Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Tragedy Inspirational Children

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Tragedy Inspirational Children

One Trip (অন্তিম পর্ব)

One Trip (অন্তিম পর্ব)

8 mins
345


" বলছি আজ একটু ওদের সাথে থাকলে পারতেন, ওরা তো এই একটা দিন আশা করে। "

"আমার এসব ভালো লাগে না, আমাকে একা থাকতে দাও আর যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যেও।"সীমা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।

বছর দুই হয়ে গেল শান্তা চলে গিয়েছে। তখন থেকে মৃণাল কেমন চুপ হয়ে গিয়েছে, একা একা ঘরের এক কোণে পড়ে রয়। যে মানুষ সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতো সে যেন প্রাণহীন হয়ে বেঁচে রয়েছে। শান্তা অসুস্থ হয়েও যখন বেঁচে ছিল তখনও মৃণালের চোখে বেঁচে থাকবার আর শান্তাকে বাঁচিয়ে রাখবার আশা ছিল। শান্তাকে সবসময় হাসিখুশি রাখবার চেষ্টা করে গিয়েছে ও। যবে চলে গেল মুখাগ্নিও দেয়নি ও, আর ছেলে খুবই ছোট তাই ভাই সুশান্ত করেছিল মুখাগ্নি আর শ্রাদ্ধের কাজ। ওই দিন পনেরো মৃণাল ভারতসেবাশ্রম সংঘে গিয়ে ধ্যান করে কাটিয়ে দিয়েছিল।

ওদিকে শান্তার মা-বাবাও অসুস্থ শান্তা চলে যাবার সময় থেকে। মৃণাল প্রায় বছর খানেক without pay নিয়ে বাড়িতে ছিল, এবছর থেকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। অবশ্য মৃণালের মা-বাবা জোর করে ছেলে নাতি-নাতনিদের হালিশহরে নিয়ে যাবার অনেক চেষ্টা করেছে, শান্তার মা-বাবাও বলাতে বলেছে " তোমরা যদি জোর করো আমি সব ছেড়ে বেড়িয়ে যাব। আমি থাকলে ওর স্মৃতি নিয়েই থাকব আর এই শহরে থাকব, ওকে আমি এই শহরেই পেয়েছি। তোমাদের বাড়িতে থাকলে যদি অসুবিধা হয় তো অন্যত্র চলে যাচ্ছি, কিন্তু এই শহর থেকে আমাকে কেউ কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না।" কেউ আর জোর করতে সাহস পায়নি। উল্টে শান্তার মা বলেছিলেন " এই বাড়ি শান্তার যতটা ছিল, তোমারও ততটা আর বাবু বৌমারও ততটাই। আমি তা বলিনি বাবা, আমরা এতো কষ্ট পাচ্ছি ওকে হারিয়ে , তোমার যন্ত্রণা কত সেটা বুঝি, তাই বলছিলাম যদি এখান থেকে দূরে থাকলে যদি ওকে ভুলে থাকতে পারো।"

" আমি ওকে ভুলতে চাইনা মা, কখনো ভুলতে চাইনা। ওর স্মৃতি আমার বেঁচে থাকবার রসদ।"

" তুমি যেখানে ভালো থাকো থেকো, আমি তোমায় কিছু বলব না। তোমায় আমি শনু আর বাবুর থেকে কখনো আলাদা চোখে দেখিনি।" তারপর থেকে শান্তার ঘরে একা চুপচাপ বসে রয়। মাঝে মাঝে নিজের মনে কথা বলতে শুনেছে ও।যেন ওর সব সুখ আশা শান্তার সাথে চলে গিয়েছে।

" মাম বাবা এলো না?"

" না মা বাবার শরীর ভালো নেই তুমি তো জানো।"

" আজ আমার জন্মদিন তবুও এলো না।"

" না আসুক তাতে কি, উনার আশীর্বাদ তোমাদের মাথার উপর আছে তো। সকালে বলেছিলাম বাবাকে প্রণাম করে আসতে, করেছ?"

" হ্যাঁ মাম করেছি। বাবা আশীর্বাদ করে বলেছে মায়ের মতো হও।"

" ঠিকই বলেছে ওর মতো হতে পারা তো ভাগ্যের বিষয়। তোমাকে শান্তার মতো হতে হবে। "

বলে ও মিশাকে জড়িয়ে ধরে। ওকে জড়িয়ে ধরতে দেখে মিশার ভাই মৃদুল দৌড়ে এসে বলে, "আমি মাম আমি।"

সীমা ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে " হ্যাঁ তুমিও হবে তো। "সীমা ওকেও জড়িয়ে নেয়। সপ্তাহ দুই হলো ওরা কোয়ার্টারে উঠে এসেছে, নারায়ণ পুজো আর মিশার জন্মদিন একসাথেই সেরে নিলো। আজ সবাই এসেছে শান্তার ভাই রায়গঞ্জ ছেড়ে দিয়েছে মাস ছয়েক হলো, ওরা এখন শিলিগুড়ি থাকে। সহ্য করতে পারছিলো না দিদি ছাড়া বাড়িটা। অবশ্য মৃণাল উল্টো ভাবে ও এই বাড়ির প্রতিটি ঘরে খুঁজে ফেরে শান্তাকে। ছিল এতোদিন, চাকরিতে যোগদান দেবার পরে সুদর্শনপুর থেকে আসতে অসুবিধা হতো, মানে সকালে ক্লাসের মাঝে ফাঁকা থাকলে ও বাড়ি ফিরে গিয়ে পরের ক্লাসগুলো নিতে আসতো না। তাই সীমা সবার সাথে আলোচনা করে এখানে চলে এসেছে।

" আরে মিশু কেকটা কাটবে না সোনামা? "

" হ্যাঁ মামু কাটবো, মামী কোথায়? "

" এইতো আমি এখানে, দেখো তোমার প্রিয় আইসক্রিম বানিয়েছি। "

" তুমি best মামি।"

" জানি তো, তবে আগে কেকটা কাটো।"

" কাটবো, দাভাই আর বুনি কোথায়?"

দাভাই অর্থাৎ শান্তার একমাত্র ভাইপো মিশার চেয়ে বছর দেড়েকের বড় আর বুনি মানে ওর বোন। অবশ্য

ওর বয়স মাত্র দেড়। ও হয়েছে একদম শান্তার মতো দেখতে।

" বুনি ঘুমোচ্ছে মা, ও তো ছোট, এসব তো খেতে পারবেনা ও।আর তোর দাভাই গিয়েছে ওর মামার সাথে। "

বলতে বলতে স্বর্ণাভ ঘরে ঢুকে বলে " এই যে আমি, নে বুনি Gift.."

" তুই gift দিচ্ছিস আমায় দাভাই?" খুশী খুশী মুখে জিজ্ঞেস করে মিশা।

" হ্যাঁ, আমি তোর দাদা না? দেখ দেখ খুলে দেখ ।" ওদের কথোপকথন শুনে সবাই হেসে ফেলে।

অহনা দাদাকে বলে " তুই তো তো উপহার দিয়েছিলি দাদা।"

" এটা আমার স্বর্ণের তরফ থেকে ওর বোনের উপহার। "

অহনা এই নিয়ে আর কিছু বলল না। ওর সুশান্তের সাথে প্রেম অনেক দিন আগে থেকেই ছিল। বিষয়টা কেবলমাত্র ওদের দিদি দাদা, মানে অহনার দাদা আর সুশান্তের দিদি শান্তা জানতো। ওদের মন থেকে খুব ইচ্ছে ছিল দিদি দাদার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠুক। আর অহনাও খুব সুনাম করতো শান্তার। অবশ্য এসবের কিছুই কোনো দিনও জানতে পারেনি শান্তা বা বাড়ির অন্য কেউ। অহনার দাদা lieutenant colonel, অনেক তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়েছিল। শান্তার জন্য সম্বন্ধও পাঠিয়ে ছিল। কিন্তু শান্তা তখন পড়াশোনায় ডুবে, কোনো দিকে মন ছিল না তখন ওর। একবার শুধু ভাই আর অহনার খাতিরে দেখা করেছিল অয়নের সাথে। কি কথা হয়েছিল তা অয়ন ছাড়া কেউ জানেনা, কিন্তু কোনো দিনও আর এই বিষয়টা কারো কাছে উত্থাপন করেনি ও। বা শান্তার নামে খারাপ কিছু বলেনি, ভেবেছিল অপেক্ষা করবে, কিন্তু বাড়ির চাপে সম্ভব হয়নি। বিয়ে করতে হয়েছিল বছর খানেকের মধ্যেই। তবে শান্তাকে খুব সম্মান করতেন, উনি নিজে মুখে স্বীকার করেছে শান্তার মতো মানসিকতার মেয়ে ও খুব কম দেখেছে। যেহেতু শান্তা অয়নকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি, তাই সুশান্ত আর অহনার বিয়ে নিয়ে একটা বাঁধা এসেছিল, তবে অয়ন নিজে সামলে দেয়, এই কথা লোক মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল, সে নাকি বলেছিল " মা তোমরা পাগল হলে? আমি বিবাহিত আর সুখী, আমার ছেলে রয়েছে। হ্যাঁ একটা সম্বন্ধ এসেছিল,সে তো কত আসে, তাই বলে এই তুচ্ছ কারণে সম্পর্কটা ভেঙে বোনের চোখের জলের কারণ হবে তোমরা আর আমাকেও ভাগীদার করবে তা আমি হতে দেবো না। এতো ভালো পরিবার তুমি অযৌক্তিক হেতুতে হারাতে চাও?" তারপর অহনার জেদ, আর অয়নের অধ্যাবসায়ের কাছে পরিবার হার মানে। ওদের বিয়ে হয়, অবশ্য শান্তা তখনও বিয়ে করেনি, তবে মৃণালের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। একই বছর দুই ভাইবোনের বিয়ে হয়, সুশান্তর বৈশাখে গরমে আর শান্তার মাঘ মাসে বিয়ে হয় আর খুব যত্ন পেয়েছিল অহনা শান্তার কাছে থেকে শুধু ওই মাস কয়েক না, যতদিন বেঁচে ছিল শান্তা, দিদি কাকে বলে বুঝতে পেরেছিল। ওদের সবাই দুই বোন বলে ভুল করতো। অহনার মা স্বীকার করেছিল এখানে বিয়ে না দিলে ভুল সিদ্ধান্ত হতো উনার।

কেক কাটা হবার পরে মেয়ের হাতে সীমা কেক পাঠিয়ে দিলো মৃণালের জন্য। সকালে পাঁচ রকমের ভাজা, পায়েস সহ পাঁচ রকম মিষ্টি, মাছের কালিয়া, চাটনি আর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিল মিশারর দিদা।তারপর সবাই মিশাকে ধান দূর্বা চন্দন পড়িয়ে আশীর্বাদ করে। দিদির দেখাদেখি মৃদুলও বসে পড়েছিল। সকালে মায়ের চাপে একবার ঘর থেকে বেড়িয়ে আশীর্বাদ করে ঘরে চলে গিয়েছিল। মেয়ে হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাও মৃণালের জন্য। 

কাজ সেরে অনেক রাত হয়ে গেল।৷ মিশার কিছু বন্ধু এসেছিল, সাথে ওদের ভাইবোন আর মা-বাবা আর সীমাদের প্রত্যেক বান্ধবী এসেছে আজকে।

কোয়াটারে দুইখানা শোবার ঘর, একটা ডাইনিং। মিশার মামা মামী মিশা আর মৃদুল আর মিশার ঠাকমা দাদুকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। থাকার জায়গা বড় কম এখানে।

একটা ঘরে মৃণাল রয়েছে, আরেকটি ঘরে নীচে উপরে বিছানা করা হয়েছে।

" শান্তা এমন করে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে বুঝতে পারিনি রে... ওকে ছাড়া কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রে.."

সীমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আগের মতো ওর মধ্যে সেই বাচালতা নেই। শান্তাকে হারিয়ে ফেলে আঘাতটা ওর বুকে বেজেছে। তাছাড়া এখন ওর দায়িত্ব অনেক।

অর্চনা চোখের জল মুছে বললো " জানিস আমি আজও আমি দীঘায় কাটানো দিনগুলোর কথা ভেবে অবাক হই, কি করে এতোটা কষ্ট বুকে চেপে রেখেছিল ও?"

" হ্যাঁরে আমাদের বুঝতে দেয়নি, উল্টে আমাদের সুখ দুখের কথা জিজ্ঞেস করেছে, আমাদের জীবনের সব প্রতিকূলতা দূর করেছে। "

সবাই চুপ করে যায়। কারো কিছু ভালো লাগছিল না।

হঠাৎ অর্চনা বলে " সীমা বলছি এবার রেজিস্ট্রীটা করে নে।"

" ধুর!... "

" ধুর না, দেখ আমাদের সবার সামনে শান্তার কথা রাখতে তোর সিঁথিয়ে সিঁদুর পড়িয়েছেন মৃণাল মানলাম। তবে আইনি ভাবে তো তোদের বিয়েটা সিদ্ধ না।" রুমা বললো কথাটা।

" দেখ আমার জীবন শুন্য ছিল, বাঁচবার মতো কোনো অবলম্বন ছিল না। আজ আমি একটা সংসার পেয়েছি, তোরা বলবি অন্যের সংসার সামলাচ্ছি। হয়তো তোরা ঠিক, জানি নিজের সন্তান নয় ওরা, তবুও ওদের মাম ডাক আমার অপূর্ণ হৃদয়কে পূর্ণতা দিয়েছে। মৃণাল বাবুর স্ত্রী আমি হতে পারবো না, যোগ্যতা আমার নেই। আর শান্তার সামান্য যোগ্যতা আমার নেই। তুলনাও করিনা আমি। আমি যা পেয়েছি সেটা অনেক আমার কাছে।"

কথা শেষ করার আগেই স্বপ্না বলে উঠলো " দেখ সব মানলাম, ধর তুই তোর জীবন দিয়ে বাচ্চা দুটোকে মানুষ করলি, নিজের সন্তানরাই দেখে না, শেষ বয়সে তোকে ঘর ছাড়া করলে কোথায় যাবি?"

সীমা উঠে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়ালো। সে আর ভবিষ্যত নিয়ে ভেবে অকারণ বিচলিত হয়না। সে কি ভেবেছিল কোনো দিনও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীর পরিচয় পাবে ও? এই স্থান আর এই সংসার সবই শান্তার ছিল। কোনো স্ত্রী মৃত্যুর পরেও স্বামী সন্তানের ভাগ ছাড়তে পারে না আর শান্তা জীবিত থাকাকালীনই সংসারের ভার কেবলমাত্র তুলে দেয়নি, যাতে আমার অসম্মান না হয় মৃণালের সাথে বিয়ে দিয়ে গিয়েছে। রেজিষ্ট্রীও করিয়ে দিতো, কিন্তু সময় পেলো কই মেয়েটা? আর কিছু কি চাইতে পারে ও?

" কি রে চুপ করে আছিস যে?"

" আমি ভবিষ্যতকে বর্তমানে টেনে বর্তমানকে নষ্ট করতে চাইনা। ভবিষ্যতকে আমি ভবিষ্যতের কাছে ছেড়ে দিয়ে বেশ আছি। "

" কিন্তু ভেবে দেখ..."

" দেখ ওই ঘরে যে মানুষটা রয়েছে সে মানুষটা আমাকে স্ত্রী মানেনি মন থেকে জানি, তবে অপরের সামনে কখনো অস্বীকারও করেনি। আর তারচেয়ে বড় কি জানিস আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। ও বেতনের টাকা আমি তুলে আনি ATM থেকে। আমি কোথায় কি খরচ করি সেটা নিয়ে একবারও জিজ্ঞেস করে না। দেখ আমি আর কিছু চাইনা। এই বিশ্বাসের উপর আমার বিশ্বাস রয়েছে, উনি কখনো আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবেন না।"

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সীমার নির্লিপ্ততায় বাড়তে পারলো না।


________


" মামের হাতে থেকে আমি এই পুরস্কার নিতে চাই, আজ সব কিছুই মামের জন্য।"

মিশা অর্থনীতিতে স্বর্ণপদক পাচ্ছে। মৃদুল ডাক্তারীতে ভর্তি হয়েছে এবার। সীমার চোখ জলে ভরে উঠে, প্রায় বছর পনেরো হলো মৃণাল গৃহত্যাগী হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তার আগে সবকিছু সীমার নামে লিখে দেয়। এই কয় বছর বাচ্চা দুটোকে বুকে করে মানুষ করেছে। মৃণাল গৃহত্যাগী হবার পরে মৃণালের মা-বাবা ওদের হালিশহরে নিয়ে এসেছিল। ওদের সহোযোগিতায় এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছে ও। আজ ও প্রকৃত অর্থে সফল মা। সীমা দু'হাত তুলে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম সেরে মনে মনে বললো "শান্তা আমি পেরেছি, তুই একমাত্র আমার উপর বিশ্বাস রেখেছিলি, তুই বলেছিলি তোর চেয়ে নাকি বেশি ভালো রাখবো নাকি ওদের। বেশি কম জানিনা, এই ব্যর্থ সীমা এই একটা জায়গায় আজ জয়ী হলো। তোর বিশ্বাস জয়ী হলো রে। তুই যেখানেই থাকিস ওদের আশীর্বাদ করিস..."

~সমাপ্তি ~



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy