সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Comedy Children

4.6  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Comedy Children

হোটেল রবিতীর্থ

হোটেল রবিতীর্থ

9 mins
455


বোলপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। উফ্....যা ভীড় ছিল আজ ট্রেনে! অবশ্য ট্রেনের'ই বা কী দোষ? একেই এই শান্তিনিকেতন এক্সেপ্রস হল কলকাতা থেকে বোলপুর আসার এক বিশ্বস্ত গাড়ি। তার উপর আজ আবার ডিসেম্বরের তেইশ তারিখ। পৌষ মেলার জন্য এখন কলকাতা থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে পর্যটকদের ঢল নামছে বোলপুরের বুকে। সেই কত্তদিনের শখ ছিল আমার, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা দেখব। অনেক নামডাক শুনেছিলাম, কিন্তু পড়াশোনা চাকরিবাকরি ইত্যাদির চাপে পড়ে কোনওদিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা হয়নি। তাই এইবার কোনওমতে অফিস থেকে ছুটি জোগাড় করেই পড়িমরি করে ছুটে এসেছি!

এখন আমার হাতঘড়িতে দুপুর সাড়ে বারোটা, কিন্তু মেঘলা আকাশে সূর্য্যের দেখা মেলা ভার। গোটা স্টেশন চত্বরটা ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। অতি কষ্টে হাতের স্যুটকেসটা সামলে....ভীড়ের মধ্যে গুঁতোগুতি করতে-করতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে চারিদিকে শুধুই রিকশার প্যাঁ-পুঁ হর্ন। একটা রিকশাওয়ালা কে পাকড়াও করলাম।
"কী হে! পৌষ মেলা দেখতে এসেছি কলকাতা থেকে। মেলার মাঠের কাছেপিঠে কোনও ভাল হোটেলের সন্ধান দিতে পারো?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ দাদাবাবু," রিকশাওয়ালা ছেলেটা একখানা দন্ত-বিকশিত হাসি হেসে বলল, "আমার চেনা একটা হোটেল আছে একদম মেলার মাঠের কাছেই। খুব ভাল হোটেল বাবু।"
"বেশ, সেখানেই চলো তাহলে।"

হোটেলটা সত্যিই চমৎকার! চাকচিক্য'র কোথাও কমতি নেই। সুন্দর সাজানো-গোছানো ফুলের বাগানটা পার করে রিসেপশনে ঢুকলাম। সেখানে একজন সুদর্শন কার্তিক-মার্কা ছোকরা বেশ টাই-ফাই পরে বসে রয়েছে। ওকেই উদ্দেশ্য করে বললাম-
"এখানে কি তিন-চারদিনের জন্য একটা সিঙ্গেল বেডরুম পাওয়া যাবে? পৌষ মেলার ক'টা দিনের জন্য মাত্র।"

ছোকরাটা কিঞ্চিৎ মেয়েলি কায়দায় হাত নাড়িয়ে বলল-
"উঁহু....পাওয়া যাবে না স্যার। আমাদের সবকটা রুমই মেলার জন্য আগে থেকে বুক হয়ে রয়েছে; উই আর এক্সট্রিমলি সরি।"
"একটাও রুম নেই? একবার রেজিস্টারটা চেক করুন না।"
"আপনার আগেও তিনজন ফিরে গেছে স্যার," রিসেপশনিস্ট ঠোঁট ওল্টাল, "বলি আপনাদেরও বলিহারি! পৌষ মেলা দেখতে এসেছেন, তাও একদম লাস্ট মোমেন্টে? এই সময় কখনও ঘর খালি পাওয়া যায়? একটু আগে থেকে অনলাইনে ঘর বুক করিয়ে তো রাখতে পারতেন নাকি!"
"অনলাইন না ছাই! মেলার এই ক'টা দিনই খুব তেড়িবেড়ি তোমাদের। এ ছাড়া সারা বছর বসে-বসে মাছি মারো। ঢং দেখো না একবার....যেন সুন্দরী কমলা!!"
"অ্যাই....কী বললেন? আমি সুন্দরী কমলা? ও স্যার!"

