কলকাতায় কলহ
কলকাতায় কলহ
কলকাতায় কলহ
কলকাতার আকাশে সেদিনও ভারী মেঘ জমেছিল। কিন্তু শহরের বাতাসের ভেতর আরও ভারী হয়ে ছিল এক অদৃশ্য আতঙ্ক।
প্রতিদিন সকালের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় শিরোনাম—
"টিটেনাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ১৫ বছরের কিশোরীর।"
"আবারও প্রাণ গেল ২০ বছরের তরুণীর।"
"টিটেনাসে শহরে মৃত্যু থামছে না।"
টিভি চ্যানেল খুললেই সারি সারি ব্রেকিং নিউজ। হাসপাতালে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর কান্নার ছবি যেন রক্তের দাগ হয়ে লেগে যায় অরিত্রির চোখে।
অরিত্রি দত্ত ( অরি )—পেশায় সাংবাদিক, বয়স তিরিশের কাছাকাছি। ছোট চুল, চশমার ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। শহরের নানা সামাজিক দুর্নীতির খবর খুঁজে বের করাই তার নেশা।
চা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খবর পড়তে পড়তেই তার ভ্রু কুঁচকে যায়।
সে নিজেকেই প্রশ্ন করে—
"টিটেনাস আজকাল তো এত মারাত্মক নয়। টিকা থাকলে এ রোগে মৃত্যু প্রায় অসম্ভব। তবে কেন একটার পর একটা মৃত্যু হচ্ছে?"
শহরের মানুষ আতঙ্কে ছটফট করছে, কিন্তু স্বাস্থ্য দপ্তর যেন ঘুমিয়ে আছে। মন্ত্রীদের মুখে শুধু আশ্বাস—"সব নিয়ন্ত্রণে আছে।"
অরি কাগজ ভাঁজ করে টেবিলে রাখল। চোখে একরাশ দৃঢ়তা।
সে জানে—এখানে কিছু একটা গড়বড় আছে।
হয়ত ভ্যাকসিনে সমস্যা।
হয়ত চিকিৎসা ব্যবস্থায় গাফিলতি।
অথবা এর পেছনে আরও বড় কোনো অন্ধকার রহস্য লুকিয়ে আছে।
অরি ঠিক করে—
সত্যটা সে বের করবেই।
এখনো সে জানে না, এই সিদ্ধান্ত তার জীবনকে এমন এক ভয়ঙ্কর পথে নিয়ে যাবে, যেখানে শুধু ভেজাল ওষুধ নয়, হাসপাতালের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে মৃত্যু, ষড়যন্ত্র আর রক্তমাখা অন্ধকার।
অরির সাংবাদিকতা মানেই সরাসরি মাঠে নামা। পরদিন ভোরে সে ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রওনা দিল শহরের এক উপকণ্ঠের হাসপাতালে।
হাসপাতালের বাইরে তখনো ভিড়। কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। সেদিনই মাত্র মারা গেছে দশ বছরের একটি মেয়ে—রিয়া।
রিয়ার বাবা-মা এক কোণে বসে নির্বাক। চোখ ফোলা, মুখ শুকনো। অরিত্রি ধীরে এগিয়ে গেল। নরম স্বরে বলল—
— "আমি অরিত্রি দত্ত , 'দৈনিক সংবাদ'-এর সাংবাদিক। আপনারা যদি কিছু বলতে পারেন, হয়তো আমরা সবাই সত্যটা জানতে পারব।"
রিয়ার মা ফুঁপিয়ে উঠলেন—
— "ওকে আমরা সব টিকা দিয়েছিলাম। ডাক্তার নিজের হাতে টিটেনাস ইনজেকশন দিয়েছিল। তবুও… তবুও…"
কথা শেষ করতে পারলেন না। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ল।
অরি মাথা নেড়ে সান্ত্বনা দিল, কিন্তু ভেতরে তার মনে সন্দেহ আরও ঘন হলো।
সে একই দিনে আরও তিনটি মৃত পরিবারের সাথে কথা বলল। আশ্চর্যের বিষয়—সবাই সময়মতো টিকা নিয়েছিল।
অরির চোখে ভেসে উঠল প্রশ্নচিহ্ন।
"তাহলে সমস্যা কোথায়?"
সন্ধ্যায় সে শহরের কয়েকটি বড় মেডিকেল স্টোর ঘুরল। কিছু টিটেনাস ভ্যাকসিন কিনল। চোখে পড়ল, একই কোম্পানির লোগো, কিন্তু অ্যাম্পুলের রঙ, মুদ্রণ আর ঢাকনার গায়ে সামান্য অমিল আছে।
অভিজ্ঞ চোখে বিষয়টা এড়িয়ে গেল না অরির।
সে সেগুলো একটি বিশ্বাসযোগ্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাল পরীক্ষা করার জন্য।
দুদিন পর ল্যাব থেকে রিপোর্ট হাতে পেল অরি । মোটা অক্ষরে লেখা—
"Sample: Tetanus Toxoid Vaccine – Result: Counterfeit. No active ingredient found."
অরির বুক কেঁপে উঠল।
মানে এই শহরে অসংখ্য মানুষকে দেওয়া হচ্ছে ভেজাল ভ্যাকসিন!
কাগজ শক্ত করে মুঠোয় ধরে সে ফিসফিস করে বলল—
"এখন আমি জানি, খেলা কোথায় হচ্ছে… কিন্তু কে করছে, সেটা বের করতেই হবে।"
এভাবেই অরি প্রথম সূত্র পেল।
এবং শুরু হলো এক বিপজ্জনক যাত্রা।
অরি রিপোর্ট হাতে পেয়ে আর দেরি করল না। সরাসরি ঢুকে গেল শহরের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট হাসপাতাল— সিটি কেয়ার মেডিকেল ইনস্টিটিউট।
চকচকে কাঁচের বিল্ডিং, লবিতে দামী সোফা, সামনে রিসেপশনে হাসিমুখে বসে থাকা কর্মীরা—সবকিছুই ঝলমলে। কিন্তু অরির মনে হচ্ছিল, এই চাকচিক্যের আড়ালে কিছু একটা ভয়ঙ্কর লুকিয়ে আছে।
হাসপাতালের করিডরে হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে দেখা হলো এক নার্সের। নাম মেঘলা দত্ত। বয়স বেশি নয়, হয়তো চব্বিশ-পঁচিশ। মুখে ক্লান্তি, চোখে ভয়।
অরিকে একপাশে টেনে নিয়ে সে ফিসফিস করে বলল—
— "আপনি কি ওই ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারির খবর বের করতে এসেছেন?"
অরি থমকে গেল।
— "আপনি জানেন কিছু?"
মেঘলা আতঙ্কিত চোখে চারদিকে তাকাল।
— "আমি সব জানি। এখানে ভেতরে যা চলছে, সেটা ভয়ঙ্কর। ডাক্তাররা, ম্যানেজমেন্ট—সবাই জড়িত। জাল ভ্যাকসিন, অঙ্গ পাচার, ব্ল্যাকমার্কেট… আমি কারও সাথে বললে বাঁচব না।"
অরির বুক ধড়ফড় করে উঠল।
— "আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন?"
মেঘলা কাঁপা গলায় বলল—
— "আমি আজ রাতে ডিউটির পর আপনাকে সব বলব। কিন্তু কাউকে কিছু বলবেন না, প্লিজ। নয়তো আমারও শেষ হয়ে যাবে।"
অরি শান্ত স্বরে আশ্বস্ত করল।
— "চিন্তা করবেন না। আমি আছি।"
কিন্তু সেই রাতে…
খবর এল— মেঘলা দত্ত মারা গেছে। হাসপাতালের রিপোর্ট বলল— "লিফট অ্যাকসিডেন্ট।"
অরির মাথায় যেন বাজ পড়ে গেল।
— "এটা কোনো অ্যাকসিডেন্ট নয়। এটা খুন।"
সে মেঘলার ডিউটি রুমে ঢুকে চারদিকে খুঁজল। লকারে হাতড়ে পেল একটি ছোট নোটবুক। পাতাগুলো ভর্তি ছেঁড়া ছেঁড়া লেখা।
তাতে একটি লাইন স্পষ্ট—
"আমি জানি হাসপাতালের পরিচালকরা ভেজাল ভ্যাকসিন বিক্রি করছে। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। যদি আমি মারা যাই, জানবেন এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়।"
অরির হাত কেঁপে উঠল।
সে বুঝল, সত্যের কাছে পৌঁছাতেই একে একে মানুষকে সরানো হচ্ছে।
এখন তার নিজের জীবনও ঝুঁকির মুখে।
রাত তখন প্রায় বারোটা। হাসপাতালের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে অরি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে মেঘলার সেই নোটবুক। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে, দূরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছে, কিন্তু তার কানে শুধু বাজছে একটাই কথা—
"যদি আমি মারা যাই, জানবেন এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়।"
অরি গাড়িতে বসে পাতাগুলো উল্টে দেখতে লাগল। ডায়েরি আসলে অগোছালো নোট—ডিউটির ফাঁকে লেখা ছোট ছোট বাক্য, অর্ধেক তথ্য, আতঙ্ক আর ছেঁড়া ছেঁড়া ইঙ্গিত।
কিছু জায়গায় লেখা—
"ভ্যাকসিন স্টোররুমে রাতে সন্দেহজনক বাক্স ঢুকছে। গার্ডরা কাউকে ঢুকতে দেয় না।"
"ডাক্তার সাহেব (ডিরেক্টরের নাম মুছে ফেলা) বিদেশি এজেন্টদের সাথে নিয়মিত মিটিং করছে।"
"অপারেশন থিয়েটারে হঠাৎ করে মৃতদেহ অদৃশ্য হয়ে যায়। পরে শুনেছি অঙ্গ পাচার।"
"আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি যদি মুখ খুলি, আমাকে মেরে ফেলবে।"
অরির গলা শুকিয়ে এল।
সে জানে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক ঝুঁকি আছে, কিন্তু এভাবে খুনের আতঙ্ক আগে কখনো এত কাছে আসেনি।
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা একটি লাইন তার বুক কাঁপিয়ে দিল—
"তারা কেবল ভ্যাকসিনেই নয়… গত চার বছরে যারা ডাক্তার-নার্স হঠাৎ মারা গেছে, তাদের মৃত্যুও পরিকল্পিত খুন।"
অরির চোখে ভেসে উঠল সেই সব খবরের শিরোনাম, যা সে গত বছরগুলোতে পড়েছে—
"যুবতী নার্স আত্মহত্যা।"
"জুনিয়র ডাক্তার হার্ট অ্যাটাকে মৃত।"
"রাতের ডিউটির পর গলায় দড়ি।"
সবই কি সাজানো খুন?
তার বুকের ভেতর চাপা রাগ জমতে লাগল।
"এখন আর শুধু ভেজাল ভ্যাকসিনের কেলেঙ্কারি নয়… এর পেছনে আছে হত্যার রাজনীতি।"
অরিত্রি চুপচাপ ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকাল। জানে—এখনই কারও উপর ভরসা করা যাবে না।
কিন্তু একটাই জিনিস নিশ্চিত—
এই সত্য ফাঁস করতেই হবে।
মেঘলার ডায়েরি হাতে পাওয়ার পর থেকে অরি দিনরাত অস্থির।
প্রমাণ তার হাতে আছে, কিন্তু এগুলো প্রকাশ করা মানেই মৃত্যু ডাক ডেকে আনা।
তবুও সে থামতে পারল না।
রাত দশটা। অরিত্রি ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে ল্যাপটপে রিপোর্ট টাইপ করছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
নম্বর অচেনা।
— "অরিত্রি দত্ত ?"
গলা ভারী, কর্কশ।
— "হ্যাঁ, কে বলছেন?"
কিছু সেকেন্ড নীরবতা, তারপর ঠান্ডা স্বর—
— "তদন্ত ছেড়ে দাও। ভ্যাকসিনের পেছনে মাথা ঘামিও না। নইলে তোমার নামও কালকের শিরোনামে আসবে।"
কল কেটে গেল।
অরির বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে গেল। তবুও সে নিজেকে সামলাল।
"তাহলে আমি সঠিক জায়গায় হাত দিয়েছি।"
পরের দিন অফিস যাওয়ার পথে লক্ষ্য করল, একটা কালো গাড়ি অনেক দূর থেকে তার পিছনে ঘুরছে। অরি বুঝল—এখন সে নজরবন্দি।
এই অবস্থায় একা লড়াই করা অসম্ভব। তার দরকার একজন ভরসাযোগ্য মানুষ—যে ভেতরের অন্ধকার চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে।
সন্ধ্যায় সে গোপনে দেখা করল পুলিশের এক পুরোনো পরিচিতের সাথে—দেবাশিস সেন।
দেবাশিস, সিআইডির অফিসার। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, চওড়া কাঁধ, চোখে দৃঢ়তা। দুর্নীতির কাছে মাথা নোয়ায় না বলে সহকর্মীদের মধ্যে আলাদা পরিচিতি আছে।
অরি নোটবুকটা তার সামনে রাখল।
সব শুনে দেবাশিস গম্ভীর হয়ে বলল—
— "তুমি যে আগুনের সাথে খেলছ, সেটা জানো তো?"
— "জানি, কিন্তু এই আগুনে না নামলে শহর জ্বলতে থাকবে।"
দেবাশিস মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল—
— "ভালো। তাহলে আমরাও নামব।"
দু'জনে ঠিক করল, প্রকাশ্যে কিছু না করে গোপনে তদন্ত চালাবে।
অরি ভেতর থেকে তথ্য জোগাড় করবে, আর দেবাশিস পুলিশি কৌশলে সিন্ডিকেটের ডালপালা ধরবে।
তখনো তারা জানত না—
এই খেলা কেবল ডাক্তার-হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে এমন শক্তি, যা সরকারকেও নড়িয়ে দিতে পারে।
শহরের আকাশে গুমোট অন্ধকার। চারদিকের বাতাসে অস্বস্তি যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে।
অরি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা পাল্টাল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় সাদা ওড়না, গায়ে সাধারণ স্যালোয়ার-কামিজ।
আজ সে সাংবাদিক নয়—একজন ইন্টার্ন নার্স।
হাসপাতালের এক ভেতরের সূত্র থেকে সে নকল আইডি কার্ড জোগাড় করেছে। নাম দেওয়া আছে—"অর্পিতা দত্ত, নার্সিং ট্রেইনি।"
সন্ধ্যা নামতেই সে সিটি কেয়ার মেডিকেল ইনস্টিটিউট-এর কর্মীদের সারির সাথে ভিড়ে গেল। কেউ সন্দেহ করল না।
করিডরের আলো ম্লান। সাদা দেয়ালে টাঙানো বড় বড় পোস্টার—"আমরা জীবন বাঁচাই।"
অরির ঠোঁটে তিক্ত হাসি ফুটল।
"এই দেয়ালের আড়ালেই লুকিয়ে আছে মৃত্যু।"
ডিউটির অজুহাতে সে ধীরে ধীরে চলে গেল বেজমেন্টের দিকে।
সেখানে স্টোররুম। দরজার পাশে দু'জন প্রাইভেট গার্ড দাঁড়িয়ে। সাধারণ নার্স হলে ঢুকতে দেওয়া হতো না, কিন্তু অরিত্রি আগেই মেঘলার নোটবুকে পড়েছিল— রাতে এখানে কিছু সন্দেহজনক বাক্স আসে।
গার্ডরা অন্যদিকে ব্যস্ত থাকতেই সে সাহস করে আধখোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে ঢুকেই শ্বাস আটকে গেল তার।
দশ-বারোটা কার্টন একসাথে সাজানো। গায়ে মোটা অক্ষরে লেখা—"টিটেনাস টক্সয়েড ভ্যাকসিন – মেডিকেয়ার ফার্মা।"
অরি কাছে গিয়ে দেখল, সিল ভাঙা, অ্যাম্পুলের লেবেল কাঁচা, অনেকগুলোতেই বানান ভুল।
পুরোপুরি নকল।
তখনই করিডরে পায়ের শব্দ।
অরিত্রি দ্রুত এক খালি আলমারির ভেতরে লুকোল।
ফাঁক দিয়ে দেখল—
দু'জন ডাক্তার, হাসপাতালের পরিচালক আর এক বিদেশি চেহারার লোক ভেতরে ঢুকল।
ডাক্তারদের একজন নিচু গলায় বলল—
— "আগামী সপ্তাহে আরও তিরিশ হাজার অ্যাম্পুল আসবে। বাজারে ছড়িয়ে দিলেই টাকা ডাবল।"
বিদেশি লোকটা ইংরেজিতে উত্তর দিল—
— "Good. And about the nurses who know too much?"
পরিচালক ঠান্ডা গলায় হাসল—
— "ওদের সমস্যা নেই। ওরা যদি মুখ খোলে, লিফট আবার নষ্ট হয়ে যাবে।"
সবাই হেসে উঠল।
অরির বুক কেঁপে উঠল।
সে মোবাইল বের করে তাড়াহুড়ো করে কিছু ভিডিও ফুটেজ রেকর্ড করল।
মুহূর্তটুকু যেন থেমে গেল তার কাছে।
"এটাই প্রমাণ। এটাই ওদের মুখোশ খুলে দেবে।"
কিন্তু সে জানত না—
এক গার্ড দূর থেকে তার ছায়া দেখে ফেলেছে।
রাত একটা।
অরি ঘামে ভিজে ফ্ল্যাটে ফিরল। ব্যাগের ভেতর মোবাইল ফোনে সযত্নে রাখা ভিডিও ফুটেজ—সিন্ডিকেটের আসল মুখোশ।
সে সঙ্গে সঙ্গেই দেবাশিস সেনকে ফোন করল।
— "প্রমাণ হাতে পেয়েছি। কাল ভোরে দেখা করব।"
ভোর পাঁচটা।
এক নির্জন কফিশপের পেছনের ঘরে অরি মোবাইলটা টেবিলে রেখে ভিডিও চালাল।
দেবাশিস গম্ভীর চোখে দেখল কিভাবে ডাক্তার, পরিচালক আর বিদেশি এজেন্ট হাসতে হাসতে ভেজাল ভ্যাকসিন আর খুনের পরিকল্পনা করছে।
ভিডিও শেষ হতেই দেবাশিস টেবিলে মুঠো চাপড়াল।
— "এবার শেষ খেলা হবে।"
তিনি ফোন তুলে সিআইডি টিমকে সতর্ক করে দিলেন।
ঝটিকা অভিযান
রাত দশটা বাজতেই শহরের চারদিকে সাইরেন বেজে উঠল।
সিআইডি ও পুলিশের যৌথ টিম একসাথে হানা দিল চারটি নামকরা হাসপাতালে এবং দুটি ফার্মাসিউটিক্যাল গুদামে।
সিটি কেয়ারের বেজমেন্ট ভেঙে পাওয়া গেল হাজার হাজার নকল টিটেনাস ভ্যাকসিন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির নথি, আর ব্যাগভর্তি টাকা।
অন্য হাসপাতালগুলোর গোপন কেবিন থেকে উদ্ধার হলো নকল সার্টিফিকেট, ব্ল্যাকমানির হিসাব খাতা, এমনকি মৃত রোগীর হারানো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের লিস্ট।
অভিযানের খবর মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই শহর উত্তাল হয়ে উঠল।
লোকজন হাসপাতালের বাইরে জড়ো হয়ে চিৎকার করছে—
"খুনিদের ফাঁসি চাই!"
মুখোশ খুলল
অভিযানে ধরা পড়ল কয়েকজন ডাক্তার, হাসপাতালের পরিচালক এবং গুদাম ম্যানেজার।
তাদের মুখে আতঙ্ক, তবুও কেউ সরাসরি কিছু বলতে চাইছে না।
কিন্তু হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় এক ডাক্তার হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—
— "আমাদের পেছনে আরও বড় শক্তি আছে! আমরা একা নই। মন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া এসব সম্ভব নয়!"
চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
অরির বুক কেঁপে উঠল।
"অবশেষে মুখ খুলতে শুরু করেছে।"
সেদিন রাতেই টিভি চ্যানেলগুলোতে ব্রেকিং নিউজ—
"ভেজাল ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারি! শহরের নামকরা হাসপাতাল থেকে উদ্ধার হাজার হাজার নকল টিকা।"
"অঙ্গ পাচার-সিন্ডিকেটে জড়িত ডাক্তার ও পরিচালক গ্রেপ্তার।"
কিন্তু খেলা এখানেই শেষ নয়।
কারণ এবার সামনে আসছে সেই ভয়ঙ্কর সত্য—
সরকারি উচ্চপদস্থ নেতাদের জড়িত থাকার প্রমাণ।
সকালবেলা শহরের মানুষ তখনও টিভির সামনে। প্রতিটি চ্যানেলে একই ছবি—হাসপাতালের পরিচালক আর ডাক্তারদের পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে। চারপাশে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, গালাগাল, স্লোগান।
কিন্তু আসল নাটক শুরু হলো পুলিশের জেরা কক্ষে।
দেবাশিস সেন কড়া দৃষ্টিতে জেরা করছিলেন।
— "কে এই বিদেশি এজেন্টদের এনেছিল? এত ভ্যাকসিন কোথা থেকে আসত?"
প্রথমে সবাই চুপ। কেউ মুখ খুলতে রাজি নয়।
কিন্তু এক ডাক্তার, নাম অমিতাভ পাল, ভেঙে পড়ল। ঘাম ঝরছে তার কপালে।
সে কাঁপা গলায় বলল—
— "আমরা তো শুধু নির্দেশ পালন করতাম। আসল কারবার নিয়ন্ত্রণ করত মন্ত্রীসভার কয়েকজন। আমাদের বলা হয়েছিল—ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়ো, বাকিটা আমরা সামলাব।"
দেবাশিস চোখ সরু করে তাকালেন।
— "কোন মন্ত্রী? নাম বলো।"
অমিতাভ কাঁপতে কাঁপতে বলল—
— "স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিজে… আর তার সাথে আরও দুইজন প্রভাবশালী নেতা।"
ঘরের ভেতর যেন মুহূর্তে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
অরি বাইরে বসে ছিল। পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এসে তাকে জানালেন খবরটা।
শুনে তার বুক ধক করে উঠল।
"তাহলে সত্যিই সরকারের উচ্চস্তর জড়িত! এজন্যই এতদিন দফতর নিশ্চুপ ছিল।"
মিডিয়ায় বিস্ফোরণ
অরি সেদিন রাতেই তার রিপোর্ট লিখল। প্রমাণ, ডায়েরির কপি, ভিডিও ফুটেজ, আর পুলিশের জবানবন্দির অংশ—সব একসাথে জুড়ে দিল।
পরের দিন কাগজের প্রথম পাতায় শিরোনাম—
"ভেজাল ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারিতে জড়িত স্বাস্থ্য মন্ত্রী!"
"অঙ্গ পাচার ও ভ্যাকসিন সিন্ডিকেটের সঙ্গে মন্ত্রীর যোগসাজশ।"
টিভি চ্যানেলগুলোতে সারাদিন চলল ডিবেট।
জনগণের ক্ষোভ ফেটে পড়ল রাস্তায়। মন্ত্রীদের effigy পোড়ানো হলো।
পাল্টা আঘাত
কিন্তু এত বড় শক্তি কি চুপ করে বসে থাকে?
সেই রাতে অরির ফোনে আরেকটা ভয়ঙ্কর মেসেজ এল—
"তুমি যত বেশি সত্য ফাঁস করবে, তত দ্রুত তোমার লাশ গঙ্গায় ভেসে উঠবে।"
অরি ফোনটা শক্ত করে ধরল।
ভয় লাগলেও তার চোখে এখন শুধু একরাশ আগুন।
"মুখোশ পড়ে গেছে। এবার ওদের শেষ করতেই হবে।"
হাইকোর্টের বাইরে হাজার মানুষের ভিড়।
সবাই চিৎকার করছে—
"খুনিদের শাস্তি চাই!"
"মন্ত্রীদের ফাঁসি চাই!"
পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই অভিযুক্ত মন্ত্রী আর হাসপাতালের পরিচালকরা আদালতে প্রবেশ করল। চারপাশে সাংবাদিকদের ক্যামেরার ঝলকানি।
আদালতের শুরু
বিচারপতি সুরেশ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—
— "আজকের শুনানিতে উপস্থাপিত হবে ভেজাল ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারির প্রমাণ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুন, প্রতারণা এবং দেশদ্রোহিতার মামলা চলছে।"
সরকারি আইনজীবী প্রমাণ পেশ করলেন—
নকল টিটেনাস ভ্যাকসিনের ফরেন্সিক রিপোর্ট।
হাসপাতালের ডায়েরি, যেখানে ভ্যাকসিনের হিসাব লেখা।
গোপন ভিডিও ফুটেজ, যেখানে মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের দৃশ্য।
ডাক্তার অমিতাভ পালের জবানবন্দি।
ভিডিও প্লে হতেই আদালত স্তব্ধ হয়ে গেল। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—মন্ত্রী নিজে টেবিলে বসে নির্দেশ দিচ্ছেন, আর বাকিরা হাসছে।
প্রতিরক্ষার চেষ্টা
মন্ত্রীদের উকিল চেঁচিয়ে উঠল—
— "সব সাজানো নাটক! ভিডিও মিথ্যে, জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে জোর করে।"
কিন্তু বিচারপতি শান্ত কণ্ঠে বললেন—
— "ফরেন্সিক রিপোর্টে প্রমাণিত—ভিডিওতে কোনো এডিট নেই। সাক্ষীর বয়ানও সঙ্গতিপূর্ণ।"
উকিল থমকে গেল।
অরির সাক্ষ্য
সবশেষে ডাকা হলো অরিকে।
সাক্ষীর আসনে দাঁড়িয়ে সে বলল—
— "আমি নিজে তদন্ত করেছি। যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছে। আমি হাসপাতালের ভেতর থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। আর আমি হুমকির মেসেজও পেয়েছি, যাতে সত্য গোপন রাখতে বলা হয়েছে।"
তার গলায় কাঁপন ছিল, কিন্তু চোখে দৃঢ়তা।
আদালত নিস্তব্ধ হয়ে শুনল।
আদালতের সিদ্ধান্ত
প্রথম দিনের শুনানি শেষে বিচারপতি ঘোষণা করলেন—
— "এই মামলা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সমস্ত প্রমাণ আদালতের কাস্টডিতে রাখা হবে। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী, তাই তাদের হেফাজতে রাখা হবে, জামিন দেওয়া যাবে না।"
ঘোষণা হতেই আদালতের বাইরে মানুষ আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই জানত—এখনও খেলা শেষ হয়নি।
কারণ অভিযুক্তদের হাত লম্বা, আর তারা শাস্তি এড়াতে মরিয়া হয়ে উঠবে।
আদালতের শুনানি শেষ হওয়ার পর থেকে অরি প্রতিদিন হুমকি পাচ্ছিল।
কখনো ফোনে, কখনো অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ—
"তুই বেশি বেঁচে থাকবি না।"
"তোর নাম পরের লাশের লিস্টে।"
কিন্তু এবার খেলা অন্য স্তরে পৌঁছল।
জেলখানার অন্ধকারে
হাইকোর্টের নির্দেশে মন্ত্রীরা এখন প্রেসিডেন্সি জেলে।
রাতের অন্ধকারে জেলের ভেতরে তাদের আলাদা ঘরে বৈঠক বসে।
হাসপাতালের পরিচালক, মন্ত্রী আর সিন্ডিকেটের লোকেরা ফিসফিস করে কথা বলছে।
মন্ত্রী রাগে টেবিল চাপড়ে বলল—
— "ও মেয়ে যদি বেঁচে থাকে, আমাদের জীবন শেষ। সাংবাদিক হয়ে কী সাহস দেখাচ্ছে! চুপ করাতে হবে।"
একজন গ্যাংস্টার এগিয়ে এসে হাসল—
— "মামলা চলুক । ওকে শেষ করা আমার কাজ। দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হবে।"
সবাই মাথা নাড়ল। ষড়যন্ত্র পাকাপাকি হয়ে গেল।
অরিত্রির চারপাশে অদ্ভুত ঘটনা
এরপর থেকেই অরির জীবনে একের পর এক রহস্যময় ঘটনা ঘটতে লাগল।
রাতে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ গাড়ির ব্রেক ফেল করে দিল।
অফিসে ঢোকার আগে চেয়ারের নিচে অচেনা চিঠি পাওয়া গেল—
"আজ নয় তো কাল, গঙ্গায় ভাসবি।"
তার কম্পিউটার হ্যাক হয়ে যায়, সমস্ত ফাইল ডিলিট হয়ে যায়।
অরি বুঝে গেল—এটা শুধু ভয় দেখানো নয়, ওকে সত্যিই শেষ করে দেওয়ার প্ল্যান চলছে।
অপ্রত্যাশিত সঙ্গী
একদিন রাতে অরিত্রি যখন আতঙ্কে বেরোতে পারছিল না, তখন দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
দরজা খুলে দেখে—একজন রহস্যময় মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বয়স তিরিশের কাছাকাছি, চোখে তীব্র দৃষ্টি।
সে বলল—
— "আমি হাসপাতালে নার্স ছিলাম। আমার সহকর্মীদের একে একে খুন করা হয়েছে। আমি সব জানি, কিন্তু পালিয়ে বাঁচছিলাম। এখন তোমার সাহায্য করতে এসেছি।"
অরি হতবাক।
"এ আবার কে? সত্যিই কি সাহায্য করতে এসেছে, নাকি এটাও ফাঁদ?"
