অদৃশ্য বন্ধু
অদৃশ্য বন্ধু
রুসা বাথরুম থেকে বেড়িয়েই রেহানের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। বাথরুমের ভিতর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলো কিন্তু এখন একেবারে স্পষ্ট। রেহান কথা বলছে। প্রথমে এতরাতে রেহান জেগে রয়েছে ভেবেই রুসা অবাক হয়। তার ওপর আবার কথা বলছে। বাথরুমের দরজা আস্তে বন্ধ করে রুসা রেহানের ঘরের পাশে এসে দাড়ায়। রুসার উদ্দেশ্য রেহান কি বলছে তা শোনা।
‘তুমি আমার জন্মদিনের পার্টিতে আসলে না কেন’? রেহান বলে।
‘আমি অনেক গিফট পেয়েছি। দেখবে’? রেহান আবার বলে।
রুসার চোখে তখনও ঘুম লেগে রয়েছে। ঘুম ঘুম ভাবটাও রয়েছে। তা সত্তেও এটা বুঝতে রুসার ভুল হয়না যে কথা গুলি রেহানই বলছে। সঙ্গে এটাও বুঝতে পারে রেহান কারো একটা সাথে কথা বলছে। অথচ অন্য প্রান্তে যে আছে তার গলা রুসা শুনতে পাচ্ছে না। তাহলে কি রেহান একা একা কথা বলছে?
অনিলাভ এবং রুসার একমাত্র সন্তান রেহান। ক্লাস ফাইভে পড়ে। রেহানকে নিয়ে দুজনেই খুব খুশি একটা ব্যাপার ছাড়া। রেহানের কোনও বন্ধু নেই। স্কুলেও নেই এবং যে সোসাইটিতে থাকে সেখানেও নেই। অনিলাভ এবং রুসা অনেকবার চেষ্টা করেছে রেহানের সাথে কাউকে বন্ধুত্ব পাতাতে, কিন্তু রেহান ওর সমবয়সী কারুর সাথে সময়ই কাটাতে একদমই উৎসুক নয়। স্কুলে একা একা থাকে এবং বাড়িতে থাকলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়তেই চায় না।
কিন্তু অনিলাভ এবং রুসা হাল ছাড়ে না। তাই রেহানের জন্মদিনে ক্লাসে এবং সোসাইটিতে যত বাচ্চা আছে তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে। এত বাচ্চা এসে হাজির হয় যে জন্মদিনে, পার্টি বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে। পার্টিতে রেহান প্রথম দিকে দু-একজনের সাথে কথা বললেও পরবর্তীতে একেবারে চুপ মেরে যায়।
পার্টি শেষে সব ঠিকঠাক করে ঘুমোতে যেতে অনিলাভ এবং রুসার মাঝরাত হয়ে যায়। দুজনেই ভয়ানক ক্লান্ত ছিল তাই বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তিনটে নাগাদ রুসার ঘুম ভেঙে যায় এবং বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পরে। বাথরুমের পাশেই রেহানের ঘর। তাই রেহানের ঘরে কোনও আওয়াজ হলে তা বাথরুম থেকে দিব্যি শোনা যায়।
রুসা দরজার পাশেই দাড়িয়ে শুনছিল। ঘরে লাইট জ্বলছিল। যদিও রুসা মনে করতে পারেনা বাথরুম যাওয়ার সময় আলো জ্বলছিল কিনা। রুসা ঠিক করে নেয় ঘরে ঢুকে দেখবে রেহান রাত তিনটের সময় আলো জ্বালিয়ে কার সাথে কথা বলছে।
এক ধাক্কায় দরজা ঠেলে সরিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায় রুসা। ঘরে ঢুকে দেখে রেহান বিছানায় বসে রয়েছে এবং দেয়ালের দিকে চেয়ে রয়েছে।
মাকে দেখে কিছুটা অবাক হয় রেহান। কিন্তু কিছু বলেনা।
‘কিরে একা একা কথা বলছিলিস কেন? এত রাতে জেগে আছিস কেন’? জানতে চায় রুসা।
কিছু বলেনা রেহান। চুপ করে থাকে।
‘কিরে কথা বলছিস না কেন’? জানতে চায় রুসা।
‘আমার বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম’। খুব ধীরে ধীরে কথাগুলি বলে রেহান।
‘বন্ধুর সাথে মানে? ঘরে তো তুই আর আমি বাদে কেউ নেই’, রুসা বিছানায় এসে বসে কথাগুলি বলে।
‘না। আমার বন্ধু এসেছিল। তুমি ঘরে আসার পরে চলে যায়’, রেহান মায়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলে।
রুসা বুঝে পায়না কি বলবে। রুসা বসে থাকতে পারেনা। উঠে দাড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। নিজের ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত স্বামীকে ডেকে তোলে এবং একপ্রকার টেনে রেহানের ঘরে নিয়ে আসে।
অনিলাভ তখনও চোখ কচলাচ্ছে। ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চায় কি হয়েছে। রুসা পাশেই দাড়িয়ে ছিল। রেহানের পাশে বসে যা ঘটেছে এবং রেহান যা বলেছে তার পুঙ্খানপুঙ্খ বিবরণ দেয়। অনিলাভ শুনে অবাক হয়। রেহানের কাছে জানতে চায় যে মা যা বলছে তা সত্যি কিনা। কিন্তু রেহান কিছু জানায় না। শুধু বলে ‘আমার ঘুম পেয়েছে’। এই শুনে রুসা বলে ‘সত্যি ঘুম পেয়েছে না আমারা চলে গেলে আবার একা একা কথা বলা শুরু করবি’। রেহান শুয়ে পরে। অনিলাভ এবং রুসাও ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। দুজনেরই আর ঘুম আসেনা। রেহানকে ঘুমোতে দেখে দুজনে বাইরের ঘরে বসে আলোচনা করতে থাকে মা-বাবা হিসেবে তাদের এখন কি করা উচিত। ওখানে বসেই দুজনে ঠিক করে যে রেহানকে অতি শীঘ্রই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
***
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে রেহানের আলাপ পর্বে, অনিলাভ এবং রুসা গোটা বিষয়টা বিস্তারিত ভাবে জানতে পারে। রেহানের এক বন্ধু রয়েছে যাকে রেহান বাদে কেউ দেখতে পায়না। প্রতি রাতে সে একবার করে রেহানের সাথে দেখা করে যায়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনিলাভ এবং রুসাকে জানায় ভয় পাওয়ার মতন কিছুই হয়নি। এই বয়সের বাচ্চাদের এটা হয়েই থাকে। যেহেতু রেহান বাড়িতে একা থাকে তাই নিজের মনেই একটা বন্ধু তৈরি করে নিয়েছে সময় কাটানোর জন্য। এই বন্ধুর প্রতি রেহান এতটাই আকর্ষণ অনুভব করে যে বাস্তবে বন্ধু তৈরি করতে পারেনা। ডাক্তারটি আরও জানায় যে, আর কিছুদিন কাউন্সেলিং করলেই রেহানের অদৃশ্য বন্ধু রেহানের জীবনে আর থাকবে না। সাথে এও জানায় যদি কেউ একজন রেহানের সাথে সব সময় থাকে তাহলে তা রেহানের পক্ষে ভালো হবে।কারন একা থাকার জন্যই রেহান নিজের মনে নিজের অজান্তেই এই বন্ধুকে তৈরি করেছে।
অনিলাভ এবং রুসা দুজনেই চাকরি করে। তাই কারর পক্ষেই রেহানকে দিনে ৩-৪ ঘণ্টার বেশি সময় দেওয়া সম্ভভ হয় না। দুজনে এক অদ্ভুত সমস্যায় পরে। কারোর পক্ষেই চাকরি ছাড়া সম্ভভ নয়। শেষে রুসা ঠিক করে জামশেদপুর থেকে নিজের মাকে কলকাতায় ডাকবে কিছুদিন ওদের সাথে থাকার জন্য। রুসার মূল উদ্দেশ্য একজন কেউ যাতে রেহানের সাথে সব সময় থাকে। রেহানের ব্যাপারে রুসার মা জানতে পেরে আসতে রাজিও হয়ে যায়।
রুসার মা অর্থাৎ রেহানের দিদিমা আসার পরও রেহানের স্বভাবে সেই ভাবে কোনও পরিবর্তন আসেনা। তার অদৃশ্য বন্ধুর সাথে কথাবার্তার পর্ব চলতেই থাকে। অনিলাভ এবং রুসা ভেবেই পায়না কি করে রেহানের এই অদ্ভুত আচরণ বন্ধ হবে।
***
এক রবিবার দুপুরে খাওয়ার পরে সবাইকে বসার ঘরে বসে থাকতে দেখে রুসার মা নিজের সঙ্গে আনা পুরনো ছবির অ্যালবাম বার করেন। রেহানকেও কাছে ডেকে নেন। চারজনে মিলে পুরনো ছবি দেখতে থাকে। অনিলাভ, রুসা এবং রুসার মা তিনজনেই লক্ষ্য করেন রেহান ছবিগুলো খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। এত মনোযোগ দিয়ে ও কোনও কাজই করেনা। তিনজনেই রেহানের এই পরিবর্তনে খুশি হয়। রুসার মা রেহানকে বলে, ‘তোর দাদুও ছবি দেখতে খুব ভালবাসত। তোর দাদু বেঁচে থাকলে তকে খুব ভালবাসত’।
রেহান বলে, ‘তাই’।
দিদিমা বলে, ‘কেন তোর কোনও সন্দেহ আছে’?
কথাটা শেষ হয়নি তখনই রেহান একটা ছবির দিকে সকলকে আকৃষ্ট করে। আঙুল দিয়ে ছবিতে উপস্থিত একটি ব্যাক্তিকে দেখায়। জানতে চায় লোকটি কে। দিদিমা খুশি হয়ে বলে, ‘এই হল তোর দাদু। যার কথা তোকে এতক্ষণ বলছিলাম। বেঁচে থাকলে তোকে খুব ভালবাসত। তোর সাথে গল্প করত’।
এই শুনে রেহান সবার মুখের দিকে একবার তাকায় এবং তারপর বলে, ‘ওই তো আমার বন্ধু। আমার সাথে রোজ রাতে গল্প করতে আসে’।

