Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Action Inspirational

4.3  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Action Inspirational

ফিরে আসা

ফিরে আসা

11 mins
668


ফিরে আসা

-শ্যামশ্রী কর্ম্মকার

-----------------------------

"তিথি ও তিথি ঘুম থেকে ওঠ অনেক বেলা হয়েছে "- মায়ের মিষ্টি ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তিথি অর্থাৎ তাথই এর।

বছর পঁচিশের সে। বহু চেষ্টার পরে সরকারি চাকরির পাওয়ার আসা ছেড়ে ও এখন বেসরকারি চাকুরীজীবি। বেসরকারী ব্যাঙ্কে চাকুরিরতা সে।বেতন মন্দ নয়, তবে কাজের চাপ খুব। টার্গেট আর টার্গেট। জীবনে ঠোকর খেতে খেতে টার্গেট অ্যাচিভ করাটা সে শিখে গিয়েছে।

কাল কিছু কাজ সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে যাবে জেনে আগে থেকেই তিথি তার মা রুমা দেবীকে বলে রেখেছিল।

আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরতে টেবিল ঘড়িতে দেখে সাড়ে আটটা। " বাপস্! মারাত্মক দেরি হয়ে গিয়েছে ওর"।

চটপট করে উঠে স্নান সেরে নিয়ে কোনমতে মুখে দিয়েই দৌড়। কপালটা খুব একটা মন্দ নয় আজ, মায়ের মুখ দেখে যে উঠেছে। সাথে সাথেই সরাসরি যাওয়ার বাসটা পেয়ে যায় ও।

চেপে বসে ৪৫ মিনিটের জন্য নিশ্চিন্ত। ১০ টা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই ব্যাঙ্কে পৌঁছে যেতে পারবে বলে মনে হয় ওর। বাসে সিট পেয়েও যায় আজ।

ভাবে মা নিজেও চাকুরিজীবি, স্কুল শিক্ষক, তবুও কোনদিন ওর আর ওর দাদার অযত্ন করেনি।কি করে সামলায় চারিদিক,ভাবলেও অদ্ভুত লাগে। বাবা পার্থবাবু মিউনিসিপালিটিতে ভালো পদে ছিলেন, বছর দুই হল অবসর নিয়েছেন, তবে তিনি বসে থাকতে চাননি, অনাথ বাচ্চাদের পড়ান, মা এসব বিষয়ে খুব সমর্থন করেন। শুধু সমর্থন বললে ভুল হবে এসব ভাবনা ভাবতে শিখেছেন বাবা মায়ের হাত ধরে। মা যে স্কুলের শিক্ষিকা তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা বেশ গরীব, তিথি দেখেছে তাদের অনেক ভালো ভালো জামা যে গুলো ছোট হয়ে যেত সেগুলো দিয়ে দিত ওদের। তার মা-বাবা দুইজনেই পোশাকের বিনিময়ে কিছু কেনা বা অকারণ অপচয় পছন্দ করতেন না। আর অনেকের বাড়িতে দেখেছে শৈশবের পোশাকও আলমারি ভর্তি করে জমিয়ে রাখতে কিন্তু তার মায়ের কথা তোদের তো আছে আরও হবে , বরঞ্চ তোদের দ্বারা কিছু মানুষের যদি উপকার হয়, পড়ে বাঁচে তবে আলমারি ভর্তি করে পচিয়ে লাভ কি? সত্যি তাই বুঝি ওর দাদাভাই আইন নিয়ে পাশ করার পরেও আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহন না করে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে গিয়েছে দেশকে ভালোবেসে।

এসব ভাবতে ভাবতে দেখে সে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি বাস থেকে নামে সে। ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে, না মিনিট ৩ আগেই পৌঁছে গিয়েছে সে।

তবে তার ভালো হলেও তার কলিগ বৃন্দার জন্য দিনটি বুঝি সত্যি খারাপ, সে আজ তার একটা টার্গেট অ্যাচিভ করতে না পারার কারণে তাকে চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিলো,তিথি জানে কারণটা, বৃন্দার মা অসুস্থ থাকার কারণে সে অফিসে আসতেও পারেনি। মায়ের মেয়ে সে, প্রতিবাদ তার রক্তে,অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাকে সে অন্যায়ের সমান মনে করে,রাগে গজরাতে গজরাতে সে প্রবেশ করল ম্যানেজার এর ঘরে, কোনো সময় না দিয়েই প্রবল প্রতাপের সাথে কথা গুলো বলে গেলো সে, সামান্য থামতেই অচেনা গলায় সে শুনতে পেলো "গলা নিশ্চয় শুকিয়ে গিয়েছে, জলটা খান"।

মুখ ফেরাতেই দেখতে পায় গলার মালিককে, হাতে জল নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। অচেনা একজন সুদর্শন যুবক,বয়স তার আশেপাশে।কিছুটা সঙ্কোচে পড়ে যায় তিথি, কি করবে বুঝতে না পেরে হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে একচুমুকে শেষ করে জলটুকু। তিথির ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে দয়াপরবশ হয়ে ম্যানেজার বাবুই উত্তর দিল "উনি নিপুণ সরকার, অডিটার, আমাদের অফিসে অডিট করতে এসেছেন "। তিথির সহজাত ভাবে হাত দুটি জোর হয়ে উঠে নমস্কার বলল। উনিও হেসে প্রতুত্তরে নমস্কার করলেন। ম্যানেজার বাবুও তিথির পরিচয় দিলেন। নিপুণ হেসে বললেন " তিথি দেবী আপনার বান্ধবীর কাজটি থাকবে আমি কথা দিলাম, এবার খুশী তো, রাগ কমেছে "। তিথি ধন্যবাদ জানিয়ে, স্মিত হেসে বেড়িয়ে গেল, যাওয়ার আগে একনজরে ম্যানেজার বাবুর দিকে তাকিয়ে বুঝলো যেন তার ঘাম দিয়ে জ্বর নামবার মতো অবস্থা।

সে জানে কেন ম্যানেজার বাবু তাকে সমীহ করে, মা যেখানে শিক্ষকতা করে সেখানকার প্রচুর মানুষদের তার হাত দিয়েই এখানে খাতা খোলা হয়েছে। তাছাড়া পরিবারের সুখ্যাতির গুনে অনেক ধনী ব্যক্তি এখানে বই খুলেছে আর নিয়মিত সেখানে লেনদেনও করেন। বৃন্দা সব শুনে তাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবে ভেবে পেলোনা।তিথি সামান্য হেসে বল্লো " পাগলি মেয়ে, এসব ছাড়, এখন বল কাকিমা আছেন কেমন? "। বৃন্দা বললো " সামান্য ভালো, তবে জ্বর আসছে মাঝে মাঝে, চাকরিটা চলে গেলে বড় বিপদে পড়তাম রে"।

দিনটি কেটে গেল, তিথি নিজের টিফিন থেকেই দিলো বৃন্দাকে। বেচারি খাওয়ারটাও আনতে পারেনি, কে দেবে ওকে।

এই মাঝে দুবার চোখাচোখি হয়েছে নিপুণ এর সাথে, কেবল একটা রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে, যা তার আগে কোনদিনও হয়নি।

অফিস থেকে বেড়িয়েই সে গাড়ি পেয়ে গেল আজ, সিট ছিল না, দাঁড়িয়ে পড়লো সে জায়গা করে, ভাবতে থাকে

" আসলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রেমের সুযোগ সে নিজেকে দেয়নি আর কারো সেভাবে তাকে এসে Propose করার সাহসও করেনি,কারণটা হয়তো তার পরিবারের পরিচিতি "।

হঠাৎ করে সামনের আসনে বসা ভদ্রমহিলার ডাকে সম্বিত ফিরে, উনি বলেন " মা সামনে নামবো, তুমি বসো এখানে "।

তিথি বসে বসে ভাবলো, কি হল আজ ওর? হঠাৎ প্রেমের কথা মাথায় এলো কেন ওর।নিজের মনেই নিজেকে শাসন করলো।

বাড়িতে পৌঁছে দেখে মা বাড়িতে ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগে আর বাবা বেড়িয়ে গিয়েছেন পড়াতে। এই সময়টা সে তার মায়ের সাথে কাটায়,পরিস্কার হয়ে হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে, মায়ের কোলে মাথা রেখে সব গল্প বলে, আজও তার ব্যতিক্রম হলো না,নিপুণের কথাও বাদ গেলো না। তবে তার অনুভূতিটা কিভাবে ব্যক্ত করবে না বুঝতে পেরে চুপ থাকলো। মায়ের মাথায় বিলি কাটার আরামে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানেনা। দেখে বাবা এসে গিয়েছে, তাকে ডাকছে খাওয়ার জন্য,দাদা তো অন্য রাজ্যে থাকে,খুব দাদাকে মিস করে।খাওয়ার সময় ভিডিও কলে কথা বলে ওরা, প্রায় প্রতিদিন।

খাওয়ার শেষ করে নিজের ঘরে শুতে গেল তিথি, রাত ১০:৩০, প্রতিদিন তাদের এই সময়ের মধ্যে খাওয়ার শেষ হয়ে যায়।

এতক্ষণ পরে মোবাইলটা হাতে নিল, সেই অফিসের ব্যগেই রয়ে গিয়েছিল মোবাইলটা।দেখে তাজ্জব বনে গেল।কয়েকশো মেসেজ What's app এ। "রাগ কমেছে ম্যাডাম?? না না ভুল হল মা দুর্গা "। " আবার রেগে গেলেন বুঝি? "যাই বলুন আপনার সাহস আছে মানতে হবে।" "তা ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলেন কেন আমায় দেখে?" "কি চুপ কেন?"।আরও অনেক কিছু লেখা। তিথি কি করবে না বুঝতে পেরে কেবলমাত্র বল্লো " বলুন আর রাগ করিনা আমি সবসময়"।

রিপ্লাই করার সাথে সাথেই উত্তর " কোথায় ছিলেন? কতক্ষণ থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি"। মিষ্টি হেসে উত্তর লিখলো "তাই???"। এভাবেই কতক্ষণ কথা চল্লো সে লক্ষ্যই করেনি, ঘড়িতে দেখে রাত দুটো। শুভ রাত্রি বলে,মুখে সামান্য হাসির রেখা এনে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরেরদিন ঘুম ভাঙতে ভাঙতে দেখে ৯ টা বেজে গিয়েছে, মাকে বল্লো ডাকো নি কেন? উত্তরে তিনি বল্লেন "অনেকবার ডেকেছি, তুই ঘুমাতে দাও বলে পাশ ফিরিয়ে শুয়েছিস"। না আজ তার দেরী কেউ আটকাতে পারবে না।

কোনমতে স্নান করেই না খেয়েই পা বাড়ালো অফিস যাওয়ার জন্য, দেখে মা আজ দুধ আর কর্নফ্লেক্স দিয়েছে, বললেন খেয়ে নে এটুকু।আর দুপুরের খাওয়ার আমি গুছিয়ে রেখেছি।এই হচ্ছে তার মা সবসময় তার পাশে। খাওয়ার খেয়ে মুখ ধুয়ে মায়ের গালে হামি খেয়ে টিফিনবক্স ঘাড়ে ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন।

ভাবতে থাকে কি করবে, ঘড়িতে ৯:৩০। বাস কখন আসবে কে জানে? হঠাৎ করে তার নামের ডাক শুনে মুখ তুলতে দেখে নিপুণ, গাড়িতে বসে, পেছনের গেট খোলা। বললেন " তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে আসুন,নইলে ঠিক সময় অফিসে কিন্তু পৌঁছাতে পারবেন না,তাছাড়া আমাদের গন্তব্যও তো এক"। সাত পাঁচ না ভেবে গাড়িতে উঠে বসলো সে।

"আচ্ছা আপনার গেস্ট হাউস তো এদিকে নয়, এদিকে হঠাত? " তিথির এ প্রশ্নের সাথে সাথেই জবাব দেয় "তোমার জন্য"। তারপর ঘুরিয়ে বলে " আসলে কাল আমার জন্যেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল আপনার, তাই ভাবলাম যদি দেরী হয়ে পৌঁছাতে।এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম আপনি থাকলে একসাথে যাওয়া যাবে"।

আর কিছু বললো না তিথি, নিপুণ পেছনে বসেছে, উনার সামনে বসার কথা। গল্প করতে করতে সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেল তারা অফিসে।

তিথি একটু আগেই নেমে গিয়েছিল একটা দরকারি জিনিস কেনার অজুহাতে।

ধীরে ধীরে ভালোলাগা তৈরি হলো তিথির মধ্যে, নিপুণ তাকে আড়চোখে দেখে অনেকের নজরে সেটা পড়লেও কিছু জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যেতো তিথি। এভাবে কেটে গেল একটা সপ্তাহ, এই ব্যঙ্কের কাজ শেষ। তবে বাকি ব্রাঞ্চ গুলোর কাজ বাকি মাস খানেন বা তার কিছু বেশী এখানেই তাকে থাকতে হবে। এই একসপ্তাহে তার জীবনধারা অনেকটাই পরিবর্তন হল, সে এখন অফিস থেকে ফিরে মায়ের কোলে শোয় না, শুলেও কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে যায়। প্রতিদিন নিপুণের সাথে অফিসে যায় আর অফিস থেকে ফিরে।

একদিন মা তিথিকে জিজ্ঞেস করলেন " কি ব্যপারে রে, অফিস থেকে গাড়ি পাঠাচ্ছে শুনলাম, প্রমোশন পেয়েছিস বুঝি"। এই প্রশ্ন যে আসতে পারে মাথায় আসেনি তিথির,কি উত্তর দেবে প্রথমে বুঝতে পারেনা। তারপর অনেক ভেবে উত্তর দিল, "আসলে আআমার ববন্ধুর গগাড়ি, ওর অফিস থেকে দিয়েছে,তাই ও বল্লো একসাথে যাওয়া যাবে।

" তোর কোন বন্ধু রে?,কিসের চাকরি করে?,কোথায় বাড়ি? "

এতোগুলো প্রশ্নবানে গলায় তার খাওয়ার আটকে যায়, কোনমতে বলে সে "তুমি চিনবে না,ব্যাঙ্ক অডিটার"।

"একদিন আসতে বলনা, মোড় থেকেই চলে যায় প্রতিদিন "।

" হ্যাঁ বলব "বলে না খেয়েই উঠে যায় তিথি। রুমাদেবী বলেন " কি রে কিছুই খেলি না যে"।

মুখ ধুতে ধুতে বলে "পেট ভরে গিয়েছে মা"। তারপর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।আজ পার্থবাবু বাড়ি নেই, গিয়েছে বোনের বাড়ি রঘুনাথপুরে, কাল সকালে ফিরবেন আর তিথির দাদা তিতাসের আজকে Night Duty তাই ফোনেই কথা বলেছ,Video Call করা সম্ভব হয়নি আজ তার।রুমাদেবী খেয়ে টেবিল পরিস্কার করে নিজের ঘরে চলে গেলেন, অবশ্য এই কাজটি তিথিই করে প্রতিদিন, "কি হয়েছে মেয়েটার প্রেমে পড়লো নাকি? এই মেয়ে প্রেমে পড়বে মনে তো হয়না, কি জানি কি হলো, অফিসের কাজের চাপ কি?"।

ঘরে গিয়েই মোবাইলে মেসেজ করে নিপুণকে, সব কথা বলে আর বলে যেন এই মোড়ে এসে না দাঁড়ায়, ও না হয় এগিয়ে যাবে। এক কথায় রাজি হয় নিপুণ। কাল রবিবার এই শহরটি ঘুরে দেখাবার অঙ্গীকার করেছে তিথি। রাতে ১১ টার মধ্যে ঘুমোনোর কথা ভাবছে, হঠাত মনে পড়লো কাল যে বাইরে যাবে মাকে তো জানানোই হয়নি, আসলে মায়ের প্রশ্নবাণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।যাইহোক কাল বেড়োনোর আগে জানিয়ে দেবে। তাও ঘুমোতে ঘুমোতে ১২:৩০ হয়ে গেল তিথির।

এলার্ম দিয়ে রেখেইছিল, তাড়াতাড়ি উঠে স্নান সেরে এলো, তারপর শুরু হলো কি পোশাক পড়বে এ নিয়ে জল্পনা। শেষ Black Denim Jeans আর একটা designer off-white tops পড়লো। সাথে Matching earring and pendant.

রুমাদেবী দেখে অবাক, " কোথায় যাচ্ছিস মা?"। সংক্ষিপ্তভাবে বল্লো "আমার একটা বন্ধুকে আমার শহরটা চেনাতে"। "তো দুপুরে খাবি না? তোর বাবা আসার পথে মাংস আনবে বল্লো"। তিথি বল্লো " আমারটা রেখে দিও রাতে এসে খাব,যাই মা"।

"আয়, তবে তাড়াতাড়ি ফিরিস আর এই চা বিস্কুটটা খেয়ে বেড় হ"। চা -বিস্কুট খেয়ে রুমা দেবীকে প্রণাম আর হামি খেয়ে বেড়িয়ে এলো তিথি, অফিস যাওয়ার সময় এই কাজটি করতে ভোলেনা সে ।না করা সত্ত্বেও মোড়ে এসে দেখে নিপুণ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে তিথি প্রশ্ন করলো " আপনি এখানে কেন? পরের মোড়ে থাকতে বলেছিলাম না?"।

নিপুণ গাল ফুলিয়ে বল্লো " এতোক্ষণ তো ওখানেই ছিলাম, তুমি না আসাতে এখানে এলাম"।

"আচ্ছা ঠিক আছে বলে ও সাথে সাথে গন্তব্যও জানিয়ে দেয় তিথি"।

আজকের দিনটি বেশ ভালো কাটলো তিথির,একটু অন্যরকম।

দেখতে দেখতে এভাবে ১ মাস কেটে গেল,ওরা প্রায় প্রতি রবিবার ঘুরতে বেড়িয়েছে। তবে তিথির বাড়ি আসতে বললে এড়িয়ে যেতো বারবার।আজ নিজের শহরে ফিরে যাবে নিপুণ। তিথির জীবনে প্রথম প্রেম। নিপুণকে সে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। নিপুণ সরাসরি না বললেও হাবভাবে বুঝিয়েছে তাকে ভালোবাসে।যাওয়ার সময় একান্তে ডেকে বল্লো " ভুলে যাবে না তো আমায়? ফোন করবে তো?" তিথির চোখে জল এসে গিয়েছিল, সেটা মুছিয়ে দিয়ে বল্লো "আমার হবে তুমি?"

তিথি চুপ। "উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম" বলে এগিয়ে গেলো সামনে।

এরপর কথা হতো ফোনে,ও হ্যাঁ, তিথি হ্যাঁ বলেছিল।চলতে থাকে তাদের প্রেম পর্ব। মাঝে মাঝে আসে নিপুণ, অনেক ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটায় ওরা।

একদিন হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যায় নিপুণ। হাজার চেষ্টা করে যোগাযোগ করবে পারে না তিথি। ধীরে ধীরে তিথি মন থেকে ভেঙ্গে পড়তে থাকে।খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। রুমাদেবী আর পার্থবাবু অসহায় হয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠায় তিতাসকে।তিতাস তিথির best friend দাদা। 

তিতাস নেমে পড়ে নিজের কাজে। যোগাযোগ করে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে। খোঁজ চালাতে থাকে। ১ সপ্তাহের মধ্যে খোঁজ মেলে। নিপুণ সরকার, পিতা সৈয়দ সরকার,বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। বিবাহিত ও দুই সন্তানের পিতা এবং স্ত্রী গর্ভবতী,তিথি যত কম বয়স ভেবেছিল তা নয়। তিথি যে ব্যাঙ্কে কাজ করত, সেই ব্যাঙ্কের মালিকপক্ষ নিপুণের কম্পানীকে অডিটের দায়িত্ব দিয়েছিল,সেই যোগসূত্র থেকেই খোঁজ মিলেছে। নিপুণ জানতো না তিতাস IPS officer,কারণ রুমা দেবী বিরক্ত বোধ করত। চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতে মেয়ের বাবারা সম্বন্ধ নিয়ে আসতো তাই তিনি নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে বলতে বারণ করেছে। আর তিতাস দাদার পরে চাকরি পায় তাই অফিসেও বৃন্দা ছাড়া কেউ জানতো না।

তিতাস যখন তিথির পরিচয় দিয়ে দেখা করতে যায়, তখন নিপুণের বাবা বলেন "দেখুন আমার ছেলে আপনার বোনকে ভালোবাসে, আর আমার ছেলে আপনার বোনকে বিয়ে করতে রাজি,তবে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করতে হবে আর দুটো বাচ্চা নিয়ে বৌমা কোথায় যাবে? আর যাবেই বা কেন? আমাদের আইনে একাধিক বিয়ে চলে"।

নিপুণকে প্রশ্ন করে তিতাস " বিয়ের আগে কেন ঘনিষ্ঠ হয়েছ? আর যদি ভালোই বাসো তবে blackmail করে কেন ঘনিষ্ঠ হলে? আর সবচেয়ে বড় কথা সত্য গোপন করলে কেন? বলোনি কেন তুমি বিবাহিত? ২ সন্তানের পিতা?"।

তিতাস আগেই তিথির কাছে শুনেছে শেষের দিকে নিপুণ নাকি টাকা চাইতো, নইলে পালিয়ে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতো।বলতো অনেক ভিডিও ও ছবি আছে তার কাছে।সোস্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেবে।

নিপুণ চুপ করে ছিল, পঞ্চান্নর সৈয়দ উত্তর দিলেন " আচ্ছা আমার ছেলেকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আপনার বোন কি কচি খুকি নাকি?আমি ওর বাবা হয়ে বলছি আমি বিয়েতে রাজি,আপনার অসুবিধা কোথায়? "

আর কথা বাড়ায় না তিতাস, সব রেকর্ড করে নিয়েছে সে রেকর্ডারে।

নিপুণকে গ্রেফতার করা হয়,সব ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের ছবি নষ্ট করে দেওয়া হয়। আইনি লড়াই লড়ে জেল হয় নিপুণের,তবে একদম ভেঙে পড়ে তিথি।চাকরি ছেড়ে দেয়। মরমে মরতে থাকে,তারজন্য তার মা-বাবার উঁচু মাথা নিঁচু হলো। নিজেকে অশুচি মনে হয় তার।তিতাস তিথিকে নিয়ে চলে যায়, ওখানে গিয়ে কাউন্সিলিং করায়, আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিল কয়েকবার।তবুও তিতাস হাল ছাড়েনা।বিভিন্ন কেসের গল্প বলে,ঘুরতে নিয়ে যায়।সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে তিথি বুঝতে পারে তার কোনো দোষ নেই, তাকে ঠকানো হয়েছে। সে তো কেবলমাত্র ভালোবেসে ছিল, একজনকে বিশ্বাস করেছিল।

দাদার কর্ম্মকান্ড শুনতে শুনতে তারও ইচ্ছে হয় দাদার মতো দেশসেবা করবে। আগে এই কাজটাই তার একদম ভালো লাগতো না।এখন যেন এটাই তার লক্ষ্য।

এরপর কেটে গিয়েছে দুইটি বছর, অক্লান্ত পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্পের ফলে সে আজ WBCS দিয়ে যোগদান করবে।সে ইচ্ছে করেই WBCS বেছেছে।দাদাটা সারাজীবন বাইরে বাইরে, মা-বাবাকে কে দেখবে? আজকে আবার বাবা-মাকে প্রণাম করে, মাকে হামি দিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে, সাথে তার মা-বাবার সাথে,দাদা আর বৌদি। বৌদি আর কেউ না বৃন্দা। ওই ঘটনার পর সত্য উদঘাটন থেকে শুরু করে, অসময় পাশে থাকা, তিথির জন্য সমাজের সাথে লড়াই করা এমনকি তিথিকে নিয়ে তিতাসরা চলে গেলে বৃন্দা সবসময় খেয়াল রাখতো রুমাদেবী আর পার্থবাবুর।

আর এরমাঝেই একসময় বৃন্দার দাদা অসুস্থ মা আর বোনকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো তখন রুমাদেবীই আশ্রয় দিয়েছিল ওদেরকে। আসলে তিথির জন্যেই চাকরি চলে যায় বৃন্দার। তিথির পাশে দাঁড়ানোর জন্য। থাকা খাওয়ার খরচ দিতে পারবে না জেনে বাড়িতে স্থান হয়নি মা-মেয়ের।এখানে এসে টিউশন করে আর পার্থবাবুর পরিচয়ের সুবাদে মিউনিসিপালিটিতে চাকরি জুটে যায়। তারপর এই বাড়িতেই নিচের ঘরগুলোতে থাকত ওরা। তবে না ভাড়া নিতে পারেনি কোনদিন রুমা দেবীরা। রুমা দেবীর বাড়িতেই মারা যান বৃন্দার মা, ততদিনে রুমাদেবী আর পার্থবাবুর ইচ্ছাতে আইনি বিয়েটা সারা হয়ে গিয়েছিল বৃন্দা আর তিতাসের। তবে জোর পূর্বক নয় তিতাস আর বৃন্দার সম্মতিতেই।

এদের একটাই ইচ্ছে ছিল যেদিন তাদের প্রিয় মানুষটির স্বপ্ন পূরণ হবে, তারপর ওরা সামাজিক বিয়ে করবে। তাই দিন পনের হলো সেই শুভ কাজটি সারা হয়েছে তিথির চাকরিটি নিশ্চিত হওয়ার পরে।

আজ তিথির পরিবারের সাথে মাথা উঁচু করে পাড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো না আবার মা-বাবার উঁচু মাথা আবার উঁচু করতে পেরেছে সে। ফিরে এসেছে তার সম্মান। ফিরে পেয়েছে নিজেকে।

একটা আঘাত মানেই ভেঙ্গে পড়া নয়, সেই আঘাত থেকে শিক্ষা নেওয়া।

আজ সে মনে করে প্রতিটি মানুষ জন্ম নেয় নির্দিষ্ট কাজ করবার লক্ষ্যে।

~সমাপ্ত~


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action