কিন্তু ততক্ষণ আর আমি ওর 'কী বললেন'এর জবাব দিতে দাঁড়িয়ে থাকিনি। স্যুটকেস হাতে হনহনিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়েছি। আশেপাশের আরও কিছু হোটেলে গিয়ে খোঁজখবর করলাম; সবার অবস্থাই তথৈবচ। সবকটা ঘর ফুলি বুকড্।

উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আমাকে পিছু ডাকল। পিছন ফিরে দেখি এক ছোট্ট চায়ের গুমটি। তার মধ্যে বসে আছে একটা খুনখুনে বুড়ো। কাছে যেতেই সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল-
"বাবু কি থাকার জন্য হোটেল খুঁজছেন?"
"হ-হ্যাঁ....কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?"
বুড়োটা আমার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে একটু মুচকি হাসল। বড় কুটিল সেই হাসি।
"সামনের এই গলিটা দিয়ে সোজা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলেই একটা হোটেল পাবেন। একটু পুরনো, তবে বাসযোগ্য।"

আর পুরনো! তখন আমার যা অবস্থা, একখানা ঘর পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মাথা বনবন করে ঘুরছে। এই পৌষ মাসের শীতেও কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় কোনও 'বাসযোগ্য' হোটেলের সন্ধান পাওয়া একরকম হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো বৈকি!

কিন্তু হোটেলের সামনে এসে বুঝলাম....এ চাঁদ পূর্ণিমার নয়, অমাবস্যার। যেন বহুযুগ পুরনো এক অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। চুন-পলেস্তরা খসে যাওয়া দেওয়াল থেকে ইঁটগুলো দাঁত বের করে যেন আমাকেই উপহাস করছিল। মাটিতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। গোটা হোটেল চত্বরটা কেমন যেন অন্ধকার-অন্ধকার। শুধু নিচতলার একটা ছোট ঘর থেকে লণ্ঠনের টিমটিমে হলুদ আলো ঠিকরে আসছিল। উপরে টাঙানো রয়েছে কাঠের বহু পুরনো এক অস্পষ্ট বোর্ড। ঘষে যাওয়া লেখাগুলি অতি কষ্টে পড়লাম....হোটেল রবিতীর্থ।

খানিকটা ইতস্তত করে লণ্ঠন-প্রজ্জ্বলিত ঘরটায় ঢুকলাম। সম্ভবতঃ এটাই হোটেলের রিসেপশন। সামনে একটা বড় আরামকেদারায় বসে আছেন একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক। চোখে মোটা চশমা, মুখের সাদা ধবধবে দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। আমাকে ঢুকতে দেখে তিনি নিজেই উঠে দাঁড়ালেন।

"এখানে কি একটা ঘর...."
"হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই! তার আগে এই রেজিস্টারে নিজের সব ডিটেল্স এন্ট্রি করে দিন।"
একখানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক! শেষ পর্যন্ত তাহলে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই পাওয়া গেল। রেজিস্টারে এন্ট্রি করতে-করতে ভদ্রলোক কে জিজ্ঞাসা করলাম-
"আচ্ছা এখানে কি এখন কারেন্ট নেই? লণ্ঠন জ্বালিয়ে বসে আছেন যে?"
ভদ্রলোক নিজের আবক্ষ সাদা দাড়িতে দারুণ এক ইউনিক কায়দায় হাত বুলিয়ে বললেন-
"আছে আছে, কারেন্ট আছে। কিন্তু আমার আবার এত বেশি উজ্জ্বল আলো-টালো এক্কেবারে পছন্দ না মশাই। যে মজা অন্ধকারে আছে, সে মজা আলোয় কোথায়? খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক!"
ভদ্রলোকের খ্যাঁকশেয়াল মার্কা হাসি শুনে আমার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। রেজিস্টার থেকে চোখ তুলে একবার ওনাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিলাম। দুনিয়ায় কত প্রকারের পাগলই যে আছে!

দো'তলায় একটা ঘর পেলাম। বেশ ভাল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। নিজের মালপত্র রেখে বিছানায় হাত-পা ছেড়ে গড়িয়ে পড়লাম। যা ধকল গেল আজ সারাদিন! রাতে চটজলদি নৈশভোজ সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। আজ আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। কাল থেকে টানা তিনদিন ধরে মেলা ঘোরার প্ল্যান। খুব প্যাকড্ শিডিউল।

ঠিক রাত ক'টা হবে জানিনা। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধুর....মাঝরাতে লোডশেডিং হয়েছে মনে হয়। কিন্তু এখন শীতকাল, তাই ঘুমের তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়লাম।

হয়তো একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, ঠিক তখনই খাটটা কেমন যেন দুলে উঠল। আমি তিড়িং করে লাফিয়ে খাটে সোজা হয়ে বসলাম। যাঃ বাবা! ভূমিকম্প নাকি? কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর আবার একই কাণ্ড। তবে এইবার স্পষ্ট অনুভব করলাম....এটা ভূমিকম্প নয়। খাটের নিচে কিছু একটা আছে, যার গায়ে ধাক্কা লেগে খাটটা বারবার নড়ে-নড়ে উঠছে। টর্চটা বার করে খাটের তলায় ফেলতেই একটা কালো মতো ছায়াশরীর চোখে পড়ল। বিড়াল-টিড়াল বুঝি? কিন্তু গায়ে টর্চের আলো পড়তেই সেই ছায়াময় অবয়বটা সটান খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। না, বিড়াল নয়....মানুষ। রোগা লিকলিকে, গায়ের রং মিশমিশে কালো। চোখদুটো ছানাবড়ার মতো।

"অ্যাই বদমাইশ!!" ধমকে উঠলাম আমি, "এখানে খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে আছিস কোন সাধু মতলবে? চোর-ছ্যাঁচোড় নাকি?"
সিড়িঙ্গে লোকটা খোনা গলায় মিনতির সুরে বলল-
"চোখে আলো ফেলবেন নাকো বাবু। বড় কষ্ট হয়...."
"আচ্ছা হারামজাদা! চুরির মতলবে মাঝরাতে খাটের তলায় সেঁধিয়েছ, আবার বলছ টর্চ মারবেন না? মামার বাড়ির আব্দার না?"
"আরে না না দাদাবাবু," লোকটা একহাত জিভ কেটে বলল, "আমি চোর-টোর নইকো....আমি এই হোটেলের কেয়ারটেকার। নাম হল পদ।"
"অ্যাঁ! পোদো? এ আবার কী ধরণের অশ্লীল নাম?"
"আজ্ঞে পোদো না, পদ।"
"সেকি! পদ মানে তো পা।"
"কে জানে? বাবা-মা এই নামই দিয়েছে। এখন এর অর্থ হাত না পা না মাথা, তা আমি কেমন করে বলব?"
"হুম, বুঝলাম। তা পদ....তুমি যে বললে তুমি নাকি এই হোটেলের কেয়ারটেকার, তো বেশ ভালই টেক-কেয়ার করছ দেখছি এই হোটেলের। একখানা আস্ত পোড়ো হানাবাড়ি বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছ।"

"হোটেল মেরামতির কথাটা কি আমি মালিকের কাছে পাড়িনি ভাবছেন?" পদ পুনরায় একহাত জিভ কাটল, "কিন্তু সে বলে, এখানে নাকি আজকাল তেমন লোকই আসে না। মিছে এত টাকা খরচা করে মেরামত করে কী লাভ? আসল কথাটা আপনাকে চুপি-চুপি বলে রাখি, মালিক যতই দাড়ি-গোঁফ পাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজুন না কেন....মালটা আদতে হেব্বি কিপটে।"
"তা বাছা তুমিও তো কম বেয়াদব না দেখছি। বাইরের লোকের সামনে মনিবের নিন্দে করছ।"

আমার এই কথায় পদ হ্যা-হ্যা করে একখানা বিটকেল হাসি দিল। লোকটা বেশ মজার তো! লাইট নেই, ঘুম আসার সম্ভাবনাও কম। কিছুক্ষণ নাহয় এই ভুঁইফোড় কেয়ারটেকারের সাথেই ভাটানো যাক।

খাটে উঠে বসতে যাব, হঠাৎ কপালে ঠাণ্ডা মতো কিছু একটা ঠেকল। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। ফোনের আলো জ্বালিয়ে দেখি....ও মা! এ যে একজন মানুষের পা। ভয়ে-ভয়ে আলোটা সিলিং ফ্যানের দিকে ফেলতেই এক বীভৎস দৃশ্য দেখলাম। ফ্যানের ব্লেডের সাথে বাঁধা রয়েছে একখান মোটা দড়ি। আর সেই দড়িতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছে একটা মৃতদেহ। ভয়ে হাঁউমাঁউ করে আমি খাট থেকে সোজা মাটিতে এসে পড়লাম। পদ ওই ঝুলন্ত মৃতদেহটা কে উদ্দেশ্য করে বলল-
"অ্যাই ভোম্বল! নিচে নেমে আয় হতচ্ছাড়া, নেমে আয় বলছি। সারাক্ষণ খালি বাদুড়ের মতো ঝুলে আছিস। দেখছিস না বাবু কেমন ভয় পেয়ে গেলেন?"
পদ'র কথায় ভোম্বল দিব্যি গলার থেকে ফাঁসির দড়িটা খুলে বিরাট এক লম্ফ দিয়ে খাটে নেমে পড়ল। আমি তখনও মাটিতে উল্টে পড়ে আতঙ্কে গোঙাচ্ছি।

"আরে বাবু ভয় পাবেন নাকো," ভোম্বল আমাকে অভয়দান করল, "আমি এখানকার ঝাড়ুদার।"
"তোর ঝাড়ুদারের চোদ্দগুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করব হারামজাদা! মাঝরাতে কি ঘরে ঝাঁট দিতে এসেছিস? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাস না! আর ওইভাবে পাখার সাথে ঝুলে ছিলি কোন আক্কেলে?"
"আসলে স্যার, গলায় দড়ি দিয়ে মরার পর থেকে মাঝেমধ্যে ঘাড়ে খুব ব্যথা হয়। তাই হাতে খালি সময় পেলেই পাখার সাথে ঝুলে পড়ি। এতে খুব আরাম পাওয়া যায়। আপনার কোনওদিন ঘাড়ে ব্যথা-ট্যথা হলে এই পদ্ধতিটা প্রয়োগ করে দেখবেন, সব রকমের ব্যথা চিরতরে ঘুচে যাবে।"
"মানে....মানে....তুমি ভূত?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ," পদ বলে উঠল, "আপনি যা ভাবছেন, আমরা আসলে তাই।"
"আমরা মানে? পদ তুমিও??"
"একদম। ভোম্বল মরেছিল গলায় দড়ি দিয়ে, আর আমি মরেছিলাম লরির সাথে ধাক্কা খেয়ে।"

ততক্ষণে আমার ঘেমে-নেয়ে করুণ অবস্থা। ভয়ের চোটে উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকুও যেন লোপ পেয়েছে। পদ আর ভোম্বল এবার হাতে-হাতে ধরাধরি করে আমাকে ঘিরে এক উদ্ভট পৈশাচিক নৃত্য আরম্ভ করেছে।

"আঁ-আঁ-আঁ!!"
"চেঁচাচ্ছেন কেন বাবু? আমাদের নাচ দেখে ভয় পেলেন বুঝি?"
"আমি বাড়ি যাব। ঢের হয়েছে, কাজ নেই আর মেলা দেখে। তোমরা আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দাও বাপ! কথা দিচ্ছি আর কোনওদিন মরতেও এই ভূতের আড্ডায় আসব না।"
পদ আর ভোম্বল নিজেদের মধ্যে একবার চোখাচোখি করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। এইবার তারা দুজনে নাচের সাথে-সাথে বেসুরো খোনা গলায় গানও ধরেছে:-

"বিপদ হতে এবার সাহেব নেইকো তোমার ত্রাণ,
মুড়াব মাথা, মটকাব ঘাড়, রক্ত করব পান।
প্রেতপুরীতে ঢুকলে নিজে, নেইকো মোদের হাত;
আজ নিশীথে হবে সাহেব তোমার মুণ্ডপাত।"

মানুষ মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলে একরকম মরিয়া হয়ে ওঠে। তখন সে যমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও পিছুপা হয়না। আমারও এখন প্রায় একই অবস্থা। কোনওমতে টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে "জয় মা কালী!!!" বলে একটা বিরাট হুঙ্কার ছেড়ে দে দৌড়! পিছনে তখনও দুই ভূতের বিদ্রূপ-মাখা খলখল হাসির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

নিচে হোটেলের মালিক মনের সুখে তামাক টানছিলেন। আমাকে ওইভাবে দু-তিনটে সিঁড়ি টপকে দুদ্দাড় নিচে নেমে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন।
"কী হল মশাই? অমন করে ছুটছেন কেন? ঘুম আসছেনা বুঝি?"
"আর ঘুম! এইটা আপনাদের হোটেল না ভূতের বাসা?"
"অ্যাঁ! ভূতের বাসা? ও আচ্ছা বুঝেছি। আপনি নির্ঘাত পদ আর ভোম্বল কে দেখেছেন, তাই না?"
"কী! আপনি সব জানতেন? আপনি জেনেশুনে আমার মতো একজন সাদাসিধে মানুষ কে কয়েকটা টাকার লোভে ভূতের খপ্পরে ফেলতে পারলেন? কী সাঙ্ঘাতিক লোক আপনি মশাই!"
"আরে না না," হোটেল মালিক আরেকবার নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন, "ওরা শুধু একটু ভয়-টয় দেখায়। কিন্তু কারও প্রাণহানি করেনা। ওরা খুব ভাল ভূত।"
"ধ্যাৎ মশাই! রাখুন আপনার ভাল ভূত। আমাকে ঘিরে তিড়িং-বিড়িং করে নেত্য করছিল....আর 'ঘাড় মটকে রক্ত খাব' না কী সব আওড়াচ্ছিল। এগুলো বুঝি ভাল ভূতের লক্ষণ?"

হোটেল-মালিক আবার খ্যাঁক-খ্যাঁক করে নিজের সেই ট্রেডমার্ক খ্যাঁকশেয়ালি হাসি হাসতে আরম্ভ করেছেন। রাগে সারা শরীর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল! অনেকক্ষণ ওইভাবে হাসার পর উনি বললেন-
"আসলে এর পিছনে একটি ঘটনা আছে। বছর পাঁচেক আগেকার কথা। তখন ভোম্বল এই হোটেলে ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করত। বলা নেই কওয়া নেই....একদিন হঠাৎ কোনও অজ্ঞাত কারণে ও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হল। পুলিশ অনেক তদন্ত করেও ভোম্বলের আত্মহত্যার রহস্য ফাঁস করতে পারেনি।"

কলকে'তে আরেকটা সুখটান দিয়ে উনি আবার বলতে শুরু করলেন।
"পদ ছিল এই হোটেলের কেয়ারটেকার। ভোম্বলের সাথে ওর খুব গলায়-গলায় ভাব ছিল। ভোম্বলের মৃত্যুর দিন দশেক পরে আমি একটা নতুন গাড়ি কিনেছিলাম। একদিন পদ কে সঙ্গে নিয়ে ওই গাড়িতে করে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ সামনে থেকে একটা লরি....বিশ্বাস করুন স্যার, হাজার চেষ্টা করেও আমি পাশ কাটাতে পারলাম না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এটা ভোম্বলের আত্মার কাজ। ও কোনওভাবে মন্ত্রবলে স্টিয়ারিং আর ব্রেকগুলো জাম করে দিয়েছিল। আসলে প্রাণের বন্ধু পদ কে ছেড়ে হয়তো স্বর্গে ওর মন টিকছিল না।"

