জয়পুরে জমজমাট
জয়পুরে জমজমাট
জয়পুরে জমজমাট
রাত আটটা। কলকাতার গড়িয়াহাটে অরিত্রি দত্তর ফ্ল্যাট। জানালার বাইরে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় আলো-আঁধারি।
টিভির পর্দায় একের পর এক ব্রেকিং নিউজ। রাজ—পেশায় ফটোগ্রাফার, পাশে বসে বিরক্ত মুখে রিমোট টিপছে।
অরির চোখ হঠাৎ থেমে গেল এক ভয়াবহ খবরের উপরে—
"রাজস্থানের জয়পুরে সক্রিয় আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। নাবালিকা মেয়েদের পাকিস্তান সীমান্তে পাচার করা হচ্ছে। অঙ্গপাচারের সন্দেহও আছে।"
অরি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।
– অরি: "রাজ, চুপ করে থাকা মানে অপরাধীদের পাশে দাঁড়ানো। আমাকে যেতে হবে।"
– রাজ (আশ্চর্য হয়ে): "মানে? জয়পুরে? এটা তো খুব বিপজ্জনক।"
– অরি: "বিপদ থাকবেই। কিন্তু কিছু না করলে এই মেয়েগুলো বাঁচবে না।"
রাজ অল্পক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদু হেসে অরির হাত ধরলো।
– রাজ: "তুই যদি যাহান্নামে নামতে বলিস, আমি নামবো। তোকে ছাড়া কোথাও যাই? তুই-ই আমার সব।"
মুহূর্তটুকু হালকা হলো। রাজ অরির গালে হাত বুলিয়ে বললো,
"শুধু তদন্ত নয়, মাঝে মাঝে আমাকেও সময় দে, জানিস তো?"
অরি মিষ্টি হেসে ফিসফিস করে বলল,
"তুই-ই আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়।"
সিদ্ধান্ত হলো—তারা জয়পুর যাবে।
রাত দশটার ট্রেন। হাওড়ার প্ল্যাটফর্মে ভিড়। অরি আর রাজ জানলার পাশে জায়গা করে বসেছে।
ট্রেন ছাড়তেই হঠাৎ এক গলা চেঁচিয়ে উঠলো—
– ভদ্রলোক: "এই যে, এই যে! মহাশয়, এ আমার সিট! ভুলে বসে পড়েছেন নাকি? আমার নামেই লেখা আছে।"
সামনের যাত্রী হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বসে পড়লেন, তারপর হেসে ফেললেন।
চোখে গোল চশমা, গলায় হালকা ওড়না, ভরাট গলা।
– ভদ্রলোক: "আরে ভয় পাবেন না। আমি বিভূ বান্ধোপাধ্যায়। পেশায় লেখক, নেশায় ধাঁধাঁবাজ। গল্প লিখি, রসিকতা করি, মানুষকে কাঁদাই-হাসাই।"
রাজ ভুরু কুঁচকালো।
"মানে, ধাঁধাঁবাজ আবার কী?"
বিভূ বাবু হেসে বললেন—
"আপনাদের মন ভারী লাগছে। চলুন, একটা ধাঁধা দিয়ে শুরু করি।"
বিভূ: "বলুন তো, কোন জিনিসটা ভাঙলে আওয়াজ হয় না?"
রাজ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
অরি শান্ত গলায় বললো—
– অরি: "নীরবতা।"
বিভূ বাবু হাততালি দিলেন।
– বিভূ: "অসাধারণ! একদম গোয়েন্দার উত্তর।"
রাজ কপাল চাপড়ালো, "ধাঁধাঁর সাথে গোয়েন্দাগিরির কী সম্পর্ক?"
বিভূ বাবু হেসে বললেন—
– বিভূ: "গোয়েন্দা মানে ধাঁধাঁর সমাধানকারী। অপরাধও এক ধাঁধাঁ।"
বিভূ: "যে নদী কখনও শুকোয় না, অথচ বৃষ্টিতে ভরে যায় না?"
রাজ বিরক্ত হয়ে বললো, "আবার নদী-টদী!"
অরি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো, "মানুষের চোখের জল।"
বিভূ বাবু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
– বিভূ: "আপনি তো সত্যিই অদ্ভুত মেধাবী।"
বিভূ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে বললেন—
– বিভূ: "আপনি কি ক্যামেরাম্যান?"
– রাজ (হেসে): "হ্যাঁ, ফটোগ্রাফার।"
– বিভূ: "তাহলে সাবধান! ক্যামেরা মানুষকে ধরে রাখে, কিন্তু মানুষ ক্যামেরাকে ধরে রাখতে পারে না। আমার বউ তাই আমাকে ক্যামেরা ধরতে দেয় না। বলে, ছবি বেশি হলে সংসার ফাঁকা হয়ে যায়।"
রাজ হেসে গড়াগড়ি খেলো। অরি শুধু মুচকি হাসলো।
ট্রেন তখন ঝড়ঝড় করে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনজনের আড্ডা জমে উঠেছে।
– বিভূ: "কোন দরজা খোলা যায় না, অথচ সবার সামনে থাকে?"
রাজ বিরক্ত হয়ে বললো, "দরজা মানেই তো খোলে, আবার খোলে না মানে কী?"
অরি বললো, "ভবিষ্যৎ।"
– বিভূ: "বাহ! ভবিষ্যতের দরজা আছে, কিন্তু কেউ খোলার চাবি পায় না।"
– বিভূ: "কোন জিনিসটা যত বেশি ধোবেন, ততই নোংরা হবে?"
রাজ অবাক হয়ে বললো, "এ কেমন প্রশ্ন!"
অরি ভেবে নিয়ে উত্তর দিলো, "জল ।"
বিভূ হেসে গড়িয়ে পড়লেন—
– বিভূ: "একদম! জলকে যত ধোবেন, তত ময়লা হয়ে যাবে।"
বিভূ হঠাৎ রাজকে বললেন—
– বিভূ: "আপনি প্রেমিক, তাই না?"
রাজ লজ্জা পেয়ে অরি দিকে তাকালো।
– বিভূ: "তাহলে সাবধান। প্রেম হলো কফির মতো—গরম থাকতে ভালো লাগে, ঠান্ডা হয়ে গেলে তেতো।"
অরি মুখ টিপে হাসলো। রাজ রেগে গম্ভীর হয়ে গেলো।
– রাজ: "আপনি কি সবসময় এমন করেন?"
– বিভূ: "না, কখনও কখনও ঘুমোইও।"
ট্রেনের হাওয়া, জানলার বাইরে অন্ধকার মাঠ।
কুপের ভেতর একেবারে জমজমাট পরিবেশ।
অরি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল—বিভূ বাবু শুধু মজার মানুষ নন, তাঁর মাথায় ভীষণ বুদ্ধি আছে। ধাঁধাঁ আর রসিকতার আড়ালে তিনি মানুষের মন, যুক্তি আর চরিত্র যাচাই করেন।
রাজ যদিও কিছুই বুঝতে পারছিল না, তবে অরির চোখে একটা অদ্ভুত কৌতূহল জেগে উঠলো—
"এই মানুষটা কেবল লেখক নন, আমাদের যাত্রায় এক রহস্যময় সঙ্গী।"
জয়পুর স্টেশন আসতেই বিভু বাবু অরি কে তাদের গন্তব্য জিজ্ঞেস করে অবাক হয়ে গেলো
সে বলে উঠলো আরিব্বাস আমিও তো ওই একই হোটেলে উঠবো। এ যেন এক ভবিতব্য।
অরি বললো আমারও তাই মনে হচ্ছে এই যাত্রা টা আপনার সাথেই লেখা আছে
জয়পুর শহরের সকালটা রঙিন। চারদিকে গোলাপি দেওয়াল, রাজপুত আর্কিটেকচারের ছাপ, রাস্তার ধারে উটের গাড়ি। রাজ তার ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলছে।
অরি হালকা নীল শাড়ি পরে হোটেলে ঢুকলো। রাজসিক লবি, বড় ঝাড়বাতি, লাল গালিচা। রিসেপশনে নাম লিখে দিল দুজনেই।
রাজ বললো,
"একটা উইন্ডো–সাইড রুম পেলে ভালো হয়, আলো ঠিকঠাক আসবে। ছবি তোলার সুবিধে।"
অরি মুচকি হেসে বললো,
– অরি: "তুই সবকিছুতেই ক্যামেরার কোণ খুঁজিস।"
তারা রুমে ঢুকেই একটু বিশ্রাম নিল।
রাত নামতেই হোটেল লবিতে চিৎকার–চেঁচামেচি শুরু হলো।
একজন আতঙ্কিত অতিথি দৌড়ে চেঁচাচ্ছে—
"বোম! কেউ নাকি হোটেলে বোম রেখেছে!"
কয়েক মিনিটে লবি ভরে গেল আতঙ্কে। বিদেশি অতিথিরাও ভয়ে কাঁপছে।
মিনিট দশের মধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কড়া মুখে নামলো কয়েকজন অফিসার।
রাজ চমকে বললো,
"অরি, এটা তো সিরিয়াস ব্যাপার। আমরা জড়িয়ে পড়লে—"
অরি তাকে থামালো,
– অরি: "চুপ থাক। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে হবে।"
৩. পুলিশের সামনে অরির আত্মপ্রকাশ
অরি সোজা এগিয়ে গিয়ে পুলিশের এক অফিসারের সামনে দাঁড়ালো।
গম্ভীর কণ্ঠে বললো—
"আমি অরিত্রি দত্ত। পেশায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, কলকাতা থেকে এসেছি। হয়তো কাজে লাগতে পারি।"
অফিসার সন্দেহভরে তাকালেন।
– অফিসার: "প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর? কাগজপত্র আছে?"
অরি ব্যাগ থেকে আইডি কার্ড বের করে দিল।
রাজ তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে একটু ভয়।
অফিসার কার্ড দেখে কিছুটা শান্ত হলেন।
– অফিসার: "এখনও পর্যন্ত আমরা শুধু ফোনে হুমকি পেয়েছি। কিন্তু লোকাল পুলিশের সাথে বাইরের কারও কাজ করা সহজ নয়।"
অরি শান্ত গলায় উত্তর দিলো—
"আমি জানি, কিন্তু আপনাদের তথ্য আমার প্রয়োজন, আর আমার কিছু দক্ষতা আপনাদের কাজে লাগতে পারে। আমি বহু কেসে সাহায্য করেছি। আপনাদের অনুমতি চাই।"
অফিসার এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন—
– অফিসার: "ঠিক আছে, তবে সাবধানে। এখানে শত্রু চোখের সামনেই ঘুরছে।"
রাজ হাঁফ ছাড়লো। অরি ভেতরে ভেতরে দৃঢ় হলো।
ঠিক তখনই লিফট থেকে ভেসে এল পরিচিত হাসি।
বিভূ বাবু ঝাড়া গলায় ডাক দিলেন—
– বিভূ: "আহা! আমি ভেবেছিলাম নাটক কেবল বইয়েই হয়, কিন্তু দেখছি জীবনও মঞ্চ।"
অফিসার অবাক হয়ে তাকালেন।
– অফিসার: "আপনি কে?"
– বিভূ (গম্ভীর হয়ে): "আমি লেখক। পেশায় রসিক, নেশায় ধাঁধাঁবাজ। তবে চিন্তা করবেন না, আমি বোমা বানাই না—শুধু গল্পের বোমা ফাটাই।"
সবার মুখে এক মুহূর্তের জন্য হাসি ফুটলো।
অরি হেসে বললো,
– অরি: "তিনি আমাদের সহযাত্রী। তবে তার মাথা ভীষণ তীক্ষ্ণ।"
অফিসাররা রিপোর্ট লিখছে। বিভূ বাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন—
"যে জিনিস চোখে দেখা যায় না, অথচ বোমার থেকেও ভয়ঙ্কর?"
রাজ ফিসফিস করলো,
– রাজ: "আবার শুরু হলো।"
অরি চোখ বন্ধ করে বললো,
– অরি: "ভয়।"
– বিভূ: "বাহ! ভয়ই সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। আতঙ্ক ছড়ালেই অপরাধীরা জয়ী।"
অফিসার মাথা নেড়ে বললেন,
– অফিসার: "ঠিক বলেছেন। আতঙ্কটাই এদের আসল অস্ত্র।"
"যে তালা সবসময় খোলা থাকে, অথচ মানুষ খুঁজে বেড়ায় চাবি?"
অরি বললো,
– অরি: "মুখ।"
বিভূ বাবু হাততালি দিয়ে উঠলেন,
– বিভূ: "অসাধারণ! মুখ সবসময় খোলা, অথচ সবাই বলে—'চুপ থাকো, তালা দাও।'"
পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশও হেসে ফেললো। আতঙ্ক কিছুটা কেটে গেল।
পুলিশ অফিসার অরির দিকে তাকিয়ে বললেন—
– অফিসার: "মিস দত্ত, আমাদের ইন্টেলিজেন্স বলছে এই হোটেল পাচারচক্রের ব্যবহার করা জায়গা। হয়তো বোমা হুমকি সত্যি নয়, আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য।"
অরি শান্তভাবে উত্তর দিলো—
– অরি: "ঠিক তাই। আতঙ্ক একটা আবরণ। এর আড়ালে তারা হয়তো মেয়েদের পাচারের চেষ্টা করবে।"
অফিসার তাকিয়ে রইলেন।
– অফিসার: "আপনার যুক্তি শক্তিশালী। আমরা আপনাকে সহযোগী হিসাবে নেব।"
রাজ পাশে দাঁড়িয়ে অরির হাত চেপে ধরলো।
– রাজ (আস্তে): "তুই সত্যিই ভীষণ আলাদা। এত বড় শহরে গিয়েও পুলিশকে বিশ্বাস করাতে পারিস।"
অরি শুধু মৃদু হেসে বললো,
– অরি: "এটাই আমার কাজ।"
বিভূ বাবু হঠাৎ ঘোষণা করলেন—
– বিভূ: "আমার মনে হচ্ছে আমরা এখন এক টিম—গোয়েন্দা, ফটোগ্রাফার আর ধাঁধাঁবাজ লেখক।
তিনটে মিলে একেবারে 'ত্রিমূর্তি'।
তবে সাবধান! এই নাটকের শেষে করতালি নাও পেতে পারি—পেতে পারি শুধু হ্যান্ডকাফ।"
সবার মুখে হালকা হাসি ফুটলো। আতঙ্কের মধ্যে হালকা আলোর রেখা জ্বলে উঠলো।
অরি জানলো—এই মুহূর্তেই সে জয়পুর পুলিশের সাথে তার প্রথম জোট তৈরি করলো।
পুলিশরা অবশেষে হোটেল লবি ছেড়ে চলে গেল। সবাইকে আশ্বস্ত করে বললো, আপাতত কোনো বিস্ফোরণের আশঙ্কা নেই। আতঙ্ক কমলেও হোটেলের পরিবেশে অদৃশ্য টানটান উত্তেজনা রয়ে গেল।
অরি আর রাজ নিজেদের রুমে ফিরে এলো।
রাজ ক্লান্ত মুখে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
– রাজ: "তুই আবার কি এতো ভাবছিস? সবসময় কেসের ধাঁধাঁ মাথায় ঘোরাস।"
অরি জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলো। অন্ধকারের মধ্যে লালচে আলোয় ভিজে থাকা জয়পুর শহর যেন এক রহস্যময় ছবি।
– অরি: "রাজ, এরা বাচ্চাদের পাচারের আড়ালে আরও ভয়ংকর কিছু করছে। আমার মাথা থেকে বেরোচ্ছে না।"
রাজ উঠে এসে অরির কাঁধে হাত রাখলো।
– রাজ: "সবকিছুর উত্তর রাতারাতি পাওয়া যায় না। ঘুমো, কাল ভোরে উঠে ঠান্ডা মাথায় ভাববি ।"
অরি চেষ্টা করলো ঘুমোতে, কিন্তু চোখ বুজলেই ছোট ছোট মেয়েদের মুখ, সীমান্ত পার হওয়ার ট্রাক, অন্ধকার ঘরে কান্নার আওয়াজ।
রাজ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো, কিন্তু অরির রাত কাটলো অস্থিরতায়।
ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় দরজায় হঠাৎ জোর ধাক্কা।
রাজ ঘুম থেকে উঠে বিড়বিড় করে বললো, "কী হল আবার?"
দরজা খুলতেই দেখা গেল বিভূ বান্ধোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে এক কাপ চা , মুখে সেই চিরচেনা খিলখিল হাসি।
– বিভূ: "আরে ঘুম থেকে উঠুন, মহাশয়–মহাশয়া! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্যটা আমি ভোরেই আবিষ্কার করেছি।"
রাজ বিরক্ত হয়ে বললো, "সকালবেলা আবার কী রহস্য?"
– বিভূ চা দেখিয়ে: "এই দেখুন! আমার সকালের চায়ের কাপে দুধ পড়েনি। রহস্য হলো—আমি দুধ অর্ডার করিনি, তবুও দুধ এলো না। বলুন তো, ওরা বুঝলো আমি চায় দুধ খাই না ?"
রাজ মাথায় হাত দিলো, কিন্তু অরি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– অরি: "তাহলে আমাদের ঘুম ভাঙাতে হলো শুধু এই কারণেই?"
– বিভূ গম্ভীর গলায় বললেন: "না না, মজা করলাম। আসল রহস্য হলো, হোটেলের কিচেনবয়ের চোখে আমি কিছু অদ্ভুত দেখেছি। ভোরবেলায় কয়েকটা বড় বাক্স বের করছিল। অতি সাবধানে, যেন কারও চোখে না পড়ে। এতো ভোরে আবার এত বড় বাক্স কোথায় নিয়ে যাবে?"
অরি সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হলো।
– অরি: "বাক্সগুলোতে কী ছিল, আন্দাজ করতে পারেন?"
– বিভূ (চোখ টিপে): "আন্দাজ না, বিশ্বাস করি—মানুষ যখন বাক্স লুকোয়, তখন সেটা কাপড়চোপড় নয়, বরং ভয়ঙ্কর কিছু।"
অরি জানলো, এটাকে হালকা করে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
অরি বিভু বাবুকে রেডি হতে বলল সময় দিলো ১০ মিনিট
বিভু বাবু বড় একটা হা করে বলল আমার মাত্র ৩ মিনিট লাগবে
আজ মরুভূমি ঘুরতে যাওয়া হবে। বাইরে থেকে এটা যেন সাধারণ ভ্রমণ, কিন্তু অরি বুঝছিল—এখানেই হয়তো কোনো সূত্র লুকোনো আছে।
রাজ ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে খুশি। মরুভূমির বালিয়াড়িতে আলো-ছায়ার খেলা, উটের গাড়ি, রঙিন ওড়না পরা রাজস্থানি মেয়েরা—সবকিছু ছবির মতো।
বিভূ বাবু উটের পিঠে বসে গলা ছেড়ে গান ধরলেন—
"ও মরু ময়ূর, কবে বৃষ্টি হবে, কবে রহস্য ফাঁস হবে!"
