের বাস্তবিক চরিত্র থেকে বহু ক্রোস দূরেই রাখিয়াছিল তাহার প্রিয়তমা ভবানী। ভবানী দেবী উল্লাসের মা। উল্লাসের সবথেকে কাছের মানুষ। তাহার প্রধান কাজ ছিল উল্লাসের জীবনে তৈরি হওয়া ভুল পথ ও ভুল কাজকে সঠিক ভাবিয়া সকলের থেকে তাহা গোপনে রাখা। বিশেষ করিয়া উপেন্দ্রনাথ এর অনুভূতি থেকে তো বহু দূরে। যা ভবানীর মধ্যে আজও বর্তমান। 


ভালোবাসার নামে নিজের ছেলেকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়ার মজা যে কি - তাহা এক প্রকার ভীমরতি ধারী ভবানীর মত মানুষ ছাড়া কেহই হয়তো বুঝিবে না। প্রিয়ংবদা যে তাহা হইতে কোন অংশে কম নয় তা বলাই বাহুল্য। কেননা সেও শিবপ্রসাদের নিকট হইতে উল্লাসের চরিত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখিয়া ছিল।


 


স্নিগ্ধ বিকাল, আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘ রৌদ্রুজল আবহাওয়ায় মন সকলেরি মোহিত হইয়াছে। সবে ছাদে ফুলের গাছগুলিতে জল দিতে শুরু করিয়াছে শিবপ্রসাদ , এমন সময় রাস্তা হইতে দক্ষিণ পাড়ার ডোম হাঁক দিয়া বলিল,


-  বড়কর্তা, ও বড়কর্তা, দক্ষিণপাড়ার, প্রবালের মা তোমাকে দেখা করিতে বলিয়াছে। 


ছাদ হইতে শিবপ্রসাদ উত্তরে বলিল,


-  কেন রে? তোকে কিছু বলেছে?


-  না কর্তাবাবু, আমাকে কিছু বলেনাই। মন্দির থেকে ফেরার পথে দেখা হইয়াছিল। আমাকে বলল বাড়ি ফেরার পথে বলে দিয়ে যাস।


-  তুই, বাড়ি যা আমি গিয়ে দেখা করে নেব।


ডোম আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ মাথার দিকে এগিয়ে গেলো। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance