STORYMIRROR

Raj Nandi

Action Crime Thriller

4  

Raj Nandi

Action Crime Thriller

অরিত্রির চোখে সত্য

অরিত্রির চোখে সত্য

13 mins
9

অরিত্রির চোখে সত্য

রবিবারের সকাল


রবিবারের সকালটা ছিলো অদ্ভুত শান্ত। কলকাতার ব্যস্ত ট্রেনলাইন আজ যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ট্রেনে বসে অরিত্রি আর রাজ্ জানালার ধারে পাশাপাশি। দুজনেই একে অপরের হাত ধরে জানলার বাইরে তাকিয়ে।


রবিবার মানেই ওদের দুজনের জন্য আলাদা এক দুনিয়া। সারা সপ্তাহ অফিসের ফাইল, প্রেজেন্টেশন, টার্গেটের চাপ—সব ভুলে গিয়ে এ একান্ত দুজনের সময়। রাজ্-এর ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে, অরিত্রির মুখে আনন্দের ঝিলিক। ওরা যাচ্ছিলো বনের ভেতরে, পাখির ছবি তুলতে।


কিন্তু আজ ট্রেনটা অদ্ভুত রকম ফাঁকা। এই সময়ের ট্রেনে সাধারণত সরকারি অফিসের যাত্রীদের ভিড় থাকে। অথচ আজ দুজনের সামনে বসে আছেন একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। চোখে ক্লান্তি, মুখে বিষণ্ণতা, হাতে কুঁচকানো সংবাদপত্র।


অরিত্রি প্রথমেই লক্ষ্য করেছিল। ভদ্রলোককে দেখে হঠাৎ তার মনে হলো—

“চেনা চেনা লাগছে তো!”


সে সাহস করে বলেই ফেললো—


অরিত্রি : “মাফ করবেন… আপনাকে কোথায় যেনো দেখেছি মনে হচ্ছে।”


ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন—


ভদ্রলোক : “হয়তো আপনি আমাকে চিনেছেন। আমি আমার মিসেসের অফিসে কয়েকবার গিয়েছিলাম। তখন হয়তো আপনাকে দেখেছি।”


অরি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো—


অরিত্রি : “আপনার মিসেস আমাদের অফিসে কাজ করেন? নামটা বলবেন?”


ভদ্রলোক : “হ্যাঁ, দীপা… দীপা রায় চৌধুরী।”


অরি হঠাৎ চমকে উঠলো।


অরিত্রি : “অরে! আপনি তাহলে অতনু দা! দীপার স্বামী? এতদিনে প্রথম দেখা হলো।”


রাজ্ হাসলো হালকা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ্য করলো অতনুর মুখে গভীর বিষণ্ণতার ছাপ।


অরিত্রি : “কোথায় যাচ্ছেন এত সকালে? আপনাকে খুব মনমরা লাগছে।”


ভদ্রলোকের চোখে হঠাৎ জল চিকচিক করে উঠলো।


অতনু : “দীপা… দীপা গতকাল থেকে নিখোঁজ।”


এই কথাটা যেনো বাজ পড়ার মতো নেমে এলো ওদের দুজনের কানে।


অধ্যায় ২ : নিখোঁজ দীপা


রাজ্ আর অরিত্রি একে অপরের দিকে তাকালো। দুজনের চোখেই একই প্রশ্ন—“কি করে সম্ভব!”


অরিত্রি : “সে কী! কোথায় গিয়েছে? কোনো আত্মীয়ের বাড়ি?”


অতনু মাথা নেড়ে বললেন—


অতনু : “সব জায়গায় খুঁজেছি। আত্মীয়, বন্ধু—কোথাও নেই। কালই থানায় গিয়েছিলাম রিপোর্ট করতে। পুলিশ বললো, ‘অপেক্ষা করুন, হয়তো নিজে থেকেই ফিরবে।’ কিন্তু আমি জানি… কিছু একটা অঘটন ঘটেছে।”


তার গলা কেঁপে উঠলো।


রাজ্ চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে। দীপাকে অফিসে সে দেখেছে—চঞ্চল, প্রাণবন্ত, সৌন্দর্যে ভরপুর। অথচ আজ তার কোনো খোঁজ নেই!