রাজ হেসে বললো, "আপনি সবকিছুতেই নাটক করেন!"
– বিভূ: "নাটক নয় মহাশয়, জীবনই সবচেয়ে বড় মঞ্চ।"
বালুর মধ্যে হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য নজরে এলো।
দূরে কয়েকজন লোক, মুখ কাপড়ে ঢেকে, উটের গাড়িতে বড় বড় বাক্স তুলছে।
অরি চোখ ছোট করে তাকাল। রাজ সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় জুম করলো।
লেন্সে ধরা পড়লো বাক্সগুলোর ওপর লাল রঙে লেখা অদ্ভুত চিহ্ন—অর্ধেক হিন্দি, অর্ধেক উর্দু অক্ষর।
– অরি: "রাজ, ছবি তুলে রাখ। এগুলো কেবল মালপত্র নয়। এর সাথে পাচারচক্রের যোগ থাকতে পারে।"
বিভূ ফিসফিস করে বললেন—
"বলুন তো, কোন শব্দটা দুই দেশের সীমান্ত মুছে দেয়?"
অরি এক মুহূর্ত ভেবে বললো—
"অপরাধ।"
– বিভূ: "ঠিক তাই। অপরাধের কোনো দেশ নেই, শুধু পথ আছে।"
ওদের সন্দেহ আরও গাঢ় হলো।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে অরি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলো।
অফিসার: "মিস দত্ত আপনি সব ছবি গুলো নিয়ে আমার অফিস চলে আসুন না। এখানে বসে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে
অরি, রাজ, বিভু বাবু থানার উদ্যেশে রওনা হলো। অফিসারকে ছবি গুলো দেখালো
অফিসাররা প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো ভুল দেখা, কিন্তু অরি ছবিগুলো দেখাতেই গম্ভীর হয়ে গেল।
চিহ্নগুলো আসলে একধরনের কোড, যেটা পাকিস্তানি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।
– অফিসার: "মিস দত্ত, আপনি বুঝতে পারছেন কি বলছেন? মানে হোটেলটাই যদি এদের ঘাঁটি হয়, তবে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে সাপের গর্তে ঢুকেছি।"
অরি দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো,
"আমি ঠিক সেটাই বলছি। আতঙ্ক ছড়ানো, বোমার গুজব—এসব আসল খেলার আড়াল। এরা হোটেল থেকেই পাচার চালাচ্ছে।"
বিভূ বাবু হেসে উঠলেন—
"বলুন তো, কোন ঘর মানুষ ভরিয়ে রাখে, অথচ সেটা যত ভরবে, তত ফাঁকা হবে?"
রাজ বিরক্ত হয়ে বললো, "এখন আবার ধাঁধাঁ?"
অরি হেসে বললো, "শ্মশান।"
বিভূ মাথা নেড়ে বললেন—
"অসাধারণ। অপরাধীদের ঘরও ঠিক তেমন। যত টাকা–মানুষ ভরবে, তত ফাঁকা হয়ে যাবে মানবতা।"
পুলিশ অফিসাররা সিদ্ধান্ত নিল—গোপনে হোটেল রেইড করবে।
অরি-রাজ-বিভূ এবার অফিসিয়াল সহযোগী।
অন্ধকার নামলো জয়পুর শহরের উপর। হোটেলের ঝাড়বাতির আলোয় লুকিয়ে রইলো ভয়ংকর ছায়া।
অরি জানলো—এই ভ্রমণ কেবল রহস্য নয়, জীবন-মরণ খেলা।
আর বিভূ বাবুর ধাঁধাঁ যেন অদ্ভুতভাবে প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে।
জয়পুর শহরের এক নামী হোটেল, যার ভেতরে রাজ–অরি আর বিভূ বাবু মাত্র এক দিন আগেই উঠেছে। এখানে হয়তো একটা বড় সন্ত্রাসী চক্রের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে। বাইরে থেকে সব যেন শান্ত—গেটের সামনে পর্যটকের ভিড়, লবি ঘিরে আলো ঝলমল। অথচ ভেতরে বাতাসে চাপা অস্থিরতা।
অরি তখন পুলিশ অফিসার ডি.এস.পি. রণজিৎ সিং–এর সঙ্গে কথা বলছে।
অরি (গম্ভীর মুখে):
"স্যার, আমি নিশ্চিত এই হোটেলের ভেতরে পাচারচক্রের লোক ঢুকেছে। যদি আমরা সরাসরি অভিযান চালাই, ওরা পালিয়ে যাবে। তাই প্রথমে চুপিসারে খোঁজ করতে হবে।"
রণজিৎ সিং কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন—
"ঠিক বলেছো মিস দত্ত। তুমি যেভাবে বলছ আমরা সেই ভাবেই এগোবো ? জানো তো, ঝুঁকি অনেক।"
অরি মৃদু হেসে উত্তর দিলো—
"ঝুঁকিই তো আমার কাজের আসল মজা।"
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। হোটেলের সাধারণ অতিথিদের কিছুই বুঝতে না দিয়ে তিনজন সাধারণ পোশাকের পুলিশ, সঙ্গে অরি আর রাজ। বিভূ বাবু পেছনে পেছনে হাঁটছেন, চুপ করে থাকার চেষ্টায়, কিন্তু ঠোঁটে এখনও দুষ্টু হাসি।
বিভূ বাবু ফিসফিস করে:
"অভিযান মানেই তো রহস্যের গোলকধাঁধা। কিন্তু গোলকধাঁধার আসল পথ বের করতে চাইলে... প্রথমে চোখ খোলা রাখতে হবে।"
রাজ বিরক্ত হয়ে তাকালো, "এখন আবার ধাঁধা!"
অরি মুচকি হেসে বলল, "মানে উনি বলছেন, আমাদের চারপাশে যা হচ্ছে সব লক্ষ রাখতে হবে।"
রণজিৎ সিং: "আমাদের ইনফরমেশন বলছে, পাচারচক্র মাঝে মাঝে এই হোটেলের বেজমেন্ট ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা যখনই নামি, তখন কিছুই পাই না।"
অরি চোখ সরু করে ভাবলো।
– অরি: "মানে, তারা হয়তো নিয়মিত জায়গা বদলায়। তবে একটা জিনিস সবসময় থেকে যায়—চিহ্ন।"
রাজ কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল।
– রাজ: "আমি ছবি তুলতে পারবো তো?"
– অরি: "হ্যাঁ, তবে সাইলেন্ট মোডে।"
বিভূ বাবু চেয়ার থেকে উঠে এসে হাঁ করে বললেন—
– বিভূ: "আচ্ছা! এবার বুঝলাম, এই হোটেলের গল্পই আসল থ্রিলার। আমি তো ভেবেছিলাম শুধু রুম সার্ভিসে ধোঁকা খাওয়ার ব্যাপার হবে।"
সবাই মৃদু হেসে উঠলো, তারপর টিম নেমে পড়লো বেজমেন্টে।
লোহার গেট পেরিয়ে নীচে নামতেই অন্ধকার ঘন হয়ে এল। ছাদ নিচু, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। কোথাও পুরনো কাঠের বাক্স, কোথাও ঝুলছে মাকড়সার জাল।
রাজ ক্যামেরার আলো হালকা জ্বালিয়ে দিল।
বিভূ বাবু পেছন থেকে বললেন—
– বিভূ: "ওরে বাবা! এ জায়গায় তো ভৌতিক গল্প লিখলে বাজারে ঝড় তুলবে।"
অরি হাতের টর্চটা ঘুরিয়ে চারপাশ লক্ষ্য করলো। হঠাৎ মেঝেতে শুকনো কাগজের টুকরো দেখতে পেল। তুলে নিতেই রাজ ক্যামেরা ফ্ল্যাশ ছাড়াই ক্লিক করে ফেললো।
– অরি: "এই কাগজটা একটা চালানপত্রের টুকরো। তারিখ গত সপ্তাহের। 'গার্মেন্টস সাপ্লাই' লেখা আছে।"
রণজিৎ সিং: "গার্মেন্টসের আড়ালে মেয়েদের পাচার—আমাদের সন্দেহ মিলতে শুরু করেছে।"
এমন সময় বিভূ বাবু হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন—
ধাঁধাঁ:
"যা যত লুকানো, খুঁজে পাওয়া তত সহজ;
যা যত চোখের সামনে, মানুষ তত মিস করে।"
রাজ বিরক্ত হয়ে বললো,
– রাজ: "এই অন্ধকারে আবার ধাঁধাঁ কেন?"
অরি হেসে বললো,
– অরি: "উত্তর হলো—'সত্য'। সত্য সবসময় চোখের সামনে থাকে, কিন্তু মানুষ খেয়াল করে না।"
বিভূ বাবু হাততালি দিয়ে উঠলেন—
– বিভূ: "অসাধারণ! বুঝলুম, এখন আমরা সত্য খুঁজতে চলেছি।"
অরি হঠাৎ লক্ষ্য করলো এক দেওয়ালে হালকা দাগ। যেন ঘষা হয়েছে বারবার। সে হাত বুলিয়ে দেখলো—ওখানে একটা ছোট্ট ফাঁক।
– অরি (চুপচাপ): "দেখো…এই দেওয়ালটা আলগা।"
রাজ আলো ফেলে দিল। সত্যিই, ইটের পেছনে কাঠের ফ্রেম দেখা গেল।
অরি আস্তে চাপ দিল—দেওয়ালের অংশটা সরেই গেল। ভেতরে অন্ধকার টানেল।
সবাই স্তব্ধ।
রণজিৎ সিং ফিসফিস করে বললেন—
– মেহতা: "আমরা এতবার খুঁজেছি, অথচ এটা চোখে পড়েনি।"
– বিভূ: "সত্যিই তো, চোখের সামনে লুকানো জিনিস সবচেয়ে মিস হয়।"
অরির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো।
তারা ভেতরে ঢুকলো। টানেল সরু, বাঁকানো। কিছুদূরে গিয়ে কাঠের বাক্সে ভরা ছোট্ট ঘর পাওয়া গেল। বাক্সগুলোতে লেখা—
"লেডিস গার্মেন্টস, মেড ইন ইন্ডিয়া"।
অরি একটাকে খুলে ফেললো। ভেতরে ছিল কয়েকটা শাড়ি, কিন্তু নিচে লুকোনো ছিল ছোট ছোট প্যাকেট।
প্যাকেটগুলো খুলতেই চমকে উঠলো সবাই—ভেতরে পাসপোর্ট, কিছু মেয়েদের ছবি, আর নামের লিস্ট।
– অরি (গম্ভীর গলায়): "এটাই প্রমাণ। এই হোটেল পাচারচক্রের ডিপো।"
রাজ তাড়াতাড়ি ছবি তুলতে শুরু করলো।
বিভূ বাবু চশমা মুছতে মুছতে বললেন—
– বিভূ: "ওরে বাবা! আমি তো ভেবেছিলাম গল্প লিখবো, কিন্তু এখানে তো খবরের শিরোনাম তৈরি হচ্ছে।"
ঠিক তখনই পেছনে হালকা শব্দ—কারও পায়ের আওয়াজ!
সবাই থমকে গেল। আলো বন্ধ করে কোণে লুকালো।
দুজন লোক টর্চ হাতে ভেতরে ঢুকলো। তারা হিন্দি–রাজস্থানি মিশিয়ে বলছে—
– "বস বলেছে আজ রাতেই মাল সরাতে হবে।"
– "হ্যাঁ, কাল সকালে ডেলিভারি।"
অরি রাজের দিকে ইশারা করলো—"চুপচাপ ছবি তোল।"
রাজ কাঁপা হাতে ক্যামেরা তুললো।
বিভূ বাবু শ্বাস চেপে ফিসফিস করলেন—
– বিভূ: "যদি এখন হাঁচি চলে আসে তো সব শেষ!"
রাজ অল্প হেসে ফেললো, তবে অরি তার হাত শক্ত করে ধরলো।
লোক দুজন বেরিয়ে যেতেই রণজিৎ সিং এগিয়ে গিয়ে বললেন—
রণজিৎ সিং: "আপনাদের ছাড়া আমরা হয়তো প্রমাণই পেতাম না।"
অরি শান্ত গলায় বললো—
– অরি: "এখনও কাজ শেষ হয়নি। এরা যেভাবে মেয়েদের পাচার করছে, আজ রাতেই তাদের থামাতে হবে।"
রাজের চোখে ভয় আর গর্ব মিশে গেল।
বিভূ বাবু আস্তে বললেন—
– বিভূ: "আহা! একেবারে সিনেমার চূড়ান্ত মুহূর্ত আসছে মনে হচ্ছে।"
অফিসার হাত বাড়িয়ে দিলেন অরির দিকে।
রণজিৎ সিং: "আপনি আজ থেকে অফিসিয়ালি আমাদের সহযোগী। আজ রাতে আমরা একসাথে অভিযান চালাবো।"
অরি হাত মেলালো।
রাজ আর বিভূবাবু পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো—এই বেজমেন্টেই জন্ম নিলো তাদের আসল জোটবদ্ধতা।
অরি, রাজ, বিভূবাবু আর অফিসার রণজিৎ সিং সেই রাতে বেজমেন্ট থেকে উদ্ধার করা পাসপোর্ট, ছবি আর নামের লিস্ট টেবিলে সাজিয়ে বসেছে।
কিছু নাম সাধারণ—মাঝারি শহরের মেয়েরা, কিন্তু দু'একটা নামের পাশে ছিল লাল কালি দিয়ে একটা বিশেষ চিহ্ন।
রাজ হুঁশ করে বললো—
"এই লাল দাগের মানে কী?"
অরি লিস্টটা মন দিয়ে দেখে গম্ভীর গলায় বললো—
– অরি: "এগুলো ভিআইপি কনসাইনমেন্ট। মানে খুব দামি ক্রেতাদের জন্য বাছাই করা।"
বিভূবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন—
– বিভূ: "আরে বাবা! মানবজাতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাজারটা কি তবে এখানেই?"
রণজিৎ সিং নীরব। তারপর আস্তে বললেন—
"কোনো একটা নাম আমার চোখে পড়ছে। 'সাবা আনোয়ার'। এই নাম পাকিস্তানের গোয়েন্দা ফাইলে আছে।"
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
পাকিস্তানি যোগসূত্রের ইঙ্গিত
অরি চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি করতে লাগলো।
– অরি: "মানে পাচারচক্র শুধু মেয়েদের বেচাকেনা করছে না…এর সঙ্গে সীমান্তপারের নেটওয়ার্কও জড়িত।"
রণজিৎ সিং মাথা নেড়ে বললেন—
"হ্যাঁ। আমরা আগেও খবর পেয়েছি, পাকিস্তানের করাচি থেকে একাধিক রুটে মেয়ে পাচার হয়। তবে ভারতীয় হোটেলের ভেতর এভাবে নেটওয়ার্ক চালানো হচ্ছে—এটাই নতুন।"
রাজ একটু ভয়ে, একটু উত্তেজনায় বললো—
"মানে আমাদের তদন্ত একেবারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেল?"
বিভূবাবু তখনো চশমা নামিয়ে রেখে বিড়বিড় করছেন—
"এবার তো আমার গল্প লিখতে হলে হেমিংওয়েকেও টেক্কা দিতে হবে।"
অরি আবার সেই বাক্সগুলো দেখতে গেল। একটির ভেতরে শুধু কাপড় নয়, নিচে সেলাইয়ের মধ্যে গোপন পকেট লুকোনো ছিল। ভেতরে ছোট্ট একটা ইউএসবি ড্রাইভ।
রাজ উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো।
– রাজ: "এবার তো আসল রহস্য ফাঁস হবে।"
অরি ড্রাইভটা পুলিশের ল্যাপটপে চালাতে বললো।
ফাইলগুলো খুলতেই দেখা গেল—একটা এক্সেল শিট, যেখানে নাম, তারিখ আর জায়গার পাশে অদ্ভুত কোড লেখা।
রণজিৎ সিং ধীরে ধীরে পড়লেন—
– "LHR–KHI, BOM–DXB, CCU–KHI…"
অরি দ্রুত বললো—
"এগুলো এয়ারপোর্ট কোড। লাহোর, করাচি, বোম্বে, দুবাই, কলকাতা… অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পাচারের এয়ার রুট।"
ঘরটা যেন হিম হয়ে গেল।
চাপা উত্তেজনার মাঝে বিভূবাবু আবার মুচকি হেসে বললেন—
ধাঁধাঁ:
"যেখানে সীমান্ত মুছে যায়,
সেখানে আইনও অচেনা হয়ে যায়।
বল দেখি, এ খেলায় আসল খেলার মাঠ কোনটা?"
রাজ বিরক্ত গলায় বললো—
– রাজ: "বাবু, আবার ধাঁধাঁ?"
অরি কিন্তু সিরিয়াস মুখে বললো—
– অরি: "উত্তর হলো—'কালোবাজার'। সীমান্তের ওপারে যা চলে, সেটাই এই কালোবাজার।"
বিভূ তালি দিয়ে উঠলেন—
"বাহ, তুমি না থাকলে আমার ধাঁধাঁ মরেই যেত।"
কিন্তু এবার হাসির আবহ দ্রুত মিলিয়ে গেল, কারণ ঘরে উপস্থিত সবাই বুঝলো—এটা কেবল স্থানীয় তদন্ত নয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পথ খুলছে।
ছায়ার মতো ভয়
রাতের বাকি সময়টা পুলিশ টিম বাক্সগুলো জব্দ করলো। তবে হোটেলের ভেতরে পাচারচক্রের লোকজনও ঘাপটি মেরে আছে—এটা সবাই জানে।
অরি রাজকে আলাদা ডেকে বললো—
"তুই সাবধানে থাকিস। এরা খুব হিংস্র। ক্যামেরা দেখলে এরা সাংবাদিক মনে করে আর সাংবাদিক মানে ওদের চোখে শত্রু।"
রাজ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো।
বিভূবাবু কিন্তু চাপা কৌতুকে ভর দিয়ে বললেন—
"আমার বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু রসিকতা করতে করতে গুপ্তচর ধরা যায়, এটা তোমরা কালই দেখবে।"
অরির ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটলো, তবে চোখে ভেসে উঠলো গভীর চিন্তা।
কারণ ও জানতো—এই কেসটা এখানেই শেষ নয়। পাকিস্তানি যোগসূত্র মানে, আগামী দিনগুলোয় খেলা হবে অনেক বেশি বিপজ্জনক।
রণজিৎ সিং ম্যানেজারকে চতুর্থ তলায় তদন্ত করতে সাহায্য করতে বললো
রহস্যময় দরজা
তাদের দল হোটেলের চতুর্থ তলায় পৌঁছলো। এক কোণে একটা রুম—৩০৪। বাইরে থেকে তালা দেওয়া, কিন্তু দরজার নিচ থেকে হালকা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আছে।
অরি নিচু হয়ে কাগজটা টেনে নিলো। দেখল তাতে অদ্ভুত সব চিহ্ন আর অক্ষর—
Δ-9 / PZK / S-22
রবি-শুক্র
KASH-7
রাজ অবাক হয়ে বলল, "এগুলো আবার কী!"
অরি চোখ ছোট করে দেখল, তারপর খালি কাগজ বের করে কয়েকটা লাইন টানল।
অরি:
"এগুলো আসলে শিফার কোড। Δ-9 মানে ফ্লাইট কোড, PZK মানে পাকিস্তানের করাচি এয়ারপোর্টের শর্টকাট। S-22 হয়তো সিট বা রুট নাম্বার। KASH-7—এটা হয়তো কাশ্মীরের যোগাযোগ কেন্দ্রের ইঙ্গিত।"
রণজিৎ সিং হালকা আতঙ্কে বললেন,
"মানে পাচারচক্রের শিকড় সরাসরি পাকিস্তান পর্যন্ত?"
অরি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো,
"একদম। আর রবি থেকে শুক্রবার পর্যন্তই হয়তো ওরা পাচারের রুট ব্যবহার করে। এই কাগজ প্রমাণ।"
অন্ধকারের ভেতর
হঠাৎই করিডোরের লাইট দু-একবার টিমটিম করে নিভে গেল। বিভূ বাবু চাপা গলায় বললেন—
"আলো নিভে গেলে অন্ধকার বাড়ে, কিন্তু অন্ধকারেই দেখা যায় আসল মুখোশ।"
অরি ঝট করে রাজকে বলল—
"ক্যামেরা রেডি রাখো, কিছু একটা ঘটতে চলেছে।"
সত্যিই, ঠিক পরের মুহূর্তে ৩০৪ নম্বর রুমের ভেতর থেকে হালকা একটা ঠক্ শব্দ শোনা গেল। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
পাকিস্তানি এজেন্ট ধরা
দরজা ভাঙতেই ভেতরে দেখা গেল এক মধ্যবয়সী লোক, হাতে ল্যাপটপ, খোলা ট্রাভেল ব্যাগে কিছু নথি। পুলিশের হঠাৎ উপস্থিতিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
অরি এগিয়ে গিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল—
"আপনার নাম কী?"
লোকটা প্রথমে হিন্দিতে গড়গড় করে উত্তর দিলো, তারপর ইংরেজিতে ঘুরিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার পাসপোর্ট আর ল্যাপটপে স্পষ্ট লেখা—
"Mohammad Aslam – Karachi"।
রাজ হতভম্ব হয়ে গেল, "মানে এ লোকটা পাকিস্তানি এজেন্ট!"
ঠিক তার পাশের একটা ঘর থেকে মেয়েদের কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই অরি রাজ সজোরে দরজায় লাঠি মেরে দরজা টা খুলে দেখলো ১৫ ১৬ বছরের ২০ ২৫ জন মেয়ে সেই ঘরে বন্দি। পুলিশের দলবল ঘরে ঢুকে মেয়েদের বের করে তাদের হেপাজতে নিয়ে নিলো
অরি শান্তভাবে পুলিশের দিকে ঘুরে বলল—
"স্যার, এবার আর সন্দেহ নেই। জয়পুরের পাচারচক্র পাকিস্তানের সাথেই জড়িত। এদের লক্ষ্য শুধু মানব পাচার নয়, অঙ্গ পাচারও।"
রণজিৎ সিং এক লাফে এজেন্টকে গ্রেপ্তার করলেন।
রণজিৎ সিং বললো হোটেল ম্যানেজারের জেরা করতে হবে
ম্যানেজার—এক লম্বা, ফর্সা মানুষ, নাম মৃণাল শুক্লা। সাদা শার্ট, নীল টাই, কিন্তু মুখে ঘাম জমেছে।
রণজিৎ সিং (কঠিন গলায়):
"মি. শুক্লা, আপনার হোটেলে একজন পাকিস্তানি এজেন্ট এতদিন রুম ভাড়া নিয়ে থাকছে, অথচ আপনাদের কোনো ধারণাই নেই? আপনার হোটেলে এতগুলো মেয়ে উপরে বন্দি আপনি কিছু জানতেন না ? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?"
ম্যানেজার ঠোঁট শুকিয়ে বলল—
"স্যার, আমরা তো অতিথিদের ভিসা–পাসপোর্ট দেখে তবেই এন্ট্রি দিই। উনি নিজেকে দুবাইয়ের ব্যবসায়ী বলেছিলেন। এতো বড় বিষয় জানলে নিশ্চয়ই…" আর আমি সত্যি জানি না মেয়ে হলো এখানে করা কি ভাবে নিয়ে এলো
অরি হঠাৎ থামিয়ে দিলো।
"আপনার কথায় অসংগতি আছে। উনি চেক–ইনের সময় যে পাসপোর্ট নম্বর লিখেছেন, সেটা আর তার ব্যাগে পাওয়া পাসপোর্ট মিলছে না। আপনার ফ্রন্ট ডেস্ক এটা খেয়ালই করল না?"
ম্যানেজার অস্থির হয়ে গেল।
"মিস দত্ত, আমি… আমি হয়তো অসতর্ক ছিলাম। কিন্তু…"
অরি গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল—
"অসতর্কতা আর যোগসাজশ—দুটো কিন্তু আলাদা। এখন আপনিই আমাদের জানাতে পারবেন, এজেন্ট আসলাম কি একা এসেছিল, নাকি অন্য কেউ সঙ্গে আছে না কি আপনিই সরাসরি এই পাচারের সাথে যুক্ত ?"
ম্যানেজার চুপ। ঠোঁট কাঁপছে। রাজ কাছে এসে গর্জে উঠল,
"বলুন! নইলে আপনাকেও আমরা সহযোগী ধরে গ্রেপ্তার করব।"
অবশেষে ম্যানেজার স্বীকার করল—
"হ্যাঁ… উনি একা ছিলেন না। হোটেলের স্টাফদের মধ্যেই কয়েকজন তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। আমি… ভয় পেয়ে চুপ ছিলাম।"
স্টাফদের জেরা
হোটেলের তিনজন কর্মী—একজন কিচেন সুপারভাইজার, একজন রুম সার্ভিস বয়, আর একজন সিকিউরিটি গার্ডকে আলাদা ঘরে নিয়ে জেরা শুরু হলো।
অরি (কিচেন সুপারভাইজারকে):
"তুমি আসলামের জন্য বিশেষ খাবার দিতেই বা কেন?"
লোকটা তোতলাতে তোতলাতে বলল,
"ম্যাডাম, আমি যা বলত সেটা দিতাম। উনি মাঝে মাঝে প্যাকেটবন্দি কিছু বাক্স রাখতেন ফ্রিজে। আমি জিজ্ঞেস করলে বলতেন—ঔষধ।"
অরি মৃদু হাসল,
"ঔষধ না, ওগুলো অঙ্গ পাচারের জন্য রাখা অঙ্গ। তোমার চোখে পড়েছিল?"
লোকটা সন্ত্রস্ত হয়ে মাথা নেড়ে ফেলল।
এবার রুম সার্ভিস বয়কে জেরা করল।
সে ভয়ে কাঁপছে।
"আমি শুধু বার্তা পৌঁছে দিতাম, ম্যাডাম। ছোট ছোট চিরকুট। কখনো লন্ড্রি ব্যাগের ভেতরে লুকিয়ে দিতেন।"
অরি কাগজগুলো মিলিয়ে দেখল—সব কোডেড মেসেজ পাকিস্তানি নেটওয়ার্কের দিকে যাচ্ছে।
কোড ভাঙার খেলা
এরপর অরি ল্যাপটপ হাতে নিলো। ল্যাপটপ পাসওয়ার্ড চাইছে।
অরি ফিসফিস করে বলল—
"ধাঁধার উত্তর তো সব জায়গাতেই থাকে।"
সে কাগজের কোডটা আবার পড়লো। Δ-9 / PZK / S-22…
অরি কীবোর্ডে লিখল "PZKS22"—
ক্লিক! স্ক্রিন খুলে গেল।
ভেতরে একটা লুকানো ইমেল চেইন। তাতে লেখা—
"Shipment confirmed. Next transfer via Jaipur–Lahore route."
অরি ধীরে ধীরে শ্বাস নিলো।
"খেলা শুরু হয়েছে। এবার প্রমাণ হাতে। কিন্তু চক্রটা অনেক বড়। শুধু এই এজেন্টকে ধরলে চলবে না।
ঠিক তখনই লাইট চলে গেল। করিডোর অন্ধকার। হঠাৎ গুলির শব্দ। পাকিস্তানি এজেন্টদের আরও একদল ভেতরে ঢুকেছে।
পুলিশ আর ওদের মধ্যে তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো।
অরি রাজকে টেনে ল্যাপটপ, নথি আর আসল প্রমাণ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।
কিন্তু এক মুখোশধারী হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল, হাতে বন্দুক।
রাজ গর্জে উঠল—
"আমাদের মারলে প্রমাণ তোমাদের হাতেই ধরা পড়বে!"
অরি ঠান্ডা মাথায় একটা সাদা কাপড় মাটিতে ছুড়ে দিলো। মুহূর্তেই মুখোশধারী বিভ্রান্ত হলো। সেই সুযোগে রাজ তাকে ধরাশায়ী করে ফেলল।
রাতভর অভিযান শেষে ভোরবেলায় হোটেলের লবি জুড়ে শান্তি ফিরে এল।
ম্যানেজার মৃণাল শুক্লা, তিন স্টাফ আর ধরা পড়া পাকিস্তানি এজেন্টরা পুলিশের হেফাজতে।
রণজিৎ সিং বললেন,
"মিস দত্ত, আজ যদি তুমি না থাকতে, এই চক্র কোনোদিন ধরা পড়ত না।"
অরি মৃদু হেসে বলল,
"খেলা শেষ হয়নি, স্যার। চক্রটা বড়, কিন্তু জয়পুরের হাব ধ্বংস হলো আজ। বাকিদের খোঁজ আমরা নিশ্চয়ই পাব।"
রাজ জানালার বাইরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
"এবার আমাদের নামের তালিকায় ওরা কাকে রেখেছে, কে জানে!"
বিভূ বাবু হাসলেন,
"ধাঁধা শেষ হলে নতুন ধাঁধা শুরু হয়। তার উত্তর খুঁজতেই তো জীবন।"
রণজিৎ সিং অরি , রাজ ও বিভু বাবুকে একটা গেস্টহাউস ঠিক করে দিলো। ওরা সেই গেস্টহাউসে গিয়ে উঠলো।
জয়পুরের নিস্তব্ধ বিকেলে অরি ও রাজ পৌঁছেছিল সরকারি গেস্টহাউসে। জায়গাটা ছিল নির্জন, শহর থেকে খানিকটা বাইরে।
তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল DSP রণজিত সিং—একজন কঠোর, সোজাসাপ্টা পুলিশ অফিসার।
বিভূ বাবু "আরে বাবারে! এ গেস্টহাউসের চেহারা তো একেবারে ভূতের বাড়ির মতো!"
অরি হাসল, "ভূত থাকলে আপনি তো আমাদের আগে দেখতে পাবেন। আমরা নিশ্চিন্ত।"
গেস্টহাউসের ভেতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত নীরবতা টের পাওয়া গেল।
পুরো ভবনটা যেন অনেকদিন ধরে ব্যবহার হয়নি। করিডোরের দেয়ালে পুরোনো ছবি, ধুলোমাখা ঝাড়বাতি, কাঠের সিঁড়ি—সব মিলিয়ে যেন সময় থমকে আছে।
রাজ প্রথমেই ক্যামেরা বের করল।
"আরে! দারুণ জায়গা। ফিল্মের সেটের মতো লাগছে।"
ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলতে লাগল।
বিভূ বাবু একেবারে ভুরু কুঁচকে বললেন—
"চুপ! এতসব ছবি তোলার কী দরকার? আমার বুকের ভেতরেই তো ক্যামেরা চলছে। প্রতিটা শব্দ ধুপ করে লাগছে।"
অরি কিছু না বলে ঘরের কোণ, জানলার ফাঁক, দরজার তালা—সব খুঁটিয়ে দেখছিল।
তার চোখে স্পষ্ট অস্বস্তি।
প্রথমেই তারা যেই ঘরে উঠল, সেটার জানলার কাচে ফাটল। কাঠের ফ্রেমে পোকায় খাওয়া দাগ।
রাজ মজা করে বলল—
"এখানে ভূত আসলে জানলার কাচ দিয়ে উঁকি মারবে।"
বিভূ বাবু চমকে উঠে বললেন—
"কী? ভূত?"
তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
"শোনো, আমি আগে থেকেই বলছি—এখানে কোনো অদ্ভুত জিনিস হলে আমাকে সামনে রেখো না। আমি প্রথমে পালাব।"
অরি হেসে শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল—
"শত্রু যদি থাকে, তবে সে মাংস আর রক্তের মানুষ। ভুতের চেয়ে তাদের ভয় বেশি।"
করিডোরের শেষ প্রান্তে ছোট একটা রান্নাঘর। এক বৃদ্ধ কর্মচারী চুপচাপ চা বানাচ্ছিলেন।
চায়ের ট্রে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন—
"মেমসাহেব, রাতের পর বাইরে যাবেন না। এদিকটা ফাঁকা এলাকা। হামেশাই অচেনা লোক ঘোরাঘুরি করে।"
রাজ জিজ্ঞেস করল—
"অচেনা লোক মানে? কেমন লোক?"
বৃদ্ধ একবার চারপাশে তাকালেন, তারপর নিচু স্বরে বললেন—
"কারা আসে, কোথা থেকে আসে—আমি জানি না। তবে রাতে মাঝে মাঝে সাদা গাড়ি এসে থামে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়।"
অরি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল।
তার ঠোঁটে হালকা হাসি খেললেও চোখে অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা।
"তাহলে এই গেস্টহাউসটা খালি নয়। বাইরে থেকে ছায়ারা আসে।"
বিভূ বাবু গিলে ফেললেন এক চুমুক চা, তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন—
"এই যে, আমি কিন্তু ঘুমাতে চাই। রাতে যদি বোম-টোম পড়ে তবে আমাকে আগে খবর দিয়ো।"
রাজ হেসে উঠল।
"আপনাকে খবর দেব কেন? আপনি তো এমনিতেই আওয়াজ শুনবেন বোমা কি শুধু আমাদের জন্য ফাটবে?'"
অন্ধকার নামতে নামতে গেস্টহাউসটা আরও বেশি নিঃশব্দ হয়ে গেল।
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর করিডোরে অকারণে হাওয়া বইছে—সব মিলিয়ে পরিবেশটা ক্রমশ ভৌতিক হয়ে উঠল।
কিন্তু অরি জানত—
এ নিঃশব্দতায় ভয় নেই।
ভয় আছে ছায়ায়, যেখানে লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা শুধু ভয়ঙ্কর নয়—অমানবিকও।
অনেক বড় সংঘাতের পর একটু বিশ্রাম ও কিছু সময় রোমান্টিক মুহূর্ত ।
পাশের ঘরে বিভু বাবু ঘুমোচ্ছেন। মনে হয় যেও তার জীবনে এমন কিছুই ঘটে নি
রাজ ল্যাপটপে ছবিগুলো ঘাঁটছিল, অরি টেবিলে ফাইল ছড়িয়ে রেখেছে। পাশের ঘরে বিভু বাবু হাই তুলতে তুলতে বলছিলেন—
"আহা! এত ফাইল–টাইল দেখে লাভ কী? শেষে তো আবার প্রমাণ হবে, ভাতের হাড়িতে ইলিশের আঁশটুকু নেই।"
অরি ভ্রু কুঁচকে তাকালেও রাজ হেসে ফেলল।
ঠিক তখনই—
ধুম্!
গেস্টহাউসের সামনের উঠোন কেঁপে উঠল এক প্রচণ্ড শব্দে। সঙ্গে সঙ্গেই আগুনের শিখা উঠে গিয়ে জানলার কাচ ভেঙে অরিদের ঘরে ঢুকে পড়ল। পর্দা মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
অরি বিদ্যুতের মতো ছুটে গিয়ে জলের জগ ছুঁড়ে দিল পর্দার উপর। রাজ ক্যামেরাটা বুকে চেপে ধরে দরজার দিকে তাকাল, যেন শত্রুর ছবি তুলতে প্রস্তুত।
আর বিভূ বাবু?
প্রথম শব্দ হতেই তিনি খাট থেকে খৎ করে মাটিতে গড়ালেন। কিন্তু ওঠার বদলে হামাগুড়ি দিতে দিতে সোজা বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে পড়লেন। মুখে চিৎকার—
"মোরে গেলাম গো! মোরে গেলাম গো!
বউমা, আমার শেষ ইচ্ছেটা শুধু এটাই—আমাকে কাল ভোরে দুধ–পাওরুটি খেতে দিও।"
অরি হেসে ফেললেও চুপ থাকার উপায় ছিল না। পরিস্থিতি ভয়াবহ।
"বিভূ বাবু, নাটক বন্ধ করুন! বাইরে বোমা ফেটেছে, যেকোনো মুহূর্তে আরেকটা হতে পারে।"
বিভূ বাবু হাঁপাতে হাঁপাতে উঠলেন, জামার ধুলো ঝেড়ে বললেন—
"আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম বোমার শব্দ শুনেই স্বর্গে ডাক পড়েছে। তাই আগেভাগেই প্র্যাকটিস করে নিলাম।"
রাজ চোখ ঘুরিয়ে বলল—
"আপনার প্র্যাকটিসে যদি পুরো গেস্টহাউসটা উড়ে যায়, তখন কে আপনাকে মঞ্চ দেবে?"
এই হাস্যরসের ফাঁকেও অরি জানত, ব্যাপারটা মোটেই তামাশা নয়। বোমাটা কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়, স্পষ্টতই তাদের টার্গেট করা হয়েছে।
সে জানলার ফ্রেম থেকে গলে যাওয়া কাচ সরিয়ে বাইরে তাকাল। গলির শেষে কয়েকটা ছায়া দ্রুত সরে যাচ্ছে। অরি বুকের ভেতরে চাপা শীতল আগুন অনুভব করল।
"খেলা সত্যিই শুরু হলো," সে ফিসফিস করে বলল।
"এবার প্রতিপক্ষ জানিয়ে দিল, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা লক্ষ্য করছে।"
বিভূ বাবু হাত নেড়ে বললেন—
"তাহলে আমি আজ রাতেই চেক–আউট করে যাব! বোমা–টোমার খেলা আমার পক্ষে নয়।"
অরি কড়া স্বরে তাকালেন।
"আপনি নড়বেন না, বিভূ বাবু। কারণ আপনার 'বোমার শব্দে হামাগুড়ি' আমাদের শত্রুকেই হাসাবে।"
রাজ হেসে উঠল।
"ঠিকই অন্তত কমেডি রিলিজার হিসেবে উনিই আমাদের টিমের গোপন অস্ত্র।"
গেস্টহাউসের ভাঙা জানালা দিয়ে রাতের আকাশে ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছিল। বাইরে পাখিরা চমকে উড়ে গেছে, কুকুরগুলো হু হু করে ডাকছিল। অথচ ঘরের ভেতরে তিনজন মানুষ—ভয়, উত্তেজনা আর হাসির মিশেলে—নতুন অধ্যায়ের প্রথম পাতায় পা রাখছিল।
গেস্টহাউসের ভাঙা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছিল, কিন্তু ঘরের ভেতরে সবাই ঘামছে। বিস্ফোরণের ধোঁয়া এখনও হালকা ভেসে আছে।
অরি মাটির থেকে কুড়িয়ে আনা সার্কিটের টুকরো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল।
রাজ জিজ্ঞেস করল,
"এই সার্কিটটা তো কোনো লোকাল জিনিস নয়। কোথা থেকে এসেছে?"
অরি গম্ভীর গলায় বলল,
"এই ধরনের মাইক্রো-চিপ পাকিস্তান আর দু-একটা দেশের সেনা ছাড়া কেউ ব্যবহার করে না। এরা শুধু ভয় দেখাতে আসেনি, ওরা চায় আমরা চুপ হয়ে যাই।"
বিভূ বাবু কোণ থেকে হাত তুলে বললেন,
"মানে আমাদের চুপ করাবেই? এহেন দেশে জন্ম নিলাম বলে দুঃখিত! আমি কাল সকালেই কলকাতার ট্রেনে উঠছি।"
অরি উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়ভাবে বলল,
"এই বোমাটা আমাদের জন্য বার্তা—ওরা বুঝেছে আমরা সত্যের কাছে চলে এসেছি। এখন যদি দেরি করি, আরও কত নিরীহ মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে।"
ঠিক সেই সময় DSP রণজিত সিং গেস্টহাউসে এলেন।
মুখ শক্ত, চোখে রাগ।
"এটা শুধু পাচারচক্র নয়। এরা পাকিস্তানের এজেন্ট। ছোট ছোট মেয়েদের সীমান্ত পেরিয়ে পাচার করছে। আর এখন আমাদের থামাতে চাচ্ছে।"
অরি গম্ভীর হয়ে বলল—
"কিন্তু এরা একা নয়। এদের ভেতরে ভরসা দেওয়ার মতো কেউ আছে। এমন শক্তিশালী সুরক্ষা, ডকুমেন্ট, পারমিট—এসব লোকাল গুন্ডাদের হাতে আসে না।"
রাজ চাপা গলায় বলল—
"মানে ভেতরে কোনো গদ্দার আছে?"
অরি ধীরে মাথা নাড়ল।
বিস্ফোরণের পর গেস্টহাউসের চারপাশটা যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
দু'পাশে পুলিশ ব্যারিকেড, ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠেছে, আর কনস্টেবলরা দৌড়োদৌড়ি করছে।
অরি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। তার চোখে সেই চিরচেনা ভাব—যখন মস্তিষ্ক একসঙ্গে হাজারটা সূত্র গাঁথতে থাকে।
রণজিত সিং এগিয়ে এলেন।
"আমরা চারদিকে তল্লাশি চালালাম। বোমার টুকরো পাওয়া গেছে, মিলিটারি গ্রেড বিস্ফোরক। আর যে গাড়িটা পালিয়েছে, সেটা নম্বরপ্লেটবিহীন।"
অরি হালকা মাথা নাড়ল।
"মানে, কাজটা অপেশাদারদের নয়। এর পেছনে সংগঠিত একটা নেটওয়ার্ক আছে।"
রাজ ক্যামেরার ডিসপ্লেতে ছবি দেখাচ্ছিল।
"দেখুন, আমি বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা ছবি তুলেছি। গাড়িটা কালো SUV, জানালার কাচ কালো ফিল্মে ঢাকা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অন্তত তিনজন বসেছিল।"
রণজিত সিং ছবি দেখে চোয়াল শক্ত করলেন।
"আমরা শহরের সব এন্ট্রি পয়েন্টে বার্তা পাঠাচ্ছি। গাড়িটা বেশি দূর পালাতে পারবে না।"
এইসময় বিভূ বাবু ব্যান্ডেজ বাঁধা হাঁটু নিয়ে এসে দাঁড়ালেন।
"শোনো দাদা, একটা কথা বলি? এই যে বোমা টোমা ফাটাল—এ সব কি আসলেই আমাদের উদ্দেশ্যে, নাকি ভুলবশত অন্য কারও জন্য?"
অরি তাকাল বিভূ বাবুর দিকে।
তার ঠোঁটে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি।
"ভুলবশত কেউ সরকারী গেস্টহাউসে বোমা ফাটায় না, বিভূ বাবু। আমাদের ট্র্যাক করেই এখানে এসেছে।"
বিভূ বাবু থতমত খেয়ে গলা নামালেন।
"মানে আমরা একেবারে টার্গেট! ওফ বাবা, আমার তো বুক ধড়ফড় করছে।"
রাজ মুচকি হেসে বলল—
"আপনার বুক যদি না ধড়ফড় করত, তবেই তো অদ্ভুত হতো।"
এরপর অরি ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে করতে ধীরে ধীরে বলল—
"শত্রুরা শুধু বাইরে নেই। গেস্টহাউসের অবস্থান জানত কজন? আমরা, রণজিত সিং, আর সরকারের ভেতরের কয়েকজন। তবু ওরা এত তাড়াতাড়ি লোকেশন পেয়ে গেল। এর মানে… খবর ভেতর থেকেই গেছে।"
রণজিত সিং কপালে হাত বুলিয়ে বললেন—
"মানে, ভেতরে কোনো 'মোল' আছে?"
অরি চুপ করে মাথা নেড়ে জানালার বাইরে তাকাল।
দূরে আগুনের শিখা তখনও লেলিহান হয়ে জ্বলছে।
সে গম্ভীর গলায় বলল—
"হ্যাঁ। দেশের ভেতরেই কেউ ওদের হাতিয়ার। সেই মানুষটা খুঁজে বের করাই এখন প্রথম কাজ।"
করিডোরের বাতি দপ দপ করে জ্বলে উঠল।
বাতাসে যেন একটা অদ্ভুত সিগন্যাল—
যুদ্ধ এখন কেবল শুরু।
বিস্ফোরণের পরের দিন ।
অরি আর রাজ দিনভর লোকাল সূত্র খুঁজে বেড়াল।
শেষে যে তথ্যটা হাতে এল, তাতে ছবিটা একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল—
শহরের বাইরে, প্রায় নির্জন জায়গায় একটা পুরোনো রাজবাড়ি বা হাভেলি।
লোকমুখে শোনা যায়, রাতে সেখানে আলো জ্বলে ওঠে, গাড়ি ঢোকে, আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিন্তু স্থানীয়রা কেউ কাছ ঘেঁষে না।
সন্ধে নামতেই অরি, রাজ আর বিভূ বাবু রওনা দিল।
সঙ্গে রণজিত সিং আর তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অফিসার।
হাভেলির ফটকটা লোহার তৈরি, মরচেধরা।
কিন্তু ফটকের ঠিক ভেতরেই নতুন টায়ারের দাগ।
রাজ ক্যামেরায় ক্লিক করল।
অরি নিচু গলায় বলল—
"এটাই ওদের আস্তানা। পাচারের যাবতীয় রসদ এখানে জমা হচ্ছে।"
বিভূ বাবু গলার স্বর নামিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন—
"হায় রে, আমি যে ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম, সে ভ্রমণ এখন সোজা নরকে নিয়ে যাচ্ছে।"
রণজিত সিং হাত তুলে ইশারা করলেন।
পুলিশরা নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
ভেতরে ঢুকতেই একেবারে ভুতুড়ে দৃশ্য।
বড় হলঘরের ভেতর সাদা সাদা বাক্সের সারি।
কিছু বাক্স খোলা—ভেতরে মেয়েদের পোশাক, বিদেশি সিগারেট, আর কিছু নকল পাসপোর্ট ছড়ানো।
রাজ নিচু স্বরে ফিসফিস করল—
"মানে, এরা শুধু পাচার নয়, পরিচয় বদলের পুরো চক্র চালাচ্ছে।"
অরি একটা পাসপোর্ট তুলে দেখল।
"হ্যাঁ। এই মেয়েদের নাম মুছে দেওয়া হয়। পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরিচয় দেওয়া হয়।"
হঠাৎ পেছন দিক থেকে কড়া কণ্ঠ ভেসে এল—
"হাত উপরে তুলুন!"
