বৃত্তের বাইরে পর্ব ছিয়াত্তর
বৃত্তের বাইরে পর্ব ছিয়াত্তর
পর্ব ছিয়াত্তর
রাজদীপ বলল - সব জেনেও এ বিয়ে স্বীকার করতে আমারই কুন্ঠা বোধ হচ্ছে । ভাগ্যিস আমার মা দাদা এখানে নেইয়। নচেৎ তাঁরা কোনদিন আমার মুখ দর্শণ করতেন না । আমি চললাম।
মিঃ পাঠক বললেন - দেখে যান না ভিডিও রেকর্ডিংএ কি আছে ? মিসেস ব্যানার্জী , ডক্টর খৈতান যদি দেখতে পারেন, মিঃ ব্যানার্জী যদি সহ্য করতে পারেন ; আপনি পারবেন না ?
রাজদীপ চুপ করে গেল । উপস্থিত সকলের সামনে ভিডিও দেখানোর তোড়জোড় চলছে । বিভূতিভূষণ মাথা নীচু করে বসে আছেন । ডক্টর খৈতান বলে উঠলেন - পাবলিকলি এটা আপনারা দেখাতে পারেন না ।
মিঃ পাঠক তাঁর দিকে তাকালেন। কামদাকিঙ্কর বললেন - থাক না সাহেব । কেচ্ছা সবার সামনে তুলে ধরে আর লজ্জায় ফেলবেন না । বরং আদালতে পেশ করলে আপনাদের সুবিধা হবে বেশী ।
সম্পাতি বলল - অন্তত দীপুকে দেখতে দিন । নইলে যে আমার কপাল পুড়তে চলেছে !
কামদাকিঙ্কর বললেন - ইয়েস, ইউ আর রাইট । মিঃ পাঠক ! অনুরোধ করছি রাজদীপকে একবার দেখিয়ে দিল।
ওসি নিয়ামত শেখের চেম্বারে ওদের নিয়ে যাওয়া হল । শুধু সম্পাতি এবং রাজদীপকে ।
নিয়ামত শেখ বললেন - গুড আইডিয়া স্যার । এতে ওদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলেও হতে পারে ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - ঠিক তাই । ওসি বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছেন ।
মিঃ পাঠক বললেন য়- ঠিক আছেয়, তাই হবে । তবে আমি মিঃ ও মিসেস ব্যানার্জী এবং মিঃ খৈতানের মধ্যে রিপার্কাসনও দেখতে চাই । ওঁরা ভিডিও দেখুন, আমরা সিসিটিভিতে ওদের মানসিক অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করব ।
এস পি নিজে এ কথা বলেছেন যখন আর তো কারও কিছু বলার নেই । সেইমত আয়োজন করা হল । ওসির চেম্বারে ল্যাপটপে ওঁরা ভিডিও দেখছেন আর সিসিটিভিতে বাকিরা সকলে ওই তিনজনের মানসিক পরিবর্তন পর্য্যবেক্ষণ করছেন।
ভিডিও দেখার আগে - চলুন একবার ঘুরে আসি - ওমপ্রকাশ খৈতানের বাড়ি । দুর্গাপুরের এম এ এম সি কলোনীস্থিত পাঁচ কাঠা জমি নিয়ে ছিমছাম একটা দোতলা বাড়ি । খৈতান সাহেব অবিবাহিত। বৃদ্ধা মা কান্তাদেবীকে নিয়ে মোটামুটি একলাই থাকেন । দোতলা বাড়ির একপাশে গাড়ি রাখার জায়গা । কিছুটায় ইউক্যালিপ্টাস গাছ, আর তাদের তলায় ছোট ছোট বাগান।
বৃদ্ধা কান্তাদেবীকে দেখভালের জন্য চব্বিশ ঘন্টার ঝি রেখেছেন তিন জন । সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। ফিরতে রাত এগারোটা। হাসপাতালের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময় কোথায় থাকেন কেউ খবর রাখে না ।
একটু ভুল বললাম - সম্পাতির ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর জানা গেছে তিনি বিভূতিভূষণের বাড়িতেই কাটতেন। বামুন বউ তখনও কাজে বহাল হয়নি । শুভমিতা দেবী নিজে রান্নাবান্না করতেন , তবে বাড়ির কাজের জন্য অবশ্যই ঝি ছিল ।
একদিনের ঘটনা । সম্পাতি কলেজ থেকে ফিরে নিজের রুমে ঢুকতেই পাশের ঘর থেকে কোন অচেনা কন্ঠস্বর শুনতে পায় । বাবা মায়ের ঘরে তো দুম করে যাওয়া উচিৎ নয় ; সে'জন্য গলা ঝেড়ে মাকে বলে - মা ! আসব ?
শুভমিতা দেবী বলেন - আধঘন্টা পর । এখন খুব বিজি আছি । ডাইনিং এ খাবার ঢেকে রাখা আছে ; যেয়ে খেয়ে নে । তোর বাবা অফিস থেকে ফিরতে পারবে না বলেছে।
সম্পাতি গেল না ঠিকই; কিন্তু তাঁদের কথাবার্তা শুনতে লাগল । আলতো করে দরজা ঠেলে দেখল ভেতর থেকে খিল দেওয়া আছে ।
একটি পরিণত মেয়ের মনে সন্দেহ ঘনীভূত হল । সে আরও সুষ্ঠু ভাবে কান পেতে শুনতে লাগল তাঁদের কথা । তখন কিডনি পাচার নিয়ে রফা হচ্ছিল । সম্পাতি ভাবল এই জন্যই হয়তো তার মা তার সাথে ভালো ব্যবহার করে না ।
দুপুরের খাবার খেয়ে গেল শম্ভুর কাছে । তখন শম্ভুও বাড়িতে ছিল না । এই সময়টাতে সে নিজের বাড়ি চলে যায় । বিকেলে শম্ভু এলে জেনে নেবে - ভেবে নিজের রুমে চলে গেল এবং শরীর ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়ল ।
সন্ধ্যায় শম্ভু এলেও তাকে জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর পেল না । বলল - বলা বারণ আছে দিদিমণি ! খোদ সাহেব মানা করে দিয়েছেন। কি করে বলি ! চাকরি থাকবে না তো !
তখন সম্পাতি বলল - তাহলে এক কাজ করবে । আমার ঘরে যেভাবে ক্যামেরা ফিট করে আমার কথা রেকর্ড করেছিলে ; ঠিক সেই ভাবে ওই ঘরে একটা ভিডিও ক্যামেরা তোমাকে লাগিয়ে দিতে হবে ।
শম্ভু বলল - অসম্ভব । এটাও করতে পারব না ।
- তবে আমাকে একটা সুযোগ করে দাও - আমি নিজে ফিট করে আসব । তুমি গাছে চেপে কাঠের জানালায় যেমন আমার ঘরে ফুটো করেছিলে তেমনই একটা ফুটো করে দাও । এতেও যদি আপত্তি কর আমি সোজাসুজি বাবাকে বলে দেব তুমি বলেছ বাইরের লোক প্রায়ই আসে এই বাড়িতে । তখন তোমার চাকরি থাকবে তো ?
শম্ভু পড়ল অতল জলে । এরা তো মানুষ নয় ; শাঁখের করাত যেন - আসতেও কাটে যেতেও কাটে ।
বলল - তুমি ক্যামেরা দাও, আমি কোন সময় লাগিয়ে দিয়ে আসব । তবে ভেতরের কাজটা তোমাকেই করে নিতে হবে । আমার তো ও ঘরে ঢোকার পারমিশন নেই !
সম্পাতি রাজী হয়ে গেল । কোন ফাঁকা সময় পেয়ে শম্ভু ও সম্পাতি মিলে ওই ঘরে ক্যামেরা লাগিয়ে দিল ।
ডক্টর খৈতান যেমন আসছিলেন এলেন, ইচ্ছে করেই বিভূতিভূষণ অফিসে থেকে গেলেন । খৈতান সাহেব শুভমিতার সঙ্গে ......
তারপরই তাঁদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হল ।
খৈতান বললেন - যদি প্রচার করে দি তোমার মেয়ে বিভূতি বাবুর নয় ; আমার - তখন পারবে ওর বিয়ে দিতে ?
নিমেষে শুভমিতা দেবী চুপসে গেলেন । কিছু তো বলার ছিল না ! একটার পর একটা পাপ কাজ করেও তিনি বহাল তবিয়তে বিভূতিভূষণের সংসার পালন করতে লাগলেন।
মাঝে মাঝে সম্পাতি দেখেছে মা বাবার তর্ক হতে, টানা তিনদিন দু'জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকত । সম্পাতি জানারও চেষ্টা করেছে , ধমক খেয়ে চুপ করে যেত ।
ভিডিও রেকর্ডিং পেয়ে সম্পাতি তা' তার ল্যাপটপ দিয়ে দেখল । কি ঘেন্না ! কি ঘেন্না ! মায়ের মত সংসারী রমণী যে খৈতানের সঙ্গে এমন ন্যাক্কারজনক কাজ করতে পারে - প্রথম দিকে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল ।
তারপর থেকে সেও বাবার মত একগুঁয়ে হয়ে যায় । কথায় কথায় মায়ের সঙ্গে তর্কে জড়ায় । বাবাকেও ঘৃণা করতে শুরু করে ।
ভেবেছিল পুলিশকে সব বলে দেবে । কিন্তু রাজদীপকে পাবার জন্য সে অশান্তি করেনি ।
আজকে যখন ওঁরা সকলেই ধরা পড়ে গেছেন তখন ভিডিও হস্তান্তর করে রাজদীপের মন জয় করতে চেয়েছিল , কিন্তু রাজদীপ যে ডিভোর্সের কথা বলবে ভাবে নি ।
সব দেখে জেনেও রাজদীপ বলল - আমি তোমার সঙ্গে ঘর করতে পারব না । আমি আজই ডিভোর্সের মামলা ফাইলিং করব ।
সম্পাতি কাঁদতে কাঁদতে বলল - আমি তো কিছু লুকাইনি, তারপরও...
- হ্যাঁ, তারপরও আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাই ।
রাজদীপ থানার ভেতরে দাঁড়িয়ে বলল - তবে আমি তোমাকে যথার্থ ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাব ।
সম্পাতি বলল - আমি কিছুই চাই না, দরকার হলে আমি আমাদের ঘর ছেড়ে চলে যাব । তবু তুমি আমার এত বড় ক্ষতি করে দিও না ।
কামদাকিঙ্কর এসে রাগ দেখিয়ে রাজদীপকে বললেন - আমি কে জানো ? না জানলে মিঃ পাঠক বা মাইতি সাহেবের নিকট জেনে নাও । তুমি ডিভোর্স করলে আমি তোমাকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব । বলে রাখলাম ।
তারপর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিভূতিভূষণ ও শুভমিতার সামনে গিয়ে বললেন - এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগাতে গেলে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় । এনিওয়ে তোমরা আমার যে উপকার করেছ তাতেই আমি ধন্য হয়েছি ।
( চলবে )