অরি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো—


অরিত্রি : “আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”


অতনু : “এক আত্মীয়ের বাড়ি। যদি কোনো খবর পাই… জানি না।”


ট্রেন থামলো পরের স্টেশনে। অতনু নেমে গেলেন। মুখে এখনও সেই অবসাদ, চোখে এক অদ্ভুত অন্ধকার।


ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। জানলার বাইরের সবুজ মাঠ ছুটে যাচ্ছে। অথচ অরি আর রাজ্-এর মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা।


রাজ্ ধীরে ধীরে বললো—


রাজ্ : “আজ আর জঙ্গলে আমাদের মন বসবে না।”


অরি চুপ। তার মনে হঠাৎই এক ভয় জাগছে। দীপা—যে সবসময় হাসিখুশি, লড়াকু, অফিসে সবার সঙ্গে মেশে—সে হঠাৎ করে কোথায় গেলো?


ট্রেন এগোচ্ছে বনের দিকে। আর অরিত্রির বুকের ভেতরে যেনো জমছে এক অজানা ঝড়।



ট্রেন থেকে নামার পর রাজ্ আর অরি দুজনেই গম্ভীর হয়ে গেল। সাধারণত রবিবার মানেই ওদের চোখে মুখে উচ্ছ্বাস থাকে, আজকের দিনটা যেনো একেবারেই অন্যরকম।


রাজ্ ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে এগোচ্ছে, কিন্তু তার হাত কেমন শিথিল হয়ে আছে। অরিত্রি পিছু পিছু হাঁটছে, মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে অকারণ ভয় জমে উঠছে।


বনের ভিতরে ঢোকার পর চারপাশে পাখিদের ডাক, পাতার শব্দ—সবকিছু যেনো স্বাভাবিকই ছিলো। কিন্তু দুজনের মন যেনো কেমন অশান্ত।


হঠাৎ রাজ্ থেমে গেল।


রাজ্ : “অরি… ওটা দেখছিস?”


অরি তাকিয়ে দেখলো, ঝোপের আড়ালে একটা অদ্ভুত সাদা কাপড়ের ঝলক।


দুজন একসাথে দৌড়ে গেলো কাছে। তারপর যা দেখলো—সে দৃশ্য যেনো সারাজীবনের জন্য ওদের চোখে গেঁথে রইলো।


একজন মহিলা… অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে মাটিতে। শরীরের চারপাশে শুকনো রক্ত, মুখে আতঙ্কের ছাপ।


অরি চিৎকার করে উঠলো—

অরিত্রি : “এ তো… দীপা!”


রাজ্ স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠলো। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে নিশ্চিত হলো—হ্যাঁ, এ দীপাই।


ক্যামেরা হাতে রাজ্ আর ছবি তুলতে পারলো না। বরং ফোন বের করে দ্রুত পুলিশে কল করলো।


অরিত্রি হেঁচকি তুলতে তুলতে কাঁদছিলো।


অরিত্রি : “রাজ্… ওকে তো খুন করা হয়েছে! এ তো… রেপের মতো লাগছে।”


রাজ্ দাঁতে দাঁত চেপে বললো—

রাজ্ : “হ্যাঁ। এটা সাধারণ হত্যা নয়। এর পেছনে বড় রহস্য আছে।”


দুজনের চারপাশে বনটা হঠাৎ আরও ভয়ানক মনে হলো।


অধ্যায় ৪ : তদন্তের শুরু


কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পৌঁছালো। চারপাশ ঘিরে ফেললো। তদন্তকারীরা মৃতদেহ দেখেই বুঝলো—এটা নৃশংস অপরাধ।


ইন্সপেক্টর ঘোষ, যিনি কেসটা হাতে নিলেন, মুখ গম্ভীর করে বললেন—


ইন্সপেক্টর ঘোষ : “এটা কেবল হত্যা নয়। আগে ধর্ষণ, তারপর হত্যা। অপরাধী হয়তো চেষ্টা করেছিল মৃতদেহ লুকোতে, কিন্তু পারেনি।”


অরিত্রি ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। রাজ্-এর ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ জমতে লাগলো।


মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হলো। পুলিশের গাড়ি চলে গেলে বনটা যেনো আবার আগের মতো চুপ হয়ে গেল।


কিন্তু অরির মনে তখন শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরছে—

“কে করতে পারে এমনটা?”


সে জানতো দীপা অফিসে খুব সুন্দরী আর চঞ্চল স্বভাবের। অনেক সহকর্মী তাকে নিয়ে রসিকতা করতো, কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রেমের প্রস্তাবও দিতো। এমনকি বসও নাকি অনেকবার তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিলো।


রাজ্ ফিসফিস করে বললো—

রাজ্ : “অরি… এই খুনের পেছনে অফিসের কারও হাত থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি।”


অরি মাথা নেড়ে বললো—

অরিত্রি : “কিন্তু আজ সকালে আমরা অতনু দাকে ট্রেনে দেখেছিলাম। সে এতটা ভাঙা, হতাশ ছিলো… তবুও আমার কেনো জানি ওর আচরণটা অদ্ভুত লাগছে।”


রাজ্ চুপ করে গেল।


ওদের দুজনের চোখে চোখে একটাই প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠলো—

“যদি পুলিশ না-ও পারে, আমরা নিজেরাই সত্যিটা খুঁজে বের করবো।”



দীপার মৃত্যুর খবর যেনো বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়লো পুরো অফিসে।

মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেই চকচকে করিডরগুলোয় সবাই ফিসফিস করছে, কেউ কারও চোখে চোখ রাখতে পারছে না।


অরি আর রাজ্ অফিসে ঢুকে লক্ষ্য করলো—

সবার মুখে অদ্ভুত ভয়, অনিশ্চয়তা, আবার কেউ কেউ কেমন যেনো স্বস্তির হাসি চেপে রাখছে।


ক্যাফেটেরিয়ায় বসে অরি ধীরে ধীরে সহকর্মীদের খোঁজ নিতে লাগলো।


সহকর্মী ১ : “দীপা তো খুবই স্মার্ট আর সুন্দরী ছিলো। ওকে সবাই পছন্দ করতো… তবে সত্যি বলতে, অনেকে ওকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবতো।”


সহকর্মী ২ : “তুমি জানো না? বস মেহেতা সাহেব নাকি ওকে বারবার ডিনারে ডাকতো। দীপা সবসময় এড়িয়ে যেতো।”


সহকর্মী ৩ : “কেবল বস কেনো, সেলস টিমের অমিত তো একদম পাগল হয়ে গিয়েছিলো দীপার পেছনে। অফিসে সবসময় ওর চারপাশে ঘুরঘুর করতো।”


অরি শুনে শুনে আরও অস্থির হয়ে উঠলো।

এত মানুষ… এত সম্ভাব্য সন্দেহভাজন।


রাজ্ পাশ থেকে বললো—

রাজ্ : “এখন যদি সত্যি খুঁজতে হয়, তাহলে প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ কেস স্রেফ পুলিশের হাতে ছেড়ে দিলে কিছু হবে না।”


অরির চোখে তখন দৃঢ়তা—

“হ্যাঁ, আমি নিজেই তদন্ত শুরু করবো।”


অধ্যায় ৬ : সন্দেহভাজনের তালিকা


অরির মাথায় ধীরে ধীরে একটা ছবি পরিষ্কার হচ্ছিলো।


১. অফিসের বস – মেহেতা সাহেব :

চিরকাল দীপাকে নিজের প্রভাব খাটিয়ে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রত্যাখ্যান করলে হুমকিও দিয়েছিলো বলে গুঞ্জন।


২. সহকর্মী অমিত :

দীপাকে প্রেমে রাজি করানোর জন্য মরিয়া ছিলো। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ওর প্রতি একধরনের বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিলো।


৩. অন্য টিম লিডার শর্মা :

দীপার পদোন্নতির বিরুদ্ধে ছিলো। বলতো, “ও শুধু সুন্দরী বলেই প্রমোশন পাচ্ছে।”


৪. দীপার স্বামী অতনু :

বাইরে থেকে ভদ্র, কিন্তু সংসারে কী ঘটতো, তা কেউ জানতো না। দীপার অনেক সময় অফিসে কান্নাভেজা চোখে আসার পেছনে হয়তো অতনুরই হাত ছিলো।


অরির ভেতরে কেমন অশান্তি বাড়ছিলো।


রাতে বাসায় ফেরার পর রাজ্ বললো—

রাজ্ : “অরি, মনে হচ্ছে আমরা একটা বিপজ্জনক খেলায় পা দিতে চলেছি।”


অরি দৃঢ় গলায় বললো—

অরিত্রি : “সত্যিটা বের না করলে দীপার আত্মা কখনও শান্তি পাবে না।”



দীপার মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে।

তদন্তে পুলিশের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।


ইন্সপেক্টর ঘোষ প্রতিবারই একই কথা বলেন—

ইন্সপেক্টর ঘোষ :

“আমরা চেষ্টা করছি, দোষী খুব শিগগিরই ধরা পড়বে।”


কিন্তু বাস্তবে কিছুই এগোচ্ছে না।


একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে অরিকে ডেকে পাঠালেন ঘোষ।


ঘোষ :

“মিস অরিত্রি, আপনিই তো দীপার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিছু জানেন না? কোনো পুরনো শত্রু, বা অস্বাভাবিক কিছু?”


অরি শান্ত স্বরে বললো—

“স্যার, দীপা অনেক কিছু সহ্য করছিলো। অফিসে ওর ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিলো। অনেকে ওকে হেনস্থা করতো। কিন্তু আপনি যদি সত্যিই চান খুনিকে ধরতে, তাহলে অফিসটা ভালো করে খুঁজে দেখতে হবে।”


ঘোষ খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন—

“দেখুন, আমরা জানি কী করতে হবে। নাগরিকেরা যদি পুলিশি কাজ শেখাতে আসে, সেটা ভালো লাগে না।”


অরি বুঝলো, পুলিশের ওপর নির্ভর করা যাবে না।

তাহলে… সত্যি খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিতে হবে তাকেই।


অধ্যায় ৮ : অরির গোপন তদন্ত শুরু


অরি রাজকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করলো।

সেদিন রাতে ওরা দু’জনেই বসলো অরির ঘরে।


টেবিলের ওপর রাখা কাগজে অরি লিখলো চারটে নাম—


মেহেতা (বস)


অমিত (সহকর্মী)


শর্মা (টিম লিডার)


অতনু (স্বামী)


অরি :

“এদের মধ্যে একজনই আসল খুনি। কিন্তু সরাসরি কাউকে অভিযুক্ত করা যাবে না। আমাদের চুপচাপ প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে।”


রাজ্ মুচকি হেসে বললো—

“মানে তুমি একরকম গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে চলেছো?”


অরি দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো—

“হ্যাঁ। যদি সত্যিটা আমি না খুঁজি, তাহলে দীপার মৃত্যু চিরকাল রহস্য হয়েই থেকে যাবে।”


প্রথম পদক্ষেপ


অরি ঠিক করলো, প্রথমে শুরু করবে অফিসের বস মেহেতা সাহেবকে দিয়ে।

ওকে সবার আগে সন্দেহের তালিকায় রাখা দরকার।


অরি পরিকল্পনা করলো—


মেহেতার গতিবিধি নজরে রাখা


দীপার ইমেইল, অফিসের কম্পিউটার চেক করা


অফিসের অন্য কর্মচারীদের কাছ থেকে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা


রাজ্ বললো—

“এই খেলাটা মোটেও সহজ হবে না, অরি। হয়তো আমাদের জীবনও বিপদে পড়বে।”


অরি জানালার বাইরে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো—

“সত্যের জন্য যদি লড়াই করতেই হয়, তবে আমি প্রস্তুত।”



অরি ঠিক করলো, প্রথম টার্গেট মেহেতা।

অফিসে সবাই ওকে “পারফেক্ট জেন্টলম্যান” বলে মানে।

কিন্তু দীপা একদিন অরিকে গোপনে জানিয়েছিলো—


দীপা :

“অরি, মেহেতা সাহেব বাইরে থেকে ভদ্রলোক। কিন্তু ওর চোখের ভেতরে এমন কিছু আছে, যেটা আমাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে। ও আমাকে অনেকবার ডিনারে যেতে বলেছে। আমি না করলেই মুখ কালো করে বসে থাকে।”


অরি সেই কথাই মনে করলো।


একদিন অফিসের ক্যান্টিনে অরি ইচ্ছে করে মেহেতার টেবিলের পাশে বসল।

হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো—


অরি :

“স্যার, দীপা না থাকায় অফিসে যেন অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, তাই না?”


মেহেতা এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলো, তারপর বললো—

“হুম্… ও খুব প্রতিভাবান ছিলো। তবে জীবনে যে কখনো কারও ওপর বিশ্বাস করা যায় না, সেটা আমি আগেই বলেছিলাম।”


অরি চমকে উঠলো।

“কার কথা বলছেন স্যার?”


মেহেতা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো।

“আরে কিছু না, কাজের কথা বলছিলাম।”


অরি বুঝলো—এই লোক কিছু লুকাচ্ছে।


অধ্যায় ১০ : গোপন ইমেইলের সূত্র


অরি অফিস শেষে রাজকে নিয়ে দীপার ডেস্কে গেলো।

অফিস তখন প্রায় খালি।

অরি জানতো দীপার পাসওয়ার্ড হতে পারে—ওর প্রিয় বইয়ের নাম।


কয়েকবার চেষ্টা করার পর পাসওয়ার্ড খুলে গেলো— “Middlemarch2020”।


ইনবক্সে ঢুকেই অরি স্তম্ভিত হয়ে গেলো।

সেখানে একটি ফোল্ডার, নাম দেওয়া “PRIVATE”।


ভেতরে একাধিক মেইল।

সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে—মেহেতা সাহেব বারবার দীপাকে ডিনার, ট্যুর, এমনকি অফিসের বাইরে প্রজেক্টে যোগ দিতে বলছে।

শেষ দিকের মেইলগুলোতে হুমকির সুরও আছে—


মেইল (মেহেতা → দীপা) :

“তুমি যদি আমার কথা না শোনো, তবে তোমার ক্যারিয়ার আমি এক নিমেষে শেষ করে দেবো। আমার ক্ষমতা তুমি জানো না।”


অরি কাঁপা গলায় বললো—

“রাজ্, এটাই প্রমাণ। মেহেতা ওকে ব্ল্যাকমেইল করছিলো।”


রাজের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো।

“কিন্তু এটুকু প্রমাণেই খুনের দায় ওর ঘাড়ে চাপানো যাবে না। আমাদের আরও গভীর খুঁজতে হবে।”


অরি ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়ে উঠলো।

“ঠিক বলেছো। সত্যিটা চাপা থাকলে দীপার আত্মা কখনো শান্তি পাবে না। আমি থামবো না।”



সেদিন সন্ধ্যায় অফিস ছুটি হতেই অরি রাজকে বললো—


অরি :

“আজকে মেহেতাকে ফলো করবো। ওকে কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, সব জানতে হবে।”


রাজ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।

ওরা দুজন দূর থেকে মেহেতার গাড়ির পেছনে লাগলো।


মেহেতা সোজা শহরের নামী এক ক্লাবে ঢুকলো।

ক্লাবটা মূলত ধনীদের আড্ডাখানা, সাধারণ মানুষ এখানে ঢুকতে পারে না।

অরি আর রাজ বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিলো।


হঠাৎ তারা খেয়াল করলো—মেহেতার সাথে বসে আছে দুজন অপরিচিত লোক।

একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আরেকজন পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার।


রাজ নিচু গলায় বললো—

“বুঝতে পারছো? এদের সবার সাথে মেহেতার যোগসাজশ আছে। এ কারণেই পুলিশ এতদিনেও কিছু খুঁজে পায়নি।”


অরি’র বুকের ভেতরটা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেলো।

এই রহস্যে যে অনেক বড় বড় নাম জড়িয়ে আছে, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।


অধ্যায় ১২ : গোপন লেনদেন


অরি আর রাজ যখন ক্লাবের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো, তখন হঠাৎ ওদের চোখে পড়লো—

মেহেতা সেই রাজনীতিবিদকে একটা ছোট প্যাকেট দিলো।

লোকটা সেটাকে পকেটে পুরে ফেললো গোপনে।


অরি ধীরে ধীরে রাজকে বললো—

“ওটা হয়তো টাকা, কিংবা কোনো সিক্রেট ডকুমেন্ট।”


রাজ ফিসফিস করে বললো—

“আমার মনে হচ্ছে দীপার খুনের সাথে এই সিন্ডিকেটের সম্পর্ক আছে। হয়তো দীপা এমন কিছু জেনে গিয়েছিলো যা ওদের হাতে থাকা উচিত ছিলো না।”


অরি মনে মনে শপথ নিলো।

“আমি সত্যিটা না জানা পর্যন্ত থামবো না।”


ওরা যখন সেখান থেকে বের হতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ অরির মনে হলো কেউ ওদের লক্ষ্য করছে।

পেছনে ঘুরে তাকাতেই অরি স্পষ্ট দেখতে পেলো—

একজন লোক সানগ্লাস পরে, সিগারেট টানতে টানতে ওদের পিছু নিচ্ছে।


অরি’র বুক ধক্ করে উঠলো।

“আমাদের ওপর নজরদারি শুরু হয়ে গেছে।”



ক্লাব থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরার জন্য ওরা হেঁটে যাচ্ছিলো।

হঠাৎ অরি অনুভব করলো—কেউ যেন পিছু নিয়েছে।


রাজ ফিসফিস করে বললো—

“অরি, পিছনে তাকিও না। ওরা আমাদের ফলো করছে।”


অরি ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পুলিশের হেল্পলাইন নাম্বার ডায়াল করতে যাবে, ঠিক তখনই পিছন থেকে কালো গাড়ি এসে দাঁড়ালো।

দু’জন লোক নেমে এলো।


একজন গম্ভীর গলায় বললো—

“যেটা নিয়ে নাক গলাচ্ছেন, সেটা না গলানোই ভালো। না হলে জীবিত ফিরতে পারবেন না।”


অরি কাঁপা গলায় জবাব দিলো—

“আমরা শুধু সত্যটা জানতে চাই।”


লোকটা হেসে উঠলো,

“সত্য জানলে মানুষ বেশিদিন বাঁচে না।”


রাজ ও অরি কোনোরকমে লোকগুলোর হাত থেকে পালিয়ে দৌড়ে ট্রেন ধরলো।

ট্রেন চলতে শুরু করলে দুজনেই হাঁপাতে হাঁপাতে বুঝলো—

এখন তারা একটা বড় ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি।


অধ্যায় ১৪ : মৃত সাক্ষী


পরের দিন সকালে অফিসে গিয়ে অরি চমকে উঠলো।

অফিসের এক জুনিয়র স্টাফ, যে দীপার শেষদিনে কিছু সন্দেহজনক আচরণ দেখেছিলো, সে হঠাৎ “অ্যাকসিডেন্টে” মারা গেছে।


রাজ খবরের কাগজ দেখিয়ে বললো—

“দেখো, কাল রাতেই গাড়ি চাপা দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে এটা দুর্ঘটনা না, পরিকল্পিত খুন।”


অরি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো।

এখন পরিষ্কার—

যে-ই সত্যটা জানতে চাইছে, একে একে তাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।


অরি ধীরে ধীরে রাজকে বললো—

“রাজ, আমাদের হাতে সময় খুব কম। দীপা কেসটা শুধু রেপ-মার্ডারের মামলা না। এর পেছনে আরও ভয়ঙ্কর রহস্য আছে। হয়তো ড্রাগস, কালোবাজারি, অথবা রাজনৈতিক খেলা।”


রাজ তার হাত ধরে বললো—

“তুমি ভয় পেও না। আমরা সত্যটা বের করবো, যে কোনো মূল্যে।”


অরি চোখ বন্ধ করে মনে মনে শপথ নিলো—

“যারা দীপাকে খুন করেছে, তাদের আমি ছাড়বো না।”



অরি দীপার কেবিনে গিয়ে খুঁজতে শুরু করলো।

ড্রয়ার খুলতেই কিছু কাগজপত্রের মাঝে একটা ছোট ডায়েরি পেয়ে গেলো।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—

“যদি আমি মরে যাই, তবে জানবে আমার মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়।”


অরি শিউরে উঠলো।

পাতা উল্টাতেই বেরিয়ে এলো ভেতরের কাহিনি।


দীপা লিখেছিলো—


অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার বারবার তাকে প্রলোভন দিচ্ছিলো।


এক উচ্চপদস্থ নেতার নামও বারবার এসেছে, যিনি নাকি কোম্পানির আড়ালে কোটি কোটি টাকার কালোবাজারি চালান।


দীপা সব জানতো, কিন্তু প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছিলো না।


অরি চোখ মুছতে মুছতে রাজকে বললো—

“দেখো রাজ, দীপা মৃত্যুর আগে সব জানতো। ওর ডায়েরিটাই আসল প্রমাণ।”


রাজ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললো—

“তাহলে খুনি শুধু ওর দেহ মাটির নিচে চাপা দেয়নি, ওর মুখও চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে চেয়েছিলো।”


অধ্যায় ১৬ : ছদ্মবেশী শত্রু


ওরা ডায়েরিটা পুলিশের কাছে দিতে যাচ্ছিলো।

ঠিক সেই সময় এক অপরিচিত মহিলা এসে অরির সঙ্গে পরিচয় করালো নিজেকে—

সে বললো সে দীপার খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।


মহিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো—

“আমিই আপনাদের সাহায্য করবো। আমি জানি দীপাকে কারা খুন করেছে।”


অরি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে চাইলো।

কিন্তু রাজ ফিসফিস করে কানে বললো—

“সাবধান অরি, এ নারীটা হয়তো শত্রুর লোক।”


সেদিন রাতে, অরি একা ফিরছিলো।

রাস্তার মোড়ে হঠাৎ সেই মহিলাকে দেখলো, সে কারও সাথে ফোনে ফিসফিস করছে—

“ডায়েরি ওদের হাতে চলে গেছে, কাল রাতেই শেষ করে দেবো।”


অরি হতভম্ব হয়ে গেলো।

এখন নিশ্চিত—

খুনি শুধু পুরুষ নয়, এর সঙ্গে এক নারীও জড়িত।



অরি আর রাজ্ ডায়েরি নিয়ে পুলিশের কাছে গেলো।

কিন্তু পুলিশ অদ্ভুতভাবে চুপ।

ডায়েরি পড়েও তারা কোনো অ্যাকশন নিলো না।


রাজ সন্দেহ করে বললো—

“অরি, পুলিশও হয়তো এ চক্রের সঙ্গে জড়িত।”


অরি ধীরে ধীরে সব কেটে বুঝতে পারলো।

ডায়েরিতে শুধু ম্যানেজার আর নেতার নামই নেই,

বরং পরোক্ষভাবে পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসারের নামও আছে।


অরি বললো—

“যদি সত্যিই পুলিশ জড়িত থাকে, তাহলে আমাকে অন্যভাবে প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।”


তারা ঠিক করলো, অফিসে গোপনে ক্যামেরা বসাবে।

কোম্পানির ভেতরের অন্ধকার ব্যবসার ভিডিও তারা সংগ্রহ করবে।


অধ্যায় ১৮ : রাতের ফাঁদ


সেদিন রাতেই রাজ আর অরি কোম্পানির বিল্ডিংয়ে ঢুকলো।

অফিস তখন ফাঁকা।

রাজ ছোট ক্যামেরা বসাতে ব্যস্ত।

অরি চারপাশে লক্ষ্য রাখছে।


হঠাৎ করেই পেছন থেকে পদশব্দ।

অরি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে সেই রহস্যময়ী মহিলা—

তার হাতে ছোট্ট পিস্তল।


মহিলা হেসে বললো—

“তোমরা ভেবেছো সত্যি প্রকাশ করতে পারবে?

ডায়েরি কেড়ে নাও ওদের কাছ থেকে।”


ঠিক তখনই অন্ধকার থেকে আরেকজন বেরিয়ে এলো—

সে আর কেউ নয়, দীপার স্বামী অতনু।


অরি স্তব্ধ হয়ে গেলো।

“অতনু দা… আপনি?”


অতনু চোখ নিচু করে বললো—

“হ্যাঁ, আমিই। দীপা সব জানতো।

ও যদি মুখ খুলতো, আমার সব শেষ হয়ে যেতো।”


অরি আর রাজ দুজনেই শিহরিত হলো।

এখন স্পষ্ট—

অতনুই দীপার খুনি।



অরি হঠাৎ দৃঢ় গলায় বললো—

“অতনু দা, আজ সত্যি কথা বেরিয়ে এসেছে।

আপনি নিজেই খুনের স্বীকারোক্তি দিলেন।”


অতনু ভীষণ চমকে উঠলো।

রাজ্ পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখালো—

সে সব রেকর্ড করেছে।


অতনুর মুখ মুহূর্তেই সাদা হয়ে গেলো।

সে গর্জে উঠলো—

“তোমরা ভাবছো এই ভিডিও নিয়ে বাঁচতে পারবে?

এ শহরে সব আমার নিয়ন্ত্রণে।”


কিন্তু অরি হেসে বললো—

“না, অতনু দা। এখন আর শুধু আপনার হাতে ক্ষমতা নেই।

আপনার মিথ্যা, আপনার মুখ থেকেই ধরা পড়েছে।”


মহিলা পিস্তল তাক করে অরির দিকে এগিয়ে আসছিলো,

ঠিক তখন রাজ্ তার হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিলো।


অধ্যায় ২০ : ন্যায়বিচারের সকাল


অরি সেই ভিডিও আর ডায়েরি একসাথে মিডিয়া ও এক ভরসাযোগ্য উচ্চ আদালতের বিচারপতির কাছে পাঠালো।

খবর ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে।


টিভি চ্যানেলগুলোতে শিরোনাম—

“ডাক্তারদের খুন, ভেজাল ওষুধ চক্র, আর দীপা রায়চৌধুরীর হত্যার রহস্য উন্মোচিত।”


পুলিশ আর লুকাতে পারলো না।

অতনু গ্রেপ্তার হলো,

আর সেই মহিলা বেরিয়ে এলো এক বড় রাজনৈতিক নেতার গোপন এজেন্ট হিসেবে।

সবাই ধরা পড়লো আইনের জালে।


অরি আর রাজের চোখে জল এলেও বুক ভরে গর্ব হলো।

কারণ দীপার আত্মা এবার শান্তি পেলো।


রাজ্ অরির হাত ধরে বললো—

“তুমি যদি না থাকতে, হয়তো সত্যিটা চিরকাল চাপা পড়েই যেতো।”


অরি তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে।

সূর্যের আলো ভোরকে নতুন করে আলোকিত করছিলো—

ঠিক তেমনি তাদের লড়াইও এনে দিলো নতুন ন্যায়বিচারের সকাল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action