One Trip ( পর্ব - নয়)
One Trip ( পর্ব - নয়)
" কাকিমা চিনতে পারছেন?" বলে প্রণাম করে রুমা।
" থাক থাক, তা কে মা তুমি?
" আমি রুমা কাকিমা,আগে এসেছি শান্তার কাছে নোট নিতে, তা চিনতে পারছেন না মনে হয়। "
তিনি কি বললেন বোঝা গেল না।
" আমি আজই ফিরেছি, ফিরেই আগে এখানে এলাম। শান্তর জন্মদিনে আসতে পারিনি। "
উনি মুখে কাপড় দিয়ে চলে গেল। এমন ব্যবহারের কারণ বুঝতে পারলো না। ও বসার ঘরে চুপ করে বসে রইলো। কেমন থমথমে পরিবেশ।
একজন ত্রিশ বত্রিশের মহিলা বাইরে থেকে ঘরে এসে রুমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
" আপনি... ঠিক চিনতে পারলাম না.. তবে চেনা চেনা লাগছে।"
" আমি রুমা শান্ত মানে শান্তার বান্ধবী।"
" ও আপনি দিভাইয়ের বান্ধবী রুমা, তাই চেনা মনে হচ্ছিলো। আপনাদের ছবিগুলো নিজেও দেখতো আর আমাদের দেখাত সবসময় অর্চনাদি আর সীমাদি ছিল ওর জন্মদিনে। বাকিদের বড় আশা করেছিল। জীবনে কোনো দিনও জন্মদিন পালন করা হয়নি ওর। তার ইচ্ছের মতো পালন করতে চেয়েছিল। কিন্তু হলো কি মন মতো? সব কি মন মতো হয়? তবে ওর সব প্রিয় বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে যাবার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিল তাই অনেক। "
" আমাকে হঠাৎ বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যেতে হয়েছিল। "
" তা শুনেছি সীমাদির কাছে।"
" আচ্ছা তুমি কিছু মনে করোনা, তুমি কি শান্তার বোন? "
" বোনই বটে, তবে সম্পর্কে ভাইবৌ।"
" ও তুমি? তোমার কথা বড্ড বলতো। বড় ভালোবাসে তোমাকে।"
" আমার দিভাই ওমনি, সবাইকে ভালোবাসে, বান্ধবীদের কি কম ভালোবাসে? কিন্তু বহিঃপ্রকাশ কম, তাই দিভাইকে কেউ বুঝতে পারেনা।"
রুমা কথাটা শুনে অস্থির হয়ে বলল "আর ওকে তো দেখছিনা, অবশ্য এই বাড়ি ছাড়া ওর কোনো বাড়ি চিনিনা। তা ও থাকে কোথায়? "
" দিভাইয়ের আর্মি ক্যাম্পের কাছে কোয়ার্টার থাকলেও এই বাড়িতেই থাকে, তাছাড়া এখন ওকে একা রাখতে চাইনা। যে কটা দিন..."
" কেন কি হয়েছে? "
" কেন আপনি জানেন না কিছু? "
রুমার কেমন সংকোচ লাগলো জানেনা কথাটা বলতে।
" হু জানি, আজ আসি.."
" যাবেন এখুনি? কিছু মুখে দিলেন না।"
" আমি আছি রায়গঞ্জে, আবার আসব।"
" কিছু মুখে দিয়ে যান, দিভাই শুনলে কষ্ট পাবে।"
রুমা হাতে হাত রেখে বললো "আজকেই শেষ নাকি? যাওয়া আসা লেগেই থাকবে। "
আর ওকে বাধা দিলোনা নিলা।
রুমা বাইরে বেড়িয়েই প্রথমে সীমাকে ফোন করেও না পেয়ে অর্চনাকে ফোন করলো।
" অর্চনা কি বলছিস তুই? আমি জানতাম না রে, আমার সাথে কি ওর দেখা হবে না?.. "
" জানিনা রে, তবে তুই একা না মালাও উত্তরাখণ্ড থেকে আসতে পারেনি শ্বাশুড়ির অসুস্থতার জন্য, আর স্বপ্না সিমলা গিয়েছিল। "
" আমি রায়গঞ্জ এসেছি জানিস.."
" লাভ তো নেই, ওরা তো মনে হয় কলকাতায় আছে।"
" জিজ্ঞেস করতে পারে নি রে.."
" কি করবি এখন? "
" ভাবছি যাব.."
" একা?"
" ভেবে দেখি... রাখি তবে.. "
" আমি যাব তুই যদি ব্যবস্থা করতে পারিস.."
রুমা খুশী হয়ে বললো " যাবি তুই সত্যি যাবি?"
" হ্যাঁ যাব... আমার জন্য যা করেছে ও।"
" কি করেছে?"
" আমার ছেলে-মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওর স্কুলে,সব খরচের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে।সামান্য কিছু হয়তো লাগবে দিতে হঠাৎ কখনো হলে। আর জানিস প্রতিবন্ধীরা যে সরকারি সাহায্য পায়, সেটার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে আমার স্বামীর জন্য।"
" কি সত্যি।?"
" হ্যাঁ রে... আমি ওর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব রে।"
" সবার জন্য ভাবে... জানিস দীঘা থেকে ফেরার আগের দিন ও আমার সাথে একটানা ঘন্টা দুয়েক কথা বলেছিল। ওর বুদ্ধিতেই আমি ভর্তি হয় নাচের ক্লাসে। ওই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমাকে যে নাচ শেখাতো সে ওর স্কুলের প্রথম ব্যচের ছাত্রী। আমাকে খুব যত্ন নিয়ে শেখাত, initial খরচটা ও দিয়েছিল। অবশ্য আমি পরে মিটিয়ে দিয়েছিলাম। তবে এখন যতই মেটাই, আসল সময় ও আমার পাশে ছিল, যখন আমি অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলাম। আর আমি কিনা এতোটা স্বার্থপর হয়ে গেলাম ওর জন্মদিনেই কাজের অজুহাতে এলাম না।" বলে কান্নায় ভেঙ্গে পরে রুমা।
" আরে কাঁদিস না, ও তোর উপর রাগ করেনি বিশ্বাস কর। তোর উন্নতিতে ও খুব খুশী হয়েছে। তোকে যে নারী দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র নৃত্য বিভাগ থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল সেটা জেনে ওর চোখে মুখে আমি আনন্দাশ্রু দেখেছি।"
" আমি জানি ও খুব খুশী হয়েছে। আমরা কি ওর জন্য কিছু করতে পারি না?"
" কি করতে পারি জানিনা, তবে জানিস ইচ্ছে করে খুব ওর জন্য কিছু একটা করি।"
রুমা " হু" বলে একটা ছোট শ্বাস ছাড়ে।
_______
" আরে তোরা এখানে? "
" সীমা তুই কলকাতায় চলে আসতে পারিস আমরা আসতে পারব না? কি ভাবিস আমাদের?"
সীমা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
মালা সজল চোখে বলে "আমাদের কিছুই জানালি না তুই? পারলি এমন করতে?"
" উনার দোষ নেই, শনুই চায়নি কেউ জানুক।"
শান্তার স্বামী মৃণাল কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা কেউ লক্ষ্য করেনি।
" আপনি? "
" উনি শান্তার স্বামী... "
" শান্তা..."
" আপনারা আমাদের ফ্ল্যাটে চলুন, বিকেলে আসবেন। এখন দেখা করতে দেবে না। একটু সমস্যা হবে এতোজনের। তবুও যদি...."
" কি যে বলেন আপনি! আমরা কি এখানে আনন্দ করতে এসেছি। "
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা মৃণালের ফ্ল্যাটে চলে এলো। ফ্ল্যাটে এসে দেখে মৃণালের মা-বাবাও রয়েছেন আর বাচ্চা দুটোকে খাওয়াচ্ছেন,দেখে ওদের চোখে জল চলে এলো। দুধের শিশু।সীমাকে দেখে বাচ্চাদুটো দৌড়ে চলে এলো। সীমা কোনো মতে নিরস্ত্র করলো, হাসপাতালের পোশাক যে ওর পড়ণে। ভেতরের ঘর থেকে শান্তার বাবাকে উৎকন্ঠিত ভাবে আসতে দেখা গেল।
" বাবা মৃণাল ডাক্তার... " বলেই এতোজনকে দেখে থেমে গেলেন।
অর্চনা এগিয়ে গিয়ে উনাকে প্রণাম করে বললো "চিনতে পারছেন কাকাবাবু?"
" মা তুমি... আমার মেয়েটা" বলে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
" আপনি শান্ত হোন কাকাবাবু, শক্ত হোন। বাচ্চা দুটোর কথা ভাবুন।"
উনি কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো দেখে কিছু বুঝতে পারছেন না উনি।
______
" আসব?"
" আপনি? "
" আমার নাম স্বপ্না..."
" হ্যাঁ আমি চিনি আপনাকে, আপনার কথা শুনেছি শনুর মুখে। "
" আচ্ছা আপনারা কবে জানতে পারলেন?"
মৃণাল ছোট করে একটা শ্বাস ছাড়লো।
" আপনারা তো জানেন ও কেমন চাপা.... অনেক আগে থেকেই নাকি পেট যন্ত্রণা করত। ও কাউকে কোনো দিনও বলেনি। দাঁত চেপে সব কাজ করে যেতো।।ঘর বাহির সুচারুভাবে সামলাতো। আপনারা যে সময় ঘুরতে গেলেন সেবার প্রথম ও নিজের জন্য কিছু চাইলো আর সেই প্রথম ছেলে মেয়ে দুটোকে একা রেখে কোথাও যেতে চাইলো। আমি অবাক হলেও খুশী হলাম। আমার কি মনে হয় জানেন ও মনে হয় জানতে পেরেছিল কিছু। কারণ তার মাস দুই আগে ও দিল্লিতে একটা মিটিংয়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল এই খবর প্রথমে পেলেও পরে ফোন করে তেমন কিছু জানতে পারিনি। পরে আমার মনে হয়েছে সেসময় ধরা পড়েছিল হয়তো রোগটা। কারণ সেখান থেকে আসার পরে থেকে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে কোয়ার্টার ছেড়ে ওর বাড়িতে এসে উঠেছিল। নিজের কাছেও কম রাখত৷ আমার কেমন কেমন লাগত বিষয়টা। আগে অবশ্য অনেকটা সময় দিদা আর মামির কাছে কাটালেও রাতটা থাকত ওরা আমাদের কাছেই। রাতেও ও বাচ্চাদের আমাদের কাছে রাখত না। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চায়, না তারপর ভুল ভাঙলো যেদিন দেখলাম ও একা তিনতলায় চিলেকোটায় চলে গেল। কিছু বললে বলতো খাতা দেখতে হবে। আমার কেমন কেমন লাগতো ওর এমন ব্যবহার। "
" তারপর... "
" তারপর আর কি গেল হঠাৎ করে ঘুরতে গেল তোমাদের সাথে। ফিরে এসে তিনদিন ছুটি নিলো, কেন বুঝতে পারলাম না। সারাদিন চিলেকোঠার ঘরেই পরে থাকে। একদিন দেখি বেলা ১০টা হয়ে গিয়েছে ও তখনও উপর থেকে নামেনি। আমরা সবাই মিলে উপরে গেলাম। দরজা ধাক্কা দিলাম সারা নেই। আমি আর ভাই মিলে দরজা ভাঙলাম। দেখি ও নীচে জ্ঞান হারিয়ে পরে রয়েছে। গা দেখি বেশ গরম।চোখে জল দিতে চোখ মেলে তাকালো ও। আমি ডাক্তার ডাকতে চাইলেও ও বারণ করলেও ওর ভাই শুনলো না। জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এদিকে ওর এতোটাই অসুস্থ ও পথেই জ্ঞান হারিয়ে আমার কোলে ঢলে পড়েছে। আমি তখন মনে মনে বেশ একটা শঙ্কা এসে গিয়েছে। ডাক্তার ওর অবস্থা দেখে সেদিনই কলকাতায় পাঠিয়ে দিলো। ওর ভাই আর আমি কিছু না ভেবে ওকে নিয়ে চলে গেলাম কলকাতা। । ধরা পড়লো ওর Stomach Cancer এর শেষ পর্যায়।আর এটাও ধরা পড়লো Ulcer থেকেই এই ক্যান্সার হয়েছে। তারপর প্রায় দিন সাতেক পরে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমার সব হারিয়ে। ওকে মুম্বাই নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, ও রাজি হয়নি, বলেছে 'লাভ নেই আমি জানি, দিল্লিতে জানতে পেরেছিলাম। আমার মশালাদার খাবার চলবে না। কিছু কিছু নিয়ম মানলে আছি কিছুদিন।' কি বলব বলেন ও বড় স্বার্থপর একবারও ভাবলো না আমি কি করে থাকব?"
স্বপ্না চুপ করে বসে রয়। অবাক হয় এই ভেবে ও এতাটা যন্ত্রণা চেপে দীঘাতে সবার সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরেছে, বাইরের খাবার খেয়েছে, একবারও বুঝতে দেয়নি। ফিরে এসেও ও যখন বাড়ির পরিস্থিতির কথা বলেছে, তখন উকিল পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছে, একবারও নিজের যন্ত্রণার কথা জানতে দেয়নি। আজ সবাইকে সুখী করে চলে যাচ্ছে সবাইকে কাঁদিয়ে। স্বপ্না আর বসে থাকতে পারে না। ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসে, দরজার কাছে বাকি বান্ধবীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওদের জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।
বি:দ্র:- পরের পর্ব অন্তিম পর্ব