সন্দেশে সংহার
সন্দেশে সংহার
চরিত্রপরিচয়
অরিত্রি (অরি) – তরুণী সাংবাদিক, সত্য উদঘাটনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাজ – ফটো সাংবাদিক, অরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযাত্রী।
জাহাঙ্গীর খান – স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা, চোরাচালান, নারী নির্যাতন, জমি দখল সবকিছুর মূল হোতা।
মেহেরু খাতুন – গ্রাম্য বিধবা নারী, যিনি গোপনে অরিদের সাহায্য করতে চান।
তন্ময় দত্ত – সৎ কিন্তু চাপের মুখে চুপ থাকা স্থানীয় পুলিশ অফিসার।
রিয়াজ – জাহাঙ্গীরের ডানহাত, ভয়ঙ্কর চরিত্র।
কেন্দ্রীয় তদন্ত দলের এক অফিসার (অবিনাশ সেন) – পরে কাহিনিতে প্রবেশ করে।
থিম ও আবহ
রহস্য + রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র + মানবিক যন্ত্রণা
সীমান্ত অঞ্চলের বাস্তব সমস্যা, চোরাচালান, নারী নির্যাতনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গল্প।
অরির চোখ দিয়ে পাঠক ধীরে ধীরে আসল কাহিনি আবিষ্কার করবে।
সন্দেশে সংহার :
ট্রেন থেকে নামতেই এক অচেনা হাওয়া এসে লাগল অরিত্রির গায়ে।
স্টেশনটা ছোট, চারদিকে কুয়াশার আস্তর, আর ভ্যাপসা গন্ধে ভরা বাতাস। রাজ পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরাটা শক্ত করে ধরল। সে ফিসফিস করে বলল,
— "এই জায়গাটা একেবারে অন্যরকম। যেন বাইরে থেকে শান্ত, ভেতরে কোথাও চাপা টানাপোড়েন।"
অরি চুপ করে চারদিকে তাকাল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কয়েকজন মানুষের চোখ যেন তাদের ওপরেই নিবদ্ধ। চোখে ভেসে উঠছিল ভয়ের ছাপ—কিন্তু সেই ভয়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত নীরবতা। যেন কারও নাম উচ্চারণ করলেই বিপদ।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় রাজ অরিকে বলল,
— "লোকজন আমাদের দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেন?"
অরি হালকা হেসে উত্তর দিল,
— "কারণ আমরা বহিরাগত। আর এখানে বহিরাগত মানেই প্রশ্ন। মনে রেখো, আমরা সাংবাদিক। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ওরা টের পাবে।"
রিকশাওয়ালাদের কাছে গন্তব্য বলতেই ওরা একটু দ্বিধা করল। অবশেষে এক বয়স্ক রিকশাওয়ালা রাজি হল। রিকশায় বসে যেতে যেতে অরি দেখল চারপাশ—মাটির বাড়ি, কাঁচা রাস্তা, ছায়াঘেরা পুকুর, আর তার মাঝেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক অচেনা বিষণ্নতা।
রিকশাওয়ালা হঠাৎ নিজে থেকেই বলে উঠল—
— "আপনারা এখানকার লোক না তো? সাবধানে থাকবেন। রাতে বাইরে বেরোনো ভালো না।"
অরি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— "কেন? কী হয় রাতে?"
লোকটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, তারপর নিচু গলায় বলল—
— "রাতে এখানে বাঘ ঘোরে… বাঘ, তবে জঙ্গলের না, মানুষের চেহারায়।"
এই কথাটা শুনে রাজ চুপ করে গেল। অরি বুঝল, মানুষটা ভয় পেয়ে গেছে। আর প্রশ্ন না করে সে শুধু বলল—
— "ঠিক আছে কাকু, আমরা সাবধানে থাকব।"
সন্ধে নামতে না নামতেই গ্রামটা অন্যরকম হয়ে উঠল। দোকানপাট তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল, মানুষ গুটিয়ে নিল নিজেদের ঘরে। অরি আর রাজ একটা ভাড়া বাড়িতে উঠল, কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে তারা দেখল—দূরে কোথাও আলো-আঁধারির মাঝে গাড়ির লম্বা কনভয় ঢুকছে। গাড়িগুলো থেকে নামছে কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক।
রাজ ক্যামেরা হাতে তুলে নিল। অরি তার হাত চেপে ধরল—
— "না, এখন নয়। আগে পরিস্থিতি বুঝি।"
রাত গভীর হলে পাশের বাড়ির এক মধ্যবয়সী মহিলা অরিদের দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খোলার পর আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল—
— "দিদি, আপনারা বাইরের লোক। সাবধান থাকবেন। এখানে মেয়েদের রাতের পর ঘর থেকে বার হতে দেওয়া হয় না। জাহাঙ্গীর খানের লোকেরা… তারা যাকে খুশি তুলে নিয়ে যায়।"
অরি বিস্মিত হয়ে শুনল। মহিলার চোখে জল। সে আর বেশি কিছু বলতে পারল না, শুধু একবার দোতলায় লুকোনো ছোট মেয়েটার দিকে ইশারা করল, তারপর তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।
অরি আর রাজ একে অপরের দিকে তাকাল।
রাজ ফিসফিস করে বলল—
— "মনে হচ্ছে আমরা সত্যিই এক দানবের আস্তানায় ঢুকে পড়েছি।"
অরি উত্তর দিল—
— "হ্যাঁ রাজ, এখানেই আমাদের গল্পের শুরু। এই অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো বার করতে হবে।"
জানালার বাইরে তখন কেবল অন্ধকার, কুকুরের ডাক, আর দূরে ভেসে আসা ঢোল-তবলার শব্দ—যা রাতের নিস্তব্ধতায় আরও ভৌতিক শোনাচ্ছিল।
সন্দেশখালির অন্ধকারে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের সূচনা হল সেদিন।
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। গ্রামটা নিস্তব্ধ, কিন্তু দূরের বাঁশবনের ভেতর থেকে ভেসে আসছে আলোর ঝলক আর ঢোল-তবলার তাল। যেন অন্ধকারের মধ্যে কোথাও একটা উৎসব চলছে।
রাজ কৌতূহল সামলাতে না পেরে ক্যামেরা কাঁধে তুলে নিল।
— "চলো অরি, দেখি ব্যাপারটা।"
অরি একটু দ্বিধা করল। কিন্তু সাংবাদিকসুলভ তাগিদ তাকে চুপচাপ রাজের পেছনে হাঁটতে বাধ্য করল।
দু'জনেই গোপনে পৌঁছাল একটা আধাপাকা দোতলা বাড়ির সামনে। বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন অস্ত্রধারী গুন্ডা। গেটের ভেতর আলো ঝলমল করছে। ভেতরে ঢোলক, হারমোনিয়ামের সুর, আর মেয়েদের হাসি-কান্না মিশ্রিত চিৎকার।
অরি রাজকে থামিয়ে ফিসফিস করে বলল—
— "এই সেই নাচঘর, যেটার কথা গ্রামের মহিলারা বলছিলেন।"
রাজ ক্যামেরার লেন্স গেটের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দিল। ভেতরে যা দেখল, তাতে তার বুক কেঁপে উঠল।
কয়েকজন কিশোরী মেয়ে—বয়স চৌদ্দ থেকে আঠারো—চমকদার রঙিন পোশাক পরে নাচতে বাধ্য হচ্ছে। ঘরে বসে মদ খাচ্ছে জাহাঙ্গীর খানের লোকজন। তাদের হাসি-ঠাট্টা, সিগারেটের ধোঁয়া, আর মেয়েদের চোখের জল—সব মিলিয়ে দৃশ্যটা ছিল নরককেও হার মানানো।
হঠাৎ রাজের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ভুল করে জ্বলে উঠল।
এক সেকেন্ডেই গেটের বাইরে দাঁড়ানো একজন গুণ্ডা খেয়াল করে ফেলল।
— "কে ওখানে?" চিৎকার করে সে দৌড়ে এল।
রাজ দ্রুত অরিকে টেনে নিল পাশের বাঁশঝাড়ের আড়ালে।
দু'জনেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। গুণ্ডারা টর্চ নিয়ে চারপাশ খুঁজল, গালাগাল দিতে দিতে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।
অরি কাঁপা গলায় বলল—
— "আজ যদি ধরা পড়তাম, এখান থেকে জ্যান্ত ফিরতে পারতাম না।"
রাজ ক্যামেরাটা বুকে চেপে ধরে উত্তর দিল—
— "কিন্তু প্রমাণটা আমরা পেয়ে গেছি। দেখেছিস অরি, ওরা যেভাবে মেয়েদের জোর করে নাচাচ্ছিল? এই ফুটেজ যদি আমরা বাইরে নিতে পারি, তোলপাড় হবে।"
অরি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—
— "প্রমাণ যথেষ্ট নয়, রাজ। আমাদের জানতে হবে, এদের পেছনে আসল মাস্টারমাইন্ড কে। শুধু গুণ্ডাদের ছবি তোলায় হবে না। পুরো চক্রটাকে ভাঙতে হবে।"
বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আবার তাকাল তারা।
এইবার ঘরে প্রবেশ করল এক প্রভাবশালী চেহারার মানুষ—সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, চোখেমুখে ভয়ঙ্কর দম্ভ।
লোকগুলো উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম করল।
রাজ চুপচাপ ফিসফিস করে বলল—
— "ওই কি জাহাঙ্গীর খান?"
অরির চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
— "হ্যাঁ রাজ। আজ প্রথমবার শয়তানকে নিজের চোখে দেখলাম।"
ভেতরে জাহাঙ্গীর হাত নেড়ে ইশারা করল, আরেকটা কিশোরীকে টেনে আনা হল। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে নাচতে অস্বীকার করল। মুহূর্তের মধ্যে এক গুণ্ডা তাকে থাপ্পড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিল।
ঘরের ভেতরে শোরগোল উঠল, আর রাজের হাত কেঁপে উঠল ক্যামেরার শাটারে চাপতে গিয়ে।
কিন্তু হঠাৎ পাশ থেকে একটা শব্দ এল—বাঁশঝাড়ে কারও চলাফেরা।
রাজ আর অরি ভয়ে জমে গেল।
কেউ কি ওদের দেখেছে?
নাকি অন্য কেউ লুকিয়ে আছে ওখানেই?
রাতটা যেন আরও ঘন হয়ে উঠল, আর সন্দেশখালির অন্ধকার ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ধরতে লাগল।
পরদিন সকাল। রাতের ঘটনার পর অরি ও রাজ ঘুমোতে পারেনি। রাজের ক্যামেরার ভেতরে বন্দি সেই দৃশ্য দু'জনকেই অস্থির করে রেখেছিল।
অরি জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল—গরিব কৃষকেরা মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, কারও মুখে আশা নেই। যেন তারা নিজের জমির মালিক হয়েও দাসে পরিণত হয়েছে।
ঠিক তখনই দরজায় টোকা। ভেতরে এলেন তন্ময় দত্ত—স্থানীয় থানার অফিসার। বয়স তিরিশের কোটায়, চোখে চাপা ক্লান্তি।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন—
— "আপনারা সাংবাদিক? সাবধানে থাকবেন। এখানে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে সমস্যায় পড়বেন।"
অরি স্পষ্ট জিজ্ঞেস করল—
— "আমরা তো শুধু সত্যিটা জানতে চাই। গ্রামের মানুষ কেন এত ভীত? কেন জমি চাষিরা হারাচ্ছে?"
তন্ময় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন—
— "জমিই এখানে আসল অভিশাপ, দিদি। সন্দেশখালির জমি মাছচাষের জন্য স্বর্গ। কিন্তু সেই জমি, সেই ভেরিগুলো দখল করে নিয়েছে জাহাঙ্গীর খানের লোকেরা। কারও জমির কাগজ কেড়ে নেয়, কারও পরিবারকে ভয় দেখায়, আবার কাউকে সরাসরি গুম করে দেয়। পুলিশ কিছু করতে পারে না… কারণ ওপরে থেকে অর্ডার আসে—'চুপ থাকো।'"
রাজ হতবাক হয়ে গেল।
— "মানে? ওপরে থেকে কারা?"
তন্ময় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। সরাসরি উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন—
— "আপনারা সাংবাদিক। তদন্ত করতে এলে হয়তো কিছু খুঁজে পাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন—এখানে সত্যি জানা মানেই শত্রু তৈরি করা।"
অরি দৃঢ় গলায় বলল—
— "সত্যি চাপা দেওয়া যায় না। আমি চেষ্টা করব।"
ঠিক তখনই উঠোনে প্রবেশ করল মেহেরু খাতুন—গ্রামের বিধবা মহিলা। তার চোখে ভয়, মুখে অসহায়তা। সে ফিসফিস করে অরিকে বলল—
— "আমার বোনের জমি দখল করেছে ওরা। বোনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল একরাতে। আজ অবধি সে ফেরেনি। আপনারা যদি সত্যি লিখতে পারেন, তাহলে আমাদের মুক্তি মিলতে পারে।"
মেহেরুর হাতে একটা ছেঁড়া ডায়েরির পাতা। পাতাটিতে অদ্ভুত কিছু হিসেব লেখা—কোথায় কত টাকা, কত মাছ, আর কোন জমির নাম। অরি সেটা দেখে চোখ বড় করল।
— "রাজ, এটা হয়তো ওদের ভেরি কারবারের হিসেব।"
রাজ ক্যামেরা বের করে পাতাটার ছবি তুলল।
হঠাৎ বাইরে শোরগোল। দু'জন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চোখ সরাসরি অরিদের দিকে।
তন্ময় নিচু গলায় বললেন—
— "ওরা জাহাঙ্গীরের লোক। সাবধানে থাকবেন। আমার পক্ষে যতটা পারা যায়, সাহায্য করব। কিন্তু সবকিছু করতে পারব না।"
অরি বুঝল—এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারিতে থাকবে।
জমি, মাছের ভেরি আর পাচারের টাকার পেছনে যে অভিশপ্ত চক্র, সেটাই ভাঙতে হবে। কিন্তু সেটা সহজ হবে না।
বাইরে তখন দুপুরের রোদ, কিন্তু অরির মনে হচ্ছিল—চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা।
সন্ধে নেমেছে। ঘরের ভেতরে অরি রাজের সাথে মেহেরুর দেওয়া কাগজটা খুঁটিয়ে দেখছিল। পাতার অক্ষরগুলো এলোমেলো হলেও রাজ টের পেল—এটা আসলে গোপন হিসেব। কোথায় কত ভেরি দখল, কত মাছ বিক্রি, আর পাচার হয়ে কত টাকা উঠছে—সব কিছু সংখ্যার মাধ্যমে লেখা আছে।
অরি বলল—
— "এটাই আমাদের হাতে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এখন যদি আমরা এগুলো ভিডিও ফুটেজের সাথে মেলাতে পারি, তাহলে জাহাঙ্গীর খানের চক্র ভেঙে দিতে পারব।"
রাজ ক্যামেরাটা খুলে ফুটেজ চালু করল। কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
— "অরি… ফুটেজগুলো নেই!"
অরি বিস্ময়ে চমকে উঠল।
— "কি? কই গেল ফুটেজ? কাল রাতে তো এগুলো রেকর্ড করেছিলি।"
রাজ কাঁপা গলায় বলল—
— "সব মুছে গেছে। কেউ ক্যামেরার মেমরি কার্ড খুলে নিয়েছে।"
অরি তৎক্ষণাৎ দরজার দিকে তাকাল। ঘরের তালা অক্ষত, কিন্তু বুঝতে কষ্ট হল না—তাদের ঘরে অনুপ্রবেশ হয়েছে।
অরি দাঁত চেপে বলল—
— "মানে ওরা জানে আমরা সব দেখেছি। ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে।"
ঠিক তখন বাইরে থেকে শোনা গেল সাইকেলের ঘণ্টা। পাড়ার এক কিশোর হাপাতে হাপাতে এসে খবর দিল—
— "দিদি, আপনারা সাবধান! দুপুরে যে কাগজটা আপনাদের দিল, সেটা নিয়ে ওরা খোঁজ করছে। জাহাঙ্গীরের লোকেরা বলছে, যার কাছে কাগজটা আছে, তাকে আজ রাতেই শায়েস্তা করা হবে।"
অরির বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল।
রাজ ফিসফিস করে বলল—
— "অরি, আমাদের ভেতর থেকেই কেউ খবর ফাঁস করছে। না হলে এত তাড়াতাড়ি ওরা জানল কীভাবে?"
অরি চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল। তার মাথায় স্পষ্ট একটা ছবি ভেসে উঠল—
তাদের চারপাশে একটা অদৃশ্য ফাঁদ পাতা হয়েছে।
কেউ ছায়ার মতো প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে।
তখনই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, বাইরে কয়েকটা মোটরবাইক দাঁড়িয়েছে। হেডলাইটের আলো সরাসরি ঘরের দিকে।
রাজ আতঙ্কিত গলায় বলল—
— "ওরা চলে এসেছে।"
অরি টেবিলের ড্রয়ার থেকে কাগজটা বার করে মুঠোয় চেপে ধরল।
— "না রাজ, এই প্রমাণ ওদের হাতে যেতে দেওয়া যাবে না। আমাদের লুকাতে হবে।"
মোটরবাইকের শব্দ ক্রমশ ঘনিয়ে এল। গেটের বাইরে গুণ্ডাদের চিৎকার ভেসে এল।
— "বের হয়ে আয়! নইলে ঘর ভেঙে ঢুকে যাব।"
অরি আর রাজ বুঝল—এখন তারা এক ভয়ঙ্কর রহস্যের জালে আটকা পড়েছে।
আজকের রাত বাঁচলেই তারা সামনে এগোতে পারবে।
কিন্তু সেই বাঁচা কি এত সহজ হবে?
বাইরে তখন গুণ্ডাদের হাঁকডাক। অরি রাজকে চোখে ইশারা করল—পিছনের দরজা দিয়ে বেরোতে হবে।
অন্ধকার গলিপথ ধরে দৌড়ে তারা পৌঁছাল বাঁশবনের ভেতরে। বুক ধড়ফড় করছে, গায়ে ঘাম, তবু থামবার সুযোগ নেই।
হঠাৎ অন্ধকার থেকে এক হাত টেনে নিল অরিকে। রাজ ঝটকা মারতে যাচ্ছিল, কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনেই থমকে গেল।
— "আমি… মেহেরু খাতুন। ভয় নেই।"
মেহেরুর চোখে তখন ভয় আর অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে দ্রুত তাদের একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে নিয়ে গেল। ঘরের ভেতরে মাটির প্রদীপ জ্বলছে, আর কোণে বসে আছে তার ছোট্ট ছেলে।
অরি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
— "ওরা আমাদের মেরে ফেলবে, যদি প্রমাণটা পায়।"
মেহেরু গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলল—
— "শুনুন দিদি, আমি এতদিন চুপ ছিলাম। কিন্তু আর পারছি না। আমার বোন… তাকে একরাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। আমি জানি, সে আর বেঁচে নেই। আমার জমি, মাছের ভেরি সব ওরা কেড়ে নিয়েছে। আমি ভিক্ষে করি, ছেলে না খেয়ে থাকে—কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারি না।"
তার গলা ভেঙে এল। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে আলমারির ভেতর থেকে বের করল এক পুরোনো খাতা।
— "এটা আমার বোনের স্বামী হিসেব রাখত। জমির কাগজ, ভেরির হিসেব, আর পাচারের টাকার খুঁটিনাটি সব আছে। আমি জানতাম, একদিন না একদিন কেউ না কেউ আসবে—যারা সত্যি খুঁজবে। আজ আপনাদের হাতে দিচ্ছি।"
অরি খাতা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। পাতাগুলোতে নাম, জমির পরিমাণ, এমনকি কয়েকটা চেনা রাজনৈতিক নেতার নামও লেখা।
রাজ বিস্মিত হয়ে বলল—
— "মানে জাহাঙ্গীর একা নয়… তার পেছনে আরও বড় চক্র আছে।"
মেহেরু নিচু গলায় যোগ করল—
— "হ্যাঁ। এখানকার পুলিশ, উপরের নেতা—সবাই ওর সঙ্গে যোগসাজশে আছে। তাই তো কেউ মুখ খোলে না।"
হঠাৎ বাইরে শব্দ উঠল। কারও পায়ের আওয়াজ কাছে আসছে।
মেহেরু তড়িঘড়ি করে প্রদীপ নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে ফিসফিস করে বলল—
— "ওরা চলে এসেছে। দয়া করে কিছুতেই এখন বেরোবেন না। এই প্রমাণগুলোই একদিন আমাদের মুক্তি দেবে।"
অন্ধকার ঘরে অরি খাতাটা বুকে জড়িয়ে ধরল।
সে বুঝল, আজ সে শুধু সাংবাদিক নয়—আজ সে এই নির্যাতিত মানুষগুলোর শেষ ভরসা।
কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল টর্চের আলো ঘনিয়ে আসছে।
রাজ চাপা গলায় বলল—
— "অরি, ওরা ঠিক আমাদের খুঁজে বের করবে।"
আর তখনই দূর থেকে ভেসে এল জাহাঙ্গীরের ডানহাত রিয়াজের কণ্ঠস্বর—
— "যে কাগজটা নিয়েছে, সে যদি আজ রাতেই না পাওয়া যায়, কাল সকালে গ্রাম জ্বলে যাবে।"
অরি বুঝল—এখন আর শুধু ওরা নয়, পুরো গ্রাম বিপদের মুখে।
রাত তখন গভীর। মেহেরুর ঘরে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। শুধু বাইরে থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর মোটরবাইকের শব্দ ভেসে আসছে।
রাজ জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—
— "অরি, ওরা খুঁজতে খুঁজতে খুব কাছে চলে এসেছে।"
অরি দৃঢ় গলায় উত্তর দিল—
— "আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে। মেহেরু আর তার ছেলেকে বিপদে ফেলা যাবে না।"
মেহেরু কেঁদে উঠল—
— "না দিদি, আপনারা যদি ধরা পড়েন, আমাদের গ্রাম জ্বলে যাবে। আপনারাই একমাত্র আশা।"
অরি তার হাত শক্ত করে ধরে বলল—
— "আমরা ফিরব, প্রতিশোধ নিয়ে ফিরব। কিন্তু আজ রাতটা বাঁচতে হবে।"
তারা পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে এগোল। কুয়াশার চাদরের মধ্যে যেন মৃত্যুই লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ পিছনে মোটরবাইকের হেডলাইট জ্বলে উঠল।
রিয়াজের দল তাদের দেখে ফেলেছে।
— "ওরা ওখানে!"
বাইকের শব্দ গর্জে উঠল। রাজ অরিকে টেনে নিয়ে দৌড় শুরু করল। মাটির পথ, কাদা, বাঁশঝাড়—সবকিছুর মধ্যে পড়ে গিয়ে বারবার উঠতে হচ্ছিল।
হঠাৎ গুলির শব্দ!
একটা গুলি রাজের কাঁধ擦ে গেল। সে যন্ত্রণায় হোঁচট খেল, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে অরিকে এগোতে বলল।
অরি আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করল—
— "রাজ! রক্ত পড়ছে!"
রাজ দাঁত চেপে বলল—
— "আমাদের থামা চলবে না… এখনই নয়।"
অবশেষে তারা এক পুরোনো পরিত্যক্ত ঘাটের কাছে এসে আশ্রয় নিল। নদীর জল অন্ধকারে গুমগুম করছে। দূর থেকে বাইকের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
অরি রাজের ক্ষতটা কাপড় ছিঁড়ে বাঁধতে বাঁধতে ফিসফিস করে বলল—
— "এভাবে চলতে থাকলে আমরা মরব।"
রাজ দুর্বল গলায় হেসে বলল—
— "কিন্তু মরার আগে যদি জাহাঙ্গীরের মুখোশটা খুলে দিতে পারি, তবেই বেঁচে থাকা সার্থক।"
অরি তার দিকে তাকাল। রাজের চোখে যন্ত্রণা, তবু সেখানে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
ঠিক তখনই নদীর ওপাশ থেকে একটা নৌকা ভেসে এল। নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তির কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
— "অরিত্রি দিদি? আমি তন্ময় দত্ত। তাড়াতাড়ি ওঠেন। আপনাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়।"
অরি এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। তন্ময়ের উপর ভরসা করা যায় তো?
কিন্তু সময় নেই। গুলির শব্দ আবার ভেসে আসতে লাগল।
অরি রাজকে ধরে নৌকায় তুলল। নৌকা ধীরে ধীরে অন্ধকার জলের ভেতর এগোতে লাগল।
কিন্তু অরির মনে হচ্ছিল—এই পালানো আসলে আরও বড় এক ফাঁদের দিকে এগোনো।
সন্দেশখালির রাত এখন শুধু তাদের নয়—মৃত্যুর ছায়ায় ঢেকে দিচ্ছে পুরো জনপদকে।
নৌকাটা রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চলেছিল। দু'পাশে শুধু কুয়াশা আর জলের ঢেউ। রাজ কাঁধের যন্ত্রণা সামলাতে সামলাতে বসে আছে, অরি তার পাশে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বৈঠা চালাচ্ছে তন্ময় দত্ত।
অরি ফিসফিস করে বলল—
— "আপনি হঠাৎ এসে আমাদের বাঁচালেন কেন? পুলিশের তো আমাদের খুঁজে বের করে জাহাঙ্গীরের হাতে তুলে দেওয়ার কথা।"
তন্ময়ের মুখটা ছায়ার আড়ালে, তবু গলার কাঁপনে বোঝা গেল তার ভিতরের দ্বন্দ্ব।
— "আমি সব জানি দিদি। জানি, জাহাঙ্গীর শুধু নারী নির্যাতন আর জমি দখলেই সীমাবদ্ধ নয়। ওর আসল কারবার ড্রাগস আর অস্ত্র চোরাচালান। সীমান্ত পেরিয়ে টনকে টন মাল আসে। কিন্তু কিছু বলার ক্ষমতা নেই আমার। আমি একা লড়তে পারব না।"
রাজ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল—
— "কোথায় লুকিয়ে রাখে ওসব?"
তন্ময় চারদিকে তাকিয়ে ধীরে বলল—
— "আমি আপনাদের দেখাব। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিতে হবে—এই প্রমাণ দেশ পর্যন্ত পৌঁছোতে হবে।"
নৌকা ভিড়ল একটা নির্জন ঘাটে। সেখান থেকে ঝোপঝাড় পেরিয়ে তারা ঢুকল বাঁশবনের গভীরে। হঠাৎ তন্ময় একটা পাথরের ঢিপি সরিয়ে দিল। মাটির তলায় খোলা হল এক গোপন পথ।
অরি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। নিচে নামার সিঁড়ি, অন্ধকার সুড়ঙ্গ।
তন্ময় ফিসফিস করে বলল—
— "এটাই জাহাঙ্গীরের গোপন টানেল। নদীপথে মাল আসে, আর এই টানেল দিয়ে সোজা গ্রামে ঢুকে পড়ে। বাইরে কেউ কল্পনাও করতে পারে না।"
তারা নামতে নামতে দেখল, টানেলের দেওয়ালে আর্দ্রতা, বাতাসে কড়া গন্ধ।
মাঝপথে এসে দেখা গেল কাঠের বড় বড় বাক্স স্তূপ করে রাখা। তন্ময় একটা বাক্স খোলামাত্র রাজের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল—
ভেতরে সাদা পাউডারে ভর্তি ছোট ছোট প্যাকেট।
অরি ফিসফিস করে বলল—
— "হেরোইন…?"
তন্ময় মাথা নেড়ে বলল—
— "আরও আছে। দেখুন।"
আরেকটা বাক্সে ঝকঝকে পিস্তল, কার্তুজ।
রাজ তাড়াতাড়ি ক্যামেরায় সব ছবি তুলতে লাগল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু শাটার থামল না।
ঠিক তখনই টানেলের ভেতর ভেসে এল মানুষের পায়ের শব্দ।
অরি আতঙ্কে ফিসফিস করল—
— "কেউ আসছে!"
তন্ময়ের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল।
— "ওরা জানে না যে আমি আপনাদের এনেছি। এখন ধরা পড়লে তিনজনকেই বাঁচতে দেবে না।"
টানেলের অন্ধকারে লণ্ঠনের আলো ধীরে ধীরে কাছে আসছিল। গলার স্বর শোনা গেল—
— "সব বাক্স গুনে নাও। কাল ভোরেই পার হতে হবে।"
অরি আর রাজ বুঝল, তারা এখন একেবারে সিংহের গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
এক পা ভুল হলেই মৃত্যু নিশ্চিত।
টানেলের অন্ধকারে তিনজন নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। কাছে আসছে টর্চের আলো, গুণ্ডাদের কথোপকথন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
— "কাল ভোরেই মাল যাবে।"
— "জাহাঙ্গীর সাহেব বলেছেন, এবার পার্টি অনেক বড়। দেরি করলে বিপদ।"
অরি রাজকে চোখে ইশারা করল। রাজ আস্তে ক্যামেরা নামিয়ে বুকে চেপে ধরল।
তন্ময় নিচু স্বরে বলল—
— "আমার সঙ্গে আসুন, একটা পাশের গলি আছে।"
তারা কষ্ট করে বাক্সের আড়াল ঘুরে গেল। সরু পথ বেয়ে উঠে এলো টানেলের আরেক প্রান্তে। অবশেষে একটা লোহার দরজা ঠেলে বাইরে বেরোতেই দেখা গেল—খোলা মাঠ, দূরে নদীর ধারে চাঁদের আলো।
অরি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
— "এগুলো যদি বাইরের জগৎ দেখতে পায়, তোলপাড় হয়ে যাবে।"
রাজ যোগ করল—
— "এবার শুধু প্রমাণ লুকিয়ে রাখা নয়, নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া জরুরি।"
তন্ময়ের চোখ তখন অদ্ভুত বিষণ্ণ। সে চুপচাপ বসে পড়ল মাটিতে।
অরি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—
— "কি হলো?"
তন্ময় ফিসফিস করে বলল—
— "আমি জানি আমার দায়িত্ব কী। কিন্তু আমি এক পুলিশ অফিসার, অথচ আমি অসহায়। বহুবার চাইতে গিয়েও কোনো এফআইআর লিখতে পারিনি। ওপরে থেকে অর্ডার আসে—'জাহাঙ্গীরকে ছোঁওয়া যাবে না।' যদি আদেশ অমান্য করি, আমাকেই ট্রান্সফার বা সাসপেন্ড করা হবে।"
রাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল—
— "তাহলে আপনি আমাদের এখানে এনে কী লাভ করবেন? যদি কিছু করতে না পারেন?"
তন্ময় মাথা নিচু করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল—
— "সব কিছু করতে না পারলেও, সামান্যটুকু পারি। আপনারা যদি দেশের বাইরের মিডিয়ায় বা কেন্দ্রীয় দপ্তরে পৌঁছে দিতে পারেন, তখন হয়তো ওদের হাত ছোট হবে। আমি আপনাদের সাহায্য করব। লোকচক্ষুর আড়ালে রাখব। কিন্তু খোলাখুলি কিছু করতে পারব না।"
অরি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল—
— "কখনও কখনও সামান্য সাহায্যই অনেক বড় যুদ্ধের পথ খুলে দেয়।"
হঠাৎ দূরে সাইরেনের শব্দ ভেসে এল। থানার গাড়ি।
তন্ময় উঠে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল—
— "এরা আমার লোক নয়! এরা জাহাঙ্গীরের টাকায় কেনা পুলিশ। পালান!"
রাজ আহত কাঁধ সামলাতে সামলাতে অরিকে টেনে দৌড় শুরু করল। মাঠ পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের ভেতর ঢুকল।
অরি বুক ধড়ফড় করতে করতে পিছনে তাকাল—লোহার দপদপে আলো, পুলিশের হাতিয়ার উঁচিয়ে ধাওয়া।
অরি বুঝল, এখন আর পুলিশের উপরও পুরো ভরসা করা যাবে না।
তন্ময় সত্যিই সাহায্য করবে, নাকি সেও কোনো একদিন বিক্রি হয়ে যাবে—সেটা সময়ই বলবে।
কিন্তু একটাই স্পষ্ট—
যুদ্ধটা এখন শুধু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নয়, পুরো সিস্টেমের সঙ্গে।
আকাশে তখন চাঁদ ঢেকেছে মেঘে। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
অরি আর রাজ এক ভাঙা আড়তে আশ্রয় নিয়েছিল। চারপাশে পুরোনো জাল, ভাঙা খুঁটি আর মাছের গন্ধে ভরা বাতাস।
রাজের কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল। অরি নিজের ওড়না ছিঁড়ে ক্ষত বেঁধে দিল।
রাজ কষ্টে হেসে বলল—
— "এই ওড়না অনেক দামি না তো?"
অরি ভ্রূ কুঁচকে বলল—
— "প্রাণের দামে কিছুই দামি নয়।"
ওরা যখন একটু শান্ত হতে চাইছিল, ঠিক তখনই বাইরে থেকে শোনা গেল মোটরবাইকের গর্জন।
একসাথে চার-পাঁচটা বাইক।
তারপর দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক।
সবচেয়ে সামনে রিয়াজ। তার চোখে হিংস্র ঝিলিক।
— "পালাবার অনেক চেষ্টা করলে, তাই না? কিন্তু শেষমেশ আমার কাছেই এলি।"
অরি সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বলল—
— "রিয়াজ, তোমাদের অপরাধ সবার সামনে আসবেই। তোমরা যাই করো, সত্যিটা চাপা দেওয়া যাবে না।"
রিয়াজ হেসে উঠল।
— "সত্যি? সাংবাদিকের কলম দিয়ে কি গুলি থামানো যায়?"
সে বন্দুক তুলতেই রাজ ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা ধস্তাধস্তি শুরু হল। বন্দুকের গুলিতে আড়তের টিন ছিঁড়ে ধোঁয়া আর গন্ধে ভরে গেল চারপাশ।
রাজের কাঁধের ক্ষত নতুন করে ছিঁড়ে গেল, রক্ত ঝরতে লাগল।
অরি একটা ভাঙা লাঠি হাতে তুলে রিয়াজকে আঘাত করল। রিয়াজ টলল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার লোকেরা অরিকে চেপে ধরল।
হঠাৎ বাইরে সাইরেনের শব্দ ভেসে এল। পুলিশের গাড়ি।
রিয়াজ দাঁত চেপে বলল—
— "চল, এবার ওদের নিয়ে যাই। কাল সকালে সবার সামনে বোঝা যাবে—সাংবাদিকদের কেমন পরিণতি হয়।"
লোকগুলো রাজকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল। অরি প্রাণপণে চিৎকার করল—
— "রাজ! কিছু হয়ে গেলে আমি একা লড়ব না, তোর রক্তে আমার লড়াই চলবে।"
অরি মাটিতে পড়ে গেলেও চোখে তার অদম্য আগুন।
রক্তাক্ত রাতের অন্ধকারে, চারদিকের কুকুরের ডাক আর পুলিশের ভাঁওতা সাইরেনের মধ্যে, মনে হচ্ছিল—আজ কেউই বাঁচবে না।
কিন্তু ঠিক তখনই অন্ধকার আড়াল থেকে ভেসে এল এক কণ্ঠস্বর—
— "থামো! ওদের ছাড়ো।"
অরি অবাক হয়ে দেখল—
তন্ময় দত্ত দাঁড়িয়ে আছে হাতে রাইফেল নিয়ে।
কিন্তু সে কি সত্যিই উদ্ধার করতে এসেছে?
নাকি এই রাতের রক্তাক্ত খেলা আরও বড় বিশ্বাসঘাতকতার দিকে এগোচ্ছে?
তন্ময় দত্ত রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার গলার স্বর কাঁপছে, কিন্তু চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
— "ওদের হাত ছাড়ো। এখনই।"
রিয়াজ হেসে উঠল।
— "কি রে দত্তবাবু, এতদিন জাহাঙ্গীর সাহেবের ভাত খেয়ে হঠাৎ নীতির কথা মনে পড়ল?"
তন্ময় গর্জে উঠল—
— "চুপ কর! আমি বহুদিন চুপ থেকেছি, কিন্তু আজকের পর আর নয়।"
রিয়াজ ইশারা করতেই তার লোকেরা তন্ময়ের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে গুলি ছুটল, লাঠি উড়ল।
অরি সুযোগ বুঝে রাজকে টেনে একটা ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে নিয়ে গেল।
রাজ কাঁপা গলায় বলল—
— "অরি, প্রমাণগুলো… ক্যামেরাটা… যেভাবেই হোক নিরাপদে রাখতে হবে।"
অরি তার হাত শক্ত করে ধরে বলল—
— "তুই বাঁচবি রাজ। আমরা একসাথে সব প্রমাণ পৌঁছে দেব।"
এদিকে তন্ময় একাই লড়ছে। দু'জন গুন্ডাকে ফেলে দিলেও বাকিদের আক্রমণে সে দমে আসছে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে আরেকটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল।
গাড়ি থেকে নামল কয়েকজন কালো পোশাকের লোক।
তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র। গলার ট্যাগে লেখা—NIA (National Investigation Agency)।
অরি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল—
— "কেন্দ্রীয় বাহিনী!"
এক মুহূর্তেই পরিস্থিতি বদলে গেল। রিয়াজ আর তার দল পালাতে চাইলো, কিন্তু NIA লোকেরা চারদিক ঘিরে ফেলল।
তন্ময় হাঁপাতে হাঁপাতে বন্দুক নামিয়ে দিল।
এক অফিসার এগিয়ে এসে বলল—
— "আমরা কয়েকদিন ধরে জাহাঙ্গীরের ওপর নজরদারি চালাচ্ছিলাম। আপনারা যেসব ছবি আর ভিডিও তুলেছেন, সেগুলোই আমাদের হাতে পৌঁছেছে বাইরের সূত্রে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই আজকের অভিযান।"
অরি হতবাক।
— "মানে… আমাদের সব প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি?"
অফিসার গম্ভীর গলায় বলল—
— "না। কিন্তু যুদ্ধটা এখানেই শেষ নয়। জাহাঙ্গীর শুধু এক জেলা নয়, পুরো সীমান্তে ছড়িয়ে আছে। তার পেছনে আরও বড় চক্র কাজ করছে—আন্তর্জাতিক ড্রাগস সিন্ডিকেট।"
রাজ দুর্বল গলায় ফিসফিস করে বলল—
— "তাহলে… আমাদের লড়াই আসলে শুরু হয়েছে এখন।"
অরি তার মাথায় হাত রেখে বলল—
— "হ্যাঁ রাজ, সন্দেশখালির রক্তাক্ত রাত হয়তো প্রথম অধ্যায় মাত্র।"
আকাশে তখন ভোরের প্রথম আলো ফুটছে। কুয়াশার চাদর সরতে সরতে মনে হচ্ছিল—একটা অন্ধকার অধ্যায় শেষ হলেও সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়ঙ্কর রহস্য, আরও বড় যুদ্ধ।
সন্দেশখালির ভোর আজ অস্বাভাবিক নীরব।
কিন্তু সেই নীরবতার আড়ালে জমে উঠছে এক ভয়ঙ্কর ঝড়।
NIA-র হানা, রিয়াজের ধরা পড়া—সব খবর রাতারাতি পৌঁছে গেছে জাহাঙ্গীর খানের কানে।
তার বিলাসবহুল দালানের অন্ধকার ঘরে, মদের গ্লাস হাতে বসে আছে জাহাঙ্গীর। পাশে বিদেশি বন্দুক, টেবিলে ছড়ানো টাকার বান্ডিল।
সে গম্ভীর গলায় বলল—
— "আমি ভেবেছিলাম পুলিশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সব সামলে নিতে পারব। কিন্তু এরা তো সোজা কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে এনেছে।"
এক সহযোগী ভয়ে ফিসফিস করল—
— "সাহেব, রিয়াজের কাছ থেকে সব ফাঁস হয়ে যাবে। এখন কি করবেন?"
জাহাঙ্গীর গ্লাসটা ভেঙে টেবিলে ছুড়ে মারল।
— "রিয়াজ কিছু বলার আগেই তার মুখ চুপ করিয়ে দিতে হবে।"
সে উঠে জানলার দিকে গেল। বাইরে তার ফার্মহাউজে কয়েকশো ভাড়াটে গুন্ডা অনুশীলন করছে।
— "ওরা ভাবে আমাকে এত সহজে শেষ করা যাবে? ভুল করছে। সন্দেশখালির জমি, ভেরি, নারী—সবকিছু আমার দখলেই থাকবে। এবার পাল্টা চাল শুরু হবে।"
তারপর সে মোবাইল তুলে এক অচেনা নম্বরে ফোন করল।
অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর ইংরেজি কণ্ঠ ভেসে এল।
— "Mr. Khan, we warned you. If your network breaks, our entire route collapses."
জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে হাসল।
— "চিন্তা করবেন না। আমার হাতে এখনও তুরুপের তাস আছে। আমি জানি ওসব সাংবাদিকরা কোথায় আছে।"
ফোন কেটে দিয়ে সে তার লোকদের ডেকে বলল—
— "আজ রাতেই ওদের শেষ করতে হবে। অরিত্রি আর তার সঙ্গী রাজ—এরা বেঁচে থাকলে আমার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।"
এদিকে, অরি আর রাজকে আপাতত NIA সুরক্ষা দিয়েছে। কিন্তু অরি জানে—
জাহাঙ্গীর চুপ করে বসে থাকবে না।
সে যেন ঝড়ের আগের শান্তি অনুভব করছে।
রাজ দুর্বল শরীরে বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে জেদ—
— "অরি, আমি হয়তো শারীরিকভাবে লড়তে পারব না। কিন্তু প্রমাণগুলো আমি সাজিয়ে দেব, দেশের সামনে সত্য তুলে ধরব।"
অরি তার হাত শক্ত করে ধরে বলল—
— "আমাদের জন্য রাত আরও অন্ধকার হবে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। এবার জাহাঙ্গীর বুঝবে, ভয়ের থেকেও শক্তিশালী এক জিনিস আছে—সত্য।"
ঠিক তখনই NIA-র এক অফিসার ঢুকে এসে বলল—
— "আমরা খবর পেয়েছি, জাহাঙ্গীর পাল্টা চালের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আপনাদের যেকোনো মুহূর্তে টার্গেট করা হতে পারে।"
অরি জানালার বাইরে তাকাল।
দূরে সূর্য লাল হয়ে উঠছে।
তার বুকের ভেতর শুধু একটাই প্রতিজ্ঞা—
সন্দেশখালির সংহার অসম্পূর্ণ থাকবে না।
NIA-র গোপন শিবিরে অরি আর রাজ আপাতত সুরক্ষিত।
তবুও অরির মনে হচ্ছিল, বাইরের বাতাসে অদ্ভুত এক আতঙ্ক ভাসছে।
রাজ ল্যাপটপে বসে ভিডিও এভিডেন্সগুলো সাজাচ্ছিল। জাহাঙ্গীরের খুন, নারীদের ওপর নির্যাতন, জমি দখল—সব ফুটেজ একত্রিত করে রিপোর্ট বানাচ্ছিল।
রাজ বলল—
— "অরি, যদি আজ রাতে সব সার্ভারে পাঠানো যায়, কালই খবরের চ্যানেলগুলোতে ছড়িয়ে যাবে।"
অরি মাথা নেড়ে উত্তর দিল—
— "তাহলে আর কেউ আমাদের চুপ করাতে পারবে না।"
কিন্তু ঠিক তখনই বাইরে অদ্ভুত একটা আওয়াজ শোনা গেল—
যেন শুকনো পাতার মচমচে শব্দ, তারপর নিস্তব্ধতা।
NIA পাহারাদার টর্চ নিয়ে বেরোতেই সশব্দে কিছু পড়ল মাটিতে।
তাদের চোখ বড় হয়ে গেল—
সাইলেন্সার লাগানো বুলেট।
এক পাহারাদার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
অরি আতঙ্কে রাজকে টেনে আড়ালে নিল।
— "গুপ্তঘাতক!"
অন্ধকারে গাছের ফাঁক থেকে লাল লেজার ডট দেখা গেল—সরাসরি রাজের কপালের ওপর নিশানা।
অরি বুক দিয়ে রাজকে ঢেকে ফেলল।
NIA-র অফিসার চেঁচিয়ে উঠল—
— "Sniper! Everyone take cover!"
গোলাগুলি শুরু হল। অদৃশ্য ঘাতক একে একে পাহারাদারদের নামাচ্ছে।
অরি শ্বাস রোধ করে বুঝতে পারছিল—
এটা জাহাঙ্গীরের পাঠানো হত্যাকারী।
রাজ ফিসফিস করে বলল—
— "অরি, যদি আমি… বেঁচে না থাকি…"
অরি তার ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে দিল।
— "একটা কথাও নয়। তুই মরবি না। আমরা মরলে জাহাঙ্গীর জিতবে। আর সেটা আমি হতে দেব না।"
ঠিক তখনই তন্ময় দত্ত ঝাঁপিয়ে এসে রাজকে আড়াল করে নিল। তার হাতে রাইফেল।
সে গর্জে উঠল—
— "এবার আমি পুলিশ নই, দেশের সৈনিক!"
সোজা নিশানা করে সে একটা বুলেট ছুড়ল।
মুহূর্তের মধ্যে দূরের একটা গাছ থেকে কিছুর শব্দ হল।
একজন মুখোশধারী ঘাতক পড়ে গেল মাটিতে।
NIA দৌড়ে গিয়ে মুখোশ খুলে দেখল—
লোকটা বাইরের, ভাড়াটে খুনি। পকেট থেকে পাওয়া গেল একটা স্যাটেলাইট ফোন, আর তাতে মাত্র তিনটে শব্দ লেখা—
"Finish Ori-Raj."
অরি কেঁপে উঠল।
সে জানল—এটা কেবল শুরু।
জাহাঙ্গীর তার দিকে সরাসরি তীর ছুঁড়েছে।
রাতের অন্ধকার আবার নেমে এল শিবিরে।
আর অরি শপথ করল—
"যেভাবেই হোক, এবার জাহাঙ্গীরের পালা।"
NIA সাময়িকভাবে অরি ও রাজকে
সেখানকার একটি পুরনো সুরক্ষিত দালানে তাদের রাখা হল।
কিন্তু অরির মন খারাপ—সে জানে জাহাঙ্গীর সন্দেশখালি ছাড়েনি, বরং এখন আগের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর।
রাজ ক্লান্ত চোখে অরিকে বলল—
— "অরি, আমি যতটা পারি ডেটাগুলো এনক্রিপ্ট করে রাখলাম। যদি কিছু হয়ে যায়, অন্তত প্রমাণ নষ্ট হবে না।"
অরি হাত ধরে বলল—
— "আমাদের কিছুই হবে না রাজ। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি—এখানে কেউ বিশ্বাসঘাতক আছে। না হলে গুপ্তঘাতকরা এত সহজে আমাদের খুঁজে পেত কী করে?"
ঠিক তখনই NIA অফিসারদের ভেতরে প্রবল তর্ক শুরু হল।
কেউ বলছে জাহাঙ্গীরকে আটকাতে সরাসরি আর্মি লাগাতে হবে, কেউ বলছে চুপচাপ রাজনৈতিক চাপ সামলাতে হবে।
তন্ময় দত্ত পাশে দাঁড়িয়ে অরিকে ফিসফিস করে বলল—
— "তুমি ঠিকই বলেছ। ভেতরে কেউ আছে, যে খবর ফাঁস করছে।"
অরি গম্ভীর মুখে জানালার বাইরে তাকাল।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল—একটি সাদা গাড়ি দালানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ড্রাইভার জানালার কাঁচ নামিয়ে মোবাইলে ফিসফিস করছে।
তন্ময় তৎক্ষণাৎ বুঝে গেল।
— "ওটা কোনো সাধারণ গাড়ি নয়। এটা জাহাঙ্গীরের লোক।"
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল।
পুরো দালান অন্ধকারে ডুবে গেল।
তারপর ভেতর থেকে শোনা গেল ধাতব দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ।
রাজ আতঙ্কে চিৎকার করল—
— "অরি! এটা ফাঁদ!"
মুহূর্তের মধ্যে ভেতরের দরজা-জানালা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে গেল।
NIA অফিসাররা বুঝতে পারল—দালানটাই আসলে জাহাঙ্গীরের ফাঁদ।
কয়েক সেকেন্ড পর ভেতরের স্পিকারে ভেসে এল জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর—
গভীর, বিদ্রূপে ভরা—
— "অরিত্রি, এতদিন তোদের খেলা চলল। এবার আসল সংহার দেখবি।"
তারপর সারা দালান কেঁপে উঠল।
মেঝের নিচ থেকে গ্যাস বেরোতে শুরু করেছে।
রাজ শ্বাস নিতে না পেরে কাশতে লাগল।
অরি চিৎকার করে উঠল—
— "না! এভাবে নয়… আমি এখনও শেষ করিনি!"
তন্ময় গম্ভীর গলায় বলল—
— "একটাই রাস্তা আছে, গোপন সার্ভিস টানেল। কিন্তু সেটা কোথায় খোলে আমি জানি না।"
স্পিকারে আবার জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ—
— "পালানোর রাস্তা আমি আগেই বন্ধ করেছি। আজ এখানে তোদের দাফন হবে।"
চারদিকে গ্যাসের গন্ধ, অন্ধকারে আতঙ্ক,
আর ঘড়ির কাঁটার মতো সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
দালানের ভেতর চারদিকে গ্যাসের গন্ধ। চোখ জ্বালা করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট।
রাজ মাটিতে কাশতে কাশতে বসে পড়েছে।
অরি তার মাথা কোলে নিয়ে চিৎকার করছে—
— "না! রাজ, শক্ত থাক!"
তন্ময় টর্চ জ্বালিয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগল।
হঠাৎ তার আলো পড়ে এক দেওয়ালের কোণে—পুরনো লোহার ঢাকনার মতো কিছু।
সে গম্ভীর গলায় বলল—
— "এটাই টানেল! কিন্তু ভিতর থেকে আটকে রাখা আছে।"
ঠিক তখনই স্পিকারে আবার জাহাঙ্গীরের বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠ ভেসে এল—
— "তোরা কি ভেবেছিলি আমার সঙ্গে খেলে জিতবি? এটা দালান নয়, এটা মৃত্যুঘড়ি। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে পুরো ঘরটা আগুনে উড়ে যাবে।"
একই সঙ্গে টিক-টিক-টিক শব্দ কানে এলো।
অরি আঁতকে উঠল।
— "বোমা! এই গ্যাস আসলে ডিটোনেটরের ফুয়েল।"
NIA অফিসাররা পাগলের মতো দেয়াল ভাঙতে লাগল, কিন্তু লোহার কাঠামো অতি শক্ত।
রাজ দুর্বল গলায় বলল—
— "অরি, যদি আমরা মরেও যাই, প্রমাণগুলো যেন দেশের কাছে পৌঁছে যায়।"
অরি চোখে জল নিয়ে তার কপালে হাত রাখল।
— "তুই কিছু বলবি না। আমরা মরব না।"
তন্ময় দাঁত চেপে বলল—
— "আমার হাতে একটা শেষ চেষ্টা আছে।"
সে নিজের রাইফেল দিয়ে লোহার ঢাকনার তালায় গুলি চালাল। তালা খানিকটা ভাঙল, কিন্তু পুরোপুরি নয়।
সময় বয়ে যাচ্ছে—মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।
অরি হঠাৎ মনে পড়ল—রাজের ব্যাগে ছোট একটা পাওয়ার ব্যাংক আছে।
সে ব্যাগ ছুঁড়ে বের করে সেটার ধাতব প্লেট খুলে তালার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল।
বিদ্যুতের স্পার্কে তালা চমকে খুলে গেল।
তন্ময় চেঁচিয়ে উঠল—
— "দ্রুত! সবাই টানেলে নামো!"
অরি রাজকে কাঁধে তুলে ঝাঁপ দিল টানেলের ভেতর।
NIA অফিসাররা একে একে ঢুকল।
শেষে তন্ময় ঢাকনাটা আবার টেনে দিল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড পর দালানটা কেঁপে উঠল।
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে চারদিক আলো আর আগুনে ভরে গেল।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা ভাবল—অরি আর রাজ শেষ।
কিন্তু অন্ধকার টানেলের ভেতর অরি রাজকে শক্ত করে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
— "জাহাঙ্গীর, তুই ভেবেছিস জিতলি? আসল যুদ্ধ এখন শুরু।"
টানেলটা অন্ধকার, ভেতরে বাতাস ভারি আর স্যাঁতসেঁতে।
অরি রাজকে আধশোয়া অবস্থায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পেছনে তন্ময় আর দুই NIA অফিসার পথ দেখাচ্ছে।
টানেলটা খুব সরু, কিন্তু দূরে একটা হালকা আলো দেখা যাচ্ছিল।
অরি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
— "ওই আলোই হয়তো বের হওয়ার রাস্তা।"
হঠাৎ টানেলের ভেতর একটা অদ্ভুত শব্দ হল।
শুরুতে মনে হচ্ছিল পানির ফোঁটার টপটপ,
তারপর সেটা রূপ নিল "শা-শা" শব্দে।
তন্ময় টর্চ জ্বালাতেই দেখা গেল—
টানেলের দেয়াল ফুঁড়ে কোথাও থেকে আগুন ঢুকে পড়ছে।
বিস্ফোরণের আগুন টানেল ধরে ছুটে আসছে!
NIA অফিসাররা চিৎকার করে উঠল—
— "দ্রুত দৌড়াও! এই টানেল যেকোনো সময় ধসে পড়বে।"
অরি রাজকে বুকে চেপে যতটা সম্ভব দৌড়াতে লাগল।
রাজ কষ্টে ফিসফিস করে বলল—
— "অরি, তুই আমাকে ছেড়ে দে। তুই অন্তত বাঁচ…"
অরি দাঁত চেপে উত্তর দিল—
— "চুপ কর রাজ! আমি তোর ছাড়া বাঁচব না।"
পেছনে আগুন ঝলসে আসছে। তাপের দমক শরীর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
তন্ময় গর্জে উঠল—
— "এটা শুধু অগ্নিপথ নয়, এটাই আমাদের বাঁচা-মরার পরীক্ষা।"
অবশেষে তারা আলো-ভরা প্রান্তে পৌঁছল।
তবে出口টা ছিল লোহার জাল দিয়ে আটকানো।
সময় একেবারে ফুরিয়ে আসছে। আগুন ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
তন্ময় রাইফেল দিয়ে জালে গুলি চালাল, কিন্তু জাল কেবল ফাটল।
অরি মরিয়া হয়ে একটা ইট তুলে আঘাত করতে লাগল।
অবশেষে জাল ছিঁড়ে গেল, আর সবাই হাপাতে হাপাতে টানেল থেকে বেরিয়ে পড়ল এক অচেনা গ্রামের ধারে।
পেছনে বিস্ফোরণে পুরো টানেল কেঁপে উঠল, ধোঁয়া আর আগুন আকাশ ঢেকে দিল।
অরি হাঁটু গেড়ে বসে রাজকে জড়িয়ে ধরল।
রাজ দুর্বল হলেও ম্লান হাসি দিল—
— "আমরা মরিনি… মানে আমাদের কাজ এখনও বাকি।"
তন্ময় ধোঁয়া-ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল—
— "এখন জাহাঙ্গীর ভেবে নেবে আমরা শেষ। আর ওর এই ভুলটাই হবে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ।"
অরির চোখে আগুনের প্রতিফলন—
"এবার আমি সরাসরি ওর সাম্রাজ্যে আগুন ধরাব।"
সন্দেশখালির ভেতরে নদীর ধার ঘেঁষে এক বিশাল প্রাসাদের মতো দালান।
লোকেরা একে বলে "দরবার"—এটাই জাহাঙ্গীর খানের আসল ঘাঁটি।
বাইরে মাছের ভেরি, অস্ত্রভর্তি গুদাম, ভেতরে তার বাহিনী।
রাতের অন্ধকারে জাহাঙ্গীর বসে আছে সিংহাসনসদৃশ কাঠের চেয়ারে।
চারপাশে তার অনুগত লোক, গায়ে বিদেশি অস্ত্র।
মদের গ্লাস হাতে সে হেসে উঠল—
— "অরি আর রাজ আজ ছাই হয়ে গেছে। এখন আমার সাম্রাজ্যের পথে আর কেউ দাঁড়াতে পারবে না।"
ঠিক তখন এক গুন্ডা এগিয়ে এসে কানে ফিসফিস করল।
জাহাঙ্গীরের চোখ মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল।
— "কি বললি? তারা মরেনি?"
