অদৃশ্য সৈনিক
অদৃশ্য সৈনিক
অদৃশ্য সৈনিক
নাম তাঁর হরভজন সিং । ভুল করছেন ! ভাবছেন আমি স্বনামধন্য ক্রিকেটার হরভজন সিং - এর কথা বলছি ?
না । আমি এখানে ক্রিকেটিয় ধারণা বলতে আসিনি। আমি বলতে যাচ্ছি একজন অতি সাধারন সৈনিকের কথা ; যিনি জীবদ্দশায় দেশভক্তি ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতেন না।
এ হেন হরভজন সিং-এর জন্ম ৩০শে আগষ্ট ১৯৪৬ সালে বর্তমানে পাকিস্তানের সদরণা গ্রামে এক শিখ পরিবারে। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৬৫ সালের মার্চে পাঞ্জাবের পট্টিতে ডি এ ভি হাই স্কুল থেকে
ম্যাট্রিক পাশ করেন । আর সেই বছরই তিনি সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগ দেন । মাত্র বাইশ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে তিনি শহীদ হন । সেই শহীদী কোন সংঘর্ষে নয়; প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে তিনি দেহরক্ষা করেন । চীন সীমান্তে মৃত্যুর পরও তিনি ভারত প্রহরায় অবিচল ।
এখন যখন ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দিনের পর দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, আগ্রাসন দেখানোর জন্য সীমান্তের এপার ওপারে বিশাল সৈন্য সমাবেশ হচ্ছে, এবং লড়াই যখন চীনের বিরূদ্ধে, স্বাভাবিক ভাবেই তখন মনে পড়ে এই আত্মত্যাগী জোয়ানের কথা ।চীন সীমান্তে প্রহরারত এক অমর ভারতীয় সৈনিকের কথা।
দেশের কাজে জোয়ানরা আসেন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে। কোন ক্ষুদ্র স্বার্থ নয় ; বৃহত্তর স্বার্থে তাঁরা নিবেদিত প্রাণ ।
তিনি নেই ; আবার তিনি আছেনও। না থেকেও তিনি পাহারা দিয়ে চলেছেন দেশের সীমান্ত। মৃত্যুর বহুবছর পরও তিনি রক্ষা করে চলেছেন মাটি এবং প্রহরারত ভারতীয় সেনাদের। এমনই বিশ্বাস ভারতীয় সেনাবাহিনীর একাংশের । তাঁদের কাছে হরভজন সিং দেবতা । তিনি বাবা ( সাধু ) ।
তিনি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছেন তখনই ঘটে গিয়েছে ভারত-চীন সর্বনাশা যুদ্ধ । তারপর একসময় তা থেমেও গিয়েছে। হরভজন ভারতীয় সেনাদলে যোগ দিলেন এবং তার পোস্টিং পেলেন ১৪১২৩ ফিট উঁচুতে অবস্থিত ভারত-চীন সীমান্ত দুর্গম গিরিপথ নাথু লায়। তখন কোনরকম যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল না। তথাপি অবস্থানগত দিক দিয়ে নাথু লা সবসময়ই স্পর্শকাতর ।
সীমান্তের এই অংশে মালবাহী পশুর পিঠে পণ্য নিয়ে তিনি রওনা দিয়েছিলেন অতি দুর্গম প্রত্যন্ত দেশের আউটপোস্টে যেখানে তাঁর সঙ্গীরা অপেক্ষায় ছিলেন রসদের জন্য ।
১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাস। কয়েকদিন থেকেই অতিবৃষ্টি ও তুষারপাতে ধ্বস নেমেছিল নাথু লা সীমান্তে।
প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও তিনি নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা করেননি। রওনা দিয়েছিলেন সাথীদের উদরান্ন নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি। যে ভারবাহী পশুদের ( সম্ভবত ঘোড়া ) নিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন তাদের কয়েকটি ফিরে আসে আগের আউটপোস্টে । ততক্ষণে তাঁর সাথীরা বুঝে গিয়েছেন হরভজন নিশ্চয়ই কোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন ।
শুরু হয় তল্লাশি। তিন চারদিন লাগাতার চেষ্টা করেও তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। হিমবাহে কোন জায়গায় তিনি আটকে পড়েছেন তার কোন হদিস পাওয়া গেল না ।
সকলেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। হেডকোয়ার্টারে এই সংবাদ দেওয়া হল । অবশেষে অলৌকিক ভাবে তিনি সহকমী প্রীতম সিংকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁর শব কোথায় রয়েছে তা' জানিয়ে দিলেন। অবাক হওয়ার কথাই, স্বপ্নে দেখা স্থানেই মিলল তাঁর মরদেহ।
তাঁর মৃত্যুর কারণ বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে পূর্ণ সামরিক মর্য্যাদায় পার্থিব শরীরের শেষকৃত্য করা হয় ।
মৃত্যুর পরও তিনি নাকি তাঁর কর্তব্যে অবিচল। শত্রুপক্ষ থেকে আসা আগাম বিপদের কথা তিনি নাকি সতর্ক করে দেন সেনা জওয়ানদের । এমনকি কোন সেনার জামা কাপড় সামান্য অবিন্যস্ত থাকলে তার গালে শুন্য থেকে চড় মারেন।
অলৌকিক ঘটনার এখানেই শেষ নয় ; স্বপ্নে তিনি বলেছিলেন তাঁর স্মৃতিতে যেন একটি স্মারকসৌধ নির্মাণ করা হয়।
এই সৌধে গেলে দেখা যাবে একটি শয়নকক্ষ । যেখানে তাঁর পোষাক, জুতো, কম্বল সংরক্ষিত আছে। তিনি যাতে নিজের কাজ করতে পারেন তার জন্য একটি কার্য্যালয়ও রয়েছে। প্রহরারত সেনাদের বক্তব্য সেই পরিপাটি করে সাজানো ঘর নাকি মাঝে মধ্যেই এলোমেলো হয়ে যায়। তাঁদের বিশ্বাস হরভজন সিং এখনও সেখানে বিশ্রাম নিতে আসেন। এমনকি তাঁর জুতোজোড়াতেও মাঝেমাঝে ধূলোবালি কাদা লেগে থাকে। এটাই প্রমাণ করে তিনি সীমান্তে পাহারা দেন।
তাঁর সাহসিকতা, আত্মত্যাগ শত শত জওয়ানের অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও প্রহরা অবিচল
হিরো অফ নাথু লা ।
হরভজন সিং -এর সাহসিকতা , কর্তব্য বোধ তাঁকে মরণোত্তর মহাবীর চক্র এনে দিয়েছে।
বারো বছর আগে পর্য্যন্ত তাঁকে জীবিত সেনার মত বাৎসরিক ছুটি দেওয়া হত। তাঁর নামে ট্রেনে রিজার্ভেশন করা হত। একজন সেনা তাঁর ছবি ও জিনিসপত্র এবং সেনাদের সংগ্রহ করা কিছু অনুদান নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে কাপুরথালার কোকে গ্রামে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেত এবং ছুটি শেষে আবার নাথু লায় ফিরে আসত। তাঁর কাজের জায়গা কিন্তু বদল হয়নি। ১৯৬৮ থেকে এখনও তিনি নাথু লায় কর্মরত।
কেউ বলেন হিরো অফ নাথু লা ; ধার্মিক জনে বলেন বাবা ( সাধু ) । এভাবেই যুগ যুগ তিনি থাকবেন জওয়ানদের অন্তরে আর ভারতবাসীর মননে।