কিবোর্ডের কেরামতি
কিবোর্ডের কেরামতি
‘রাতের অথিতি’ উপন্যাসটি লেখার পর অর্কর মনে হয়েছিল এবার হয়ত শিকে ছিঁড়বে। এবার সেরা লেখকের পুরস্কারটা সে পাবে। লোকে তাকে চিনবে, তার সম্বন্ধে জানবে। তার লেখা পড়বে। কিন্তু না, এবারও না। এবারও সে সেরা লেখকের পুরস্কারটি জিততে পারেনি। উপন্যাসটা গুণী মহলে সমাদৃত হওয়া তো দুরের থাক, বই হিসেবে বাজারে খুব একটা কাটেনি।
তাও আশা ছিল লেখক হিসেবে তাকে হয়ত মর্যাদা দেবে ‘লেখক সঙ্ঘ’ নামক গোষ্ঠীটি। তার মূল কারন, দশ বছরের বেশি সময় ধরে লেখক জগতে তার উপস্থিতি। সে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা কিভাবে সায়ন সান্যাল পর পর দু’বার এই পুরষ্কারটা পেল। এর পিছনে যে রাজনীতি রয়েছে এ বিষয়ে তার কোনও দ্বিমত নেই।
মন ঠিক করতে অর্ক পাহাড়ে বেড়াতে চলে যায় ছুটি কাটাতে। সেখানে থাকাকালীনই ঠিক করে তাকে কিছু একটা অন্যরকম করতেই হবে যার থেকে এই পরাজয়ের গ্লানি কিছুটা দূর হয়। অনেক ভেবে সে ঠিক করে সে কম্পিউটারে লিখবে। সে লেখার জন্য কাগজ-কলম ব্যাবহার করত কিন্তু এবার থেকে সে কম্পিউটারে লিখবে। সে নিশ্চিত এর ফলে একটা পরিবর্তন তার অনুকূলে আসবেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কলকাতায় ফিরেই অর্ক তার প্রিয় বন্ধু রঞ্জনকে কল করে।
‘একটা কম্পিউটার কিনব। কোথায় ভাল পাওয়া যাবে।’‘চাদনি মার্কেটে চলে যা। ভাল পেয়ে যাবি।’‘দোকানের নাম-ধাম কিছু নেই?’‘ওখানে অনেক দোকান। যেটাতে কম দাম দেখবি ঢুকে পরবি’।পরেরদিনই বেড়িয়ে পড়ে কম্পিউটার কিনতে। চাঁদনি মার্কেটে অনেক দোকান দেখে অর্ক একটু ঘাবড়ে যায়। অনেক দোকান, কোনটাতে ঢুকবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারে না। তার দোটানাময় অবস্থা দেখে একটি কিশোর এগিয়ে আসে। ছেলেটি ফুটপাথে বসে অর্ককে লক্ষ্য করছিল। সে বুঝতে পেরেছিল অর্ক কিছু একটা ঠিক করতে পারছে না। অথচ সে কিছু একটা খুঁজছে।
‘কি খুজছেন দাদা?’ (যদিও প্রশ্নটা বাংলায় করেছে কিন্তু বাংলায় একটা হিন্দির টান আছে)
‘কম্পিউটার’।
‘চলে আসুন আমার সাথে। বেস্ট জায়গায় নিয়ে যাব। চিন্তা করতে হবেনা।’
‘কত-এর মধ্যে পড়বে?’
‘সব থেকে কমে করে দেবো আপনাকে। চলে আসুন’।
অর্ক একপ্রকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সে যে কোন দোকানে ঢুকবে সেটা ঠিক করতে পারছিলনা তা ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছিল।
কিছুটা পথ হাটার পর, তারা একটা গলির ভিতরে এসে ঢোকে। সরু গলি। তার ভিতরেই দোকান। ডাই করে রাখা কম্পিউটার পার্টস। দোকানদার অর্কর কাছে জানতে চায় কি জিনিস সে চায়। অর্ক উত্তর দেয়। সঙ্গে তার বাজেটও বলে। বাজেট শুনেই দোকানদার জানতে চায়, ‘কি কাজে ব্যাবহার করবেন’? উত্তরে লেখালেখি শুনেই দোকানদারটি বলল, ‘এমন জিনিস দিয়ে দেবো সারাজীবন মনে রাখবেন। বেস্ট মাল দেবো আপনাকে। কোথাও পাবেন না এই জিনিস’। কথা শেষ করা মাত্রই দোকানদারটি অন্য একটি ঘরে চলে যায়। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে কম্পিউটারের বিভিন্ন পার্টসগুলি বাক্সবন্দী অবস্থায় বের করে আনে।
অর্কর কথা অনুযায়ীই সে বাক্স থেকে একে একে পার্টসগুলি বের করতে থাকে কারন অর্ক একবার চালিয়ে দেখে নিতে চায় সব পার্টস গুলো ঠিক-ঠাক কাজ করছে কিনা। বিভিন্ন পার্টস এসেম্বেল করে যখন কম্পিউটারটি চলতে শুরু করে তা দেখে অর্ক নিশ্চিত হয় কম্পিউটারটি কেনার ব্যাপারে। কিবোর্ডে লিখে দেখেও নিল লিখতে কেমন লাগে। কম্পিউটার নিয়ে অর্ক মহানন্দে বাড়ি ফেরে।
যে কাজটি করার জন্য কম্পিউটারটি কেনা, সেটাও অর্ক শুরু করে দেয়। একটা গল্প মাথায় ঘুরছিল সেটা লিখতে শুরু করে দেয়। কিন্তু লিখতে গিয়ে বুঝতে পারল যতটা সহজ মনে করেছিল ততটা সহজ নয়। লিখতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেতে লাগলো। কিবোর্ডের দিকে তাকিয়ে অর্ককে লিখতে হচ্ছিল। এর ফলে সময় তো বেশি লাগছিলোই সঙ্গে গল্পের ধারাবাহিকতাও ব্যাহত হতে লাগলো। কিন্তু অর্কও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে ভাবেই হোক এই গল্পটা ও কম্পিউটারে লিখবে।
গল্পটা কম্পিউটারে লেখা শেষ করল বটে কিন্তু অর্ক সময় নিল ১ মাস। যে গল্প হাতে লিখে শেষ করতে সব চেয়ে বেশি ৩ দিন লাগত, তার কাছে ১ মাস সত্যিই অনেকটা সময়। কিবোর্ডে লেখা সে প্র্যাকটিস করতে লাগলো যাতে সে আরও দ্রুত লিখতে পারে। তা স্বতেও বুজতে পারে কিবোর্ডে সড়গড় হতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে কম্পিউটারে লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার কাগজে-কলমে লেখা শুরু করে। কম্পিউটারের কথা একেবারেই ভুলে যায়।
এইভাবে বেশ কিছু মাস কেটে যায়। তারপর একদিন কোনও একটি তথ্য ইন্টারনেটে খোঁজার জন্য কম্পিউটারটি অন করে। এবং কিছুটা অজান্তেই মাইক্রোসফট ওয়ার্ড অন করে এবং লিখতে শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণ লেখার পর বুঝতে পারে সে আগের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি লিখছে। লিখতেও সে আগের থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। এর পর অর্ক ঠিক করে কম্পিউটারেই লিখবে, যেমনটা ভেবে সে কম্পিউটারটি কিনেছিল।
২ দিন লেখার পরই অর্কর মনে হতে শুরু করল যে লেখার স্পিড তো বেড়েইছে সঙ্গে লেখার গুনগত মানও অনেকটাই ভাল হয়েছে। এর কিছুদিন বাদে, লিখতে লিখতে একটা জিনিস খেয়াল করল যে কোনও একটি শব্দের সব কটি অক্ষর টাইপ করার আগেই শব্দটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। ঘটনাটি তাকে উত্তেজিত করে তোলে। তাহলে কি কম্পিউটারটি নিজের থেকেই শব্দ চিনতে পারছে? তাকে আর টাইপ করতে হবে না। কিন্তু এরকম হয় তা কখনই অর্ক শোনেনি।
এই ঘটনার দিন দুই পরে লিখতে লিখতে খেয়াল করে অর্ক একটা শব্দ লিখলে বাকি শব্দ গুলি নিজের থেকেই কম্পিউটার লিখে একটা বাক্যগঠন করে নিচ্ছে। এই ব্যাপারটির পড়ে অর্ক একদমই ঘাবড়ে যায়। সে বুজতে পারে তার আর কন্ট্রোল নেই নিজের লেখার ওপর। কিন্তু কে এটা করছে বা কিভাবে হচ্ছে সেই ব্যাপারটিও তার জানা নেই। এমনই একদিন লেখার জন্য যেই কম্পিউটারটি খুলেছে ওমনি কম্পিউটারটি আপনা থেকেই লিখতে শুরু করে দেয়। এবং মুহূর্তের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেলে। অর্ক অবাক হয়ে যায়। সে বুঝতে পারেনা কি করবে। সে যখন ভাবছে তার নেক্সট চাল কি হবে তখনই স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে ওঠে-‘ হ্যালো অর্ক, সাবমিট দিস টু উওর পাবলিশার’। মেসেজটি পড়ে অবাক হয়ে যায় অর্ক। কম্পিউটারটি কি ভাবে জানলো তার প্রকাশকের ব্যাপারে।
অর্ক দোটানায় পড়ে যায় লেখা জমা দেবে না নিজের কাছে রেখে দেবে। সে ভাবে যদি কেউ জানতে পেরে যায় এ লেখা তার নিজের নয়। কিন্তু অনেক ভেবে সে ঠিক করে লেখা প্রকাশকের কাছে জমা দেবে। যা হবে দেখা যাবে। লেখাটি জমা দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই বই আকারে বারও হয়। এবং বার হওয়ার সাথে সাথেই একেবারে হটকেকের মতন বিক্রি হতে থাকে। পথে-ঘাটে, ফেসবুকে-হোয়াটসঅ্যাপে একটাই কথা- অর্ক মজুমদারের নতুন উপন্যাস – ‘অন্য জগৎ’। এবং সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে সে বছরের সেরা লেখকের পুরষ্কার পায়।
সেরা লেখকের পুরষ্কার পাওয়া অর্কর অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল। তার এই ইচ্ছেটা যে এভাবে পুরন হবে তা কখনই ভেবে উঠতে পারেনি। যদিও এই পুরস্কারের জন্য তার আনন্দিত হওয়ার কথা কিন্তু তা না হয়ে তার নিজেকে পরাজিত মনে হতে লাগে।
সে ঠিক করে এটা কোনও ভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। অর্ক সিদ্ধান্ত নেয় সে কাগজে-কলমেই লিখবে এবং কম্পিউটার লিখুক নিজের মতন। কম্পিউটারকে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করে।
অর্ক লেখা শুরু করে দেয়। যে ভাবেই হোক কম্পিউটারকে পরাজিত করতে হবে। একটি লেখা কমপ্লিট করেই প্রকাশকের কাছে পাঠায়। ছাপানোর জন্য। কিন্তু সেই লেখা গ্রহন করা হয় না। অর্ক অবাক হয়ে যায় তার লেখা গ্রহন না হওয়া দেখে। তাহলে কি কম্পিউটার তার থেকে বেশি ভাল লেখে? এই প্রশ্নটি যখন অর্ককে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তখন সে ঠিক করে আর যাই হোক কম্পিউটারে সে কোনোদিন লিখবে না এবং কম্পিউটারের লেখা কোনও গল্প প্রকাশকের কাছে পাঠাবেও না। শেষ পর্যন্ত সে কম্পিউটারটিকে একটি ঘরে তালা বন্ধ অবস্থায় রেখে দেয়।
অর্ক নিজের লেখার জগতে ফিরে যায় এবং একপ্রকার কম্পিউটারটির কথা ভুলেই যায়। কিন্তু একদিন খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সে চমকে ওঠে একটি খবর পড়ে। একজন গল্পকারকে একটি পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে লেখার জন্য। অর্থাৎ গল্পকার কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েছে বাক্য গঠন করতে এবং গল্পটি বাঁধতে। তাহলে কি এতাই ভবিষ্যৎ? অর্ক ভাবতে থাকে।