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল তিনজন লোক।
মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। হাতে অত্যাধুনিক বন্দুক।
বিভূ বাবু একেবারে কাঁপতে কাঁপতে হাত তুললেন।
"হায় গো, আমি কিন্তু একেবারে নিরীহ পর্যটক। আমার হাতে শুধু গ্যাসট্রিকের ওষুধ আছে।"
একজন বন্দুকধারী তাচ্ছিল্য করে বলল—
"চুপ! বেশি কথা বললেই ওষুধ লাগবে না। গুলি খেয়েই শেষ।"
কিন্তু সেই মুহূর্তেই চারপাশ থেকে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল।
চিৎকার, গুলির শব্দ, লোহার সাথে লোহা ঠোকার আওয়াজে পুরো হাভেলি কেঁপে উঠল।
অরি বজ্রগতিতে এক দুষ্কৃতীর বন্দুক মাটিতে ফেলে দিল।
রাজ ক্যামেরা নামিয়ে লাঠির আঘাতে আরেকজনকে আঘাত করল।
বিভূ বাবু?
তিনি একেবারে ভয়ে কোণে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বিড়বিড় করছেন—
"ও মা, জয় কালী, জয় মা দুর্গা! আমি যদি বেঁচে ফিরি, এবার থেকে আর ভ্রমণ করব না।"
কিছুক্ষণের ভেতরেই দুষ্কৃতীরা কাবু।
বাক্সভর্তি প্রমাণ, বিদেশি যোগাযোগের নথি, আর একটা মোটা ফাইল উদ্ধার হলো।
অরি ফাইল খুলতেই ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফুটল।
"অবশেষে পাওয়া গেল সেই নাম… যে ভেতর থেকে পুরো খেলা চালাচ্ছিল।"
রাজ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল—
"কে?
অরি গম্ভীর স্বরে বলল—
"দেশের ভেতরেই উচ্চপদে বসা এক মানুষ… যার ওপর আমরা ভরসা করি।"
হাভেলির অভিযান শেষে ভোর হয়ে এসেছিল।
পুলিশের গাড়িতে করে বাক্সভর্তি প্রমাণ, নকল পাসপোর্ট আর ধৃত দুষ্কৃতীরা নিয়ে আসা হলো জয়পুর সদর দফতরে।
অরি আর রাজ সোজা বসলেন কনফারেন্স রুমে।
রণজিত সিং তাদের সামনে সেই উদ্ধার হওয়া মোটা ফাইলটা রাখলেন।
ঘরে তখন নিস্তব্ধতা।
অরি পাতা উল্টাতে উল্টাতে ধীরে ধীরে পড়ছিল।
প্রথমে টাকার লেনদেনের হিসেব, তারপর বিদেশি ব্যাংকের রিসিট, তারপরে—
একটা সরকারি চিঠি, অফিসিয়াল প্যাডে লেখা।
সই দেখে অরির চোখ সরু হয়ে এল।
রাজ এগিয়ে এসে নামটা পড়ল।
গলা শুকিয়ে গেল তার।
"অশোক ভার্মা, যুগ্মসচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।"
ঘরে তখন মুহূর্তের জন্য কেবল টেবিলের ওপর ফাইলের পাতাগুলো উল্টে যাওয়ার শব্দ।
রণজিত সিং থমকে দাঁড়ালেন।
"মানে… ভার্মা সাহেব? উনি তো দিল্লিতে বসে গোটা দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন! এ অসম্ভব!"
অরি ঠান্ডা গলায় বলল—
"অসম্ভবকে সম্ভব করেই ওরা এতদিন টিকে ছিল। বাইরে থেকে পাকিস্তানি এজেন্ট, ভেতরে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই জোট না হলে মেয়েদের পাচার, বিস্ফোরক ঢোকানো—এসব এত সহজে সম্ভব হতো না।"
রাজ টেবিলে মুষ্টি মেরে বলল—
"অবিশ্বাস্য! যে মানুষকে আমরা দেশের রক্ষক ভাবি, সেই দেশেরই শত্রু হয়ে গেল!"
বিভূ বাবু একেবারে হতবুদ্ধির মতো বললেন—
"আরে বাবা, তাহলে তো শত্রু আমাদের গৃহের ভেতরেই! আমি ভেবেছিলাম সিনেমাতেই এসব হয়।"
অরি কাগজটা রণজিত সিং-এর হাতে দিল।
"এখন আর দেরি করার সময় নেই। ভার্মা শুধু পাচারের অংশীদার নয়, ওর হাতেই দেশের ভেতরকার গোটা তথ্য বাইরে চলে গেছে। যতক্ষণ না ওকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা নিরাপদ নই।"
পরের দিন ।
অরি, রাজ, বিভূ বাবু আর রণজিত সিং গোপনে দিল্লি পৌঁছালেন।
সন্ধ্যায় ভার্মার অফিসে হানা দিলেন সিবিআই-এর বিশেষ টিম নিয়ে ।
ভার্মা তখন নিজের কেবিনে বসে চা খাচ্ছিল।
হঠাৎ দরজা ঠেলে পুলিশ ঢুকল।
রণজিত সিং কড়া গলায় বললেন—
"অশোক ভার্মা, আপনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানবপাচার ও বিদেশি গুপ্তচরদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।"
ভার্মা প্রথমে হকচকিয়ে গেল।
তারপরই মুখে হাসি ফুটল।
"তোমরা ভেবেছ আমাকে ধরতে পারবে? আমি না থাকলেও আমার মতো আরও অনেকে আছে ভেতরে। ভারতকে দুর্বল করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।"
অরি এগিয়ে এসে ঠান্ডা চোখে তাকাল।
"তাহলে ভুল ভেবেছ। যতক্ষণ একজনও সত্যের জন্য লড়বে, তোমাদের ষড়যন্ত্র সফল হবে না।"
অশোক ভার্মাকে হাতকড়া পরানো হলো।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল।
রাজ ছবিগুলো তুলতে তুলতে ফিসফিস করে বলল—
"এই ছবি একদিন ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।"
বিভূ বাবু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—
"বাবা রে, কী ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম আর কী না দেখে ফেললাম! আমি তো ভেবেছিলাম গোটা ট্যুরে শুধু রাজস্থানি ভোজ আর হোটেলের লাল মোরগ খাব।"
অরি হালকা হেসে কাঁধে হাত রাখল বিভূ বাবুর।
"আপনি না থাকলে অনেক টেনশন ভাঙত না। ভয় আর রসিকতার মাঝেই বেঁচে থাকা।"
দিল্লির রাত।
শহরের আকাশে হালকা কুয়াশা, মন্ত্রক ভবনের সামনে ভিড় জমেছে সাংবাদিক আর টিভি চ্যানেলের ভ্যান।
অশোক ভার্মাকে যখন কালো কাচওয়ালা গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানিতে গোটা রাস্তা সাদা হয়ে উঠল।
অরি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তার চোখে ক্লান্তি আছে, কিন্তু সেই ক্লান্তির আড়ালে অদম্য দৃঢ়তা।
রাজ ক্যামেরা নামিয়ে বলল—
"এই মুহূর্তের ছবিগুলো গোটা দেশকে দেখাতে হবে। মানুষ জানতে পারুক, শত্রু কেবল সীমান্তের ওপারে নয়, আমাদের ভেতরেও লুকিয়ে থাকে।"
রণজিত সিং মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
"ভার্মার মতো মানুষরা যদি শাস্তি না পায়, তবে ত্যাগী অফিসারদের সব পরিশ্রম বৃথা যাবে। কাল থেকেই বিশেষ আদালতে মামলা শুরু হবে।"
বিভূ বাবু হাই তুলে বললেন—
"আচ্ছা, আমি কি এখন একটু ঘুমোতে পারি? তিন দিন হলো টানা টেনশনে আছি। আর আমার হাঁটুতে এখনও ব্যথা।"
অরি আর রাজ হেসে ফেলল।
এই মানুষটার উপস্থিতি না থাকলে হয়তো তারা চাপের তলায় দম আটকে যেত।
পরের দিন সকাল দিল্লির গেস্টহাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অরি চা খাচ্ছিল।
আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে।
রাজ কাগজ হাতে এসে বলল—
"অরি দেখো, আজকের হেডলাইন— 'দেশের অভ্যন্তরে বিশ্বাসঘাতক ধরা পড়ল, শিশু পাচার চক্র ভেঙে গেল।'"
অরি খবরটা পড়ল।
তারপর চুপ করে আকাশের দিকে তাকাল।
সেখানে পাখিদের সারি উড়ে যাচ্ছে।
"খেলা শেষ হয়নি, রাজ। এই নেটওয়ার্কের মাথা হয়তো আরও দূরে, সীমান্তের ওপারে। আমরা কেবল একটা স্তর ভেঙেছি।"
রাজ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল—
"মানে, আবারও নতুন খেলা শুরু হবে?"
অরি হালকা হেসে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিল।
"হ্যাঁ। প্রতিটা জয় কেবল পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি।"
বিভূ বাবু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন পাজামা আর শাল জড়িয়ে।
"আচ্ছা, তোমরা আবার নতুন খেলা খেলো। আমি কিন্তু এবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে শুধু রসগোল্লা খাব আর শান্তিতে ঘুমোব। দেশের জন্য যা করার সব তোমরা করেছো।"
আবারো যদি এই খেলায় নাবো আমাকে ডেকো
অরি, রাজ আর রণজিত সিং একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল।
সূর্যের আলো তখন সোনালি রঙে গেস্টহাউসের দেয়ালে পড়ছে।
এক অধ্যায় শেষ, কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে আরও অজানা পথ, আরও নতুন ষড়যন্ত্র, আর আরও লড়াই।
