বৃত্তের বাইরে পর্ব তিয়াত্তর
বৃত্তের বাইরে পর্ব তিয়াত্তর
পর্ব তিয়াত্তর
ধূমধাম করে নাতির বিয়ে দিলেন কামদাকিঙ্কর। দিব্যেন্দুর বড় বোন ইন্দুর সঙ্গে । অলংকারে ঢেকে দিলেন শরীর ।
বিন্দু অর্থাৎ ছোট বোন আনন্দে আটখানা হয়ে নেচে বেড়াতে লাগল । আর দিব্যেন্দু ?
সে তখন ব্যস্ত অতিথি অভ্যাগত জনের আপ্যায়নে । ওদিকে যে তার মা কামদাকিঙ্কর ও ক্ষণপ্রভা দেবীর পায়ে পড়ে মাথা ঠুকছে তাঁদের এই অহৈতুকী করুণার জন্য ; বড় বিব্রত বোধ করতে লাগলেন কামদাকিঙ্কর ।
ক্ষণপ্রভা দেবী ধমক দিয়ে উঠলেন - এই শুভদিনে মায়ের চোখ থেকে জল বের হওয়া শুভ নয় । তুমি উঠে দাঁড়াও বউমা !
- বউমা ডাক শুনে আর এক প্রস্থ কেঁদে নিলেন তিনি ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - তুমি ভেব না মা ! তোমার ছোট মেয়ের জন্য এমনই এক পাত্র এনে দেব । তার বিয়েও এমনই ধুমধাম করেই হবে ।
কামদাকিঙ্কর ঘুরে ঘুরে প্রতি নিমন্ত্রিতদের জিজ্ঞেস করছেন আর কিছু লাগবে কি না ।
কাছাকাছি দিব্যেন্দুকে পেয়ে গেলেন । বললেন - ওহৈ ডাক্তার ! দেখ তো আমার শরীরটা গরম লাগছে কেন ?
দিব্যেন্দু পরীক্ষা করে বলল - কই ? না তো ? শরীরে কিছু হয়নি দাদু । হয়েছে আপনার মনে । ব্যানার্জী ভিলার কেউ আসেনি বলে আপনাকে অস্থিরমতি মনে হচ্ছে।
- তা যা বলেছ ভায়া । এত করে বলে এলাম , সপরিবারে ওর মেয়ের বিয়েতে পাত পেড়ে খেয়ে এলাম - তবু কেউ এল না ? দেখি একবার ফোন করি ওদের ল্যাণ্ড ফোনে।
- দরকার হবে না দাদু ! ওই দেখুন , মনে হচ্ছে ওঁরা এসে পড়েছেন ।
কামদাকিঙ্কর এগিয়ে গেলেন । দিব্যেন্দু বলল - আপনি এখানে বসুন । আমি ওঁদের আপনার কাছে নিয়ে আসছি ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - তা হয় না হে । আমি হলাম গিয়ে বরের ঘরের মাসী আর কনের ঘরের পিসি । আমাকে যেতেই হবে । নইলে বিভূতির আবার আত্মসম্মানে লেগে যাবে ।
কামদাকিঙ্কর ধীর পায়ে চলেছেন সপরিবার বিভূতিভূণের দিকে । হাত নেড়ে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। বিভূতিভূষণ বা শুভমিতা মুখ নীচু করে এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - তোমরা তো এলে বিভূতি, তোমার কুটুমবাড়ির ওঁরা কোথায় ?
শুভমিতা দেবী ওঁদের দেখিয়ে বললেন - ওদের তাড়া আছে , তাই আগেভাগে খেয়ে নিয়ে চলে যাবে বলেছে ।
কামদাকিঙ্কর কিছু একটা অনুমান করলেন । লাহাবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি বুঝি । সেইজন্য পুনরায় ব্যাঙ্কোয়েট হলে ঢুকে ওঁদের সাথে পরিচিত হতে গেলেন ।
বিভূতিভূষণ আড় চোখে তা' দেখছিলেন । দু'জন ভাড়াটে গুণ্ডাকে রাজকিশোর এবং রাজকুমার সাজিয়ে ওদের খাবার টেবিলে বসিয়ে রেখেছেন । ঘোমটা মাথায় সাদা থান পরিহিতা একজনকে ঈশারা করলেন ।
সম্পাতির তা' দৃষ্টি এড়ায়নি । কামদাকিঙ্করের বদান্যতায় সে যে রাজদীপের গলায় মালা দিতে পেরেছে সেই কৃতজ্ঞতা বোধটুকু তাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল ।
রাজদীপকে বলল - মা ও দাদারা তো ফিরে চলে গেছেন- তাই না ?
রাজদীপ বলল - সে তো অনেকক্ষণ আগেই ।
সম্পাতি বলল - তবে ওই যে দুজন খাবার টেবিলে বসে আছে ওরা কারা ? সাদা থান পরা ভদ্রমমহিলাকে দেখে তো শাশুড়ি মা-ই মনে হচ্ছে ।
বুঝতে সময় নিল না রাজদীপ । সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওঁদের তিনজনকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে । এরা নিশ্চয় কোন বদ মতলবে এসেছে ।
কালীকিঙ্কর এবং হৈমন্তী দেবীও ঠিক তাদের পাশেই বসে আছেন । এখনই কোন ব্যবস্থা না নিলে কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে ।
সম্পাতি বলল - চল আমরা ওদিকটায় যাই । তুমি ঘোরাফেরা করলে দাদারা নিধ্চয় তোমার সঙ্গে কথা বলবে ! অবশ্য রিয়েলি যদি তারা তোমার দাদা এবং মা হন ।
কামদাকিঙ্কর শ্রীধর মাইতি, মিঃ মিত্র আর মিঃ পাঠককেও আসতে বলেছিলেন । কিন্তু তাঁরা কেউ আসতে পারেননি । সুযোগের অপব্যবহার করেননি বিভূতিভূষণনও । রক্ত তাঁর চাইই । সেইজন্য সজাগ দৃষ্টি নিয়ে হলে ঢুকলেন ।
সম্পাতি ও রাজদীপকে বললেন - তোমরা এখানে কি করছ ? খেতে বসনি ?
সম্পাতি বলল - আমরা বর কনের সঙ্গে বসব ।
শুভমিতা দেবী বললেন - খেতে রাত করলে হজমের গোলমাল হতে পারে মা । তোমার এখন একটু সাবধানে থাকতে হবে যে !
কামদাকিঙ্কর এগিয়ে এলেন । সাদা থান পরিহিতা মহিলা নড়েচড়ে বসল ।রাজদীপ ও সম্পাতি নিজের বাবা মাকে ছেড়ে কাদাকিঙ্করকে ঘিরে দাঁড়াল । প্রথমে ভেবেছিল আরও প্রণাম করবে - কিন্তু করল না, তাহলে নীচু হতে হবে । সাদা থানওয়ালীর খুব সন্নিকটে তিনি ( কামদাকিঙ্কর ) দাঁড়িয়েছেন । তারপর তাঁকে ঘিরে ধরে এক রকম টেনে নিয়ে হলের বাইরে এনে সম্পাতি বলল - কার সঙ্গে এত করুণা মাখামাখি করছেন দাদু ? আমার বাবা বিন্দুমাত্র পাল্টাননি । মা আরও নির্মম হয়েছেন। আমরা জানি আমাদের এই বিয়েটা ওঁরা কেউ মেনে নিতে পারেননি, আর তার...
কথা শেষ হতে না হতেই রাজকুমার, রাজকিশোর আর সেই মহিলা খাবার সিট ছেড়ে উঠে এল । তিন জনের হাতে তিনটে সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল এক সঙ্গে গর্জে উঠল । কামদাকিঙ্করকে জড়িয়ে রাজদীপ ও সম্পাতি মাটিতে পড়ে দিল ।
নিমেষে একটা মোটর বাইকে ওরা রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গেল ।
মিঃ পাঠক, মাইতি এবং মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে বাড়ীতে আসছিলেন । সিটি সেন্টার লিঙ্ক রোডে আসতেই তাঁরা দেখতে পেলেন তিনজন আরোহী সমেত একটি মোটর সাইকেল আচমকা লিঙ্ক রোডস্থিত জঙগলময় রঘু ডাকাতের গুহার দিকে মোড় নিল ।
পাঠকের সন্দেহ হওয়ায় তিনি চালককে বললেন - ফলো দেম ।
মাইতি এবং মিত্র বিভূতিভূষণকে নিয়ে ঘরোয়া ভাবে আলোচনা করছিলেন পিছনের সিটে বসে । মিঃ পাঠক মানে বর্দমানের পুলিশ সুপার ড্রাইভারকে কখন নির্দেশ দিয়ে বসেছেন গুহার দিকে যেতে তাঁরা খেয়াল করেননি।
হঠাৎ গাড়ি মোলায়েম পথ ছেড়ে এবড়োখেবড়ো পথে উঠল কেন দেখাতেই বুঝে গেলেন কিছু একটা ঘটেছে।
মিঃ পাঠক বললেন - শ্রীধর বাবু ! এখন আমরা ওই গুহায় গিয়ে আশ্রয় নেব ।
মিঃ মিত্র অবাক হয়ে বললেন - স্যার বিয়ে বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন আছে । এখন গুহায় যাব কেন ?
- কারণ আছে । গেলেই দেখতে পাবেন । তবে কোমর থেকে পিস্তল বের করে সবাই হাতে ধরে রাখুন। নইলে পস্তাতে হবে ।
মিঃ মাইতি বললেন - স্যার সন্দেহজনক কিছু দেখলেন নাকি ?
মিঃ পাঠক বললেন - তিনজন মোটরবাইকে করে ওদিকে ঢুকে পড়ল । এই রাতে হঠাৎ তারা কেন ঢুকল দেখতে হবে তো !
মিঃ মিত্র বললেন - গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না । আসুন আমি পথ চিনি । এই উঁচু ঢিবিটায় উঠলেই গুহায় যাওয়া যাবে ।
মিঃ পাঠক কি ভেবে বললেন - চলুন । কুইক ।
মোটরবাইক আরেহীরা তখন গুহার পথ ধরে গুহা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। মিঃ পাঠক গুলি ছুঁড়লেন। দেখাদেখি বাকি দুজনের পিস্তলও গর্জে উঠল । ত্রিফলা ধাক্কায় আরোহীরা বাইকের টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল । মোটর বাইক কিছুটা গড়িয়ে গিয়ে একটা পাথরের বড় চাঁইয়ে বাধা পেয়ে থেমে গেল ।
ওঁরা তিন জন দৌড়ে ধরে ফেললেন সন্দেহভাজনদের ।
মাথায় পিস।তল ঠেকিয়ে গাড়িতে এনে তুললেন। গাড়ির রডের সঙ্গে বেঁধে তালা মেরে দিলেন । গাড়ি চলল বিয়ে বাড়ির দিকে ।
কামদাকিঙ্কর অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল । কাজটা করলেন বিভূতিভূষণ এবং শুভমিতা দেবী মিলে ।
বিয়ে বাড়িতে এসে ওঁরা শুনলেন কামদাকিঙ্করের উপর হামলার কথা । রাজদীপ এবং সম্পাতিই তা বলে দিল । সম্পাতির মা বাবার খোঁজ নিয়ে মিঃ পাঠক চললেন নার্সিং হোমের সন্ধানে ।
সঙ্গে গেলেন কামদাকিঙ্করের স্ত্রী ক্ষণপ্রভা দেবী, ছেলে ও ছেলের বউ, নাতি করালী এবং নববধু ইন্দু । দিব্যেন্দুও যেতে চেয়েছিল কিন্তু বিয়ে বাড়ি যাতে সুষ্ঠু ভাবে শেষ হয় তাই তাকে নেওয়া হল না ।
নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ পুলিশ সুপারের পরিচয় পেয়ে তটস্থ হয়ে উঠল ।
মিঃ পাঠক বললেন - হসপিটালে না নিয়ে গিয়ে ওঁকে নার্সিং হোমে কেন আনা হল এবং যারা এনেছেন অর্থাৎ বিভূতি ও শুভমিতাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন মিঃ মাইতি।
এস পি সাহেব বললেন - ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায় ।
( চলবে )