সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Action Tragedy

4.0  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Action Tragedy

প্লেমেইট

প্লেমেইট

4 mins
367


- "যতদিন এই বাড়িতে ছিলাম, ততদিন চিলেকোঠার এই ঘরে তালা ঝুলিয়েই রেখেছিলাম। আজও খুলতাম না, নেহাৎ আপনাদের জোরাজুরি'তেই খুলতে হল।"
- "মিস্টার বসু, আপনি তো জানেন আমি একজন স্টুডেন্ট। শান্তিতে পড়াশোনা করতে চিলেকোঠার এই নিরিবিলি ঘরটা আমার নিতান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া ওই পেন্টিং নিয়ে আপনারা যখন এতটাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তখন ওইটা নিজের সঙ্গেই নিয়ে যান না! আমাদের কোনও আপত্তি নেই।"
-"না না!" বিটকেল বুড়োটার মুখটা যেন মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল, "যেই বিভীষিকার তাড়নায় আমাদের এত পুরনো পৈতৃক বাড়িটা জলের দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি, সেই অভিশাপ নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়াব? ইম্পসিবল্!"

**************

দিব্যি দশদিন কেটে গেছে। কিছুই অস্বাভাবিক টের পাইনি। যত্তসব বোগাস! মিথ্যেবাদী বুড়োটার উপর মাঝে-মাঝে ভারি রাগ হতো। এত সুন্দর তৈলচিত্রটা নাকি অভিশপ্ত! পুকুরপাড়ে বসে আছে এক এলোকেশী বিদেশিনী। কোলে তার বছর দুয়েকের শিশু। বাচ্চার ডান হাতে একখানা সবুজ বল, আরেক হাতে রয়েছে একটি ঝুমঝুমি। কী সুন্দর মুখশ্রী বাচ্চাটার! নিষ্পাপ চোখদুটো সমুদ্রের মতো গভীর নীলবর্ণ। এক পলকের জন্য সেই চাঁদপানা মুখ দেখলে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যায়।

রাত তিনটে বাজে। কাল একটা চাকরির পরীক্ষা আছে। চিলেকোঠায় বসে এক মনে অঙ্ক কষে চলেছি। আচমকা একটা শব্দে চমকে উঠলাম। খুব হালকা অথচ মিষ্টি এক শব্দ। কিন্তু ঘরের ভিতরে তো তেমন কিছুই অস্বাভাবিক চোখে পড়ল না। আওয়াজটা কি তবে বাইরে থেকে আসছে? কানে মধু ঢালা সেই ছন্দবদ্ধ সুরেলা ঝুম-ঝুম শব্দে কী যে এক গাঢ় মাদকতা মিশে ছিল....আমি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।

কতক্ষণ পর চোখ খুললাম মনে নেই। আরে! এ আমি কোথায় এসে পড়েছি? উফ্! মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে চতুর্দিক ভাল করে পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝলাম, এইটা সম্ভবতঃ আমার চিলেকোঠার স্টাডি রুমটাই। কিন্তু....কিন্তু সবই কেমন যেন অচেনা ঠেকছে। কোথায় সেই সিমেন্টের শক্ত মেঝে? মনে হচ্ছে ফ্লোরটা কাঠের তৈরি। শুধু ফ্লোর'টাই নয়, দেওয়ালগুলো পর্যন্ত কাঠের। ঘরে আমার নিজস্ব একটাও ফার্নিচার নেই। পুরনো আমলের আসবাবপত্র দিয়ে ঘরটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। ঠিক মনে হচ্ছে যেন আমি প্রায় একশো বছর আগেকার সময়কালে এসে উপনীত হয়েছি।

কিন্তু আসল ধাক্কাটা খাওয়া এখনও বাকি ছিল। ঘরের কোণায় চোখ পড়তেই দেখি এক ব্রিটিশ মহিলা; আপনমনে গুনগুন করতে-করতে একটা পুরনো বুকশেল্ফ পরিষ্কার করছেন। পাশে রাখা বেবি কটে একটি ছোট বাচ্চা। দুজনেরই মুখ আমার খুব চেনা। হ্যাঁ....এরা সেই অয়েল পেন্টিংয়ের দুই চরিত্র!

হাতের ঝুমঝুমিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে শিশুটি। খিলখিল করে হাসছে মিষ্টি ঝুম-ঝুম শব্দের তালে। মাঝে মাঝে কাঠের একটা সবুজ বল কে হাওয়ায় ছুঁড়ে সেটাকে পুনরায় লুফে নেওয়ার বিফল চেষ্টা করছে। নিজের মা কে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে আধো-আধো গলায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক এক ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, দুজনের মধ্যে কেউই মনে হয় দেখতে পাচ্ছে না যে আমি ঠিক ওদের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছি। বেশ কয়েকবার চেঁচিয়ে ডাকলাম, হাত নাড়িয়ে বার-বার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম....তবুও ওদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। একবার তো ওই মহিলার কাঁধে সজোরে ধাক্কাও দিলাম, কিন্তু আমার হাতটা সরাসরি তার শরীর ভেদ করে বেরিয়ে গেল। আতঙ্কে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা অস্ফুট চিৎকার।

শিশুটির হাত ফসকে বলটা গড়িয়ে এল আমার পায়ের কাছে। কুড়িয়ে নিলাম কাঠের তৈরি সেই সবুজ বল। তাতে লাল কালি দিয়ে লেখা:-

"Wanna play?"

তবে একটু ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতেই ভয়ে শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেল। লাল কালি নয়, এ তো....এ তো তাজা রক্ত!

ঠক্!!

বলটা সশব্দে খসে পড়েছে আমার হাত থেকে। রক্ত? রক্ত এল কোত্থেকে? আতঙ্কে হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। তাজ্জব ব্যাপার, এতক্ষণ ধরে এত ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও যারা আমার কথা শুনতে পাচ্ছিল না, বলটা পড়ার শব্দে তারা দুজনেই এখন আমার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে। একি! মা-ছেলের চোখদুটো এমন কুচকুচে কালো কেন? কী দেখছে ওরা এত মন দিয়ে? আহ্....কী স্থির অথচ অন্তর্ভেদী সেই দু'জোড়া কালো চোখ! যেন আমার বুক ভেদ করে সোজা হৃৎপিণ্ডের ভিতর ছোবল মারছে দুজনের দৃষ্টি। একটু-একটু করে শোষণ করে নিচ্ছে আমার সমস্ত প্রাণশক্তি। আমার অস্তিত্ব ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে ওদের কুচকুচে কালো চোখের অতল গভীর সাগরে........

**************

- "বলুন সাত্যকি বাবু, আপনার ছেলে কবে থেকে মিসিং?"
- "কাল রাত থেকে ইন্সপেক্টর সাহেব। ওর চিরকালই সারারাত জেগে পড়াশোনা করার অভ্যেস। কাল রাতেও বুবাই নিজের স্টাডি রুমেই ছিল। কিন্তু আজ সকালে ওর মা ঘরে চা দিতে গিয়ে দেখে, ঘরটা একদম ফাঁকা। বুবাই কোত্থাও নেই। ওর মোবাইল ফোনটাও তো খাটেই পড়ে আছে। কোথায় যে গেল ছেলেটা!"
- "বেশ। আমরা একটা মিসিং ডায়েরি করে নিচ্ছি। আপনাকে একটু কষ্ট করে একবার থানায় আসতে হবে।"
- "নিশ্চয়ই যাব স্যার। শুধু একটাই অনুরোধ, আপনারা যেখান থেকে পারেন আমাদের ছেলেটা কে খুঁজে বের করুন। ওকে ছাড়া আমাদের যে আর কেউ নেই।"
- "কাঁদবেন না সাত্যকি বাবু। আমরা নিজের দিক থেকে পুরো চেষ্টা করব। দেখা যাক কী হয়।"

কাঁচের ওপার থেকে নীরবে সব কথোপকথন শুনছি। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না। তোমরা সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলে, অথচ একটিবারও তোমাদের নজর ঘরে টাঙানো অয়েল পেন্টিংয়ের দিকে পড়ল না? সেদিকে চোখ পড়লেই বুঝতে পারতে....তোমাদের আদরের বুবাই এখন কোথায়।

সেই তৈলচিত্রে এখন দুটো নয়, তিনটে চরিত্র। চিরকালের মতো আমার আত্মা বাঁধা পড়ে গেছে এই ছবির ভিতরে। কাঁচের এই ঠুনকো দেওয়াল পার করার মতো শক্তি আমার নেই। এ এক নতুন জীবন। এখন থেকে আমার একমাত্র পরিচয়, আমি এই শিশুর খেলার সাথী....প্লেমেইট।

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror