সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Tragedy Inspirational

4.0  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Tragedy Inspirational

বন্ধু

বন্ধু

6 mins
74


আজ কালীপুজো। অঞ্জন আজ ভীষণ খুশি। ওদের অট্টালিকার সমান বিরাট বাড়িতে প্রতি বছরই মহা ধুমধাম করে কালীপুজোর আয়োজন করা হয়। এবারও হয়েছে। এখন মায়ের সন্ধ্যা আরতি চলছে। পূজামণ্ডপে ধুনুচির গন্ধের সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি মিলেমিশে সৃষ্টি হয়েছে এক মনোরম পরিবেশ। অঞ্জন দালানে বসে মাতব্বরের মতো ঢাকের তালে-তালে মাথা দোলাচ্ছে। পাশে বসে ওকে সঙ্গ দিচ্ছে ওর 'বিশেষ বান্ধবী' স্নেহা। আজ অঞ্জন বাবুকে আর পায় কে? একেই সে বড়লোক বাড়ির ছেলে। নিজেদের বাড়ির পুজো। তার উপর আবার প্রেমিকাও সাথে আছে। আর কী চাই!

এমন উপভোগ্য মুহূর্তটা বাঞ্চাল করে দিল একটি উড়ো ফোন কল। অচেনা একটা নম্বর থেকে অঞ্জনের মোবাইলে বার-বার কল আসছে। ধ্যাৎ! পুরো মেজাজটাই তিরিক্ষি হয়ে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল'টা রিসিভ করল অঞ্জন।
"হ্যালো?"
"মিঃ অঞ্জন গুহ স্পিকিং?"
"ইয়েস, আই অ্যাম।" একটু রুক্ষ ভাবেই উত্তর দিল অঞ্জন, "কে বলছেন?"
"আমার নাম ধাম ঠিকানা জেনে কাজ নেই। আপনি এক্ষুনি আপনার বাড়ির পশ্চিম দিকের বড় বট গাছটার নিচে চলে আসুন। আমি ওখানেই অপেক্ষা করছি।"
"পাগল নাকি?" সশব্দে হেসে উঠল অঞ্জন, "আমি কী করতে একটা অজানা লোকের সাথে দেখা করতে যাব? আপনার দরকার থাকলে আপনিই আসুন। আমি বাড়ির দালানেই বসে আছি।"
"সেকি!" একরাশ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরে, "ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার রাজীব গুহ'র একমাত্র ছেলে শেষে কি না একটা উড়ো ফোন কলে ভয় পেল? হাহাহা! থাক, আসতে হবে না। তুই লেজ গুটিয়ে ঘরেই বসে থাক। কাপুরুষ কোথাকার!"

এই অঞ্চলে দুঁদে ইন্সপেক্টর রাজীব বাবুর এমনই দাপট, যে কেউ তাঁর পরিবারের কোনও সদস্যের দিকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলার সাহস পর্যন্ত পায় না। সেখানে কোথাকার কে এক উটকো লোক তাঁর সবেধন নীলমণি কে যেচে ফোন করে হুমকি দেবে? ইম্পসিবল্! রক্ত উঠে গেল অঞ্জনের মাথায়। এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। স্নেহা ওর পাশেই বসে ছিল, একথা ভুলে ওর সামনেই গালাগালি দিয়ে বলল-
"শালা তুই কে রে হারামজাদা? খুব বড়-বড় কথা বলছিস যে! তুই জানিস আমি কে?"
"বিলক্ষণ জানি। এক বেইমান ঘুষখোর পুলিশ অফিসারের কুলাঙ্গার ছেলে তুই।"
"কী! এত বড় কথা? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।"

স্নেহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল অঞ্জন। সঙ্গে রাখল নিজের বাবার সার্ভিস রিভলভারটা। পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক সে। রক্ত টগবগ করে ফুটছে। তাকে গাল পেড়ে কেউ এত সহজে পার পেয়ে যাবে, এইটা অসম্ভব। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। দ্রুত পায়ে বাড়ির পশ্চিম দিকের বট গাছটার তলায় উপস্থিত হয় সে। পাতলা কুয়াশার আবরণ চারিদিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সতর্ক ভাবে সবদিক ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে নিল অঞ্জন। কাউকে দেখতে না পেয়ে হুঙ্কার ছাড়ল-
"কোথায় লুকিয়ে আছিস রে ভীতুর বাচ্চা? ক্ষমতা থাকলে সামনে এসে মুখোমুখি লড়াই কর।"

এই কথা বলা মাত্রই বটগাছের তলা থেকে একপুঞ্জ অন্ধকার যেন মানুষের মূর্তি ধারণ করে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। হালকা কুয়াশার চাদর কেটে সেই ছায়াশরীর কাছে আসতেই অঞ্জনের হাত থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটা খসে পড়ল।

"একি! প্রত্যুষ, তুই এখানে? তোকে তো আমি নিজে হাতে...."
"জানি। আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়তেই বেশি ভালবাসি। পিছন থেকে আঘাত করার অভ্যাস তোর মতো বেইমানদের। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তোর তেজ এখনও কমেনি দেখছি।"
"কিন্তু....কিন্তু তুই আবার ফিরে এলি কী করে?"
"ফিরে এলাম কী করে?" চাপা রাগে হিসহিস করে ওঠে প্রত্যুষ, "তোর সাথে যে আমার পুরনো কিছু বোঝাপড়া বাকি ছিল বন্ধু! তাই তো এত কষ্ট করে আমায় ফিরে আসতে হল।"
"আমি তো নিজে হাতে তোকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলাম পাঁচ বছর আগে, তবে কি...."
"ঠিক ধরেছিস। আমিই প্রত্যুষ। কিন্তু সেই পুরনো রক্তমাংসের প্রত্যুষ নই।"

মুহূর্তের মধ্যেই প্রত্যুষের চেহারায় একটা বীভৎস পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করল। তার মুখ থেকে চামড়া আলগা হয়ে খসে পড়তে লেগেছে। উজ্জ্বল চোখদুটো ক্রমেই নিস্তেজ হতে-হতে পরিণত হয়েছে অন্ধকার দুটো গহ্বরে। যেখানে কিছুক্ষণ আগেই অঞ্জন একজোড়া পাতলা ঠোঁট দেখেছিল, এখন সেখানে চোখে পড়ছে শুধুমাত্র দু'পাটি উলঙ্গ মাড়িবিহীন দাঁতের শৃঙ্খলা। প্রত্যুষের পুরুষালি চওড়া বক্ষদেশ এতক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে; এখন তার জায়গায় অবশিষ্ট পাঁজরের হাতেগোনা কিছু ভাঙা হাড়। ধীরে-ধীরে প্রত্যুষের সুঠাম শরীরটা বদলে গেছে একটা পূর্ণাঙ্গ নরকঙ্কালে।

"আমার কী দোষ ছিল বলতে পারিস বন্ধু?" অন্ধকারে ওই খণ্ড-খণ্ড সাদা হাড়গুলো বিলাপ করে উঠল, "আমি স্নেহা কে ভালবাসতাম, এই তো? আমাকে একবার বললে আমি তোর জন্য নিজের প্রাণটাও দিয়ে দিতে পারতাম অঞ্জন, নিজের ভালবাসা কে জলাঞ্জলি দেওয়া সেই তুলনায় কিছুই না। কিন্তু তুই একবারও আমাকে বললি না যে তুইও স্নেহাকেই ভালবাসিস। হিংসায় অন্ধ হয়ে নিজের পথের কাঁটাকে দূর করে দিলি, তাই না? আর তোর ঘুষখোর বাপটা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমার খুনের কেসটা বেমালুম ধামাচাপা দিয়ে দিল। তবে আজ আমার হাত থেকে তোকে কে বাঁচাবে? তোর বাবা? আজ যে আমার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা রে!"

প্রত্যুষের প্রেত এবার লম্বা-লম্বা পা ফেলে ওর দিকেই এগোচ্ছে। ভয়ে কুঁকড়ে গেল অঞ্জন; কোনওমতে মাটি থেকে রিভলভারটা কুড়িয়ে ফায়ার করল প্রত্যুষের দিকে। ছ'টা গুলির মধ্যে একটাও বিঁধল না।
"হাহাহা...!" ব্যঙ্গ ভরা অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল প্রত্যুষ, "এইসব খেলনা দেখে আমার পাঁচ বছর আগে ভয় লাগত রে আহাম্মক! এখন এই সবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই। কোথায় পালাবি? পালা দেখি কত বড় হিম্মত!"

ছুটতে গিয়ে পাথুরে জমিতে আছাড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল অঞ্জন। হাতে ভর দিয়ে ওঠার মতো শক্তিটাও যেন লোপ পেয়েছে। আজ সবকিছুই হচ্ছে প্রত্যুষের ইশারায়....অঞ্জন নিজে আজ সম্পূর্ণ অসহায়। কঙ্কালের দুটো লিকলিকে হাত বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে ওর কলার। প্রবল চাপে যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। ছটফট করছে অঞ্জন....কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সেই বন্ধন হতে মুক্ত করা যাচ্ছে না। প্রত্যুষের অন্ধকার দুই কোটর এখন আগুনের ভাঁটার মতো প্রজ্জ্বলিত। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে তীব্র জিঘাংসা।

"খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না? পাঁচ বছর আগে আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল জানিস, যখন তুই পিছন থেকে আমার পিঠে রিভলভারের ছয়-ছয়টা গুলি নামিয়ে দিয়েছিলি। গুলি খেয়ে আমি অতটা ব্যথা পাইনি, যতটা ব্যথা আমি রিভলভারটা তোর হাতে দেখে পেয়েছিলাম। আমার রহস্যজনক মৃত্যুর আঘাত সহ্য করতে না পেরে আমার আদরের বোনটা গলায় দড়ি দিল, আর বিধবা মা'টা কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেল। স্নেহাও আমায় কত সহজেই ভুলে গেল, তাই না? তোর যে টাকার জোর ছিল, আমার তা ছিল না। কিন্তু আজ? এই খেলাটা যে পুরো আলাদা রে! এখন আমি এই সবকিছুর অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। আমি প্রতিশোধ চাই, শুধু প্রতিশোধ!"

অঞ্জন আর বেশিক্ষণ ধস্তাধস্তি করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারল না। কালীপুজোর ঢাকের শব্দে হারিয়ে গেল ওর চাপা গোঙানি। দম আটকে জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তেও ওর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রত্যুষের অতৃপ্ত আত্মার সেই পৈশাচিক হাসি। শেষবারের মতো মা-বাবার মুখটা মানসপটে ভেসে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাঢ় অন্ধকার নেমে এল দু'চোখ জুড়ে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

চোখ খুলল নিজের ঘরের বিছানায়। সকাল হয়ে গেছে। অঞ্জনের খাটের চারিপাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা-মা, স্নেহা এবং অন্যান্য কিছু আত্মীয়-স্বজন। ডাক্তার বাবু ওর হাতে একটা ইঞ্জেকশন পুশ্ করে বললেন-
"জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। এখন আর কোনও বিপদ নেই। কিন্তু ভয়ানক মানসিক চাপ গেছে তো, তাই সিডেটিভ দিয়ে দিলাম। আপনারা যান, ওনাকে একটু বিশ্রাম নিতে দিন। আমি এবার আসি; কোনও প্রয়োজন পড়লে আমাকে খবর পাঠাবেন।"

অঞ্জনের বাবা ডাক্তার বাবু কে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তারের আদেশ অনুযায়ী অন্যরাও ঘর থেকে একে-একে বিদায় নিলেন। রয়ে গেলেন শুধু অঞ্জনের মা। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-
"খোকা, কাল কী হয়েছিল আমাকে একটু খুলে বল তো দেখি। সারারাত তুই কোথায় ছিলি?"
"মা...." সিডেটিভের ঘোরে অঞ্জনের গলা বুজে আসছে, "কী হয়েছিল আমার তো কিছুই মনে নেই। আমি এখানে এলাম কীভাবে?"
"তোকে আজ ভোরবেলায় তোর বাবা ওই বট গাছটার নিচে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করলেন। স্নেহা বলল যে তুই নাকি একটা ফোন পেয়েই ছুটে বেরিয়ে গেছিলি। কিন্তু তোর মোবাইল ঘেঁটে তো ওই সময়কার কোনও কল খুঁজেই পাওয়া গেল না।"

এক মুহূর্তেই অঞ্জনের কাছে সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ও মা কে জড়িয়ে ধরে শুধু এইটুকুই বলল-
"মা, কাল প্রত্যুষ এসেছিল নিজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। পাঁচ বছর আগে আমি ওর সঙ্গে বেইমানি করে আমাদের বন্ধুত্ব কে কলঙ্কিত করেছিলাম। কিন্তু কাল রাতে আমায় বাগে পেয়েও সে আমায় শেষপর্যন্ত প্রাণভিক্ষা দিয়ে গেল। আবার প্রমাণিত করে গেল....ও আজও আমায় কতটা ভালবাসে।"

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror