Biplab Das

Comedy Drama Romance

3  

Biplab Das

Comedy Drama Romance

ঝড়-ঝাপটা

ঝড়-ঝাপটা

6 mins
272


হোটেলের রুম লক করে অরিজিত যখন রিশেপসনে এসে পৌঁছল, দেখল দেবিকা তো নেইই, দলের কারোরই পাত্তা নেই। দেবিকা হল অরিজিতের স্ত্রী এবং দল হল অফিস কলিগেরা। অরিজিত এবং দেবিকা একই অফিসে কাজ করে। অফিসেই আলাপ, সেখান থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে বিয়ে।

অরিজিত-দেবিকা এবং ওদের অফিসের কলিগেরা সবাই মিলে পুরীতে বেড়াতে এসেছে। দিন চারেকের মতন ছুটি নিয়েছে সবাই। সমুদ্রের পাড়ে সময় কাটানোই একমাত্র উদ্দেশ্য। অরিজিতদের দলটিতে মোট আট জন সদস্য রয়েছে। দুটো পরিবারের অবশ্য একটি করে বাচ্চা রয়েছে। সব মিলিয়ে দশ জন।

রিশেপসন থেকে হোটেলের মুল গেট দিয়ে বার হয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে রঞ্জনকে দেখতে পেলো। উল্টো দিকের রাস্তায় ফোনে কথা বলছে। রাস্তাটা ক্রস না করেই অরিজিত জিজ্ঞেস করলো, ‘দেবিকাকে দেখেছিস? বাকিরা কোথায়’? ফোন থেকে মুখ সরিয়ে রঞ্জন উত্তর দিল, ‘ওরা তো এগিয়ে গেলো। মেয়েরা গেলো বাঁদিকে, কি কি সব কেনাকাটা করবে বলল। অভিরুপ আর রুদ্র গেলো স্বর্গদ্বারের দিকে। মড়া পোড়ানো দেখবে বলে’। অরিজিত শুনে উত্তর দিল, ‘ঠিক আছে। আমি এগোচ্ছি। তোর হয়ে গেলে আমায় কল করিস। আমি আশেপাশেই থাকব’।

অরিজিত বিচে এসেই দেবিকাকে কল করলো। ফোন বেজে গেলো কিন্তু দেবিকা কল রিসিভ করলো না। সে এবার রুদ্রকে কল করলো। কিছুক্ষণ ফোন বাজতেই রুদ্র ফোন ধরে বলল, ‘ভাই কোথায় তুই? একটা দারুন জায়গা পেয়েছি মাল খাওয়ার। আমি আর অভিরুপ ভদকা আর মাছভাঁজা খাচ্ছি। তুইও চলে আয়’। অরিজিত জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ভাবে যাব?’

‘আরে স্বর্গদ্বারটার ঠিক উল্টোদিকেই। বিচের ওপরেই সেট-আপটা। তুই স্বর্গদ্বারের কাছে এসে আমায় কল কর’।

‘ঠিক আছে। কিন্তু আমি এখন মদ খাবোনা’।

‘খেতে হবে না। তুই আগে আয়’।

বাঁদিকে সমুদ্র রেখে অরিজিত এগোতে লাগলো। সূর্য সবে অস্ত গেছে। আকাশ তখনও লালচে হয়ে আছে। হাওয়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণ চলার পরই জায়গাটা দেখতে পেলো। সঙ্গে অভিরুপ এবং রুদ্রকেও। কাছে যেতেই রুদ্র বলল, ‘কি কেমন জায়গাটা? পছন্দ হয়েছে তো?’ অনিচ্ছার সাথে হ্যাঁ বলল অরিজিত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিরুপ বলে উঠল, ‘মেয়েরাও আসছে। কয়েকজন খাবেও বলেছে’। অরিজিত ওদের সাথে বসে গেলো কিন্তু ওর মন অন্য কোথাও পড়ে রয়েছে। এরই মাঝে রঞ্জন এসে হাজির এবং এসেই বলল, ‘মাল খাবো’।অরিজিত মদ খাওয়ার নিমন্ত্রন নাকচ করে দিল। বাকি তিনজনে মদ খাওয়া শুরু করে দিল। এবার অরিজিতের একটু একাকি বোধ হতে লাগলো। সে উঠে গিয়ে সমুদ্র দেখতে লাগলো।

কিছুক্ষণ বাদেই একে একে মহিলারা এসে উপস্থিত হল।সবাই কেনাকাটা করে ফিরেছে। সবার পিছনে রয়েছে দেবিকা। অরিজিতের সাথে চোখাচোখি হতেই দেবিকা চোখ সরিয়ে নিল। তা সত্তেও অরিজিত এগিয়ে গেলো এবং বলল, ‘তোমায় কল করেছিলাম তো। ধরলে না’।

‘ফোনটা আমি হোটেলে রেখে এসেছি’

‘কেন?’

কিছুই জানালো না দেবিকা। বরং অরিজিতের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো। অরিজিত দুপুর থেকেই লক্ষ্য করছে দেবিকা ওর সাথে ঠিক করে কথা বলছে না। ওকে এভয়েড করছে। কারন যদিও অরিজিতের জানা নেই। সে বুজতে পারল কোন একটা কারনে দেবিকা রেগে রয়েছে ওর ওপর। অরিজিত এবং দেবিকার মধ্যে যে একটা সমস্যার মতন কিছু হয়েছে তা দলের সবাই বুঝেছিল। রুদ্রর বউ প্রিয়াঙ্কা সব থেকে বেশি আন্দাজ করে ছিল, কারন প্রিয়াঙ্কা দেবিকার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ। প্রিয়াঙ্কাও একই অফিসে দেবিকার সাথে কাজ করে।

প্রিয়াঙ্কা ব্যাপারটা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল এবং দুজনকে একে অপরের সাথে কথা বলতে না দেখে বলল। ‘তোরা একটু ঘুরে আয় না। আমরা এখানেই আছি। যা ঘুরে আয়’।

দেবিকা আগে হাঁটছে, একটু তফাতে অরিজিত। দুজনের কেউই কথা বলছেনা। দেবিকা কথা বলছেনা দেখে অরিজিতই কথা শুরু করলো।

‘কি কি কিনলে?’ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই দেবিকা বলল, ‘কি বলার জন্য এখানে এনছ বল’।

‘কি হল তোমার’? অরিজিত জানতে চায়।

-কি হবে? কিছু হয়নি’।

‘দুপুরে খাওয়ার পর থেকে বিশেষ কথা বলছো না’।

‘কি বলবো বল? তুমি যা বললে তারপর কিছু বলা যায়’?

একটু হেসে অরিজিত বলল, ‘আমি আবার কি বললাম?’

‘তুমি কিছু বুঝতে পারছনা?’

‘যা বলার সোজাসুজি বলো’।

‘কৃত্তিকা (রঞ্জনের স্ত্রী) যখন বলল মা হওয়ার থেকে ওর কাছে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল ইউ এস যাওয়া, তখন তুমি বললে কেন বললে যে আমার কাছে ইউ এস যাওয়া ম্যাটার করে না’।

অরিজিত চুপ। অরিজিতকে চুপ থাকতে দেখে দেবিকা বলল, ‘তুমি এটা সবসময় করো। নিজের চিন্তা গুলো আমার ওপর চাপিয়ে দাও’।

কথা বলতে বলতে অরিজিত এবং দেবিকা কখন যে সমুদ্রের একদম কাছে চলে এসেছে তা খেয়ালই করেনি। সমুদ্রের জল এসে দুজনেরই পা ভিজিয়ে দিল। যদিও তারা দুজনেই সেটা মোটেই আনন্দের সাথে গ্রহন করলো না। দুজনেই সরে আসলো।

‘তুমি সব ব্যাপারেই নিজে যেটা ভাল বোঝো সেটা করো’।

‘তা আবার কি করব’?

‘আমার দিকটা কখনও ভাবো না’।

‘আবার কি হল? যা বলার সোজাসুজি বলো’।

‘কৃত্তিকারা নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনছে’।

‘হ্যাঁ। তো কি হয়েছে’?

‘কি হয়েছে মানে? আমরাও একটা ফ্ল্যাট কিনি’।

‘এই ব্যাপারে তোমার সাথে আগেই কথা হয়ে গেছে। আমি পাড়া ছেড়ে কোথাও যাব না’।

‘কেন? কি আছে পাড়াতে? অত ছোট একটা ফ্ল্যাটে থাকি। কাউকে ডেকে একটা ভাল করে পার্টি করা যায়না’।

অরিজিত চুপ। দেবিকাও। দুজনেই হেঁটে চলেছে। হাটতে হাটতে অনেকটাই চলে এসেছে।

সামনে প্রসস্থ সমুদ্রতট, দুজনেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কারুরই প্রকৃতিকে আস্বাদন করার ইচ্ছেটুকুও নেই।ওরা হেঁটে চলেছে এবং ওদের সামনেই একদল বাচ্চা এসে পড়ল। সবাই হুড়োহুড়ি করছে। কেউ কেউ দৌড়াতে গিয়ে বালিতে পড়েও যাচ্ছে। 

এবার দেবিকা কথা শুরু করলো।‘আমি এখনই প্রেগন্যান্ট হতে চাইনা’।

‘হঠাৎ এই বিষয়ে কথা বলার মানে কি হল?’

‘তাহলে তুমি দুপুরে কেন বললে ‘সাম ডে আই উইল বি ফাদার’’।

‘তুমি ঝগড়া করতে চাইছ’।

‘না। আমি বলতে চাইছি সব কিছু তোমার মতন হবে না’।

আবার দুজনে চুপ। এরই মাঝে দেবিকার ফোন বেজে উঠল। কৃত্তিকার কল। ফোন ধরে বেশি কথা বলল না। কল ডিসকানেক্ট করার আগে বলল, ‘আমি আর এখন ওদের ওখানে যাব না। আমি হোটেলে চলে যাচ্ছি’।

ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই দেবিকা বলল, ‘আরও একটা কথা বলার ছিল তোমায়। আমি আগামী মাসেই আমি ইউ এস যাচ্ছি।এপ্রুভালও চলে এসেছে’।

‘কবে জানতে পেড়েছ?’ অরিজিত জানতে চাইল।

‘এই এক সপ্তাহ হল’।

‘বাহ। তুমি আমায় আজ বলছো’।

‘আগে বলার সময় ও সুযোগ দুটোই পাইনি’।

এই বলে দেবিকা হোটেলের দিকে হাটতে লাগলো। অরিজিত আর দেবিকাকে অনুসরণ করলো না। উল্টে সে দলের বাকিরা যেখানে আছে সেই দিকে হাটা লাগালো। কিছুক্ষণ চলার পর যখন জায়াগাটায় পৌছালো। তখন দেখল সেখানে দলের কেউ নেই। অরিজিতের নিজের ওপর রাগ হল ভীষণ। একটা কল করে আসা উচিত ছিল।

এদিকে তখন হঠাৎই ঝড় উঠতে শুরু করলো। সমুদ্র গর্জন করতে লাগলো। বিরাট বিরাট ঢেউ উঠতে লাগলো। বালির ঝড়ের মধ্যে অরিজিত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলনা। সেও হোটেলের দিকে এগোতে লাগলো পিছনে হিংস্র সমুদ্রকে রেখে। হোটেলে রুমের দিকে যখন এগোতে লাগলো তখন দেখল দেবিকা রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার কারন বুঝতে পারল অরিজিত – চাবি তার কাছে।

দেবিকা এবং অরিজিতের মধ্যে আর কোনও কথা হল না। দুজনে রুমেই খাবার খেলো এবং তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চলে গেলো। ঘুমোতে যাওয়ার আগে অরিজিত এই ভাবতে লাগলো কিছু একটা করে দেবিকার অভিমান ভাঙ্গা দরকার। না হলে পুরো বেড়ানোটাই মাটি হবে। 

মাঝ রাতে যখন অরিজিতের ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখল দেবিকা পাশে নেই। উঠে গিয়ে বাথরুম দেখল সেখানেও নেই। ঘর থেকে বেরোতেই দেখল পেলো দেবিকাকে। বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। সঙ্গে দলের বাকিরাও। চোখ সমুদ্রের দিকে। অরিজিতের চোখও সমুদ্রের দিকে গেলো। এবং সমুদ্রের রুপ দেখে একেবারে চমকে উঠল। বিরাট বিরাট ঢেউ উঠছে। সমুদ্র অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। সঙ্গে ভয়ঙ্কর ঝড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোডশেডিং হয়ে গেলো। হোটেল থেকে জানানো হল বাইরে বেরনো নিষেধ।

আগামী পদক্ষেপ কি কি হতে পারে সেই নিয়ে ওরা আলোচনা শুরু করলো। মোবাইলের আলো ছাড়া তখন ওদের কাছে আর কোনও অবলম্বন নেই। দেবিকা নিজেই বলল, ‘তোমার ফোনটা এখন ব্যাবহার করোনা। এখন আমারটা করো। আমারটার চার্জ ফুরিয়ে গেলে তোমারটা ব্যাবহার করো’। দেবিকার এই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার দেখে অরিজিত ভীষণই অবাক এবং খুশি হল।

পরদিন সকালে রাস্তায় বেরিয়ে দেখল পুরো লণ্ডভণ্ড অবস্থা। পুরীর অবস্থা একেবারেই উল্টে গেছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ধ্বংসের চিহ্ন। এই অবস্থা দেখে সবাই মিলে ঠিক করে তারা আজই কলকাতায় ফিরে যাবে। কিন্তু কি ভাবে যাবে? টিকিট তো দুদিনের পরের কাটা। হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ট্রেন চলাচল বন্ধ। 

এই খবরে অরিজিত এবং দেবিকা ভীষণ ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ে কিন্তু ওদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা কমে গেছে। ওরা এখন আর নিজের নিজের কথা ভাবছে না। ভাবলে দুজনের কথাই ভাবছে, গ্রুপের কথা ভাবছে। সবাই মিলে কিভাবে কলকাতায় ফিরবে সেটাই এখন মুখ্য ব্যাপার।

অরিজিতদের মূল চিন্তা হল বাচ্চারা। তাদের নিয়ে ঠিক ভাবেই ফেরাটাই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অনেক ভেবে তারা ঠিক করল ভুবেনেশ্বর যাবে, সেখান থেকে প্লেনে করে কলকাতায়।

অনেক খুঁজে তারা একটি ট্রাকের খোঁজ পেল যেটা কিনা ভুবনেশ্বর যাচ্ছে। সবাই উঠে বসল। উদ্দেশ্য একটাই সেখান থেকে কোলকাতার যাওয়ার কোনও ব্যাবস্থা করা যায় কিনা।

ট্রাকে করে পুরী থেকে ভুবনেশ্বরের যাত্রা পথ সমস্যায় ভরা ছিল। রাস্তার অবস্থা ভীষণই খারাপ ছিল। মাঝে মাঝেই ট্রাকটি থামছিল। মাল তোলার জন্য। মাল ওঠানর ফলে ওদের একেবারে চিরে-চিপটে অবস্থা। এর সাথে জলের অভাব। কিন্তু তা সত্তেও ওদের মধ্যে কোন ঝগড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

ট্রাকটি যখন ভুবনেশ্বর পৌঁছল তখন অরিজিত দেখল দেবিকা ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। গোটা মুখ জুড়ে একটি মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে। যে দূরত্বটা তৈরি হয়েছিল সেটা একে বারেই নেই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy