বৃত্তের বাইরে পর্ব আশি
বৃত্তের বাইরে পর্ব আশি
পর্ব আশি
কফিন বন্দী হয়ে বিভূতিভূষণ এলেন লাহা বাড়ির প্রাঙ্গনে । আগে আছে পুলিশের গাড়ি, তারপর শববাহী যান , আবার পুলিশের গাড়ি এবং সব শেষে রাজদীপদের গাড়ি ।
শুভমিতা দেবী বায়না ধরেছিলেন শেষকৃত্যে যোগ দিতে । এ নিয়ে এস পি সাহেবের নিকট আর্জিও জানিয়েছিলেন।
অবশেষে আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনিও পুলিশের গাড়িতে এলেন ।
গাড়ি থেকে নামতেই রাজদীপ সম্পাতির শর্ত মনে করিয়ে দিল । পুলিশ শুভমিতাকে বাধা দিল । গাড়ি থেকে নামতে নিষেধ করল ।
শুভমিতা দেবী আদালতের কথা মনে করিয়ে দিলে পুলিশ বলল - শ্মশানে তো যাবেনই। তবে লাহা বাড়িতে আপনার যাওয়া হবে না । প্রাথমিক ক্রিয়া সম্পন্ন হলেই শ্মশানে যাবেন । এইটুকু শর্ত আপনাকে মাথায় রাখতেই হবে । আর আদালত আপনাকে শ্মশানে যাবার অনুমতি দিয়েছেন , লাহা বাড়িতে নয় ।
- লাহা বাড়ি , লাহা বাড়ি, লাহা বাড়ি ! আপনারা ওঁর নিজের বাড়ি ' ব্যানার্জী ভিলায়' নিয়ে গেলেন না কেন ?
মিঃ পাঠক বললেন - দেখুন ! প্রথমত ওই বাড়ি বাজেয়াপ্ত করা আছে । ও বাড়ি এখন আদালতের জিম্মায় । দ্বিতীয়ত মিসেস লাহা মানে আপনার কন্যার স্ট্রিক্ট নিষেধ আছে লাহা বাড়িতে আপনার পদার্পণ নিয়ে । সেজন্য...
- তাহলে আমি সৎকার কর্মে থাকতে পারব না ? মুখাগ্নি দেখতে পাব না ? আমার মেয়ে যে মুখাগ্নির নামে ওঁকে বাবা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করতে পারব না ? প্লীজ ! আমাকে নিয়ে চলুন । ভয় নেই আমি পালিয়ে যাব না ।
এস পি সাহেব বললেন - পালানোর তো প্রশ্নই নেই । সরি আপনাকে এখানেই ওয়েট করতে হবে ।
বিভূতিভূষণেরা পার্থিব শরীর লাহাদের তুলসী তলায় নামানো হল । কফিন খুলে সম্পাতিকে ডেকে আনা হল ।
এস পি সাহেব মুখাগ্নির ভিডিও করতে নির্দেশ দিলেন শুভমিতা দেবীকে দেখাবেন বলে ।
এমন সময় শুভমিতা দেবী নাভিমূল থেকে চিৎকার করে সম্পাতির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আকুল আবেদন জানালেন একবার চোখের দেখা দেখিয়ে দিতে ।
সম্পাতি কফিনের সামনে এসে দাঁড়াল। বিভূতিভূষণের মুখের দিকে চাইল । আর তার কান্না ছাপিয়ে পৌঁছে গেল শুভমিতার কানে ।
শুভমিতা অস্থির হয়ে উঠলেন । প্রিজন ভ্যানের চেয়ারে তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে তালা দিয়ে রেখেছে পুলিশ। ছটফট করছেন শুভমিতা দেবী । হাত কড়া ছিঁড়ে ফেলতে চাইছেন। দুমদাম লাথি মেরে চলেছেন। সেই শব্দও সম্পাতির কানে এসে পৌঁছাচ্ছে।
হঠাৎ সম্পাতি লোকজন ঠেলে দরজার বাইরে এসে মাকে খুঁজতে লাগল ।
দেখতে পেয়ে শুভমিতা দেবী চিৎকার করে বললেন - মা গো আমি এখানে !
সম্পাতি প্রিজন ভ্যানে উঠে পড়ল । শুভমিতাকে দেখে কেঁদে কেঁদে সারা হয়ে গেল যেন ।
- কেন এমন করলে মা ?
শুভমিতা দেবীও অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন ।
মিঃ পাঠক ওঁর হাত কড়া খুলে দেবার নির্দেশ দিলেন। সে করুণ দৃশ্য দেখে পুলিশের লোকজনের চোখও ভিজে এল ।
সম্পাতি বলল - মা চল। বাবার মূখে কেমন করে আগুন দিলে ওঁর জ্বালা করবে না ; তুমি বলে দেবে ।
এস পি সাহেব কর্তব্যে কঠোর কিন্তু তাঁরও তো বিবেক বলে একটা বস্তু আছে । সশস্ত্র পাহারা দিয়ে শুভমিতা ও সম্পাতিকে তুলসী তলায় নিয়ে গেলেন ।
মাত্র দুই মিনিটের অনুষ্ঠানে মুখাগ্নি ক্রিয়া শেষ হল ।
মঞ্জরী দেবী বেরিয়ে এসে শুভমিতাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন । বিভূতিভূষণ আবারও কফিন বন্দী হয়ে চললেন মহাশ্মশানের পথে ।
সম্পাতি এমন ভাবে শুভমিতাকে জড়িয়ে ধরেছিল যে আর ছাড়তেই চায় না । বুঝিয়ে বলার পরও দু'জন দু'জনকে ধরে রইল ।
অবশেষে মহিলা পুলিশ এসে শুভমিতা
কে সম্পাতির বন্ধন থেকে মুক্ত করে প্রিজন ভ্যানে তুলে দিল ।
দিব্যেন্দুদের পাশের বাড়ি বলে দিব্যেন্দুও হাসপাতালে যেতে পারল না । কামদাকিঙ্করকে ফোনে সব ঘটনা জানিয়ে দিতেই কামদাকিঙ্কর বললেন - আমি আসছি শ্মশান ঘাটে । শেষ বিদায় তো আমাকেও জানাতে হয় !
ওদিকে জামাই দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রভঞ্জন ও নিরঞ্জন এসে হাজির ব্যানার্জী ভিলায় । ঘরের চারিদিকে পুলিশী প্রহরা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেল ।
জনৈক পুলিশ কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারল বিভূতিভূষণ এখন শ্মশানে ।
গাড়ি ধরে শ্মশানে গিয়ে শুভমিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল । তিনি আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলছন না। দু'ভাইকে কাছে টেনে এতদিনের অহংকার মিশিয়ে দিলেন ধূলায় ।
বললেন - আমার আর কিছু রইল না ভাই । আমার যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। ব্যানার্জী ভিলা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ব্যাঙ্ক এটাউন্ট সীল করে দিয়েছে ।
প্রভঞ্জন বলল - তবে আর দেখা কি হবে না কখনও?
নিরঞ্জন বলল - আমরা হাইকোর্টে যাব ।
কামদাকিঙ্কর পিছন থেকে বললেন - সাবাশ ! আমিও আছি তোমাদের পাশে ।
শুভমিতা দেবী কামদাকিঙ্করের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে সরে গেলেন তিনি ।
বললেন - এখন অশৌচ চলাকালীন প্রণাম করতে নেই মা । জেল থেকে ফিরে এস তখন করবে ।
প্রভঞ্জন ও নিরঞ্জনকে বললেন - কথামত তিন ভাগের এক ভাগ আমার এই মেয়েটিকে দিও দাদুভাই । ওর তো ওইটুকু ছাড়া আর কিছু নেই ।
প্রভঞ্জন বলল - আপনার নির্দেশ আমরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব দাদু । এই আপনার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছি ।
দেহ বৈদ্যুতিক চুল্লীতে ঢুকে গেল । আর কিছুক্ষণ পরেই রাজদীপ অস্থি সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে ত্রিবেণীতে । সেখানে গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন দিতে বলেথেন তার শাশুড়ি মা ।
কামদাকিঙ্কর রাজদীপের সঙ্গে ওদের দু'ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন । রাজদীপ বলল - মামা বাবুরা আমাদের বাড়ি যাবে তো !
নিরঞ্জন বলল - কেন যাব না ? ওখানে আমার ভাগ্নির শ্বশুরবাড়ি যে !
এত দুঃখেও শুভমিতা দেবী, প্রভঞ্জন, নিরঞ্জন এবং কামদাকিঙ্করও হেসে উঠলেন ।
কামদাকিঙ্কর শুভমিতাকে বললেন - তুমি চিন্তা কর না মা । হাইকোর্টে তোমার শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব ।
বিভূতিভূষণের অস্থি ঠিক নয় ; দাহের শেষে যখন চুল্লীর ঢাকনা খুলে গেল একরাশ ছাই বেরিয়ে এল ।
তাই সংগ্রহ করে রাজদীপ একটি নতুন কাঁসার ঘটিতে রেখে এক পিস লাল শালু কাপড়ে বেঁধে নিল ।
সব দেখছিলেন শুভমিতা দেবী । চোখের জল তখনও শুকায়নি , বরং অনর্গল ধারায় বয়ে যাচ্ছিল ।
কামদাকিঙ্কর তাঁকে বললেন - এটা তো তোমার ট্রায়াল রাণ । আসল রাণের জন্য ফিটনেস প্র্যাক্টিস ।
রাজদীপ বলল - বুঝলাম না দাদু ।
- যে বোঝার বুঝে গিয়েছে, তোমার বুঝে কাজ নেই । তোমরা তো এই পথেই ত্রিবেণী যাচ্ছ ?
রাজদীপ বলল - হাঁ দাদু । তারপর একটু কাছাকাছি হয়ে বলল - যা বললেন একটু বুঝিয়ে দিন না !
কামদাকিঙ্কর হাসলেন । সে হাসিতে কোন সহানুভূতি ছিল না ; ছিল এতদিনের চাপা ক্ষোভ, রাগ এবং অভিমান।
বললেন - মিতার বেইমানির সঠিক জবাব এর চেয়ে আর ভালো হয় না । আমি লোকটা যেমন ভালো, বেইমানির পক্ষে তত কঠোর । শুভমিতার উপর আমার কোন সহানুভূতি নেই । ও যে ওমপ্রকাশ খৈতানের কন্ঠলগ্না - মনে পড়লে আমার গা ঘিনঘিন করে ।
রাজদীপ আর কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে বসল । পুলিশ শুভমিতাকে নিয়ে জেলে পৌঁছে দিতে গেল ।
সম্পাতিকেও জানানো হয়নি যে শ্মশান থেকে অস্থিকলস নিয়ে রাজদীপ তার দু বন্ধুর সঙ্গে ত্রিবেণী গেছে ।
( চলবে )