এতক্ষণে আমার চোখদুটো সর্ব্বমঙ্গলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রসগোল্লার মতো গোল-গোল হয়ে গেছে।
"তারপর কী হল?"
"কী আর হবে? লরি এসে গাড়িতে ধাক্কা মারল। ব্যাস! খেল খতম। এক ছোবলেই ছবি।"
"ম-ম-মানে? তার মানে আপনিও...."
"বাহ্! আপনার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে তো। ঠিকই ধরেছেন, আমিও ওদের মতোই....আরে মশাই দৌড়চ্ছেন কেন? হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবেন যে!"

আর হোঁচট! তখন হোঁচট আমার ব্রহ্মতালুতে উঠেছে। অতি কষ্টে নিজের ধুতিটা সামলে বড় রাস্তা ধরে পাঁইপাঁই করে ছুটছি। সে এক হাস্যকর দৃশ্য মাইরি!

ছুটতে-ছুটতে আবার সেই চায়ের গুমটির সামনে এসে পড়েছি। চা দোকানি বোধহয় ঝাঁপ-টাপ বন্ধ করে বাড়ি ফেরার উপক্রম করছিল। কিন্তু আমাকে ওইভাবে পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে ভয় পেয়ে পুনশ্চ গুমটির ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। ততক্ষণে আমি গুমটির সামনে এসে ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়েছি। হৃৎপিণ্ডটা প্রচণ্ড ভাবে ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখের সামনে জগৎসংসার ফুটবলের মতো বাঁইবাঁই করে ঘুরছে।
"বাবু, কী হল বাবু? ওইভাবে দৌড়চ্ছিলেন কেন?"
"জল....একটু জল...."

একঘটি ঠাণ্ডা জল গলায় ঢালার পর ধড়ে প্রাণ এল। একটু ধাতস্থ হতেই আমি চা দোকানির উপর খেঁকিয়ে উঠলাম-
"তুমি কেমনধারা আহাম্মক হে? ওইরকম ভুতুড়ে হোটেলের সন্ধান দিতে কে বলেছিল তোমাকে? আরেকটু হলে তো প্রাণটাই যেতে বসেছিল!"

চা দোকানি বুড়োটা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
"সবই আমার পোড়া কপাল বাবু, সবই আমার পোড়া কপাল। হোটেল রবিতীর্থ আগে মোটামুটি ভালই চলত। ভোম্বলটা গলায় দড়ি দেওয়ার পর থেকেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। ভোম্বলের মৃত্যুর কিছুদিনের তফাতেই হোটেল মালিক আর ওনার সহকারীও পথ দুর্ঘটনায় মরল। সবই আমার পোড়া কপাল...."
"এতে তোমার পোড়া কপালের কী আছে হে? ওরা মরেছে নিজেদের দুর্ভাগ্যে। এর মধ্যে তোমার কী করার ছিল?"
"আমার কপালের দোষ নয়তো কী বাবু? যেদিন ওদের গাড়ির সাথে লরির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, সেদিন আমিও ওই রাস্তা দিয়েই সাইকেল করে যাচ্ছিলাম।"
"তারপর?"
"তারপর আর কী....গাড়িটা লরি'তে ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে সোজা আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। আমিও গাড়ির তলায় সাইকেল সমেত চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেলাম। ডাইরেক্ট পটলডাঙা। সবই আমার পোড়া....আরে ও দাদা! আপনার আবার কী হল? ওইভাবে ছুটছেন কেন? পড়ে যাবেন তো! আরে আপনার ধুতির কাছাটা খুলে গেছে যে....ওওও দাদা!!!"

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror