বিলম্বিত বোধোদয়
বিলম্বিত বোধোদয়
এস্কারসনের খবরটা ক্লাসে আসতেই যেন একটা আলোড়ন ফেলে দেয়। ক্লাসের সব স্টুডেন্টরা ভবিষ্যতে যে কিছুদিনের জন্য বাড়ি এবং স্কুলের বাধাধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে স্বাধীন হয়ে থাকতে পারবে সেই ভেবেই ভীষণই উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ক্লাসের সবাই যেন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ক্লাসের প্রায় সবাই আনন্দিত হল এই ভেবে যে তারা তাদের বয়ফ্রেন্ড অথবা গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে পারবে। প্রায় সবাই। দুজন বাদে। ক্লাসে প্রায় সবারই গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড রয়েছে। রুপজিত এবং প্রিশার বাদে। এই দুজন একে অপরকে পছন্দ করলেও দুজনের কেউই যে একে অপরকে পছন্দ করে তা বলে উঠতে পারেনি।
রুপজিতের বন্ধুরা রুপজিতকে বোঝায় প্রিশাকে এস্কারসনে যাওয়ার আগেই প্রপোজ করে দিতে। কারন এখন প্রপোজ করে দিলে এস্কারসনে গিয়ে দুজনে একসাথে সময় কাটাতে পারবে। তাছাড়া সবাই যখন কাপল হিসেবে এস্কারসনে থাকবে সেখানে রুপজিত এবং প্রিশা যদি কাপল হিসেবে না থাকে তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখাবে। বন্ধুদের মতে এখন যদি রুপজিত প্রিশাকে প্রপোজ করে দেয় তাহলে এস্কারসনে তার সামনে রাস্তা একেবারে পাকা।
কিন্তু রুপজিত কিছুতেই প্রিশাকে প্রপোজ করবে না। তার কারন রুপজিত মনে করে যে কোনও সম্পর্ক টেঁকে যখন আগে শারীরিক সম্পর্ক হয়। যদি শারীরিক সম্পর্ক ঠিক থাকে তাহলে মনের দিকটা পরে আসে। অন্যদিকে প্রিশার প্রেমের প্রতি দর্শন সম্পূর্ণ আলাদা। সে মনে করে যদি মনের মিল থাকে তাহলে শারীরিক সম্পর্কের বিশেষ গুরুত্ব থাকে না। প্রিশা অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করে রয়েছে কবে রুপজিত তাকে প্রপোজ করবে। অন্যদিকে রুপজিতও অপেক্ষা করে রয়েছে কবে প্রিশার সাথে সে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে। রুপজিতের সম্পর্ক সমন্ধে এই ধারনা প্রিশার কাছে পৌঁছেছিল। প্রিশার ধারনা ছিল একদিন রুপজিতের ধারনা ভুল প্রমাণিত হবেই।
রুপজিত প্রিশাকে স্কুলের বাইরে দেখা করতে বলে। কারন হিসেবে বলে তার কিছু জরুরি কথা বলার আছে। দুজনের সুবিধা মতন একদিন তারা স্কুলের বাইরে দেখা করে।
‘দেখ, আমরা বন্ধু। কিন্তু আমি তোকে আমার গার্লফ্রেন্ড হিসেবে দেখতে চাই’, রুপজিত প্রিশার দিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলে। প্রিশা কিছু বলে না। চুপ থাকে।
‘আমি বিশ্বাস করি যে সম্পর্ক সেক্স দিয়ে শুরু হয় তা বেশিদিন টেঁকে’, রুপজিত এক নিঃশ্বাসে কথা গুলি বলে।
‘তো আমি কি করব’, প্রিশা জানতে চায়।
‘চল আমারা করি। যদি সব ঠিক হয় তাহলে আমরা রিলেশনশিপে যাব’, রুপজিত প্রিশার দিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলে।
‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে’, প্রিশা কিছুটা রেগেই কথা গুলি বলে।
‘তুই একবার করে দেখ। আমি সিওর আমাদের মধ্যে সম্পর্ক বহুদিন টিকবে’। রুপজিত কিছুটা বোঝানোর স্বরে কথাগুলি বলে।
‘আমি আগে ছেলেটাকে ভালো করে চিনব তারপর সম্পর্কে যাব’, প্রিশা বলে।
‘ও আচ্ছা। তুই তাহলে আমার প্রপোসাল একসেপ্ট করবি না’, রুপজিত বলে।
‘এটা প্রপোসাল। তোর মতন বাজে ছেলে জন্মেও দেখিনি’, এই বলে প্রিশা সেখান থেকে চলে যায়।
***
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে রুপজিতের।
‘বাবার শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। হাসপাতালে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি ওঠ’, উত্তেজনার স্বরে রুপজিতের মা কথা গুলো বলে।
অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। রুপজিতের বাবার হার্টের সমস্যা থাকায় হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে নেয়। এবং বাবার এই হাসপাতালে থাকার সময়ই রুপজিতের জীবনেও আমূল পরিবর্তন আসে।
বাবার খেয়াল রাখার জন্য রুপজিত হাসপাতালে রাত জাগতে শুরু করে। প্রথমে রাগ জাগত বাবার দেখভাল করার জন্য। কিন্তু পরে রাত জাগার কারন পাল্টে যায়।
হাসপাতালে একটি নার্সের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। নার্সটি রুপজিতের বাবার দেখাশোনার করে। নার্সটি রুপজিতের থেকে বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনে কোনও অসুবিধা হয় না। নার্সটি নাইট শিফট করে এবং রুপজিতও রাত্রি বেলায় হাসপাতালে থাকে। নার্সটির সাথে রুপজিতের সম্পর্ক আর কয়েকটি সাধারন রুগীর পরিবার এবং নার্সের সম্পর্ক নয়।
রুপজিত নার্সটিকে পছন্দ করতে শুরু করে। নার্সটি তা বুঝতেও পারে। তাই যখন রাত্রি বেলায় রুপজিতের বাবার স্যালাইনের বোতল পাল্টাতে আসে, তখন রুপজিতকেও ডেকে নেয়।
‘এই শোনো, এই ফাঁকা বোতলটা ধরো। আমি যেমন বলব ঠিক তেমনটা করবে’, নার্সটি প্রায় আদেশের সুরে কথাগুলি বলে। রুপজিত মন্ত্রমুগ্ধের মতন তা পালন করে।
স্যালাইনের বোতল পাল্টানো হয়ে গেলে, নার্সটি বলে, ‘বোতল ছাড়া আর কি ধরতে পারো’?
রুপজিত নার্সটির ইঙ্গিত বুঝতে পারেনা। সে জিজ্ঞাসা করে, ‘মানে’?
‘আমাকে ছুঁতে পারবে?’ ছলনার সুরে প্রশ্ন করে নার্সটি। রুপজিতের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে বুঝতে পারে নার্সটি কি বলার চেষ্টা করছে। ওর গোটা শরীর শিহরিত হতে থাকে। ঠিক যেন কোনও হারিয়ে যাওয়া জিনিস অনেকদিন পর খুঁজে পেয়েছে।
‘ধরতে কেন পারব না? সব কিছু ধরতে পারি’, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে রুপজিত।
ঠিক যেন এই কথাগুলির জন্যই অপেক্ষা করছিল নার্সটি। নার্সটি এগিয়ে গিয়ে রুপজিতের হাত ধরে বলে, ‘আর কোনও কথা না বলে আমার সাথে এস’।
বাবার কেবিন থেকে বেড়িয়ে রুপজিত নার্সটির পিছন পিছন যেতে থাকে। কিছুদুর এগোনোর পর নার্সটি হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে দেয়। দ্রুত একবার চারপাশ দেখে নেয় এবং রুপজিতের হাতটা ধরে হঠাৎ একটা অন্ধকার কেবিনের মধ্যে ঢুকে পরে।
কেবিনে ঢোকামাত্রই মেয়েটি রুপজিতকে চুমু খেতে শুরু করে। জীবনে প্রথমবার রুপজিত কাউকে চুমু খায়। কেবিনের ভিতর একটি ফাঁকা বিছানা ছিল। সেখানেই শুয়েই দুজনে কিছু সময় কাটায়। পরের সাত দিন দুজনে যখনই সুযোগ পেয়েছে, কোনও পরিতক্ত্য কেবিনে সময় কাটিয়েছে।
রুপজিত মনে মনে ঠিক করে নেয় যে এই মেয়েটিকেই সে বিয়ে করবে। নার্সটিকে সে নিজের বান্ধবী হিসেবে দেখতে শুরু করে। তার কারন মেয়েটি তার সাথে প্রথমে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে তারপর বন্ধুত্ব করেছে। অর্থাৎ যে ধারনা রুপজিত পোষণ করে, ঠিক সেই ধারনা মেয়েটিও পোষণ করে।
কিন্তু রুপজিতের ধারনা ভুল প্রমানিত হয় যখন নার্সটি জানতে পারে যে রুপজিতের বাবা হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবে। নার্সটি রুপজিতের সাথে দূরত্ব তৈরি করে। রুপজিত নার্সটিকে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার বাবার ছুটি হয়ে গেলেও সে রোজ দেখা করতে আসবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েটির মন গলে না। উল্টে মেয়েটি জানায় যে সে রুপজিতের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবে না।
জীবনে প্রথমবার কোনও নারীর কাছে যাওয়ার যে অনুভূতি পেয়েছিল, ঠিক তেমনই বিরহের অনুভূতিও কেমন হয় তা মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেয়ে যায়।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যখন রুপজিতের বাবার শারীরিক অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছিল, তখন উল্টোদিকে রুপজিতের মনের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। রুপজিতের মুষড়ে পড়া অবস্থা দেখে রুপজিতের মা রুপজিতকে প্রিশার সাথে দেখা করার কথা বলে। প্রিশা যে রুপজিতকে পছন্দ করে তা রুপজিতের মা আগে থেকেই জানত।
যদিও রুপজিতের চিন্তা প্রিশার চিন্তার সাথে খাপ খায়না, তা সত্ত্বেও, কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েও, রুপজিত প্রিশার সাথে দেখা করতে যায়। দেখা করার পর বুঝতে পারে যদি সে প্রিশার সাথে দেখা না করত তাহলে কি হারাত।
***
প্রিশা যে মুহূর্তে রুপজিতকে দেখে, খুশিতে ডগমগ করে ওঠে। মুখে হাসির ঝিলিক খেলে ওঠে। প্রিশার সাথে কথা বলার পর রুপজিত বুঝতে পারে যে প্রিশা তার থেকে অনেক বড় সমস্যায় পড়েছিল। কিন্তু দুজনের সমস্যার বিষয়টা এক – সম্পর্ক জনিত সমস্যা।
ক্যাফেতে কফি খেতে খেতে প্রিশা জানায় যে তার একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল। ছেলেটি প্রিশার পাড়াতেই থাকে। ছেলেটিই প্রিশাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এবং কিছুদিন ভেবে প্রিশা সেই প্রস্তাবে সম্মতিও দেয়। দুজনে একসাথে সময় কাটায়। একসাথে সিনেমা দেখতে যায়। পার্কে সময় কাটায়। কিন্তু প্রিশার মনে খটকা হয় যখন প্রিশা ছেলেটির ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ছেলেটি কিছুতেই শারীরিক সম্পর্কে যেতে রাজি হয়না।
প্রিশা ছেলেটির ওপর নজর রাখা শুরু করে। শেষে একদিন জানতে পারে ছেলেটি অন্য একটি ছেলের সাথে সমকামী সম্পর্কে রয়েছে। এর আগেও সে বহু ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। প্রিশা যখন জিজ্ঞেস করে সে তার সাথে এরকম কেন করল। উত্তরে সে জানায় লোকজনকে দেখানোর জন্য যে তার একটি বান্ধবী রয়েছে। প্রিশা সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসে।
এরপর দুজনে চুপ করে কফি খায়। তারপর হঠাৎই প্রিশা বলে, ‘জানিস, তুইই ঠিক ছিলিস। যেকোনোও সম্পর্ক টিকে থাকতে গেলে শুধু মনের মিল না শরীরেরও মিল থাকা দরকার’।
উত্তরে রুপজিত বলে, ‘এই ক’মাসে অনেক শক্ত শক্ত কথা শিখে ফেলেছিস’।
‘দাড়া, উঠছিস কেন? আমার কথা শেষ হয়নি’, প্রিশা রুপজিতের হাতটা ধরে।
‘আবার কি বলবি’, রুপজিত জানতে চায়।
‘আজ থেকে তুই আমার বয়ফ্রেন্ড। আর আমি এটাও বুঝে গেছি যদি কোনও সম্পর্ক শারীরিক সম্পর্ক দিয়ে শুরু হয়, তা সবসময় খারাপ হয়না। তাই না?’, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে প্রিশা, ‘সেদিন তুই যখন আমায় প্রপোজ করেছিলিস তখন তোকে হ্যাঁ বলে দিলেই হত। এত ঝক্কি পোয়াতে হত না’।
‘বুঝলাম’, সংক্ষেপে উত্তর দেয় রুপজিত।
‘আর এক্সারসনে গিয়ে রাতের বেলায় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন তুই আমার তাঁবুতে আসবি। বুঝলি?’, প্রিশা এই কথাগুলি বলে লজ্জা পায়।
‘বুঝলাম’, রুপজিত হেসে বলে।
‘কিন্তু তুই তো আসল জিনিসটাই বললি না’, প্রিশা বলে।
‘কি আসল জিনিস’, রুপজিত জানতে চায়।
‘এই যে আমি তোর গার্লফ্রেন্ড’, প্রিশা গলা চড়িয়ে বলে।
‘আচ্ছা বাবা, তুই আমার গার্লফ্রেন্ড’, রুপজিত হেসে কথাগুলি বলে।