সবুজ গ্ৰহের কথা
সবুজ গ্ৰহের কথা
বিপ বিপ বিপ বিপ..... লাল আলোটা জ্বলছে নিবছে। বিপদ সঙ্কেত। চমকে উঠলাম, সামনে পিছনে মোট চারটে স্ক্রিন অন করে বুঝতে চেষ্টা করলাম বিপদটা কি ধরনের। এই মুহুর্তে পৃথিবীর থেকে আমার দুরত্ব কয়েকশো কোটি কিলোমিটার। মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম ঠিক এক মাস তিনদিন আগে। কিন্তু ছুটে আসা একটা এস্ট্রোয়েটকে এড়াতে গিয়ে নিজের কক্ষপথ থেকে বেশ কিছুটা সরে একটা ব্ল্যাক হলের ফাঁদে পড়ে গেছিলাম। এই আকাশযান অমেকা-এক এ রয়েছি আমি আর আমার রোবট বন্ধু এরিক।
এরিক বিপদ সঙ্কেত পেয়েই বাকি মেশিন, অক্সিজেনের পরিমান, সঞ্চিত জল ও বায়ুর চাপ পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। সামনেই একটা বড় মিল্কি ওয়ে। কিন্তু এমন কিছু তো আসার কথা না এ পথে!! ঐ এসট্রয়েটটি কাটাতে গিয়ে পৃথিবীর সাথে সব রকম যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে আমাদের। জ্বালানি ও কমে আসছে দ্রুত। হঠাৎ একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র কে আমাদের যানের দিকে ছুটে আসতে দেখে এরিক আবার যানের মুখ ঘুরিয়ে দিলো। বাড়িয়ে দিলো গতিবেগ। ব্ল্যাক হোলটা পার করার পর থেকেই সামনের সৌরজগতটা কেমন অচেনা লাগছে। তবে কি আমরা অন্য কোনো সৌর মন্ডলে প্রবেশ করলাম ?
এরিকের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, ও তো রোবট। ওর কাজ টুকুই মন দিয়ে করে। দূরে একটা নীলচে সবুজ গ্ৰহ দেখা যাচ্ছে। ওটা ঠিক কি, দুটো উজ্জ্বল সূর্যর মত নক্ষত্র আলো বিকিরণ করছে ঐ গ্ৰহে।
এরিক মেশিন দিয়ে দেখে বলল আমি ঠিক ভেবেছি। এটা একটা অন্য সৌর মন্ডল। ব্ল্যাক হোল পার করে এপথে চলে এসেছি আমরা। আপাতত যা জ্বালানি আছে ঐ সবুজ গ্ৰহেই উত্তরণ করতে হবে আমাদের। ও স্যাটেলাইট ক্যামেরায় দেখে বলল গ্ৰহটায় অক্সিজেন শুধু নয় গাছপালাও রয়েছে। জল রয়েছে। ভূপ্রকৃতি পৃথিবীর মতই। আপাতত আকাশ যানের মুখ ঘুরিয়ে ওখানে নামা ছাড়া উপায় নেই। জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে এই সৌরজগতের বুকেই অসীম শ্যূনে সমাধী হবে আমাদের।
তবে বলা যত সহজ করা নয়। দু ঘন্টা গ্ৰহটার চারপাশে চক্কর কেটেও উত্তরণের মত ফাঁকা জায়গা পেলাম না একটাও। অবশেষে এরিক এমারজেন্সি ল্যান্ডি করালো। এ ক্ষেত্রে আকাশ যান খুব ছোট জায়গায় ও ল্যান্ড করতে পারবে তবে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কম্পন থামতেই চারপাশটা তাকিয়ে দেখলাম, এ কোনো শীতল মরু প্রধান অঞ্চল। পাহাড়ের মাথায় বহু যুগের জমে থাকা বরফ, আসেপাশের ঝোপঝার আর বালি অনেকটা লাদাখের মত। এরিককে যানের দায়িত্বে রেখে আমি পা দিলাম অজানা গ্ৰহের বুকে। গ্ৰ্যাভিটি পৃথিবীর থেকে কম। প্রথমে পা ফেলতে অসুবিধা হচ্ছিল স্পেশ স্যুট পরে। কিছুটা হেঁটে বুঝে নিলাম। পাহাড় আর ঝোপঝার পেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখা পেলাম কিছু পশুর হাড়ের। তবে প্রাণ রয়েছে এখানে !! আনন্দে নেচে উঠলাম। দু জায়গায় স্তুপাকৃত ছাই চোখে পড়ল। কয়েকটা নাম না জানা ফলের গাছ। একটা ছোট ঝরণা পার করলাম। এ গ্ৰহে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দুটো সূর্য অস্ত যেতেই তিনটে চাঁদ ভেসে উঠল মাল
ার মত। ছাই দেখার পর থেকেই আমার মন বলছে জাতভাইদের দেখা পাবো। কারণ মানুষ ছাড়া আর কেউ আগুনের ব্যবহার জানে না। একমাত্র মানুষ এই আগুনকে করায়ত্ত করেছিল বলেই আজ আমরা উন্নতির শিখরে। যদি পৃথিবীতে ফিরতে পারি আমিই হব এই গ্ৰহের আবিস্কারক। পৃথিবীর বাসস্থান সমস্যা মিটে যাবে। খাদ্য সমস্যার সমাধান হবে। আপাতত গ্ৰহটায় জীবনের খোঁজ শুরু করলাম। আমার পকেটে একটা যন্ত্র ছিল যা আমার পাঁচ কিমি ব্যসার্ধে যদি জীবিত কোনো প্রাণী থাকে সবুজ সিগন্যাল দেবে। আমি গ্ৰহটায় পা দিয়েই পায়ের ছাপ খুঁজছিলাম। হাঁসের মতো জোড়া আঙ্গুল বিশিষ্ট কোনো প্রাণী রয়েছে। তাদের দুটো পা, চারটে আঙ্গুল জোড়া। হাঁঁটার চিহ্ন দেখে মনে হয় উচ্চতা তিন থেকে চার ফুট।
আবার হাত ঘড়িতে বিপ বিপ শব্দ। বিপদ সিগন্যাল দিচ্ছে এরিক!! কিন্তু কেনো ?
ওদিকে হাতের মেশিনে সবুজ আলো জ্বলছে, আমার খুব কাছেই রয়েছে জীবিত কেউ।
হঠাৎ তুমুল বিস্ফোরণের শব্দ আর আগুনের আভায় গ্ৰহের আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। পিছন ফিরেই বুঝতে পারলাম অমেকা-এক আর নেই। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাড়ি ফেরা আর হবে না আমার। এরিক আর নেই। রোবট হলেও ও ছিল আমার বন্ধু। একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। এবার কি করব আমি ?
হঠাৎ মনে হল বেশ কিছু শুকনো পাতা মারানোর আওয়াজ, আর পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। সবুজ আলো দ্রুত জ্বলছে এবার।তাকিয়ে দেখি দূরে একটা মশালের আলো। আমার কি লুকানো উচিত? ওরা বন্ধু না শত্রু জানি না। তবে আমার নতুন করে হারানোর কিছুই নেই। সামনের ঝোপটা নড়ে উঠতেই উঠে দাঁড়ালাম, দুটো অবয়ব বেরিয়ে এলো। পরনে পশুর চামড়ার পোশাক, বড় বড় চুল। হাতে মশাল। আরেকজন বেরিয়ে এলো এদিকে, হাতে লাঠি। অবাক হয়ে আমায় দেখছে। আদিম মানব !! গ্ৰহটা এখনো উন্নত হয়নি। লোক গুলো স্পেশস্যুট পরা আমায় দেখে অবাক হয়েছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে। আমি দু হাত তুলে শান্ত হয়ে দাঁড়ালাম। যথেষ্ট বেটে লোকগুলো। বামনদের গ্ৰহ !! কল্পনায় কত লেখক লিখেছে এদের কথা। আজ আমি তেমনি এক অজানা গ্ৰহে বামনদের মুখোমুখি। জানিনা কপালে কি রয়েছে। অমেকা-একের বিস্ফোরণে পৃথিবীতে ফেরার পথ বন্ধ। আপাতত এদের সাথেই বন্ধুত্ব করতে হবে। হাটু গেড়ে বসে মাথা ঝুকিয়ে বললাম -''আমি পৃথিবী গ্ৰহর বাসিন্দা, তোমাদের আশ্রিত। তবে ক্ষতিকারক নই। ''
পিলপিল করে আরো বামন বেরিয়ে আসছে। ওরা ইশারায় আর একধরনের আওয়াজ করে কথা বলছে। আমার কথা বুঝবে না স্বাভাবিক। আমিও ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করলাম নিজের অসহায়তা।
আমায় ঘিরে ধরেছে একদল আদিম বামন মানুষ। জানি না কপালে কি রয়েছে। তবে ওদের চোখ মুখে হিংস্রতা নেই, হয়তো ওরা পৃথিবীবাসী উন্নত এবং শিক্ষিত লোকেদের মত ক্ষতিকারক নয়। এদের মাঝেই থাকতে হবে আমায় অনন্ত কাল। আর ভয় করছে না। মায়ের মুখটা বহুদিন পর খুব মনে পড়ছে। ক্লান্ত শরীরে চোখ বুঝলাম আমি।