Indrani Bhattacharyya

Action Crime Thriller

4.7  

Indrani Bhattacharyya

Action Crime Thriller

হারানিধি

হারানিধি

49 mins
1.3K



 বছর খানেক হল, ব্রজমোহন মিত্র তার নিজের বাড়িতেই একটি পাঠাগার খুলেছেন। বান্ধবনগর সাধারণ পাঠাগার। ছোট বড় সকলের জন্যই এই লাইব্রেরির অবারিত দ্বার । ব্রজমোহন মিত্ররা এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা । বাপ ঠাকুরদার মত তিনিও ছোট থেকেই বইয়ের পোকা। তার বই সংগ্রহ এবং বই পড়ার শখ এই অঞ্চলে সুবিদিত। বই পড়ার এই অভ্যাসকে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই ব্রজমোহন বাবু নিজেদের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে বছর খানেক আগে এই পাঠাগারটি খোলেন। স্কুল কলেজ বা অফিসের চৌহদ্দির বাইরে এটাই এই অঞ্চলের একমাত্র সাধারণ পাঠাগার। 


দেখতে দেখতে এক বছরের মধ্যেই এই পাঠাগারের পাঠক সংখ্যা প্রায় দু হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। সকাল বিকেল কম বেশি কিছু না কিছু বইখেকোদের ভিড় লেগেই থাকে এই ঘরে। তাছাড়া পাঠাগারে আসা সাহিত্যপ্রেমী মানুষজনের মধ্যেও প্রায়ই জমে ওঠে আড্ডার আসর। 


এই লাইব্রেরির সদস্যদের অবশ্য বই ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্রজমোহন বাবুর বানানো একটা সহজ নিয়ম মেনে চলতে হয়। কেউ কোনো বই বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে তার বদলে তাকে নিজের সংগ্রহের একটি বই সেই সময়ের জন্য পাঠাগারে জমা রাখতে হয়। কোনো বইই নিজের কাছে এক সপ্তাহের বেশি রাখা যায় না। পাঠাগারের বই ফেরত দেবার সময়ই পাঠক তার নিজের বইটি ফেরত পান পাঠাগার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এই নিয়মের ফলে কখনোই লাইব্রেরীতে বই কম হবার সুযোগ হয় না আর সহজেই নিত্য নতুন বইয়ের স্বাদ নিতে পারে পাঠকেরা।


ব্রজমোহন বাবু ব্যবসায়ী মানুষ। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন নানান কাজে। তাই পাঠাগারের দেখভালের জন্য বহাল করেছেন তার নিজের খাস লোক সত্যকে। সত্য জন্মাবধি মিত্র বাড়িতেই মানুষ। সত্যের বাপ - ঠাকুরদা পুরুষানুক্রমে এই বাড়িতে মালির কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে ব্রজবাবু সত্যকে নিজের উদ্যোগে পড়ালেখা করিয়েছেন। এই বছর সে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। সত্য নিজেও সাংঘাতিক রকমের বই পাগল। তাই এমন কাজ তার ভালই লাগে। মন প্রাণ দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে লাইব্রেরিখানা। 


আজও সন্ধ্যেবেলা লাইব্রেরি বন্ধ করার পর বসে বসে ক্যাটালগ তৈরি করার ফাঁকে উল্টে পাল্টে দেখছিল সদস্যদের থেকে পাওয়া নতুন বইগুলো। এই যেমন সুলেখা সাহা, সমরেশ মজুমদারের লেখা 'সাতকাহন' বইটি নিয়ে দিয়ে গেছেন মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে'। দেবী প্রসাদ 'ফ্রান্সিস সমগ্র' দ্বিতীয় খণ্ডের বদলে দিয়েছেন 'মরুতীর্থ হিংলাজ'। আরেকটা সবুজ রঙের বই দিয়েছেন আরেক সদস্য। নামটা এন্ট্রি বুকে লেখা নেই পুরো। শুধু নাম আর পদবীর আদ্যক্ষরটুকুই লেখা। খাতা খুলে মিলিয়ে সত্য দেখলো তিনি নিয়ে গেছেন সাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ' শিকড়ের খোঁজে মানুষ '। 


একটু অবাক হয়েই বইটা খুলে ভারি রাগ হল সত্যর। নিজের মনেই বলে উঠলো - ' আরে, বই কোথায়? এতো দেখছি একটা ডাইরি!" মনে মনে ভাবলো, " সুবলা পিসীকে কাউন্টারে বসানোটাই আহাম্মকি হয়েছে। আসুক আজ কর্তাবাবু। সব জানাবো। এমন বেআদব লোকের সদস্যপদ বাতিল হওয়াই উচিত। তবে তার আগে মানে মানে লাইব্রেরী থেকে নিয়ে যাওয়া বইটা ফেরত নিতে হবে। " আসলে আজ সকালের দিকে সেই সময়ই কর্তা মা খোঁজ করছিলেন সত্যকে, ব্রজবাবুর অফিসে ইন্সুরেন্সের ফাইলটা পৌঁছে দেবার জন্য। তাই সুবলা পিসিকে কাউন্টারে বসিয়ে একটু সময়ের জন্য বাইরে বেরিয়েছিল সত্য। আর এন্ট্রি বুকে লেখা সময় অনুযায়ী ওই সময়েই এসেছিল লোকটি।


সত্য কার্ডের নম্বর মিলিয়ে রেজিস্ট্রেশন বুক ঘেঁটে উদ্ধার করলো সদস্যটির নাম, ধাম আর বাদ বাকি প্রয়োজনীয় তথ্য । নাহ্, প্রফুল্ল ধর নামে কোনো সদস্যের মুখ মনে করতে পারলো না । তবে খাতায় লেখা তথ্য অনুযায়ী ছেলেটি থাকে ইউথ হোস্টেলে। আসলে ইউথ হোস্টেলে নতুন নতুন ছাত্রদের আসা যাওয়া বছরভর লেগেই থাকে। এদের অনেকেই এই পাঠাগারের সদস্য। তবে তেমন ভাবে নিয়মিত না এলে প্রত্যেকের নাম মিলিয়ে মুখ মনে রাখা বেশ কঠিন । 


সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিচের তাক থেকে আনমনে প্রফুল্লর জমা করে যাওয়া সবুজ রঙের বাঁধানো ডাইরিখানা একসময় বের করে আনলো সত্য। বেশ অনেক কালের ধুলো জমে আছে তাতে। প্রথমে ডায়রিটা পড়বে কি পড়বে না সেই নিয়ে খানিক দ্বিধায় পড়লো সে। যতই হোক ডায়রি তো আর বই নয়। অনেক সময় মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপারস্যাপার লেখাজোখা থাকে তাতে। তারপর ভেবে দেখলো সে তো আর নিজে থেকে পড়তে যায়নি। কেউ যখন নিজে থেকে এসে দিয়ে গেছে সেটা তখন না পড়ার কারণ থাকতে পারে না। হাতের বইগুলো তুলে রেখে ডায়রিটা নিয়ে বসলো সত্য।



 ডায়রীতে হাত দিয়েই মালুম হয়েছিল ভালই বয়স সেটির। পাতাগুলোও বেশ হলদে হয়ে এসেছে। প্রথম পাতা খুলতেই চোখে পড়লো নীল কালির ঝর্না কলমে বেশ সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা - "খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে । বুলবুলিতে ধান খেয়েছে ,খাজনা দেবো কিসে।।" ওপরে ছাপার হরফে লেখা তারিখটি ১লা জানুয়ারি, ১৯৮০। ব্যাস , আর কিচ্ছু লেখা নেই সেই পাতায়। সত্য মনে মনে ভাবলো- " এ নিশ্চয়ই কোনো ছোট ছেলের খেয়াল। যদিও হাতের লেখাটা বেশ পাকা হাতের। তাহলে কি..." ধন্দে ধন্দে পরের পাতা উল্টে দেখলো সেখানেও লেখা নেই কিচ্ছুটি। শুধু তাই নয়, পরপর বেশ কয়েক জোড়া পাতাই এক্কেবারে ফাঁকা। একটা আঁচড় অব্দি কাটা নেই কোথাও। এবার সে নিঃসন্দেহ হলো যে এ নিশ্চয়ই কোনো ছোট ক্ষুদের সম্পত্তি । অনেক ক্ষুদেই এভাবে ডায়রির পাতা নষ্ট করে । পাতা উল্টোতে উল্টোতে আবার বেশ খানিক পর নজরে পড়লো দু চার লাইনের একটা ছড়া, ওপরে তারিখ লেখা ১৯শে ফেব্রুয়ারি,১৯৮০। এটা যদিও চেনা কোনো ঘুমপাড়ানি ছড়া নয়। বরং পড়ে লেখকের মস্তিষ্ক প্রসূত স্বরচিত পদ্য বলেই মনে হল। কে বলতে পারে এই ক্ষুদেরও হয়ত অন্য অনেকের মতই মাঝে মধ্যে কবিতা পেত আর সেগুলো হয়ত এরকম ভাবেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আত্মপ্রকাশ করতো।লেখাটা খানিক এরকম - "মাস গুনতে গুনতে, বছর হলো পার।তেমন করে মিললে পরে, ঘটে চমৎকার।।


নামে কি আসে যায়, কাজেই পরিচয়। বিন্ধ্যবাসিনি এই ভূমেই জগজ্জননী হয়।।" সত্য কয়েকবার পড়েও লাইনগুলোর অর্থ কিছুই বুঝলো না । যদিও বারবার পড়ায় বেশ মুখস্থ হয়ে গেল পদ্যখানা। সত্য পাতা উল্টে চললো। আবার বেশ কিছু ফাঁকা পাতা। তারপরের লেখা দেখা দিল সেই ৪ঠা মার্চ এর পাতায় - "গোপন কথাটি রবে না গোপনে , দেবী আদেশ দিলেন স্বপনে। মসীলিপ্ত হলো কাহিনী সবিস্তার, শুনে ধন্য হলো জগৎ সংসার।" সত্য এবারে নিশ্চিত হল যে সেই ক্ষুদে লেখক নিশ্চয়ই গোয়েন্দা গল্পের পোকা। তাই হেঁয়ালি করে এরকম পদ্য লেখার চেষ্টা করেছে এখানে সেখানে। চতুর্থ এবং শেষ পদ্যটি লেখা আছে একেবারে ডায়রির শেষ পাতায়। অদ্ভুত ভাবে সেই দিনের তারিখটা মানে 31সে ডিসেম্বর ,১৯৮০ কথাটি হিজিবিজি করে কাটা । শেষ কবিতাটি খানিক এরকম - "তাই তাই তাই, মামাবাড়ি যাই। মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই। গুড়ুমঘরে দেরাজ খুলে মণ্ডা মিঠাই পাই, তার ভিতরে রসের সাগর, স্বাদের তুলনা নাই, খোঁজ করে তাড়াতাড়ি চলে এসো ভাই।" সত্য ডায়রিটা বন্ধ করে তুলে রাখলো তাকে। গল্পের বইয়ের বদলে এমন একটা ডায়রি গছিয়ে দিয়ে যাওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হল সে। সেই সাথে সুবলা পিসির মুখটা মনে পড়ে আরো একবার মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো তার। সত্যিই তো, পিসি ছিল বলেই তো এমন ভাবে ঠকাতে পারলো ছেলেটা। 


ততক্ষনে ঢং ঢং শব্দে ঘড়ি জানান দিয়েছে ৯ টা বেজে গেছে। সুতরাং এক্ষুনি সেরে নিতে হবে রাতের খাওয়া। এ বাড়িতে সব কিছুই ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। সেদিনের মত লাইব্রেরি বন্ধ করে সত্য পা বাড়ালো ঘরের দিকে। 


ওইদিন রাতে খাবার ঘরে একথা সেকথায় ব্রজবাবুর কানে সেই ডায়রিটার কথাটা কায়দা করে তুললো সত্য। আরো বললো - " কর্তাবাবু সদস্যরা যদি এভাবে বিশ্বাসভঙ্গ করে, তাহলে লাইব্রেরী বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। এর আগে আমি বেশ কয়েক বার কয়েকজনকে হাতে নাতে ধরে বেশ কিছু বই উদ্ধার করেছি। কয়েকজনের বাড়িতে গিয়ে ফেরত নিয়ে এসেছি মাসের পর মাস আটকে থাকা লাইব্রেরীর বই। কিন্তু এবার ঘটনাটা আমার অনুপস্থিতিতে ঘটেছে। আপনি বুঝে শুনে পারলে এর একটা বিহিত করবেন। না হলে ভবিষ্যতে বই চুরি ঠেকানো যাবে না কর্তাবাবু। এই লাইব্রেরীতে অনেক মূল্যবান বই আর পুঁথি আছে যেগুলো বড় কর্তামশাইয়ের আমলের। আমার আরো ভয় সেগুলো নিয়ে। আপনিতো জানেন আজকের বাজারে সেগুলো কতখানি দুর্মূল্য। " 

ব্রজবাবু ঘটনাটা চুপ করে মন দিয়ে শুনলেন। তারপর আনমনে ইলিশ মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে হঠাৎই প্রায় স্বগতোক্তি র সুরে সত্যকে বললেন - "কাল নোটবুকখানা একবার আমার কাছে নিয়ে আসিস তো। আর ইয়ে, কাল সকালে ওই হোস্টেলে ছোটু ( ব্রজমোহন বাবুর ড্রাইভার)কে পাঠিয়ে একবার এই রবিবারে ওই প্রফুল্ল ছোকরাটিকে একটু আসতে বলিস। সে তেমন গরজ না করলে ছোটু যেন আমার নাম করে বলে যে ব্রজবাবুর ছোট মেয়েকে পড়ানোর জন্য একজন মাস্টারমশাই খোঁজ করা হচ্ছে। সেই সূত্রেই তোমাকে দেখা করতে বলেছেন। হোস্টেল সুপারকেও যেনো এই ব্যাপারে রাজি করিয়ে আসে।' 

সত্য খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে সায় জানালো তাতে। তারপর ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো।



ব্রজবাবু ব্যবসায়ী মানুষ হতে পারেন কিন্তু ছোট থেকেই যত রাজ্যের গোয়েন্দা আর রহস্য কাহিনীর ভক্ত। তাছাড়া যেকোনো রকমের হেঁয়ালি, ধাঁধা বা শব্দজব্দ সমাধানেও তিনি রীতিমত সিদ্ধহস্ত। সত্যর মুখে এমন একখানা ডায়রির গল্প শুনেই তার মন বলছিল সেটা কোনো সাধারণ ডায়রি নয়। ব্যপারটা নিজে তলিয়ে দেখবেন বলে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ডায়রির মালিক প্রফুল্লকে। যদিও তার এমন সন্দেহের কথা মুখে প্রকাশ করেননি একবারও ।

পরদিন ভোর রাত থেকেই একনাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় লাইব্রেরীতে পাঠকের সংখ্যা ছিল অন্যদিনের তুলনায় অনেকটাই কম। আর পাঁচটা দিনের মতোই সেদিন দুপুরে সত্য লাইব্রেরিতে বসে টুকটাক কাজকর্ম করছিল। এমন সময় হঠাৎই দেখল লাইব্রেরীতে ঢুকছেন ব্রজবাবু। বেশ অবাক হল সত্য। এসময় তার কিনা আপিসে থাকার কথা। ব্রজবাবু আসতেই সত্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তিনিও ধীরে সুস্থে ঘুরে ফিরে বইপত্র নেড়ে ঘেটে দেখতে লাগলেন। তারপর একসময় সত্যকে বললেন - "সেই ডায়রিটা আন দেখি, যেটার কথার কাল রাতে তুমি আমাকে বলেছিলে।" সত্য সাথে সাথে তাক থেকে নামিয়ে আনলো ডায়রিটা। ব্রজবাবু বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন সেটা। তারপর কিছু না বলেই কি যেনো ভাবতে ভাবতে ডায়রিটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন লাইব্রেরি ছেড়ে। 

দিনের বাকি সময়টা ব্রজবাবু অফিসে নানান ব্যস্ততার মধ্যে কাটালেন । কাজের চাপে এক সময় মাথা থেকে বেরিয়েই গেছিলো ডায়রিটার কথা। আবার খেয়াল হলো সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে আসার পর।


সেই সময় তিনি নিজের ঘরে বসে একা একা অভ্যাসমত কাগজের শব্দছক সমাধান করছিলেন।এমন সময়েই ঘরে চা নিয়ে ঢুকলেন ব্রজ বাবুর স্ত্রী মোহনা দেবী।স্বামীকে শুধোলেন - "হ্যাঁ গো, একটু পাঁজি দেখে বলো তো এ মাসে কবে পূর্ণিমা পড়েছে। ভাবছি সেদিন সত্য নারায়ণের পুজো রাখবো বাড়িতে। জোনাকির পরীক্ষা সামনে।" দিন দেখার কথাটা শুনেই ব্রজ বাবুর ঝপ করে মনে পড়ে গেলো ডায়রিখানার কথা। মোহনা দেবী চলে যাবার পরই অ্যাটাচি কেস খুলে সেটা হাতে নিয়ে বসলেন।


লেখাগুলোতে চোখ বুলিয়ে বুঝলেন অনেক কাল আগের লেখা। এমনিতেই তো তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল ১৯৮০ সালের ডায়রি। তাছাড়া ডায়রির মালিক লেখাগুলো লিখেওছেন বেশ কিছু কাল আগে। কারণ এখনকার দিনে আর কেউ তেমন ঝর্না কলম ব্যাবহার করে না। ডায়রিটা পড়তে পড়তে কেন জানি তার বারবার মনে হতে লাগলো এ মোটেই কোনো ছোট ছেলের কীর্তি নয়।প্রত্যেকটা লেখাই যেনো সাংঘাতিক ইঙ্গিতবাহী এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। তবে বুঝলেন এই ব্যাপারে তেমন কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে প্রয়োজন ডায়রির বর্তমান মালিকের সাথে কথা বলা।


সপ্তাহের বাকি কটা দিন কেটে গেলো গতানুগতিক ব্যস্ততায় । শুধু ডায়রিটার কথা মনে পড়লেই ভেতরে ভেতরে ছোটদের মত উত্তেজনায় ছট্ফট্ করে উঠছিলেন। যদিও বাড়িতে সেদিনের পর থেকে নিজে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করেন নি। 


অবশেষে রবিবার দিন সকাল ১০টা নাগাদ ব্রজবাবুর নির্দেশমত প্রফুল্লকে বগলদাবা করে বৈঠকখানা ঘরে হাজির করলো ছোটু। সেই সময় সত্য আর ব্রজবাবু দুজনেই হাজির ছিল সেখানে। মাসকাবারি বাজারের ফর্দ তৈরি করেছিলেন তারা। প্রফুল্ল কাঁচুমাচু হয়ে দাড়ালো সেখানে। ছোটু বলতে গেলে এক প্রকার হোস্টেল থেকে তুলেই এনেছে প্রফুল্লকে। প্রফুল্ল সবে সকালে উঠে জল খাবার খেতে নামছিল। তখনই সুপার তার ঘরে হঠাৎ ডেকে পাঠান প্রফুল্লকে। প্রফুল্ল ভেবেছিল হয়ত গত মাসের বাকি থাকা ভাড়া আদায়ের জন্য ডাক পড়েছে। প্রফুল্ল সুপারের ঘরে ঢুকতেই তিনি ছোটুকে দেখিয়ে বললেন- 'এই হল প্রফুল্ল ধর।' ছোটু প্রফুল্লকে দেখেই বলে উঠলো - " চলেন। দাদাবাবু ডাকতিছে। যেতি হবে এখুনি।" সুপারের দিকে প্রফুল্ল অবাক হতে তাকাতেই সুপার শুধু বললেন- "এসো।" তারপর ছোটু প্রায় মিলিটারি কায়দায় প্রফুল্লকে কোনো কিছু প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়েই সময় মত হাজির করেছে ব্রজবাবুর সামনে।


ব্রজবাবু প্রফুল্লর দিকে না তাকিয়েই হাতের ইশারায় বসতে বললেন তাকে। তারপর আবার সত্যর সঙ্গে ফর্দ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রফুল্ল চালাক ছেলে। ব্রজবাবুর বাড়ি এসে সে নিশ্চিত হলো যে এরা নিশ্চয়ই এই বাড়ির লাইব্রেরীতে গতকাল তার করে যাওয়া অপকর্মটি ধরে ফেলেছে। তাই ডেকে এনেছে। মনে মনে ভাবলো এখনই বাড়ি থেকে বইটা এনে ফিরিয়ে দেবে। যদিও একটা বিষয় তাকে বেশ অবাক করল। এরকম একটা ছোটো ভুল বা অপরাধের জন্য এভাবে বিনা নোটিসে হোস্টেল থেকে পাকরাও করে আনাটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না! আসলে প্রফুল্লের বরাবরই গল্পের বইয়ের নেশা। অবসরে বা ছুটির দিনে গল্পের বইই তার একমাত্র সঙ্গী। কলেজে ভর্তি হয়ে নতুন জায়গায় এসেই তাই খোঁজ করেছিল লাইব্রেরির। সবসময় তো আর বই কিনে পড়া সম্ভব হয় না।আর অত বই রাখবেই বা কোথায়। বন্ধুদের মুখে বান্ধবনগর পাঠাগারের নাম শুনে চলে এসেছিল সদস্যপদ নিতে। সেই পর্ব ভালো ভাবে মিটে গেলেও গেঁরো বেঁধেছিলো বই নিতে গিয়ে। বইয়ের বদলে বই নেওয়ার এমন অদ্ভুত নিয়ম জানা ছিল না তার। তাই বই নেবার সময় হাতে দেবার মত অন্য কোনো বই না থাকায় অকেজো ডায়রিটাই সুবলা পিসির হাতে মানে মানে গছিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছিল সে। আজ ব্রজবাবু প্রফুল্লর দিকে তাকাতেই প্রফুল্ল নিজে থেকেই কবুল করে নিল তার সেই অপরাধের কথা। 


সত্য পাশে দাঁড়িয়ে খেয়াল করলো ব্রজবাবু সেসব শুনেও তেমন কোনো গা করলেন না। বরং প্রফুল্লকে জিজ্ঞেস করলেন - " সকাল সকাল চলে আসতে হয়েছে যখন নিশ্চয়ই কিছু খেয়ে আসা হয়নি?" সেকথা শুনেই মাথা নামিয়ে নিলো প্রফুল্ল।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যকে তখন ব্রজবাবু হুকুম করলেন- " গিন্নিমাকে গিয়ে বল প্রফুল্লর জন্য লুচি তরকারির ব্যবস্থা করতে"। প্রফুল্লকে খাতিরদারি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও মনে মনে গজগজ করতে করতে সত্য পা বাড়ালো হেঁসেলের দিকে। 


ব্রজবাবু তারপর আবার প্রফুল্লর দিকে ফিরে ডাইরিটা দেখিয়ে বললেন- "এটা তোমার? মানে একান্তই তোমার তো?" নিঃশব্দে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিল প্রফুল্ল। ব্রজবাবু এবার জানতে চাইলেন - " ১৯৮০ সালের ডায়রি তুমি কোথায় পেলে? তখন তো হয় তোমার জন্ম হয় নি আর না হলে তুমি নেহাতই শিশু। কি ঠিক বলছি তো?" প্রফুল্ল জেরার মুখে আমতা আমতা করে বলল - " আজ্ঞে,হ্যাঁ মানে ঐটে আমার ছোট মামার ডায়রি।মামা অবিবাহিত ছিলেন। আমরা থাকতাম উত্তরপাড়ায়। বাবার অফিস কোয়ার্টারে। আমাদের অবস্থা এককালে স্বচ্ছলই ছিল। কিন্তু আমার বাবার ফ্যাক্টরি হঠাৎই একদিন লক আউট হয়ে যায়। একমাত্র রোজগেরে লোক ঘরে বসে পড়ায় আমাদের সংসার অথৈ জলে পড়ার উপক্রম হয়। সেই সময় আমাদের এই অবস্থা দেখে মামাই বলেন যে দাদুর অত বড় বাড়িটা যখন ফাঁকা পড়ে আছে, সবাইকে নিয়ে সেখানে সংসার পাতার জন্য। সেই মত বাবা আমাদের নিয়ে অফিস কোয়ার্টার ছেড়ে গুপ্তিপাড়ার মামাবাড়ীতে এসে ওঠেন। সেই থেকে আমরা ওখানেই থাকি। বছর পাঁচেক আগে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। মামাই ছিলেন আমাদের একমাত্র অবলম্বন। গত বছর আমার জন্মদিনে আমায় ডায়রিটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, - 'যত্ন করে রেখো ভাগ্নে। আমার শরীর ক'দিন ধরেই সুবিধের ঠেকছে না। ক'দিন আছি তার নেই ঠিক। তাই এটা তোমায় দিয়ে যেতে চাই। আর তুমি ছাড়া অন্য কোনো যোগ্য লোকও তেমন দেখি না, যে এটার কদর করতে পারবে। যদি ডায়রিখানা পড়ে মর্মোদ্ধার করতে পারো তাহলে হয়ত ভালো কিছু জুটতে পারে কপালে। ডায়রির শেষ পাতাটুকু পড়ে আমার তেমনই মনে হয়েছে।' আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম মামাকে যে তুমি কেনো নিজে সে কাজটি করছ না।তাতে মামা বলেছিলেন আমায় - ' যতটুকু সাধ্যে আর বুদ্ধিতে কুলিয়েছে ,চেষ্টা করেছি ভাগ্নে । কিন্তু পারিনি। এ ডায়রি তো আমারও ঠিক নিজের নয়, তোমার দাদুর বলতে পারো। আমার বাবা মানে তোমার দাদু গত হবার পর ওনার বালিশের নিচে এই ডায়রিখানা পাই। ভেতরে ছিল একটি চিরকুট রাখা। যাতে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা আমার নাম - 'রুকু'। শুনেছ নিশ্চয়ই বাবা মানে তোমার দাদুর কথা বন্ধ হয়ে গেছিলো শেষ বয়সে। তাই হয়ত বলে যেতে পারেননি কিছু। আমার ভালো নাম রুক্মিণী হলেও বাবা আমায় রুকু বলেই ডাকতেন। চিরকুটটা দেখে বুঝেছি বাবা এটা আমাকেই দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি ডায়রিটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু এই জীবদ্দশায় কোনো অৰ্থ খুঁজে বের করতে পারিনি। দেখো, তুমি যদি পারো।'


মামা আমাকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডায়রিটা দেন। তার তিন মাসের মধ্যেই মারা যান তিনি। অনেক দিন ধরেই ভুগছিলেন লিভার ক্যানসারে। আমিও গতবছর স্কুলের পাট চুকিয়ে সব কিছু নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে যাই এখানে। মা যদিও রয়ে গেছেন গুপ্তিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতেই। ডায়রিটা নিয়ে এসেছিলাম সাথে। সত্যি বলতে কি আমিও পড়ে কিছুই বুঝিনি। মনে হয় নি গুরুত্ব দেবার মত কিছু আছে বলে। মাকেও বলেছিলাম সে কথা। মা শুনে বলেছিলেন-' তোর দাদুর শেষ বয়সে মতিভ্রম হয়েছিল। একমাত্র মামা ছাড়া কাউকে ধারে কাছে ঘেষতে দিতেন না, ভুলভাল কথাবার্তা বলতেন। মনের ভুলে অনেক উল্টো পাল্টা কাজই করেছেন। এটাও হয়ত তেমন কিছু হবে'। আমারও শুনে তখন সেটাই সঠিক বলে মনে হয়েছিল আর এখনও তাই মনে হয়। " ব্রজবাবু পুরো ঘটনা শুনে বললেন - "ডায়রিটা আমার কাছে কিছু দিন থাক। তুমি লুচি তরকারিটা খেয়ে নাও । আর হ্যাঁ, যাবার আগে তোমার নিজের বাড়ির ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দিয়ে যেও।"


ব্রজবাবু দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর ডায়রিটা নিয়ে বসলেন লাইব্রেরীর রিডিং রুমে। এমনিতে রবিবার বলে বাইরের লোকের জন্য লাইব্রেরি বন্ধই থাকে। ফলে গোটা লাইব্রেরীতে ব্রজবাবু ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ আসার সম্ভাবনা নেই। এরকম একটি নিরুপদ্রব স্থান আর নিরিবিলি দুপুর বেলা মাথা খাটানো বা রহস্যের জট ছাড়ানোর জন্য যাকে বলে এক্কেবারে আদর্শ। ব্রজবাবু মন দিলেন কাজে। পাতা খুলেই যে ছড়াটা চোখে পড়লো সেটা আর পাঁচটা বাঙালির মত তারও জানা। ছড়াতে উল্লিখিত সব শব্দই তার চেনা। শুধু বর্গী শব্দের অর্থটা আরেকবার দেখে নেবেন ভেবে অভিধান খুললেন। দেখলেন যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। বর্গী অর্থে বোঝানো হয়েছে অষ্টাদশ শতকে লুণ্ঠনকারী মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীকে। আরো একটু বিশদে গিয়ে দেখলেন এই বর্গীরা ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লুঠপাট চালায়। সে সময় তাদের কীর্তিকলাপ বাংলার ঘরে ঘরে রীতিমত ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। বাংলার মসনদে নবাব আলীবর্দী খাঁর মত দক্ষ প্রশাসক থাকা সত্ত্বেও বর্গী আক্রমণ কোনোভাবেই প্রতিহত করা যায় নি। বরং ফি বছর তাদের অত্যাচারে বহু বাঙালি পরিবার কপর্দকশূন্য, ভিটে ছাড়া হয় । এর পাশাপাশি গোঁদের উপর বিষফোড়া হয়ে ওঠে চড়া হারে খাজনা আদায়ের জন্য তাগাদা। তাই বোঝাই যাচ্ছে তাদের সেই সন্ত্রাস এবং দারিদ্র্যের দিনগুলোরই প্রতিফলন ঘটেছে এই ধরনের ছড়ার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ডায়রির শুরুতেই এমন একটা ছড়া লেখার অর্থ যদিও তাতে স্পষ্ট হলো না। 

সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা আপাতত তিনি মুলতুবি রেখে পরের ছড়াটায় মন দিলেন। এক্ষেত্রে কাজটা প্রথম ছড়ার অর্থ উদ্ধারের মত অত সহজ হলো না।কয়েকবার পড়েও যুত্সই কিছুই তেমন বের করতে পারলেন না। ভেবে দেখলেন এই ব্যাপারে সত্য একটা কথা ঠিক বলেছে। আগেরটার মত এটা কিন্তু কোনো প্রচলিত ছড়া নয়। সম্ভবত ডায়রি যিনি লিখেছেন, এটি তারই নিজের লেখা। তাই এক্ষেত্রে লেখার সাথে জড়িত লেখকের ইঙ্গিত আঁচ না করতে পারলে অর্থ বোঝাটা সহজ হবে না। তাই মাথা ঠাণ্ডা করে আরেকবার গোড়া থেকে ভাবা শুরু করলেন ছড়াটা নিয়ে। এইবার আস্তে আস্তে মুখে হাসি ফুটতে লাগলো তার। ঠিক এমন সময়েই হঠাৎ দরজায় বেশ জোরে ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পেলেন। ডায়রিটা সামনের আলমারিতে কোনরকমে গুজে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাঁক দিলেন - "কে?" উত্তর এলো - "আমি, সত্য। "


দরজা খুলে দিতেই সত্য হাঁপাতে হাঁপাতে বললো- "একবার বসার ঘরে চলুন। আপনার সঙ্গে দেখা করবেন বলে প্রফেসর ভুজঙ্গ সান্যাল অপেক্ষা করছেন। বললেন আপনাকে এখনই ডেকে দিতে। খুব নাকি দরকার।" ব্রজবাবু গজগজ করতে করতে বললেন- 'তুমি বলতে পারলে না যে আমি ব্যস্ত আছি। পরে আসতে।" সত্য লাইব্রেরীর দরজা বন্ধ করতে করতে বলল- "বলেছিলাম তো। তাতে উনি বললেন যে ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করছি। উনি আসুক। ওনার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারবো না। আমি তাই বাধ্য হয়ে ডাকতে এলাম আপনাকে। যতই হোক প্রফেসর মানুষ বলে কথা।" কথা বলতে বলতে সত্য ভিজিটিং কার্ডটা এগিয়ে দিল ব্রজবাবুর দিকে। ব্রজবাবু একঝলক দেখে ফেরত দিয়ে বললেন - "হমম


, বান্ধব নগর কলেজের ইতিহাসের প্রফেসর। নতুন এসেছেন মনে হয়। নামটা তাই অচেনা ঠেকছে। চলো গিয়ে দেখি কি বক্তব্য।"


বসার ঘরে গিয়ে দেখলেন কৌচ জুড়ে বসে আছেন প্রফেসর সান্যাল। একমনে টেবিলের ওপরে রাখা বালিপাথরের নটরাজের মূর্তিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। ব্রজবাবুর ঘরে ঢুকলে ওনার দিকে না তাকিয়েই ব্রজবাবুকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন- "এটাতো মনে হচ্ছে উজ্জ্বয়ীনি তে পাওয়া নবম শতকের নটরাজ মূর্তির রেপ্লিকা। তাই না?" ব্রজবাবুর মুখে বিরক্তি আর আশ্চর্য ভাব একসাথে খেলা করে গেলো। তিনি দায়সারা ভাবে সম্মতি জানিয়ে বলেন - " হ্যাঁ, ওই আমার এক তুত ভাই ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট আর্কেইওলজিকাল মিউজিয়ামে কর্মসূত্রে আছেন অনেকদিন। তিনিই উপহারটি দিয়েছেন। তা বলুন কি ভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?" ভুজঙ্গ বাবু এবার ব্রজবাবুর দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন - "অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত। আসলে আমার ছাত্রের একটা জিনিস আপনার হেফাজতে রয়ে গেছে।সেটাই ফেরত নিতে এসেছি।" ব্রজবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন -"কার কথা আর কোন জিনিসের কথা বলছেন সেটা একটু খোলসা করে বললে ভালো হয়।" ভুজঙ্গ বাবু কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনী ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে শিকড়ের খোঁজে মানুষ বইটি বের করে টেবিলের ওপর রেখে বললেন- 'আমি আসলে প্রফুল্ল ধরের জমা রেখে যাওয়া সবুজ ডায়রিটা ফেরত নিতে এসেছি। ওটা আশা করি আপনার কাছেই আছে?" ব্রজবাবু এবার ভুজঙ্গবাবুকে ভালো করে জরিপ করে থেমে থেমে বললেন - "সবই তো বুঝলাম।কিন্তু প্রফুল্লর জিনিস আপনাকে কোন ভরসায় দেই বলুনতো। প্রত্যেক লাইব্রেরীরই তো একটা নিয়ম থাকে। আপনি প্রফেসর মানুষ, আপনি নিশ্চয়ই জানবেন।" তাকে মাঝপথে থামিয়ে ভুজঙ্গ বাবু বললেন-" আমি জানি। তবে আপনি বোধ হয় জানেন না, প্রফুল্ল আপনার বাড়ি থেকে ফেরার পরই তার মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশের বাড়িতে গেছে। যাওয়ার আগে আমাকে এই কাজটির জন্য অনুরোধ করে গেছে।" এই কথা বলতে বলতে তিনি একটি চিঠি এগিয়ে দিলেন ব্রজবাবুর দিকে। ব্রজবাবু দেখলেন প্রফুল্ল চিঠিতে একই কথা লিখে অনুরোধ করে গেছে ডায়রিটা ভুজঙ্গ বাবুর হাতে ফেরত দেবার জন্য। ব্রজবাবুর খটকা লাগলেও কিছু করার ছিল না। ডায়রিটা আনতে নিজেই গেলেন লাইব্রেরী। প্রথমে চিঠির সইয়ের সাথে রেজিস্টারে করা প্রফুল্লর সই মিলিয়ে দেখলেন। তারপর কি ভেবে ডায়রির ওই চারটে পাতার তারিখ আর ছড়াগুলো একটা খাতায় দেখে দেখে লিখে নিয়ে ডায়রিটা তুলে দিলেন ভুজঙ্গ বাবুর হাতে।


এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর হঠাৎই একদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ সত্যর ডাক পড়লো ওপরে, ব্রজবাবুর ঘরে। এত ভোরে তলব পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল সত্য। ব্রজবাবু সকাল আটটার আগে কোনোদিনই ঘুম থেকে ওঠেন না। তার মধ্যে গতকাল আবার বাড়িতে ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পুজো সারা হয়েছে । বাড়ির সকলেরই শুতে শুতে অনেক রাত হয়েছে। স্বভাবতই ক্লান্তি আর হেমন্তের ভোরের নরম শীতের আমেজ অগ্রাহ্য করে এত তাড়াতাড়ি ওঠার জন্য যথেষ্ট কারণ থাকা দরকার। এসব মনে হতেই হঠাৎ কোনো বিপদের কথা আঁচ করে মনকে প্রস্তুত করলো সে। গায়ে একটা আলোয়ান জড়িয়ে তড়িঘড়ি হাজির হলো দোতলায়।


গিয়ে দেখলো সারা ঘর জুড়ে উদভ্রান্তের মত পায়চারি করছেন ব্রজবাবু। পাশে গিন্নি মা একটা ক্যাম্বিস ব্যাগে ব্রজবাবুর কিছু জামা কাপড় ঢুকিয়ে রাখছেন। সত্যকে দেখেই ব্রজবাবু হুকুম করলেন - "এক্ষুনি আমার প্রফুল্লর ঠিকানা লেখা চিরকুটটা চাই। আজই ওর বাড়ি যেতে হবে। না হলে বিপদ ঠেকানো যাবে না কিংবা...." একটু থেমে বললেন ".. কে বলতে পারে হয়ত এতক্ষণে বিপদ যা ঘটার ঘটে গেছে।" সত্য বিনা প্রশ্নে তার কাছে রাখা প্রফুল্লর হাতে লেখা চিরকুটটা এগিয়ে দিলো। সেটার দিকে চোখ বুলিয়ে সত্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন - " যাক, খুব ভুল কিছু আন্দাজ করিনি তবে। বাকিটা হিসেব কষে মেলাতে হবে। এখন কোনো প্রশ্ন করো না। সময় এলে সব বুঝবে। আপাতত ছোটুকে বল গাড়ি বের করতে। আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে বেরোবো।তুমিও চটপট রেডি হয়ে নাও। আর হ্যাঁ, এক দুদিনের মত জামাকাপড় গুছিয়ে নিও সাথে। দরকার পড়তে পারে। আমরা হুগলির গুপ্তিপাড়ায় যাবো। তবে তার আগে কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে যাবো। " সত্য শুধু 'আজ্ঞে' বলে ঘাড় হেলিয়ে ছোটুকে খবর দিতে বেরিয়ে গেলো। 


প্রথমেই দুজনে পরিকল্পনামাফিক পৌঁছে গেলো কলেজের প্রিন্সিপাল মানে আহমেদ স্যারের বাড়ি। অত সকালে বিনা আমন্ত্রণে দুজনকে দোরগোড়ায় দেখে বেশ অবাকই হলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন - "কি ব্যাপার ব্রজবাবু, এত সকালে? পাড়ায় কোনো বিপদ আপদ ঘটলো নাকি?" ব্রজবাবু খানিক লজ্জা পেয়ে বললেন - " না, তেমনটা নয়। আসলে দরকারটা খানিক আমারই।আপনার সাথে দেখা করতে কলেজেই যেতাম। কিন্তু কলেজ খোলা অব্দি অতটা সময় আমাদের হাতে নেই বলেই সরাসরি আপনার বাড়িতে চলে এলাম। বেশি কিছু নয় ,আমার দুজনের সম্বন্ধে কিছু তথ্য দরকার"। আহমেদ স্যার বললেন-" বেশ তো। সে সব হবে খনে। আগে ঘরে চলুন। বসে আলোচনা করছি।" ব্রজবাবু শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন -" না না স্যার। আজ থাক। পরে একদিন বসে গল্প করবো। আমাকে শুধু বলুন আপনাদের কলেজের নতুন ইতিহাসের প্রফেসর সান্যাল বাবুকে কোথায় পাবো?" আহমেদ স্যার একটু ভেবে বললেন - "তিনি তো ছুটি নিয়েছেন এই সপ্তাহটা। বললেন বম্বেতে কি যেনো একটা গবেষণা সংক্রান্ত কাজ আছে।" শুনে ব্রজবাবু স্বগতোক্তি করে বললেন- " তেমনটাই আশা করেছিলাম।" আহমেদ স্যার স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে শুধলেন - " আপনি কিছু বললেন?" তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ব্রজবাবু বললেন - " না না, ও কিছু না। আমার আরেকটা প্রশ্ন ছিল। আপনাদের কলেজে প্রথম বর্ষের প্রফুল্ল ধর নামে একটি ছেলে পড়ে। সেও কি কলেজে আসছে না? একটু যদি খোঁজ নিয়ে বলতে পারেন।" আহমেদ স্যার সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন - " তা পারি। কিন্তু কেনো বলুন তো?" ব্রজবাবু বললেন - " মাফ করবেন। কারণটা এখনই বলতে পারছি না। আর হয়ত এখনো বলার মত তেমন কিছু ঘটেনি । পরে আপনাকে সব খুলে বলবো। আপনি শুধু এই তথ্যটুকু আমাকে জোগাড় করে দিন।" আহমেদ স্যার এবার ফোনে খানিক খোঁজ খবর করে জানালেন - "প্রফুল্ল ধর প্রায় দু সপ্তাহ কলেজে আসছে না। সম্ভবত দেশের বাড়ি গেছে । ওর মার অসুস্থতার কারণে।" ব্রজবাবু এবার আহমেদ বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওয়ানা দিলেন গুপ্তিপাড়ার পথে।


তিন ঘন্টার পথে সারাটা রাস্তা একটা কথাও বললেন না ব্রজবাবু। একবার শুধু বিড়বিড় করে বললেন- " বিন্ধ্যবাসিনী, মা দুর্গা আর মা জগদ্ধাত্রী যে মহামায়ারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ তা আগে কেনো মাথায় এলো না আমার।" আরেকবার উদ্দেশ্যহীন ভাবে সত্যকে বললেন- "আচ্ছা সন্দেশ ও তো মিষ্টি, তাই না?" যদিও সত্যের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার ডুবে গেলেন গভীর চিন্তায়। 


সারা রাস্তা আর কোনো কথা বললেন না ব্রজবাবু। এদিকে খিদে পেলেও সত্য, ব্রজবাবুর মেজাজ দেখে মুখ ফুটে কিছু বলারও সাহস পেলো না। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে কর্তামা কিছু নাড়ু আর মুড়ি দিয়ে দিয়েছিল ব্যাগে করে। সেই দিয়েই তখনকার মত পেট ভরালো সে। 


দেখতে দেখতে ছোটু ঠিক পথ চিনে প্রফুল্ল ধরের লেখা ঠিকানা অনুযায়ী সময়মতোই অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা এনে হাজির করলো পার্বতী নিবাসের সামনে। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষনে বারোটা ছুঁই ছুঁই। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো পেল্লায় আকারের দোতলা বাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সেটা বেশ পুরনো দিনের। বয়স না হলেও প্রায় একশো বছর তো হবেই, বরং তার বেশিই হতে পারে। চোখে পরলো বাইরে শ্বেতপাথরের ফলকে ক্ষয়ে যাওয়া হরফে লেখা নাম - পার্বতী নিবাস। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় রক্ষণা বেক্ষণের অভাবে বাইরের পলেস্তরা খসে বেরিয়ে পড়েছে ইটের পাঁজর। পাঁচিলের চারপাশে আগাছার জঙ্গল থাকলেও শ্বেত পাথরের ভাঙ্গা ফোয়ারা, হাত ভাঙ্গা পরীর মূর্তি, নক্সা করা রেলিং দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না যে একসময় এখানেই কেয়ারি করা বাগিচা ছিল। তখন বাড়ির মালিক শুধু অর্থবান নয় , ছিলেন রুচিশীল এবং শিল্পের সমঝদারও বটে। যদিও এখন আর সেই সুদিন নেই, আর তারই ছাপ পড়েছে বাড়ির আনাচে কানাচে।

মূল ফটক পেরিয়ে সত্য আর ব্রজবাবু ঢুকলেন অন্দরে। একতলায় ঢুকতেই চোখে পরলো শ্যাওলাধরা ,ভাঙ্গা বর্গাকার প্রশস্ত উঠোন। চারপাশের বারান্দা জুড়ে সারি সারি সাত / আট খানা ঘর। যদিও সেগুলোর বেশিরভাগই তালা বন্ধ। তিনটে মত ঘরে লোক আছে বলে মনে হলো। বাইরে দড়িতে ছড়ানো গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি তার প্রমাণ। একটা ঘর থেকে মৃদু সুরে ভেসে আসছে রেডিওর গান। সেদিক পানে গলা তুলে সত্য জিজ্ঞেস করল - "শুনছেন, এটা কি প্রফুল্ল ধরের বাড়ি।" কোনো উত্তর এলো না কোথাও থেকে। সত্য আবার স্বর চড়িয়ে একই প্রশ্ন করলো। এবারে কাজ হল। ডানদিকের সারির তিন নম্বর ঘর থেকে একটা দশ বারো বছরের ছেলে বেরিয়ে এসে বললো- "কাকারা তো ওপরে থাকে।" তারপর আবার "মা চান হয়ে গেছে, ভাত দাও" বলতে বলতে ছুটে গেলো কোনার একটা ঘরের দিকে। 


সত্য এবার ব্রজবাবুর মুখের দিকে তাকালো। ব্রজবাবু সম্মতি জানাতেই সত্য এগিয়ে গেল। ব্রজবাবুও সত্যর পিছু পিছু একপাশে গোল হয়ে উঠে যাওয়া সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন। দোতলার অবস্থাও তথৈবচ। লম্বা লম্বা ফাটল ধরেছে অলিন্দ জুড়ে। তার একধার দিয়ে একতলার মতই অনেকগুলো ঘর পরপর সাজানো। একটা ঘরের বাইরে দেখা গেল ফ্যানের হাওয়াতে পর্দা উড়ছে। দু এক জোড়া জুতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ঘরের বাইরে। সেদিকেই এগিয়ে গেলো দুজনে।

সত্যই শুধল- "ভেতরে আসতে পারি?" অন্দর থেকে দুর্বল মেয়েলি কণ্ঠে উত্তর এলো -" কে প্রফুল্ল নাকি? " সত্য উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু সত্যকে থামিয়ে ব্রজবাবু বললেন - " আমরা বিশেষ একটি দরকারে বান্ধব নগর থেকে আসছি। আপনার সাথে একটু কথা বলার ছিল। ভেতরে যেতে পারি?" ভেতর থেকে মিনমিন সুরে উত্তর এলো - "এসো। "


ঘরে ঢুকতেই ভ্যাপসা একটা গন্ধ এসে লাগলো নাকে। ঘরের ভেতরে চাপা অন্ধকার। খড়খড়ি দিয়ে চুইয়ে পড়া আলোতে দেখা গেল পুরোনো দিনের একটি পালঙ্কের ওপর একজন কঙ্কালসার প্রৌঢ়া শুয়ে আছেন। তিনি কাঁপা কাঁপা হাত দুটো জড়ো করে বললেন - " নমস্কার। বসুন। আপনাদের প্রফুল্ল পাঠিয়েছে বুঝি? " ব্রজবাবু সে কথার উত্তর না দিয়ে সংক্ষেপে নিজেদের পরিচয় দিলেন। তারপর বললেন - " আমরাও আসলে প্রফুল্লের খোঁজেই এসেছিলাম। প্রফুল্লর এখানেই তো আসার কথা। চিন্তা করবেন না, মাসিমা। হয়ত কোনো কাজে আটকে পড়েছে। দু একদিনে ঠিক চলে আসবে।" ভদ্রমহিলা চিন্তার সুরে বললেন - " তাই হয়ত হবে।" 

ব্রজবাবু তারপর সেই মহিলার সাথে কথায় কথায় জানতে পারলেন, ইনিই প্রফুল্লর মা নীভা দেবী। দীর্ঘ মেয়াদি কোনো জটিল অসুখে ভুগছেন। এখন প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকেন। বাড়িখানা উত্তরাধিকার সূত্রে নীভা দেবী তার পিতৃদেবের থেকে পেয়েছিলেন। এ বাড়িতেই একে একে গত হয়েছেন প্রফুল্লর দাদু, বাবা এবং মামা। বর্তমানে বাড়িতে রোজগেরে তেমন কেউ নেই। সংসারে আয় বলতে একতলায় তিনঘর ভাড়াটিয়ার দেওয়া ভাড়া, নিজের সামান্য পেনশনের টাকা আর প্রতি মাসে বড়ো মেয়ের কলকাতা থেকে পাঠানো সামান্য কিছু খোরাকি। এর প্রায় সবটাই চলে যায় সংসার খরচ আর প্রফুল্লর পড়ার খরচ মেটাতে। ফলে অনটনের কারণে চিকিৎসায় গাফিলতি লেগেই থাকে। গত হপ্তায় প্রফুল্ল নাকি হঠাৎই একদিন বাড়ি এসেছিল। তারপর তিনদিনের মাথায় আবার দুম করে বেপাত্তা হয়ে যায়। এক বন্ধুকে দিয়ে একদিন পর খবর পাঠায় যে সে কলকাতা যাচ্ছে বিশেষ প্রয়োজনে। দু একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। কিন্তু সময়সীমা পেরিয়ে যাবার পর কেটে গেছে আরো দুদিন। প্রফুল্ল এখনো এ বাড়ি মুখো হয়নি। নীভা দেবী তাই ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। তিনি এও বললেন, প্রফুল্ল যে বন্ধু মারফত তার কলকাতা যাওয়ার খবর পাঠিয়েছিল ,তাকে নাকি প্রফুল্ল বলে দিয়েছে সে না ফেরা অব্দি মায়ের কাছে থাকতে। ব্রজবাবুর কথাটা শুনেই একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠলো মুখে। মনের ভাব গোপন করে তিনি বললেন - " সে একদিক দিয়ে প্রফুল্ল ভালই করেছে। আপনার তো শরীর ভালো নয় । তা সে কোথায়? দেখছি না তো আশে পাশে কাউকে।' নিভা দেবী জানালেন, সে নাকি কিছুক্ষণ আগেই গেছে। খেয়েদেয়ে আসবে। নীভা দেবী ব্রজবাবুদের প্রথম দিনের পরিচয়ে, অল্প সময়ের কথা বার্তাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ,ছেলের এই বন্ধুটিকে তাঁর মোটেই পছন্দ নয় । ব্রজবাবুরা নিজেদের প্রফুল্লর পাড়াতুত দাদা বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন - " আসলে গুপ্তিপাড়ায় আমার স্ত্রীয়ের এক আত্মীয়া থাকেন। সেখানে পুজো দেখতে এসেছিলাম। প্রফুল্ল বলেছিল এখানে এলে একবার ঘুরে যেতে। তাই এসেছিলাম আর কি। ভালই হল আপনার সাথে পরিচয় হয়ে। আজ উঠি। প্রফুল্ল ফিরলে নয় আসবো একদিন ।" মনে না চাইলেও প্রয়োজনের খাতিরে খানিক বাধ্য হয়েই সেদিন ব্রজবাবুকে এটুকু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিলো।


তাদের কথা বলার মাঝেই মিনিট দশেকের মাথায় একজন ষন্ডা মত লোক দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ঘরে ঢুকলো। নীভা দেবী পরিচয় করিয়ে দিলেন- "এই হলো প্রফুল্লর বন্ধু, মানস।" সত্য অবাক হয়ে দেখলো সৌজন্যের ছিটে ফোঁটাও দেখালো না লোকটা। উল্টে তাদের সামনেই নীভা দেবীকে ধমকের সুরে বলল- "এসব উটকো লোককে যখন তখন বাড়িতে ঢোকান কেনো? আপনার হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে প্রফুল্লকে কি জবাব দেব? জানেন না, আপনার বেশি কথা বলা বারণ।" ব্রজবাবু লোকটার কথায় পাত্তা না দিয়ে নীভা দেবীর দিকে ফিরে করজোড়ে বললেন - "আজ তবে আসি মাসিমা। আপনার খাওয়ার দেরি করিয়ে দিলাম অযথা । আমরা পরে আবার আসবো। চিন্তা করবেন না। প্রফুল্ল খুব শিগগির ফিরে আসবে।" নিভা দেবী কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বললেন- "তাই যেনো হয় ঠাকুর।" সত্য, ব্রজবাবুর সাথে বেরিয়ে এলো পায়ে পায়ে। মুখে কিছু না বললেও সত্য আন্দাজ করতে পারলো এই ক'দিনে একটা গভীর রহস্যের জাল চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে তাদের।



ব্রজবাবু ও সত্য পার্বতী নিবাস থেকে বেরিয়ে অন্নপূর্ণা হোটেলের দিকে এগোলেন। গঙ্গার ধারে হোটেলটা ছোটর ওপর বেশ ছিমছাম আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এত কম সময়ে এরকম একখানা আস্তানা জোগাড় করতে পারার কৃতিত্ব অবশ্য সম্পূর্ণই ছোটুর। ব্রজবাবুরা পার্বতী নিবাসের অন্দরে যখন কথা বলতে ব্যস্ত ছিলেন তখন ছোটুই স্থানীয় লোকেদের থেকে কথা বলে জেনেছিল এই হোটেলের সন্ধান। হোটেলে লোকজনদের ব্যবহার এবং রান্নাবান্না দুটোই বেশ ভালো মানের। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ব্রজবাবু নিজে থেকেই গল্প জমালেন হোটেলের ম্যানেজার কুন্তল বাবুর সঙ্গে। তারপর বিকেল বেলা চা, ফুলকপির সিঙ্গারা খেয়ে সত্যকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ঘুরতে। এবার যদিও আর নিজের বাহনে নয়, পায়ে হেঁটে আর রিক্সায় চেপেই চষে বেড়ালেন মন্দিরে ঘেরা এই শহরের নানান জায়গা।

সন্ধ্যে নামার মুখে ব্রজবাবু রিক্সাওলাকে বললেন - "ভাই এবার বিন্ধ্যবাসীনি মন্দির নিয়ে চল। " নামটা শুনেই চমকে উঠলো সত্য। এই নামটাই তো পড়েছিল সে সবুজ ডায়রীতে। এবার আর উৎসাহ গোপন করে রাখতে পারলো না সত্য। ব্রজবাবুকে সাহস করে জিজ্ঞেসI করেই বসলো - "আচ্ছা কর্তাবাবু, এই বিন্ধ্যবাসীনি মন্দিরের কথাই কি বলা হয়েছিল ওই সবুজ ডায়রীতে?" ব্রজবাবু মুখের হাসি গোপন রেখে ভারিক্কি চালে বললেন - " তা আমি কি করে বলবো বলো? সে ডায়রি তো আর আমার হাতে নেই। তোমার সামনেই তো ফেরত দিয়ে দিয়েছি। এখানে আমি এসেছি আমার ব্যবসার কাজে।..' এই কথা বলতে বলতে আড়চোখে সত্যের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন যে সত্য মোটেই তার এই কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। সেই বুঝে ব্রজবাবু বলে চললেন - " তুমি তো জানো,সত্য, আমার কনস্ট্রাকশনের বিজনেস। গুপ্তিপাড়া মন্দিরের শহর। এখানে জোড় বাংলো, এক রত্ন, আটচালা সহ বিভিন্ন আঙ্গিকের বেশ কিছু টেরাকোটার মন্দির আছে। শিল্পের নিরিখে এই সব মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী যথেষ্টই উচ্চমানের। শিল্পরসিকদের কাছে এই ধরনের মন্দিরের গুরুত্ব এখনো অপরিমেয়। আর সে কারণেই হয় তো এই অঞ্চলে পঞ্চ রত্ন মন্দিরের ধাঁচে একটি বিষ্ণুমন্দির গড়ার বরাত পেয়েছে আমাদের কোম্পানি। বুঝতেই পারছ বড় প্রজেক্ট আর অনেক টাকার কাজ। তাই দেরি না করে নিজেই তড়িঘড়ি চলে এলাম। বেরোনোর সময় প্রফুল্লর কথা মনে পড়লো হঠাৎ। ছেলেটার বাড়ির ঠিকানায় এই গুপ্তিপাড়া নামটা দেখেছিলাম মনে হল। তাই তোমার কাছে চিরকুটটা চেয়েছিলাম। ভালই হলো কি বলো? একই সাথে রথ দেখা আর কলা বেঁচা দুইই হল!" সত্য তখনও ব্রজবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন বোকার মত। ব্রজবাবু বললেন - " ও হ্যাঁ, রথের কথা বলতে মনে পড়লো, হোটেলের ম্যানেজার বাবু বলছিলেন , এখানের রথ নাকি খুব বিখ্যাত । ওই সময় কলকাতা ও আশেপাশের জেলাসহ রাজ্যের অনেক জায়গা থেকেই অনেক পর্যটক এখানে ভীড় জমান।এখানে কোনো হোটেলেই তিল ধারণের জায়গা থাকে না তখন।..." কথা বলা চলতে চলতেই রিক্সাওয়ালা জানালো - "এসে গেছি বাবু। ওই যে মন্দির। " ভাড়া মিটিয়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন দুজনে। ব্রজবাবু পেছনে না ফিরেও চশমার কোনে চোখ রেখে দেখতে পেলেন নীল রঙের বাইকে প্রফুল্লর সেই ষন্ডা মার্কা বন্ধু হুশ করে ঢুকে গেলো মন্দিরের পেছনের গলিতে। 


ততক্ষনে সেদিনের মত শেষ হয়েছে সূর্যদেবের ডিউটি। চার্জ হ্যান্ড ওভার নিয়েছে রাতের আকাশে চাঁদ তারাদের দল। সন্ধ্যারতির জন্য আস্তে আস্তে মন্দির চত্বরে ছোটোখাটো একটা ভিড় কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছে। তারই মধ্যে কুন্তল বাবুর পরিচিত হিসেবে পরিচয় দিয়ে আলাপ সেরে রাখলেন পুরোহিত মশাই শিবনাথ চক্কত্তির সাথে। আরতি শেষ হবার পর দুর্গা দালানে বসে ব্রজবাবুর অনুরোধে শিবনাথ চক্কত্তি শোনালেন তাদের গুপ্তিপাড়ার ইতিহাসের জড়িয়ে থাকা এই মন্দিরের গল্প - " এই সেই মা বিন্ধ্যবাসীনী যাঁর পূজা এককালে শুরু করেছিলেন এই অঞ্চলেরই বারোজন বন্ধুস্থানীয় মানুষ মিলে। সময়টা ১৭৯০ সাল নাগাদ হবে। গুপ্তিপাড়ার ভূস্বামী ,বল্লাল সেনের বংশধর রাম সেনের উদ্যোগে ১৫৮৩ সাল থেকে চলে আসা সেনবাড়ির পারিবারিক দুর্গা পূজায় ব্রাত্য ও অপমানিত মানুষজন এককাট্টা হয়ে শুরু করেন এই পুজো। শোনা যায় যে পুজো শুরুর সূচনা কাল থেকেই এই পুজোয় সর্ব সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না।১৭৯০ সালে তৎকলীন জমিদার কীর্তিচন্দ্র সেন বাড়ির পুজো চলাকালীন গ্রামেরই কয়েকজন যুবকের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে জমিদার বাড়ি থেকে তাঁদের বের করে দেন। মনমরা সেই বারো জন ব্রাহ্মণ বন্ধু এসে বসেন সেনবাড়ির অদূরে এই বিন্ধ্যবাসিনীতলায়।


তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে জমিদারবাড়ির পুজোর বাইরে নতুন করে নিজেদের উদ্যোগে পুজো শুরু করবেন তাঁরা। পরিকল্পনা মোতাবেক রাতারাতি গ্রামের লোকজনের থেকে চেয়ে চিন্তে জোগাড় করেন কিছু টাকা। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিন্ধ্যবাসিনীতলার জঙ্গল পরিষ্কার করে সেই টাকায় প্রতিষ্ঠা করেন দেবীর বেদি । কিন্তু ততদিনে দুর্গাপুজো প্রায় শেষ! সে পূজো করতে হলে আবার এক বছরের অপেক্ষা। অগত্যা ভেবেচিন্তে নতুন একটা উপায় বের করেন ‘বারো ইয়ার’। ঠিক হয় পরের নবমী তিথিতেই ওই বেদিতে গ্রামের সকলের চাঁদায় করা হবে জগদ্ধাত্রী পুজো। তিনিও দুর্গারই আর এক রূপ। গুপ্তিপাড়ার সেই বারো জন বন্ধুর জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে ভিড় করেন আশপাশের গ্রামের অনেকেই। মুখে মুখে রটে যায় বারো ইয়ারের পুজোর কথা। স্থানীয় মানুষজন সেই প্রথম প্রাণ খুলে সামিল হন পুজোর আনন্দে। সেই থেকেই ঘটা করে এইখানে পূজো হয়ে আসছে বছরের পর বছর। এইভাবেই বারো জন যুবকের হাত ধরে দুর্গাপূজায় সর্বজনের অংশগ্রহনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই রীতি কালক্রমে গুপ্তি পাড়ার পরিধি ছাড়িয়ে বাংলার অন্যান্য স্থানেও অনুসৃত হতে থাকে, যার বর্তমান রূপ আজকের এই সার্বজনীন দুর্গাপূজা। বারোজন বন্ধু বা ইয়ার মিলে এই পুজোর সূচনা করেছিল বলে সার্বজনীন পুজোর আরেকটি প্রতিশব্দ হিসেবে বারোয়ারি পুজোর ধারণাটি চিরকালের মত বাংলার অভিধান তথা বাংলার সংস্কৃতিতে পাকাপাকি ভাবে স্থান করে নেয়।" পুরোহিত মশাইয়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতেই মন্দিরে দেবীকে ভোগ নিবেদনের সময় হয়ে আসে। সেদিনের মত গল্প থামিয়ে পুরোহিত মশাই এগিয়ে যান গর্ভগৃহের দিকে। ব্রজবাবু আর সত্য হোটেলের পথ ধরেন। 



ব্রজবাবু ঘড়ির ডায়ালে চোখ রেখে দেখলেন , ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁইছুঁই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশায় উঠে পড়লেন চটপট। রাস্তায় বেশিরভাগ দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আলো কমে এসেছে বেশ। সেই অল্প আলোতেই রিক্সাওলার হ্যান্ডেলে লাগানো কাঁচে ব্রজবাবু লক্ষ্য করলেন বেশ খানিকটা তফাৎ রেখে তাদের পিছু পিছু ছুটে আসছে সেই নীল বাইকটাও। ব্রজবাবুর ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল আবার।

সেদিন হোটেলে ফিরেই দুজনে শরীরটাকে ছুড়ে দিলেন নরম বিছানায়। সারাদিনের যাতায়াতের পরিশ্রমে আর ক্লান্তিতে কিছুক্ষনের মধ্যেই তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে।

পরদিন অনেক ভোরে উঠলেন ব্রজবাবু। সত্য তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ব্রজবাবু নীচে নেমে সকালের জলখাবার খেয়ে ছোটুকে ডেকে একাই বেরিয়ে পড়লেন গাড়ি নিয়ে । যাবার আগে সত্যকে ডেকে বললেন - " আমি বেরোচ্ছি। কিছু কাজ আছে। তুই এখন ঘরেই থাক। আমি না আসা অব্দি বেরোবি না। কেউ ডাকলেও না।"

গাড়িতে উঠতে উঠতেই ছোটুকে বললেন - " চোখ কান একটু খোলা রাখিস।" ছোটু বহুদিনের পোড় খাওয়া ড্রাইভার। মনিবের সেটুকু ইশারাই যথেষ্ট ছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছোটু দেখলো, তাদের অ্যাম্বাসাডর গাড়ির পিছু পিছু নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে একটা নীল বাইক ধাওয়া করে আসছে। কঠিন হয়ে এলো ছোটুর চোয়াল। স্টিয়ারিং এ রাখা হাতের আঙ্গুলগুলো আরো শক্ত হয়ে চেপে বসলো।ব্রজবাবু এবার রাস্তার দিকে দেখতে দেখতে শুধু হালকা স্বরে বললেন - 'আগ বাড়িয়ে কিছু করিস না কিন্তু। নতুন জায়গা, মেপে পা ফেলিস '। ছোটু মুখে কিছু না বলে হালকা করে ঘাড়টা হেলিয়ে দিল ।


পিছনে ফেউ লেগেছে দেখে একদিকে মনে মনে খুশিই হলেন ব্রজবাবু। এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে অপরাধী এখনো রহস্যের কিনারা করে উঠতে পারেনি আর তাই ব্রজবাবু আর সত্যর মত অনভিপ্রেত লোকজনকে খরচের খাতায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। 

আজ ব্রজবাবু প্রথমেই গেলেন শিশির বাণী মন্দির পাঠাগারে। এটি এই অঞ্চলের বেশ সমৃদ্ধ ,সরকার পোষিত পাঠাগার। ব্রজবাবু ব্যবসায়ী মানুষ। বাড়িতে এত বই থাকলেও আর মনে মনে ইচ্ছে হলেও ইদানিং সেই ভাবে আর বইপত্র পড়ার সময় বা সুযোগ কোনোটিই হয় না। এদিকে এই ধরনের রহস্য উদঘাটনের জন্য বিভিন্ন বিষয় বিশেষত এই ক্ষেত্রে ইতিহাসের ওপর যতটা ব্যুৎপত্তি থাকা প্রয়োজন তার তিনি বেশ অভাব বোধ করছিলেন। প্রফুল্লর ডায়রিটা পড়ার পর থেকেই তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাঁকে বারবার জানান দিচ্ছিল যে ঠিক ঠিক ভাবে এগোতে পারলে, গুপ্তি পাড়ার এই গুপ্ত রহস্যের কুহেলিকা ছিন্ন করে উঠে আসতে পারে বাংলার ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়। অথচ মুশকিল হচ্ছিল যে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে ঠিক ঠাক ভাবে তথ্য না থাকায় খানিকটা অনুমানের ওপর নির্ভর করেই অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তে হচ্ছিল তাঁকে। মূলত মনের সেই অন্ধকার দূর করতেই আজ তার লাইব্রেরীতে আসা। 

শিশির বাণী মন্দির লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান বেণীমাধব গোস্বামী বেশ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। পাঠাগারে ব্রজবাবুর মত উৎসাহী জ্ঞানপিপাসু পাঠকের দেখা তিনি সচরাচর পান না। তাই বেশ খুশি খুশি মনেই ব্রজবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ছোট ছোট তথ্য আর আখ্যানের মোড়কে পরিবেশন করলেন গুপ্তিপাড়ার প্রাচীন ইতিহাস। জানা গেল এক কালে এই গুপ্তিপাড়া ছিল বাংলায় সংস্কৃত চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। স্বাভাবিক ভাবেই এই অঞ্চলে ছিল বহু সংস্কৃত পণ্ডিতদের টোল। সেই সময়ে তাদের লেখা বহু পুঁথিই পরবর্তী কালে উদ্ধার হয় এবং তার বেশ কিছু সংরক্ষিত হয়েছিল এই পাঠাগারে। এমনিতে তেমন আগ্রহী বা বিশ্বস্ত মানুষজন না হলে বেণীমাধব বাবু সহজে এই পুঁথি গুলো দেখান না কাউকে। দিনকাল ভালো নয়। তার মধ্যে এ পাড়াতে চোর ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব লেগেই থাকে বছরভর। তাই এসব পুঁথি পত্তরের সন্ধান সকলে জানলে খোয়া যাবার ভয় থেকে যায়। চোরাই মালের বাজারে এসব জিনিসের ভালো দাম আছে। তবে ব্রজবাবুর সাথে কথা বলে বেশ ভরসা পাওয়াতেই ব্রজবাবুর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না তিনি। আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে দোর বন্ধ করে দেখালেন বেশ কিছু পুঁথি। ব্রজবাবু বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন সেসব। তারপর একসময় সেগুলো ফেরত দিয়ে বেণীমাধব বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলেন পাঠাগার থেকে।


ব্রজবাবু মনে মনে অনেক আগে থেকেই ফন্দি আঁটছিলেন পিছু ধাওয়া করা লোকটার চোখে ধুলো দিয়ে পার্বতী ধাম পৌঁছনোর । প্রথম দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, প্রফুল্লর বন্ধু বলে পরিচয় দেওয়া এই লোকটি তাকে সেখানে দেখতে পেলে কখনোই তাকে নিভা দেবীর ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। অথচ তদন্তের স্বার্থে নিভা দেবীর সাথে খোলাখুলি বেশ কিছু ব্যাপারে কথা বলা প্রয়োজন।

 ব্রজবাবু খোঁজ খবর করে বুঝেছিলেন গুপ্তিপাড়ার এই পাঠাগারটি বেশ বড়, অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই মূল ফটক ছাড়াও বাইরে বেরোনোর এক বা একাধিক দরজা থাকা উচিত । তবে আদৌ আছে কিনা তেমন কিছু , সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। এক্ষেত্রে আজ ব্রজবাবুর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। পাঠাগার থেকে বেরিয়ে হঠাতই চোখে পড়ল সিঁড়ির পেছনে ওয়াশরুমের গা লাগোয়া তালা বিহীন একটা জং ধরা গ্রিলের দরজা। বিনা কসরতেই সেটা খুলেই বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। সামান্য ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে সরু রাস্তা ধরে গিয়ে উঠলেন উল্টোদিকের মেন রোডে। তারপর সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটিকে ডেকে দরদাম না করেই উঠে পড়লেন চটপট। সওয়ারি নিয়ে রিক্সা চললো পার্বতী নিবাসের দিকে।

ছোটুকে আগেই বলে রেখেছিলেন যে লাইব্রেরির সামনে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে। তার মধ্যে তিনি না ফিরলে ছোটু যেনো হোটেলে ফিরে যায় আর বিকেলের মধ্যে না ফিরলে অবশ্যই একবার যেনো থানায় খবর দেয়। ছোটু সেই অনুযায়ী বেলা এগারোটা নাগাদ ফিরে গেলো হোটেলে। ছোটুর খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া দেখে ষন্ডা লোকটা একটু ফাঁপরে পড়ে গেলো। সাত পাঁচ ভেবে কুল কিনারা না পেয়ে শেষমেষ ব্রজবাবু লাইব্রেরীতে আছেন ভেবে লাইব্রেরির সামনেই বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়।

ততক্ষনে ব্রজবাবু পৌঁছে গেছেন পার্বতীনিবাস। আজ একেবারে সরাসরি দোতলায় উঠেই দেখতে পেলেন এক জোড়া পালিশ করা বুটজুতো দরজার বাইরে রাখা। হাওয়ায় নড়ছে পর্দখানা। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখলেন, খাটে শুয়ে আছেন নিভা দেবী।শরীরটা প্রায় বলতে গেলে মিশে গেছে বিছানার সঙ্গে। ব্রজবাবুর দিকে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে ইনজেকশন রেডি করছেন এক ভদ্রলোক, সম্ভবত ডক্টরই হবেন। ব্রজবাবুকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে একটু তাড়াতাড়িই যেনো ইনজেকশনটা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। যাবার আগে নিভা দেবীকে খানিক ধমকের সুরেই বলে গেলেন - " কথা বেশি বলবেন না একদম। ঘুমোনোর চেষ্টা করুন। আপনার হার্ট বেশ দুর্বল। এই অবস্থায় যে কোনো রকম পরিশ্রমই বিপদ ডেকে আনতে পারে।" ঘর থেকে বেরোনোর সময় ব্রজবাবুকে দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেলেন। আলো আঁধারিতে ডক্টরের মুখটা এক ঝলক দেখেই কেমন যেনো চেনা চেনা ঠেকলো ব্রজবাবুর।

এবার নিভা দেবীকে একা পেয়ে শুধলেন ব্রজবাবু - "প্রফুল্ল এসেছিল?" নিভা দেবী আধবোজা চোখে একবার ব্রজবাবু কে দেখে দুদিকে ঘাড় নাড়ালেন। ব্রজবাবু দেখলেন হাতে সময় বেশি নেই । একটু পরেই নিভা দেবী ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন। তাড়াতাড়ি পরের প্রশ্ন করলেন - "এই ভিটে কি আপনার পিতা হরিশ্চন্দ্র মজুমদারের মাতুলালয়?" প্রশ্ন শুনে আবারও সম্মতিসূচক ঘাড় হেলালেন নিভা দেবী। পরপর দুটো প্রশ্নের আশানুরূপ উত্তর পেয়ে ফস করে মোক্ষম প্রশ্নটা করেই ফেললেন ব্রজবাবু -" আচ্ছা এ বাড়িতে গুড়ুম ঘরটা কোথায় বলতে পারেন কি? " এ বারে যদিও কোনো উত্তরই পেলেন না ব্রজবাবু। নিভা দেবী ততক্ষনে তলিয়ে গেছেন গভীর ঘুমে। 

অগত্যা সেদিনের মত পার্বতীনিবাসের কাজ শেষ করে হাজির হলেন দ্বিতীয় গন্তব্য গুপ্তিপাড়া থানায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে বড়বাবুর সাথে দেখা করে, কথা বলে হোটেলের পথ ধরলেন। 

দুপুর দুটো নাগাদ ব্রজবাবু ফিরে এলেন হোটেলে। ফেরার পথে হোটেলের ম্যানেজার কুন্তল বাবুর পরামর্শ মতো এক মিষ্টির দোকান থেকে কিনে আনলেন খান দশেক বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি গুপ্ত সন্দেশ বা গুঁফো সন্দেশ। গুপ্তিপাড়ায় এসে এখানের ভূমিপুত্র তথা বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার এই সিগনেচার মিঠাই গুঁফো সন্দেশ না কিনলে যে গুপ্ত পাড়ায় আসাটাই অনেকটা বৃথা হয়ে যায়।



সেদিন বিকেল হতে না হতেই সারা আকাশ অন্ধকার করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।ব্রজবাবু ভেবেছিলেন এখন একবার লাইব্রেরি যাবেন কিন্তু আকাশের গতিক দেখে বুঝলেন এই বৃষ্টি সহজে ধরার নয়। অগত্যা হোটেলের ম্যানেজার কুন্তল বাবুকেই ডেকে নিলেন ঘরে। কফি আর চিকেন পকোড়া সহযোগে জমে উঠলো সান্ধ্য আড্ডা। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কখনো ফরমাইস মাফিক কখনো মর্জি মত টুকটাক গলা সাধা , আবৃত্তি করাও চলতে লাগলো। কুন্তল বাবুর গানের গলাটি বড়ই চমৎকার। সত্য আবার ছোট থেকেই আবৃত্তি করে খাসা। সব মিলিয়ে অনেক দিন পর এত ভালো সময় কাটালেন সবাই। 


এমন সময় আড্ডা চলার ফাঁকে সকলেই লক্ষ্য করলেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হঠাৎই যেন বৃষ্টির তোড় বেড়ে গেছে অনেকটা।সেই সাথে কানে এলো টুপটাপ শিল পড়ার শব্দ আর মেঘের গর্জন। ঘড়িতে দেখতে দেখতে কখন যেনো আটটা বেজে গেছে। ব্রজবাবু এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে ইন্টারকমে কিচেনে খবর পাঠালেন রাতে চার পাঁচ জনের মত খিচুড়ি চাপিয়ে দেবার । তারপর কুন্তল বাবুর দিকে ফিরে বললেন - "এটা আপনার হোটেল হলেও আজ রাতে আপনি কিন্তু আমাদের অতিথি। রাতের খাবার আজ আমাদের সাথেই সারবেন।" কুন্তল বাবু সম্মতি জানিয়ে গান ধরলেন সানন্দে - ' গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বত শিখরে, অরণ্যে তমোশ্চ্ছায়া....' আর তখনই বিদ্যুৎ চমকের মত শব্দগুলো আছড়ে পড়লো ব্রজবাবুর মাথায়। কুন্তল বাবুকে গানের মাঝপথেই থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - "আচ্ছা, গুড়ুম করে শব্দ করে শুধু কি মেঘই ডাকে? গোলা বারুদ, বন্দুকের নলও তো ঐ একই ভাষায় কথা বলে। তাই না?" কুন্তল বাবু হঠাৎ এমন খাপছাড়া প্রশ্নে চমকে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন - "তা তো বটেই । তা এমন প্রশ্ন হঠাৎ মনে এলো কেনো আপনার?" ব্রজবাবু যেনো শুনতেই পেলেন না কুন্তল বাবুর প্রশ্ন। উল্টে বেশ অন্যমনস্ক ভাবেই শুধলেন তাকে - "আচ্ছা কুন্তল বাবু এই অঞ্চলে তো একসময় ভালই ডাকাতের উপদ্রব ছিল বলে শুনেছি। ডাকাতে কালীর পূজোও নাকি হতো। তা একটা জিনিষ বলুন দেখি। সম্পন্ন ঘরের মানুষজন নিশ্চয়ই আত্মরক্ষার্থে গোলা বারুদ অস্ত্র শস্ত্র প্রয়োজন মত নিজেদের কাছে মজুদ রাখতেন? "কুন্তল বাবু বললেন - "হ্যাঁ, তা তো বটেই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ও ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার অন্যান্য স্থানের মত এই অঞ্চলেও দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছিলো ডাকাতদের। আর তেমনটা হবে নাই বা কেনো।সেই বর্গী আক্রমণ থেকে শুরু হয়ে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের লুণ্ঠন শোষণ আর দুর্ভিক্ষের হাত ধরে চলতে থাকা আর্থিক অবক্ষয়ের ছবিটা এক শতক ধরে বাংলার মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছিল।জানেনই তো, কথায় বলে পেটের জ্বালা বড় বালাই। তাই উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য হয়েই একদল মানুষ অর্থোপার্জনের জন্য এই অসৎ পথ নিতে বাধ্য হয়। গ্রামের জমিদার, ফিরিঙ্গি আর সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষজন তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। গুপ্তি পাড়ার তৎকালীন ইতিহাসও খানিক এই রকমই।সেই সময় এখানের জমিদার ছিলেন সেনরা। তাদের জমিদারিতে আমার পিতৃপুরুষরা দু শতক ধরে নায়েবের কাজ করেছেন। ছোট বেলায় শুনেছি যে জমিদার বাড়িতে ডাকাত পড়লে নাকি জমিদারবাড়ির মেয়ে বউরা গিয়ে সেধুতেন পাকশালার অন্দরে। ডাকাতরা চট করে মহিলা আর শিশুদের আক্রমণ করতেন না। সিন্দুক আর ভাঁড়ারের প্রতিই তাদের নজর ছিল বেশি। সেন বাড়িতে তাই পাকশালাতে বাসনপত্রের সঙ্গে লুকিয়ে রাখা হত বন্দুক, গোলা বারুদ। পাইক লেঠেলরা ডাকাতদের হাতে জখম হলে বাড়ির কর্তারা তখন রুখে দাঁড়াতেন আর আড়াল থেকে গোপনে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেন বাড়ির মহিলারা। জমিদার বাড়ির দেখাদেখি তখনকার বেশ কিছু ধনী পরিবারও একই ভাবে নিরাপত্তার কারণে পাকশালাতে গোপনে অস্ত্র মজুদ করে রাখতেন।.." 

কুন্তল বাবুর গল্প বলার মাঝেই ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো ঘরের ইন্টারকম । রিসিভার তুলে "আসছি" বলে নামিয়ে রেখে কুন্তল বাবু বললেন - "খিচুড়ি আর আলুর দম রেডি হয়ে গেছে । চলুন খেয়ে নেওয়া যাক। 'ব্রজবাবু এবার উঠে কুন্তল বাবুর হাত ধরে বললেন- "অনেক ধন্যবাদ। আপনি আজ আমার একটা বড় উপকার করেছেন। চোখের সামনে ঝুলে থাকা পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিয়েছেন । চলুন এবার খেয়ে আসি। আজ আর দেরী করে লাভ নেই।" কুন্তল বাবু ,ব্রজবাবুর কথার অর্থ বুঝতে না পারলেও তখনই তা জিজ্ঞেস করা অনুচিত হবে মনে করে চুপ করে এগিয়ে গেলেন ডাইনিং হলের দিকে। বাইরে তখন দুর্যোগ কেটে গিয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।



 ব্রজবাবু ঘরে ফিরে এসে সত্যকে বললেন- "তুমি স্যুটকেস গুছিয়ে রাখো। মন বলছে হয়ত কালকেই এখানের কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারবো আমরা। "সত্য ঘাড় নেড়ে খানিক চুপ থেকে বললো -"কিন্তু কর্তাবাবু , ,প্রফুল্লকে যে খুঁজে পাওয়া গেলো না এখনো, তার কি হবে?" ব্রজবাবু নির্লিপ্ত ভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন- 'সে তো পুলিশের কাজ সত্য। আমি এ ব্যাপারে কি করতে পারি বল? তার চেয়ে তোমাকে বরং কিছু এমন তথ্য দেই যেটা এখনো অব্দি গুপ্তি পাড়ার কেউ জানে না।' সত্য মুষরে পড়তে গিয়েও এমন কথা শুনে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ব্রজবাবু বলতে লাগলেন - "উইলিয়াম কেরির নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। আজকের দিনে বাংলা সাহিত্যের এমন সুদিন আমরা হয়ত দেখতেই পেতাম না তার মত মানুষজন এদেশে না এলে। ঊনবিংশ শতকের আগে বাংলা ভাষায় যে ধরনের সাহিত্য চর্চা হত তা ছিল নেহাতই দুর্বোধ্য, সংস্কৃত ঘেঁষা এবং বেশির ভাগটাই পদ্যের আকারে ছন্দ মিলিয়ে লেখা। সাধারণ মানুষের পক্ষে সে সাহিত্যের রসাস্বাদন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কেরি সাহেবের মতো ব্যাপটিস্ট মিশনারী ও ধর্ম প্রচারকরা জনসাধারনের মধ্যে মূলত খ্রিস্ট ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই সাধারণের উপযোগী ভাষায় বাইবেলের মত ধর্মগ্রন্থগুলো অনুবাদের কাজ শুরু করেন। যদিও তখনও সেই সকল অনূদিত গ্রন্থের ভাষা খুব কিছু প্রাঞ্জল বা সহজপাচ্য ছিল না। তবু সেগুলোকেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম সোপান বলা যেতে পারে। এ ব্যপারে শ্রীরামপুরের মিশনারীরাই মূলত অগ্রণী ভূমিকা নেন। চার্লস উইলকিনস বাংলা ভাষায় প্রথম ছাপার হরফ তৈরি করেন। এরপর শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন ছাপাখানা থেকে একে একে বাংলা ব্যাকরণ, অভিধান প্রভৃতি ছাপা হতে থাকে।বলতে পারো দেশীয় ভাষায় সাহিত্য চর্চার সেই শুরু। তারপর ব্রিটিশ রাজশক্তি একে একে দেশীয় রাজশক্তি গুলোর ওপর প্রভুত্ব বিস্তার শুরু করে।ফলে প্রশাসনিক কাজে দক্ষ একদল অফিসারের প্রয়োজন দেখা যায় যারা কিনা এ দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে এ দেশকে শাসন করতে পারবে।সেই সূত্রেই ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গড়ে ওঠে। সেই সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যও পুনর্জন্ম লাভ করে।কেরি সাহেবকে মধ্যমণি করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, রাজীবলোচন মুখুজ্যে প্রমুখ বিদগ্ধ পণ্ডিতদের একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যাদের হাত ধরে একে একে প্রকাশিত হতে থাকে বাংলা ভাষায় লেখা হিতোপদেশ, রাজাবলী, প্রতাপাদিত্য চরিত্র, ঈশপের গল্প প্রভৃতি বইগুলো। পরবর্তী কালে এদের দেখানো পথে হেঁটেই বাংলা সাহিত্যকে আরো পরিণত রূপ দেন রামমোহন রায় এবং আরো পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়। কিন্তু তোমাকে আমি আর ততদূর নিয়ে ফেলতে চাই না। তবে এতক্ষণ যা বললাম তার অনেকটাই হয়ত তোমার জানা। যেটুকু জানো না এবার সেটাই বলবো।" সত্য অধীর আগ্রহে জানতে চাইলো - "সেটা কি কর্তাবাবু?" ব্রজবাবু দম নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন- 'ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে সেই যুগে বলা হত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। তৎকালীন সময়ে এই কলেজের সাথে যুক্ত এক বিদগ্ধ পণ্ডিত নৃপতি হালদার ছিলেন এই অঞ্চলের এক বিশিষ্ট মানুষ এবং প্রফুল্লর বর্তমান ভিটে পার্বতী নিবাসের প্রতিষ্ঠাতা ভবানিপ্রসাদ হালদারের সুযোগ্য পুত্র। উইলিয়াম কেরির স্নেহধন্য এই মানুষটি বলতে গেলে প্রায় একার চেষ্টায় উদ্ধার করেন বিস্মৃতপ্রায় বহু সংস্কৃত পুঁথি যার অনেকগুলিই সযত্নে সংরক্ষিত হয়েছে স্থানীয় শিশির মন্দির পাঠাগারে। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি তার কয়েকটা। তবে সত্য তার এবং ভবানী প্রসাদ সম্পর্কিত আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুমি জানতে পারবে কাল।আজ আপাতত এটুকুই থাক।" এই বলে লম্বা হাই তুলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন ব্রজবাবু। ব্যাজার মুখে ঘড়িতে ব্রজ বাবুর নির্দেশ মত সকাল ছ'টায় অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লো সত্যও।


পরদিন সকাল থেকেই উসখুস করছিলেন ব্রজবাবু। কুন্তল বাবু স্পেশাল ভাবে তাদের জন্য আজ জলখাবারে মাছের কচুরি, আলুর দম, ক্ষীরের জিলিপি আর মোহনভোগের ব্যবস্থা করেছিলেন। সত্য আর ছোটু সব চেটে পুটে সাবার করলো। কিন্তু এত ভালো খাবার থাকা সত্ত্বেও সব কিছু কেমন যেনো ফেলে ছড়িয়ে খেলেন ব্রজবাবু। সত্য ব্রজবাবুর মেজাজ দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করবে ভেবেও করে উঠতে পারলো না। কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে শেষমেষ সেদিনের খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। মাঝে একবার ব্রজবাবুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, ভুরু কুঁচকে তিনি কিসব যেনো লেখালেখি করছেন ছোট একটা নোটবুকে। খাওয়া শেষ করে সকলে ফিরে গেলেন ঘরে।

বেলা দশটার দিক করে রিসেপশন থেকে খবর দিল, ব্রজবাবুর নামে একটি ফোন এসেছে। খবরটা পেয়েই ব্রজবাবু উদ্ভ্রান্তের মত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ফোন ধরতে। তারপর ঘড়ি ধরে ঠিক মিনিট পাঁচেকের মাথায় ঘরে ফিরে সত্যকে বগলদাবা করে বেড়িয়ে পড়লেন। গাড়িতে উঠেই ছোটুকে শুধু বললেন - "পার্বতী নিবাস।" বাকি রাস্তাটুকু মুখে পুরো কুলুপ এঁটে বসে রইলেন। সকালে রাস্তা ফাঁকা থাকায় ছোটু এককথায় প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গেলো গাড়ি। একবার শুধু লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে দেখে নিলো আজও তাদের পিছু নিয়েছে সেই নীল বাইক।

পার্বতী নিবাসে পৌঁছেই ছোটুকে বললেন - "তুই ওই মর্কটটাকে সামলা।" তারপর সত্যর দিকে ফিরে বললেন - " সত্য কুইক।" এই বলে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে গেলেন বাড়ির মধ্যে। এদিকে পিছু ধাওয়া করে আসা ছেলেটা ওদের আটকাতে গিয়েও পারলো না। তার তখন পথ আটকেছে ছোটু। 

ব্রজবাবু বাড়িতে ঢুকতেই প্রথম দিনের দেখা সেই ভাড়াটিয়ার ছেলেটা চোখ দিয়ে ব্রজবাবুকে ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা করলো। সেদিকে একবার দেখে ব্রজ বাবু ছুটে দোতলায় উঠেই দেখলেন প্রফুল্লর মায়ের ঘরের বাইরে আগের দিনের মতোই সেই গাঢ় খয়েরী রঙের এক জোড়া বুট জুতো। আজ অনুমতি না নিয়েই ঘরে ঢুকে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলো সত্যও। 


ব্রজবাবু দেখলেন ডাক্তার সবে তার ক্যাম্বিস ব্যাগটা খুলবেন ভেবে হাত বাড়িয়েছেন। খাটে একই ভাবে শুয়ে আছেন প্রফুল্লর মা। ব্রজবাবু ওদের হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আগেই বজ্রকঠিন কণ্ঠে বললেন - "ডাক্তার বাবু, আজ বরং চিকিৎসাটা বন্ধ থাকুক। আগে আপনার ইনজেকশনটা একটু দেখান দেখি আর ঐ লেটার প্যাডটাও।" ডাক্তার ততক্ষনে ধাতস্ত হয়েছেন কিছুটা। গলা তুলে বললেন - "রোগী বা রোগীর নিকট আত্মীয় ছাড়া আমি কারুর কোন কথা শুনতে বাধ্য নই। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। এমনিতেই এমন একজন মুমূর্ষু রোগীর ঘরে না বলে ঢুকে যথেষ্ট অন্যায় করেছেন। তার মধ্যে আবার আমার কাজে বাধা দিচ্ছেন। আপনাদের সাহস তো বড় কম নয়।" ব্রজবাবু এবার জোরে হেসে উঠে বললেন - " কথাটা বেড়ে বলেছেন কিন্তু। তা আমার সাহস একটু বেশি বৈকি। তবে আপনার থেকে বেশি কি?..." সেই সময়েই সত্য পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে উত্তেজনায় ছট্ফট করতে করতে বারান্দায় শুনতে পেলো ভারি বুটের শব্দ। ব্রজবাবু কথা বলতে বলতে সেদিকেই গলা তুলে বললেন- "ভেতরে আসুন ইন্সপেক্টর সাহেব।" এমন অবস্থায় থানার বড় বাবুকে দেখে চমকে গেলেন ডাক্তার। ব্রজবাবু আবার বলতে লাগলেন - "ধরাচুড়োটা এবার মানে মানে নিজেই খুলে ফেলুন দেখি। আপনার খেল খতম ভুজঙ্গ বাবু। প্রথমদিন দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে আপনার আসল মুখটা চেনা চেনা লাগলেও মনে করতে একটু দেরি হয়ে গেছিলো। " ব্রজবাবুর কথা শুনে দুজন কনস্টেবল এগিয়ে যেতেই মাথার নকল চুল আর নকল দাড়ি নিজের হাতে এক টানে খুলে ফেললেন ডাক্তার থুড়ি বান্ধবনগর কলেজের সদ্য নিযুক্ত ইতিহাসের অধ্যাপক ভুজঙ্গ সান্যাল। এমন সময় পেছন থেকে আর্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন নিভা দেবী - " কিন্তু আমার ছেলে কোথায়?" 


ব্রজবাবু স্বান্তনার সুরে বললেন - "প্রফুল্ল কোথায় তা পুলিশ ঠিক বের করে নেবে ভুজঙ্গ বাবুর পেট থেকে। তবে এটুকু মোটামুটি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি যে, সে এখনো বেঁচে আছে। চাইলেও তার চরম ক্ষতি এখনও করে উঠতে পারে নি ভুজঙ্গ বাবু কারণ সেই ইপ্সিত বস্তুর সন্ধান তিনি যে এখনও পান নি। দুঃখের বিষয় হল প্রফুল্ল আমার লাইব্রেরীতে ডায়রিটা জমা করার আগে বিশ্বাস করে ভুজঙ্গ বাবুকে দেখিয়েছিল সেখানা। ভুজঙ্গ বাবু জিনিসটার গুরুত্ব আঁচ করতে পারলেও প্রফুল্লকে বুঝতে দেননি সে কথা। প্রফুল্লর খামখেয়ালি কাজকর্মের দরুন ডায়রিটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন সেটা হাতে পাবার জন্য এবং শেষ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে প্রফুল্লর নাম করে মিথ্যে বলে হাপিস করেন সেটা। কি ঠিক বলছি তো ভুজঙ্গ বাবু?" প্রশ্ন শুনে রাগে গজগজ করতে লাগলেন হাতকড়া পরিহিত ভুজঙ্গ বাবু। সত্য এবার জানতে চাইলো - "ডায়রীতে কিসের কথা বলা আছে কর্তা বাবু?" ব্রজবাবু বললেন - "সেটা এমন একটা জিনিস বলে আমার অনুমান যার মূল্য সোনাদানা, হিরে জহরতের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়, অন্তত তেমন ইঙ্গিতই পেয়েছি সেই ডায়রিতে। আমার কাজ হলো সূত্র মিলিয়ে তোমাদের সকলের সামনে সেটা খুঁজে বের করা।" এবার ইন্সপেক্টর নরহরি সমাদ্দার বললেন - " তাহলে ব্রজবাবু আর দেরি না করে কাজ শুরু করা যাক। " ব্রজবাবু বললেন - " কাজ শুরু করতে গেলে আগে প্রয়োজন সেই সবুজ ডায়রিটা যার আসল মালিক নিভা দেবীর বাবা শ্রী হরিশ্চন্দ্র মজুমদার । কিন্তু বর্তমানে সেটি ভুজঙ্গ বাবুর হেফাজতে । ভাগ্যিস ভুজঙ্গ বাবুকে দেবার আগে বুদ্ধি করে আমি তারিখসহ কবিতাগুলো একটা খাতায় দেখে দেখে লিখে রেখেছিলাম। যাই হোক, এবার আসল বিষয়ে আসি। ডায়রিটা ১৯৮০ সালের ডায়রি। হরিশ্চন্দ্র মজুমদার প্রথম ছড়াটি লিখেছিলেন ১ লা জানুয়ারি। সেটি ছিল " খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে । বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।" আপাত দৃষ্টিতে এটা সামান্য একটা ছেলে ভোলানো ছড়া হলেও একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন এটা বাংলার বুকে ঘটে যাওয়া এক ঐতহাসিক ঘটনার ইঙ্গিতবাহী।" সত্য মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলো - "সেটি কি বর্গী বা মারাঠা আক্রমণ? " ব্রজবাবু খুশি হয়ে বললেন " একদম ঠিক বলেছ সত্য। এরা ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে বাংলাকে একেবারে তছনছ করে দেয়। কি ঠিক বলছি তো ভুজঙ্গ বাবু? ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন অবশ্যই.." তারপর ভুজঙ্গ বাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চললেন ব্রজবাবু- "তবে একাধিক বছর ধরে কোন ঘটনা ঘটতে থাকলে আমরা অনেক সময়েই সেই ঘটনাকে উল্লেখ করার সময় শুরুর সাল ধরেই উল্লেখ করে বুঝিয়ে থাকি যেমন ১৭৮৯ এর ফরাসি বিপ্লব বা ১৯১৭ র রুশ বিপ্লব। তেমনই এই ক্ষেত্রেও ধরে নেওয়া যাক লেখক মশাই ছড়ার মাধ্যমে যে বিশেষ বছরের কথা বোঝাতে চেয়েছেন সেটি হলো ১৭৪১ সাল। এবার আসি পরের পদ্যে যেটি লেখা ১৯ শে ফেব্রুয়ারি মানে মাঝে ১৮টি পাতাতে কলমের কোন আঁচড় পড়েনি। হিসেব করে এই ভাবে পাতা ফাঁকা রাখার অর্থ কোন বিশেষ সময়ের দ্যোতক হতে পারে বলেই মনে হয়েছিল আমার। সেক্ষেত্রে এক একটি পাতাকে এক একটি বছর হিসেবে ধরলে পরের পদ্যের অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হয়। সেই মত ১৭৪১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে এক একটি পাতাকে এক একটি বছরের রূপক হিসেবে ধরলে ১৯ শে ফেব্রুয়ারি হয়ে দাঁড়ায় ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ।" সত্য অবাক হয় বললো - "সত্যি তো। ডায়রিটা তো আমিও দেখেছিলাম কিন্তু ফাঁকা পাতাগুলো দেখে তো এটা এক্কেবারে মাথায় আসে নি আমার।" ব্রজবাবু একটু হেসে আবার বলতে লাগলেন - " দ্বিতীয় পদ্যখানা পড়ে শোনাই এবার। তাহলেই বোঝা যাবে আমার এই অনুমান ঠিক কিনা - "মাস গুনতে গুনতে, বছর হলো পার।তেমন করে মিললে পরে, ঘটে চমৎকার।। নামে কি আসে যায়, কাজেই পরিচয়। বিন্ধ্যবাসিনি এই ভূমেই জগজ্জননী হয়।।" তাহলে বল তো সত্য , কত মাসে এক বছর হয়?" সাথে সাথে উত্তর এলো - "বারো।" কথাটা লুফে নিয়ে বললেন- "ঠিক তাই। দ্বিতীয় লাইনেই সেই সূত্র ধরে বলা আছে যে বারো জন একত্রে কোনো বড় কিছু করেছিলেন। এখানের ইতিহাস একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০ সালে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল যা বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে একটি চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।" থানার বড় বাবু এবার একটু উৎসাহসহকারে শুধোলেন - "সেটি কি বলুন তো! আসলে আমি তো মাস খানেক হলো এ অঞ্চলে বদলি হয়ে এসেছি। তাই সবটা এখনও জেনে উঠতে পারিনি।" ব্রজবাবু বললেন - " সেই বছরই এই অঞ্চলের ওই বারোজন ইয়ার বন্ধু মিলে শুরু করেছিলেন জগদ্ধাত্রী রূপে মা দুর্গার পূজো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সর্বসাধারনের অংশগ্রহনের মাধ্যমে দুর্গাপুজো শুরু করার কিন্তু সেই বছর দুর্গা পুজোর সময় পেরিয়ে যাওয়াতে জগদ্ধাত্রী পূজো দিয়েই তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই পুজোয় সকলের ছিল অবারিত দ্বার। এটিই বাংলার ইতিহাসে প্রথম সর্বজনীন পূজো বা বারোয়ারী পুজো বলে স্বীকৃত। পদ্যের শেষ দুটো লাইন পড়লেই এই ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়। এবার আসি পরের পদ্যে যেটা লেখা আছে ৪ ঠা মার্চের পাতায়। তার মানে আবার ১২ দিনের থুড়ি ১২ বছরের অন্তর। আমরা এবার সেই মত এগিয়ে গিয়ে দেখি কি ঘটেছিল ১৮০৩ সালে। তার আগে একবার ৩নম্বর পদ্যটা পড়ে শুনিয়ে দেই - "গোপন কথাটি রবে না গোপনে , দেবী আদেশ দিলেন স্বপনে। মসীলিপ্ত হলো কাহিনী সবিস্তার, শুনে ধন্য হলো জগৎ সংসার।" এক্ষেত্রে আমার প্রথম লাইনের অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে বারোয়ারি পূজো সংক্রান্ত গুপ্তিপাড়ারই কোন অশ্রুতপূর্ব ইতিহাসের কথা বোঝানো হয়েছে যাকে ঈশ্বরের নির্দেশ মোতাবেক লিপিবদ্ধ করে এবং ছাপিয়ে সকল বঙ্গবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেবার আয়োজন করা হয়েছিল। আপনারা তৎকালীন বাংলার ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিলেই লক্ষ্য করতে পারবেন তার বছর কিছু আগেই শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের উদ্যোগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। প্রাচ্য ভাষায় শিক্ষাদান, বাংলা ভাষায় বই মুদ্রণের কাজ শুরু হয়েছে জোর কদমে। এই সময়কারই গুপ্তিপাড়ার এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন নৃপতি হালদার। তার অনেক কীর্তিই সযত্নে রক্ষিত হয়েছে এখনকার শিশির বাণী মন্দির পাঠাগারে। শুধু তাই নয়, ওনার পিতা ভবানীপ্রসাদ হালদার ছিলেন সেই বিশিষ্ট বারো ইয়ারের একজন যাদের একত্র প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছিল বারোয়ারি দুর্গাপুজো। সুতরাং যতদিন নৃপতি হালদার বেঁচে ছিলেন ততদিন বারোয়ারি পুজোর সেই ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করার যে একটা জোড়ালো সম্ভাবনা ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। লাইব্রেরিয়ান বেণীমাধব বাবুর কাছেই শুনেছি এই নৃপতি হালদারের পুত্র জ্যোতির্ময় হালদারের আমলে ব্যবসায়িক দিক থেকে হালদার বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। যদিও বিদ্যাচর্চার দিক থেকে ভাঁটার টান দেখা যায়। ওনার এক পুত্র নীলাম্বর হালদার ছিলেন স্বল্পায়ু। আরেক কন্যা যশোধরা দেবীর বিবাহ হয় নদিয়ার কৃষ্ণনগরের রাজশেখর মজুমদারের সঙ্গে। যোশোধরা দেবী ভাইয়ের অকালমৃত্যুর পর পিতার সম্পত্তি দেখভালের জন্য সপরিবারে এসে ওঠেন এই পার্বতী নিবাসে।এই যশোধরা দেবীরই পুত্র ছিলেন হরিশচন্দ্র মজুমদার , যার লেখা পদ্য আমি এখন আওরে চলেছি। কি নিভা দেবী ঠিক বললাম তো?" নিভা দেবী এবার নিঃশব্দে ঘাড় হেলালেন। সেদিকে তাকিয়ে ব্রজবাবু আবার বলা শুরু করলেন - "এবার তবে ডায়রির শেষ পদ্যতে আসি - "তাই তাই তাই, মামাবাড়ি যাই। মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই। গুড়ুমঘরে দেরাজ খুলে মণ্ডা মিঠাই পাই, তার ভিতরে রসের সাগর, স্বাদের তুলনা নাই, খোঁজ করে তাড়াতাড়ি চলে এসো ভাই।" এখানে আসল ডায়রির পাতাটা খেয়াল করলে দেখা যাবে ৩১ শে ডিসেম্বর তারিখটা কেটে দেওয়া হয়েছে। তার মানে এক্ষেত্রে আর ঘটনাক্রম অনুসরণ করার প্রয়োজন বোধ করেন নি লেখক। তাই ধরে নেওয়া যায় এই কবিতাটিতে তিনি তৎকালীন সময় এবং নিজের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। এই অব্দি এসেই আমি আটকে যাই। ভুজঙ্গ বাবুরও আশা করি অনুরূপ দশাই হয়েছিল। তা না হলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না তাকে।" এই বলে কড়া নজরে একবার জরিপ করে নিলেন ভুজঙ্গ বাবুকে। ভুজঙ্গ বাবু ততক্ষনে ভেঙে পড়েছেন একেবারে। ব্রজ বাবু বলতে থাকলেন - 'এই ব্যাপারে আলোকপাত করতে আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেন অন্নপূর্ণা হোটেলের ম্যানেজার কুন্তল বাবু। এবার সে কথাই শোনাবো আপনাদের, তবে তার জন্য সমাদ্দার বাবু এই ঘর ছেড়ে সবাইকে নিয়ে এখনই একবার নিচে যেতে হবে। এবাড়ির হেঁসেলেই হবে বাকি রহস্যের সমাধান।" ইন্সপেক্টর সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন - "কেনো বলুন তো। সেখানে কি আছে।" ব্রজ বাবু একটু থেমে বললেন- " সেখানে কি আছে সেটা আমি নিশ্চিত হয়ে এখনই বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় সেখানেই কোনো গুপ্ত প্রকোষ্ঠে রাখা আছে সেই মহামূল্যবান জিনিস যার সন্ধান আমরা সবাই করছি।" ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন - "আপনার তেমন মনে হবার কারণ ?" ব্রজবাবু জবাব দিলেন- "সেটা আমি অকুস্থলে গিয়েই বলছি না হয়। চলুন সকলে আর হ্যাঁ ভুজঙ্গ বাবুকে ও নিয়ে চলুন সাথে।" 


ব্রজবাবু হাঁক দিলেন - "গোবিন্দওওও। " ডাক শুনে সেই নিচের ভাড়াটিয়ার ছোট ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির হল। একতলায় ততক্ষনে পুলিশ এসেছে খবর পেয়ে বড়সড় একটা জটলা পাকিয়েছে স্থানীয় লোকজন। গোবিন্দ রান্নাঘরের দিকে সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো আর দুজন কনস্টেবল বাইরে রয়ে গেলো অবাঞ্ছিত ভিড় সামলাতে। 

রান্নাঘরটা প্রায় একটা প্রমান সাইজের হলঘরের সমান। ছড়ানো ছেটানো আয়োজন দেখে বোঝাই যাচ্ছে বাড়ির মেয়ে বউয়েরা কিছুক্ষন আগেই ব্যস্ত ছিলেন রান্নার কাজে। ব্রজবাবু বললেন- "গোবিন্দ তোমাদের বাসন পত্তর কোথায় রাখা হয় বলো তো।" তখনই একজন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন - "ও ছোট ছেলে । ও কি করে বলবে? আমি ওর মা। আমিই বলছি "। ব্রজবাবু দায়সারা গোছে নমস্কার জানিয়ে তাঁকে একই প্রশ্ন করলেন। গোবিন্দর মা বললেন - " বাসন কোসন আর কোথায় এমন। এই তো দু চারটে জিনিস। এসব ওই তোরঙ্গেই তুলে রাখি কাজের শেষে। " ব্রজবাবু বললেন- "না না এ তেমন ছোটখাটো কিছু হবে না। দেখুন তো ঘরে দেওয়াল আলমারি গোছের কিছু আছে কি না ।" ঘরের মধ্যে তেমন কোনো জিনিসই চোখে পড়ল না কারোর। সত্য দেখলো ভুজঙ্গ বাবুর ঠোঁটে এমন সাময়িক ব্যর্থতায় হালকা বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছে। 


ঘণ্টা খানেক ধরে আতিপাতি করে কিছুই না পেয়ে হাল যখন প্রায় ছেড়ে দিচ্ছেন সবাই তখনই ব্রজবাবুর চোখে পড়লো ভাতের ফ্যান গালার বড়ো গর্তটা। পাথরটায় দীর্ঘদিন ব্যাবহারের ফলে সাদা দাগ হয়ে গেছে। ব্রজবাবু জায়গাটা সামনে থেকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে দেখলেন পাথরটা কেমন যেন উঁচু হয়ে আছে। তারপর ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরে বললেন - " এই পাথরটা সরানোর ব্যবস্থা করুন দেখি। আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোনো গুপ্ত ঘর থাকলেও থাকতে পারে।" বড়বাবু লোক লাগিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে ফেললেন পাথরখানা। সরাতেই দেখা গেলো ব্রজবাবুর অনুমান এক্কেবারে সঠিক। পাথরের নিচেই চাপা পড়েছিল একটা মিশকালো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। ইন্সপেক্টরের নির্দেশে সাথে সাথে আলোর ব্যবস্থা করা গেলো। দেখা গেলো সেই খোঁচরে ঢোকার মুখটা এতই ছোট যে একটা বাচ্চা ছেলে ঢুকতে পারে কোনরকমে। উপায়ন্তর না দেখে গোবিন্দর কোমরে দড়ি বেঁধে হাতে একটা বড় ৮সেলের টর্চ দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো সেখানে। গোবিন্দই নিচ থেকে জানালো সামান্য ধুলো ময়লা ছাড়া ঘরটা মোটামুটি পরিষ্কার। মিনিট পাঁচেক বাদেই আবার সে গলা তুলে জানালো -" ভেতরে একটা ছোট আলমারি আছে । তাতে দুটো নলওয়ালা বন্দুক, একটা মোটা দড়ি, কিছু ছেঁড়া কাপড়, একটা ভাঙ্গা কাটারি আর একটা মোটা বই আছে। আমি একে একে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি সব।" ব্রজবাবু বলে উঠলেন - "সাবাশ গোবিন্দ।" তারপর ইন্সপেক্টর সাহেবের দিকে ফিরে বললেন - "এই ছেলেটাই সকালে আমাকে ভুজঙ্গ বাবু আসার খবর দেয়। তাই তো হাতে নাতে ধরতে পরলাম ভুজঙ্গ বাবুকে। এই রহস্যের কিনারা হলে চেষ্টা করবেন ছেলেটাকে এই সততা আর সাহসিকতার জন্য কোনো ভাবে পুরস্কৃত করতে। এরাই তো আগামী দিনে দেশের ভবিষ্যত।"


গোবিন্দ ততক্ষনে কাজ মিটিয়ে উঠে এসেছে ওপরে। এবার ব্রজবাবু ধুলো ঝেড়ে বইটা হাতে নিয়ে দেখলেন, বইটা ১৯৭৫ সালের সন্দেশের পুজাবার্ষিকি সংস্করণ। বইয়ের ভেতরে একটা হলদে তুলোট কাগজের গোছা পাট করে রাখা। সেটা আস্তে আস্তে খুলে দেখলেন ওপরেই ছাপার হরফে লেখা - "শ্রী শ্রী দূর্গাসহায়।" বাকিটা খুলতেই চোখে পরলো পাতা ভর্তি ছাপার হরফ আর মাঝে মাঝে টুকটাক কিছু হাতে লেখা শব্দ। এই হস্তাক্ষর দেখেই চিনতে পারলেন ব্রজবাবু। এমনটা তিনি আগেও দেখেছেন, শিশির বাণী মন্দির পাঠাগারে সংরক্ষিত প্রাচীন পুঁথির সংস্কৃত শ্লোকের নিচে নৃপতি হালদার কর্তৃক লিখে রাখা টিকায় । ব্রজবাবু এবার কাগজের গোছাটা হাতে নিয়ে উচু করে তুলে ধরে বললেন - "এই সেই মহামূল্যবান সম্পদ যার জন্য আমরা সবাই আজ এখানে।" এবার সত্য বলে উঠলো- "এটা কি কর্তা বাবু।" "বলবো' , ব্রজ বাবু উত্তর করলেন "তবে তার আগে ফিরে যেতে হবে ডায়রিতে সেই শেষের কবিতায়- "তাই তাই তাই, মামাবাড়ি যাই। মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই। গুড়ুমঘরে দেরাজ খুলে মণ্ডা মিঠাই পাই, তার ভিতরে রসের সাগর, স্বাদের তুলনা নাই, খোঁজ করে তাড়াতাড়ি চলে এসো ভাই।" এক্ষেত্রে এতক্ষণে সবাই জেনে গেছি যে এটি হল ঈশ্বরচন্দ্র মজুমদারের মামাবাড়ী । সুতরাং এই ঘরখানাই হল কবিতা মোতাবেক সেই গুড়ুমঘর। বড়বাবু আর বাকি সকলের বোঝার উদ্দেশ্যে বলে রাখি এই ধরনের ঘরেই এককালে অস্ত্রশস্ত্র জমা রাখতেন এ অঞ্চলের জমিদার এবং সম্পন্ন বাড়ির লোকজন। ডাকাত পড়লে বা কোনো বিপদ ঘটলে বাড়ির পাক শালায় লুকিয়ে রাখা এই সকল অস্ত্রই বাড়ির পুরুষদের হাতে তুলে দিতেন মহিলারা। এই তথ্য আমি জানতেই পারলাম না কাল কুন্তল বাবুর সাথে গল্প করতে না বসলে। এই পদ্যে এই গুড়ুমঘরেই রাখা মণ্ডা মিঠাইয়ের কথা বলা আছে। তবে মণ্ডা মিঠাই বলতে কিন্তু এখানে কোন মিষ্টান্নকে বোঝানো হয় নি। আমার হাতে ধরা এই সন্দেশ পত্রিকাটির কথাই ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে। পদ্যানুসারে এই বইয়ের মধ্যেই থাকার কথা সেই মহার্ঘ্য বস্তু মানে বারোয়ারি পুজোর লিখিত ইতিহাস । সুতরাং পত্রিকার মধ্যে পাতার ভাজে লুকিয়ে থাকা এই পুঁথিরই রসাস্বাদনের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা, অপেক্ষা করছে গোটা বাংলা।" ইন্সপেক্টর সাহেব এবার ব্রজবাবুর পিঠ চাপড়ে বলে উঠলেন - "সাবাশ ব্রজবাবু। ধন্যি আপনার বুদ্ধি। চলুন বাকি কাজটা এবার সেরে ফেলি। আমার থানার সাব ইনসপেক্টর মোহান্তি বাবু ইতিমধ্যেই মেডিক্যাল অফিসারকে ডেকে নিয়েছেন আর সেই সাথে কাগজের রিপোর্টার এবং পুরাতত্ব সংরক্ষণ বিভাগের লোককেও খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওনারা চলে এলেন বলে। মোহান্তি বাবু এবার বললেন -"স্যার মেডিক্যাল অফিসার বললেন নিভা দেবীকে দেওয়া ভুজঙ্গ বাবুর ইঞ্জেকশানটিতে কড়া ঘুমের ওষুধ আছে।" ইন্সপেক্টর সাহেব হেসে বললেন, -" তাই নাকি। তাহলে একদিকে ভালই হলো। এক্ষুনি ভুজঙ্গ বাবুকে ওটা পুশ করে দিতে বলো। এতক্ষণ ওনাকে অনেক শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে।" ইন্সপেক্টর সাহেবের নির্দেশ মত, ভুজঙ্গ বাবুর ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও মেডিক্যাল অফিসার ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। তারপর পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে ভুজঙ্গ বাবু আর ওনার সেই প্রফুল্লর বন্ধু বলে মিথ্যে পরিচয় দেওয়া সাগরেদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। 


বাকি সময় দারুণ কাটলো সকলের । গুপ্তি পাড়ায় এমন একটা জিনিস আবিষ্কারের ফলে হইহই পড়ে গেলো চারিদিকে। নিভাদেবীর অনুমতিক্রমে পুরাতত্ব বিভাগের হাতে তুলে দেবার আগে বইটি স্থানীয় শিশির বাণী মন্দির পাঠাগারে পুলিশি পাহারায় দুদিনের জন্য রেখে দেওয়া হল সাধারণ মানুষের দেখার জন্য। গোবিন্দর বাড়িতে সেদিন ব্রজবাবু ,সত্য আর ইন্সপেক্টর সাহেব দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলেন। ইন্সপেক্টর সাহেব খেতে খেতে বললেন-" শুধু একটাই খটকা রয়ে গেলো বুঝলেন। হরিশচন্দ্র মজুমদার নিজে সব জেনে কেনো নিজে কিছু বললেন না। কেনোই বা হেঁয়ালি করে ডায়রি লিখে গেলেন।" ব্রজবাবু সায় জানিয়ে বললেন -"সে প্রশ্ন আমার মনেও এসেছে। আমার মনে হয় উনি চান নি কোন অযোগ্য লোকের হাতে এই নথি চলে যাক আর তাই এই হেঁয়ালী করেছেন যাতে কোনো যোগ্য ব্যক্তির হাতেই এটি যায় যে সেটার মূল্য বুঝবে। দ্বিতীয়ত এটা তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে উদ্ধার করেন । তাই এটি ১৯৭৫ সালের সন্দেশ পত্রিকার ভেতর পাই। সেই সময় উনি নিজেও মানসিক ভাবে খুব একটা সুস্থ ছিলেন না বলে শুনেছি। এই যুগপৎ কারণেই বাংলার ইতিহাসের এই অমূল্য দলিলকে ভবিষ্যতের হাতে সুরক্ষিত করে যেতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক। 


সেদিন রাতেই বান্ধব নগর ফিরে যান ব্রজবাবু আর সত্য। ফেরার আগে কুন্তল বাবু জোর করে ধরিয়ে দিয়ে ছিলেন এক হাঁড়ি গুঁফো সন্দেশ। পরদিন সকালে ফলাও করে সব কাগজে বেরোলো ব্রজবাবুদের এই মূল্যবান নথি উদ্ধারের খবর। টিভিতেও বারবার দেখানো হলো খবরটা আর সেই সাথে ব্রজবাবুর বক্তব্য এবং এ বইয়ের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মূল্যবান মতামতও জানানো হলো। বান্ধব নগরেও ব্রজবাবু আর সত্যকে ঘিরে সকলে আনন্দে মেতে উঠলো।

এত উচ্ছ্বাসের মাঝেও সকাল থেকে প্রফুল্লর জন্য ব্রজবাবুর মনটা ভারি হয়ে ছিল। সেদিন বিকেলের দিকে ইন্সপেক্টর সাহেবই শোনালেন সুখবরটা। প্রফুল্লকে নাকি অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেছে ভুজঙ্গ বাবুর সিউড়ির বাড়ি থেকে। ভুজঙ্গ বাবু পুলিশের কাছে চাপে পড়ে সব স্বীকার করাতে প্রফুল্লকে এত তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। জানা গেছে প্রফুল্ল এমন ঘটনায় খুব খুশি । সরকারি তরফেও আশ্বাস মিলেছে পার্বতী নিবাসের এই অবদানকে যথেষ্ট মর্যাদা সহকারে সরকারি বিবৃতিতে তুলে ধরা হবে। উদ্ধারকারী হিসেবে ব্রজবাবুর পাশাপাশি পার্বতী নিবাসের বর্তমান উত্তরাধিকারী নিভাদেবি আর প্রফুল্লর কথাও বলা হবে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তরফে বইটি টিকাসহ পুনর্মুদ্রণ এর ব্যাবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে যার রয়্যালটি পাবেন পার্বতী নিবাসের এই দুই বর্তমান মালিক এবং সেই সাথে ব্রজবাবুও। সব শুনে ব্রজবাবু পাশে দাড়িয়ে থাকা সত্যকে বললেন - "এই গোটা ঘটনা থেকে একটা শিক্ষা হলো তো? কোনো কিছুকেই সহজে তুচ্ছ জ্ঞান করতে নেই। কথাতেই তো আছে - যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।"










Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action