নীল হীরার রহস্য
নীল হীরার রহস্য
নীল হীরার রহস্য
কলকাতার এক পুরনো অভিজাত বাড়ি। নামেই বোঝা যায় ধনদৌলত ও ঐশ্বর্যের ছাপ আছে।
এই বাড়ির কর্তা নীলাদ্রি বাবু, বয়স পঁয়ষট্টি। বয়সের ভার আছে বটে, কিন্তু মুখে একধরনের তৃপ্তি আর গর্ব সবসময় খেলা করে।
কারণ?
তার কাছে আছে এক অমূল্য সম্পদ—এক বিরল নীল হীরা।
এটা শুধু হীরা নয়, যেন পুরো পরিবারের ভাগ্যের রক্ষক। বহু বছর আগে তাঁর দাদুর হাত দিয়ে আসা এই হীরা নিয়ে নীলাদ্রি বাবুর বিশ্বাস,
“যতদিন এই হীরা আমার কাছে আছে, সংসারে সুখ-শান্তি ও ঐশ্বর্যের অভাব হবে না। একবার হারালে সব শেষ।”
এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় যে, কোটি টাকার প্রস্তাব এলেও তিনি কখনো কাউকে দেননি।
অসংখ্য হীরার ব্যবসায়ী তাঁর দরজায় এসেছে। কেউ হুমকি দিয়েছে, কেউ প্রলোভন দিয়েছে। কিন্তু নীলাদ্রি বাবু অনড়।
তাঁর পরিবারও যেন এই হীরার মতো চকচকে—
বড় ছেলে নিহার : এক সফল ডাক্তার। সুদর্শন, শিক্ষিত স্ত্রী, এক মেয়ে।
মেজো ছেলে রঞ্জন : সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার। মার্জিত সুন্দরী স্ত্রী, এক ছেলে।
ছোট ছেলে অঞ্জন : অবিবাহিত ব্যবসায়ী, পরিবারের সবার চোখে বাবার ভরসার জায়গা।
তিন সন্তানই বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বউমারাও সুলক্ষণা, সংসার ভরা ঐশ্বর্য, ভালোবাসা আর সম্মান।
মনে হয় যেন কোনো ত্রুটি নেই।
তবুও নীলাদ্রি বাবুর মনে একটাই ভয়—
“এই হীরাই সব সুখের কারণ। যদি এটা হারাই… সব শেষ।”
ভোর।
সূর্যের আলো তখনও পুরো উঠেনি।
বড় ছেলে নিহার প্রতিদিনের মতো বাবার ঘরে প্রণাম করতে ঢুকল।
ঘরে ঢুকেই যেন বুকের ভেতর বরফের টুকরো গলল।
নীলাদ্রি বাবু খাট থেকে মেঝেতে লুটিয়ে আছেন, নিথর।
নিহারের চোখ আটকে গেল এক জায়গায়—
বাবার গলায় একটা সিরিঞ্জ গেঁথে আছে।
মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
চোখ পড়ল সিন্দুকের দিকে।
চাবি দিয়ে খোলা, ভেতরটা পুরো ফাঁকা।
না আছে সেই অমূল্য নীল হীরা, না আছে নগদ টাকা।
—“বাবা…!”
নিহারের গলা ফেটে গেল।
চিৎকার শুনে ছুটে এল রঞ্জন, অঞ্জন, বউমারা। সবাই হাহাকারে ভেঙে পড়ল।
রঞ্জন সবার আগে মাথা ঠান্ডা করে বলল,
—“এটা স্রেফ চুরি নয়। পরিকল্পিত খুন।”
পুলিশে খবর দেওয়া হলো।
কিন্তু রঞ্জন জানে, কলকাতার পুলিশের অবস্থা ভালো নয়।
তখনই সে বলল,
—“এভাবে কিছু হবে না। আমার পরিচিত একজন আছে—অরিত্রি দত্ত । ও-ই পারে রহস্য ভেদ করতে।”
রঞ্জন ফোন করল অরিকে।
ঘুম থেকে সবে উঠেছে সে। ফোন দেখে অবাক, তারপর ঘটনার কথা শুনে আর দেরি করল না।
“আমি এক্ষুনি আসছি রঞ্জনদা। তোমরা ভেবো না।”
পুলিশের আগেই বাড়িতে পৌঁছল অরি।
তার চোখে পড়ল প্রতিটি খুঁটিনাটি।
সিরিঞ্জ। খোলা সিন্দুক। জানালার অবস্থা।
তারপর পরিবারের ভেঙে পড়া মুখ।
শুধু একটাই বাক্য বলল—
“এই বাড়ির কেউ খুনি নয়। কিন্তু খুনি খুব কাছেই আছে।”
অরিত্রি দত্ত, বয়স প্রায় ত্রিশ। ছোটখাটো গড়ন, কিন্তু চোখে এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন কোনো কিছুই এড়িয়ে যায় না। সে পুলিশের সঙ্গে কাজ করে না, তবে তার নাম শুনলে কলকাতার অপরাধ জগত শিউরে ওঠে।
বাড়িতে ঢুকেই প্রথমেই সে মৃতদেহটা দেখল।
নীলাদ্রি বাবুর গলায় ঢুকে থাকা সিরিঞ্জটা খুঁটিয়ে দেখল।
—“অসাধারণ ঠান্ডা মাথার কাজ,” অরি ফিসফিস করে বলল।
তারপর সিন্দুকের দিকে গেল।
ভাঙচুরের কোনো চিহ্ন নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আসল চাবি ব্যবহার করা হয়েছে।
চাবি কোথায় ছিল, তা সবাই জানত। নীলাদ্রি বাবু সবসময় বালিশের নিচে রাখতেন।
এবার অরি জানালার কাছে গিয়ে দেখল।
লক ভাঙা হয়নি। বাইরে থেকে ঢোকার সম্ভাবনা নেই।
তাহলে খুনি ভেতরের লোকই? নাকি ভেতরের কারও সহায়তা পেয়েছে?
বড় ছেলে নিহার, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
—“অরি, আমাদের হীরা ফেরত চাই। আর বাবার খুনিকে তুমি শাস্তি দাও।”
অরি ধীরস্থির স্বরে উত্তর দিল—
—“নিশ্চিন্ত থাকো। আমি নিশ্চিত এই পরিবারের কেউ খুনি নয়। কিন্তু খুনি এমন একজন, যে তোমাদের খুব কাছের।”
অরি প্রত্যেককে আলাদাভাবে জেরা শুরু করল।
নিহার
ডাক্তার হিসেবে সে জানে কীভাবে ইনজেকশনে বিষ দেওয়া যায়। কিন্তু সে কাঁপতে কাঁপতে শপথ করল, বাবার ঘরে সে রাতে ঢোকেনি।
অরি জিজ্ঞেস করল—
—“তুমি নিশ্চয়ই জানো, এটা সাধারণ বিষ নয়। একটা বিশেষ ওষুধ মিশ্রিত ড্রাগ। খুব সহজে পাওয়া যায় না। তোমার চেম্বারে কি এরকম কিছু আছে?”
নিহার একদম অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
—“আ… হ্যাঁ, কিন্তু ওই ওষুধ শুধু হাসপাতালেই পাওয়া যায়। আমার কাছে নেই।”
রঞ্জন
সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার, আত্মবিশ্বাসী, তবে বাবার মৃত্যুতে অদ্ভুত স্থির।
অরি খেয়াল করল, রঞ্জনই সবার আগে বলেছিল—পুলিশ কিছু করতে পারবে না।
এমন আত্মবিশ্বাস কেন?
রঞ্জন বলল—
—“আমি বাবার মৃত্যুর পেছনে বাইরের কোনো চক্র দেখতে পাচ্ছি। হীরার লোভে কেউ এই কাজ করেছে।”
অঞ্জন
সবচেয়ে ছোট ছেলে, অবিবাহিত। ব্যবসায়ী।
তবে ব্যবসায় তার টানাপোড়েন চলছে, এ কথা গোপন করতে চাইলেও অরির চোখ এড়াল না।
অরি সরাসরি প্রশ্ন করল—
—“তুমি কি কখনো হীরাটা বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলে?”
অঞ্জন চমকে উঠল—
—“না! বাবাই বারণ করেছিলেন। আমি কি সাহস করব?”
বউমারা
তিনজনেই কাঁদছিল।
কিন্তু অরির কানে এল মেজো বউমার ফিসফিসানি—
—“এই হীরাটা সংসারে সুখ আনে না, অশান্তি আনে।”
অরি থমকে গেল।
এই প্রথম কেউ বলল, হীরাটা অভিশাপ।
অরি মাথা তুলল জানালার দিকে।
বাইরে রাস্তায় তখন কোলাহল শুরু হয়েছে।
তার মনে হতে লাগল—এই খুন শুধুমাত্র হীরার জন্য নয়।
এটা একটা অনেক বড় ষড়যন্ত্রের শুরু।
অরি দ্বিতীয় দিনের তদন্তে আবার বাড়িতে এল। এবার সে বাবার পুরনো ডায়েরি খুঁজে পেল।
ডায়েরির পাতায় অদ্ভুত কিছু লেখা—
“আমি জানি কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। হীরার জন্যই সব। যদি কোনোদিন আমার কিছু হয়, তবে আমার সন্তানদের সতর্ক থাকতে হবে।”
অরি পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে থেমে গেল এক জায়গায়—
সেখানে লেখা আছে এক নাম, “মাহবুব আলি”।
বাড়ির কেউই ভালো করে জানে না। তবে অঞ্জন একটু থেমে বলল—
—“ও হীরার ব্যবসায়ী। আমার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। বাবাকে কিনতে অনেকবার চেষ্টা করেছে।”
অরি কপাল কুঁচকাল।
এখন স্পষ্ট—এটা পরিবারের বাইরের ষড়যন্ত্রও হতে পারে।
অরি পুলিশের কাছে তথ্য চাইল। পুলিশ বলল, গত কয়েকদিন ধরে এলাকায় এক বিদেশি গাড়ি ঘোরাঘুরি করছে। গাড়ির নম্বর নাকি মহারাষ্ট্রের।
অরি মনে মনে হিসেব করল—হয়তো কোনো বড় চক্র হীরার পিছনে রয়েছে।
কিন্তু তখনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
মেজো বউমার ঘর থেকে পাওয়া গেল এক চিঠি, যেখানে লেখা—
“যদি হীরা তোমাদের কাছে থাকে, তবে আমাকে দাও। নইলে ফল ভালো হবে না।”
অরি চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল—
—“এটা শুধু ভয় দেখানো নয়, এদের মধ্যে কেউ বাইরের লোককে খবর দিচ্ছে।”
অরি এবার প্রত্যেককে আবার জেরা করল।
তার প্রশ্ন ছিল আরও গভীর, যেন ভেতরের আসল ভয় বের করে আনতে পারে।
নিহার
প্রথমে শান্ত থাকলেও এবার অস্থির হয়ে উঠল।
অরি বলল—
—“তুমি ডাক্তার, তুমি সহজেই ওই ইনজেকশনটা বানাতে পারতে। সত্যিই কি তোমার চেম্বারে এই ওষুধ ছিল না?”
নিহার এবার ঘামতে শুরু করল।
—“ছিল… কিন্তু তিনদিন আগে কেউ সেটা চুরি করেছে। আমি ভেবেছিলাম স্টাফ নিয়েছে।”
অরি মনে মনে নোট করল।
রঞ্জন
অরি তাকে বলল—
—“তুমি বাবাকে খুব ভালোবাসতে। তবুও বাবার মৃত্যুর পর তুমি অদ্ভুত ঠান্ডা কেন?”
রঞ্জন নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিল—
—“সরকারি চাকরিতে আমি প্রতিদিন মৃত্যু দেখি। আবেগ দেখিয়ে লাভ নেই।”
অরি খেয়াল করল, রঞ্জনের চোখে কিছু একটা লুকোনো আছে।
অঞ্জন
অরি জিজ্ঞেস করল—
—“তোমার ব্যবসায়িক পার্টনার মাহবুব আলির সঙ্গে কি এখনও যোগাযোগ আছে?”
অঞ্জন অস্বস্তি নিয়ে বলল—
—“না… আমি সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। কিন্তু… ও লোকটা বিপজ্জনক।”
অরি এবার বউমাদের দিকে ফিরল।
মেজো বউমা ফিসফিস করে বলল—
—“আমি জানি না খুনি কে, কিন্তু বিশ্বাস করো দিদি, এই হীরাটা অভিশপ্ত। এর জন্যই সব অশান্তি।”
অরি এবার নিশ্চিত হলো,
হীরার সঙ্গে শুধু অর্থ নয়, অভিশাপের গল্পও জড়িয়ে আছে।
অরি রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ রাস্তায় এক মোটরবাইক দাঁড়াল, আর একজন কালো হেলমেট পরা লোক গলা ঝাঁকিয়ে বলল—
—“তদন্ত ছেড়ে দাও, অরিত্রি সেন। নইলে তুমিও বাঁচবে না।”
লোকটা সজোরে বাইক চালিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
অরি থেমে গেল। ঠোঁটে একরকম রহস্যময় হাসি ফুটল।
“যতই ভয় দেখাও, আমি থামব না। খুনি যেই হোক, হীরা যেখানেই থাকুক—আমি খুঁজে বের করব।”
অরি আবার ঘটনাস্থলে ফিরে এল। এবার তার সঙ্গে এক পুরোনো পরিচিত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছিল—ড. অনিরুদ্ধ।
সে সিরিঞ্জটা পরীক্ষা করে বলল—
—“এটা সাধারণ বিষ নয়। খুব কম মানুষ জানে, এই ড্রাগ মেশালে মৃত্যু নিঃশব্দে ঘটে। আর মাত্র এক মিনিটে।”
অরি জিজ্ঞেস করল—
—“এটা কি হাসপাতালে পাওয়া যায়?”
অনিরুদ্ধ উত্তর দিল—
—“হ্যাঁ, কিন্তু কেবল নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে ব্যবহৃত হয়। আর একটা কৌতূহলকর ব্যাপার… এই সিরিঞ্জের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।”
অরি শ্বাস আটকে শুনল।
—“কার?”
—“নিহারের।”
সবাই হতভম্ব।
নিহার হোঁচট খেয়ে বসে পড়ল।
—“না! আমি বাবাকে খুন করিনি। ওষুধ আমার চেম্বার থেকে চুরি হয়েছিল, হয়তো কেউ আমাকে ফাঁসানোর জন্য ব্যবহার করেছে।”
অরি ঠাণ্ডা গলায় বলল—
—“আমি তোমাকে এখনই দোষী বলছি না। তবে এটাই প্রথম শক্ত প্রমাণ।”
এদিকে পুলিশও চাপ বাড়াচ্ছে। তারা চায় তদন্ত নিজেদের হাতে নিতে।
কিন্তু রঞ্জন দাঁত চেপে বলল—
—“অরি ছাড়া আর কেউ এই রহস্য ভেদ করতে পারবে না।”
অরি এবার বাড়ির বাইরে সূত্র খুঁজতে বেরোল।
সে গেল অঞ্জনের পুরোনো ব্যবসায়ী পার্টনার মাহবুব আলির খোঁজে।
মাহবুবকে পাওয়া গেল একটি হোটেলের ঘরে।
মাথায় টুপি, চোখে সানগ্লাস, তবুও তার মুখের চেনা ধূর্ততা লুকানো গেল না।
অরি সরাসরি বলল—
—“নীল হীরা কোথায়?”
মাহবুব একচোট হেসে বলল—
—“আমার দরকার নেই। ওই হীরার জন্য যারা মরছে, তারাই বোকা। আমি হাতও দিইনি।”
অরি বিশ্বাস করল না।
কিন্তু হোটেল রুম খুঁজেও হীরার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
ঠিক তখনই পুলিশের খবর এলো—
এক অচেনা লোককে ধরা হয়েছে। তার ব্যাগে নকল নীল হীরা পাওয়া গেছে।
লোকটা স্বীকার করেছে, কেউ তাকে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিল যেন পরিবারকে বিভ্রান্ত করে।
অরি ব্যাগটা হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
“নকল হীরা মানে আসল হীরাটা কোথাও লুকানো আছে। আর খুনি এখনো মুক্ত।”
অরি যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন হঠাৎ তার গায়ে একটা পাথর এসে পড়ল।
চিঠি বাঁধা ছিল তাতে—
“তুমি যতই খোঁজ করো, হীরা তোমার হাতে আসবে না। আর খুনি? খুনি তোমার চোখের সামনেই আছে।”
অরি আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল—
—“ঠিক আছে। খুনি যদি এত কাছে থাকে, তবে পালাতে পারবে না।”
অরি এবার পরিবারের ভেতরে মনোযোগ দিল।
বহুদিনের সুখী সংসারের মুখোশের আড়ালে আসল চেহারা বেরোতে লাগল।
নিহার
সে চাপা গলায় স্বীকার করল, তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। স্ত্রী বারবার বাবার কাছে টাকা চাইত, যা বাবাকে বিরক্ত করত।
অরি ভাবল—টাকার লোভে কি নিহার খুন করেছে?
রঞ্জন
সে বাইরে থেকে স্থির, কিন্তু অরি তার ঘর থেকে এক কাগজ পেল—একটা লোনের কাগজ। তাতে বিশাল অঙ্কের টাকা বাকি।
সরকারি চাকরিতেও দুর্নীতি করে টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিল সে।
অরি মনে মনে হিসেব করল—হীরাটা পেলে রঞ্জনের সব ঋণ মিটে যেত।
অঞ্জন
ব্যবসার নামে সে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়েছিল। মাহবুব আলি তাকে চাপ দিচ্ছিল হীরা বিক্রি করতে।
অরি জিজ্ঞেস করল—
—“তুমি কি বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করোনি?”
অঞ্জন মাথা নিচু করল।
—“করেছিলাম… কিন্তু বাবা রাজি হননি।”
আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য বেরোল—
বউমাদের মধ্যে হিংসা ও প্রতিযোগিতা ছিল।
কে বেশি গয়নাগাটি পাবে, কে বাবার কাছে বেশি প্রিয়, এই নিয়েই তাদের মধ্যে লুকোনো আগুন জ্বলছিল।
অরি মনে মনে বলল—
“সুখী সংসারের ছবিটা আসলে ভাঙা আয়না। প্রত্যেকেরই বাবার হীরার উপর নজর ছিল।”
অরি আবার ডায়েরি পড়তে শুরু করল। এক জায়গায় লেখা ছিল—
“আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাই আমায় ধ্বংস করবে।”
অরি চমকে উঠল।
এর মানে খুনি একেবারে পরিবারের ভেতরেই।
তখনই সে খেয়াল করল—
সিন্দুকের তালার পাশে ছোট্ট একটা আঁচড় আছে।
খুব সূক্ষ্ম, চোখে পড়ার মতো নয়।
এর মানে সিন্দুক খোলা হয়েছিল চাবি দিয়ে নয়, এক বিশেষ যন্ত্র দিয়ে।
এমন যন্ত্র কার কাছে থাকতে পারে?
অঞ্জনের কাছে। কারণ ব্যবসার কাজে সে প্রায়ই লকার খোলার লোকজনের সঙ্গে মিশত।
অরি এবার অঞ্জনের চোখের দিকে তাকাল।
—“সত্যি বলো, হীরাটা কোথায়?”
অঞ্জন হঠাৎ রেগে চিৎকার করে উঠল—
—“আমি খুন করিনি! হীরাটাও আমার কাছে নেই!”
কিন্তু তার চোখ এড়িয়ে গেল না অরির।
চোখে আতঙ্ক, ভেতরে গোপন কিছু চাপা।
ঠিক তখনই পুলিশ খবর দিল—
শহরের বাইরে একটা গুদামে নীল হীরার মতো কিছু পাওয়া গেছে।
অরি দাঁড়িয়ে উঠে বলল—
—“খেলা শেষের দিকে এগোচ্ছে। এবার আসল খুনির মুখোশ খোলা শুরু হবে।”
অরি পুলিশের সঙ্গে শহরের বাইরে গুদামে পৌঁছল।
অন্ধকার গুদামের কোণে রাখা ছিল এক বাক্স। তার ভেতর ঝলমল করছে—নীল হীরা।
কিন্তু অরি এক নজরেই বুঝল—এটা আসল নয়। নিখুঁত নকল।
অরি মৃদু হেসে বলল—
—“খুনি এবার ফাঁদে পা দিয়েছে।”
ঠিক তখনই পুলিশ খবর দিল—অঞ্জনকে সন্দেহজনক অবস্থায় ধরা হয়েছে।
অরি তাকে জেরা করল।
অঞ্জন কাঁপতে কাঁপতে স্বীকার করল—
—“হীরাটা আমি চেয়েছিলাম। আমার ব্যবসা ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবাকে খুন করিনি। আমি শুধু সিন্দুক খোলার চেষ্টা করেছিলাম। আসল হীরার খোঁজ আমিও পাচ্ছি না।”
অরি মাথা নেড়ে বলল—
—“তাহলে খুনি তুমি নও। তবে যে হীরার কাছে গিয়েছিল, সে-ই আসল খুনি।”
তখনই অরির মনে পড়ল, মৃতদেহের পাশে রাখা সিরিঞ্জে নিহারের আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল।
কিন্তু নিহার ডাক্তার, সে জানে প্রমাণ মুছতে হয়। এত বড় ভুল সে করবে না।
অরি চোখ বন্ধ করে সমস্ত সূত্র মিলাল—
সিন্দুক যন্ত্র দিয়ে খোলা,
ড্রাগ হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া,
নকল হীরা ছড়িয়ে বিভ্রান্তি,
আর বাবার ডায়েরিতে লেখা “আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাই আমায় ধ্বংস করবে।”
হঠাৎ অরির চোখে ঝলক খেলল।
সে ধীরে ধীরে পরিবারের দিকে ঘুরল।
—“খুনি আর কেউ নয়… রঞ্জন।”
সবাই স্তব্ধ।
রঞ্জনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
অরি বলল—
—“তুমিই বাবাকে খুন করেছ। কারণ তোমার ঋণের বোঝা মাথার ওপর চেপে বসেছিল। তুমি বাবার বিশ্বাস অর্জন করে চাবি কোথায় রাখেন জানত। তুমি চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলে হীরাটা নিয়েছিলে। তারপর নিহারের হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরি করে সিরিঞ্জে ঢুকিয়ে বাবাকে খুন করেছ। আর প্রমাণ মুছে ফেলার ভান করে নিহারের আঙুলের ছাপ লাগিয়েছ।”
রঞ্জন দাঁড়িয়ে চিৎকার করল—
—“হ্যাঁ! আমি করেছি। বাবাই দায়ী। তিনি কখনো হীরা বিক্রি করতে দিলেন না। অথচ আমার জীবন ভেঙে পড়ছিল। আমি যদি হীরাটা পেতাম, সব ঠিক হয়ে যেত। তাই আমি…”
তার গলা কেঁপে উঠল।
—“আমি জানতাম হীরা ছাড়া আমরা কিছুই না।”
অরি শান্ত গলায় বলল—
—“না, রঞ্জন। হীরা কোনো সুখ আনেনি। এটা কেবল লোভ আর অশান্তি এনেছে। বাবার মৃত্যু তার প্রমাণ।”
পুলিশ রঞ্জনকে গ্রেপ্তার করল।
তার চোখে জল টলমল করছিল, কিন্তু অপরাধ ঢাকবার উপায় ছিল না।
অরি সিন্দুকের ভেতর থেকে পাওয়া আসল নীল হীরাটা সবার সামনে রাখল।
সে বলল—
—“হীরাটা সিন্দুকের ভেতরেই লুকানো ছিল, ডাবল লেয়ারে। রঞ্জন বুঝতে পারেনি। সে শুধু নকলটা ঘুরিয়েছে।”
পরিবার হাহাকারে ভেঙে পড়ল।
নীল হীরা উদ্ধার হলো, কিন্তু তাদের চোখে আর কোনো উজ্জ্বলতা রইল না।
অরি বিদায় নেওয়ার সময় বলল—
“এই হীরাকে অভিশপ্ত ভাবো না। অভিশাপ মানুষের মনে থাকে, পাথরের ভেতর নয়।”
