অশান্ত জীবন
অশান্ত জীবন
অশান্ত জীবন (৫)
সন্ন্যাসী গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেখলেন আশ্রিত ব্যক্তি ভগবান শঙ্করের পদতলে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে অশ্রু বিসর্জন করছে।
তিনি তাঁকে বিরক্ত করলেন না। তাঁর মনের অবস্থা সম্যক বিবেচনা করে একান্তে থাকতে দেওয়াই বিধেয় বলে ফিরে যেতে মনস্থ করলেন। এই সময় নয়ন যুগল ভাসলে কৃতকর্মের অনুতাপ দগ্ধ হবে। মনের ভার লাঘব হবে।
সন্ন্যাসী অতি সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করতে যাবেন ; দিগন্ত একপ্রকার দৌড়ে এলেন এবং সন্ন্যাসীর চরণ ধরে পুন: কাঁদতে লাগলেন।
সন্ন্যাসী বললেন - বৎস ! তুমি আদর্শচ্যুত হও নাই ; এই অপেক্ষা গর্বের আর কিছুই হতে পারে না। আমি তোমার আদর্শ জ্ঞানকে প্রণাম করি। আহা ! তোমার মত আধিকারিক যদি আরও কয়েকজন জন্মাত !
দিগন্ত এতক্ষণ কেঁদে কেঁদে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন তাঁর চক্ষে সপ্ত সমুদ্রের বারিও নি:শেষিত হয়ে গেছে। তিনি সন্ন্যাসীকে করজোড়ে বললেন - আমি পাপী । মহাপাপী। একত্রে স্ত্রী-পুত্রের বিনাশ করেছি । আমি শাস্তি প্রার্থনা করি । আমি মৃত্যুকে আহ্বান করছি। আপনি আজ্ঞা করুন - মন্দাকিনী অথবা অলকানন্দার ক্রোড়ে এক গজ স্থান গ্রহন করি ।
সন্ন্যাসী হাসলেন ।
জন্ম মৃত্যু নিয়তির হস্তে। কারও অনুজ্ঞা, অনুরোধের বশীভূত নয়। তুমি বৃথা আক্ষেপ করছ। এই যে নিয়তির বিধান ছিল ! তুমি সেই বিধানকে প্রতিপাদ্য করেছ মাত্র। শঙ্কর মহাদেব তোমার মঙ্গল করুন।
সন্ন্যাসী চলে গেলেন । দিগন্ত সেই গমনপথের দিকে অপলক চেয়ে রইলেন এবং আরেক প্রস্থ ক্রন্দন বারি নির্গত করে শঙ্করের চরণতলে এসে বসলেন।
সন্ন্যাসী পুনর্ধ্যানে নিমগ্ন হলেন । দিগন্ত একসময় নিদ্রাভিভূত হলেন। পরম নির্ভরতার নিদ্রা ।
অলকানন্দা এবং মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থলে সূর্য্য উদিত হল । নব প্রভাতের রক্তিম আভায় সমুদায় অঞ্চল এক অনাস্বাদিতপূর্ব শোভায় চিত্রিত হল । এতদৃশ মনোরম পরিবেশ দিগন্তর অন্তরে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারল না। তাঁর দশা 'পুনর্মূষিক ভব' -ন্যায় , এই অপরূপ প্রত্যুষে বড়ই বেমানান মনে হল । অনন্যোপায় দিগন্ত চৌধুরী মনকে শান্ত করবার জন্য সঙ্গমস্থল দর্শণহেতু প্রস্থান করলেন।
সন্ন্যাসীর চক্ষু তা ' লক্ষ্য করেছে। তিনি দিগন্তর অনুগামী হয়ে তথায় উপস্থিত হলেন।
দুই জনে দৃষ্টি বিনিময় করলেন । দিগন্ত ম্লান কৃত্রিম হাসি হাসলেন। তাঁহার অন্তর হাসবার জন্য নিষ্ফল প্রয়াস করল।
সন্ন্যাসী প্রথম বাক্য বিনিময় করলেন।
- অখিল ভারতবর্ষে কতই না সুন্দর মনোরম স্থান রয়েছে । তুমি এই দুর্গম স্থান নির্বাচিত করলে কেন ?
প্রশ্ন শুনে দিগন্তর হৃদয় চমকিত হল । কে এই সন্ন্যাসী ? কি করে তিনি তাঁর ঘটনাচক্র জানতে পারলেন ? একজন সাধারণ মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে , আবেগতাড়িত হয়ে এসেছে - এতে কার্য্যকারণ সম্পর্ক খুঁজছেন কেন - এই প্রশ্ন বারংবার তাঁকে পীড়িত করতে লাগল । তবে কি সন্ন্যাসীর ভেক ধরে তিনি তাঁর অনুগমন করছেন!
কিন্তু তিনি তো পূর্ব হইতেই এই স্থানে রয়েছেন ! এরূপ নানা প্রকার ভাবনার সম্মুখীন হয়ে তিনি ভীত হয়ে পড়লেন ।
সন্ন্যাসী দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলেন । তিনি নিশ্চুপ রয়েছেন দেখে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন।
এইবার দিগন্ত প্রশ্ন করলেন - যোগীবর ! আমি দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ বিভাগে কর্ম করেছি। প্রচুর ঘটনার তদন্ত করেছি। বেশীর ভাগ ঘটনার সমাধানও করেছি। সাধুবেশী সন্ন্যাসীও অনেক দেখেছি। আপনার মত জ্ঞানী গুনবান সন্ন্যাসীর সহিত কখনও পরিচয় ঘটে নাই। যদি অনুগ্রহ করে বলেন আপনি কেমন করে আমার সম্পর্কিত তথ্যগুলি প্রাপ্ত হয়েছেন - শ্রবণ করে কৃতার্থ হই ।
সন্ন্যাসী মৃদু হাসলেন । বললেন - বৎস ! আমি তপস্বী। বেশ কিছু সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছি। আমার অন্তর্দর্শণ ঘটেছে। সেইজন্য আমি অতি সহজে পূর্বাপর দৃশ্য অবলোকন করতে পারি।
দিগন্ত বিস্মিত হলেন । দেবভূমির সাধকদের এইরূপ দিব্যদৃষ্টি থাকতে পারে । তিনি চুপ করে গেলে সন্ন্যাসী বললেন - আর কিছু জানতে ইচ্ছা করে ? নির্ভয়ে বলিও; আমি সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত আছি।
দিগন্তর অনিসন্ধিৎসু মনে বহু প্রশ্ন উপস্থিত হয়েছে কিন্তু তিনি পুলিশের লোক বলে তক্ষুণই কোন প্রশ্ন করলেন না। সন্ন্যাসীকে নজরে রাখতে হবে ভেবে তখনকার মত বিরত রইলেন।
অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থলে কঠমূলি বৃক্ষের পত্রগুলি প্রকম্পিত হতে লাগল । পর্বতমালার সুদৃশ্য বনরাজি দুলে উঠল । দুই স্রোতস্বিনীর ভিন্ন ধারার জল যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল ।
দিগন্ত চৌধুরীর মন প্রাণ যেন আন্দোলিত হতে থাকল । সন্ন্যাসী মৃদুহাসে অকুস্থল পরিত্যাগ করে গুহার মধ্যে যাবার প্রস্তুতি নিলেন।
দিগন্তকে বললেন - যদি কিছু মনে না কর তো বলি ?
দিগন্ত তাঁর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন এবং করজোড়ে বললেন - বলুন ।
- পুত্রহত্যার কারণ না হয় যথেষ্টই ছিল ; অকারণে নিজের পত্নীকে হত্যা করলে কেন ?
দিগন্তের সন্দেহ ঘনীভূত হল । এ সন্ন্যাসী না গুপ্তচর ভেবে পেলেন না । প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে সঙ্গম স্থলের দিকে চেয়ে রইলেন ।
সন্ন্যাসীও পুলর্বার প্রশ্ন করলেন না ।
************ ক্রমশ ****************

