অশান্ত জীবন
অশান্ত জীবন
অশান্ত জীবন (৪)
সেকেণ্ড অফিসার গোপন পত্রখানা দিগন্তের হস্তে ন্যস্ত করে বোধ করি নিশ্চিন্ত হলেন। দিগন্ত পত্রটি হস্তে গ্রহন করে কিয়ৎক্ষণ উল্টে পাল্টে দেখে নিলেন তা' অক্ষতই আছে।
সেকেণ্ড অফিসার তাঁর আপন আসনে যেয়ে সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। পত্র পাঠের পর তাঁর মুখমণ্ডলের কোন পরিবর্তন হয় কি না তা' লক্ষ্য করতে লাগলেন । দিগন্ত পত্রটি পকেটস্থ করে ফাইল ঘাঁটতে লাগলেন। পত্রটি এইবার খুলে দেখলেন; হেড কোয়ার্টার থেকে ডাইরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ রণজিৎ গুপ্তের নিজ হস্তে লিখিত একটি সম্পূর্ণ গোপন পত্র। সম্বোধনে নিজের নাম দেখিয়া কৌতূহল বৃদ্ধি পেল। স্বয়ং পুলিশ কর্তা লিখেছেন -
Dear Sri Chowdhury,
Having solemnly confirmed by the Detective Department ,it is learnt that a naxalite action squad headef by Prantor Chowdhury by name has arrived on the forest land of Midnapore; particularly in the Goaltore area and is trying to mislead poor peoples .
As such you are hereby directed to make a stubborn encounter to end the calamity.
দিগন্ত চৌধুরীর মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগল । প্রান্তর যে তাঁরই পুত্র সেই কথা অস্বীকার করবেন কি প্রকারে। অধিকন্তু এতদৃশ আদেশনামা অগ্রাহ্য করবারও উপায় নেই । এমনকি চাকুরীতে ইস্তফা দিলেও অব্যাহতি মিলবে না।
এই প্রথমবার - ইয়েস - এই প্রথমবারের মত দিগন্ত চৌধুরী নামক দুর্ধর্ষ নির্ভীক পুলিশ অফিসারের মনে যুগপৎ সন্দেহ এবং ভয় আশ্রয় করল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কিয়ৎক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়ে রইলেন। সেকেণ্ড অফিসার তা' লক্ষ্য করেছেন । কিন্তু কিছু প্রশ্ন করতে সাহস করলেন না।
কিছুক্ষণ পর দিগন্ত অকস্মাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠলেন এবং ক্ষিপ্রপদে থানা থেকে বা'র হয়ে গেলেন। সেকেণ্ড অফিসার রামশরণ যাদবকে ইঙ্গিত করলেন সাহেবের অনুগামী হবার জন্য ।
রামশরণ গাড়িতে স্টার্ট দিল । সাহেবের সম্মুখে গাড়ি রেখে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। দিগন্ত চৌধূরী গাড়িতে উঠলেন না। সোজা বাটির দিকে
চলতে লাগলেন।
রামশরণ সাহেবকে কিছু বলতে চেয়েছিল । দিগন্ত তা'তে কর্ণপাত না করে চলতে লাগলেন । রামশরণ আর অগ্রসর হল না । সাহেবের এই উন্মনা ভাব পূর্বে সে কখনও দেখেনি ।
তারপরের ঘটনা তো পূর্বেই বলেছি।
বৈকালের দিকে দিগন্ত চৌধুরী থানার উদ্দেশ্যে রওনা হবার পূর্বে পত্নীর নাম ধরে ডাকলেন।
- মধু ! এই মধু ! বিকাল হয়েছে, এক কাপ চা দাও তো !
প্রত্যুত্তর পাবার পূর্বেই তিনি মধুপর্ণা দেবীর ঘরে গিয়ে দেখলেন তিনি সাজসজ্জায় ব্যস্ত ।
হাসপাতাল থেকে ফিরে মধুপর্ণা দেবী নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন । স্বামী কখন ফিরলেন তিনি খেয়াল করেননি ।
অকস্মাৎ স্বামীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তাঁর টনক নড়ল । শীঘ্র দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দিগন্ত চৌধুরী দেখলেন পত্নী সাজসজ্জায় রত । প্রশ্ন করলেন
- কোথায় যাবে ?
- কলকাতা।
- কি কাজ; একবার যদি বলতে !
- হস্টেলে যাব। দেখি ছেলে সেখানে থাকে কি না।
- তাতে কি উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে ?
- ছেলে যে নকশাল হয়েছে তা' জানতে পারব।
দিগন্ত স্ত্রীর হস্ত ধারণ করে বললেন - কোন লাভ হবে না। ছেলে এখন গোয়ালতোড়ের জঙ্গলে অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছে । আমি সন্ধ্যায় সেখানেই যাচ্ছি। ছেলেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করিয়ে গৃহে ফিরিয়ে আনব।
মধুপর্ণা দেবী স্বামীকে যথেষ্ট ভালো চিনেন। তিনি যে এনকাউন্টারে যাচ্ছেন তা' বুঝতে বিলম্ব হল না। তিনি বললেন - ও তা হলে আমার আশঙ্কাই সত্যি প্রতিপন্ন হতে চলেছে ?
- মানে ?
- বুঝতে পারছি তুমি কেন যাচ্ছ ?
কথার দিক পরিবর্তন করে দিগন্ত বললেন
- যা ভাবছ তা নয় । প্রয়োজনে তুমিও আমার সঙ্গে যেতে পার । তা'তে ছেলেকে বোঝতে আরও সুবিধা হবে।
কি হল বলতে পারব না। মধুপর্ণা দেবী ভয়মিশ্রিত কন্ঠে স্বামীকে বলিলেন - ওকে মেরে ফেলবে না তো !
দিগন্ত চৌধুরী হাসলেন। সে হাসিতে আনন্দ নাই। এক অজানা আশঙ্কায় হাসি দিয়ে মলিনতা ছেয়ে দিলেল। বললেন - ওই জন্যই তো তোমাকে যেতে বলছি।
মধুপর্ণা দেবী দুর্গা নাম জপ করতে লাগলেন।
এ যেন মাসাইমারার জঙ্গলে সিংহের হরিণ শিশুকে লালন করার মত মনে হল তাঁর ।
দিগন্ত চৌধুরীকে যতখানি চেনেন তা'তে নকশালদের প্রতি তাঁর যে কোন সহানুভূতি থাকবার কথা নয় ; সে' বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই জঙ্গলমহলে প্রেরণ করেছেন ।
ভয়ে এবং আশঙ্কায় মধুপর্ণা দেবীর মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করল । দিগন্ত চৌধুরীর শ্যেন দৃষ্টিতে তা' গোপন থাকল না ।
- তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস কর মধু ?
বক্ষের চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল দিগন্তের কথায় ।
- বিশ্বাসও করতে পারি না যে !
ম্লান হাসলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার দিগন্ত চৌধুরী ।
- বেশ বুঝতে পারছি, আমার মত মানুষের সংসার পাতা উচিত হয় নাই ।
মধুপর্ণা এই কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ।
- মা হয়ে ছেলেকে গুলি খেতে দেখা তো সম্ভব নয় । আমি যাব না ।
বজ্রকন্ঠে গম্ভীর নাদে দিগন্ত চৌধুরী বললেন - অবশ্যই তুমি যাবে । যেতে হবেই । নচেৎ তুমি যে একলা বাড়িতে থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলবে - সে ব্যাপারে আমি কনফিডেন্ট । তবে একটা কথা বলতে পারি বাবা হয়ে ছেলেকে মেরে ফেলব সে সুযোগ যেন ঈশ্বর আমাকে কখনোই না দেন ।
আশঙ্কার মেঘ না কাটলেও মধুপর্ণা দেবী যেতে সম্মত হলেন । পরক্ষণেই মত পরিবর্তন করে বললেন - আমি যাব না । ললাটে যা' লেখা আছে তা ' খণ্ডাবে কে !
( ক্রমশ )