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে বলল—
— "হুজুর, খবর এসেছে তারা গ্রামে দেখা দিয়েছে।"
জাহাঙ্গীর টেবিলে গ্লাস ছুঁড়ে ভেঙে ফেলল।
— "মরার আগে আমায় চ্যালেঞ্জ করতে সাহস দেখাচ্ছে! তাহলে এবার ওরা সরাসরি আমার দরবারে আসুক… আর এখানেই ওদের কবর হবে।"
ওদিকে, অরি, রাজ আর তন্ময় গোপনে গ্রামে ঢুকেছে।
অরি দূর থেকে সেই প্রাসাদের আলো দেখল।
তার গলায় যেন শ্বাস আটকে গেল।
— "ওখানেই সব শেষ হবে। আমাদের যাত্রার শেষ, আর জাহাঙ্গীরের শাসনেরও।"
তন্ময় পরিকল্পনা করল—
দরবারে ঢুকতে হলে তাদের ছদ্মবেশ নিতে হবে।
রাজ কষ্টে হলেও ক্যামেরা ঠিক করে নিল।
সে বলল—
— "এইবার সরাসরি জাহাঙ্গীরের আসল রূপ ক্যামেরায় ধরা পড়বে।"
কিন্তু অরি জানে—এটা সহজ লড়াই নয়।
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকলেই চারদিক থেকে অস্ত্রধারীরা ঘিরে ধরবে।
অরির চোখে দৃঢ়তা—
"যে ভয় পায় সে-ই হারে। আজ আমি ভয় পাব না।"
রাত নামতেই তারা তিনজন ধীরে ধীরে দরবারের দিকে এগোল।
চাঁদের আলোয় নদীর জল রক্তের মতো ঝলমল করছে।
দরবারের ভেতরে জাহাঙ্গীর অপেক্ষায়।
চারদিক থেকে ঢোলের মতো শব্দ ভেসে আসছে—
শয়তানের দরবার শুরু হতে চলেছে।
দরবারের ভেতরে প্রবল হৈচৈ।
মঞ্চে গানের আসর বসানো হয়েছে, সামনে নাচছে কিছু ভীত মুখের তরুণী—
তাদের চোখে ভয়, কিন্তু দেহকে জোর করে হাসতে বাধ্য করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর পেছনে বসে হুঁশিয়ারির হাসি দিচ্ছে, হাতে রাইফেলের ট্রিগার ঘোরাচ্ছে।
হঠাৎ দরজার কাছে তিনজন ছায়া ঢুকল।
অরি, রাজ আর তন্ময়—ছদ্মবেশে শ্রমিকের মতো।
তাদের চোখ একসঙ্গে মঞ্চের মেয়েদের দিকে পড়তেই বুক হাহাকার করে উঠল।
রাজ ধীরে ক্যামেরা চালু করল—সব রেকর্ড হচ্ছে।
অরি মুষ্টি শক্ত করল।
— "আজ এই দরবারেই শেষ হবে জাহাঙ্গীরের রাজত্ব।"
তন্ময় ফিসফিস করে বলল—
— "সিগন্যাল দিলেই আমি গুলি চালাব। কিন্তু আগে প্রমাণ রেকর্ড করো।"
ঠিক তখনই জাহাঙ্গীর হাত তুলে গলা চড়াল—
— "থামাও এই ভন্ডামী! আমার নাচ দরকার নেই, আমার দরকার শিকার।"
তার চোখ ঘুরে গিয়ে পড়ল অরির উপর।
ছদ্মবেশ সত্ত্বেও যেন সে চিনে ফেলল।
জাহাঙ্গীর গর্জে উঠল—
— "অরিত্রি! ভাবলি পালিয়ে এসে আমাকে হারাতে পারবি? আজ তোর মৃত্যু হবে আমার দরবারে, সবার সামনে।"
চারদিক থেকে অস্ত্র তুলে ধরল গুন্ডারা।
অরি রাজকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তার কণ্ঠ বজ্রের মতো—
— "মৃত্যু হবে ঠিকই, কিন্তু সেটা তোর, জাহাঙ্গীর।"
এরপর শুরু হল গুলির ঝড়।
দরবার ভরে গেল বারুদের গন্ধে।
তন্ময় নিখুঁত নিশানায় একের পর এক শত্রু নামাচ্ছে,
রাজ ক্যামেরায় প্রতিটি দৃশ্য বন্দি করছে,
আর অরি দৌড়ে গিয়ে মেয়েদের শিকল ভেঙে মুক্ত করছে।
কিন্তু জাহাঙ্গীর শুধু বসে নেই।
সে নিজে রাইফেল হাতে নেমে এলো।
অরিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল—
ধাঁই!
অরি অল্পের জন্য বাঁচল, কিন্তু তার কাঁধ ছুঁয়ে গুলি চলে গেল।
রক্ত গড়িয়ে পড়ল, তবু অরি দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল।
— "এই রক্তই হবে তোর শেষের সূচনা, জাহাঙ্গীর।"
দরবার রক্তে ভিজে যাচ্ছে,
কেউ পালাচ্ছে, কেউ মরছে,
আর চারদিকে একটাই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—
"সংহার! সংহার! সংহার!"
দরবার এখন যুদ্ধক্ষেত্র।
ধোঁয়া, বারুদের গন্ধ, মেয়েদের চিৎকার, বন্দুকের শব্দ—সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য।
অরি হাত থেকে ছিটকে যাওয়া রক্তের দাগ মুছে দাঁড়াল।
রাজ ক্যামেরা আঁকড়ে ধরে রেকর্ড করছে—
কারণ এটাই একমাত্র প্রমাণ যা দেশের সামনে জাহাঙ্গীরের আসল মুখোশ খুলে দেবে।
তন্ময় শেষ কয়েকটা গুলি চালিয়ে বলল—
— "অরি! ওকে নামাতে হবে এখনই, নইলে সব শেষ।"
জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে আছে দরবারের মাঝখানে।
চোখ লাল, রাইফেল হাতে, তার কণ্ঠে উন্মাদনা—
— "তোরা ভাবছিস আমায় হারাবি? আমি সীমান্তের রাজা! আমার হাতে কোটি টাকা, বিদেশি অস্ত্র, আর তোদের মাথার দাম।"
অরি এগিয়ে গেল, গলায় বজ্রের মতো গর্জন—
— "তুই রাজা না, তুই দানব। আজ মানুষের রক্ত দিয়ে তোর রাজত্ব শেষ হবে।"
জাহাঙ্গীর ট্রিগার টানল—
ধাঁই! ধাঁই!
অরি একবার গড়িয়ে পড়ে এড়াল, তারপর টেবিলের উপর থেকে একটা ছুরি তুলে নিল।
তন্ময় গুলি চালাতে যাচ্ছিল, কিন্তু অরি থামাল—
— "না! এটা আমার লড়াই।"
দুজনের চোখে চোখ পড়ল।
একদিকে অরি—জীবন-মরণ লড়াইয়ে শপথবদ্ধ,
অন্যদিকে জাহাঙ্গীর—অহঙ্কারে অন্ধ শয়তান।
তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অপরের দিকে।
রাইফেলের আঘাত বনাম ছুরির ঝলকানি।
একসময়ে অরি তার কাঁধে আঘাত পেলেও দাঁত চেপে ছুরি চালিয়ে দিল সরাসরি জাহাঙ্গীরের বুকে।
জাহাঙ্গীর হোঁচট খেল, রক্ত ছিটকে পড়ল।
তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
সে গলা দিয়ে বিড়বিড় করে বলল—
— "অসম্ভব… আমি… আমি তো অমর…"
অরি কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিল—
— "না, তুই অভিশাপ ছিলি। আর অভিশাপ শেষ হতেই হয়।"
জাহাঙ্গীর ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
দরবারে হঠাৎ সব নিস্তব্ধ।
রাজ কাঁপা হাতে ক্যামেরা নামাল।
তন্ময় গম্ভীর গলায় বলল—
— "শেষ হয়েছে। আজ সন্দেশখালি মুক্ত।"
অরি হাঁটু গেড়ে বসে চারদিকে তাকাল।
মুক্ত হওয়া মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরল।
তার চোখে অশ্রু ঝিলমিল—
— "এই সংহার মানুষের জন্য ছিল। আজ থেকে নতুন শুরু হবে।"
বাইরে ভোরের আলো ফুটছে।
আকাশে লাল আভা—কিন্তু সেটা আর রক্তের নয়,
বরং আশার সূর্যোদয়।
