বৃত্তের বাইরে অন্তিম পর্ব
বৃত্তের বাইরে অন্তিম পর্ব
অন্তিম পর্ব
বিভূতিভূষণ চলে গেলেন । তাঁর বিগত জীবনের স্মৃতি পরিচিত জনের মনে দগদগে ঘা হয়ে রইল । বিশেষত কামদাকিঙ্কর ও করালীর মনে ।
দিব্যেন্দুর বোন ইন্দুকে বিয়ে করে করালী সুখী দাম্পত্য জীবন উপভোগ করছে । কামদাকিঙ্করের কথায় দিব্যেন্দুর বাড়ির সকলে ওঠাবসা করে ।
তিনি প্রস্তাব রাখলেন রাজকিশোরের সঙ্গে দিব্যেন্দুর আরেক বোনের বিবাহ দিতে । দিব্যেন্দু ও তার মা এতে রাজী হয়ে গেলেন । কামদাকিঙ্কর তখন সম্পাতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লাহা বাড়িতে এলেন ।
ইতিমধ্যে বিভূতিভূষণ , শুভমিতা ও সম্পাতিকে নিয়ে তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণে রাজকিশোর তথা মঞ্জরী দেবীও বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন । সাদর অভ্যর্থনা সমেত তাঁকে স্বাগত জানিয়ে স্বর্গত রাজশেখরের কক্ষে বসানো হল ।
সম্পাতি প্রণাম করে বলল - দাদু ! আমার মায়ের মামলায় কতদূর অগ্রগতি হয়েছে?
- দেখ মেয়ে ! এ বড় কঠিন লড়াই । বিভূতির অকালপ্রয়াণ এই মামলাকে বড়ই প্রভাবিত করেছে । মিতা একটি নতুন মামলা দিয়েছে যে পুলিশ মানসিক নির্য্যাতন করে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
আমার এখন উভয় সঙ্কট । এস পি মিঃ পাঠক এক সজ্জন পুলিশ অফিসার । আমরা জানি তিনি নির্দোষ । অথচ মিতা এখনও তার নতুন নতুন চাল একটার পর একটা দিয়ে যাচ্ছে । ফলে আসল মামলাটি ঝুলে পড়েছে ।
- আপনি মাকে বোঝান দাদু ! আমি জানি মা আপনার কথা মেনে নিতে বাধ্য হবেন ।
কামদাকিঙ্কর সম্পাতিকে বললেন - তার আগে আমি তোমার ও তোমার শ্বশুরবাড়ির মতামত পেতে চাই । তোমরা যদি মনে কর মিতার সাজা কমে গেলে ; তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না, তবেই আমি...
মঞ্জরী দেবী বললেন - আমাদের আর কি ক্ষতি হবে কাকাবাবু !
কামদাকিঙ্কর বললেন - মা ! তোমরা তো জানো ছাড়া পেলে ওর আর কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই । আমি মিতাকে বলেছি কেস তুলে নিতে । আর জেলে সদাচার করতে । আদালতে যা হচ্ছে হোক ও যেন জেলের মধ্যে কোন গোলমাল পাকিয়ে না বসে ।
আবারও বললেন - এস পি সাহেব কথা দিয়েছেন শুভমিতা দেবী যদি মানবিক আচরণ করেন তবে তিনি নিজে তাঁর শাস্তি মকুবের জন্য রাজ্য সরকারের নিকট আবেদন জানাবেন ।
কথা হল , আমরাও তাকে নিয়ে আদালতে ভালো সওয়াল
করব । আমি পাঁচ জন বড় উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি - ওঁরা শুভমিতার কেস লড়বেন বলেছেন । এখন শুধু মিতা মামলা তুলে নিলে সুবিধা হয় ।
মঞ্জরী দেবী বললেন - ছাড়া পেলে আমরা খুশী হব - আর ওঁর থাকা খাওয়া বা যত্নের কোন অভাব হবে না । আমাদের কাছে এনে রাখব ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - সম্পাতি তো খৈতান ডাক্তারের ঘরবাড়ি বা অর্থ সকলের হকদার প্রমাণিত হয়েছে, আমি বলি কি - মিতা যদি সেখানে থাকে , সম্পাতির কোন আপত্তি নেই তো !
সম্পাতি বলল - ওই পাপের সম্পত্তি আমি নিচ্ছি না । মা নিলে আমার কোন অবজেকশন নেই ।
সকলেই আন্দাজ করে নিল কামদাকিঙ্কর কিছু একটা করতে চলেছেন ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - পাঠক সাহেব অলরেডি রেকমেণ্ড করে দিয়েছেন । মিতা হয়তো আজকালের ভেতরে মামলা উঠিয়ে নেবে ।
তারপর মঞ্জরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন - আমি কিন্তু আজ একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছি !
সকলেই বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে রইল।
কামদাকিঙ্কর মঞ্জরী দেবীকে বললেন - মা তোমার দুই ছেলে এখনও অবিবাহিত । তোমার কি ইচ্ছে আছে বড় ছেলে বা মেজ ছেলের বিয়ে দিতে ?
মঞ্জরী দেবী বললেন - বড় তো বিয়েই করবে না বলে দিয়েছে । আপনি দেখুন যদি রাজী করাতে পারেন, আর আপনার সন্ধানে কি কোন ভালো মেয়ে আছে ?
কামদাকিঙ্কর বললেন - আছে ।
- কোথায় ?
- তোমার পাশের বাড়িতেই ।
- ও বিন্দু ? সে তো দেখেছি ভীষণ সংসারী মেয়ে। আপনি কাকাবাবু ব্যবস্থা করুন । আমি রাজকিশোরকে রাজী করিয়ে নেব ।
রাজকুমার গলা খাকারি দিয়ে বলল - দাদু ! আমার এত বড় ক্ষতি করবেন না ।
হেসে উঠলেন কামদাকিঙ্কর। হাসলেন মঞ্জরী দেবী, সম্পাতিও ।
সম্পাতি বলল - ছোড়দা ? সিঙ্কিং সিঙ্কিং ড্রিঙ্কিং ওয়াটার ?
মঞ্জরী দেবী বললেন - আমি আজই ওদের সঙ্গে কথা বলব ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - এখনই চল মা । আমি শেষ কাজটাও সম্পূর্ণ করে আসি ।
তারপর ফোনে দিব্যেন্দুকে জানিয়ে দিলেন - এখনই বাড়ি চলে এস দাদু । আমরা তোমার বাড়িই যাচ্ছি ।
শুনে দিব্যেন্দু তো হতবাক । খবর পেয়েই দৌড়াদৌড়ি চলে এল হাসপাতাল থেকে ।
ততক্ষণে সব কথা হয়ে গেছে । কামদাকিঙ্কর দিব্যেন্দুকে বললেন - কাজে নেমে পড় । নাতি সাহেবকে ডেকে দু'জনে মিলে আয়োজন কর । খরচাপাতি আমার ।
মঞ্জরী দেবী বললেন - গত জন্মে বোধ করি আপনিই আমার জনক ছিলেন ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - এখন কি ডিমোশন হয়ে গেছে নাকি ? আমি তো তোমার বাবার মতই ।
মঞ্জরী দেবী বললেন - মতই না ! আপনি আমার বাবা-ই ।
রাজকুমার তার প্রেয়সীকে পেয়ে তো আনন্দে নাচতে লাগল ।
রাজকিশোর বলে উঠল - মা ! আমি মত পরিবর্তন করলাম । তারপর কামদাকিঙ্করকে বলল - আমারও একটা হিল্লে করে দিন দাদু ।
কামদাকিঙ্কর হাসতে হাসতে বললেন - আবার আর একটা টাস্ক ? দেখি কি করি !
সম্পাতি বলল - বড়দাই বা কেন বাকি থাকবেন ! দাদু কিছু একটা করুন ।
- আমার মামাতো ভাইয়ের নাতনি আছে , চলবে ?
রাজকিশোর বলল - চলবে মানে ? কানা খোঁড়া হলেও দৌড়াবে ।
আবার একটা হাসির রোল উঠল । কামদাকিঙ্কর মামাতো ভাই অজয়কে ফোন করে জানাতে তিনি বললেন - আজ রাতেই আসছি তোমার ওখানে ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - লে হালুয়া ! চলি গো মা! তোমরা তৈরী হয়ে নাও, একসঙ্গে দুটো বিয়ের বাদ্যি বাজতে চলেছে । দেখি যদি এক ডেটেই হয়ে যায় !
কামদাকিঙ্কর চললেন জেলে । শুভমিতা দেবীকে বললেন সম্পাতির কথা । তিনিও খুশী হলেন ।
বললেন - এবার থেকে আপনি যেমন বলবেন আমি তেমনই থাকব । ইস ! মেলামেশা করেও আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম । পুরন্দরপুরে আমি থাকতে পারব না ।
- তারও বন্দোবস্ত করে দিয়েছি । খৈতানের বাড়িতে ।
শুভমিতা দেবী বললেন - আজ সত্য ঘটনাটা আপনাকে খুলে বলি কাকাবাবু। বিভূতিভূষণকে আমার কোনদিন পছন্দ হয়নি । ওমের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল । ও যখন পুরন্দরপুরে প্র্যাক্টিস করত তখনই ওর সাথে আমার ...
- বুঝে গেছি । সুরঞ্জন বৃত্তের বাইরে বেরোতে না পেরে নিজের কুল রক্ষা করতে কুলীন ঘরে বিয়ে দিয়েছিল - এই তো !
শুভমিতা দেবী মাথা নীচু করে বললেন - ওমের কেসটাও দেখবেন কাকাবাবু । যে কয়টা দিন আছি ওর কাছে যেন থাকতে পারি ।
কামদাকিঙ্কর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছেন । বিভূতিভূষণ এসেছেন তাঁর শয্যার উপরে । এই রে ! গলা টিপে মারল বুঝি !
- বিভূতি !
- হ্যাঁ মুখুজ্যে মশাই, আমি ।
- তুমি কি প্রতিশোধ নিতে এসেছ ?
হা হা করে হেসে উঠলেন বিভূতিভূষণ ।
বললেন - না , ক্ষমা চাইতে এসেছি । জীবদ্দশায় যা পাইনি, মরণোত্তর ক্ষমা লাভের জন্য এসেছি কাকাবাবু।
আপনি মিতার জন্য যা করলেন তাতে আমি সুখী হয়েছি। আমি বিয়ের পর জানতে পারি ও অন্যের প্রতি অনুরক্ত ।
সেজন্য কোনদিন ওকে স্পর্শ করিনি । এক ছাদের তলায় থেকেও নিজেকে আড়াল করে গেছি । সম্পাতিকেও জানতে দিইনি ওর আসল জন্মদাতা কে ? নিজে বঞ্চিত হয়ে থেকে আমার শয়তানি শুরু হলেও মিতাকে কোনদিন অবহেলা করিনি বরং অন্ধকারের পিছনে ওর যে আলোর ছটা ছিল তাকে দীপ্যমান রেখেছি ।
সম্পাতি আমাকে খুব ঘৃণা করে জানি ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - সে ঘৃণা নয়; তোমাকে ভালবাসে । তোমার ছবিতে দু'বেলা মালা পরিয়ে ধূপ দীপ জ্বালে !
বিভূতিভূষণ মাথার চুল ছিঁড়ে বলেন - শুভমস্তু ।
তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন । কামদাকিঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল । তাঁর মনে হল স্বপ্নেরাও যেন চলে এসেছে বৃত্তের বাইরে।
( শেষ )