Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Inspirational

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Inspirational

One Trip( পর্ব - পাঁচ)

One Trip( পর্ব - পাঁচ)

12 mins
432


" কি অসাধারণ লাগছে না রে সমুদ্রটাকে দেখতে, যেন তুলি দিয়ে আঁকা ছবি। "

সীমার কথাটা শুনে শান্তা বলে " চিত্রশিল্পীরা তো প্রকৃতিকে দেখেই ছবি আঁকে।"

স্বপ্নাকে মালা বল্লো "একটা গান ধর না, কি ভালো গাইতিস।"

" ওসব কবেই চুকেবুকে গেছে রে, সংসার নারীদের দেয় যতটা না কেড়ে নেয় তারচেয়ে বেশী। "

" তুই কি সুখী নোস স্বপ্না?"

" সুখী নই কি করে বলি বল, সবারটা শুনে মনে হচ্ছে আমি সুখীই। বাদ দে না এসব। চল কিছু একটা কিনে খাই।"

" কি খাবি?"

" যা হয় বসে বসে খেতে খেতে গল্প করতে বেশ লাগবে।"

বলে একজন বাদাম বিক্রেতাকে ডেকে সবাইকে কিনে দেয়।

এবারে অর্চনা বলে "শান্তা তোর বিয়েটা ঠিক কবে হয়েছে রে?"

" এই তো হলো বছর ছয় সাত। "

" তুই আমাদের চেয়ে সবচেয়ে দেরি করে বিয়ে করেছিস।"

" হবে হয়তো, আমি তো বিয়েই করবো না ভেবেছিলাম। "

" তাহলে করলি যে..."

শান্তা লজ্জিত মুখে মুচকি হেসে বলল " ওই আর কি.."

" ওই আর কি বলে লাভ নেই, বলতেই হবে, বল বল।"

সবাই জোর করতে সে লজ্জিত মুখে বললো " সে অনেক কথা, অনেক সময় লাগবে... "

" আরে আমাদের কাছে বল বল।"

সীমা বললো "শান্তার এই রূপ প্রথমবার দেখলাম রে। ওই মানুষটা কে যার জন্য এই রূপটা আমরা দেখতে পেলাম।"

" ধ্যাৎ, মার খাবি বুড়ী বয়েসে। "

" সে মার,তার আগে বল আগে শুনি.."

" আচ্ছা বলছি, তবে কথা দে পেছনে লাগবি না। "

" তোকে বিশ্বাস নেই সীমা.."

"আরে ওর হয়ে আমরা কথা দিচ্ছি, এবার বল।"

বলছি বলে গলা পরিস্কার করে বলতে শুরু করে " ওর সাথে আমার পরিচয় কলেজ যাবার পথে। ও তখন পলিটেকনিক কলেজে পড়ে। আমি আর ও একই বাড়িতে পড়তে যেতাম।সে পড়ত যে ম্যাডামের,আমি উনার স্বামীর কাছে পড়তাম। আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল নোটস জেরক্স করার সুবাদে, তবে আমার দিক থেকে ছিল কেবলমাত্র বন্ধুত্ব, কিন্তু সে নাকি তখন থেকেই পছন্দ করতো। আমি মাস্টার্স করলাম, তারপর বি.এড, এম.এড। ওর সাথে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হতো, আমি ক্ষেপাতাম ওই বান্ধবী কয়টা হলো কি এসব নিয়ে। ও তেমন কিছু না বলে খালি বলত ধ্যাৎ।আর বলত আছে একজন সময় হলে জানতে পাবি। আমি জোর করিনি জানতে,কারণ কারো বিষয় নিয়ে আমার আগ্রহ কম।তারপর আমি নিজের সিন্ধান্তেই আমি সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম, এমনকি ওর সাথেও। খালি মুখ গুঁজে চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। এরমাঝে ও এমটেক শেষ করে একটা সরকারি পলিটেকনিক কলেজের অধ্যাপক হয়েছে। আর হয়েছে আমাদের রায়গঞ্জেরই। আমি সেসব জানিনা, কি করেই বা জানব। আমি তখন অন্য লড়াইয়ে ব্যস্ত। ওর মুখে শুনেছি চাকরি ও পলিটেকনিক পাশ করে বা বিটেক শেষ করেই পেয়ে যেতো। কিন্তু বাড়ির বড়রা বিয়ে নিয়ে জোর করত, তাই ও এমটেক করে। তারপর কলেজে চেষ্টা করতে থাকে, শেষে পেয়ে যায় এই চাকরি। ওর বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল, তবে ব্যবসায়ী পরিবার। তবে ওর মামাবাড়ির পরিবার চাকুরীজীবি, ওর দাদামশাই একজন ঊচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন আর দিদিমাও একটা স্কুলে পড়াতেন।আর ঠাকুরদার ছিল তিনপুরুষের সোনার ব্যবসা। ওর বড়দা আর ওর বড় জ্যাঠামশাই এর দুই ছেলে এবং ছোট কাকার একমাত্র মেয়ে মিলে এখন ওই ব্যবসাটা দেখে। হালিশহরে ওদের বিশাল নাম-ডাক। ওর বাবাও এই ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন,সবে বার্ধক্যজনিত কারণে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যবসা সঁপে দিয়েছেন। তবে আমার শ্বাশুড়ি মাতা মায়ের মতো একজন শিক্ষিকা ছিলেন। ও বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো ছিল দেখে ওকে ওর মতো থাকতে দিয়েছে। ওকে কোনো দিনও অর্থকষ্ট কি বুঝতে হয়নি, লেখাপড়ার খরচ নিয়েও তাই ভাবতে হয়নি ওকে। ও অনেক ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে শেষে না পেরে কিভাবে ঠিকানা জোগাড় করে আমাদের বাড়িতে আস। বাবা আমাকে আমার ঘর থেকে ডেকে পাঠায়, সাধারণত আমি নিজের ঘর ছেড়ে কম বের হতাম। আমি তো ওকে দেখে অবাক আর ও আমার চেহারা দেখে অবাক। তখন আমি অনেক রোগা হয়ে গিয়েছিলাম আর চোখের তলায় কালি। আমাকে দেখেই বলে ' কি শান্তা একি চেহারা হয়েছে তোর? কোনো রোগে পড়েছিস নাকি?'

আমি ওকে দেখে এতোটাই ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলাম প্রথমে কথা বলতেই পারিনি।

' কি রে ভুত দেখার মতো চেয়ে আছিস কেন?' আমি খালি অস্ফুট স্বরে বলেছিলাম 'তুই এখানে? ' ও আমার দিকে কেমন একটা অভিমানমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো 'আমি তোর শহরে চাকরি পেয়েছি সেটা জানাতে কত ফোন করেছিলাম, তোর ফোন তো দূর কোথা থেকেও তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি, তুই হঠাৎ করে ডুমুরফুল হয়ে গিয়েছিস, সেদিন তোকে হঠাৎ দেখেছিলাম দূর থেকে। তুই ছিলি রাস্তার ওপারে, ডাকার আগেই তুই কোথায় হারিয়ে গেলি। তখন বুঝতে পারলাম তুই শহরেই আছিস, ভাবলাম তোর বাড়িতে গিয়েই খবরটা দিয়ে আসি।' আমি কি উত্তর দেবো জানিনা। বাবা বাজারে বের হচ্ছিলো, ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওকে সামনাসামনি না চিনলেও, নাম ধাম জানে। পরে শুনেছিলাম ও এসে বাবাকে প্রণাম করে ওর পরিচয় দিয়েছিল।

' তোরা গল্প কর, আমি বাজারটা সেরে আসি। তা বাবা আজকে দুপুরে যা হোক খেয়ে যাবে কিন্তু। ' ওর উত্তরের সময় না দিয়ে বাবা বেড়িয়ে গেল। ইদানীং বাবা একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছে। অবসরের পরে বাড়িতে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো।

একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললাম 'তা এসেছিস খুব ভালো করেছিস,বস তুই যাই গিয়ে চা নিয়ে আসি। ' ও আমার হাত ধরে বসিয়ে বলল 'ধুর এসব ছাই কে চা খেতে চাইছে? আগে বল তোর এমন চেহেরাটা হয়েছে কেন?' এমন সময় মা হাতে খাবার নিয়ে বসার ঘরে আসতে আসতে বলে ' তা বাবা হবে না? সারাক্ষণ নিজেকে ঘর বন্দী রেখে পড়ে চলেছে। ওর দোষ দিইনা, কি পরিস্থিতি বলো, চাকরির কি আকাল পড়লো। যাও বা হচ্ছে সেসব লাখ লাখ টাকার বিষয়।' তারপর খাবারের পাত্রটা টেবিলে রেখে চোখ মুছে আমার মাথায় হাত রেখে বললো 'মেয়েটার আমার একটাই স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। ঈশ্বর কবে মুখ তুলে চাইবে কে জানে?' আমি বিরক্ত হয়ে বললেম ' আহ্ মা কি শুরু করলে? ও প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এসেছে, ভালো ভালো কথা বলো, তা নয় দুঃখের পাঁচালী খুলে বসলে।' ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো 'তুই থামত, প্রথমবার এসেছি মানেই এই না যে শেষ আসা। আমি মাঝেমধ্যেই আসব,বাড়ি থেকে এতোদূরে থাকি বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে মুখটা আর মুখে নেই। কাকিমা আসলে রাগ করবেন না তো?' মা তো ওর কথা শুনে একদম গলে জল, বলে ' অবশ্যই আসবে, তুমি, বাবু আর সনু কি আমার পর? এই নাও এই খাবারটুকু খেয়ে নাও, সবটা খেতে হবে কিন্তু ' ও খাবারগুলোর দিকে 'এগুলো আমার জন্য? ' বলে এমন একটা হাসি দিলো, মা তো হেসে ফেলে বললো ' হ্যাঁ তোমারই, আর লাগলে বলো।' দন্তবিকশিত করে বলে ' হাত ধবো কোথায়? ' বেসিন দেখিয়ে দিতেই হাত ধুয়ে খেতে শুরু করে, আমি ওর কান্ড দেখে হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনা। লোকে যে ওকে হ্যাংলা ভাবতে পারে ওই দিকে খেয়াল নেই। তারপর হঠাৎ খাওয়া থামাতেই মা বলে 'কি হলো বাবা? কিছু লাগবে?' ও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো 'এটা তো আমার খাবার হতেই পারেনা, আমি তো সবে এলাম। আপনি না খেয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছেন না তো?' মা হেসে বলল 'এসব তোমারই, তুমি তো দীপুর কাছে থেকে ফোন করে বাড়ির ঠিকানা নিয়েছিলে কাল আর বলেছিলে রবিবার সকালে আসবে। ফোন করে আমাকে বলেছিল। মেয়ের ফোন পায়না তাই সবাই আমাকেই ফোন করে। তুমি আসছো বুঝতে পেরেই ভেজে নিলাম লুচি গুলো। ' এবারে হেসে পেটুক বলে কি, ' বাঃ বেশ, আর দুটো হবে কি?' মা খুশী হয়ে এখুনি আনছি বলে রান্নাঘরে চলে গেল। মা খাওয়াতে খুব ভালোবাসে। আমি নীরবে ওর কাণ্ড দেখে যাচ্ছি। কে দেখে বলবে ও প্রথমবার এসেছে এই বাড়িতে। ও তারপর মাঝে মাঝেই আসতো। এটা ওটা নিয়ে আসত। মা-বাবাকে কারো কাছে থেকে সামান্য কিছু নিতে দেখিনি, কিন্তু কেমন ভাবে ও বাবা-মায়ের মন জয় করে নিয়েছিল জানিনা। এমনও দেখেছি ইটাহার দূর্গাপুরে স্বামীনাথনের মেলায় যাবার ইচ্ছে মা হয়তো কথায় কথায় প্রকাশ করেছে, ও ব্যটা বাইক নিয়ে হাজির। মাকে দেখাতে নিয়ে চলে গেল। মা রাজি না বলাতে মুখ ভারি করে বলে 'ধুর কত আশা নিয়ে এসেছিলাম, ভাবলাম মেলাটা দেখে আসি।কার সাথে যাব বলো?' আগে আপনি বললেও পরের দিকে মাকে তুমি বলত আর মাকে বলত ওকে তুই বলতে। মায়ের সংকোচ হলেই ও গাল ফোলাত। মা যদি বলত 'একটা বিয়ে করো বাবা..' মুখটা কালো করে বলত ' আমি বাড়ি থেকে এজন্য পালিয়ে এসেছি, তুমিও কি চাওনা কাকিমা আমি তোমার কাছে আসি? তাড়িয়ে দিতে চাও তুমি? তাহলে বলে দাও সোজাসুজি। ' মা তখন আর কি বলবে চুপ করে যেত। এমন করে চলছিল, ভাইকেও কেমন করে পটিয়ে নিয়েছিল। আগে যেমন দুই-ভাইবোনে ঘুরে বেড়াতাম। তেমনি বাড়ি আসলেই দুইভাইয়ের মতো ঘুরে বেড়াত। ঘুরতেও নিয়ে গেছিল দার্জিলিঙয়ে। ও আসার পরে বাড়ির থমথমে পরিবেশটার অনেকেটা পরিবর্তন এসেছিল,কেমন একটা ইতিবাচকতা অনুভব করতাম। ওর সাথে কথা বলে জোর পেতাম মনে। আর বাড়ির লোকগুলোর মুখে হাসি দেখে আমার মনের ভয়টা কাঁটতে শুরু করে,ওর পরে বছর দুইয়েকের মাথায় চাকরিটা পেয়ে যাই। ও যে কি খুশী হয়েছিল কি বলব, কত মিষ্টি এনেছিল জানিস না। আমি বারণ করলে মুখটা কালো হয়ে যেতো। ওর কালো মুখ দেখলেই ভাবত আমি ওকে কিছু বলেছি, আমাকে মা বকতে আসলে, ওই আমাকে বাঁচাত, আর সত্যি বলতে আমি ওকে রাগ করে অনেক কিছু কথা শুনিয়্ব দিতাম। বলতাম এসব না করতে। শুনত না। আমার ভয় হতো যদি লোকে কিছু উল্টো পাল্টা লটায়। ও এতো ভালো চাকরি করে, আর আমি রয়েছি। সেসব কিছু হয়নি সেটাই রক্ষা, আমি চাকরি পাওয়ার পরে মনের যা যা ইচ্ছে ছিল মেটাতে লাগলাম। বালুঘাটে আমার পোস্টিং ছিল, সপ্তাহে সপ্তাহে আসতাম। মা-বাবাকে ঘুরতে নিয়ে গেছি, ভাইয়ের সব ইচ্ছে মেটানোর ইচ্ছে করতো। চাকরি পেয়ে ওর জন্য একটা দামী ঘড়ি কিনে দিয়েছিলাম, অবশ্য মায়ের বুদ্ধিতেই। কি যে খুশী হয়েছিল কি বলব। সেবার স্কুলের পরীক্ষা চলছে, দুই সপ্তাহ বাড়ি ফিরতে পারিনি। পরের সপ্তাহে ও এসে হাজির, আমি দেখে অবাক। বললাম 'তুই এখানে, কোথায় এসেছিস?' ও কোনো ভনিতা না করে বললো 'তোর কাছে?' আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। আমি বরাবরই কাঠকোট্টা, এর উত্তর যা দেবার সেটা না দিয়ে বললাম ' আমি তো একজনের সাথে রুম শেয়ার করে থাকি, তুই কোথায় থাকবি?' ও কেমন করে একটা হাসলো। আমি ওকে মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতে বলে, আমি সেদিনের খাতা দেখা বাদ দিয়ে, খাতাগুলো লকারে রেখে এসে দেখি ও নেই। আমার এবারে খারাপ লাগলো, কথা না বলেই চলে গেল। বাইরে এসে দেখি ও একটা জায়গায় বসে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। ওর চোখে জল। আমি পাশে বসতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আমি কি করব কি বলব বুঝতে পারলাম না। না ওকে সরিয়ে দিতে পারলাম। ওর চোখের জলে পীঠ ভিজে যাচ্ছিলো। রবিবার ছাত্র-ছাত্রী কেউ নেই, তাই কারো চোখে পড়ার আশঙ্কা নেই, যদি কেউ এসে যায় কি বলব তাই ভাবছি।"

সীমা অধৈর্য্য হয়ে বলেই ফেললো "তুই কি রে? ছেলেটা কাঁদছে আর তুই এসব ভাবছিস?"

শান্তা হেসে বলল "আমি এমনই, ভালো মানুষ নই।"

" সীমা থামত, আর শান্তা তুই শেষ কর আগে, বল তারপর কি হলো?" রুমা বললো।

" আমি ভাবলাম ওর বাড়ির কারো কিছু হয়েছে, বললাম ' কাকিমারা কেমন আছে রে? সবাই ঠিক আছে তো? কারো কিছু হয়নি তো?' ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বললো 'সব ঠিক আছে, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। ' এই প্রথম আমার মনটা কেমন করলেও আমি হাত বাড়িয়ে বললাম 'অভিনন্দন..' ও কিছু বললো না, মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আমি বললাম 'চল ঘুরব চল, একসাথে খাবো।' ও কিছু না বলে পিছু পিছু এলো। আমি প্রথমেই একটা ভালো রেষ্টুরেন্টে গেলাম। ওদের কাছে গিয়ে স্পেশাল থালি অর্ডার দিয়ে বললাম আইবুড়ো ভাতের থালি সাজাতে একটা, যা লাগবে দিয়ে দেবো আমি। ওর সামনে এসে বসলাম, ও দেখি জানালা দিয়ে চেয়ে রয়েছে। আমি বললাম 'কি দেখছিস রে?' ও উত্তর না দিয়ে তেমন করেই চেয়ে রইলো বাইরের দিকে। আমি ওর পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেখার মতো কিছুই নেই। আমি বললাম 'কিছুই তো নেই ওমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?' ও হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বললো 'তুই তো চাকরি পেয়ে গিয়েছিস, এবার বিয়েটা কবে করবি?' আমি হেসে বললাম 'কেন রে তুই এখন ফেঁসে গেছিস, এখন আমাকেও ফাঁসাতে চাইছিস?' ও এবারে রাগ করে বলল ' ধুর বলনা।'

'কি বলব? '

' বিয়ে কবে করবি?'

' ধুর বিয়েটিয়েতে আমি নেই..'

' কেন?'

' কেনর কোনো উত্তর নেই..'

' বলনা..'

'বুড়ি হয়ে গিয়েছি, এখন বিয়ে করলে অন্যের বরকে বা অন্যের প্রেমিককে বিয়ে করতে হবে।'

' আর যদি না করতে হয় অন্যের...'

কথা শেষের আগেই ওরা আমাদের ডেকে নিয়ে যায় একটা ঘরে। টেবিল সুন্দর করে সাজানো আর টেবিল ভর্তি খাবার।

' এসব কি শান্ত? '

' তোর আইবুড়ো ভাত খাবার আমায় দিয়ে শুরু হোক।'

ওকে রাগ করে চলে যেতে দেখে বাঁধা দিয়ে বলি 'আমি আশা করে ব্যবস্থা করলাম তুই খাবি না?'

ও এবারে এসে বসল। ওর চোখে জল। আমি এবার ভাবলাম খুশীর জল।

আমি বললাম ' তুই অনেক ভালো রে, আমি চাই তুই অনেক সুখী হ।'

ও কেমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বললাম ' পেটুক খাবার শুরু কর। আমারও খিদে পেয়েছে।'

ওকে তখনও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে আমি চামচ দিয়ে পায়েসটা ওর মুখে দিয়ে দিলাম। এবারে ও হুহু করে কেঁদে ফেললো। আমি এবার বুঝতে পারলাম বিষয়টা অন্য। আমি এবারে ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই ও বললো 'আমি তোকে অনেক ভালোবাসি রে, কোনো দিনও মুখ ফুটে বলিনি,ভেবেছিলাম তুই বুঝতে পারবি। তুই বুঝিস নি। আমি জানতাম তোর জীবনের প্রথম লক্ষ্য নিজে পায়ে দাঁড়ানো। তুই চাকরি পেয়েছিস সেটাও বছর দেড়েক হয়ে গেল। ভাবলাম বলি আমার বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, তাহলে হয়তো তুই বাঁধা দিবি, উল্টে তুই আইবুড়ো ভাত খাওয়াচ্ছিস? তুই কি পাষাণ রে।'

আমি হেসে বললাম 'এই পাষাণীকে কেন যে তোর মনে ধরলো তুই জানিস, সারাজীবন আঘাত সইতে পারবি কি?'