কিন্তু নার্সের হাতে থাকা একটি ফাইল দেখে সে থমকে গেল।
ফাইলের ভেতরে হাসপাতালের আসল গোপন চুক্তিপত্র, যেখানে মন্ত্রীদের সই করা!
অরিত্রির চোখ চকচক করে উঠল।
"এটাই হতে পারে আসল অস্ত্র। কিন্তু সময় খুব কম… ওরা যেকোনো মুহূর্তে আমাকে শেষ করতে পারে।"
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। শহরের রাস্তায় ভিড় কমে এসেছে।
অরিত্রি সাংবাদিক দপ্তর থেকে বেরোচ্ছে হাতে নতুন প্রমাণভর্তি ফাইল নিয়ে।
তার মাথায় তখনও ঘুরছে সেই নার্সের দেওয়া চুক্তিপত্র—যেটা পুরো কেলেঙ্কারির মূল হাতিয়ার।
অদৃশ্য ছায়া
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে।
কাঁধ ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল—কালো পোশাক পরা এক মোটরসাইকেল বারবার তার পিছনে ঘুরছে।
অরিত্রি গতি বাড়াল।
কিন্তু মোটরসাইকেলও বাড়াল।
অবশেষে মোড় ঘোরার সময় হঠাৎ দুই দিক থেকে দুটো গাড়ি এসে তাকে ঘিরে ধরল।
অপহরণ
চোখের পলকে কয়েকজন মুখোশধারী বেরিয়ে এলো।
একজন গর্জে উঠল—
— "চালাকি করে অনেক বেঁচেছিস। আজ শেষ!"
অরিত্রিকে জোর করে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।
তার মুখে কাপড় বেঁধে দিল, হাত পা বেঁধে ফেলল।
গাড়ি ছুটতে লাগল অন্ধকার হাইওয়েতে।
অরিত্রির বুক ধড়ফড় করছে—
"এবার কি সত্যিই সব শেষ? এই ফাইলটা যদি আদালতে না পৌঁছায়, এত লড়াই করেও কোনো লাভ হবে না!"
মৃত্যুর মঞ্চ
একসময় গাড়ি থামল শহরের বাইরে এক পরিত্যক্ত গুদামে।
ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো অরিকে।
গুদামের মাঝখানে ঝুলছে এক বিশাল দড়ি, পাশে জ্বলছে মোমবাতি।
গ্যাংস্টাররা হাসতে হাসতে বলল—
— "তোকে এখানে অ্যাকসিডেন্ট বলে সাজিয়ে মারা হবে। পুলিশের কাছে রিপোর্ট যাবে—তুই আত্মহত্যা করেছিস।"
অরিত্রি ঠান্ডা মাথায় চারপাশ দেখল।
সে জানত—কিছু একটা করতে হবে, নইলে এখানেই তার সমাপ্তি।
অপ্রত্যাশিত বাঁক
ঠিক যখন গ্যাংস্টাররা তাকে দড়ির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাইরে থেকে সাইরেন বাজল।
গুদামের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল পুলিশের একটি বিশেষ টিম।
অবাক হয়ে অরিত্রি দেখল—সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই নার্স!
তার হাতেই ফোন ছিল। সে গোপনে সবসময় অরিত্রিকে অনুসরণ করছিল, আর বিপদ বুঝেই পুলিশে খবর দিয়েছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই গ্যাংস্টারদের গ্রেপ্তার করা হলো।
অরিত্রি গভীর শ্বাস ফেলল।
"আজ হয়তো বেঁচে গেলাম, কিন্তু খেলা এখনও শেষ হয়নি। আসল মস্তিষ্ক তো এখনও জেলের ভেতরে বসে হাসছে…"
রাতের সেই গুদামের ঘটনার পর অরি হাসপাতালে দেওয়া সব প্রমাণ নিয়ে বসেছিল।
তার সামনে নার্স বসে আছে, চোখে আতঙ্ক আর প্রতিশোধের আগুন।
অরি বলল—
— "তুমি এতদিন লুকিয়ে ছিলে কেন?"
নার্স দীর্ঘশ্বাস ফেলল—
— "কারণ আমার চারপাশের সবাইকে খুন করা হয়েছে। আমি জানতাম, কথা বললেই আমাকেও শেষ করে দেবে। কিন্তু তুমি একা লড়াই করছ দেখে সাহস পেলাম।"
কাগজে লেখা সত্য
নার্সের দেওয়া ফাইল খুলে অরিত্রি স্তব্ধ হয়ে গেল।
এখানে শুধু ভেজাল টিটেনাসের প্রমাণ নয়, আরও ভয়ংকর নথি লুকানো ছিল।
হাসপাতালের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের গোপন বৈঠকের মিনিটস।
অঙ্গপাচারের জন্য ভুয়া রোগীর নামের তালিকা।
আর সবচেয়ে বড়ো—একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতার স্বাক্ষর।
অরিত্রির হাত কাঁপতে লাগল।
সেই নাম দেখে তার বুক কেঁপে উঠল।
মন্ত্রী নন, হাসপাতালের চেইন নন—
এই পুরো চক্রের আসল মাস্টারমাইন্ড আসলে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নন, বরং কেন্দ্রীয় দলের এক শীর্ষ নেতা।
অপ্রত্যাশিত ধাক্কা
অরিত্রি ভেবেছিল কারাগারে থাকা মন্ত্রীরাই সবচেয়ে বড়ো অপরাধী।
কিন্তু বুঝল, তারা আসলে ফাঁদে ফেলা বলির পাঁঠা।
আসল নিয়ন্ত্রণ ছিল অন্য কারও হাতে—যিনি এতটাই ক্ষমতাবান যে পুলিশ, আদালত, এমনকি তদন্ত সংস্থা পর্যন্ত তার কথায় নাচে।
অরিত্রির মনে হলো চারপাশের দেয়াল হঠাৎ ভেঙে পড়ছে।
"যার বিরুদ্ধে আমি লড়ছি, সে যদি দেশের এত বড়ো ক্ষমতাধর হয়—তাহলে কি সত্যিই তার পতন সম্ভব?"
বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া
এরপর আরও ভয়ঙ্কর কিছু সামনে এলো।
ফাইলের শেষ পাতায় নার্সের নোট করা একটি লাইন—
"এই সিন্ডিকেটকে সাংবাদিকদের সব তথ্য পাইয়ে দিচ্ছে ভেতরের একজন।"
অরিত্রি স্তব্ধ হয়ে গেল।
মানে কি? তার আশেপাশেই কেউ বিশ্বাসঘাতক?
যে তার প্রতিটি পদক্ষেপ মাফিয়াদের জানাচ্ছে?
অরির চোখে রক্তচক্ষু ভরল।
"এবার আসল মুখোশ খুলে ফেলতেই হবে। কে সেই ছদ্মবেশী শত্রু—সবাইকে জানাতে হবে।"
গভীর রাতে অরি নিজের ছোট্ট অফিসে একা বসে আছে।
টেবিলের ওপর ছড়ানো ফরেন্সিক রিপোর্ট, নোটবুক, নার্সের দেওয়া ফাইল।
তার চোখে ঘুম নেই।
বারবার মনে হচ্ছে—
"আমার প্রতিটি পদক্ষেপ কিভাবে এত দ্রুত মাফিয়াদের কাছে পৌঁছে যায়? কাকে বিশ্বাস করছি আমি অন্ধভাবে?"
গোপন ফাঁদ
অরিত্রি একটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।
সে ভুয়া তথ্য লিখল—একটি গোপন সূত্র নাকি শহরের পুরনো সিনেমা হলের ভেতরে লুকিয়ে আছে।
এই খবরটা সে শুধু তার টিমের তিনজনকে জানাল—
ক্যামেরাম্যান রণজয়,
সহকর্মী সাংবাদিক দোলন,
আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়ন্ত।
তারপর অপেক্ষা করতে লাগল।
প্রকাশ্যে ধরা
দুদিন পর খবর এল—সেই পুরনো সিনেমা হলে পুলিশের হানা।
কিন্তু সেখানে কোনো সূত্র পাওয়া গেল না।
বরং জায়গাটা আগেই ফাঁকা করে রাখা হয়েছিল।
অরি বুঝে গেল—এই ভুয়া খবরও মাফিয়াদের কাছে পৌঁছে গেছে।
মানে এদের মধ্যেই কেউ একজন বিশ্বাসঘাতক।
সত্যের মুখোমুখি
পরদিন রাতে অরি হঠাৎ জয়ন্তকে অফিসে ডেকে পাঠাল।
জয়ন্ত ঢুকতেই অরিত্রি শান্ত গলায় বলল—
— "তুই আমার অনেক পুরনো বন্ধু, তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করছি। কেন আমাকে বেচে দিলি?"
জয়ন্ত হকচকিয়ে উঠল।
— "কি বলছিস তুই! আমি তোকে বেচব?"
অরি টেবিলে আঙুল ঠুকল।
— "যে খবরটা আমি শুধু তিনজনকে বলেছিলাম, সেটাই পুলিশের কাছে পৌঁছে গেল। আর পুলিশের রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা—সেই তথ্য দিয়েছে জয়ন্ত নামের এক সাংবাদিক।"
জয়ন্তের মুখ শুকিয়ে গেল।
শেষে ভেঙে পড়ল।
বিশ্বাসঘাতকের স্বীকারোক্তি
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল—
— "আমার কিছু করার ছিল না রে অরি। ওরা আমার পরিবারকে মেরে ফেলবে বলেছিল। প্রথমে সামান্য তথ্য চাইত, পরে পুরো খবর নিতে লাগল। আমি ভয়ে রাজি হয়ে গেছিলাম।"
অরির বুক কেঁপে উঠল।
সে জানত জয়ন্ত ছোটবেলা থেকে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
কিন্তু আজ সেই বন্ধু হয়ে গেছে তার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা।
অরি দাঁত চেপে বলল—
— "তুই যদি সত্যিই আমার বন্ধু হতি , তাহলে ভয় পেয়ে আমাকে বিক্রি করতি না। পরিবারকে বাঁচাতে চেয়েছিস, কিন্তু এতে হাজারো পরিবার অন্ধকারে ডুবে গেল।"
জয়ন্ত মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল।
নতুন শপথ
অরি এবার বুঝে গেল—এই লড়াই শুধু মাফিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধেও।
সে সিদ্ধান্ত নিল—
"আর কাউকে বিশ্বাস নয়। এবার একাই নামতে হবে শেষ যুদ্ধে।"
শহরে তখন রাত বারোটা।
রাস্তাগুলো প্রায় ফাঁকা।
অরি তার স্কুটি করে হাসপাতালের গোপন আর্কাইভ রুমে যাচ্ছিল, যেখানে শেষ প্রমাণগুলো লুকানো আছে।
কিন্তু সে টের পেল—তার পিছনে একটা কালো এসইউভি গাড়ি বারবার লাইট ফেলে তাকে অনুসরণ করছে।
হঠাৎ আক্রমণ
মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়াল।
চারজন মুখোশ পরা লোক নামল।
তাদের হাতে লোহার রড, বন্দুক।
একজন গর্জে উঠল—
— "অরি! তোর খেলা শেষ। অত খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। আজ এখানেই শেষ।"
অরির বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
কিন্তু সে ভয় পেল না।
স্কুটি ঘুরিয়ে পাশের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল।
মৃত্যুর সাথে দৌড়
গলির মধ্যে অন্ধকার।
সামনে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা ইট, ময়লা, কুকুরের চিৎকার।
পিছনে গাড়ির গর্জন—
হঠাৎ গুলি ছুটল!
অরি ঝুঁকে পড়ল, গুলি তার মাথার এক ইঞ্চি ওপরে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সে প্রাণপণে স্কুটি চালাচ্ছে, গলির পর গলি পার হচ্ছে।
একটা ভুল মোড় নিলেই শেষ।
ফাঁদ
হঠাৎ রাস্তা শেষ হয়ে গেল।
সামনে বিশাল গুদামঘর, চারপাশে দেয়াল।
গাড়িটা এসে তাকে ঘিরে ফেলল।
চারদিক থেকে লোকজন এগিয়ে আসছে।
অরি এক মুহূর্তে বুঝে গেল—এবার পালানো কঠিন।
অপ্রত্যাশিত সাহায্য
ঠিক তখনই দূর থেকে হেডলাইটের আলো।
একটা মোটরসাইকেল গর্জন করে ঢুকে পড়ল।
পেছনে চড়ে আছে সেই নার্স, হাতে লোহার পাইপ।
সে এক ঝটকায় এক গুন্ডার মাথায় আঘাত করল।
অন্যদিকে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে রণজয়—অরির ক্যামেরাম্যান!
রণজয় চিৎকার করে বলল—
— "অরি! ওঠ তাড়াতাড়ি!"
অরি স্কুটি ছেড়ে তাদের সাথে লাফ দিল।
মিনিটের মধ্যে তারা পালিয়ে গেল অন্ধকার রাতে।
শেষ প্রতিজ্ঞা
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে অরির বুক ভরে উঠল প্রতিজ্ঞায়।
সে জানল—এবার খেলা শেষ করার সময় এসেছে।
এখন আর পালিয়ে বাঁচা নয়, এবার অপরাধীদের একে একে শাস্তি দেওয়ার পালা।
"এই যুদ্ধ হবে শেষ যুদ্ধ। আর আমি জিতবই।"
শহরের প্রান্তে বিশাল এক প্রাইভেট হাসপাতাল।
রাতে সব অন্ধকার, কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে।
সেখানেই লুকিয়ে আছে পুরো চক্রের মাস্টারমাইন্ড।
অরি, রণজয় আর নার্স—তিনজন মিলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
রণজয়ের ক্যামেরা চালু, যেন প্রতিটি প্রমাণ ধরা থাকে।
মুখোমুখি
হঠাৎ করেই অরি ঢুকে পড়ল হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে।
সেখানে বসে আছে শহরের প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রিসভায় থাকা স্বাস্থ্য দপ্তরের মন্ত্রী সোমনাথ সেন।
তার চারপাশে বডিগার্ড, টেবিলে ছড়ানো নকল টিটেনাস ভায়াল, ফরেন একাউন্টের নথি।
অরি গর্জে উঠল—
— "তাহলে আপনিই সেই মাস্টারমাইন্ড? শিশুদের মৃত্যুর পিছনে, ডাক্তারদের খুনের পিছনে, সবকিছুর নেপথ্যে আপনিই?"
সোমনাথ হেসে বলল—
— "সাংবাদিক, তুমি ভেবেছিলে সত্যি ফাঁস করলে আমাকে ধ্বংস করতে পারবে? এই শহর, পুলিশ, আদালত—সব আমার মুঠোয়।"
শেষ চাল
অরি শান্ত গলায় বলল—
— "একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন মন্ত্রী মহাশয়। আজ আপনার প্রতিটি কথা, প্রতিটি স্বীকারোক্তি লাইভ যাচ্ছে।"
সে দেখাল রণজয়ের ক্যামেরা।
অন্যদিকে নার্স মোবাইল থেকে লাইভ স্ট্রিম করছে নিউজ চ্যানেলের সোশ্যাল মিডিয়ায়।
মুহূর্তে হাজারো মানুষ শুনতে পাচ্ছে মন্ত্রীর অপরাধের কাহিনি।
বন্দুক আর সত্য
মন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে বন্দুক বের করল।
— "তোমাদের আজ এখানেই শেষ করে দেবো!"
অরি স্থির দৃষ্টিতে তাকাল।
ঠিক তখনই পুলিশ ঢুকে পড়ল।
কারণ, লাইভ সম্প্রচারের পর জনগণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল—"মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করো।"
জনতার চাপে প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে।
পুলিশ মন্ত্রীকে হাতকড়া পরাল।
তার চিৎকার—
— "তোমরা আমাকে কিছু করতে পারবে না! আমি ফের বেরিয়ে আসব!"
অরি শান্ত গলায় উত্তর দিল—
— "যদি বেরিয়েও আসেন, আমি আবার কলম তুলে দাঁড়াবো। সত্যিকে কেউ থামাতে পারে না।"
দিন কয়েক পর শহরের সব বড়ো চ্যানেল, পত্রিকা একসাথে প্রকাশ করল অরির তদন্ত।
শিশু মৃত্যুর আসল কারণ, ভেজাল ভ্যাকসিন, ডাক্তারদের খুন—সব ফাঁস হয়ে গেল।
শহর আবার শ্বাস নিতে শুরু করল।
কিন্তু অরি জানে—
"অপরাধ শেষ হয় না। একেকটা চক্র ভাঙি, আবার নতুন জন্ম নেয়।
কিন্তু যতদিন আমি আছি, কলম আর ক্যামেরা থাকবে অস্ত্র হয়ে।"
সে আকাশের দিকে তাকাল—
আর মনে মনে বলল—
"যুদ্ধ শেষ হয়নি। কিন্তু আমি লড়াই থামাবো না।"