ও এবারে উজ্জ্বল মুখে আমার দিকে তাকালো। তারপর অনেক কষ্টে বল্লো 'তুই রাজি?'

' আমি রাজি হলেই হবে? তুই আমার চেয়ে বয়সে বছর খানেকের ছোট নিশ্চয় মনে আছে। তোরা কায়স্থ, আমার নই। আমি সুন্দরীও না। কেন মেনে নেবে তোর পরিবার? সবাই লাল টুকটুকে সুন্দরী বউ আশা করে। আর এসব বাদ দিলাম তোর না বিয়ে ঠিক হয়েছে, তার কি হবে? '

ও এবার দাঁড়িয়ে আমার মুখখানা দু'হাতে ধরে বললো 'তুই জানিস কার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? কে আমার হবু বৌ? '

আমি বললাম 'আমি চিনি? '

' হ্যাঁ চিনিস'... বলে বিলিতি কায়দায় আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পকেট থেকে একটা আংটি বের করে বললো 'Will You marry me?'

আমি কি বলব? ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলাম। "

এবারে স্বপ্না বিরক্ত হয়ে বললো "তুই কি বোকা রে? ইস আমাকে যদি এমন করে কেউ বলত সাথে সাথে রাজি হয়ে যেতাম।"

মালা ওকে সমর্থন করে বললো " আমি ভাবতাম আমারটা রোমান্টিক ছিল, তোর জন তো কয়েক কাটি উপরে। "

" আগে বল কি উত্তর দিয়েছিলি?"

শান্তা হেসে বলল " আমি কি বলব ও বলতে শুরু করলে 'শান্ত কিছু বল আমার হাঁটু ব্যথা করছে আর ভুল করেও না বলবি না, ঠ্যাং ভেঙে গেলেও হ্যাঁ না শুনা পর্যন্ত বসে থাকব। ' তারপর আর কি বাধ্য হয়ে হ্যাঁ বললাম। লোকজনও বেশ জমে গিয়েছিল। এর মধ্যে কেউ আমার ছাত্রী-ছাত্রদের পরিবারের কেউ না কি করে জানবো? "

সীমা এবারে রাগ করে বললো "তুই ভাই এক্কেবারে নিরস, এমন মুহুর্তেও কি কেউ এসব ভাবে? "

" আমি ভাবি, কি করব বল, সবাই তো সমান হয়না।"

অর্চনা বলল "তারপর "

" তারপর আর কি ও হেসে বলল 'নিজের প্রথম বিয়ের আইবুড়ো ভাত নিজের হবু বৌয়ের কাছে থেকে খাচ্ছি, এমন কেউ খেয়েছে কোনো দিনও.. ' ভাব কেমন নির্লজ্জ। "

রুমা জিজ্ঞেস করল "বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হয়নি?"

" ঝামেলা? ওর বাড়ির লোকেরা ওর মনের কথা আগে থেকেই জানতো। আর আমার বাড়ির সব্বাই আমার বিয়ের বছর খানেক আগে থেকে জানে। কেবলমাত্র আমার বিয়ে আর আমি জানতাম না। "

কথাটা শুনে সবাই হেসে ফেললো।

" তা তোর ছেলে মেয়ে কয়টা?"

এর উত্তর মালা দিলো " ওর দুই ছেলে মেয়ে।"

" বয়স কত হলো ওদের?"

" মেয়ের চার ছেলের পাঁচ। "

" খুবই ছোট ছেড়ে আসলি কি করে? "

" আমার প্রয়োজন নেই ওদের মামী দিদার কাছেই থাকে, তাছাড়া ঠাকুমা দাদুও এসেছে তো। "

" তবুও.. "

" মাত্র তিন দিন, ওই বললো ঘুরে আসতে, যদি আর সময় না হয়। "

" তা ঠিক সবারই সংসার ।"

শান্তা বলল "বেশ রাত হয়েছে, ফিরতে হবে চল, খিদেও পেয়েছে। গল্প করলে কি পেট ভরে?"

সবাই হৈ হৈ করে হোটেলের দিকে ফিরে চললো।

চলবে...



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational